জলের নিনাদ

রেজাউল করিম সুমন

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার সূত্রপাতকারী প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের সর্বশেষ জীবিত প্রতিনিধি এবং ‘চল্লিশের বয়ানধর্মী শিল্পধারা আর পঞ্চাশ থেকে সূচিত আঙ্গিকপ্রধান শিল্পধারার মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ’১ সফিউদ্দীন আহমেদ (২৩ জুন ১৯২২-২০ মে ২০১২) বিদায় নিলেন নববই বছর বয়সে। আমাদের আর কোনো চিত্রকর এত দীর্ঘ শিল্পীজীবন পাননি। গত বছর প্রয়াত হয়েছেন তাঁর অগ্রজ সতীর্থ ও সহকর্মী শফিকুল আমীন (১৯১২-২০১১), নিরানববই বছর বয়সে। দীর্ঘতর আয়ুর অধিকারী হলেও তাঁর শিল্পীজীবনের ব্যাপ্তি তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদই শিল্পচর্চায় সক্রিয় থেকেছেন সবচাইতে বেশি সময় জুড়ে – দীর্ঘ সাত দশক।

Surjamukhi, Oil, 1956
Surjamukhi, Oil, 1956

সফিউদ্দীনের জন্ম অবশ্য পূর্ববঙ্গে নয়, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। দেশভাগের সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিজ্ঞতার চাপে তিনি ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশান্তরি হয়ে চলে আসেন এ-বঙ্গে (পরে এর নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান)। পেছনে পড়ে রইল কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টের ছাপচিত্র বিভাগের চাকরি (১৯৪৬-৪৭), শিল্পী হিসেবে নবীন বয়সেই অর্জিত খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবৃত্ত আর প্রিয়তম প্রিন্ট মেশিন। ঢাকায় থিতু হওয়ার পর মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। আরো পরে প্রিন্ট মেশিনটাও নিয়ে আসতে সমর্থ হন।
নতুন করে গড়ে তুলতে হলো সবই। কিছুদিন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে শিল্প-শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেন গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর ছাপচিত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টের চারুকলা বিভাগে ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে পাঠগ্রহণ শেষে ছাপচিত্র বিভাগে শিক্ষকতাকালে সফিউদ্দীন শিল্পী হিসেবে সর্বভারতীয় পরিমন্ডলে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দেশভাগের পর তিনি স্বীকৃতি অর্জন করেন পাকিস্তানের অন্যতম অগ্রণী চিত্রকর হিসেবে। চারুকলায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬৩ সালে ভূষিত হন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট পদকে। পরবর্তীকালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে অর্জন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-প্রদত্ত একুশে পদক (১৯৭৮) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৬)।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বীকৃতি, সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সফিউদ্দীন বরাবরই পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। শিক্ষিতজনের কাছে তিনি জয়নুল আবেদিনের মতো পরিচিত নন, জনসমক্ষে তাঁর কামরুল হাসানের মতো সপৌরুষ উপস্থিতি কল্পনাতীত, সুলতানের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক ও দৃষ্টি-আকর্ষক চরিত্রের মানুষও নন তিনি। তবে সপ্রতিভ, সুবেশ উপস্থিতির রুচিস্নিগ্ধ শালপ্রাংশু মানুষটিকে যে-কোনো ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করা যেত। শিল্পী হিসেবেও তাঁকে আমরা মর্যাদার আসনে বসিয়েছি; কিন্তু তাঁর সৃজনমুখর শিল্পীসত্তার স্বাতন্ত্র্য সাধারণের গোচরে বড়ো একটা আসেনি। এ দূরত্বের আড়ালটুকু রচনায় তাঁর নিজেরও হয়তো খানিকটা ভূমিকা ছিল। তিনি দেশে একক প্রদর্শনী আয়োজনে দ্বিধা ও অনাগ্রহ দেখিয়ে এসেছেন জীবনের প্রায় শেষ পর্যায় পর্যন্ত। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আধুনিক ঐতিহ্যের অগ্রণী শিল্পীদের নিয়ে সচিত্র অ্যালবাম প্রকাশে উদ্যোগী হলে সে-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন; তাঁকে নিয়ে মনোগ্রাফ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলে কর্তৃপক্ষকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সৌভাগ্যবশত সফিউদ্দীনের নিজেকে আড়ালে রাখার এসব প্রয়াস শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হয়নি।

দুই
১৯৪২-৪৭ কালপর্বের ‘দুমকা’ (ড্রাই পয়েন্ট, ১৯৪৫), ‘ঘরে ফেরা’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৪৫), ‘সাঁওতাল রমণী’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৪৬), ‘মেলার পথে’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৪৭) ইত্যাদি ছাপচিত্রের জন্যই সফিউদ্দীন আহমেদ স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সহপাঠী সতীর্থ, বিখ্যাত ছাপচিত্রী হরেন দাসের (১৯২১-৯৩) মতো সাদৃশ্যধর্মিতা আর পারিপার্শ্বিক দৃশ্যজগতের অনুপুঙ্খ রূপায়ণের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তাঁর চিত্রভাষার পর্বান্তর আমাদের সামনে হাজির করেছে নতুন এক সফিউদ্দীনকে।
ছাপচিত্র মাধ্যমের সর্বাধুনিক করণকৌশল আয়ত্ত করার জন্য তিনি ১৯৫৬ সালের শেষদিকে নিজ খরচে ভর্তি হয়েছিলেন লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের ছাপচিত্র বিভাগে। কলকাতায় ও ঢাকায় দীর্ঘ এক দশক শিক্ষকতার পর নতুন করে ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেয়ে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। এচিং, অ্যাকুয়াটিন্টের করণকৌশল নিয়ে নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিমগ্ন থেকেছেন। বারো ঘণ্টা অক্লান্ত কাজ করে প্রতি রাতে ঘরে ফিরেছেন প্রায় টলতে টলতে। দুবছরের কোর্স শেষে ১৯৫৮ সালে এচিং আর এনগ্রেভিংয়ে ডিপ্লোমা পেয়েছেন ডিস্টিংশনসহ; বিভাগীয় প্রধানকে দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ডিপিআইকে পত্রযোগে সুপারিশ করিয়ে শিক্ষাছুটি বাড়িয়ে নিয়েছেন আরো এক বছর। প্রবাসে অাঁকা তৈলচিত্র আর ছাপচিত্র নিয়ে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনের নিউ ভিশন সেন্টার গ্যালারিতে – ১৯৫৯ সালে।
সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটে সফিউদ্দীন ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে পেয়েছিলেন স্বনামধন্য ছাপচিত্রী মেরলিন ইভান্সকে (১৯১০-৭৩)। ইভান্স চল্লিশের দশকের শেষদিক থেকে এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, এনগ্রেভিং ও ড্রাইপয়েন্টের সংমিশ্রণে রঙিন ছাপচিত্রের চর্চা শুরু করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি শুগার-লিফ্ট অ্যাকুয়াটিন্ট পদ্ধতিতে ‘ভার্টিকাল সুইট ইন ব্ল্যাক’ নামে ছয়টি বড়ো ছাপচিত্র করছেন যখন, সে-সময়ে সফিউদ্দীন ছাপচিত্রের করণকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তাঁরই নেতৃত্বাধীন বিভাগে। পরের বছর লন্ডনের সেন্ট জর্জস গ্যালারি প্রকাশ করেছিল ওই ছাপচিত্রমালার সংগ্রহ। সেসব ছাপাই ছবিতে আদিম শিল্পকলার অনুপ্রেরণায় ইভান্স ব্যবহার করেছিলেন জ্যামিতিক রূপবন্ধের ঘনসংবদ্ধ বিন্যাস, যা সফিউদ্দীন আহমেদকে হয়তো দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকবে। অবশ্য তাঁর তৈলচিত্রে নতুন চিত্রভাষা অনুসন্ধানের সূচনা হয়েছে তার আগেই – ১৯৫৬-তে অাঁকা ‘শূন্য খাঁচা’ বা ‘শরবতের দোকান-১’ ছবিতে রূপবন্ধের সরলীকরণ আর জ্যামিতিক বিন্যাস তার প্রমাণ।
১৯৫৭ সালে সফিউদ্দীন মেরলিন ইভান্সের সঙ্গে বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনকুশল ছাপচিত্রী স্ট্যানলি হেটারের (১৯০১-৮৮) প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারিতে। একটি এচিংয়ের অভিনব করণকৌশল নিয়ে ছাত্রের জিজ্ঞাসার সদুত্তর দিতে না পারায় শিক্ষক ইভান্স নিজের শিল্পগুরু হেটারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। এচিং ও অ্যাকুয়াটিন্টের সূক্ষ্ম করণকৌশল নিয়ে এই বিশ্ববিশ্রুত শিল্পীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ সফিউদ্দীনকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল।২
শিক্ষাসূত্রে প্রবাসে থাকাকালে সফিউদ্দীন শিল্পতীর্থ পারীর জাদুঘর আর গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে পাশ্চাত্যের পাঁচশো বছরের শিল্পসম্ভার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। গিয়েছিলেন পিকাসোর স্মৃতিধন্য একটা প্রিন্ট স্টুডিওতেও। ইতালির ভেনিস দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর বিভিন্ন প্যাভিলিয়নে পরিচিত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনের বিচিত্রমুখী সাম্প্রতিক প্রবণতার সঙ্গে। বেলজিয়ামে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফেয়ারে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল মেক্সিকোর শিল্পকর্ম আর আফ্রিকার মুখোশের শিল্পকুশলতা। আমস্টারডামে খুব কাছ থেকে তিনি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন রেমব্রান্টের বিশ্ববিশ্রুত সব ছবি। এই শিল্পযাত্রা সফিউদ্দীনের সৃজনভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
তাঁর শৈশবের পারিবারিক আবহে সংগীতের চর্চা ছিল। এক বোন গান করতেন, সফিউদ্দীন তাঁর রেওয়াজ শুনতেন নিয়মিত; কিশোর বয়সে নিজে তালিম নিয়েছিলেন সেতারে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের নিবিষ্ট শ্রোতা। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণকালে মস্কোর বলশোয় থিয়েটারে অর্কেস্ট্রা শুনতে গিয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। এতজন বাদক এত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলছেন, আর সবটা মিলে তৈরি হয়ে উঠছে আশ্চর্য সুন্দর এক ঐকতান। সুরের ইন্দ্রজালে ডুবে যেতে যেতে সফিউদ্দীনের মাথায় ঝিকিয়ে ওঠে নতুন ভাবনা – একটামাত্র প্লেটের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন করণকৌশলের প্রয়োগে এরকম সুরসংগীতময় একটা ছাপচিত্র রচনার পরিকল্পনা! এর প্রায় এক দশক পরে, দীর্ঘ সময় ধরে এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট আর এনগ্রেভিংয়ের সংমিশ্রণে তিনি রচনা করলেন ‘জলের নিনাদ’ (১৯৮৫)।
বস্ত্ততপক্ষে, সফিউদ্দীনের দ্বিতীয় পর্বের ছাপচিত্র ও ছবির রূপবিন্যাসে যে অন্তর্লীন সাংগীতিকতা আমরা পাই, তার পেছনে সক্রিয় থেকেছে তাঁর সংগীতবোধ।

তিন
সফিউদ্দীন আহমেদের প্রধান পরিচয় মূলত একজন পথিকৃৎ ছাপচিত্রী হিসেবে :
ইভান্সের শিক্ষায় সফিউদ্দীন ছাপচিত্রের আধুনিক করণকৌশল রপ্ত করে তা বাংলাদেশে সঞ্চারিত করে বাংলাদেশে ছাপছবির পথিকৃৎ হলেন। সফিউদ্দীন যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তখনো ভারতে মুকুলচন্দ্র, রমেন্দ্রনাথ ও হরেন্দ্রনারায়ণের পরে ছাপছবিতে আধুনিক ইয়োরোপীয় করণকৌশল আসে নি, সাবেক এচিং, ড্রাইপয়েন্ট, লাইন এনগ্রেভিং চলছিল। এদিক থেকে সফিউদ্দীনকে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, উপমহাদেশেরও পথিকৃৎ বলা যায়।৩
বলা বাহুল্য, এটা তাঁর খন্ডিত পরিচয়। ছাপচিত্রে তো বটেই, রেখাচিত্র, জলরং, তৈলচিত্র প্রভৃতি মাধ্যমের ছবিতেও তাঁর সিদ্ধি তর্কাতীত :
এ শিল্পীকে কোথাও আমরা বলেছি শিল্পী-কারিগর। শিল্পের যত মাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন তার প্রতিটির উপাদান ও নির্মাণশৈলী অনুপুঙ্খভাবে এবং পরিপূর্ণ দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত না করে তিনি শিল্পনির্মাণে অগ্রসর হননি। তেলরং বা জলরং বলি বা ছাপাই ছবির নানান মাধ্যমের কথাই বলি, এসব বিষয়ে বাংলাদেশে সফিউদ্দীন আহমেদের চেয়ে কুশলী কেউ কখনো ছিলেন না, এখনো নেই।৪
ছাত্রজীবনে জলরঙে অাঁকা তাঁর ‘জড়জীবন ১’ (১৯৩৯) নামের ছবিটির সজীবতা ছয় যুগ পরেও পুরোমাত্রায় অটুট। বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন কি পেঁয়াজগুলো যেন-বা কিছুক্ষণ আগে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৪৪-৪৫ সালে দুমকা অঞ্চলের নিসর্গ আর দেহাতি মানুষজন নিয়ে অাঁকা ছোট আকারের কয়েকটি তৈলচিত্র বা বছর কয়েক পরের ‘ধানঝাড়া’ (১৯৫২) কুশলী বর্ণলেপন সত্ত্বেও মূলত অনুশীলনধর্মী ছবি। তৈলচিত্র মাধ্যমে সফিউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলি তাঁর অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের সৃষ্টি। উদাহরণ হিসেবে ‘মাছ ধরার জাল’ (১৯৭৫), ‘সূর্য, বৃক্ষ ও নারী’ (১৯৮৯), ‘মাছ’ (২০০৪) ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়।
পেনসিল আর ক্রেয়নের পাশাপাশি তিনি রেখাচিত্র এঁকেছেন চারকোলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে চারকোল ও ক্রেয়নের সংমিশ্রণে। আবার চারকোল, কালি ও জলরঙের সমন্বয়ে এঁকেছেন ‘কালো সিরিজে’র (১৯৯২-৯৫) স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত ছবিগুলো।
বিশ শতকের মধ্য-পঞ্চাশের বন্যার বাস্তব অভিজ্ঞতার অভিঘাত পড়েছিল সফিউদ্দীনের প্রবাসে অাঁকা ছবিতে ও ছাপচিত্রে। এরপরও বারবার বন্যাকে বিষয় করে ছবি এঁকেছেন তিনি – নানা মাধ্যমেই। তার মধ্যে শিল্পোত্তীর্ণ ছবি বেশ কয়েকটিই : ‘বন্যা’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৫৬), ‘নেমে যাওয়া বান’ (সফ্ট অ্যাকুয়াটিন্ট, ১৯৫৯), ‘বন্যা’ (অ্যাকুয়াটিন্ট, ১৯৫৯), ‘জলের নিনাদ’ (এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট ও এনগ্রেভিং, ১৯৮৫), ‘বন্যা : বাংলাদেশের আনন্দ-বেদনা’ (চারকোল ও ক্রেয়ন, ১৯৯৪) ইত্যাদি।
পাশ্চাত্যের করণকৌশল সফিউদ্দীন সযত্ন নিষ্ঠায় আয়ত্ত করেছেন, তার কুশলী প্রয়োগ তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে; কিন্তু তাঁর ছবির বিষয়বস্ত্ত দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে পুরোপুরি দেশীয় : ঘানিটানা, ধানের বাজার, পল্লিনিসর্গ, শরবতের দোকান, বাদামওয়ালা, কাপড় বিক্রেতা, মুরগির খাঁচা, মাছ, মাছধরা, জাল, নৌকা, গুণটানা, নদী কিংবা বন্যা। পাশ্চাত্যের শৈল্পিক উৎকর্ষের প্রয়োগ-নৈপুণ্য ও করণকৌশল সচেতনভাবেই দেশীয় বিষয়বস্ত্ততে প্রয়োগ করেছেন তিনি।৫
নিজের পরিণত ছবিতে নৌকা, জাল, মাছ আর কখনোবা চোখের মোটিফের পুনরাবৃত্ত প্রয়োগে সফিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে উত্তরকালের শিল্পরসিকদের সামনে উন্মোচিত হবে আমাদের দেশের সবচেয়ে আঙ্গিকসচেতন ও রূপদক্ষ শিল্পীর পৌনে এক শতাব্দীর শিল্প-অভিযাত্রা।

তথসূত্র :
১. আবুল মনসুর, ‘দৃশ্যকলার সন্ধিক্ষণ : সফিউদ্দীনের গুরুত্ব’, শিল্প ও শিল্পী, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪১৮, পৃ ১০।
২. মাহমুদ আল জামান, ‘সফিউদ্দীন আহমেদ’, (বাংলাদেশের শিল্পকলা গ্রন্থমালা, ২), ঢাকা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৪০৯, পৃ ৬৬।
৩. শোভন সোম, ‘সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রকলা’, নিরন্তর, পঞ্চম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৪০৬, পৃ ৮৫।
৪. আবুল মনসুর, ‘দৃশ্যকলার সন্ধিক্ষণ : সফিউদ্দীনের গুরুত্ব’, শিল্প ও শিল্পী, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪১৮, পৃ ৯-১০।
৫. সফিউদ্দীন আহমেদ, ‘নিজের কথা’, দ্র. মতলুব আলী (সম্পা.), রূপবন্ধ, ঢাকা, মানব প্রকাশন, ১৪০৫, পৃ ২৫৫। 