জঙ্গল ও কমলা, মাখনলালও বটে

Jangal-o-Kamala

অর্ণব রায়

পাথরডুবুরি বিশপুকুর গাঁয়ের সনাতন ম-লের নাম যে পুবে রতনপুর মোলস্নাহাটি বোদপুর, পশ্চিমে তামাগ্রাম অজগরপাড়া, এমনকি দক্ষেণে মজিলপুর বিল পার করে খোদ সদরের জেলা জজ সাহেবের বাংলো বাড়ির এমত্মার শুকনো পাতা পড়ে থাকা উঠোনে পেতে রাখা বিকেলের চায়ের টেবিলে গিয়ে পৌঁছেছিল, তা সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হলফ করে সাক্ষী দেওয়াটাকে মটরার গম্ভীরা গানের মতো শিল্প করে তুলতে পেরেছিল বলেই না। জগতে সত্যি-মিথ্যা যে নিছকই মায়া তা সনাতন ম-লের সাক্ষী দেওয়া থেকেই আরো বেশি করে বোঝা যেত। আর একবার এক জেলা জজ তো তার বিদায়ী ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সনাতনকে নেমন্তন্নই করে বসেছিলেন। এমনই ছিল তার আদালতে যাতায়াত। এহেন সনাতন ম-লের ছেলে হয়ে মাখনলাল চোদ্দো হতে না হতে বুলেটবাইক হাঁকড়াবে, বিশ বছরে কন্ট্রাক্টরি ধরবে, তিরিশ ছুঁতে না ছুঁতে ওই শাদাতগঞ্জ থেকে এই বোদপুর পর্যন্ত ন্যাশনাল হাইওয়ে চওড়া করার বরাত বগলদাবা করবে, এ আর বেশি কথা কি! তার পরের পাঁচ বছর তো আর বছর নয়, জেলাসত্মর থেকে রাজ্যসত্মর – সব সরপুঁটি থেকে থলথলে চিতল নেতা-মন্ত্রীদের পাশে-পাশে ঘুরে বেড়ানোর দাগে-দাগে দাগানো ক্যালেন্ডার মাত্র।

সনাতন ম-লের আমলে যে-ম-লবাড়ি ‘মামলাবাড়ি’ নাম পেয়েছিল, আজ সেখানে ‘মাখন ম-লের বাড়ি’ বললে একেবারে বড় রাস্তা থেকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়ার লোকের অভাব হবে না। তা মানুষ বড় হলেই তার নামে গুজব রটে। এই যে সেখদিঘি বাসস্ট্যান্ড থেকে মোরাম রাস্তা এঁকেবেঁকে পদ্মার ধার-ধার একেবারে ফিডার ক্যানেলে গিয়ে শেষ হলো, এর ধারে-ধারে মোড়ে-মোড়ে এত যে চায়ের দোকান, চপ-মুড়ির দোকান, মুদিখানা, এমনকি বাংলার ঠেক, এদের কোথাও-না-কোথাও হাত-পা গুছিয়ে বসলে কি শোনা যাবে না, মাখন ম-লের প্রথম বউটা যে পুড়ে মরল, তার কোনো হিলেস্ন আজ অবধি যে হলো না, তাতে কি তার আর একটা বিয়ে করা আটকেছে? না মেয়ের বাপ তাকে মেয়ে দেয়নি? তবে? আর এই যে গোবিন্দ সরকার, যার হাত ধরে কি না মাখনলাল কন্ট্রাক্টরিতে এলো, সে-ই বা অমন হুঁশিয়ার মানুষ হয়ে কী করে পঞ্চাননতলা মোড়ে বাইক নিয়ে ট্রাকের তলায় সেঁধিয়ে গেল! তাও আবার অত রাতে! নেশাভাং তো আর সে একদিন-দুদিন হলো করছে না। আর এতই যখন জানেন, তাহলে যখন পঞ্চায়েতে মিটিং হয়, নানারকম এদিক-ওদিক কমিটিতে সভাপতি-সেক্রেটারি হিসেবে মাখনলালের নাম প্রস্তাব হয়, কোরাম না ফোরাম কী সব খেমটা নাচন হয়, আপনাদের হাতগুলো কি সব ইয়ের মধ্যে ভরে রাখেন? আর এই যে মাখনলাল বুকের বোতাম খুলে মহিলা বিডিওর ঘরে ডেপুটেশনের নাম করে চেয়ার-টেবিল উলটে দিলো, খিসিত্ম করল, এমনকি নেশা করে বিডিওর গায়ে হাত, শাড়ি ধরে টানাটানিরও অভিযোগ, সে-কথা খোলাখুলি লিখতে তো কই লেখকের দমে কুলোচ্ছে না। ‘টানাটানির অভিযোগ’ লিখে সরে পড়ার তাল করছে।

অতএব মাখনলালের কাছে, (অ, চরিত্তির বন্ননা বুঝি এখনো আধখাপচা নাগতেচে বাবুদের। তা যাও না, এন এইচ ধরে সোওওজা রাস্তা, কে মানা করেচে। যাও, গিয়ে শুধোও কে মাখনলাল, কী তার পেত্থম বউয়ের বেত্তান্ত, বা কীভাবে গোবিন্দ সরকার ম’ল। যত্তোসব।)। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মাখনলালের কাছে বিডিওই হও আর ঝাঁসির রানী, ‘মেয়েমানুষ’ তো। আর মেয়েমানুষ কী বস্ত্ত তা কি মাখনলাল জানে না নাকি? সেই তো হাত-পা চিতিয়ে শোবে, কাচ্চাবাচ্চা ঘরগেরস্থালি নিয়ে ন্যাতাজোবড়া হয়ে পড়ে থাকবে। তার ঘরেও একটা আছে। আগেও একটা ছিল। সেটা গেছে, এটা জুটেছে। এটা গেলে আরো জুটবে। এই যে অত চেয়ার গরম করে বসে থাকা বিডিও, সেও তো সেদিন কোয়ার্টারে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। মাখনলাল কি জানে না! বিডিওর ঠিকে ঝি পামিত্ম নিজে এসে তাকে বলেনি! আর এসব ছড়িয়ে রাখা জালের গায়ে গালা পালিশ রাখতে যে মাসে দশ-বিশ হাজার যাবে, সে-কথাটাও কি গল্পের মধ্যে রাখার মতো একটা ব্যাপার হলো!

বিশু মালোর বিধবা কমলা, বিধবা এমনকি বিশু মালোরও হওয়ার আগে থেকেই মাখনলাল আলগোছে তার ওপর নজর ফেলে রেখেছিল। তার কারণ যে, কমলা আর পাঁচটা মাঠে গোবর-কুড়ানো ঘাটে কোঁদল করা ঢেঁকিকোটা মেয়েদের থেকে আলাদা কিছু তা নয়। মাখনলালের নজর অমন দশ-বিশটা মেয়ের ওপর সাধুনাথ মহাজনের বাজারে হাওলাত দিয়ে ফেলে রাখা টাকার মতো হামেশা ফেলে রাখাই থাকে। হ্যাঁ, আলাদা বলে নজর করার মতো যেটুকু, শরীরের গড়ন আঁটো, বুকে দাবনায় মাংস আছে, চালচলনে চমক আছে। তার কারণ হয়তো এই, বছর বিয়োনি মেয়েদের দলে থেকেও তার আঁটকুড়ো বদনাম না ঘোচা। বিশু মালোর সঙ্গে ঘর তো নাই-নাই করে সাত বছর করা হলো। হাসপাতাল হাকিম পা-ধোয়া জলপিরের মাজারের শিন্নি কোনো কিছুই তো বাদ থাকেনি। কিন্তু কোথায় কী! তা নিয়ে মাঠের ধারে দুবেবা তুলতে গিয়ে কথা, ঘাটের ধারে কাপড় থুপতে গিয়ে কথা – বাড়ি এসে ফুঁপিয়ে কান্না। ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলা। ঘরের কোণে শিবের পট মনসার পট সমেত্মাষী মার পট – কেন আমারই এরকম – কেউ তো মুখ তুলে তাকাও – একটা ছেলে কি একটা মেয়ে। সবার ঘরে-ঘরে পিলপিল করছে, শুধু আমার ঘর বাদ। এ তোমার কেমন বিচার – এসব আরকি।

যাই হোক, বিশু মালোও সদর টাউনে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে চারতলা থেকে পা হড়কে সেই যে ইটের গাদায় পড়ল, উঠল একেবারে চারজনের কাঁধে চেপে, নাকে তুলো গুঁজে। গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত লম্বা সেলাই। মরাকাটা ঘরের আদরের দাগ। অপঘাত তো বটে। তা এই হাসপাতাল ডোমচার্জ দিয়ে বডি ছাড়ানো, ম্যাটাডরে চাপিয়ে বডি নিয়ে আসা – এসব কে করবে? ‘মাখনলাল ছাড়া আবার কে’। এসব কাজ করতে গিয়ে আজকাল মাখনলাল এর আগের কথাটা হাজার পাবলিকের মুখে একসঙ্গে শুনতে পায়, ‘এবার ভোটে জিতবে কে’। সেজন্যেই না এত কিছু করা। আর করতে গিয়েই বিশু মালোর বডির সদ্যবিধবা কমলাকে ভালো করে দেখা। বডিকে বিশু মালো ভেবে জগতের বিধবাদের মতোই তার বুক তাক করে আছড়েপড়া, কান্না, আকুল আবেদন, যেন শুনতে পেয়ে চলে-যাওয়া প্রাণপাখি শরীরে ফিরে আসবে। ঘটনার স্বাভাবিকতার আড়ালে গল্পে আরো সুড়সুড়ি ঢোকাতে এ-সময় কমলার কাপড়চোপড়ের কিছু ঠিক থাকবে না, মাখনলাল দুচোখ ফেড়ে যা দেখার দেখবে, কালী দুধওয়ালিকে কমলার পেছনে ফিট করতে চাইবে, কালী দুখানা বাহা শাড়ি একজোড়া রম্নপোর মল আর কিছু নগদের নিচে তার দর নামাবে না, মাখন গাঁইগুঁই করে রাজি হবে, রাহাখরচা বা আগাম বায়না যা-ই বলা যাক, সে-বাবদ কিছু নোট কালীর হাতে গুঁজে দেবে, আর কালী পেছন ঘুরলেই মনের দাঁতে পেষণ লাগিয়ে বলবে, একবার কাজটা উঠে যেতে দে শালি, রম্নপোর মল তোর আমি
কোথায় ভরি দেখবি তখন। কালীও তা একরকম বুঝেই নগদ যা হাতে আসে তাই লাভ বলে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাবে। এ তো খুব স্বাভাবিক, মানে গরম্নর জাবরকাটা বা কুকুরের গাড়ির টায়ার দেখলে পেচ্ছাপ করার মতো প্রাকৃতিক মসৃণতায় ঘটে যাবে। চাইলে দিনের পরে রাত হওয়ার মতো বা সূর্যাসেত্ম চন্দ্রোদয় জাতীয় তুলনা দেওয়াই যেত, কিন্তু তাহলে বলতে হয়, সব গ্রাম-শহরেই এরকম ঘটনা ঘটে। তা তো আমরা বলতে পারি না। আমাদের অত জ্ঞানগম্যি নেই বাপু।

সনাতন ম-লের নাম সাক্ষী দিয়ে-দিয়ে পুবে ছড়াল, পশ্চিমে ছড়াল, দক্ষিণে জনমনিষ্যিহীন মজিলপুর বিল থাকা সত্ত্বেও ছড়িয়ে পড়ল, উত্তরে ছড়াল না কেন? লেখকের মন? গজার বন। হ্যাঁ, বটে-অশ্বত্থে-অর্জুন শিমুলে-গামার-পলাশ আরো দশক-দশকের আগাছায় ঘোর জঙ্গল। ছিল, বাগানই ছিল। তবে বাড়ির সামনের ফুল-ফোটানো কেয়ারি করা ফোয়ারা ছোটানো ন্যাংটো পরীর বাগান নয়, শাগঞ্জ মিঠিপুরের গাছপাগল জমিদার রূপনারায়ণ রায়ের (গাছ নিয়ে মাতামাতির কারণে যিনি জনমানসে ‘হুপনারান’ নামে বেশি পরিচিত) খামখেয়ালিপনার বাগান, আর তিনি জমিদারির শেষ পিদিমটুকুতে ফুঁ মেরে নিভিয়ে গত হওয়ার পরে সাপ বাছুর ভাম নেশাখোর আর ভূতের জঙ্গল। বাগান, এলাকা নির্দিষ্ট, হোক না বিঘার পর বিঘা, আমাপা তো নয়। বাগান বলেই আর সব জঙ্গলের মতো একটা-দুটো গাছ এককদম-দুকদম দুলকি চাল দিয়ে ঘন হতে-হতে ঘোর অন্ধকার সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছয় না, স্যাঁতসেঁতে – সেরকম নয়। বরং এ-জঙ্গল দুম করে শুরম্ন হয়। পাঁচিলের মতো খাড়া। বুকের ওপর চেপে আসে। গাঁয়ের সীমানা। মাঝে দেয়াল ভেদ করে খাটাশ বেরোয়, ভাম বেরোয়, শেয়াল বেরোয়, খাঁচার তার বেঁকিয়ে হাঁস-মুরগি ধরে, তাক মতো পেলে ছোট বাচ্চা ধরার তালে থাকে। গেরস্থ ছেলেপুলে সামলে রাখে। সাবধানে থাকে। কমলার সেইসব ভয় নেই। গ্রামের শেষ-ঘেঁষে মানুষ বসতির শেষ ছাপটা তার। মানে এককালে বিশু মালোর। বা জনবসতির শেষ ঘরই বা বলা কেন, কমলার ঘরের আশপাশে দশ হাতের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি-লোকজন কিচ্ছু নেই। এরকম সোনা আর সোহাগা আর হয়! মাখনলালের হাত নিশপিশ করে। শুধু হাত?

মাখনলাল সবুর করে থাকে। দিন কাটে, হপ্তা কাটে, মাসও কেটে-কেটে যায়। তাড়াহুড়ো করলে হবে! এ হলো গেরস্থ মেয়েমানুষ। হলোই বা নিচু জাত। সোয়ামির চিতা থেকে উঠে-উঠেই তোমার উঠোনবাগে হেঁটে আসবে না কি! সবুরের ফল কী রকম যেন হয়! মাখনলাল মুখে-বুকে মিঠা সোয়াদ পায়। এনএইচ ধরে হু-হু করে বাইক চালিয়ে যেতে-যেতে কি ঝিমধরা দুপুরে লেবারদের ধমকাতে-ধমকাতে। এমন নয় যে, মাখনলাল এই
দিনগুলোয়-রাতগুলোয় সারাক্ষণ কমলার কথাই ভাবছিল। তারও অন্য কাজ আছে, আমাদেরও। আর কাজ বলে কাজ! ছমাস ঘুরতে না ঘুরতে ভোট। হাজারটা চিমত্মা। সবচেয়ে বড়ো জুজু, পার্টি টিকিট দেবে কি দেবে না। যে-হারে গ্রম্নপে-গ্রম্নপে কোন্দল লেগেছে। মাখনলাল বুঝে উঠতে পারে না কোন খুঁটি ধরবে। এমনি করে-করে বছর ঘুরতে চলল। বেশিদিন দু-নৌকায় পা দিয়ে চললে বিচি জলে ঠেকে যাবে। জেলার থেকে অমুক দাদা আসে, মাখনলাল গাঁয়ের পোলট্রি ফার্ম দেখায়, ফুটবল ক্লাব দেখায়, ভৈরবতলার জরাজীর্ণ দশা দেখায়,
মদ-মুরগির ব্যবস্থা করে। জেলার থেকে আবার তমুক দাদা আসে, মাখন কম্বল বিতরণ করায়, কালচারাল ফাংশন করায়, তাতে কচি-কচি মেয়েরা হারমোনিয়াম গুছিয়ে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গায়, একটু বড় মেয়েরা মঞ্চে উঠে আসে মালা পরাবে বলে, দাদারা খুশি হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই এগোয় না। কোন মুখে চুমো খাবে বুঝতে না পেরে মাখনলাল একবার এর পেছনে, একবার ওর পেছনে হাওয়া করে বেড়ায়। মাঝে-মাঝে ধুৎকার লেগে যায়। ধুর শালা নিকুচি করছি নেতা-মন্ত্রীর, কোনো শালাকে আর তেল দেব না। কিন্তু বাঘের পিঠে একবার চড়ে তো আর নামব বলে বায়না করলে চলবে না বাবা। মাখনলাল নামতেও চায় না। কিন্তু কোন বাঘ শেষ পর্যন্ত জ্যান্ত
থাকবে সেটাই ঠাহর করতে পারছে না। এরকমই ধোঁয়া-ধোঁয়া আবছা সময়ে কালী খবর নিয়ে এলো, বিশু মালোর বউ পেট
বাঁধিয়ে বসেছে।

মাখনলালের জেলা কমিটি, একশ দিনের কাজের হিস্যা, জনসভা, ইলেকশন সব গুলিয়ে গেল। মাথায় কেবল ঘুরতে লাগল, কমাস যেন, কমাস হলো বিশু মালো ফৌত হয়েছে? আঙুলের কর গুনে-গুনে থই পায় না মাখনলাল। বিশুর মরা যে বছর ঘুরে গেছে। এরই মধ্যে? এদিকে এই সময়টা জুড়ে ভুজুং দিয়ে কালী কম মাল খিঁচেছে? চাই কি দুখানা শাড়ির একখানা বাজারের আশীষের দোকান থেকে কিনে দিতে হয়েছে। নেই-নেই করে বার-দশেক কমলার বাড়ি হানা দিয়েছে মাখনলাল। দাওয়ায় গিয়ে বসেছে। সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিয়েছে। ঠারে-ঠারে নানা রসের কথা বলেছে। তালে-বেতালে গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বরাবরই কমলি মাগি সিঁটকে উঠে পিছলে গেছে। মাখনলালের সারা শরীর উস্স্ করে উঠেছে। এরকম খেলানো অরাজি মেয়েমানুষ বশ করেই তো মজা। সব ছিলা টানটান করে সে অপেক্ষা করেছে। পুন্নিমে গেছে, অমাবস্যা গেছে। মাখনলাল ধৈর্য হারায়নি। আর তারপর কি না এই! তাহলে কালী কী করছিল? সেও কি আমায় সময়ে-অসময়ে ভরসা দেয়নি, একটু সবুর করো মাখনবাবু, সবে সবে সোয়ামি মরেছে, ভুলতে সময় লাগে তো। বলেছে আর পঞ্চাশটা-একশটা টাকা হাত করেছে। আবার দরকারটা পঞ্চাশ-একশয় না মেটার হলে বলেছে, আজই তো আপনের কথা বুলছিল বহিন, মাখনবাবুর নামেও মাখম মনডাও মাখমের মতোই লরম। হামার বিপদের দিনে কত করলে হামরাগে লাগে। এসব ঘি-লাগানো কথাবার্তা বোঝাই যাচ্ছে কালীর বানানো। নয়তো সারাদিন পা মেলে বসে বিড়ি বেঁধে মাঠ থেকে গোবর কুড়িয়ে আর কাঠের চুলায় জ্বাল ফুঁকে-ফুঁকে কমলার মুখ থেকে ও বুলি বেরোয়!

এদিকে কালীও দুনিয়া বেচে খায়। জানে, আড়ালে-আবডালে একা বা বাড়ি গিয়ে বললে মাখনলাল হাত-ফাত চালিয়ে দিতে পারে। তাই তাকে একেবারে ভরা বাজারের মধ্যে পাকড়েছে। চারদিকে ভ্যান-অটোটোটো দোকান পাশার, লোকে একেবারে গিজগিজ। সবাই তাদের দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কথা শুনতে পাচ্ছে না চেঁচামেচিতে। সব শুনল মাখনলাল। তারপর কালীকে মিষ্টি করে বলল, তুই পরে আমার বাড়িতে দেখা কর। বলে, কালী হারগিজ আর তার বাড়ির রাস্তা মাড়াবে না বুঝে নিয়ে কালীর ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলার আগেই বাড়ির রাস্তা ধরল। অথচ তার এখন একবার পার্টি অফিস হয়ে কাজের সাইটে যাওয়ার কথা।

এখন কী করতে ইচ্ছে করে? রাতের দিক হলে সোজা যাওয়া যেত কমলার বাড়ি। চুলের গোছা ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে উঠোনে আছড়ে ফেলা যেত। তারপর রগড়াতে-রগড়াতে শুধানো যেত, বুল শালি, কাকে তু হামার চেয়ে বেশি মরদ পেলি এ-গাঁয়ে?

হ্যাঁ বে হ্যাঁ। আমি মাখনলাল ম-ল। আমার কথায় সাতটা গাঁয়ের লোক ওঠে-বসে। ইশ্কুলের হেডমাস্টার আমি ঘরে ঢুকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, পঞ্চায়েত অফিসে ঢুকলে প্রধান পড়ি কি মরি ব্যসত্ম হয়ে ওঠে। এই পুরো সাবডিভিশনে কোনো থানা, কোনো ফাঁড়ি, কোনো ক্যাম্প আছে যেখানে আমার খাতির নেই! আমি কোনো মেয়েছেলের দিকে তাকালে তার পেটের ভাত, পরনের কাপড় নিয়ে কোনোদিন ভাবতে হয়েছে? আর তু কিনা আমার থাবার তলা দিয়ে অন্য পুরম্নষ দিয়ে পেট বাঁধিয়ে বসলি!

বস্ত্তত এতটা এগোনোর পর গল্প বলুন, ঘটনা বলুন, সূত্রপাত এখানে। মাখনলাল ছিপ ফেলল, মাছ খেয়ে গেল অন্য কেউ। কালী দুধওয়ালির কাছে এই খবর পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে তার নিজেকে ছাগলের তৃতীয় বাচ্চা ও পিতাকে টেনে এনে দেওয়া চার অক্ষরের প্রচলিত খিসিত্মর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি মনে হলো। মাখনলালের শরীরে, মাথায় আগুন লেগেছে, আমরাও এই কেচ্ছার আঁচে হাত-পা সেঁকি চলুন।

বাড়িতে ঢুকে কুয়ো থেকে ঠান্ডা জল টেনে তুলে বারবার হাতে-মুখে-ঘাড়ে-কনুইয়ে জল দিয়ে থাবড়ে, বাপের আমলের ‘মক্কেলের ঘর’, যেটা এখন মাখনলালের আমদরবার, সেখানে দুপুর পর্যন্ত কাপের পর কাপ চা খেয়ে আর বিড়ি টেনে, দুপুরে ভাতের পর স্ত্রীতে হিংস্রভাবে উপগত হয়ে বিকেল পর্যন্ত দাবড়ে ঘুমিয়ে মাথাটা থিতু হলো। সত্যি, ঝোঁকের মাথায় কমলার বাড়ি গিয়ে কিছু একটা করে বসলে, কী গুখুরির কাজটাই না হতো! ওসব যে-বয়সে করার সে-বয়সে করা যায়। এখন ওসব গা-জোয়ারি কি তাকে মানায়! তার চেয়ে দেখো না, ঠান্ডা মাথায় কেমন সুন্দর একটা মতলব এসে পড়েছে। যেন ভাঁজে-ভাঁজে ঘি-লাগানো পরোটা। নিজের ভাবনার তারিফে মাখন ফিক করে হেসে ফেলে। একা-একাই হাসে। তারপর বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

সুয্যিদেব পাটে বসেছেন। চারদিকে ঘোর-ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে। আকাশে তাকালে ঝাঁকে-ঝাঁকে ছোট-ছোট পাখি কিচমিচ করতে-করতে ঘরে ফিরে আসছে। দেখে মনে হয়, ঝাঁক-ঝাঁক জিরের দানা উড়ে বেড়াচ্ছে। মাথার ওপর পিনপিন করছে মশা। কেষ্টপুরের মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে। বাড়ি-বাড়ি শাঁখ বেজে উঠছে। এরকম শামিত্ম-শামিত্ম, বউয়ের কাছে উনুনের ধারে উবু হয়ে বসে বিড়ির আগুন চাওয়া যায় এরকম পরিবেশে মাখনলাল পা মেপে-মেপে গোয়ালঘরের দিকে গেল। সাঁজালের ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি। এখনকার মশাগুলোও চালাক আর শক্তিমান হয়ে গেছে। শুধু ভিজে খড়ের ধোঁয়ায় আর পালাতে চায় না। রতন তাই ডিমের ট্রেগুলোতে আগুন ধরাচ্ছে। গোয়ালে যে সাঁজাল দিচ্ছে সন্ধেবেলা, সে রাখাল নয়তো কি প্রধানমন্ত্রী হবে? তবে রতনের আরো পরিচয়, সে গ্রামের সংবাদপত্র। চলমান। ধরেপেড়ে বসিয়ে হাতে একটা চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো। রতন অন হয়ে যাবে। তবে সেরম-সেরম খবর থাকলে রতনকে ধরে বসাতে হয় না। সে-ই লোকজনকে ধরে-ধরে বসিয়ে খবরটা শুনিয়ে ছাড়ে। পারলে চা-সিগারেটও খাওয়ায়।

মাখনলাল খুব খানিক আনতাবড়ি বকে রতনের সঙ্গে। মাখনলালের এহেন ব্যবহারে রতন একটু অবাক হলেও, মালিক তো, যা খুশি করতেই পারে ধরে নিয়ে হাঁ তে হাঁ দিতে থাকে। তারপর মাখনলাল একথা-সে-কথার মাঝে টুক করে খুব সাবধানে আর অযত্নের সঙ্গে কমলার খবরটা বাতাসে ছেড়ে দিলো আর রতন কান কুকুরের মতো খাড়া করে শব্দ বাই শব্দ মাথায় টুকে নিল। আড়ে-আড়ে এটা লক্ষ করার পরই মাখনলাল নিশ্চিন্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে পড়ে।

কেচ্ছা-কেচ্ছার মতোই ছড়ায়। আগুন দাবানল এসব ফালতু কথা বলে তার গতির কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না। এক টক্কর দিতে পারে গুজব। তবে তাকেও ঠিকঠাকভাবে ছড়াতে গেলে একটা যুদ্ধ কি দাঙ্গা কি ভূমিকম্প – এরকম বড় মতন উসকানি লাগে। রং দিয়ে যদি এই ছড়িয়ে পড়া বোঝাতে হয়, তাহলে পরদিন বিকেলের মধ্যে গোটা গাঁ খুনখারাবি লালে রাঙিয়ে গেল। সাতদিনের মধ্যে কমলার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। ঘাটে অবধি যেতে পারে না। এবার তাহলে আর দেরি না করে সাত গাঁয়ের মাথাদের জুটিয়ে একটা সালিশি সভা ডেকে ফেলতে হয়। টাইম এক্কেবারে যাকে বলে খাপে খাপ, কে বাচ্চার বাপ!

টিকটিকিপাড়ার সতে কুমোর যেমন একতাল মাটি চাকের মধ্যে থপ করে ফেলে। তারপর চাক ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আর হাতের মাপমতো চাপে কলসি হাঁড়ি বদনা ইচ্ছেমতো তৈরি করে ফেলতে পারে, মাখনলালও ঠিক কোন জায়গায় কতখানি চাপ দিলে ঘটনা আর রটনা মিলে মনের মতো আকারটা নেবে তা ভালোই বোঝে। গাঁয়ে তার রোয়াব থাকলেও সে একা রম্নসত্মম নয়। বিশেষ করে এসব রসের কেসে টাকা-পয়সা ছাড়াও মসিত্ম নেওয়ার একটা ব্যাপার থাকেই। ফলে সবাই আগে এসে শের হতে চায়। খেলাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বুঝতে না পারলেও মোটামুটি একটা আবছা ছক মাখনলালের কষা আছে। আরে বাবা, অভিজ্ঞতা বলেও তো একটা জিনিস আছে, না কি! গাঁয়ে সব রঙের পার্টিই আছে। সব পার্টিরই আছে ছোট-বড় নানা মাপের দাদা। মাখনলাল সবার কাছেই পৌঁছয়। কোথাও নিজে, কোথাও লোক মারফত। যেখানে যে-ফোঁড়ার মুখে চাপ দিলে কাজ হবে, দেয়। নব মাস্টারের কাছে নৈতিকতার দোহাই তোলে তো শ্রীধর মেম্বারের নোলায় সুড়সুড়ি দেয়। তবে টাকার টোপটা মোটামুটি সব ঘটের মুখেই সিঁদুর-মাখানো কলার মতো লাগানো থাকে।

বেড়ায় আগুন লাগানো হয়ে গেলে মাখনলাল এবার অপেক্ষা করে। চারদিক থেকে গোল হয়ে পুড়তে-পুড়তে এসে কমলি মাগিকে খপ করে ধরবে। মাখনলাল খুব হুঁশিয়ার হয়ে তদারক করতে থাকে। সে যে পুরো রামায়ণটি ঘটাচ্ছে, তা প্রকাশ্যে যেন না আসে। তবে এরকম একটা ব্যাপারে, মানে গাঁয়ের মধ্যে এরকম একটা অশালীন কাজ, নৈতিকতার এমন পতনের বিরম্নদ্ধে মাখনলাল ম-ল যে রম্নখে দাঁড়িয়েছে সে-কথা সবাই জেনে গেল। তারা তখন জরিমানার অঙ্ক কত হবে তা নিয়ে জল্পনা করতে ব্যসত্ম। যথারীতি খবর বিশ্বসত্মসূত্রে ছড়িয়ে গেল, কমলার পোয়াতি সবে দুই মাস। তবে তো আরোই নিশ্চিত, এ বিশু মালোর কাজ হতেই পারে না। যারা কমলার সঙ্গে ঘাটে যেত, মাঠে গোবর কুড়াতো, তারা সব মহিলার মতো দাঁতে আঁচল দিয়ে বলল, ওমা, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তখনই আবার অন্যদের কাছে মুখঝামটা খেল, কেন লা, তোদের চোখে কি ন্যাবা ধরেছিল? আমরা তো বেশ বুঝেছিলাম বাপু, সোয়ামিকে খেয়েও অমন ঠমক, অমন কোমর দুলিয়ে চলন, ও-মেয়ের নাগর না থাকা হয়!

শুধু এই গোপন নাগরটি যে কে তা হাজার চেষ্টা-চরিত্র করেও বের করা গেল না। যারা কমলার বাড়ি গেল, দরজা বন্ধ পেল। সকালে গেলে বন্ধ। রাতে গেলে বন্ধ। খালি কালীকে ঢুকতে দেয়। তাতে বোঝা যায়, গলায় দড়িটড়ি দেয়নি। তবে কালীকে ধরো। কালী বলে, আঁধার ঘরের কোণে ঠাকুরের পটের কাছে বসে কেবলই কাঁদে। তা বেধবা মেয়েমানুষ এমন কা- বাঁধালে কাঁদবে না তো কি নেত্য করবে! এখন কেঁদে কী হবে? শরীর এলিয়ে শোয়ার সময় মনে ছিল না? তা লোকটা কে? অ কালী? বল না। আমাদের গাঁয়ের কেউ? পাশের গাঁয়ের? চেনা?

এরকম করেই বাঁশ পোঁতা হয়, দড়ি বাঁধা হয়। মাখনলাল ও তার লোকজন মাকড়সার মতো ডেকোরেটরের ছেলেদের মতো উঠে-উঠে ঝুলে-ঝুলে মঞ্চ প্রস্ত্তত করে। ক্যাপ্টেন সাহেবের বটতলা প্রস্ত্তত হয়। চার্জার লাইটে কষে চার্জ দিয়ে রাখা হয়। মরদরা টর্চের ব্যাটারি পালটায়। মেয়েমানুষরা রান্নাবান্না, বাচ্চা-খাওয়ানো তাড়াতাড়ি সেরে রাখে। দিন ঠিক। কালীকে দিয়ে কমলার কাছে খবরও পাঠানো হয়েছে। ‘আগামী বারোই ফাল্গুন ক্যাপ্টেন সাহেবের বটতলায় গ্রামের পাঁচজন ভদ্রলোকের সামনে তোমাকে হাজির হয়ে নিজের
কৃতকর্মের জবাবদিহি করার জন্য বলা হচ্ছে। সময় সন্ধ্যা সাতটা’। না, এরকম গুছিয়ে বলা হয়নি ঠিকই, তবে কথাটা এরকমই ছিল।

ফাল্গুন মাসের বারোই এলে সন্ধে হতে না হতে গাঁয়ের লোক পিঁপড়ের মতোই শৃঙ্খলা মেনে সারে-সারে এঁকেবেঁকে, কারণ পথ আঁকাবাঁকা, বটতলার দিকে এগিয়ে গেছিল। আমরা এই ঘটনাটা নিয়ে লিখছি তাই, নয়তো গাঁ-দেশে সালিশি সভা তো লোকে কিছু নতুন দেখছে না। কিসের পরে কি, সবই তাদের জানা। আগে তো মাসে একটা-দুটো লেগেই থাকত। ইদানীং পুলিশের উৎপাতে আর সেরকমভাবে করা যায় না। করলেও তাদের পেটেই সিংহভাগ মালকড়ি ঢুকে পড়ে, হাতে কিছু লাভ থাকে না। তা বলে কি নমাসে-ছমাসে একটা-আধটাও হয় না, তা হলে আর গাঁয়ে থাকা কেন। এই তো সেদিনই হারানের বউ স্বামীর ঘর ছেড়ে জোলাপাড়ার রশিদের ঘরে গিয়ে উঠল। তখনো জরিমানার টাকায় দুই পার্টির দুই ক্লাবে ফিস্ট হয়নি? পাবলিকেও তো মজা নিয়েছিল, না কি? আজকের সভায় তো দুনো মজা। বিশুমালোর বিধবার পেটের বাচ্চার বাপ কে। কে? কে? খোলসা হবে আজ আজ আজ। আর যদি সে হয় গাঁয়েরই কেউ? তাহলে তো এক টিকিটে দুখানা পালা। যদি গাঁয়ের না-ই হয়, তাতেই বা কি। কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনাটা কোনো ব্যাপার! তা সে যেখানেই থাকুক না কেন। মাখনলাল আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছে।

কিন্তু ঘাট বাঁধাই সার হলো। সারা গাঁয়ের মোড়ল মুরম্নবিবর লণ্ঠন চার্জার জ্বেলে বিড়ি-হাতে বটতলায় হাঁ করে বসেই রইল। ঘড়ির কাঁটা সময়ের পর সময় দেখিয়েই চলল। চিড়িয়া ভাগলবা। সে কি? কখন? কীভাবে? তার চেয়েও বড় কথা, কোথায় গেল? হিসাবমতো সকাল থেকেই কমলার বাড়ির সামনে পাহারা, ভেতরে কালী। পাশে বসে সান্তবনা দিলেও বা রান্নাবান্নার কাজ হাতে-হাতে এগিয়ে দিলেও কমলার ওপর নজর রাখাটাই ওর কাজ। বিশেষ করে গুপ্তপ্রেমিক যখন আছে, পালানোর চেষ্টা ও নেবেই। কাজেই পাহারায় ফাঁক ছিল না। না কি ছিল। তবে একা মাখনলাল তো নয়, গোটা পাথরডুবরি বিশপুকুরের চোখ এখন কমলার বাড়ির দেয়ালে সেঁটে। কিন্তু সালিশি সভা বসে গেলে গাঁয়ের রাত পার্টির লোকজন, যাদের নাম আসগর, মোজাম্মেল, অসীম, তুফান ও তোফাজুল – যা কিছু হতে পারে, তারা লাঠি-চর্ট, যা নাকি ইদানীং শুতে গেলেও তাদের হাতে থাকে, সেই লাঠি ঠুকে-ঠুকে টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে কমলার বাড়ি গিয়ে দেখে, সব ভোঁ-ভাঁ। সদর খিড়কি সব দরজা-কপাট হাট করে খোলা। ঝুপসি অন্ধকারের ভেতর মরা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আর তার মধ্যে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কালী। তাদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

রাতপার্টির ছেলেপিলে কমলাকে না পেয়ে কালীকেই ধরে নিয়ে আসে সবার মাঝখানে। বেশি ধমকধামক করতে হয় না।
কান্না-হেঁচকি আর অনেক ‘মা কালীর কিরা’র মধ্যে কালী যা বলে গেল তা হলো, সকাল থেকে সব ঠিকই ছিল। খুব একপশলা কান্নাকাটির পরে কমলা তার ভবিতব্য যেন মেনেও নিয়েছিল। অন্তত কালীর তাই মনে হয়। সারাদিন খুটখাট কামকাজ করল। মাঝে-মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছিল। হাজার হোক কাঁচা পোয়াতি। কালী তাই ওকে খুব বেশি নড়াচড়া করতে না দিয়ে নিজেই হাতে পাতে কাজকম্ম করে দিচ্ছিল। পাছে নজর আলগা হয়ে যায়, কালী তাই পিঠটা সারাদুপুর একটু টান পর্যন্ত করেনি। বরং কমলাই খাবার পর খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। দিয়ে বিকেল যখন সন্ধে হবো-হবো, কমলা কালীকে বলে, কালী দিদি, কোমরটায় একটু টানমতন লাগছে, তুমি হামার মুরগিগুলানকে একটু খোঁপে ভরে দিবা? দুমাসের পোয়াতি মেয়ের কি মুরগির পেছনে ছোটাছুটি করা উচিত, না আমার তাকে ছোটাছুটি করতে দেওয়া উচিত, আফনেরাই বুলেন? আর মুরগিও কি যে সে মুরগি! সবকটা তাজা দেশি। কিছুতে ঘরে ঢুকবে না। আমাকে আলগা পেয়ে আরো খেলাচ্ছে। সবকটাকে যদিবা কোনোরকমে ঢোকানো গেল, লাল ঝুঁটিওয়ালা ডাঁটো মোরগটা দরজা খোলা পেয়ে ফুড়ুৎ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই মুরগি ভরার খেলা সারা বিকেল-সন্ধে চলত, তখনই কালী খেয়াল করে, পেছনের দরজা খোলা, কমলা নেই। প্রথমে কালী ভেবেছিল, ঘরের ভেতরে-টেতরে গেছে বোধহয়, তারপর ব্যাপার মাথার ভেতরে সেঁধুতে শিকেয় উঠল মোরগ ধরা। কালী ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে আসে। তিনদিকে ধু-ধু মাঠ। ফসলও নেই সেরকম। এটুকু সময়ের মধ্যে কি বাতাসে উবে গেল? না কি গিয়ে ঢুকল পেছনের জঙ্গলে?

ঘটনা ক্যাপ্টেন সাহেবের বটতলায় এরপর যা ঘটল, মানে যা চোখে দেখা গেল, মহা হট্টগোল, যাকে বলে একেবারে কেলোর কিত্তি, কথা-কাটাকাটি, ঝগড়া, পাঁচশো রকম মতামত, কালীকে দফায়-দফায় জেরা, দুচারটে চড়-চাপাটি, তু শালি উয়াকে ভাগিয়েছিস, কালীর ‘মা কালীর দিব্যি, মা মনসার দিব্যি আমি যদি মিছা কথা বুলি তো মুখে অক্ত উঠি মরি যাবো’, খিক্খিক্ হাসি, ওরে খোঁজ-খোঁজ, গাঁয়ের কুন মরদটা ইখানে নাই, কার সঙ্গে ভাগল, আহ্ থামো দিকি, গাঁয়ের মানসম্মানের কথা এখন দিলস্নাগি জুড়েছে – এত সব চোখের দেখার আড়ালে যা দেখা গেল না, মাখনলালের মাথা জ্বলছে, মুখ জ্বলছে, কোমরের নিচ থেকে ধু-ধু আগুন। ফসকে গেল! এত করে ধরে-ধরে জাল গুটিয়ে আনলাম। আমার হাতে এলি না, এলি না, তোকে যে টেনেহিঁচড়ে এনে বটতলায় আর পাঁচজনার সামনে দাঁড় করাব, পঞ্চাশটা পুরম্নষমানুষের চোখ তাকে চাটবে, আঙুল তুলবে, আঁচড়াতে কামড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে, আর তুই সিঁটিয়ে যাবি, গুটিয়ে মিলিয়ে যেতে চাইবি, হাত জোড় করে হাউমাউ করে কাঁদবি, বুক দিয়ে যাকে পাবি তার পা চেপে ধরবি, তবে না আমার এতদিনের রাজনীতি করা, এতদিন ধরে একটু-একটু করে তৈরি করা রোয়াব! তবে না আমি শের! তা না, পালিয়ে গেলি!

ক্ষেতের আল কেটে জল বের করার মতো মাখনলাল রাতপার্টির ছেলেপুলে আরো সব জোয়ান কম জোয়ান আধবুড়ো সবাই মিলে কমলাকে খুঁজতে বেরোনোতে প্ররোচিত করে ও সহজেই সমর্থ হয়। হাতের তলা থেকে পালানো মেয়েমানুষকে টর্চ-লাঠি নিয়ে হইহই করতে-করতে ‘খোঁজার’ মধ্যে শেয়াল তাড়া করার থেকেও বেশি মজা। কোণঠাসা হয়ে গেলে শেয়াল উলটে কামড়াতে আসে, মেয়েমানুষ শুধু কাঁদে। একথা ভাবলে ভুল হবে যে, এই দলবেঁধে নারী শিকারে যাওয়াটাকে সবাই একবাক্যে সমর্থন করেছিল। সভার মধ্যে অনেকে একে পাশবিক আদিম ইত্যাদি ইশ্কুলে পড়ানো হয় এমন সব শব্দে বর্ণনা করেছিল। তো তাদের এই বলে বোঝানো হলো, আরে এই রাতবিরেতে পোয়াতি মেয়েমানুষ জঙ্গলে সেঁদুলো না কোথায় গেল, তার কী হলো, মরল না বাঁচল একবার দেখতে হবে না! হাজার হোক, গাঁয়ের লোকের তো একটা দায়িত্ব আছে না কি! আর যেসব মেয়ে এর প্রতিবাদ করেছিল, তাদের আওয়াজ মন থেকে মুখে আসেনি। টর্চ-লণ্ঠন-হ্যাজাক-চার্জার লাইট এসবের মিছিল খুব উৎসাহের সঙ্গেই কমলার বাড়ি পর্যন্ত এলো। রাস্তায় সম্ভাব্য কিছু জায়গা তারা নেড়েঘেঁটে দেখে এসেছে। যেমন নাদের সেখের ভাসিত্ম আয়মনির বাড়ি। আয়মনিও তার বয়সকালে বিনা বিয়াতি অবস্থাতে পেট বাঁধিয়ে বসেছিল। সারা গাঁয়ে ঢিঢি। শেষে নাদের আলী কবরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা এক বুড়োকে কোত্থেকে জোগাড় করে এনে আয়মনিকে তার চার নম্বর বিবি করে। সে বুড়োও দুদিন পরে মাটি নিল। আয়মনির বাচ্চাটাও বাঁচল না। সেসব অবশ্য একযুগ আগের কথা। তবু কালী তো কালীই। একবার লাগলে যতই ধোয়া পাখলা করো, ফিকে হতে-হতেও দাগ থাকেই। আজ কমলার অবস্থা দেখে যদি আয়মনির পুরনো দরদ উথলে ওঠে। বলা তো যায় না। খোঁজ নিতে গেলে রাতপার্টির ছেলেপুলেদের আয়মনি কীভাবে উঠোন থেকে নারকোল পাতা কাটার দা তুলে তাড়া করেছিল আর ওরা কোনোমতে জান নিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল, সে-ঘটনা এই আখ্যানের অংশ নয়। সে শাখানদী, মানে রাতপার্টির ছেলেদের দলটা এসে চুপচাপ বাকি লোকের সঙ্গে এসে মিশে যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, না উখানে নাই খো।

কমলা বাড়ির ভেতর বাহির ঘর উঠোন মাচার ওপর খাটের নিচে ঢেঁকির তলায় খাটা পায়খানার পেছনে সব জায়গায় আলো-আলো করেও দেখা গেল কালীর কথাই ঠিক। উপরন্তু এটা বোঝা গেল, কমলা কিছুই নিয়ে যায়নি। একখানা আয়না-চিরম্নণিও না। এমনকি শিকেয় ঝোলানো একখান কেলে হাঁড়ির ভেতরে প্রায় দুশোটা টাকা পাওয়া গেল। মানে টাকা-পয়সাও কিছুই নিয়ে যায়নি। বা যেতে পারেনি। তাহলে কি যার সঙ্গে পালাল সে টাকা-পয়সাওয়ালা পার্টি, না কি যেখানে গেল সেখানে টাকা-পয়সার কোনো প্রয়োজন নেই? দ্বিতীয় ভাবনাটা অবশ্য ওখানে যারা ছিল তাদের কেউ ভাবেনি, আর ভাবলেও ‘ভাগ বে, তাই আবার হয় না কি কুথাও’ বলে হ্যাটা খেত। বরং তারা ভাবছিল, এবারে কী করা যায়, কোথায় খোঁজ করা যায়।

মাখনলাল সামনে আসে। কেন, একদল গ্রামের দিকে যাবে, একদল বিলের ধারধার খোঁজ করবে আর জলের দিকেও চোখ রাখবে, যদি বডি ফডি কিছু ভেসে ওঠে। মাঠের দিকটা দেখার কিছু নেই, ধুধু করছে। তবু দু-একজন যাক। আর বাকিরা জঙ্গলে ঢুকবে। তার সঙ্গে। কেননা আমরা জানি তার মন বলছে, কমলা জঙ্গলেই ঢুকেছে।

বাকি সবদিকে যাওয়া ঠিক আছে, জঙ্গলে ঢোকার কথাতে দেখা গেল সবার বীরদর্প শুকিয়ে আসছে। এ-ওর মুখের দিকে তাকাতাকি করছে। এ-ওর আড়ালে লুকোতে চাইছে। মাখনদার কথা, ওরা ফেলতেও পারছে না। আপদে-বিপদে মাথা ফাটাফাটি থানা পুলিশে কে আর দেখে ওদের। তা বলে ওই জঙ্গলে, তাও আবার এই অন্ধকারে! ওই গেছো ‘হুপনারান’ জমিদারের ভূত রাত নামলে গাছে-গাছে হেঁটে বেড়ায় না! আর তাছাড়াও সাপ তক্ষক শেয়াল বনবিড়াল ভাম এসব তো আছেই। ভয় করে না বুঝি!

ভয় করে। মাখনলালেরও করে। এখন করছে না। এখন তার ক্ষিধে পাচ্ছে না, ক্লান্ত লাগছে না। বিড়ির নেশা লাগছে না। নিজের হাত কোথায় পা কোথায় বোধ নেই। মাথার ভেতরে সাড় নেই। শুধু মনের ভেতর রেকর্ড ঘুরছে, ওই জঙ্গলের ভেতরে আছে কমলা, চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনতে হবে। মাখনলাল ম-লকে বুরবাক বানিয়ে অন্য মরদের বিছানা গরম করার শাসিত্ম দিতেই হবে মাগিকে।

পাবলিক একেই বলে, জোশ মাথায় চেপে যাওয়া। মাখনলাল অতএব লাফিলে-লাফিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়। তার বক্তৃতায়, যা সে দুমিনিট আগেই দিয়ে উঠেছে, তাতে উত্তেজিত হয়ে দু-চারটে ছেলেছোকরা তার পেছু নিলেও শেষ পর্যন্ত জঙ্গলে ঢোকে কি না বোঝা যায় না।

একহাতে লাঠি আর একহাতে চার্জার লাইট নিয়ে ঝোপঝাড় পেটাতে-পেটাতে জঙ্গলে ঢুকে যাওয়াটা দারম্নণ ব্যাপার। যতক্ষণ পর্যন্ত না কোথাও গিয়ে একটা জববর হোঁচট খাওয়া যায়। তার ওপর যদি মনের মধ্যে ঝড় আগুন বন্যা সব একসঙ্গে চলতে থাকে, তাহলে কি আর মানুষের খেয়াল থাকে, কতদূর চললাম, কোনদিকে এলাম, কোনটা ডানদিক কোনটাই বা বাঁ। হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে এটা-ওটা লতাপাতা ধরে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালে বোঝা যায়, চারদিক কতটা নিসত্মব্ধ। লোকজনের আওয়াজ সাড়াশব্দ কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। খালি একটানা ঝিঁঝির ডাক। আর কোনো রাতের পাখির কর্কশ আওয়াজ। কাছ দিয়ে কোনো প্রাণীর ছুটে-যাওয়ার ঘষে-ঘষে যাওয়ার ঝটপট সড়সড়। কেউ কি তাহলে তার সঙ্গে আসেনি? যে-দিকটাকে পেছন বলে মনে হচ্ছে, সেদিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে, কোনদিক থেকে কোথায় এসে
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না। সোজা কথায়, হারিয়ে গেছি। মাখনলালের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো চিত্তির। হাত থেকে পড়ে চার্জার লাইটের বাল্ব চুরমার। লাঠিটা কোথায় ছিটকে পড়েছে, কে জানে।

আরে কতক্ষণ হলো, কত দূরে এসে পড়লাম, কোনো শালার কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? রফিকুল? আলম? সাগঅঅঅ… র? কুণ্ঠে গেলি বে তুরা? হামারগে আওয়াজ পেছিস? সাড়া দে না কেনে বে! সাড়া দে! ওই… রফিকুউউউ… ল? মাখনলাল এলোপাতাড়ি ঘুরতে থাকে আর মাঝে-মাঝে ডাক ছাড়ে। গলার জোরের সঙ্গে তার সাহসও কমে আসতে থাকে। না কি সাহস কমার সঙ্গে-সঙ্গে গলার জোর? ছোটবেলা থেকে এই জঙ্গলের আশপাশেই সে বড়ো হয়েছে। খাটাশ ভাম আর দু-চারটে শেয়াল ছাড়া কিছু আছে বলে সে জানে না। কতবার কাঠবিড়ালি বনবিড়াল তাড়া করে এর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আবার বেরিয়েও এসেছে। আজ পারছে না কেন? কত বড়োই বা হবে? পাঁচ বিঘা, দশ বিঘা? আমি মাখনলাল ম-ল,
এক-একর জমির হাতবদল করি। জমি জরিপের সব ঘাঁতঘোঁত বুঝি। বাঘা-বাঘা আমিন আমার কাছে কেঁচো হয়ে থাকে। সেই আমি আজ কিছুতেই ধরতে পারছি না। এই বাগানটা, হ্যাঁ বাগানই তো, কোথায় শুরম্ন কোথায় শেষ! খালি গাছ আর গাছ। উঁচু-উঁচু গাছ। মোটা-মোটা গুঁড়ি। সোওওওজা ওই উপরে উঠে গিয়ে আকাশের দিকে হাত-পা মেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের কাছে খুদে মতন একটা মানুষ বেভুল ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। বা হয়তো খেয়াল আছে। খেয়াল আছে বলেই ঊর্ধ্বপানে মুখ করে মজা নিচ্ছে। মাখনলাল যেভাবে, আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই ছোটবেলায় এ-আঙুল থেকে ও-আঙুলে লালপিঁপড়ে হাঁটিয়ে মজা পেত।

মাখনলাল এগাছে-ওগাছে ধাক্কা খায়। মরা জ্যোৎস্নায় ঝোপকে কমলা ভেবে দৌড়ে যায়। এদিক-ওদিক পিটপিট করে তাকিয়ে রাস্তা ঠাহর করার চেষ্টা করে। যদিও ক্রমে বুঝতে পারার মতো কিছু একটা তার মনের মধ্যে জন্ম নেয়, এ-জঙ্গল থেকে সে একলা বেরোতে বোধহয় পারবে না। কমলাকে এখন তার খুব দরকার। মাখনলাল এলোমেলো পা চালায়, মুখও। গাছে-গাছে ঝুলে থাকা মাকড়সার ঝুলরা, মাটি তুলে ঝুরো করে তার মধ্যে আরামে শুয়ে থাকা কেঁচোরা, কাঠঠোকরার ঠোঁটের ঘায়ে গাছের গায়ের ফুটো থেকে ঝরতে-ঝরতে জমে যাওয়া রসেরা শুনতে পায়, মাখনলাল বিড়বিড় করছে, কমলা রে, কুনঠে গেলি তু? একবার সামনে আয়। হামি তুকে কিছু বুলবো না। কেউ তুকে কিছু বুলবে না। খালি হামার সামনে আয় একবার। হামাকে এই জঙ্গলের বাইরে নিয়ে চ।

Published :


Comments

Leave a Reply