জয়নুল আবেদিন : পথিকৃৎ তিনি নানাভাবে

নজরুল ইসলাম

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বারবার আমার এ-কথাটিই মনে জাগছে যে, বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির জগতে তিনি কতভাবেই না পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। শিল্পী হিসেবে যেমন, তেমনি শিল্প-সংগঠক হিসেবেও। আমার আলোচনাটি দুটো অংশে উপস্থাপন করব – প্রথমে শিল্পী হিসেবে তাঁর পথিকৃতের ভূমিকার বিষয়, দ্বিতীয় অংশে শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী ও দিশারি ভূমিকার বিষয়ে।

গত বছর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও ইতালির প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা (Skira), যৌথভাবে Zainul Abedin শিরোনামের যে-গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে, তাতে আমার একটি রচনা স্থান পেয়েছে। রচনাটির আমি শিরোনাম দিয়েছিলাম Zainul Abedin : Pioneer of Modern Art in Bangladesh. সম্পাদক শিরোনামটি কিছুটা বদলে দিয়ে করেছেন, Zainul Abedin : Pioneering Modern Art in Bangladesh. তাঁর দেওয়া শিরোনামটি অধিকতর অর্থবহ হয়েছে। জয়নুল শুধুই পথিকৃৎ ছিলেন না, তিনি পথপ্রদর্শনের প্রক্রিয়াটিও পরিচালনা করেছেন। কিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করবো।

ক.

জয়নুল আবেদিনের শিল্পী হওয়ার বাসনাটিই ছিল তৎকালীন সমাজবাস্তবতায় এক অসাধারণ চিন্তা। পূর্ব বাংলার মফস্বল শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের চাকরীজীবী পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান জয়নুল ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই সুদূর কলকাতায় শিল্পশিক্ষার জন্য অভিযাত্রা করবেন, এ ছিল খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। একটি পথিকৃৎ সিদ্ধান্তই বটে। কলকাতার আর্ট স্কুলে অবশ্য তাঁর আগেই দুয়েকজন মুসলমান শিক্ষক বা ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁরা পশ্চিম বাংলার। আর্ট স্কুলে জয়নুল তাঁর মেধা ও শ্রম দিয়ে ছাত্র হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছিলেন, এবং ছাত্রত্ব শেষ হবার আগেই তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী শিক্ষক পদ লাভ করেছিলেন (১৯৩৭ সালে)। এটিও ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। অবশ্য এক্ষেত্রে জয়নুলের মেধার স্বীকৃতি জানিয়ে কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

শিক্ষকতার প্রথম পর্বে কয়েক বছর জয়নুলের চিত্রচর্চার আঙ্গিক ছিল বাস্তববাদী, পূর্ব বাংলার নদী, নিসর্গ ও প্রকৃতি ছিল যার মূল প্রেরণা। জয়নুলের বাল্যকাল ও কিশোর জীবনের ব্রহ্মপুত্রের সান্নিধ্য ছিল অভিজ্ঞতা ও অনুভবের জগৎ। রোমান্টিকতা ছিল মানসিকতায়। এই পর্বটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৪৩-এর বাংলার মহামন্বন্তর ছিল জয়নুলের শৈল্পিক চেতনায় প্রচন্ড এক আঘাত। কলকাতা মহানগরীর ফুটপাতে অবস্থান নেওয়া অনাহারী মানুষের অসহায়ত্ব তাঁর মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে। শিশু, নারী, পুরুষ, এরা যেন আর মানুষ নয়, শুধুই কংকাল। কংকালসার মানুষ শহরের ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যান্বেষণে তাদের শেষ শক্তি দিয়ে কাক আর কুকুরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। মানবতার এই চরম অবমাননা জয়নুলকে ভীষণভাবে বিচলিত করে, আবেগাপ্লুত করে। কিন্তু সে-আবেগ তিনি শৈল্পিক সৃষ্টিতে রূপান্তর করেন। তিনি মোহগ্রস্তের মতো মহানগরের এসব অমানবিক দৃশ্যের স্কেচ করতে থাকেন, অনবরত অনুশীলন করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় আড়াই ডজন পরিপূর্ণ ছবি আঁকেন, যা পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় তাঁর অবিস্মরণীয় ‘দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা’ নামে।

জয়নুলের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের চিত্রকলার ঐতিহ্যে এক বৈপ্লবিক ঘটনা। ন্যাচারালিজম ও রোমান্টিক ধারার শিল্প-আঙ্গিকের বাইরে সমাজবাস্তবতা বা সোশ্যাল রিয়েলিজম জাতীয় শিল্প-বক্তব্য উপস্থাপন করেন জয়নুল। বিষয় নির্বাচন, উপস্থাপনার আঙ্গিক ও শৈলী, এমনকি অঙ্কনের মাধ্যম, সবকিছুই ভিন্ন প্রকৃতির। বিষয় ও আঙ্গিকের এত শক্তিশালী সমন্বয় বস্ত্তত বিশ্ব-চিত্রকলার ইতিহাসেই বিরল। অতিসাধারণ কাগজে শুধু কালো চায়নিজ ইংকে তুলির টানের রেখা সমৃদ্ধ ছবি যে এত বাঙ্ময় হতে পারে, তা জয়নুলের দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। একটি, দু-তিনটি বা চারটি মাত্র ছবি নয়, প্রায় তিরিশটি ছবি আঁকেন তিনি এই ধারায়। বাস্তববাদী আঙ্গিক হলেও প্রতীচ্যের আঙ্গিকও নয়, পূর্ব এশীয় ধারাও নয়, বরং সবকিছুর সারমর্ম যেন ব্যবহৃত হয়েছে এই চিত্রমালায়। দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে জয়নুল বক্তব্যপ্রধান ও নিজস্ব আঙ্গিকের শিল্প সৃষ্টি করে শিল্প-ঐতিহ্যে পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন, স্থায়ী অবদান রেখেছেন। আমার কাছে ১৯৪৩-এর জয়নুলের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা ১৯২১-এর কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো বিপ্লবাত্মক সৃষ্টির দৃষ্টান্ত মনে হয়। বক্তব্য, আঙ্গিক ও শৈলী সবকিছুতেই অসাধারণ বিশিষ্টতা।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জয়নুল যেসব জলরং ছবি এঁকেছেন, বাংলার প্রকৃতি (‘কালবৈশাখী ঝড়’) অথবা কৃষি সংস্কৃতির (‘মই দেয়া’), তাতেও মাধ্যম চর্চা ও কম্পোজিশন নির্মাণে অসাধারণ মৌলিকত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। একই দশকের প্রায় মাঝামাঝি এসে তিনি আবার পথিকৃৎ শিল্পীর ভূমিকা পালন করেছেন, তবে পূর্ব বাংলার লোকশিল্প-ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিল্পের সমন্বয় করে একটি সিরিজ এঁকে। ‘পাইনার মা’, ‘নব বধূ, ‘পললী জননী’, ‘দুই রমণী’, ‘প্রসাধনরত নারী’ ইত্যাদি আপাত রোমান্টিক মেজাজের কাজে লোকজ ও আধুনিক ধারার সমন্বিত আঙ্গিক  জয়নুলের অন্যতম পথিকৃৎ চিত্ররীতির দৃষ্টান্ত। বাংলার চিত্রকলার আধুনিকতার মূল শক্তি হবে লোকজ ঐতিহ্য, এমন বিশ্বাস থেকে জয়নুল এই সমন্বয়ী ধারাটির চর্চা শুরু করেছিলেন। তাঁর কলকাতার শিষ্য ও ঢাকার সহযাত্রী কামরুল হাসানও প্রায় কাছাকাছি সময়ে এরকম সমন্বয়ী ধারা নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন এবং অসাধারণ সফল শিল্পনিদর্শন রেখে গেছেন। পরবর্তীকালে আবদুস শাকুর ও অন্য কয়েকজন তরুণ শিল্পী লোকজ ঐতিহ্য ও আধুনিক শিল্পরীতির সমন্বয়ী সুন্দর কাজ করেছেন; কিন্তু পথপ্রদর্শক ছিলেন জয়নুলই।

জয়নুলের ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম পর্বের ছাত্ররা পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই চিত্রকলায় উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান এবং মধ্য দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেন। এদিক থেকে অবশ্য তরুণরাই জয়নুলের পূর্বসূরি। নভেরা আহমদ (তিনি জয়নুলের ছাত্রী ছিলেন না) এদেশের পথিকৃৎ ছিলেন পশ্চিমে (লন্ডন) গিয়ে শিল্পশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে (১৯৫০), প্রায় কাছাকাছি সময়ে জয়নুলের ছাত্র হামিদুর রহমান ইউরোপ (প্যারিস) যান। জয়নুল ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে। তার দুবছরের মধ্যে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান ১৯৫১ সালের আগস্টে। লন্ডন, প্যারিসসহ ইউরোপের আধুনিক চিত্রকলার কেন্দ্র ও বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। বস্ত্তত তখুনি তিনি বাংলাদেশের লোক শিল্প-ঐতিহ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করেন, বিষয়টি খুবই তাৎপর্যময়। দেশে ফেরার পর তিনি তাঁর লোকজ ও আধুনিক ধারায় সমন্বয়ী আঙ্গিকটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে তরুণ শিল্পীরা তাঁর পরে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে পাশ্চাত্য আধুনিক ধারা (কিউবিজম-প্রভাবিত ও অ্যাবস্ট্রাক্ট বৈশিষ্ট্যের) প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন। জয়নুল তাদের এই প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করেননি, বরং নানাভাবে প্রণোদনা দিয়েছেন। এসব শিল্পীকে তাঁর চারুকলা ইনস্টিটিউটে (পরে কলেজ) শিক্ষক নিয়োগ করেছেন। তিনি নিজেও সমবিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারায় কিছু কাজ করেছেন, সুন্দর কাজ, কিন্তু সহজেই অনুভব করেছেন, সে-ধারায় তাঁর মন সায় দিচ্ছে না, তিনি প্রত্যাবর্তন করেছেন তাঁর সেই ’৪৩-এর রেখাপ্রধান ও আখ্যানমূলক আঙ্গিকে। তবে পুনরাবৃত্তি নয়, বরং এক অসাধারণ নবধারার শিল্প সৃষ্টি করেন। এখানে কিছু অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বাংলার লোকজ পটচিত্র ধারার। তিনি স্ক্রলচিত্র আঁকলেন ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘নবান্ন’ চিত্রটি (১৯৭০ সালে আঁকা)। ৪ ফুট প্রশস্থ কাগজে আঁকা এই স্ক্রলটি মূলত তুলির টানে কালো কালিতে আঁকা স্কেচধর্মী। এতে কালো কালির সঙ্গে মোম ও জলরঙের ব্যবহার ছিল। মোম দিয়ে তিনি সাদা রেখার সূচনা করেছেন। আঙ্গিক শৈলীতে এ-ধরনের অভিনবত্বের পাশাপাশি বিষয়বক্তব্যের জন্য ‘নবান্ন’ স্ক্রলটি অবিস্মরণীয়। এটি মূলত তখনকার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। ‘সোনার বাংলার শ্মশান’ হওয়ার আখ্যান ছিল ‘নবান্ন’ দীর্ঘচিত্র। বছর না ঘুরতেই বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রচন্ড সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে তিন লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বিধ্বস্ত হয় উপকূলীয় জনপদ ও সম্পদ। ’৪৩-এর জয়নুলের পুনর্জাগরণ ঘটল যেন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। ‘মনপুরা ’৭০’ শীর্ষক ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের আরেকটি স্ক্রলচিত্র আঁকেন তিনি। তবে তার আগে ঘটনার জায়গা ঘুরে এসেছেন, ত্রাণকর্মী হিসেবে। ‘মনপুরা ’৭০’ জয়নুলের এক মহৎ কাজের নিদর্শন।  প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে প্রায় সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত মানব জাতির বিপন্ন অবস্থার মহাআখ্যান এই চিত্রটি শক্তিশালী তুলির মোটা রেখা, সঙ্গে মোম ব্যবহার, সাদা কালোতেই বিশেষ তাৎপর্যময়। ‘নবান্নে’র তুলনায় ‘মনপুরা ’৭০’-এর রেখা বলিষ্ঠ।

এই স্ক্রলটি আঁকার পাশাপাশি জয়নুল এই বিষয়-সম্পৃক্ত অনেকগুলো মাঝারি মাপের ছবি এঁকেছেন, যার একটিতে জননেতা মওলানা ভাসানীকে তিনি দুর্গত মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রেও জয়নুল এক পথিকৃতের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সত্তরের আগে বাংলাদেশের কোনো শিল্পী কোনো রাজনৈতিক নেতাকে বিষয় নির্বাচন করে বিশাল পরিসরে তেমন কোনো ছবি আঁকেননি (সাধারণ প্রতিকৃতি হয়তো এঁকেছেন)। পরবর্তীকালে শাহাবুদ্দিন আহমেদ ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীও এগিয়ে এসেছেন বড়মাপের দেশাত্মবোধক ছবিতে নেতার প্রতিকৃতি সংযোজন করে। তবে শুরুটা করেছিলেন জয়নুল।

আধুনিক চিত্রকলায় ‘পারটিসিপেটরি আর্ট’ বা অংশগ্রহণমূলক শিল্পসৃষ্টির একটি ধারণা স্থান করে নিয়েছে। এতে মূল শিল্পীর কাজের সঙ্গে অন্যান্য সহযোগী শিল্পী বা বিশেষ করে দর্শকের একটি ভূমিকা থাকতে পারে। জয়নুল আবেদিন এদেশে এ-ধারার পথিকৃৎ। পঞ্চাশের দশকে আঁকা তাঁর এক অসাধারণ সুন্দর জলরং ছবি ‘বুড়িগঙ্গায় নৌকা’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনের কক্ষে সংরক্ষিত), এতে মূল ছবির চারদিকেই অসংখ্য দর্শকের স্বাক্ষর নিয়েছেন শিল্পী। একই কাজ করেছেন তাঁর মহামূল্যবান ‘নবান্ন’ স্ক্রলচিত্রটিতেও। এক্ষেত্রে অবশ্য ছবির শেষের দিকে অনেকটা জায়গাজুড়ে দর্শকের স্বাক্ষর নিয়েছেন। বড় শিল্পীর কাজে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

জয়নুল পথিকৃৎ ছিলেন শিল্পের বিষয় নির্বাচনেও। অবশ্যই তাঁর মূল প্রেরণা ছিল, প্রাথমিকভাবে নিসর্গ, যা তিনি ধরে রেখেছিলেন জীবনের শেষ পর্যন্ত ‘দুর্ভিক্ষ’ পর্ব থেকে প্রধানত ‘মানুষ’, নানা অবস্থানে, নানা পরিস্থিতিতে মানুষ, কর্মে, বিশ্রামে, প্রসাধনে, দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, প্রেমে, সংগ্রামে ও অর্জনে। তবে জীবন-সংগ্রামে গরুগাড়ির চালক, জেলে, মাঝি, কৃষক, পল্লি নারীকর্মী, আদিবাসী নর-নারী এরাই তাঁর প্রিয় মানুষ। কালেভদ্রে শহুরে মধ্যবিত্ত, যদিও তিনি নিজে ছিলেন তাঁদেরই একজন।

খ.

শিল্পচর্চার নানান দিকে যেমন জয়নুল ছিলেন পথিকৃৎ শিল্প-সংগঠনেও ছিলেন তেমনি মহান পথপ্রদর্শক; বস্ত্তত উদ্যোক্তা ব্যক্তি। বর্তমান নিবন্ধে পরিসরসীমার কথা ভেবে এদিকটায় তেমন অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না, তবে দুয়েকটি বিষয় শুধু উল্লেখ করা যায়।

ইসলাম ধর্মীয় ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় একটি চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল জয়নুল আবেদিনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী সাংগঠনিক অবদান। শুরু থেকেই ঢাকার সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউট ছিল অতি অসাম্প্রদায়িক আধুনিক চেতনাসমৃদ্ধ। অল্পদিনের মধ্যেই চারুকলায় ছাত্রীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। অতিদ্রুত তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণে সমর্থ হয়েছিলেন। শাহবাগে চারুকলার স্থাপত্য ও সাইট পরিকল্পনার আধুনিকতা দৃষ্টান্তমূলক। স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এ-কাজে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন নিজে।

১৯৪৮ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জয়নুল আর যে-একটি কাজ করেছেন, তা হলো তখনকার বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও সাংবাদিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। রীতিমতো আড্ডার আসর ছিল তাঁদের। এতে শিল্পীদের মানসিক বিকাশে যেমন সহায়তা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসারেও তেমনি ভূমিকা রেখেছে। এরকম বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরোয়া আড্ডার ব্যবস্থাও ছিল অগ্রসরচিন্তা।

ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট ছিল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রায় এক বছরের মধ্যে ঢাকা আর্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শিল্পীদের নিজস্ব উদ্যোগ ও আয়োজনে গড়ে তুলেছিলেন একটি সহযোগী আন্দোলন। এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন অবশ্য কামরুল হাসান; কিন্তু গ্রুপের সভাপতি ছিলেন জয়নুল আবেদিন। চারুকলা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা আর্ট গ্রুপ যে বাংলাদেশের শিল্পচর্চা তথা সাংস্কৃতিক বিকাশে কত বড় ভূমিকা রেখেছে, তার যথার্থ মূল্যায়ন অপেক্ষমাণ।

জয়নুল আবেদিনের আরেকটি সাংগঠনিক উদ্যোগ ছিল তাঁর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আহমাদ হাসান দানীর আহবানে সাড়া দিয়ে সে-বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন (১৯৬৫)।

জয়নুল ছিলেন শিল্পী ও শিক্ষক। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা-আন্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নানাভাবে। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত মওলানা ভাসানীর জনসভায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পক্ষে ভাষণ দিয়েছেন। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সরকার-প্রদত্ত সম্মানজনক উপাধি ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ বর্জন করেছেন। এখানেও তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।

শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদিনের অগ্রণী ভূমিকার প্রশংসনীয় উদাহরণ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ, ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠায় তাঁর সর্বাত্মক নেতৃত্ব ও সহযোগিতা ও সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাঁর একনিষ্ঠ মনোযোগ। এসবের বাইরেও অনেক ক্ষেত্রেই তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর অবদানের কিছু স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের হাতের লেখার মূল সংস্করণ অলংকরণের নেতৃত্বদানের। তিনি এদেশের অন্যতম প্রথম জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমির সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন। গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া ‘শিল্পাচার্য’ উপাধিতে সম্মানিত হয়েছেন। এদেশের মানুষ জয়নুলকে শিল্পাচার্য নামে  অভিহিত করতেই পছন্দ করে। তিনি বস্ত্ততই শিল্পাচার্য ও শিল্প-পথিকৃৎ।

২৬ নভেম্বর ২০১৪