জি ম্বা বু য়ে তে ভ্র ম ণ প্লাজা হোটেলে প্রজনন পুতুল

মঈনুস সুলতান

হারারে নগরীর প্লাজা হোটেল স্থাপত্যের মাপকাঠিতে যতটা না আলিশান, তার চেয়েও বেশি প্রসিদ্ধ কলোনিয়াল যুগের রক্ষণশীল কেতা-কানুনের জন্য। আমি এর লবিতে বিপুল এক ফ্রেস্কোর নিচে দাঁড়িয়ে ‘সাডেক’ বা ‘স্যাদার্ন আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’র দুজন নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ি। জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের তামাদি হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। ইলেকশন কমিশন কোনো অজুহাত না দেখিয়ে ফল প্রকাশে টালটিমালটি করছে। শহরের এখানে-ওখানে সরকারি দল ‘জানুপিএফে’র উদ্যোগে বিরোধী দল ‘মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’র সদস্যদের উৎখাত করা হচ্ছে তাদের বনেদি বসতবাড়ি থেকে। একই সঙ্গে শহরতলিতে চলছে বেধড়ক ভায়োলেন্স। হারারে শহরের তাবৎ বাণিজ্যিক এলাকা ও আবাসিক অলিগলিতে বসেছে পুলিশ, মিলিটারি ও সরকারদলীয় মিলিশিয়াদের চেকপয়েন্ট। সে-তুলনায় প্লাজা হোটেলের বার্ড অব প্যারাডাইস নামক সোনালি পুষ্পে সজ্জিত ফোয়ারার ঝরঝর শব্দে মর্মরিত লবিকে দেখায় অভয়ারণ্যের মতো সুনসান নিরাপদ।
প্লাজা হোটেলের লবিতে আজ সোয়া দশটা নাগাদ দক্ষিণ আফ্রিকার এক নামজাদা লেখিকা হাইডি হলান্ডের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। হাইডি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বিস্তর বই-পুস্তক-প্রবন্ধাদি প্রকাশ করেছেন। তাঁর ডিনার উইথ রবার্ট মুগাবে বইটির বিশ্লেষণমুখী স্মৃতিচারণের জন্য বেজায় নামডাক আছে। ‘ডি-ই-ডি’ বলে একটি জার্মান উন্নয়ন সংস্থা আমাকে নিযুক্ত করেছে বর্তমান পরিস্থিতির ওপর কিছু তথ্য সংগ্রহ করে দিতে। এ বাবদ তারা আমার রাহা খরচ থেকে শুরু করে দরাজহস্তে সম্মানী পর্যন্ত দিচ্ছেন। আমি হালফিল অর্থকষ্টে আছি। সুতরাং খানিক রিস্ক নিয়ে এ-কাজে হাত লাগিয়েছি। হাইডি পেশায় ঠিক সাংবাদিক নন, তবে তিনিই একমাত্র ফ্রি-ল্যান্স রাইটার, যাকে জিম্বাবুয়ের ডিক্টেটর হিজ এক্সেলেন্সি রবার্ট মুগাবে মাসখানেক আগে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
প্লাজা হোটেলের লবির এক নির্জন কোণে স্তরে স্তরে সাজানো লাল হলুদ সবুজে ডোরাকাটা চিত্রাপাকরা হাতে গলায় অলংকার পরানো অনেকগুলো ‘ফার্টিলিটি ডল’ বা ‘প্রজনন পুতুল’। হোটেলের এক পরিচারিকা পালকের ঝাড়ন দিয়ে উর্বরতার প্রতীক পুতুলগুলোর ধুলা ঝাড়ে। ঝাড়পোছ করতে করতে সে একটি পুতুলকে কোলে তুলে আদর করে চুমো খায়। এ-পুতুল দ্বীপের আড়ালে দেখি হাইডি হলান্ড ল্যাপটপ কম্পিউটারে কিছু লিখছেন। আমি তাঁর মনযোগ ভাঙতে চাই না, তাই নীরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে প্রজনন পুতুলের সঙ্গে পরিচারিকার খুনসুটি দেখি। হাইডি অপেরা গ্লাস চোখে লাগিয়ে দূরের দেয়ালে ঝুলানো জিম্বাবুয়ের মস্ত একটি মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপে কিছু একটা লিখেন। পরিচারিকা একটি প্রজনন পুতুলকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে বোধ করি ঘুমপাড়ানি গায়। তার গানের শব্দে বিরক্ত হয়ে হাইডি ভ্রƒকুটি করে এদিকে তাকান। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি ‘গুড মর্নিং’ বলে তাঁকে সম্বোধন করি। তিনি ‘হ্যাভ অ্যা সিট’ বলে আবার কাজে ফিরে গিয়ে টাইপ করতে শুরু করেন।
হাইডির টেবিলে রাখা টমাস বোউয়েন বলে খ্যাতনামা এক মিশনারি পর্যটকের লেখা অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড মিশনারি লেবারস ইন সেভারেল কান্ট্রিস ইন দ্য ইনটেরিওর অব আফ্রিকা ফ্রম ১৮৪৯ টু ১৮৫৬ নামক একটি গ্রন্থ। ইতিপূর্বে আমি বইটির কথা শুনেছি, অন্য লেখকদের লেখায় এর উদ্ধৃতিও পড়েছি; কিন্তু এ-গ্রন্থ কখনো চাক্ষুষ করিনি। খানিক ইতিউতি ভেবে পুস্তকটি হাতে তুলে নিই। গ্রন্থের মলাট হলুদ হতে হতে পাপড়ের মতো মুড়মুড়ে হয়ে আছে। আমি পাতা উল্টে খানিক কষ্টে প্রকাশের তারিখ দেখি। ১৯১৩ সালে বইটি মুদ্রিত হয় লন্ডনের এক বনেদি প্রকাশনী সংস্থা থেকে। মনে মনে বইটি ধার চাওয়ার বাসনা হয়; কিন্তু হাইডি যেরকম ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে টাইপ করে চলেছেন, তাতে ঠিক হিম্মত পাই না। হাইডি ম্যাপের দিকে অপেরা গ্লাস দিয়ে চেয়ে চেয়ে কী তথ্য টুকছেন ঠিক বুঝতে পারি না, তাঁর ল্যাপটপের পাশে ছড়ানো বেশ কিছু কার্ড, তাতে জিম্বাবুয়ের নানা এলাকায় সাম্প্রতিক ভায়োলেন্সে খুন-জখমের বিবরণ আছে। কার্ডগুলোতে নিহতদের সংখ্যা লাল ও আহতদের সংখ্যা হলুদ রঙে হাইলাইট করা।
হাইডি কিছুক্ষণ কার্ডের লাল ও হলুদ সংখ্যাগুলো নিরিখ করে আমার দিকে তাকান। আমি হাসি, কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে বিখ্যাত এ নারী লেখক আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন দম ধরে। আমার মুখের ওপর থেকে তাঁর দৃষ্টি স্থানাস্তরিত হয় না মোটেই, মনে হয় তিনি যেন আমার বিষয়টা কী – কেন এসেছি – তা মাপজোখ করে দেখছেন। মহিলা বেজায় রকমের নীরব হয়ে আছেন বলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, তিনি কী ভাবছেন? অত্যন্ত সিনিয়র এ-লেখিকার মুখমণ্ডল অভিব্যক্তিহীন, তাতে কোথাও হাসি কিংবা বিষণœতার কোনো রেখা নেই, এজন্য সম্ভবত উত্তর ষাটের এ-মহিলা রাইটারকে দেখায় স্বাস্থ্যবতী প্রৌঢ়া নারীর মতো।
অবশেষে নীরবতা ভেঙে তিনি জানতে চান, ‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো?’ আমি জবাব দিই, ‘টেল মি সামথিং অ্যাবাউট রবার্ট মুগাবে, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট কি জানেন না তার দেশের মানুষের বর্তমান হাল-হকিকত, তাদের দুর্দশা ও জীবন-যাপনের গর্দিস?’ হাইডি অপেরা গ্লাস টেবিলে রেখে খানিকক্ষণ কিছু ভেবে বলেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু আন্ডারস্ট্যান্ড রবার্ট মুগাবে – ইউ হ্যাভ টু ফ্যাক্টর ইন দিস ইনফরমেশন। দুটো বিষয় বিবেচনায় না আনলে তুমি রবার্ট মুগাবেকে ঠিক বুঝতে পারবে না। শৈশবে মুগাবে ছিলেন অত্যন্ত পড়–য়া, বলা চলে গ্রন্থকীট। তিনি বড় হন বন্ধুবান্ধব ছাড়া একাকী। হি ওয়াজ লোনলি, অলথ্রো লোনলি। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য একসময় তিনি জোরে জোরে আফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতা আবৃত্তি করে নিজেকে সমঝদার শ্রোতা ভেবে আনন্দ পেতেন। নো, আই ডোন্ট থিং হি নোজ হাউ পিপল আর সাফারিং। আমার ধারণা তিনি ঠিক জানেন না, জিম্বাবুয়ের মানুষ কিরকম কষ্ট পাচ্ছে।’ হাইডি আরো জানান, ‘আমার সঙ্গে রবার্ট মুগাবের প্রথম দেখা হয় ১৯৭৫ সালে। সাউথ আফ্রিকার ‘অ্যাপারটাইট’ বা বর্ণবিভাজন প্রথার বিরোধিতার কারণে আমি তখন মোজাম্বিকে নির্বাসিত জীবনযাপন করছি। মুগাবে সীমান্ত অতিক্রম করে – আমি চিমোয়েও বলে যে-শহরে বাস করছি, তার পাশেই পাহাড়ে রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ অরগানাইজ করছিলেন। তিনি আমার বাসায় একবার আসেন সামাজিকভাবে ভোজসভার ছদ্ম আবরণে একজন শাসনতান্ত্রিক আইনজীবীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে।’ আমি জানতে চাই, ‘মাসকয়েক আগে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাদের মধ্যে কী ধরনের কথাবার্তা হয়েছে।’ হাইডি খানিক হতাশ স্বরে জানান, ‘হি ওয়াজ টোটালি রিমোট ফ্রম দ্য রিয়ালিটি, এ মুহূর্তে বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই নেই। তাঁর কোনো ধারণাই নেই, মুদ্রাস্ফীতির কারণে জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতি কতটা খতরনাক। আমাদের আলাপচারিতার সময় মুগাবে বারবার রোডেশিয়ার শেষ ব্রিটিশ গভর্নরের বিধবা পতœী লেডি মেরি সামেসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। তাঁর ধারণা লেডি সামেস বিলাতের রয়েল ফ্যামিলির কাছে অনেকদিন ধরে কান-ভাঙানি দিয়ে আসছেন, এতে ক্রমশ পাশ্চাত্যের সঙ্গে মুগাবের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তিনি বারবার বিলাতের রয়েল ফ্যামিলির সঙ্গে তাঁর যে কোর্ডিয়েল সম্পর্ক ছিল তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য আফসোস করেন।’
প্র্রজনন পুতুলের সারির ফাঁকে আমি সহসা টোপে আবেলোভির প্রসাধন-চর্চিত মুখ দেখতে পাই। আমার সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হয়। আমি আলোচনার ইতি টানার জন্য সাদাসাপটা প্রশ্নের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাইডিকে জিজ্ঞেস করি, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক অ্যাবাউট রিসেন্ট ইলেকশন রেজাল্ট? সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে আপনার মতামত কী?’ হাইডি ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘রেজাল্ট জানার জন্য তোমার পরিসংখ্যানবিদ বা গবেষক হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মুগাবের ক্লিয়ারলি হার হয়েছে; তবে জানুপিএফ পার্টির পলিসি মেকার সব কর্তাব্যক্তি সংবাদটি তাঁকে খোলাসা করে বলেছে কিনা বলা মুশকিল। তুমি নিশ্চয়ই গ্রেইস মুগাবের কথা শুনেছ? মুগাবের প্রথম পতœীর মৃত্যু হলে তাঁর থেকে অন্তত তিরিশ বছরের জুনিয়র প্রসিডেন্ট হাউসের যে সুদর্শনা স্টাফকে মুগাবে বিয়ে করেছেন – এ-মহিলা গতকাল মুতারে এলাকায় ভাষণ দিয়েছেন। দেশের ওয়ার-ভেটারান বা শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে অশীতিপর প্রেসিডেন্টের প্রণয়িণী জাঁক করে বলেছেন, ‘মুগাবে বিপ্লব করে দেশকে রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ শাসন থেকে মুক্ত করেছেন, তাঁর কাছে জাতির ঋণ অশেষ, শুধু ব্যালট ব্যবহার করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যাবে না। ইলেকশনে মুগাবের হার হলেও আমি বিরোধী দলের সাম্রাজ্যবাদী চেলাদের হাতে গভর্নমেন্ট হাউজের চাবি হস্তান্তর করব না!’
‘ডু ইউ নিড টু নো মোর, তোমার আরো জানার দরকার আছে ড. সুলতান?’ আমি মাথা ঝাঁকাই। হাইডি এবার বিদ্রƒপের স্বরে বলেন, ‘ইউ ড্রেসড আপ ভেরি নাইসলি টুডে… হোয়াট ইজ গোয়িং অন? এত চমৎকারভাবে পোশাক-আশাক পরে আছ কেন, আজকে ব্যাপার কী?’ আমার আজ জনা-দুই ডিগনিটরির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি বার্গেন্ডি রঙের শার্টের সঙ্গে ধবধবে সাদা কোরিয়ান সিল্কের জ্যাকেট পরে আছি। আমি চাই না আমাকে দেখে কোনো চেকপয়েন্টের পুলিশ অফিসারের ধারণা হোক, আমি সাংবাদিকতা কিংবা তথ্য বিষয়ক রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত আছি। বিষয়টি হাইডিকে বলতেই তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে মন্তব্য করেন, ‘ইউ ল্কু গুড, বাট ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাউ ডেঞ্জারাস ইট মাইট বি ইফ ইউ আর কট কালেকটিং ইনফরমেশন! তোমাকে সুদর্শন দেখাচ্ছে বটে; কিন্তু এই যে তথ্য সংগ্রহ করছ, তোমার কোনো ধারণাই নেই, ধরা পড়লে বিষয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে!’ আমি আফ্রিকা ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে আমাকে দেওয়া ভিজিটিং স্কলার হিসেবে একটি আমন্ত্রণপত্রের উল্লেখ করি। হাইডি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘লিসেন ড. সুলতান, আই সেইড Ñ দিস ইজ প্লেইন ডেঞ্জারাস… জাস্ট গেট দ্য হেল আউট অব হিয়ার, আই মিন জিম্বাবুয়ে। এ-কাজ খুবই বিপজ্জনক, ঝামেলায় জড়ানোর আগে যত তাড়াতাড়ি পারো স্রেফ বেরিয়ে যাও জিম্বাবুয়ে থেকে।’
হাত ঝাঁকাঝাঁকি করে খানিক বিরসবদনে হাইডি হলান্ডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি টোপে আবেলোভির সন্ধানে লবির এদিক-ওদিক হাঁটি। টোপে হারারেতে নিযুক্ত নাইজেরিয়ান অ্যাম্বাসাডরের কন্যা। এ-তরুণীর পানাসক্তি ও ড্রাগসে মাতোয়ারা হওয়ার প্রবণতা হারারের বোদ্ধা মহলে আলোচনার মুখরোচক বিষয়। আজ সে আমাকে ডিপ্লোম্যাটিক কোরের  প্লেট-লাগানো গাড়িতে করে হারারের নানা জায়গায় কয়েকটি অ্যাপয়েন্টমেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছে। যদিও এ-সাহায্যের পেছনে হার্ড কারেন্সিতে লেনদেনের ব্যাপার আছে, তারপরও কূটনৈতিক মর্যাদার গাড়িতে করে লিফট দেওয়ায় যে নিরাপত্তার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমি মেয়েটির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করি। বেশ  খোঁজাখুঁজির পর টোপেকে পাওয়া যায় প্লাজা হোটেলের পানশালায়। সে একটি উঁচু বার-টুলে বসে স্মোক করতে করতে পা দোলাচ্ছে। আজ তার ঠোঁটের রঙে হালকা ধূসরে বেগুনির প্রলেপ। চোখের নিচেও ল্যাভেন্ডার বর্ণের গাঢ় শেড লেপা। টোপে আমাকে ‘হাই দেয়ার’ বলে গ্রিট করে। ঠিক তখনই ওয়েট্রেস তার সামনের বার কাউন্টারে ঠক করে রাখে রুপালি তরলে টলটলে বরফভাসা পানপাত্র। টোপে মৃদু হেসে বলে, ‘আই হ্যাভ অ্যা ট্যারিবল হ্যাংগওভার, সো… জাস্ট হেভিং এন আই ওপেনার, উড ইউ লাইক টু জয়েন মি ফর অ্যা ড্রিংক? হ্যাংগওভারের জন্য চোখ একেবারেই খুলতে পারছি না, তাই একটু খাচ্ছি, আমার সঙ্গে যোগ দেবে তুমি?’ আমি পানে অসম্মতি জানাই। মেয়েটির সম্ভ^বত মাথা ভারী হয়ে আছে, তাই চোখ খোলা রাখার জন্য সে খানিক পান করবে তাতে আমি আপত্তির কিছু দেখি না। কিন্তু সে আমাকে নিয়ে ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়াবে Ñ বিষয়টি দ্রুত ক্যালকুলেট করে বলি, ‘হাউ অ্যাবাউট অ্যা গুড ব্রেকফাস্ট?’ টোপে আদুরে মেয়ের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে সায় দেয়। তার প্রিয় ব্রেকফাস্ট হচ্ছে স্ক্রেম্বল এগসের সঙ্গে ক্রিস্প করে ভাজা কুড়মুড়ে বেকন। জিম্বাবুয়ের সর্বত্র আজকাল খাবার-দাবারের আক্রা যাচ্ছে। সবচেয়ে দামি পঞ্চতারকা হোটেলেও পাওয়া যাচ্ছে না বেকন-এগডস নামের আদনা খাদ্যদ্রব্য। টোপে অবশেষে চিজ দেওয়া কেঁয়াসো খেতে রাজি হলে আমি বিল পরিশোধের কথা বলে তার কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে খানিক একাকী আগামী অ্যাপয়েন্টমেন্টের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য লবির অন্যদিকে চলে আসি।
লবির একটি ছোট্ট দোকান থেকে প্রবাল রঙের আধফোঁটা গোলাপ কিনে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তা বাটনহোলে গুঁজি। খানিক দোনামোনা করে অবশেষে ব্রিফকেস থেকে বের করি টারকুইজের নীল পাথর-বসানো রেড ইন্ডিয়ান কেতার বলো-টাই। তা গলায় বাঁধতেই নিজেকে মারওয়ারি মিলিওনিয়ার পিতার বখাটে পুত্রের মতো দেখায়। নিজের সাজগোঁজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে লবিতে বেরিয়ে আসি। আমার পরবর্তী অ্যাপয়েন্টমেন্ট জার্মানির রাষ্ট্রদূত হের ইয়োরগান বোমগার্ডনারের সঙ্গে। এ মুহূর্তে আমার প্রয়োজন খানিকটা মনঃসংযোগের। হের বোমগার্ডনারকে সাক্ষাৎকারের সময় কী প্রশ্ন করব তা একটু ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। অ্যাপয়েন্টমেন্টের আরো মিনিট চল্লিশেক বাকি আছে, সুতরাং টোপের কাছে ফিরে গিয়ে তার প্রভাতী পানের দর্শক হয়ে খেজুরে গল্পে জড়াতে চাই না। আমি খানিক হাঁটাহাঁটি করে লবির এক নিরিবিলি প্রান্তে বার্ড টার্মিনালের পাশে একটি বেঞ্চে বসি। টার্মিনালের জালিতার-ঘেরা এক চিলতে চত্বরে ডালপালায় বিস্তৃত একটি আস্ত গাছ। তার ডালে ডালে ঝুলছে ডজন দুই জেব্রা-ফিঞ্চ বলে ছোট ক্বদের চটপটে পাখি। গাছের তলায় পার্টিতে আসা রংচঙে স্কার্ট-ব্লাউজ পরা যমজ কিশোরীদের মতো গটগট করে ঘুরে বেড়ায় লাল সবুজ ও হলুদে মিশ্রিত পালক ফুলানো দুটি ফেজেন্ট পাখি। আমার ঠিক পাশেই পেতলের দাঁড়ে বসা মস্ত একটি ম্যাকাও পাখি। আমাজান অঞ্চলের অসম্ভ^ব উজ্জ্বল এ-খেচরটি কী কারণে জানি জীবনের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে চোখ মুদে ঝিমায়। আমি নোটবুক খুলে রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করার জন্য সম্ভাব্য প্রশ্নের তালিকা তৈরি করি। কিন্তু কাজে মনযোগ আসে না। টোপে কি আরেক গ্লাস পানীয় সেবন করছে? বেশি খেলে ড্রাইভ করবে কীভাবে? রোদেলা দিনে হালকা চালে উড়ে যাওয়া চিলের ছায়ার মতো তার অবয়ব মনের অলি-গলিতে কেন জানি ঘুরে বেড়ায়।
টোপের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় মাসকয়েক আগে হারারের ক্রেস্টা-লজ বলে একটি পর্যটক-উপদ্রুত গেস্ট হাউজে। জিম্বাবুয়েতে তখন ভোগ্যপণ্য সংকটের তীব্রতা বানের জলের মতো ফুঁসে উঠছে। আদনা সব জিনিসপত্র তথা সেভিং ক্রিম, বলপয়েন্ট কলম, পেপার ন্যাপকিন সমস্ত কিছুই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। কোথাও চা কিংবা কফি পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেস্টা লজের আয়ান ফ্লেমিং বলে একটি পানশালায় তখন উচ্চমূল্যে বিক্রি হতে শুরু হলো টিপটে করে পাশে তশতরিতে বিস্কিট সাজিয়ে শ্রীলংকার ডালমিয়া ব্র্যান্ডের টি। আমার মতো যাদের বিকেল বেলা এক পেয়ালা চা না পেলেই চলে না, তখন আয়ান ফ্লেমিং বারে অপরাহ্ণের শেষ আলোয় তাদের জড়ো হতে দেখা যেত। এরকম এক বিকেলের কথা Ñ চিত্রিত টিপট থেকে শুধু পেয়ালায় চা ঢালছি, বারের মিউজিক সিস্টেমে জিম্বাবুয়ের নামজাদা গায়ক অলিভার মুটুকুদজির রাখালিয়া কণ্ঠে বাজছে ‘…চেমবেরা… চিবা মুচামবেরা…চি চি চেমবেরা…’। দেখি বারের একপ্রান্তে যেখানে জেমস বন্ডের কাল্পনিক প্রস্তরমূর্তি অবহেলায় রাখা, তার আবডালে হালকা চালে একাকী নাচছে একটি মেয়ে। যুবতীটি পরে আছে হালকা সোনালি প্রিন্টের কাঁধ খোলা ব্লাউজ। তার কোমর জড়িয়ে একই বর্ণের আটোসাটো র‌্যাপ। তার ব্লাউজের ফ্রিল দেওয়া ঢোলা স্লিভ বাহুমূলে পাখনার মতো আটকে আছে। মেয়েটি তার নিরাভরণ বাহু প্রসারিত করে যেন মুটুকুদজির মরমি সুরকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে, তাতে বাহুর আন্দোলনে তৈরি হচ্ছে প্রজাপতির পাখনার মতো সোনালি দ্যোতনা।
মিউজিক শেষ হতেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলি, ‘ক্যান আই অফার ইউ অ্যা কমপ্লিমেন্ট?’ মেয়েটি আদুরে ভঙ্গিতে ঘাড় হেলিয়ে হাসে। আমি বলি, ‘ইউ লুক লাইক অ্যা মনার্ক বাটারফ্লাই ইন দিস গোল্ডেন এথনিক ড্রেস। আদিবাসীদের এ সোনালি পোশাকে তোমাকে মনার্ক প্রজাপতির মতো দেখাচ্ছে।’ সে মৃদু হেসে বলে, ‘দিস ইজ ইনডিড অ্যা সুইট কমপ্লিমেন্ট, ওয়েল, আই অ্যাম টোপে আভেলোবি। আই অ্যাম ফ্রম নাইজেরিয়া, হোয়াট আই অ্যাম ওয়ারিং ইজ কলড ইবি। তোমার প্রশংসা খুবই সুইট, নাইজেরিয়ার যে পোশাক আমি পরে আছি তার নাম হচ্ছে ইবি।’ বলেই সে আমার চায়ের পেয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হোয়াট রাবিশ আর ইউ ড্রিংকিং, ইটস টি, ইয়াক! ইউ আর স্পয়েলিং দ্য বিউটিফুল আফটারনুন। জঘন্য চা খেয়ে তুমি চমৎকার বিকেলটা নষ্ট করছ।’ খানিক জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে বলতে তার শরীর যেন সাঁই করে পাক খেয়ে ওঠে। সে জেমস বন্ডের মূর্তির মস্তক ধরে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে লাজুক ভঙ্গিতে হাসে। আমি জানি যে, ক্রেস্টা লজে এ দুর্মূল্যের বাজারেও হালফিল বিস্তর ড্রাগস পাওয়া যাচ্ছে। আন্দাজ করতে চেষ্টা করি, টোপে কি এমফিটামিন নিয়েছে, নাকি তার রক্তে ক্রিয়াশীল হয়েছে ক্রিস্টল মিথ? সে টলোমলো পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি, ‘আই উড নট মাইন্ড অফারিং ইউ অ্যা প্রপার সান ডাউনার ডিংকস। সূর্যাসে—র পানীয় অফার করতে আমার ভালোই লাগবে।’ সে খুব আহ্লাদি ভঙ্গিতে কব্জিতে বাঁধা শৌখিন ঘড়ি দেখে বলে, ‘ও হেল, আই হ্যাভ টু ওয়েট এনাদার ফোরটি মিনিটস ফর দ্য সান টু গো ডাউন। হোয়াট অ্যাম আই গোনা ডু ফর অল দিস টাইম? আমাকে সূর্য ডোবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো চল্লিশ মিনিট। এতক্ষণ বসে বসে আমি কী করব?’ আমি তাকে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার জীবনের কথা বলতে অনুরোধ করি। প্রলোভন হিসেবে যোগ করি, ‘আই অ্যাম গোনা বাই ইউ অ্যা সিঙ্গেল মল্ট স্কচ ইফ ইউ টেল মি অল অ্যাবাইট ইউ। তোমার সম্পর্কে সব কিছু বললে অবশ্যই সিঙ্গেল মল্ট স্কচ অফার করব।’
নাইজেরিয়ান রাষ্ট্রদূতের এ আহ্লাদি গোছের কন্যার শৈশব কাটে অগবমসো বলে একটি এলাকায়, যেখানে মূলত বসবাস ইউরোবা গোত্রের। সে দিদিমার কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে তার গাঁয়ের নাম ওকোররির সঙ্গে তরোমরি, গুলহরি ইত্যাদি আবজাব শব্দের অন্ত্যমিল দিয়ে ছড়া কাটে। বাতচিত ঈষৎ বেপথে যাচ্ছে দেখে আমি তাকে ইউরোবা ভাষা শেখানোর অনুরোধ করি। সে ফরফর করে বলে যায়, ‘ইকারো-গুডমর্নিং, ইকাবো Ñ ওয়েলকাম, আডুপে Ñ থ্যাংক ইউ।’ আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোবা শব্দগুলো জপি। সে খিলখিল হেসে বলে, ‘তোমার উচ্চারণ শুনে মনে হয়, তুমি যেন ভার্জিন মেয়ের নাভিমূলে জিব দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছ।’ আমি তার উপমায় বিব্রত না হয়ে রাজসড়কে কুড়িয়ে পাওয়া ভাংতি পয়সার মতো ইউরোবা লবজগুলো নোটবুকে টুকে নিই। অতঃপর টোপেকে তার গ্রাম ওকোররিতে তার শৈশবের গল্প করতে বললে সে দুহাতের আঙুল দিয়ে বৃহৎ দুটি ফড়িঙের উড্ডয়নের রেখা তৈরি করে বলে, ‘বিফোর আই টেল ইউ এনি ডার্ন থিং অ্যাবাউট মাই চাইল্ডহুড, ইউ মাস্ট কিপ ইয়োর প্রমিজ। আমার শিশুকাল সম্পর্কে জানার আগে তুমি যে-কথা দিয়েছ তা কিন্তু রাখতে হবে।’ আয়ান ফ্লেমিং বারের কাচের জানালায় ঝলসে যাচ্ছে বেলা শেষের অস্তরাগ। আমি অত্যন্ত খোশমেজাজে তার জন্য এক পেগ সিঙ্গেল মল্ট স্কচের অর্ডার করি।
টোপে অত্যন্ত সুচারু ভঙ্গিতে লিপস্টিকের প্রলেপ বাঁচিয়ে পান করতে করতে বজ্রবিদ্যুতের দেবতা ‘সাঙ্গো’কে তুষ্ট করার গল্প বলে। বেলা শেষে তীব্র ড্রামবিটের সঙ্গে বৃষ্টি প্রার্থনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে একাধিক আঙুুল দিয়ে শূন্যতায় গাঁয়ে জলপূজার দৃশ্যপট আঁকে। তার বাহুর দোলনে মনে হয় মোনার্ক নামের এক পরিযায়ী প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে ইথিওপি নামের আঁকাবাঁকা নদীর কূলে কূলে যার জল কাচের মতো স্বচ্ছ। আমি যেন দেখতে পাই Ñ বালুচরের দীঘল সবুজ ঘাস লিলুয়া বাতাসে নেচে যাচ্ছে নৃত্যপ্রবণ ইউরোবা নারীদের মতো। তার তীরে এসে দাঁড়ায় সারা শরীরে ধবধবে সাদা খড়িমাটি মেখে একদঙ্গল কুমারী নারী। তারা মাথায় করে বয়ে এনেছে শ্বেতশুভ্র তৈজস যা পরিপূর্ণ মুনবিড, কড়ি ও কোলানাটে। যুবতীরা ‘মামিওটা’ বা জলদেবীর পূজার উদ্যোগ নিলে ঘাসের আড়াল থেকে সহসা বেরিয়ে আসে জনাকয়েক পৌরুষদীপ্ত সব ‘ইগুনগুন’। তারা সবাই নদীতীরে এসেছে মুখোশ পরে। তাদের হাতে বিচিত্র কাঠের কাঠামোতে লাল ও সাদা রঙে উজ্জ্বল করে আঁকা জন্তুর মুখ। ইগুনগুনরা মুখোশ নৃত্যের সঙ্গে সনাতনী সব কিসসা বলতে শুরু করলে তাদের পেশিবহুল কাঁধে কাঁপে পয়মন্ত পশুর দীর্ঘ সোনালি কেশর।
প্লাজা হোটেলের পানশালার পাট চুকিয়ে টোপে উঠে পড়েছে। পরবর্তী অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে এলো বলে আমি দ্রুত ওয়ালেট থেকে কখানা পাঁচ ও দশ ডলারের খুচরা নোট বের করে জ্যাকেটের পকেটে রাখি। খুব হালকা চালে এদিকে হেঁটে আসছে টোপে। ডলারের বিলগুলো হাতের কাছে থাকায় চেকপয়েন্টের ধড়পাকড় মোকাবেলায় খানিক হিম্মত পাই। টোপের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে চোখ আপনা-আপনি চলে যায় তার দোদুল্যমান হিপে, যেখানে প্রশস্ত বেল্টে গাঁথা উজ্জ্বল বর্ণের চাকতি চাকতি সব আয়না। যেতে যেতে আমি আয়নার মসৃণ অবয়বে বার্ড টার্মিনালের ভগ্নাংশের প্রতিফলন দেখি। অতিদ্রুত একটি পাখির উড্ডয়ন রেখা অপসৃত হতেই ঝিক করে ভেসে ওঠে প্রজনন পুতুলের শান্ত মুখশ্রী।
পার্কিংলটে যে কালো সেলুন কারটি দাঁড়িয়ে আছে তাতে পতাকা নেই বটে, তবে ডিপ্লোম্যাটিক কোরের প্লেট ও টিনশেড গ্লাসের জন্য তাতে বসে হঠাৎ করে হাতে পাওয়া সঠিক ছাড়পত্রের মতো এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ করি। টোপে ভারী গাড়িখানা দক্ষ হাতে চালায়। ধড়পাকড়, ভায়োলেন্স ও পেট্রোলের আক্রার জন্য রাজ সড়কে ট্রাফিক একেবারেই নেই। তবে প্রশস্ত এভিনিউতে প্রিজনভ্যান থামিয়ে হাঁটাচলা করছে বেশ ক’জন রায়ট পুলিশ। পাশের দেয়ালগুলোতে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে ও তার তরুণী ভার্যা গ্রেইস মুগাবের রংচঙে পোশাকপরা অনেকগুলো পোস্টার সাঁটা। সে অত্যন্ত কনফিডেন্সের সঙ্গে চেকপয়েন্টগুলো নেভিগেট করে জার্মান রাষ্টদূতের ম্যানসনের লাগোয়া একটি দৃষ্টিনন্দন চার্চের আঙিনায় গাড়ি পার্ক করে। না, টোপে আমার সঙ্গে হের ইওরগান বোমগার্ডনারের ভিলা অবধি যেতে চায় না। তার স্তনসন্ধির কাছে ঝুলন্ত ক্রুশের প্রতীক দেখিয়ে বলে যে, সে খানিকটা চার্চের নিরিবিলিতে যিশুখ্রিষ্টের সান্নিধ্য চায়। তার সহসা আরাধনার বাসনা হয়েছে দেখে আমি খানিক তাজ্জব হই; কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার তো উপায় নেই। তাই তাকে সাময়িকভাবে গুডবাই বলে পয়দলে দূত ম্যানসনের দিকে আগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে সে সিগ্ধভাবে ঘাড় কাত করে পোলাইট স্বরে বলে, ‘মে উই টেক কেয়ার অব দ্য বিজনেস নাও?’ আমি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার সার্ভিসের মূল্য বাবদ ডলারের হার্ড কারেন্সিতে পূর্ণ এনভেলাপটি তাকে দিই। সে বিড়বিড় করে ইউরোবা ভাষায় ‘আডুপে’ বা থ্যাংক ইউ বলে খানিক সংলগ্ন হয়ে আমার গলায় ঝুলানো বলো-টাইয়ের টারকুইজ পাথর এডজাস্ট করে দেয়। ঠিক তখনই সাত-পাঁচ ভেবে তার হাতে ককো-পয়জন বলে জিম্বাবুয়েতে অধুনাদুর্লভ পারফিউমের শিশির সঙ্গে আটকানো মিনিয়েচার থ্যাংকিউ কার্ডটি ধরিয়ে দিয়ে বলি, ‘পারহেপ্স ইউ উইল টেল মি অ্যা লিটল মোর অ্যাবাউট ইয়োর সেল্ফ টুডে। তোমার সম্পর্কে আরেকটু বললে কিন্তু খুব ভালো হয়।’  সে ঠোঁট বৃত্তাকার করে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘হেল নো, অ্যাবসলিউটলি নাথিং অ্যাবাউট মাইসেল্ফ টুডে। একবারেই না, আমার সম্পর্কে কিছুই আর বলা যাবে না।’ টোপে চার্চে ঢুকে গেলে আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। ঠিক বুঝতে পারি না, হঠাৎ করে তার ডলারের জরুরত পড়ল কেন?  রাষ্ট্রদূতের ম্যানসনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ভর দুপুর বেলা জনবিরল চার্চে বেচাকেনা বা আবগারি দ্রব্যের লেনদেনের কোনো ব্যাপার আছে কি?
রাষ্ট্রদূতের ম্যানসনের চালের সঙ্গে লাগানো ক্লক টাওয়ার। তাতে অকেজো একটি ঘড়ি সূর্যালোকে রুপার থালার মতো ঝকঝক করে। ম্যানসনটি দেখতে অনেকটা ছোটখাটো জাদুঘরের মতো। গেটের দুপাশে পাইক পেয়াদা বরকন্দাজদের মতো সটান দাঁড়িয়ে আছে গোটা পাঁচেক দীর্ঘ পামগাছ। আঙিনা থেকে গাড়িবারান্দা অবধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা রকমারি সব পাথরের ভাষ্কর্য। ডোরম্যান আমাকে সরাসরি নিয়ে আসে উনার কোর্টইয়ার্ডে। এখানে  মস্ত সব শেডট্রির পত্রছায়ায় বিশাল সবুজ লন। হের বমগার্ডনার টেনিসসু পরে লনমোয়ার চালিয়ে ঘাস কাটছেন। আমাকে দেখেই ঘাসকাটার যন্ত্রটি অফ্ করে হাসি মুখে তাকান। এ কূটনৈতিক কর্মকর্তা আমার ঠিক অপরিচিত নন, কিন্তু ইতিপূর্বে তাকে পার্টি পরব ককটেলে স্যুট-মুট পরা হালতে দেখেছি। আজ তিনি অত্যন্ত ক্যাজুয়েলি আধময়লা এক গল্ফ শার্ট পরে আছেন। পেশার উপযুক্ত ধড়াচূড়া না থাকার ফলে হের বমগার্ডনারকে বীমা কোম্পানির ব্যর্থ দালালের মতো দেখায়। রাষ্ট্রদূত কথা বলার মানুষ পেয়ে খুশি হন। সপ্তাহখানেক হলো মুগাবে সরকার পাশ্চাত্যের দূতাবাসগুলোকে শুধু জরুরি কাজ ছাড়া বাদবাকি সব তৎপরতা সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করতে অনুরোধ করছেন, সে থেকে হের বোমগার্ডনার বাড়িতে বসেই সময় কাটাচ্ছেন। আমাকে তিনি লনের একপ্রান্তে শনের ছাউনি দেওয়া কাঠের সামার কটেজে কফি পানের আমন্ত্রণ জানান।
তার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে সিমেন্টে বাঁধানো চৌবাচ্চার পাশাপাশি আসতেই আমি সহসা আঁতকে উঠি। আমার ঠিক সামনেই ঘাস মাড়িয়ে সড়সড় করে বুকে হেঁটে যাচ্ছে আস্ত এক কুমির। আমার আতঙ্ক দেখে হের বোমগার্ডনার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘দিস ইজ জাস্ট অ্যা লিটল ক্রোকোডাইল, হার নেম ইজ ফ্রাউলাইন অনিটা, সি ইজ স্টিল ভার্জিন। ছোট্ট এ কুমিরটি এখনও কুমারী। তার নাম অনিটা।’ কুমিরের কুমারীত্ব নিয়ে আমার কিন্তু মাথাব্যথা কিছু নেই, তবে তার দাঁতের ব্যবহার নিয়ে আছে তীব্র আতঙ্ক। হের বোমগার্ডনার আরো বলেন, ‘ফ্রাউলাইন অনিটাকে আমরা শিশু বয়স থেকে  কোলেপিঠে করে মানুষ করছি।’ কী মুশকিল, কুমিরের বাচ্চা লালন-পালন করলে তা কি কখনো মানুষ হয়ে ওঠে! আমি রাষ্ট্রদূতের আশ্বাসে সন্তুষ্ট না হয়ে চটজলদি লম্ফ দিয়ে সামার কটেজের বারান্দায় উঠি।
হের বোমগার্ডনার পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে বলেন, ‘আমরা শুধু আফ্রিকায় এসেছি, তানজানিয়ার এক নিভৃত এলাকায় নদীর চরের কাছে আমাদের লগ-কেবিন। একটি বুড়োসুড়ো কুমির চরে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। তারপর একদিন গান ফায়ারের আওয়াজ শুনে কেবিনের বাইরে এসে দেখি পোচাররা গুলিবিদ্ধ মামি ক্রোকোডাইল ও দুটি বেবি ক্রোকোডাইলকে পিকআপে তুলে হাওয়া হচ্ছে। এ বাচ্চাটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। আমরা তাকে কেবিনে নিয়ে এসে দত্তক নিই। ফ্রাউলাইন অনিটা সড়সড় করে চৌবাচ্চার জলে নেমে যায়। হের বোমগার্ডনার কচমচ করে পুদিনার চাটনিতে চুবিয়ে সমুসা খাচ্ছেন। জার্মান রাষ্ট্রদূতের ম্যানসনে এ-ধরনের স্ন্যাক্স এক্সপেক্ট করিনি, তাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। তিনি বলেন, ‘আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইটিং সাম স্পাইসি ইন্ডিয়ান সমুসাজ, মশলাদার সমুসা খেতে তোমার অসুবিধা হওয়ার তো কথা না। হারারের বাজারে আজকাল শুধু ইন্ডিয়ান স্টোরে অল্পবিস্তর খাবার-দাবার পাওয়া যাচ্ছে, ফ্রাউলাইন অনিটা পর্যন্ত কারি চিকেন খেতে শুরু করেছে।’
এ ডিপ্লোম্যাট দীর্ঘকাল হলো আফ্রিকায় আছেন। তার সাহেবি চামড়ায় সানবার্নের পোড়া মরচে রঙের দাগ। তিনি নিজে থেকেই কাজের কথায় এসে বলেন, ‘স্কুপ হলো, ইলেকশনে মুগাবের হার হয়েছে, জানুপিএফ দলের ঘাগেল সাঙাতরা সেকেন্ড রাউন্ড ইলেকশনের কথা ভাবছে। ডিপ্লোম্যাটিক কমিউনিটি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আপসরফার জন্য চাপ দিচ্ছে। এখন প্রয়োজন একজন মিডিয়েটার বা মধ্যস্থতাকারীর।’ আমি মিডিয়েটরের নাম জানতে চাই। হের বোমগার্ডনার বলেন, ‘সাউথ আফ্রিকার যশস্বী নোবেল লরিয়েট ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটুর নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু রবার্ট মুগাবে তাকে এককথায় খারিজ করে দিয়েছেন। এখন আফ্রিকান ইউনিয়ন চাচ্ছে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে লাগানোর জন্য; কিন্ত এতে বাদ সাধছেন সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শেষমেষ তাকেই মিডিয়েটর হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।’ এসব ইনফরমেশনের জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ার সময় জানতে চাই, ‘রবার্ট মুগাবে কি আপস আলোচনায় রাজি হবেন? হের বোমগার্ডনার গেট পর্যন্ত আসতে আসতে বলেন, ‘অফকোর্স, হি উইল অ্যাগ্রি, ইফ নট, উই হ্যাভ অ্যা ট্রামকার্ড ইন আওয়ার স্লিভ। রাজি না হলে আমাদের তুরুপের তাস তো আছেই।’ তার আঁস্তিনের ভাঁজে রাখা তুরুপের তাসটি কী তা ভাবতে ভাবতে আমি তাকে গুডবাই বলে পায়ে হেঁটে চার্চের দিকে চলি।
রাজপথ এভয়েড করে একটু ঘুরে আমি সংকীর্ণ গলির ভেতর দিয়ে হাঁটি। হালফিল হারারে শহরে পৌরসভার তরফ থেকে গারবেজ কালেকশন করা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই গলিপথের দুপাশে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে বিস্তর আবর্জনা। নর্দমার ময়লা পানিতে ডোবা পাথরের পাশে বসে তিনটি বস্তির ছোট্ট ছেলে। তারা প্লাস্টিকের বোতলে ভরছে কর্দমাক্ত নোংরা পানি। মাসখানেক হলো হাই ডেনসিটি নেইবারহুড বলে পরিচিত বস্তিগুলোতে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে আছে। বস্তিওয়ালা মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি নামক বিরোধীদলকে সাপোর্ট করলে পৌরসভা ওয়াটার সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। যেতে  যেতে ভাবি  Ñ তবে কি বাচ্চারা এখানে থেকে সংগ্রহ করছে খাবার পানি। শহরে একটু-আধটু কলেরা ছড়াচ্ছে Ñ এ-খবরও দিন তিনেক আগে পত্রিকাতে পড়েছি।
চার্চের দুয়ারের পিতলের আংটা ঝুলানো পাল্লা দুটো বেজায় রকমের ভারী। খানিক কসরতে তা খুলে ভেতরে ঢুকে চোখে আলো-আঁধারি সইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় গির্জার বিশাল হলঘরে আজ জ্বলছে না কোনো বাতি। দেয়ালের আইকনে Ñ যিশু, মাতা মরিয়ম ও সন্ন্যাসীদের বর্ণাঢ্য চিত্ররাজি মোমহীন আঁধারে যেন খাবি খাচ্ছে। আমি সারি সারি ‘পিউ’ বা উপাসনার সময় বসার বেঞ্চগুলো সাবধানে অতিক্রম করে টোপেকে খুঁজি। অবশেষে তাকে পাওয়া যায় পাদ্রি যে-মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরিচালনা করেন প্রার্থনানুষ্ঠান তার কাঠে বাঁধানো বেদিতে বসে। তার পাশে অযতেœ পড়ে আছে বাইবেল, মেয়েটি দুচোখ মুদে পবিত্র গ্রন্থে হাতের তালু রেখে যেন ভারসাম্য রক্ষা করছে। আমি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করি, ‘টোপে, আর ইউ অলরাইট?’ সে চোখ মেলে তাকায়, তার অক্ষিগোলককে পুরু  লেন্সের মতো দেখায়। উপাসনার বেদি আলোহীন নয়।  দেয়ালের মস্ত জানালায় কাচের চিত্রিত সার্সি Ñ তাতে ফিল্টার হয়ে অপরাহ্ণের বর্ণাঢ্য আলোয় ভরে আছে প্রার্থনামঞ্চ। টোপে নড়েচড়ে জায়গা বদলে বসে। তাতে তার গ্রীবা, কাঁধ ও বক্ষদেশের কিয়দংশ ভরে উঠে রঙিন আলোয়। সে অত্যন্ত সুন্দর করে হেসে বলে, ‘ইউ ওয়ান্ট টু নো মাই স্টোরি, রাইট?’ আমি জবাব দিই, ‘তুমি যে রকম ড্রাগসের ট্রিপে থাকো, এ হালতে তোমার ড্যাডি অ্যাম্বাসির গাড়ি ড্রাইভ করা এলাও করে কি ভাবে, জাস্ট আনসার মি দিস?’ টোপে আমার চোখে চোখ রাখে, তার স্ফুরিত ঠোঁট ভরে উঠে মাতা মরিয়মের হাসির স্বর্গীয় বিভায়। সে অত্যন্ত রিলাক্স স্বরে বাইবেলের উপর হাত রেখে বলে,‘আই অ্যাম টেলিং ইউ দ্য ট্রুথ … ওকে।’ আমি সত্য ভাষণ শোনার অপেক্ষায় উদগ্রীব হই। সে সাদামাটা স্বরে বলে, ‘হি হ্যাজ বিন অ্যাবিউজিং মি সিন্স আই ওয়াজ অ্যা লিটল গার্ল! সো আই উইল ডু এনিথিং আই উইশ। ছোটবেলা থেকেই সে আমাকে অবিউস করছে। সুতরাং আমি যা ইচ্ছা হয় তাই করতে পারি। আমি যদি মামির কাছে বিষয়টা বলে দিই এ-ভয়ে সে কিন্তু আমার কোনো কাজে বাধা দেবে না, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই সেইড।’ আমি যতটা না বিস্মিত হই তার চেয়ে বেশি কনফিউজড হয়ে বলি, ‘ডু ইউ মাইন্ড টেলিং মি অ্যা লিটল মোর’, তোমার সম্পর্কে কাইন্ডলি আরেকটু বলবে কি? টোপের চোখেমুখে আবার ফিরে আসে মাতা মরিয়মের মৃদু হাসি। সে আদুরে ভঙ্গিতে ঘাড় হেলিয়ে বলে, ‘আমি আমার গ্র্যান্ড মাদারের সঙ্গে অগবমসোতে বাস করছিলাম। গ্র্যান্ডমায়ের মৃত্যু হলে এগারো বছর বয়সে আমি মা-বাবার কাছে আসি। আমার ড্যাডি তখন জেনেভার নাইজেরিয়ান দূতাবাসে কর্মরত। বারো বছর বয়স থেকে সে আমাকে মলেস্ট করতে শুরু করে। আমি যখন চোদ্দো বা পনেরো বছরের কিশোরী, তখন থেকেই সন্দেহ হতে থাকে সে আমার আসল পিতা কিনা? আমার মা তখন বেশ বছর কয়েক হলো প্যারালাইসিসে আংশিকভাবে চলৎশক্তিহীন। আমি খেয়াল করে দেখি, আমার চেহারার সঙ্গে আমার ডিপ্লোম্যাট পিতার চেহারা-সুরতের তেমন কোনো মিল নেই। অবশেষে একদিন বেইসমেন্টে মায়ের পুরনো স্যুটকেস ঘেঁটে খুঁজে পাই একতাড়া লাভ-নোটের সঙ্গে সুপুরুষ এক যুবকের ছবি। আয়নার সামনে আমার মুখের পাশাপাশি ছবিটি রেখে একটু তাকাতেই আমাদের চেহারার সামঞ্জস্য ধরা পড়ে। মাকে একটু চাপ দিতেই মামি স্বীকার করেন যে, এ যুবকই তার বিবাহ-পূর্ব জীবনের বয়ফ্রেন্ড এবং তিনিই আমার আসল পিতা। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন বেআইনি অস্ত্রশস্ত্রের স্মাগলার। একবার সীমান্ত অতিক্রমের সময় তিনি রক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। এ কাহিনি শুনে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, কেন আমাকে সমগ্র শৈশব পিতৃমাতৃহীন হালতে গ্র্যান্ডমার সঙ্গে অগবমসোতে কাটাতে হয়েছে।’ এ পর্যন্ত বলে টোপে, ‘সাচ ইজ মাই লাইফ’ বলে ককো-পয়জনের শিশি বের করে শূন্যতায় ¯েপ্র করে পারফিউম।
আমার পরবর্তী অ্যাপয়েন্টমেন্ট হারারের আর্ট অ্যাকাডেমিতে। চার্চ থেকে প্রায় দুই ব্লক দূরে অ্যাকাডেমির অবস্থান। সেখানে জিম্বাবুয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইকোনমিস্ট ড. জন রবার্টসনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা আছে। টোপেকে এ হালতে ড্রাইভ করতে বলা যায় না। সে খানিক বিশ্রাম নিতে পারলে হয়তো বিকেলবেলা নরমাল হয়ে উঠবে। তাই আমি খানিক রিস্ক নিয়ে হেঁটে আর্ট অ্যাকাডেমির দিকে চলি। আমাকে শুধু একটি চেকপয়েন্ট পাড়ি দিতে হয়। পয়েন্টের বিরসবদন কনস্টেবল পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে অন্যমনষ্কভাবে আমার কাছে সিগ্রেট চায়। আমি পলমলের প্যাকেট থেকে তাকে তিনশলা খুচরা সিগ্রেটের সঙ্গে এক ডলারের নোট দিলে সে নগ্ন নারীচিত্র থেকে চোখ না তুলেই বলে, ‘গড ব্লেস ইউ স্যার।’ আমি ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে পেল্লায় এক পাথরের ভাস্কর্য ও রংচটা ফ্রেস্কোর নিচ দিয়ে আর্ট অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ করি।
ড. রবার্টসন এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই আমি হলঘরের দেয়ালে ঝুলানো আলোকচিত্রের প্রদর্শনী দেখি। বিশেষভাবে নজরে আসে একটি সাদামাটা ফটোগ্রাফ। তার নিচে আলোকচিত্রির নাম গডফ্রি ফুফুফো লেখা দেখে একটু অবাক হই। মি. ফুফুফো পেশায় হাইস্কুলের শিক্ষক। গতকাল আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি প্রসঙ্গক্রমে তাঁর যে-ছবি তোলার হবি তা বলেছিলেন। ভদ্রলোক পুরনো মডেলের কডাক ক্যামেরা দিয়ে সাদাকালো ছবি তুলে থাকেন। হারারেতে ফিল্মের আক্রা থাকায় তিনি কিছুদিন হলো ছবি তোলা থেকে বিরত আছেন। তার ছবি যে জাতীয় পর্যায়ে প্রদর্শিত হচ্ছে তা কিন্তু তিনি আমাকে বলেননি। মানের দিক থেকে ছবিটি অতুলনীয়। আমি ব্রিফকেইস থেকে ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে আবার তা গাঢ়ভাবে নজর করে দেখি; কৃষ্ণাঙ্গ বালিকা এক বাঁশের কাঠামোতে হাত রেখে চেয়ে আছে শূন্যতায়। তার গলায় ধাতুর লকেট। মেয়েটির দৃষ্টিতে যে-বিষণœতা তা দর্শকের বক্ষদেশে প্রতিফলিত হয়ে চিনচিন করে পাঁজর বেয়ে ছড়িয়ে যায় কলজে অবধি। আমি পারমিশন ছাড়াই ছবিটার কপি করি। বাঁধানো ফ্রেমের কাচে ঝালসে যায় ফ্লাশ। আলোকচিত্র থেকে চুষকাগজের মতো বিষণœতাকে শুষে নিয়ে চলে আসি পাশের সাইবার ক্যাফেতে।
ভাবি ড. রবার্টসন যখন এসে পৌঁছাননি এ-সুযোগে ই-মেইলটা চেক করে ফেলি। কিন্ত এখানে নসিব মন্দ, কম্পিউটারের ¯্র‹িনে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো হাতে লেখা একটি নোটিশ। তাতে লেখা – হোম মিনিস্ট্রি মাত্র একমাসের জন্য আর্ট অ্যাকাডেমির ইন্টারনেট সংযোগ বাতিল করেছেন। খাজুল হয়ে চেয়ারে বসে মি. ফুফুফোর কথা ভাবি। পরেরবার হারারেতে আসার সময় সাউথ আফ্রিকা থেকে তার জন্য কিছু ফিল্ম নিয়ে আসতে পারলে মন্দ হয় না। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সেলারি ২৯১ ডলারের মতো। গত চার মাস হলো তিনি বেতন তুলতে পারেননি। পুত্রকন্যা, বৃদ্ধা মা মিলিয়ে তার সাতজনের সংসার। এদিকে বাজারে ছোট্ট এক বোতল তেলের দাম ১৬ ডলার, এক ব্যাগ যবের আটা ৩৫ ডলার। মাসখানেক হলো তিনি আর স্কুলে বিকেল বেলা পড়াচ্ছেন না, সে-সময়টা তিনি কাটাচ্ছেন সুপার মার্কেটের পার্কিংলটে পপকর্ন ও মোবাইল ফোনের সিম কার্ড বিক্রি করে।
হুড়মুড় করে সাইবার ক্যাফেতে এসে ঢুকেন ড. রবার্টসন। রুপালি চুলের বৃদ্ধ ইকোনমিস্টের হাতে ধরা বাঁকানো পাইপ। তাঁর সময় অল্প তাই আমরা দ্রুত কাজের কথায় চলে আসি। তিনি কোনো ভূমিকা না করেই বলেন, জিম্বাবুয়েতে মুদ্রাস্ফীতির হার যেখানে গেল বছর ছিল এক মিলিওন শতাংশ তা গেল ছমাসে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১১ মিলিয়ন শতাংশ। তিনি জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতির ইমপ্যাক্ট হিসেবে বেশ কিছু উপাত্ত দেন; কিন্তু বিষয়টি টেকনিক্যাল বলে আমি বিশেষ একটা ফলো করতে পারি না। তিনি আমার অর্থনৈতিক জ্ঞানের খামতি দেখে সাদাসাপটা কথায় চলে আসেন। বছরকয়েক আগেও জিম্বাবুয়ের জনসংখ্যা ছিল ১২ মিলিয়ন। অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে দুই মিলিয়নের ওপর লোক শরণার্থী হয়ে সাউথ আফ্রিকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। দেশে বর্তমানে যে আট মিলিয়ন লোক বাস করছে তাদের মধ্যে পাঁচ মিলিয়নের প্রয়োজন ফুড রিলিফ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্য ত্রাণ কর্মসূচি চালাতে চায়, বিরোধী দলের সমর্থকরা তা থেকে ফায়দা উঠাবে, এ-অজুহাতে মুগাবে সরকার তাদের রিলিফ ওয়ার্কের পারমিশন দিচ্ছে না। এতে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনাহার, অপুষ্টি ও অহেতুক মৃত্যু। আমি জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ‘দ্বন্দ্ব নিরসনে মিডিয়েশনে’র উল্লেখ করে জানতে চাই, তাদের কাছে তুরুপের তাস কি থাকতে পারে? ড. রবার্টসন তামাকহীন পাইপে কষে দম দিয়ে বলেন, ‘রিজার্ভ ব্যাংক যে বিলিয়ন ডলারের নোট ছাপছে, জার্মানরা তার কাগজের জোগান দিয়ে থাকে। রবার্ট মুগাবে মিডিয়েশনের মাধ্যমে সুলে সমঝোতায় না আসলে তারা কাগজ সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেবে।’ আমি জানতে চাই এতে কী পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন কিছু হবে? ‘আই ডোন্ট নো, টোটালি ডোন্ট নো’ বলে ড. রবার্টসন দাঁতের খিলালের মতো কিছু দিয়ে পাইপ পরিষ্কার করে বলেন, ‘রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর এটা জানেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তারা টাকার হিসাব থেকে পাক্কা দশটি ডিজিট কমিয়ে দেওয়ার হুকুম দেবেন। কারণ কাগুজে টাকার সংখ্যা পরিমাণে এত বেড়ে গেছে যে, তার হিসাব-কিতাব করতে কম্পিউটারেও বেহদ্দ সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া কাগজের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে পুরনো নোটকে ব্লিচ দিয়ে মুছে তাতে নতুন টাকা ছাপানো যায় কিনা  সে-বিষয়টিও রিজার্ভ ব্যাংক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে।’ ড. রবার্টসন উঠে পড়েন। আমি তার সঙ্গে আর্ট অ্যাকাডেমির গেট অবধি হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাই, ‘এ পরিস্থিতিতে তার ব্যক্তিগত অসুবিধা কিছু হচ্ছে কি?’ তিনি খালি পাইপ দেখিয়ে বলেন, ‘ব্ল্যাক মার্কেটেও আজকাল জুতসই টোব্যাকো পাওয়া যাচ্ছে না, সাচ ইজ লাইফ।’ আমি পলমলের প্যাকেট বের করে তাকে সিগ্রেট অফার করি। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আই অ্যাম লয়েল টু মাই ওন ব্র্যান্ড।’ বৃদ্ধ ইকোনমিস্ট তামাকহীন পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে চলে যান তাঁর গাড়ির দিকে।
পার্কিংলটের এক কোণে মুছাছা গাছের ছায়ায় কালো রঙের সেলুন কারটি। ড্রাইভিং সিটে হাসিমুখে বসে টোপে স্টিরিও বাজিয়ে মুটকুদজির পাস্টোরাল সংগীত শুনছে। সে আমাকে যাতে আবার চেকপয়েন্ট হয়ে চার্চের দিকে হেঁটে যেতে না হয়, এ-বিষয় বিবেচনা করে গাড়ি নিয়ে আর্ট অ্যাকাডেমিতে চলে এসেছে দেখে আমি খুশি হয়ে ইউরোবা ভাষায় আডুপে বা ধন্যবাদ বলি। সে সুচালো ঠোঁটে চুয়িংগামের বাবোল ফুটিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠার ইশারা দেয়। এভেনডেইল এভিনিউ দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে সে বলে, ‘আই অ্যাম ইন দ্য মুড অব অ্যা লং ড্রাইভ। তুমি চাইলে আমি তোমাকে শহরের বাইরে গ্রামের দিকে নিয়ে যেতে পারি। আমার জানাশোনা একটি বটল স্টোর আছে। ওখানে বসে গ্রামের লোকজনদের সঙ্গে তুমি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে পারবে।’ আমি ইতোমধ্যে লেখক, শিক্ষক, কূটনীতিক কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলাপ করেছি। বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে গ্রামের মানুষদের ইমপ্যাক্ট করছে সে-বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে আমার স্টাডির মান বাড়ে, তাই কোনো দ্বিধা ছাড়াই রাজি হই।
শহরের বাইরে রাজপথের একপাশে বৃত্তাকার কটি ছোট-বড় পাথুরে পাহাড় যেন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। অন্যদিকে রোদপোড়া ঘাসের বিপুল প্রান্তর। রাজসড়ক এখানে হয়ে এসেছে আঁকাবাঁকা খানাখন্দে পিচ-উপড়ানো বন্ধুর। গাড়ি শার্প টার্ন নিতেই দেখি কাঁটাওয়ালা আকাশিয়া ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে গোলাকার ছনে ছাওয়া সব কুটির। বৃত্তাকার ঘরগুলোর দেয়ালে চুন, আলকাতরা ও গাছের লোহিত কষ দিয়ে আঁকা বর্গাকৃতির সব জ্যামিতিক নকশা। গায়ের পাশেই মস্ত এক মাঠ জুড়ে যবের চাষ। আমরা মাঠের পাশ দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে সহসা নজরে পড়ে ধুমকেতুর মতো বঙ্কিম এক বিপুল রেখা উড়ে যাচ্ছে আকাশে। বেশ কিছুক্ষণ হলো গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রায়ই উইন্ডশিল্ডে এসে বাড়ি খাচ্ছিল বাদামিতে মেশা হালকা লোহিত বর্ণের এক ধরনের পতঙ্গ। টোপে আকাশ ছেয়ে আসা ধুমকেতুর দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠে, ‘ও লর্ড, ইটস অ্যা সোয়ার্ম! লোকাস্ট সোয়ার্ম! প্রভু, আমাদের দিকে যে ধেয়ে আসছে পঙ্গপালের ঝাঁক।’
গতকাল আমি হারারে হেরাল্ড নামে খবরের কাগজে জিম্বাবুয়ের ফসলের ওপর লোকাস্ট বা পঙ্গপালের আক্রমণের খবর পড়েছি। পঙ্গপালের উড়ন্ত ঝাঁককে সামনাসামনি দেখা আমার জীবনে এই প্রথম। ধুমকেতুর মতো বিশাল বাদামি লোহিতাভ মেঘ আকাশে কুণ্ডলি পাকিয়ে কিছুক্ষণ উড়ে। ড্রাইভ করে সামনে বাড়তে বাড়তে দেখি পাশের মাঠে নেমে আসছে হাজার বিজার পতঙ্গ। আলখাল্লার মতো নীল উত্তরীয় পরা একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, বোধকরি গায়ের পুরোহিত তিনি, একঝাঁক পঙ্গপোকার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন নিঃসঙ্গ। সড়কের পাশে একটি গ্রাম। তার জরাজীর্ণ শনে ছাওয়া কুটিরের সামনে খেলছে শিশু, চালে শুকাতে দেওয়া কাপড়-চোপড়, লাল-সাদা রঙের বার্নিশ করা পিপা সমস্ত কিছু আচ্ছন্ন করে অনৈসর্গিক বৃষ্টিধায়ার ঝরছে শত শত বাদমি ধূসর পঙ্গ পতঙ্গ।
আমরা আরেকটু সামনে বাড়ি। এদিকের গাও-গেরামেও ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে। মানুষজন বেরিয়ে আসছে হাঁকডাক করে, ঢোল বাজিয়ে ক্যানেস্থরা পিটিয়ে। আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতের মতো পঙ্গপালের লাখে লাখে পতঙ্গরাজি ঝরে পড়ছে যবের ক্ষেতে। গাঁয়ের নারী ও শিশুরা দলে দলে ফসলের ক্ষেতে নেমে বাটিকের গামছা দিয়ে পেটাচ্ছে দুধে ভরা তাজা যব। গাড়ির কাচে এবার বাড়ি খাচ্ছে হাজারে-বিজারে পতঙ্গ, এদের অতি নিচু উড্ডয়নে প্রতিবেশে ছড়িয়েছে বাদামি লোহিত বর্ণের অন্ধকার। ওয়াইপারের কাঁটায় বেশ কিছু পতঙ্গ দুমড়ে-মুচড়ে পিষ্ট হয়ে আটকে গেলে টোপে ‘ইয়াক’ বলে সড়কের পাশে গাড়ি দাঁড় করায়। গাঁয়ের নাগাঙ্গা বা পুরোহিতরা এখন শিঙ্গা ফুঁকে পশুর লেজ বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে যবের সারির মাঝ বরাবর। তাদের সামনে নগ্নবক্ষা কটি কুমারী মেয়ে। কিছু কিছু মানুষ জাল দিয়ে পতঙ্গ ধরে পুরছে বেতের খাকারিতে।
আমরা গাড়ির কাচঘেরা নিরাপত্তার মাঝে বসে থেকে পঙ্গপালের হাত থেকে ফসল বাঁচানোর মানবিক লড়াই দেখি। গতকালের হারারে হ্যারাল্ড পত্রিকায় পড়া তথ্যের প্রসঙ্গ মনে আসে। পঙ্গপালের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন কীটনাশক রাসায়নিক ছাড়ানোর ক্রপ ¯েপ্রয়ার অ্যারোপ্লেন। পাশ্চাত্যের আরোপিত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ফলে খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে জিম্বাবুয়ের প্লেনগুলো উড়তে পারছে না আকাশে। জল সেচের পাইপ পাম্প ইত্যাদি মেনটেন্যান্সের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে সারাদেশে এবার ক্রপ ফেইলার বা ফসলের উৎপাদনে ঘাটতি সত্তর শতাংশ। তার ওপর এবার আসমানি গজবের মতো মাঠে মাঠে নামছে লোকাস্ট সোয়ার্ম বা পঙ্গপালের দলবদ্ধ অবতরণ।
টোপে তার গলা থেকে কাঠে খোদাই করা ভারী ক্রুশ চিহ্ন খুলে ফেলে আমার দিকে খানিক রহস্যভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। সে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে যিশুর পেরেকবিদ্ধ দুবাহু ও মস্তক আলগা করতে করতে বলে, ‘হারারের এ নিভৃত চার্চ আমার খুব প্রিয়, যখনই একা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে, এবং ভাবতে চাই শুধু নিজের কথা, আমি এ-চার্চে চলে এসে বসে থাকি পবিত্র বাইবেলের পৃষ্ঠা খুলে।’ টোপের হাতে এখন দুভাগে বিভক্ত ক্রুশচিহ্ন, যার নিচের অংশটি সুর্মাদানির ভেতরের মতো ফাঁপা। সে ফাঁপানো অংশে নাক লাগিয়ে খুশবো শুকার মতো নিশ্বাস টানে। ক্রমশ তার চোখমুখ হয়ে আসে সূর্যালোকে ঝলসে-ওঠা চার্চের শার্শির মতোই অপার্থিব রকমের উজ্জ্বল। আমি খানিক বিব্রত হয়ে বলি, ‘টোপে আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো এনিথিং মোর অ্যাবাউট ইউ, তোমার জীবন সম্পর্কে আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বাট, উড ইউ লাইক টু ডু সামথিং দ্যাট ইউ মাইট এনজয় ডিপলি? তোমার কি এমন কিছু করার ইচ্ছা হয় যা তুমি রিয়েলি গভীরভাবে এনজয় করবে?’ আমার এ-প্রশ্নে টোপের চোখেমুখে ফিরে আসে মাতা মরিয়মের ম্লান হাসি। সে ক্রুশচিহ্ন প্যাঁচিয়ে বন্ধ করতে করতে বলে, ‘আই উড অ্যাপ্রিসিয়েট তুমি যদি স্রেফ ভুলে যাও আমি তোমাকে যা বলেছি, আমি কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলিনি, ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যা লাই।’ আমি জবাবে বলি, ‘দ্যাটস ইজি, আই উইল নট রিমেমবার হোয়াট ইউ সেইড, ওকে। তুমি যে আমাকে এসব বলেছ আমি তার কিছুই মনে রাখব না।’
টোপে এবার দুবাহু ঊর্ধ্বে তুলে ক্রুশচিহ্ন গলায় পরতে পরতে বলে, ‘ওয়ান মোর থিং, আমার কিন্তু এখানে বাস করতে একেবারেই ভালো লাগে না, সোকল্ড ডিপ্লোম্যাট ফাদারের সঙ্গে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ানো আর কোথাও শিকড় না গাড়া। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু ওগবমসো। মনে হয় কোনো একদিন আমার গ্র্যান্ডমার শনের কুটিরে আমি বাস করতে পারব একাকী। কখনো কখনো স্বপ্নে এ শনের কুটির উড়ে আসে একদম আমার বিছানার পাশে, ভেরি ক্লোজ টুু মি, ভেরি নিয়ার টু মাই হার্ট।’