জল ও রঙের গহিনে

এস এম সাইফুল ইসলাম

চিত্রশিল্পের ইতিহাসে জলরং মাধ্যম একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। সন-তারিখের সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও প্রস্তরযুগে ইউরোপে গুহাচিত্রে জলরং ব্যবহারের হদিস মিলেছে। মিশরীয়দের পাণ্ডুলিপি চিত্রণেও জলরঙের ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অবশ্য ঐতিহাসিকগণ মন করেন, প্রকৃত জলরং মাধ্যমে চিত্রচর্চা শুরু হয় ইউরোপে রেনেসাঁস যুগে। সে-সময়ের মহান জার্মান শিল্পী অ্যালব্রেক্ট ডিউরর (১৪৭১-১৫২৮) জলরঙের আদিপিতা হিসেবে বিবেচিত। ১৫০২ সালে জলরঙে আঁকা তাঁর ‘কচি খরগোশ’ শীর্ষক চিত্রটি শিল্পানুরাগীদের মনে আজো চিরঅম্লান হয়ে আছে। প্রাচ্যে, বিশেষত চীন, জাপান, কোরিয়া ও ভারতবর্ষে, জলরং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্পমাধ্যম এবং একই সঙ্গে তা নিজ নিজ জাতি ও ভূখণ্ডের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবেও পরিগণিত। দেশভাগের পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জলরং চর্চা ও বিকাশের পথ সুগম করেন।
সম্প্রতি গ্যালারি কায়া দেশের বরেণ্য ও নবীন ১৬ জন শিল্পীর একটি দলবদ্ধ জলরং চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে। ‘ওয়াটার রাইমস’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি ১৫ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
শিল্পী মুর্তজা বশীরের সৃজন বহুমাত্রিক। তিনি একাধারে চিত্রকর, লেখক, মুদ্রা সংগ্রাহক ও গবেষক। ১৯৫৪ সালে বশীর এঁকেছেন জলরংচিত্র ‘চকবাজার অ্যাট নাইট’। পঞ্চাশের দশকের পুরান ঢাকার চকবাজারের একটি রাত্রিকালীন দৃশ্য। রাতের নাটকীয় আলো-আঁধারে ঘেরা কিছু মানুষ ও রাস্তার দোকানপাট অনেকটা মূর্ত হয়েও চিত্রে সামগ্রিকভাবে বিমূর্ত ইমেজ তৈরি করেছে। শিল্পীর আরো দুটি ছবির একটি ‘প্রেসম্যান’ ও অন্যটি ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন মুরি-২’।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের চিত্রশিল্প ও গ্রাফিক ডিজাইনের জগতে একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তাঁর আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ, নামলিপি, পোস্টার ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, টাইপোগ্রাফি ইত্যাদি শিল্প একবাক্যে অতুলনীয়। প্রদর্শনীতে শিল্পীর আঁকা দুটি ছবি ‘গোল্ডেন বেঙ্গল’ ১ ও ২।  বাংলার চিরায়ত অনুষঙ্গ বৃক্ষ, নদী, নৌকা, মাছ, জাল, গ্রাম্য রমণী প্রভৃতি শিল্পীর নিজস্ব শৈলীতে ছবিতে প্রতিভাত হয়েছে। কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলায় যে বিশুদ্ধ জ্যামিতিক গুণ, আলংকারিক সৌন্দর্য এবং রং ও পরিসরের সুষ্ঠু বিন্যাস আমরা প্রত্যক্ষ করি তা অসামান্য।
বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের বই নকশা ও অলংকরণের ক্ষেত্রে শিল্পী হাশেম খান একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর আঁকা জলরংচিত্র ‘অন দ্য ব্যাংক অব যমুনা’। ছবির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমিন জুড়ে রয়েছে সবুজের আবাহন। সবুজের এক প্রান্তে নদীতে অপেক্ষমাণ নৌকার সারি। নদীর ওপারে দূরের আকাশ ও শুভ্র মেঘ পরিপ্রেক্ষিতের নিয়মে দিগন্তে মিলেছে। চলচ্চিত্রের লং-শট দৃশ্যের মতো একপ্রকার উদাস অভিব্যক্তি ও সবুজের বলিষ্ঠ ওয়াশ ছবিতে চমৎকার ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে।
দলবদ্ধ প্রদর্শনীর একটি ভালো দিক হলো, তা দর্শকের মনে একসঙ্গে বিবিধ চিত্রভাষার স্বাদ দিতে পারে। সাধারণ দর্শক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের স্বাতন্ত্র্যবোধ, বিষয়, শৈলী, বৈশিষ্ট্য ও ঝোঁক সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানার সুযোগ পায়।
‘টোকাই’ চরিত্রের সফল স্রষ্টা শিল্পী রফিকুন নবী। এদেশের কাঠখোদাই ও জলরং মাধ্যমে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব আমাদের অভিভূত করে। ‘দিজং ইন থিম্পু’ শীর্ষক জলরং চিত্রে তিনি প্রতিভাত করেছেন ভুটানের থিম্পু শহরের রাত্রিকালীন শোভা। পাহাড়ি শহরে রাত নেমেছে। কাছে-দূরে ঘরবাড়িগুলো যেন নীরবে ঘুমিয়ে পড়েছে  মায়াবী রাতের অন্ধকারে। রফিকুন নবীর চিত্রকর্ম বরাবরই রোমান্টিক, ফলে তাঁর ছবি সহজেই দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়।
বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্প শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। জলরং মাধ্যমে তিনি সুখ্যাতি পেয়েছেন বহু আগেই। প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা ছয়টি জলরং চিত্রে ভুটানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
শিল্পী চন্দ্রশেখর দে ‘উইমেন’ সিরিজের কাজে বাঙালি নারীর বিশেষ অভিব্যক্তি উপস্থাপন করেছেন। জলরঙের ওয়াশের সঙ্গে কলমের ড্রইংয়ের মেলবন্ধের ফলে তাঁর কাজে একপ্রকার আলংকারিক স্বাদ তৈরি হয়েছে।
‘বেহুলা কাহিনী’ সিরিজখ্যাত শিল্পী তরুণ ঘোষ ‘ফুল মুন’ শীর্ষক ছবিতে পূর্ণিমার চাঁদ ও রাতের শাশ্বত সৌন্দর্য বয়ান করেছেন। শিল্পে চন্দ্রবন্দনা করেননি এমন বাঙালি কবি ও শিল্পী খুঁজে পাওয়া দুরূহ বোধ করি।
শিল্পী রতন মজুমদার জ্যামিতিকভাবে চিত্রের জমিন বিভাজন করেছেন। বর্গাকার ঘুড়ির ফর্ম তাঁর ছবিতে বিবিধ আকারে, রঙে ও টেক্সচারে উপস্থাপিত হয়েছে।
শিল্পী কাজী রাকিব অত্যন্ত সরলভাবে এঁকেছেন বৃষ্টিভেজা দিনের ছবি। শিল্পী রনজিৎ দাস রং, রেখা ও ফর্মে এঁকেছেন নিসর্গচিত্র।
আশির দশকে যে কয়েকজন শিল্পী ভিন্নধর্মী চিন্তা-চেতনা ও সৃজনের মধ্য দিয়ে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য তাঁদের মধ্যে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর আঁকা ‘ল্যান্ডস্কেপ-১’ ও ‘অন ওয়ে টু পারো’ শীর্ষক চিত্রকর্মে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, রোদ্দুরমাখা নীলাকাশ ও পরিপ্রেক্ষিতের নির্মিতি মনোমুগ্ধকর, কাজগুলোতে শিল্পীর অ্যাকাডেমিক দক্ষতার প্রতিভাস চমৎকার।
প্রদর্শনীর অপেক্ষাকৃত কয়েকজন তরুণ শিল্পী সমীরণ চৌধুরী, নগরবাসী বর্মণ, কামালুদ্দিন ও সোহাগ পারভেজের কাজে নিয়মিত জলরং মাধ্যমে ছবি আঁকার প্রবণতা লক্ষণীয়। তাঁদের কাজে সম্ভাবনার আভাস আছে।
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন – মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, চন্দ্রশেখর দে, তরুণ ঘোষ, রতন মজুমদার, কাজী রাকিব, রনজিৎ দাস, মাসুদা কাজী, শিশির ভট্টাচার্য্য, সমীরণ চৌধুরী, নগরবাসী বর্মণ, কামালুদ্দিন ও সোহাগ পারভেজ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য ও জলবায়ু জলরং মাধ্যমে ছবি আঁকার জন্য যথেষ্ট উপযোগী। আমাদের নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে জলরং চিত্রচর্চার প্রতি যে-অনুরাগ লক্ষ করা যায়, অনাগত প্রজন্মের শিল্পীরা নিশ্চয়ই সে-পরম্পরা ধরে রাখবেন অসীম উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়।