জন্মান্ধ দিনের শেষে

ইমতিয়ার শামীম

ভরআশ্বিন গ্রামে অরিত্র কোনোদিন যায়নি। কিন্তু কবে যেন সেখানে সে যেতে চেয়েছিল।
এমন নয় তা কথার কথা, সত্যিই সে চেয়েছিল তখনি রওনা হতে। যদিও পকেটে টাকা-পয়সা ছিল না তেমন (তখন তো টাকা-পয়সা থাকার বয়সও নয়!), তাছাড়া কেন যেন রেল-বাসও চলছিল না কোনো রুটে। তবে সত্যিই যেতে চেয়েছিল সে – মনে হয়েছিল, ভরআশ্বিন গ্রাম দেখতে না পারলে ক্লান্তির ভারে সে তলিয়ে যাবে। এরকম নামের একটি গ্রামকে না-দেখার যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে সারাজীবন। একটা গ্রাম থেকে আরেকটা গ্রাম তেমন একটা আলাদা হয় না, প্রতিটি গ্রামেই এতিম-এতিম বৃক্ষ ও ঘাসেরা থাকে। পায়ে চলার পথও থাকে। থাকে বিস্তৃত শস্যের ক্ষেত, থাকে এলোমেলো বাড়িঘর কিংবা ডোবা ও পুকুর। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো,
মানুষগুলোকে মনে হয় একই রকম – সাদাসিধা, আলাভোলা, মন্বন্তরের প্রতিচ্ছবিময় ও ভয়ানক নিুকণ্ঠী মানের মানুষ; দিনকয়েক না থাকলে বোঝাই যায় না প্রতিটি মানুষ আসলে আলাদা ভীষণরকম – এত বেশি আলাদা যে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো নিঃসঙ্গ গ্রহে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেও তারা একজোট হবে না। আনমনে নামটি শুনেছিল সে, কোনো কথাই শোনার ইচ্ছা হচ্ছিল না সেদিন; কিন্তু একটুকরো রোদের মতো নামটি তার কানের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল আর তার মনে হয়েছিল, নামই যখন এত অন্যরকম, সেখানকার মানুষগুলো না জানি কী ভীষণ অন্যরকম! ওখানে গিয়ে কমপক্ষে মাসখানেক থাকতে হবে।
কিন্তু তার পরপরই নিশিকান্তরা হারিয়ে গেল। নাকি মিলিয়ে গেল? হারিয়ে গেলে তাও ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন থাকে। যেমন, বেঁচে আছে এরকম অদ্ভুত অলীক এক প্রত্যাশা ঝুলে থাকে বিশ্বযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া সৈনিকদের স্মারকতালিকা জুড়ে, আর সেই প্রত্যাশা বছরের পর বছর ধরে অবিনশ্বর অক্ষরে জ্বলজ্বল করতে থাকে মনুমেন্টের দেয়ালে। গার্মেন্টে আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও খুঁজে না-পাওয়ার তালিকায় একেকটি নামের অস্তিত্ব ফিরে পাওয়ার ভীষণ মিথ্যা প্রত্যাশা জাগিয়ে স্বপ্নময় করে রাখে আর্তনাদ করে ফেরা স্বজন সবাইকে – তাদের সেই আর্তনাদের ঘোরকে সম্বল করে ক্ষতিপূরণ না-দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে মালিকের দল। কিন্তু মিলিয়ে গেলে? কী হয় কেউ মিলিয়ে গেলে? বলা চলে, নিশিকান্তরা তো মিলিয়েই গেছে। নিশিকান্ত আর তার বউ-মেয়েকে বাসায় রেখে অভয় দিয়ে সে মোড়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখেছিল, বাইরে থেকে দরোজার ছিটকিনি তোলা আছে – যেমনভাবে সে তুলে রেখে গিয়েছিল সামনের রাস্তা দিয়ে মোড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে। কিন্তু ঘরের ভেতরে একজনও নেই। কোনো এলোমেলো বিন্যাস নেই, মেঝেয় ছিটকে পড়া কোনো কিছু নেই; নিশিকান্তের ঘাড়ব্যাগটা অবিকল পড়ে আছে চেয়ারের ওপরেই। কেবল নেই নিশিকান্ত, নেই তার বউ, নেই তাদের মেয়ে। মিলিয়ে গেছে, যেমন করে মিলিয়ে যায় আকাশ থেকে মালয়েশিয়ার বিমান।
তা হলে কী করবে সে আর ভরআশ্বিন গ্রামে গিয়ে!

দুই
এমন নয়, ভরআশ্বিন গ্রামে নিশিকান্তের বাড়ি ছিল – কথা ছিল অরিত্র তাদের সেই গ্রামের বাড়িতে যাবে। অথবা এমনও নয়, নিশিকান্তের কাছে সে ভরআশ্বিন গ্রামের কথা শুনেছিল মুগ্ধ হয়ে, আর শুনতে শুনতে দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার। এমন এক মন্ত্রণালয়ে সে চাকরি করে যে, দেশে থাকলেও ঢাকার বাইরে পোস্টিং হওয়ার তার কোনো সম্ভাবনাই নেই – তাই কেউ যে অনুমান করবে, ভরআশ্বিনের মতো কোনো গ্রাম এলাকায় তার আসলে সরকারি চাকরির সুবাদে পোস্টিং হয়েছে, সে-আশঙ্কাও নেই।
তাহলে, যে-কারণেই যাওয়ার কথা ভেবে থাকুক, কাউকে কি সে বিশ্বাস করাতে পারবে সেজন্যেই সে ভরআশ্বিন গ্রামে যেতে চেয়েছিল!? বাংলা শব্দের বেশিরভাগ নাম শুনেই যেমন অনেকে আগ বাড়িয়ে ভেবে বসে, হিন্দু নাম রাখা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে তারও কি ভরআশ্বিন গ্রামের নাম শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, বাঁশবাগানের ছায়ায় গোবর-গোলানো পানিতে নিকানো উঠোনে কাঁসার একটি থালার ওপর এইমাত্র কয়েকটি রক্তজবা ফুল তুলে এনে রাখা হয়েছে? তেমন হলেই বা সমস্যা কোনখানে? এদেশের মানুষ গ্রিক পুরাণের নামে কোনো নাম রাখতে পারে, ভারতবর্ষীয় পুরাণের কোনো নাম রাখলে সমস্যা কোনখানে? এদেশের মানুষ কানাডায় বাড়ি কিনতে পারে, ইউরোপে বাড়ি কিনতে পারে, ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে, তাহলে বাড়ির কাছে ভারতে বাড়ি বানালে বা ব্যাংকে টাকা রাখলে কেন বলা হবে, কাজ সেরেছে!
কিন্তু এখন আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, এরকম সময় রাজধানীর রাস্তাতেই কোনো রিকশা আর পাওয়া যায় না, আর এ তো দূরের এক ছোট শহরের নির্জন রাস্তা। দূরে একটা টং দোকানে কেউ হারিকেনের আলো একটু কমিয়ে দিলো পোকামাকড়ের আগ্রাসন থেকে রেহাই পেতে। তবে রেডিওর শব্দ বোধহয় খানিকটা বাড়লো, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির প্রশংসামুখর বিজ্ঞাপন অন্ধকারকে জাপ্টে ধরে যন্ত্রসংগীত বাজাতে শুরু করল। আর বারান্দায় সে দাঁড়িয়ে থাকল এবং মনে করতে পারল না, এ-শহরে তার আসার কারণ। এরকম এক শহরেই কি সে জন্ম নিয়েছিল? কিংবা এ-শহরই কি আসলে তার সেই জন্মকালের শহর? নাকি ভরআশ্বিন গ্রামের মতো ছোট্ট এ-শহরটাতেও সে কোনো একদিন আসতে চেয়েছিল? নাম ভুলে যায়নি বলে ভরআশ্বিন গ্রামে তার আর যাওয়া হয়নি; কিন্তু নাম ভুলে গেছে বলে শেষ পর্যন্ত আজ সে এসে পৌঁছেছে এ-শহরটিতে? কিন্তু আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তার কেবল এটুকুই চোখে পড়েছে, একটা অন্ধ ফকির তখনো রাস্তার ধারে বসে দাদ-বিখাউজ চুলকাচ্ছে আপন মনে। রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে পান খেতে খেতে লুঙ্গির অর্ধেকটা তুলে দেয়ালের এককোণে ‘এখানে প্র¯্রাব করিবেন। না করিলে ওইটা কাটিয়া নেওয়া হইবে’ লেখা অক্ষরগুলোর সামনে মূত্রবর্ষণ করে চলেছে এক মাঝবয়সী লোক, ‘ফুলমালার গুণের কথা করিব বর্ণন’ গাইতে গাইতে ভ্যান চালিয়ে চলে যাচ্ছে চঞ্চল এক কিশোর, দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে মধ্যবয়সী এক নারী আর তার অনামিকা ধরে রাখা ছোট বালিকা।
তাহলে শহরটাকে আরো একটু ভালো করে দেখা কি উচিত – যাতে তার মনে পড়ে, কেন সে এসেছে এ-শহরটিতে? এমন এক অদ্ভুত শহর, আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, কিন্তু চারপাশে মাটি থেকে অন্তত চার হাত ওপর পর্যন্ত কী সুন্দর টলটলে আলো দুলছে! কী করে এখন সে এই আলো থেকে দূরে থাকে, কী করে সে ভুলে থাকে এই মাটিকে! কিন্তু এ-আলো দেখে নিলে সত্যিই কি চোখের আলো নিভে আসতে পারে, যেমন ভরআশ্বিন গ্রামের কথা মনে হলে ভরআশ্বিন নেমে আসে তার চোখের পাতায়? যেন পরিত্যক্ত খেয়াঘাটের বাঁশের মাচাগুলোয় নির্বিবাদে ঘর বাঁধার পর একদল পোকামাকড় দিনরাত কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টার কাছে। নিজের বাড়ির একেবারে পাশ দিয়ে উপশহরে যাওয়ার পাকা রাস্তা নিয়ে যাওয়ার বাসনায় যে নদীর ওপরকার পুরনো পাকা সেতু থেকে মাত্র আধামাইল দূরত্বে আরো একটি নতুন সেতু নির্মাণ করায় পরিত্যক্ত হয়েছে এই খেয়াঘাট। আর খেয়াঘাটের পাড় জুড়ে নেমে এসেছে বৈশাখের দুপুরের নির্জনতা।
হাত থেকে মোড়ানো খবরের কাগজটা অরিত্র আস্তে করে নামিয়ে রাখে। কেউ বোধহয় বাইরের দরোজায় কড়া নাড়ছে। ভরআশ্বিন গ্রাম সেই কড়া নাড়ার শব্দের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

তিন
নারীদের থুতনির নিচে যদি একটু রোদ থাকতো! কণ্ঠার নিচে তাহলে মালার ছায়া পড়তো। ছায়াগুলো কখনো ছোট, কখনো বড়, কখনো আবার একেবারে টায়-টায় একই মাপের – রোদ কখন ওঠে, কখন আবার নামে, কখনই বা পৌঁছায় কণ্ঠার মাঝামাঝি – তার ওপর ভর করে রোদের এই খেলায় মালাটাকে কেমন যে দেখাতো! দরোজা খুলে সামনে দাঁড়ানো নারীটির গলায় রঙের প্রলেপ দেওয়া টুকরো-টুকরো মাটি দিয়ে তৈরি মালা দেখে এরকমই মনে হয় অরিত্রের। সে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয় – সরাসরি চোখের দিকেই তাকায়; কিন্তু তার চাউনিতে কোনো প্রশ্ন থাকে না, জিজ্ঞাসা থাকে না, ঔৎসুক্য থাকে না, থাকে না বিরক্তি। অথচ সেরকম থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল তার দুচোখ জুড়ে। এরকম সময়ে এই প্রায়ান্ধকার বাড়িতে একজন নারী কেন আসবে, তাও তার মতো অচেনা একজনের কাছে। একটু অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বটে। সে অপেক্ষা করতে থাকে নারীটির কথা শোনার জন্যে।
আমি আপনার একটু সময় নেব। খুব বেশি সময় না। আমি একটি জরিপের কাজে এসেছি। অ্যাজমা রোগের ওপর জরিপ। আপনার বাসায় আপনি বা কারো অ্যাজমা রোগ আছে?
এটা কি সত্যিই তার বাসা? অরিত্র বাইরের অন্ধকার হাতড়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। না-কি স্মৃতিহীনতা তাকে গ্রাস করছে? মেঘের ফাঁকের একটু রোদের মতো, একটু অন্ধকারের জোনাকির মতো, একটু সুখের মতো সে একটু স্মৃতিও খুঁজে ফেরে। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতায় ডুবে যেতে যেতে ঠিক করে বরং প্রশ্নের জবাবটাই আগে দিয়ে নেবে সে। চোখ ফিরিয়ে এনে নারীটির দিকে তাকিয়ে সে তাই বলে, না, নেই। তবে থাকলে বোধহয় ভালোই হতো।
মানে?
না, আপনার জরিপের কাজে লাগতো, এই আর কী।
সেটা তো – সেটা তো ধরেন না থাকলেও কাজে লাগবে। নেই-এরও একটা শতাংশ পাওয়া যাবে, অবস্থা কী সেটা বোঝা যাবে। তাই না?
জরিপ করতে আসা নারীটি তার দিকে তীক্ষè চোখে তাকিয়ে থাকে। সেও দ্বিধা করে না তার চোখের দিকে চেয়ে থাকতে, যতক্ষণ না সামনের চোখ দুটো অবনত হয়। জরিপের কাগজপত্রে চোখ দুটোকে অবনত করার ভান করতে করতে সে বলে, আপনার বয়স?
অরিত্র মনে মনে হিসাব কষে। দশকের শেষ সালটায় জন্ম হওয়ায় বয়স বের করা তার খুবই সোজা। সে খুব সহজেই বলতে পারে, এবার ৩৪ হলো। কেন, বলেন তো?
বাহ্, আপনি সার্ভের পারটিসিপ্যান্ট। বয়স কত সে-রেকর্ড রাখতে হবে না? আচ্ছা, আপনি সিগারেট খান?
না। সিগারেট খাই না। আর মদ – বোঝেনই তো, এদেশে অত সহজলভ্য নয়। যেখানে-সেখানে গ্রহণযোগ্যও নয়।
ভদ্রমহিলা বোধহয় হাসি চাপেন। তারপর মুখ তুলে বলেন, আপনার নাম না হলেও চলবে – শুধু বাসার নম্বরটা লিখে রাখলাম। ঠিক আছে, চলি।
মানে আপনার জরিপ শেষ?
হ্যাঁ।
মানে ঠিক বুঝলাম না। এই জরিপ কেন করছেন, তাও ধরতে পারছি না।
অ্যাজমা – জানেনই তো, ভয়াবহ একটা রোগ। আমরা এটা নিয়ে এক ধরনের নেটওয়ার্কিং করতে চাইছি। বিশেষ করে ভাসমান চলমান মানুষদের ওপরই জরিপটা করা হচ্ছে। আপনার যদি রোগ থাকত, তাহলে আরো কিছু প্রশ্ন করতে হতো; কিন্তু আপনি তো সুস্থ – সেসবের আর দরকার হবে না। – বলে চলে যায় সে।
মাটির দুলপরা নারীটি চলে যাওয়ার পরও বেশ খানিকক্ষণ সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটাই কেমন ঘোর-ঘোর জাগানো। আর তখনই তার মনে পড়ে, ঠিক অ্যাজমা কিনা জানা নেই, তবে তার দাদার ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট ছিল। কেমন লম্বা গোঁ-গোঁ শব্দ তোলা নিঃশ্বাস নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত সে মারা গিয়েছিল। তার মানে অ্যাজমা তাদের বংশে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এখন আর এ-কথায় কোনো কিছু যায়-আসে না। জরিপ করতে আসা নারীটি চলে গেছে এবং এখন তার এও মনে পড়ছে, কালো শাড়ি পরেছিল নারীটি। অন্ধকারের মধ্য থেকে তাই তাকে কিছুতেই আলাদা করতে পারছিল না সে। আর আগামীকাল তাকে দেখলে সে চিনতে পারবে বলেও মনে হয় না। ভীষণ অপরিচয়ের ভার নিয়ে সে দরোজা বন্ধ করে আবারো ওপরের বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তখন ছাদটাকে অনেক উঁচু মনে হয়, মনে হয় বাড়িটা অনেক পুরনো হবে। বিদ্যুৎ নেই বলে বড় বড় কয়েকটি মোমবাতি জ্বলছে মোমদানিতে। শহরের এই প্রান্তে বিদ্যুৎ এলেও বোধহয় অনেকেই এখনো ক্লায়েন্ট হতে পারেনি, ছোট দোকানগুলোতে তাই সন্ধ্যা হলে হারিকেন কিংবা কুপিবাতি জ্বলে, লাইটপোস্টের নিচে বসে একজন মুচি জুতো পালিশের জন্যে হাঁক ছাড়তে থাকে। আর দূরে সিনেমা হলটিতে ইভনিং শো শুরু হওয়ার আগে রমরমা গান বাজতে থাকে। মনে হয়, একদিনেই সে অনেক কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অথচ এখনো ভরআশ্বিন গ্রামটি না দেখার বেদনা নামছে তার শরীর জুড়ে।

চার
অনেক রাতে হঠাৎ জেগে উঠে অরিত্র চিঠিটি খুঁজতে থাকে। প্রথমে খোঁজে জামার পকেটটাতে, না পেয়ে খোঁজে প্যান্টের পকেটে, তারপর মানিব্যাগের মধ্যে; কিন্তু সেখানেও না পেয়ে সে হাতব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। তারপর মনে পড়ে, হয়তো শোয়ার আগে সে চিঠিটি একবার পড়েছিল, তারপর সেটি বালিশের নিচে রেখে ঘুম আনার চেষ্টা করেছিল। অতএব সে বালিশের তলায়ও খোঁজে। এবার অকস্মাৎ মনে পড়ে, চিঠিটি আসলে ফোনের মধ্যে আছে এবং সে মেসেজে গিয়ে সেটিকে খুঁজে পায় অবশেষে। ‘মুরাদ টাকলা’ ভাষা অবলম্বনে লেখা এসএমএসটি সে আবারো মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করে, হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করে – ‘আপনার হয়তো কিছুই করার নেই; কিন্তু তারপরও একবার এখানে আসলে আমি খানিকটা শান্তি পেতাম। আপনার স্কুলজীবনের সহপাঠিনী ইন্দিরা।’
এখন সে বুঝতে পারে, ভরআশ্বিন গ্রামটিকে সে হয়তো সত্যিই একটু-একটু চেনে। কেবল নামটা অন্যরকম বলেই সেখানে সে যেতে চায়নি বোধহয়, আরো কোনো কারণ ছিল, এখনো আছে। এই উপলব্ধি তাকে খানিকটা উত্তেজিত করে তোলে এবং ইন্দিরা নামটিও বটে। ইন্দিরা গাবে-গাবে একাকার এক ছিপছিপে পানসি, ইন্দিরা এক দীঘল কালো টলটলে শীতল দীঘি, ইন্দিরা এক নীলদ্যুতি ছড়ানো মৃত্যুপরোয়ানা, ইন্দিরা অনেক রাতে জেগে-ওঠা মৃদু আলোর সাঁতার, ইন্দিরা গাছের পাতার ফাঁকে ঝিম ধরে থাকা লক্ষ্মীপেঁচা, ইন্দিরা চাঁদের তলদেশে জমে-ওঠা হিংসুটে জ্যোৎøা, ইন্দিরা আকাশের গায়ে শুয়ে থাকা বেনীআসহকলা, ইন্দিরা ঘুমচোখে জেগে ওঠা সকালের মন্দির, ইন্দিরা স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনা রঙিন কাগজে মোড়ানো টকটকে চকোলেট, ইন্দিরা নারকেল পাতা দিয়ে বানানো ঘড়ি-চশমা, ইন্দিরা চোখের নিচে জমে-ওঠা দুপুরের নরম উদাসীনতা, ইন্দিরা হারিয়ে যাওয়া প্রীতিলতা বইটা, ইন্দিরা হলুদ ফিতায় বন্দি এলোমেলো চুল, ইন্দিরা চোরকাঁটায় ছেয়ে-যাওয়া বিকেলের মাঠ, ইন্দিরা কলাবতী ফুলের উন্মনা পাপড়ি, ইন্দিরা সার্কাস দলের সঙ্গে চলে যাওয়া ঝলমলে রাত, ইন্দিরা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখা ভীরু ইচ্ছা, ইন্দিরা আত্মহত্যার সামান্য চিরকুট…
অরিত্র চমকে উঠে দাঁড়ায়। আবারো ইনবক্সে হানা দিয়ে দেখে, প্রথম মেসেজটি এসেছিল চার-পাঁচ দিন আগে; অচেনা নম্বর। এ-ধরনের নম্বর থেকে ফোন এলে সে কখনোই ধরে না, মেসেজও পড়ে ধীরেসুস্থে। তাছাড়া প্রথম মেসেজটিতে তো কোনো নামও ছিল না। শুধু লেখা ছিল – আজ চারদিন হলো আমরা পালিয়ে আছি।
ব্যস, এটুকুই, আর কিছু নয়। হয়তো তার কাছে ভুল করে এটি চলে এসেছে। তা ছাড়া গাড়ির মধ্যে এসি থাকলেও প্রলম্বিত জ্যামের মধ্যে পড়ে ভীষণ বিরক্ত ছিল সে। তবে এটি তো ঠিক, ভরআশ্বিন গ্রামে সে যেতে চেয়েছিল, ভরআশ্বিন গ্রামে ইন্দিরার বিয়ে হয়েছিল। ক্লাস নাইনে পড়া ইন্দিরা তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল বিয়ের পরেই। সে হিসেবে তার স্মৃতি থেকে ইন্দিরার মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। যেমন, গ্রামটিও মরে গেছে তার স্মৃতি থেকে। তবে এটি তো ভাবা যেতেই পারে, ভরআশ্বিন নামটি কেন রাখা হয়েছিল। তা কি এজন্য, কোনো এক ভরআশ্বিনের দিনে সেখানে গিয়ে একটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল? আশপাশে কেবলই জলাভূমি, সামান্য জেগে-ওঠা জমি, এলোমেলো অনেক গাছগাছালি – কিন্তু যত দিন গেছে, ততই সেটি গ্রাম হয়ে উঠেছে, লোভাতুর হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে এবং মানুষ ছুটে গেছে সেখানে বসতি গড়ে তুলতে। একটি গ্রামের ইতিহাস কখনোই লেখা যায় না, ভরআশ্বিন গ্রামের ইতিহাসও নিশ্চয়ই কোনোদিন লেখা যাবে না; কিন্তু আশপাশের জমিজমার দিকে তাকিয়ে, একেকটি ভিটেবাড়ির দিকে তাকিয়ে, মরে যাওয়া জলাভূমি দেখতে দেখতে কিংবা নতুন মাটি ফেলে তৈরি করার সড়কের দিকে চেয়ে অনুমান করে নেওয়া যাবে ইতিহাসের একেকটি ম্রিয়মাণ স্তর। আর মানুষগুলো কেমন, তা তো সে ভালো করেই জানে – ভালো করেই জানে, কত সুদীর্ঘ জিলিপির প্যাঁচ রয়েছে তাদের শান্তশিষ্ট মাথাগুলো জুড়ে। কিন্তু প্রথমে সে সত্যিই ভাবেনি, এরকম একটা মেসেজ আসলে ইন্দিরার কাছ থেকে এসেছে – সেই ইন্দিরার কাছ থেকে, স্কুলের ফাংশনে যে ‘মমির দেশের মেয়ে মমির পুতুল’ হয়ে ‘বিহ্বল চঞ্চল পায়’ নেচেছিল ছোট মঞ্চ জুড়ে। মেসেজ জমিয়ে রাখার অভ্যাস নেই তার, অপ্রয়োজনীয় মেসেজের মধ্যে প্রয়োজনীয় মেসেজ পেতে বেগ পেতে হয়; তার পরও সেটি বেঁচেছিল একই নম্বর থেকে আরো একটি মেসেজ আসা পর্যন্ত – ‘পারলে আমাদের জন্যে একটা কিছু করেন। ইন্দিরা, ভরআশ্বিন গ্রাম।’ এবার সে ভ্রু কুঁচকেছিল, মেসেজটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল…
ভরআশ্বিন গ্রাম… ভরআশ্বিন গ্রাম… এই নামের গ্রামটি তাহলে এখনো আছে…

পাঁচ
এখন কী করবে সে? ইন্দিরা পারলে কিছু একটা করতে বলেছে; কিন্তু সে যে কিছু একটা করতে পারবে, শেষ পর্যন্ত বোধহয় অতটুকু ভরসা রাখতেও পারেনি! নইলে শেষ মেসেজে কেন আবার লিখতে যাবে, ‘আপনার হয়তো কিছুই করার নাই…’। ইন্দিরা কী করে এতদিনেও তাকে মনে রেখেছে, কী করে তার ওপর এত ভরসা পুষে রেখেছে। আবার দীর্ঘদিনের অদর্শনে সেই ভরসা নিয়ে সংশয়ীও হয়েছে – এরকম একেকটি প্রশ্ন তাকে দোলাতে থাকে, যেমন দুলিয়েছে সারাটা পথ জুড়ে। আর রাতের এক নির্ঘুম রাজ্যে ঠেলে দিয়ে এখনো দুলিয়ে চলেছে। সে কি আগামীকাল সকালে বরং একবার ফোন করবে ইন্দিরাকে? কথা বলতে বলতে এটাও জেনে নেবে, কোথা থেকে কী করে সে তার ফোননম্বর পেলো? এই এত সহজ একটা ব্যাপার তার এতক্ষণ পর মনে হলো কেন, চিন্তা করে সে রীতিমতো বোকা হয়ে যায়।
দূরে একটা রাতজাগা পাখি ডাকছে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে সে সিগারেট জ্বালে আর আবারো মেসেজগুলো পড়ার তৃষ্ণা জাগে; কিন্তু ইনবক্সে গিয়ে বুকটা ধক করে ওঠে। চোখগুলো ছোট হয়ে আসে। একটা মেসেজও সে আর খুঁজে পায় না। খুব বেশি মেসেজ তো নেই তার ইনবক্সে, আর সেগুলো মুছেও ফেলেনি সে, বরং যতœ করে রেখে দিয়েছে। আসার পথে বারবার পড়েছে, পড়তে পড়তে কী এক গ্লানিতে অস্থির হয়েছে, রাতে শহরের ডাকবাংলোয় থাকার পর সাতসকালে ভরআশ্বিন গ্রামে গিয়ে কী করতে হবে তাও চিন্তা করেছে দু-একবার; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কোনো মেসেজও নেই ইনবক্সে!
তাহলে, কেন সে এতদূর ছুটে এলো তড়তড়িয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতিতে? কিসের আকাক্সক্ষায়, নাকি কিসের মোহে? যে অতীত দুর্নিবার ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়, সেই অতীতকে একবার দেখে নিতে? সংবাদপত্রে কেবলমাত্র এক কলামের একটা ছোট্ট খবর পড়ে, সেনানিবাসের জন্যে ভরআশ্বিন গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েকশো একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করছে জেনে? এটুকু সংবাদ তাকে এত উন্মূল করে ফেলল কেন এত সহজে? অধিগ্রহণ করতে গেলে যা হয়, তা তো স্বাভাবিকই – প্রতিবাদ হবে, মানুষজন জড়ো হবে, মিছিল হবে, পুলিশ দেখে তারা ঢিল ছুড়বে, পুলিশও তাদের তাড়া করবে, মানুষজন তখন পালিয়ে বেড়াবে, দু-একজন হয়তো মারাও যাবে, তখন বেশ কয়েকদিন সারাদেশই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে – বৃত্তাকারে এসবই তো হয়ে আসছে দূরের অতীত থেকে!
অরিত্র বুঝতে পারে, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সন্ধ্যায় আসা নারীটিকে সে হয়তো ঠিক বলেনি, এখন তো দিব্যি বুঝতে পারছে – আছে, তারও অ্যাজমা আছে। ভরআশ্বিন গ্রাম না থাকতে পারে, ভরআশ্বিন নামের একটি গ্রাম হারিয়ে যেতে পারে, ইন্দিরা নামের কোনো মেয়ে না থাকতে পারে, ইন্দিরা নামের কোনো মেয়ে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতে পারে – কিন্তু অ্যাজমা আছে, শ্বাসকষ্ট আছে, বিবর্ণতা আছে, মৃত্যুর স্বাদ দিতে পারে এরকম কোনো কিছুও আছে। ভয়ংকর শ্বাসকষ্টে দুলতে দুলতে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে কনফেশনের তীর নিঃশব্দে ছুটে যেতে থাকে অন্ধকারের দিকে…