অনুবাদ : মুহাম্মদ সামাদ ও আনিসুর রহমান
কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মারের জন্ম স্টকহোমে ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল আর প্রয়াণ এ-বছরের ২৬ মার্চ। ছাত্রজীবন থেকেই সুইডেনের সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে সতেরোটি কবিতা (১৭ উরশঃবৎ) শিরোনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সুইডিশ ভাষার একজন শক্তিমান কবি হিসেবে আবির্ভূত হন। লেখালেখির শুরম্নর সময়ে তিনি সুইডেনের আধুনিকতাবাদী কবিদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষার বিপরীতে সহজ ভাষা ও সরল রচনাশৈলী ব্যবহারের সিদ্ধামত্ম নেন, যা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বব এবং দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানানসই। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে অতীতের সুইডিশ কবিতা থেকে ভিন্নতর। ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার বড় অংশ জুড়ে স্থান পায় প্রকৃতি ও সংগীত। সমগ্র লেখালেখিতে ট্রান্সট্রয়মার বোধের অতিপ্রাকৃত গভীরতা, প্রজ্ঞা আর পৃথিবীকে উপলব্ধি করায় আচ্ছন্ন ছিলেন। বিশ্বের সত্তরটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয় তাঁর কবিতা। তিনি দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। উত্তর ইউরোপের জীবন ও প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে তুলনীয়। অনুবাদও তেমনি দুরূহ। তাই, অনুবাদগুলো মূল সুইডিশ থেকে করা হলেও রবিন ফালটনের ইংরেজি ভাষামত্মরের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনুবাদের অনুমতি
প্রদানের জন্যে ট্রান্সট্রয়মারের সহধর্মিণী মনিকা ট্রান্সট্রয়মার এবং বর্তমান অনুবাদকর্মটির ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার জন্যে উপসালা সাহিত্যকেন্দ্র এবং সুইডিশ আর্টস কাউন্সিলের কাছে অনুবাদকদ্বয় কৃতজ্ঞ।]
যুগল
ওরা বাতি নেভানোর পর ঘরের আলোটা
মিলিয়ে যাবার আগে মুহূর্তের জন্যে ছড়ায় কিঞ্চিৎ আভা –
যেভাবে একটি ট্যাবলেট গস্নস্নাসে জলের অাঁধারে মিশে যায়।
অন্ধকারে হোটেলের দেয়াল আকাশে জেগে ওঠে;
ভালোবাসা আন্দোলিত হয়ে থিতু হয়; তারা নিদ্রা যায়।
তবে, স্কুল-বালকের ছবি অাঁকার খাতার
ভেজা পাতায় ছড়িয়ে পড়া রঙের মতোন
তাদের গোপন ভাবনা মিলিত হয়।
এখন নীরব অন্ধকার!
আজ রাতে শহর অনেক অমত্মরঙ্গ।
জানালায় খিল এঁটে বাড়িগুলো পরস্পর কাছাকাছি হচ্ছে।
ওরা ভাবলেশহীন এক জটলায়
গাদাগাদি দাঁড়িয়ে – অপেক্ষমাণ।
চঞ্চলতা
এক নীরস দিনের শেষে আমি হাইডেনের সংগীত বাজাই
আর হাতে অনুভব করি খানিক উষ্ণতা।
চাবিগুলো তৈরি – বিনীত হাতুড়ি নিচে পড়ে যায়।
ধ্বনিরা সতেজ, সবুজ ও ভরপুর নীরবতায়;
ধ্বনিরা বলতে থাকে – স্বাধীনতা অবারিত আর
কেউ একজন জুলিয়াস সিজারকে খাজনা দেয় না।
হাইডেন-পকেটে ঢোকাই আমার হাত
আর একজন শামত্মশিষ্ট মানুষের মতো চলি।
আমি হাইডেন-পতাকা উড়াই – বার্তা হলো :
‘আত্মসমর্পণ করি না – আমরা শামিত্ম চাই।’
সংগীতেরা যেন পাহাড়ের ঢালুতে কাচের বাড়ি;
পাথর উড়তে থাকে – পাথর গড়ায়;
বাড়ি বরাবর পাথর গড়িয়ে পড়ে – তবে
জানালার শার্সির কাচেরা এখনো অটুট।
১৮৪৪ সালের একটি স্কেচ
আবহাওয়ার পাগলামিতে উইলিয়াম টার্নার্সের মুখ এখন
বাদামি।
সমুদ্রতটে আছড়ে পড়া ঢেউ থেকে দূরে সে ইজেল খাড়া
করে।
আমরা মাটিতে রম্নপোলি-সবুজ রশি ধরে হাঁটি।
অতিকষ্টে সে মৃত্যুপুরীর ঢালু পথ পাড়ি দেয়।
ক্রমাগত রেলগাড়ি আসে এবং নিকটবর্তী হয়।
বৃষ্টি আমাদের ওপর ভ্রমণ করে চলে যায়
পাহাড়ের চূড়া থেকে
আমি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াই আর সমুদ্রে তাকাই।
নৌকোরা বিশ্রাম নেয় ঝলমলে রোদের ওপরে;
জোছনায় পস্নাবিত ঘুমের পথিক আমরা –
এমনটাই বলে সাদা পালগুলো।
আমরা পিছলে পড়ি একটা ঘুমের ঘরে;
বিনয়ে দরজা খুলি;
আমরা মুক্তির দিকে হেলে পড়ি –
এমনটাই বলে সাদা পালগুলো।
আমি জগতের পাল তোলা ইচ্ছেগুলো দেখি –
তারাও একই পথের পথিক।
আমরা এখন অমত্মর্হিত। কারো পাহারায় নয় –
সাদা পালগুলো বলে এমনটাই।
রেললাইন
ঘড়ির কাঁটায় দুটো। জোছনায় ভরা রাত।
রেলগাড়ি থেমে গেছে শস্যের প্রামত্মরে। বহুদূরে একটি
শহর থেকে
আলোর ঝিলিক এসে দিগমেত্ম ঠান্ডায় দোল খায়।
স্বপ্নের গভীর থেকে কেউ যখন চৈতন্যে ফিরে আসে
তখন স্মরণ করতে পারে না
কোথায় ছিল সে।
অথবা যখন কেউ গভীর অসুখে ভোগে
তখন সময়গুলো তার কাছে কিছু জ্বলজ্বলে স্ফুলিঙ্গ কিংবা
ঠান্ডা জলাশয় আর নিষ্প্রাণ প্রামত্মর মনে হতে থাকে।
রেলগাড়ি সম্পূর্ণ নিশ্চল।
জোছনা-পস্নাবিত রাত। ঘড়ির কাঁটায় দুটো। আকাশে নক্ষত্র কিছু…
আখ্যান
ধূসর বৃক্ষের দিকে তাকাও। আকাশ
তার তন্তু বেয়ে দ্রম্নত পৃথিবীতে নেমে গেছে –
কেবল একটি ঘনীভূত মেঘ পড়ে থাকে;
যখন পৃথিবী করে পান।
চুরি হয়ে যাওয়া শূন্যতা ভাঁজে ভাঁজে
সংকুচিত হয়ে শ্যামলিমায় পেঁচিয়ে ওঠে;
আমাদের মাঝে মুক্তির পলকা মুহূর্তগুলো জেগে ওঠে,
বারবার চরকায় ঘুরপাক খায়…
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.