জানালা

ও য়া সি  আ হ মে দ

একটা কংকাল। গা-ভর্তি বড় বড় খোড়ল। শোবারঘর থেকে জানালা বরাবর তাকালে সীমা চোখের যন্ত্রণায়ই বেশি ভোগে। চক্ষুশূল। সে অবশ্য আরো লাগসই আইসোর কথাটাই ভাবে।

চারতলা পর্যন্ত উঠে বাড়িটা আটকে আছে। মুশকিল হলো, তার শোবারঘরের একমাত্র জানালার ওপারে দশ হাত তফাতেও হবে কিনা, বাড়িটা উঠতে না উঠতে থেমে পড়তে ভূতভবিষ্যৎহীন বাড়ির অনিশ্চয়তা যে তার মধ্যেও সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে, সীমা ইদানীং ভালোই বুঝতে পারছে।

বছরতিনেক হবে যেইসেই। নোংরা খাম্বা ও বিমে বৃষ্টির পানিতে শ্যাওলা, রোদে শুকিয়ে শ্যাওলা বলে ধরার উপায় নেই, কালো কালো চাপড়া এখানে-ওখানে, তার মধ্যে আবার ঘাসও গজিয়েছে, আর কাকদের যা কাজ – বীজ ছড়ানোর অপার দক্ষতার প্রমাণস্বরূপ কয়েকটা বট-অশ্বত্থের ডগোমগো চারা এদিকে-ওদিকে উঁকিঝুঁকি দিলেও সীমার চোখে সেসব আইসোরই। এসবের মধ্যে সন্ধ্যার পর জানালার মুখোমুখি খোড়লে যখন টিমটিম কুপি, কোনোদিন হারিকেন জ্বলে, অন্ধকার-চেরা ম্লান হলুদ ফুলকিতে তার নিজের অনিশ্চয়তাই বুঝি কাঁপা কাঁপা ছায়া ফেলে।

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। সীমা করতে যায়ও না। শুধু এটুকু বোঝে, চোখের সামনে সারাক্ষণ কংকালসার বাড়িটা তাকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না। আনিস হয়তো ভাবে সীমার দুশ্চিন্তাটা মনগড়া, তারপরও একথা-সেকথা বলে প্রসঙ্গটা চাপা দিতে বলে, সমস্যাটা তো তোমার-আমার না, ডেভেলপার মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে কেটে পড়েছে, বা সেরকম কিছু না হলে হয়তো ব্যাংক লোনের চক্করে ফেঁসে গেছে। তোমার খারাপ লাগলে পর্দা সরিও না, জানালা তো বন্ধ রাখতে পারবে না। আনিস যে তার বিষয়ে দুশ্চিন্তায় তার প্রমাণ দিতে বলে, এ-সময় ওয়ারি করা চলবে না। বইটই পড়ো, গান শোনো। সীমা বইটই পড়ে। গান বড় একটা শোনা হয় না। কলেজে ছুটি চলছে, ছুটির পর জয়েন করেই ম্যাটারনিটি লিভের দরখাস্ত করবে। ছয় মাসের ম্যাটারনিটি লিভ – এ-সরকারের এটা একটা ভিজিবল ভালো কাজ। ‘ভিজিবল কেন? প্রেগন্যান্সি ব্যাপারটা না হয় ভিজিবল, তাই বলে ম্যাটারনিটি লিভ কেন তা হতে যাবে!’ আনিসের ডাক্তারি মগজে এমন কুটকচালও খেলে!

বিয়ের সাত বছর পার করে ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে বলেই সম্ভবত সীমা যেমন, আনিস নিজে ডাক্তার হয়েও এক ধরনের চাপা অস্থিরতায় রয়েছে। তবে সীমার মাথায় যা আজকাল প্রায়ই ঘুরঘুর করে তা ঠিক অস্থিরতা নয়। কয়েক রাত আগে ভোরের দিকে স্বপ্নে দেখেছে, ওপাশের চারতলাটা ঝড়বৃষ্টি ছাড়াই তাদের এই আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ির গায়ে ঢলে পড়ে যেন এটার পতন ঠেকাতে ঠেস দিয়ে আছে। স্বপ্নের যদি খারাপ-ভালো বলে কিছু থেকে থাকে, এটা অবশ্যই একটা খারাপ স্বপ্ন। সীমার একটা সুবিধা সে কোনো দিনই স্বপ্নের মানেটানে নিয়ে মাথা খাটাতে যায় না। তার সব স্বপ্নই মাথামু-ুহীন। এখন অবশ্য সময়টা অন্যরকম। অন্যরকম বলেই যে-কোনো কুচিন্তা মাথায় উঁকিঝুঁকি দিয়েই কেটে পড়ে না, বরং পাকাপোক্তভাবে গেড়ে বসবে বলে তোড়জোড় বাধিয়ে দেয়।

আনিস বেশ বোঝালো, ওপাশের বাড়িটা নিয়ে যে চিন্তা করে, সেটাই কারণ – স্বপ্ন তো সাবকনশাসেরই…। বেচারা আনিস, নাক-কান-গলার ডাক্তার হয়েও তাকে তোতাপাখির মতো বস্তাপচা বুলি আওড়াতে হলো।

কিছুদিন যেতে, কলেজের ছুটি তখনো শেষ হয়নি, সীমা নতুন উপদ্রবে পড়লো। এতোদিন কংকালবাড়িটা যে-অনিশ্চয়তা নিয়ে তার ওপর ভর করেছিল, সেটা যেন পাশ ফিরে শুলো। জানালার ওপারে সোজাসুজি যে খোড়লে টিমটিম কুপি বা হারিকেন জ্বলে, সেখানে হালকাপাতলা গড়নের খোঁচা খোঁচা দাড়িধারী যুবক দারোয়ান যে তার অল্পবয়সী বউ নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে মিস্ত্রিদের ফেলে-যাওয়া তোবড়ানো বালতিতে-ড্রামে লাউ, পুঁইয়ের চারা তুলে লকলকে ডগাগুলো রীতিমতো জাংলায় চরিয়ে, এমনকি খোড়লের এক কোণে মুরগির ঘর বসিয়ে দিব্যি সংসার করছে, এ- ধাঁধার সুরাহা কে করবে! কবে যে দারোয়ানের চাকরি জুটেছিল কে জানে, হতে পারে বাড়ির কাজ যখন আরম্ভ হয়েছিল তখনই, ধীরে ধীরে বাড়িটা ওপরের দিকে উঠতে থাকায় ঠাঁই গেড়েছে চারতলার এই খোড়লে। হতে পারে তখনি গ্রাম থেকে বউকে নিয়ে এসেছে, কিংবা মোটেও বিচিত্র নয় বিয়েটা হয়তো তখনি সেরেছে – ঠাঁই যখন মিলেছে। এসবের ফলে সীমার যে সমস্যা তা সোজা-সরল। তুলে তো দেবে যে-কোনো দিন, তারপর? সীমা না তাকিয়ে পারে না, কী অপার শাস্তিতে মেয়েটা, মানে বউটা, দু-পা ছড়িয়ে বসে কুলায় চাল বাছছে। যেদিন শাকটাক নিয়ে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয়। সীমার বিস্ময়, কিসের এতো কোটাবাছা!

আনিস যখন এসব শোনে সে নিশ্চিত হতে পারে না সীমার দুর্ভাবনা কতখানি আন্তরিক। তবে কিছুদিন আগেও সীমা পারতপক্ষে পর্দা সরিয়ে বা না সরিয়ে জানালার ওপারে তাকাত না। এখন নিশ্চয় তাকায়, পর্দার ফাঁকে চুরি করেই হয়তো, না হলে মেয়েটার চাল বা শাক বাছার এতো খুঁটিনাটি জানবে কী করে! কৌতূহলের সঙ্গে কি একটু আনন্দের যোগও নেই?

প্রশ্নটা করে বসতে সীমা মোটামুটি গুছিয়ে যা বললো তা এক ধরনের মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। আনন্দের ব্যাপারটা সে সরাসরি স্বীকার করলো না, তবে এমন আনসার্টেন অবস্থায়ও যে মানুষ এতো সিকিওর থাকতে পারে তা বিস্ময়কর মানলো।

‘আনসার্টেন কেন?’

‘একটা গুহার মধ্যে থাকছে, হোক না বড়োসড়ো। ইলেকট্রিসিটি নেই, গ্যাস নেই, থাকার মধ্যে ছাদ। আজ আছে, কাল যে তুলে দেবে না কে বলবে!’

‘তারপরও লাউয়ের, পুঁইয়ের চারা তুলেছে।’

‘মুরগির খোঁয়াড় পর্যন্ত।’

‘তা হলে?’

‘কী পরিমাণ সিকিওর ফিল করছে ভাবো।’

‘আনসার্টেনটির মধ্যে, মানে কদিন টিকতে পারবে ঠিক নেই, তারপরও নিশ্চিন্তে-নির্ভাবনায়… এটা মানতে পারছো না, তাই তো?’

‘আমার মানা-না মানায় ওদের কী আসে-যায়!’

‘এটাই আসল কথা। এজন্যই মানুষ টিকে আছে পৃথিবীতে। দেখছো না কী দুর্ভোগ মাথায় করে পালে পালে মানুষ ঘরবাড়ি-দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, আবার পথেঘাটে আটকা পড়ে খাবার তৈরি করতে চুলা বানাচ্ছে।’

‘তোমার কাছে ব্যাখ্যা চাইছে কে! ঠেকায় পড়ে করছে, চুলা যদি না ধরায় না খেয়ে মারা পড়বে। তাই বলে এদের মতো গেরস্তি পেতে বসেনি।’

‘কথা কিন্তু একই।’

‘না, এক না। এরা জানে এদের সামনে কিছু নেই, তবু… ’

‘কিছু নেই কেন বলছো? যেদিন তুলে দেবে, ফ্রেশ লাউডগা পেড়ে চুলায় চড়িয়ে চলে যাওয়ার আগে পেট ঠেসে খেয়ে নেবে।’

সীমা ও আনিসের এসব কথাবার্তা চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে পুঁই বা লাউডগা-সংক্রান্ত কৌতূহল – যা বলার অপেক্ষা রাখে না – স্রেফ কৌতূহলে আটকে নেই, অন্তত সীমার কাছে। কাকতালীয় হোক বা না হোক, দিন দুই পরে যখন কংকালবাড়ির দারোয়ান লোকটা দুই হাতে কচি-টাটকা পাতাসহ একগাদা জকড়িমকড়ি লাউডগা নিয়ে দরজায় লাজুক মুখ করে দাঁড়ালো, সীমা ভ্যাবাচেকা খেয়ে কী বলবে ভেবে উঠতে পারলো না। লোকটা, বছর তিরিশ-বত্রিশ হবে বয়স, নাম বললো রমযান, উলটোদিকের ফেলাটে সে তার পরিবার মিলে লাউ ও পুঁইয়ের চারা তুলেছে, সার-টার তেমন দেয়নি তারপরও এমন বাড়, নিজেরা খেয়ে কুলাতে পারছে না। সীমা টাকা দিতে চাইলে সে এমনভাবে জিব কাটলো, সীমার ভয় হলো পান খাওয়া কালচে-লাল জিবটা না ঘ্যাঁচ করে দুই টুকরো করে ফেলে!

রমযানের বিষয়ে নতুন তথ্য মিললো। দারোয়ান হিসেবে সে বহাল সেই গোড়া থেকে, যখন বাড়িটা উঠি-উঠি করছিল। বেতন-টেতন কিছু নিশ্চয় পায়, তবে তার মূল রোজগার অন্যত্র। সে ইলেকট্রিকের কাজ জানে, সে-সুবাদে তার এদিকে-ওদিকে ডাক পড়ে। কেউ কেউ রেফ্রিজারেটর, এসির কাজেও ডাকে। খোড়লের এক কোণে সাজসরঞ্জাম নিয়ে সে ভালোই জাঁকিয়ে বসেছে। আদতে সে মিস্ত্রি।

ছুটি শেষ। এবার টানা ম্যাটারনিটি লিভ, অপেক্ষা। সীমা হাঁপিয়ে ওঠে। কাজকর্মহীন দিনের পর দিন। শারীরিক অসুবিধার বিষয়গুলোও এমন নয় যে তাকে সারাক্ষণ দখল করে রাখবে। আনিস যতটা পারে তাকে সঙ্গ দেয়, বিকেলের দিকে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে বসতো, এক ছুতায় এখন সন্ধ্যাগুলো বাসায় কাটায়। সীমা আপত্তি করে, রোজ সন্ধ্যায় ঘরে বসে বসে অভ্যাস খারাপ করে ফেললে পরে ডাক্তারির কী হবে!

ঠাট্টার মেজাজে বললেও কথাটা সে এমনি এমনি বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে, ইউনিভার্সিটিতে তখন, বিয়েটিয়ে হয়নি, দলে-বলে ভাইবোন মিলে লংলা চা-বাগানে বেড়াতে গেছে কয়েক দিনের জন্য, সঙ্গে সবে বিয়ে হওয়া ছোটখালা ও তার ডাক্তার বর। দিনের বেলা ডাক্তার খালু সবার সঙ্গে ঘোরাঘুরিতে যোগ দিলেও বিকেল-সন্ধ্যাগুলো তার কাটতো ঘরে বসে, একা। দু-তিনদিন যেতে দেখা গেল, কিছু না, স্রেফ নিজেকে বাইরের প্রলোভন থেকে সরিয়ে রাখতেই এ-ব্যবস্থা। ছোটখালা অবশ্য চোখ-মুখ গম্ভীর করে অকাট্য যুক্তি দেখিয়েছিল, সন্ধ্যাবেলা ডাক্তারদের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে নেই, এ-সময়টা তাদের ইবাদতের, আর এর মোক্ষম জায়গা হলো চেম্বার। বাইরের টান থাকলে ইবাদতের কী হবে!

ঘটনাটা শুনে আনিস হাসেনি। এটা নাকি হাসির কথা নয়। মানুষকে খেয়ে-পরে টিকে থাকতে গেলে রোজগার করতে হবে, সেটা সকাল-দুপুর-রাত যে-কোনো সময়ই হতে পারে। তাছাড়া ডাক্তারদের এতো কম্পিটিশন, পসার জমাতে গেলে চোখ-কান বন্ধ করে চেম্বার নামের চৌখুপিতে বন্দি না থেকে উপায় নেই।

‘এখন যে বড় শুয়ে-বসে সিরিয়াল আর ক্রিকেট দেখে সন্ধ্যাগুলো পার করছো!’

‘এমনি এমনি তো করছি না।’

‘কেন করছো?’

‘উত্তরটা তোমার জানা জরুরি?’

‘না। কিন্তু তোমার অভ্যাসের কী হবে! যদি চেম্বারে বসার অভ্যাসটাই বরবাদ হয়ে যায়?’

পরপরই বেখেয়ালে বলে উঠলো, ‘তা হবে না। টাকার টান বড় টান।’

অনিচ্ছাকৃত খোঁচাটা দিয়েই সে সেটাকে মেরামত করতে গলার সুর পালটালো, ‘আমার জন্য খুব ইনসিকিওর ফিল করো, না?’

 

মাসে একবার চেকআপের জন্য যে গায়নোকোলজিস্টের কাছে সীমাকে যেতে হয় তিনি পুরুষ। গোড়াতে সীমা বেঁকে বসেছিল। শহরে ডজন-ডজন মহিলা গায়নোকোলজিস্ট থাকতে একজন পুরুষকে কেন আনিসের পছন্দ এ-নিয়ে তর্কাতর্কি-ঝগড়াঝাঁটির পর্যায়ে গেলেও শেষমেশ ডাক্তার ভদ্রলোকের প্রতি চরম আস্থার প্রমাণ দিতে আনিসকে যখন-তখন বক্তৃতাবাজিতে মেতে উঠতে দেখে সীমা বাধ্য হয়ে হাল ছেড়েছে বটে, তবে প্রতিমাসে একজন পুরুষের হাত, হোক না গ্লাভস-মোড়া, তার ঊরুসন্ধির কোটরে চরে বেড়াবে, চাই কি টর্চ টিপে জরিপ চালাবে, এ নিয়ে আনিসের সামান্যতম হেলদোল নেই দেখে ভেবে ভেবে কূল-কিনারা করতে পারেনি।

সীমাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে বিষয়টার মীমাংসা হয়ে গেছে ভেবে আনিস বলেছে, ‘ডাক্তারের কাছে প্যাশেন্টের জেন্ডারে কিছু যায়-আসে না। মেয়ে-পুরুষ এক। বলতে পারো রোগী দেখার সময় বেসিক ইনস্টিংক্ট ভোঁতা হয়ে থাকে।’

‘বাজে কথা বলবে না।’ সীমা ঝাঁজিয়ে উঠেছে।

‘বাজে কথা!’

‘বাজেই না, একদম ফালতু।’

আনিসকে এ-নিয়ে বক্তৃতাবাজির সুযোগ না দিতে সীমা উঠে পড়েছে। উঠে আর যাবে কোথায়! আনিস একসময় ঠিকই তাকে পাকড়াও করেছে, তবে সীমার মেজাজ-মর্জি আঁচ করে বক্তৃতার বদলে অন্য কথা পেড়েছে, ‘ভদ্রলোক আমার স্যার ছিলেন। আমার চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের বড় – হি ইজ মোর দ্যান সিক্সটি।’

কথাটা সীমাকে উসকে দিলো। ‘তোমার চিন্তাভাবনা খুব ক্রুড। বয়স ষাট না সত্তর কে জানতে চাচ্ছে! তুমি কি ভাবছো চেকআপের সুযোগে লোকটা আমাকে রেপ করতে পারে, এ-দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হচ্ছে না!’

থতমত খেয়ে আনিস বোকার মতো তাকিয়ে থাকলে সীমা ঠান্ডা গলায় বলেছে, ‘একজন পুরুষ, সে ডাক্তার হোক বা ট্রাফিক পুলিশ, কাপড় খুলে আমাকে দেখবে তা তোমার জন্য সমস্যার না হলেও আমার জন্য তো হতে পারে।’

কথাগুলো এভাবে মুখ ছিটকে বেরোবে সীমা ভাবেনি। আনিস শোনামাত্র চুপসে গেছে। তখনি সীমার মনে হয়েছে, এতো ক্যাটকেটেভাবে বলা উচিত হয়নি। বরং তার মনে যে খটকাটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো, ভেবে ভেবে কিছুতেই দূর করতে পারছিল না, তার বিহিত অন্যভাবে করলেও করতে পারতো। নিজের বউকে একজন পুরুষ চরম আবরুহীন অবস্থায় ছেনে দেখবে, এ নিয়ে কি আনিসের কোনোই অস্বস্তি হচ্ছে না – কথাটা তো ঘোরপ্যাঁচে না গিয়ে হালকা চালে তুললে পারতো।

ব্যাপারটার সুরাহা হয়নি। তবে প্রতিমাসে চেকআপের বিশেষ দিনে আনিস যে একটা অস্বস্তিতে থাকে সীমা টের পায়। আর তখনি তাকে এক ধরনের অনিশ্চয়তা পেয়ে বসে। শারীরিক উপসর্গে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, এমনকি হাতে-পায়ে পানি জমা বা অতিরিক্ত ওজন বাড়ার মতো সাধারণ লক্ষণও সীমার নেই দেখে আনিসের মোর দ্যান সিক্সটি স্যার ভালো ভালো কথা শোনান। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে মধুর করে হাসেন আর সীমাকে উপদেশ-টুপদেশ দেওয়ার বদলে আনিসকে নিয়ে পড়েন। সে কেন খামোকা টেনশন করছে, চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমায়নি, ঘটনা কী! আনিস আমতা আমতা করে, হয়তো প্রথমবার বাবা হতে যাচ্ছে বলে লজ্জায় কী বলতে চায় বোঝা যায় না। মোর দ্যান সিক্সটি মজা পেয়ে চেম্বার কাঁপিয়ে হাসেন। আনিস নিজে ডাক্তার হয়েও গোবেচারা হবু বাবাদের মতো আচরণ করছে এটাই নিশ্চয় তাকে মজার খোরাক জোগায়।

সীমার শরীর সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। আয়নায় দাঁড়ালে নিজের বেঢপ আকৃতি অস্বস্তির চেয়ে এক বিদঘুটে ধাঁধার মতো ঠেকে। তারপর যেদিন থেকে ঢাউস পেটে নড়াচড়া টের পেতে শুরু করলো, তার মনে হলো বাচ্চাটা ঠিকমতো তার শরীর থেকে খাবার নিতে না পেরেই হাত-পা ছুড়ছে। কোনো কোনো দিন পরিষ্কার লাথি খেয়ে সন্দেহটাকে আরো পোক্ত করে তোলে। এমন অবস্থায় আনিসের যা করা উচিত করে। অভয় দেয়, সীমাকে শুইয়ে বা বসিয়ে পেটে কান পাতে।

কংকালবাড়িটা জানালা খোলা অবস্থায়ও যাতে সীমার চোখে না পড়ে সেজন্য ভারী পর্দা এমনভাবে আনিস টাঙিয়ে দিয়েছে, টেনে সরাতে রীতিমতো কসরত করতে হয়। আলো ঢোকার জন্য ঘরের দ্বিতীয় জানালাই যথেষ্ট। তারপরও ভারী পর্দামোড়া জানালা দিয়ে আলোর পথ করে দিতে পর্দার রেইল অনেকটা নামিয়ে জানালার ওপরের দিকটা ফাঁকা করার কাজও আনিস নিজ হাতে করেছে। অবশ্য এজন্য ড্রিল মেশিন জোগাড় করতে তাকে যার শরণাপন্ন হতে হয়েছে সে কংকালবাড়ির রমযান।

গলিতে রমযানের মুখোমুখি হলে শুধু সালাম দিয়েই রমযান ক্ষান্ত হয় না, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে, এমনকি একদিন আনিসকে অবাক করে জানতে চেয়েছে জালিকুমড়া পছন্দ করে কিনা – সে টবে শসা-কুমড়ার চারা তুলেছে, পাতা আর ডগার এমন বাড় আশা করেনি, ফুল অনেক ঝরে গেলেও কুঁড়ি যা টিকে গেছে, কম না। ড্রিল মেশিন তার আছে কিনা জিগ্যেস করতে রমযান অতিউৎসাহে জানতে চেয়েছে কী কাজ, তার নিজের নেই, তবে চেনা লোকের কাছ থেকে এনে দেবে, কবে আনবে? অতিউৎসাহে আনিস অপ্রস্ত্তত হলেও বলেছে, যে-কোনো দিন আনলেই চলবে, সামান্য কাজ, সে নিজেই পারবে।

দেয়াল ফুটো করে রেইল লাগানো হয়ে যেতে আনিস কিছু সময় একটা অপরাধবোধে ভুগলো। সীমাকে কিছু বললো না, তবে ভেতরে  ভেতরে অপরাধবোধটা বেশ খোঁচালো। রমযানের ঘরগেরস্তিকে সীমার নজর থেকে আড়াল করতে রমযানেরই দেওয়া ড্রিল দিয়ে কাজ সারতে হলো! মেশিন ফেরত দেওয়ার সময় অপরাধবোধের খেসারত হিসেবে রমযানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কিছু টাকা জোর করে গছাতে পেরে সে এক ধরনের স্বস্তি পেল।

যার জন্য এতোকিছু সেই সীমা কিন্তু দিনে একবার-দুবার কসরত করে হলেও পর্দা ফাঁক করে ওপাশে চোখ রাখে। লতাপাতার ঘেরাটোপে খোড়লের আদি চেহারাটা চাপা পড়ে গেছে। রমযানের বউকে বড় একটা নজরে পড়ে না। কদাচিৎ এক-আধ ঝলকের জন্য পড়লেও কুলায় চাল নিয়ে বা শাক কোটা-বাছায় মশগুল অবস্থায় পাওয়া যায় না। সীমা ভাবে, লতাপাতার ঠাসাঠাসি আড়ালই কারণ। মেয়েটা হয়তো ঘরকন্নায় আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী।

দেখা মেলে না বলেই হয়তো দিনে বেশ কয়েকবার সীমা ঠেলেঠুলে কম্বলভারী পর্দাটা সরায়। কোনো দিন জানালা ফাঁকাই রেখে দেয়। হঠাৎ চোখ গেলে সবুজে মোড়ানো দরজা-জানালাহীন, দেয়ালহীন আস্তানাটাকে শূন্যে ভাসমান দ্বীপ বলে ঠাহর হয়। গাঢ় টাটকা সবুজের সমারোহ বাইরের আলো-রোদের বিপরীতে চোখে আরাম। সীমা চক্ষুশূলের কথা ভুলে যায়।

জালিকুমড়া নিয়ে সত্যি সত্যি রমযান একদিন দরজায় দাঁড়ালো। আকারে ছোট, কদবেলের চেয়ে সামান্য বড় বেশ কয়েকটা গামছায় বেঁধে সেই প্রথমবার যেমন লাউডগা নিয়ে হাজির হয়েছিল, তেমনি লাজুক হেসে জানালো, বড় হবে ভেবেছিল, হলো না। তবে কচি আর একদম টাটকা বলে খেতে স্বাদ। সীমা না আবার প্রথমবারের মতো দাম সাধতে যায় এই ভয়ে আগেরবারের মতো নিজেকে জিব কাটার সুযোগ না দিয়ে কথাগুলো বলেই সে ছুটে পালালো।

যে-অনিশ্চয়তা বা নিরাপত্তাহীনতা সীমাকে অনেকটা অকারণেই খোঁচাচ্ছিল তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে এক সকালে, আনিস তখন হাসপাতাল ডিউটিতে, ভারী পর্দামোড়া জানালাটাকে সে পুরোপুরি আড়াল-আবরুহীন করে ফেলে। আনিস ফিরতে জানায়, এই ভালো, আলো-হাওয়া আর এতো সবুজ। নাকে টেনে সবুজের গন্ধও বুঝি সে শোঁকে।

ক্লিনিকে ভর্তির দিন দ্রুত ঘনায়। মোর দ্যান সিক্সটির নিজস্ব ক্লিনিক। ভারী শরীরে সীমা এঘর-ওঘর করে। এটুকুতেই হাঁসফাঁস ধরে। জানালার ওপারে লতাপাতার ফাঁকফোকরে রমযানমিস্ত্রির বউয়ের ছায়া-কায়া কিছু নেই।

এ-সময় হঠাৎই একদিন ভোর-ভোর কংকালবাড়ি ঘিরে নানা তোড়জোড়। ট্রাকের গোঁ-গোঁ শব্দ, শ্রমিকদের হল্লাগোল্লা, ডালাখোলা ট্রাক থেকে ভারী সরঞ্জাম নামানোর আওয়াজ। কৌতূহল নিয়ে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে সীমার চোখে পড়ে আগুপিছু দুটো ট্রাকে মিক্সচার মেশিন, সত্মূপাকার সিমেন্টের বস্তা, বান্ডিল করে বাঁধা সরু-মোটা সুরমাই রড, আরো কত কী! ফেলে রাখা বাড়ির কাজ তবে এতো দিনে ফের চালু হবে।

তাকিয়ে থেকে তার অস্থিরতা জাগে। পায়ে পায়ে শোবারঘরে ফিরে টের পায় অস্থিরতাটা বাড়ছে। জানালার ওপাশে শিশিরভেজা সবুজে সদ্যফোটা লালচে আলো।

দিন গড়াতে আরো হুলস্থুল। এতো দিনের অসমাপ্ত কাজ বুঝি এক দিনেই সেরে ফেলা হবে। হল্লাগোল্লা ঠেকাতে এবার শুধু পর্দাই না, জানালা আটকানো ছাড়া পথ থাকে না।

রমযান আসে এক সন্ধ্যায়। মাথায় চেপে বসানো গোল টুপি, গাল-থুতনি ঘেরা বড় বড় দাড়িতে চেহারা বদলে গেলেও হাসি দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না। তেমনি লাজুক। টুপি-দাড়িতে তাকে বেঁটে দেখায়। আগের দুবারের মতো হাতে কিছু নেই বলে খালি হাতদুটো কী করবে, এ নিয়ে যেন অস্বস্তিতে। পুরনো সুতিকাপড় যদি থাকে, ছেঁড়া শাড়ি-টাড়ি হলেও চলবে – কাঁচুমাচু মুখে বলে রমযান। সীমা শাড়িই দেয়, পুরনো, তবে ছেঁড়া-টেড়া না। পুরনো শাড়ি দিয়ে কী করবে জিজ্ঞেস করতে মুখে আটকায়। অবশ্য সে-সুযোগ রমযান দেয় না। পুঁটলি পাকিয়ে সিঁড়ির পথ ধরে। সীমা ঠিক করে ফেলে রমযানের বউয়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি পাওনা থাকল।

ক্লিনিকে ভর্তির পালা। আনিস চায় শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় না থেকে সীমা আগেভাগেই একটা কেবিনে থিতু হোক। হালকা জামাকাপড়সহ নানা টুকিটাকি ব্যাগে ভরে কবে ফেরা হবে ঠিক নেই ভেবে সীমা আস্তে-ধীরে বন্ধ জানালাটা খোলে।

পর্দা ফাঁক করতেই অবিশ্বাস্য রমযানের বউ। পুঁই-লাউডগার ঝাড় উধাও। খোলা, আড়াল-আবডালহীন খোড়লের মুখে মেয়েটা। রোগাপটকা শরীরে রমযানের জালি না, পরিপক্ব চালকুমড়ার মতো ঠেলে বেরোনো ঢাউস পেট। দড়িতে ভেজা কাপড় মেলে দিচ্ছে, শরীরের উপরিভাগ ঢাকা পড়ায় দেখার মধ্যে শুধু উপচানো পেট। ধীরে ধীরে পা টেনে মেয়েটা ভেতরে আড়াল হয়েও হয় না। উঁচু পেটটা যেন সীমার মাথায় গচ্ছিত রেখে যায়।

 

ক্লিনিকের পরিপাটি বিছানায় পেটে খিঁচ ধরা যন্ত্রণায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে সীমা ভেবে পায় না, রমযানের বউয়ের উপচানো পেট মাথা থেকে কী করে তাড়ায়। মাথাজুড়ে বিকট, বিস্ফোরক পেট ফুলেফেঁপে মেয়েটার চোখ-মুখ ঢেকে দিচ্ছে, গিলেই ফেলবে বুঝি – যতক্ষণে না ফেটে চৌচির হচ্ছে। r