টিকটিকি ও মানুষের ঘরবসতি

আনিসুল হক

টিকি, ঠিকি, ডিকি। তিন বোন। তিন বোনের একটাই ভাই। তার নাম টিকটিকা।
টিকটিকা খুবই দুষ্টুপ্রকৃতির। অস্বাভাবিক ছটফটে। একটা দণ্ডও স্থির থাকতে পারে না।
তবে তার গানের গলা আশ্চর্য সুন্দর। সে যখন গান গায় :
টিক টিক টিক টিক
চারদিকে সব ঠিক

ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক
সবকিছু স্বাভাবিক

টিক টিক ঢিক ঢিক
খোকা হাসে ফিকফিক
তখন তিন বোন তাদের কাজ ভুলে যায়। তারা মুগ্ধ
হয়ে তাদের ভাই টিকটিকার গান শুনতে থাকে। টিকটিকার যে শুধু গানের গলা ভালো তাই তো নয়, তার গান বানানোর ক্ষমতাও বিস্ময়কর। এত অল্প বয়সে এত সুন্দর গান কেউ বানাতে পারবে না।
বাবা বলেন মাকে। আমাদের ছেলেটা তো মনে হচ্ছে বিশাল গায়ক হতে যাচ্ছে। আমাদের এই এলাকার টিকটিকি সমাজে এত বড় ওস্তাদ গাইয়ে আর আসেনি।
মা বলেন, আমারও তো তাই মনে হয়। তবে ওর এই গান না জানি আমাদের জন্য দুঃখ বয়ে আনে।
বাবা বলেন, সে কী কথা। গান কেন দুঃখ আনবে।
মা বলেন, তা তো জানি না। কে যেন কথাটা বলেছিল। মনে হয়, মানুষদের কেউ। শিল্পীদের জীবনে নাকি বড় দুঃখ! যে গান গায়, সে নাকি সুখী হতে পারে না।
বাবা বলেন, এইসব কুলক্ষুনে কথা বোলো না তো। মানুষেরা কী কথা বলেছে, আর তুমি কী শুনেছ, তার কি কোনো ঠিকঠিকানা আছে।
মা বললেন, না না, আমি ঠিক শুনেছি। ওদের মেজছেলেটা ভালো গান গায়। সে একজন বড় কাওয়ালি শিল্পী হতে চায়। তার নাম হায়দার। তার বয়স ১১ বছর। সেদিন কী সুন্দর গান ধরেছিল, দয়াল বাবা কেবলা কাবা আয়নার কারিগর, আয়না বসায় রাখছে কলবের ভিতর। তা শুনে আমি তো টিকটিকি, আমি পর্যন্ত একেবারে বুঁদ হয়ে গেলাম।
বাবা বললেন, সে তো খুব ভালো কথা। তুমি হায়দারের গান শুনে বুঁদ হয়ে গেলে। এর সঙ্গে দুর্ভাগ্যের কী সম্পর্ক?
মা বললেন, তা তো বলতে পারি না।
তাদের আম্মা বললেন, হায়দার, তুই কি শেষতক কাওয়াল হয়ে যাবি?
হায়দার ছেলেটার বড় বড় চোখ, কোঁকড়ানো চুল, পাতলা ঠোঁট, সে বলল, আমি হতে চাই আম্মা।
তখন হায়দারের আব্বা বলল, গানওয়ালা হওয়ার কোশেশ করিস না বেটা। গান জীবনে দুঃখ আনে। আমরা হলাম কারিগরের বংশ। আমি সেলুনে চুল কাটি। তোর আম্মা কারচুপির মজুর। তোর আম্মার হাতের কাজ পুরা ঢাকা শহরে এক নম্বর। কামিজের জন্য সুন্দর সুন্দর ডিজাইন সে বানায়। পুঁতি বসায়। জড়ি-চুমকি বসায়। তুইও হাতের কাজ শিখে নে। তোকে সেলুনে নিয়ে যাব। সেলুনে জোগানির কাজ পাবি।
ওদের আম্মা বললেন, এত ছোট ছেলে সেলুনে কী কাজ করবে?
ওদের আব্বা বললেন, সেলুনে নানান কাজই থাকে বাচ্চালোগদের জন্য। ঘরটা ঝাড় দেওয়া, হাতিয়ারপাতি সাফ করা। কাজের কি সীমা আছে?
হায়দার বলল, আব্বা, আমি গান করতে চাই।
ওদের আব্বা আবার বললেন, আব্বাজান, গান দুঃখ ডেকে আনে।

বাবা টিকটিকিটা মা টিকটিকির সব কথা শুনে বলল, তুমি আবার ওদের আব্বার কথার শেষে টিক টিক বলে ওঠোনি তো?
মা টিকটিকি বলল, কক্ষনো না। আমি টিক টিক বলে উঠলে তো সেই কথা সত্য হয়ে যেত। আমি কেন তা করতে যাব।

বাবা টিকটিকি চার ভাইবোন, টিকি, ঠিকি, ডিকি আর টিকটিকাকে ডাকলেন সন্ধ্যাবেলা। বললেন, আজকে তোমরা নিজের খাবার নিজেরাই জোগাড় করবে। নিজেরা শিকার করতে যাবে। তোমরা বড় হয়ে গেছ।
শুনে তিন বোনের বুক ঢিপঢিপ করে কাঁপতে লাগল। টিকটিকা তো খুশিতে লাফাচ্ছে।
হুর রে, আজ শিকার করতে যাব। টিকটিকা লেজ নাড়ে। গলার রগ ফোলায়। তার চোখ গোল গোল করে।
টিকি বলে, শিকার ধরা সহজ নয়।
টিকটিকা বলে, খুব সহজ। লাইটের কাছে যাব। চুপ করে মড়ার মতো দেয়ালের সঙ্গে লেপ্টে থাকব। যেই একটা পোকা আসবে অমনি ঝাঁপিয়ে ধরব। তারপর খাব। কী মজা।
টিকি বলল, পোকাটা ধরতে গিয়ে যদি দেয়াল থেকে নিচে পড়ে যাই? তখন, ইমা ব্যথা লাগবে না?
টিকটিকা বলল, না না পড়ব কেন? টিকটিকি কোনোদিনও দেয়াল থেকে পড়ে না।
ঠিকি বলল, যদি একটা বড় মাকড়সা আসে। সে যদি একটা বড় জাল পাতে?
টিকটিকা বলল, তাহলে তো আরো মজা হবে। জালে অনেক পোকা আটকে থাকবে। আমাদের কাজ হবে পোকাগুলোকে ধরে ধরে টপাটপ খেয়ে ফেলা।
ডিকি বলল, কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই জালে আটকা পড়ি?
টিকটিকা বলল, মাকড়সার জাল এত শক্ত হয় না। মাকড়সার জালে পোকা আটকায়। টিকটিকি আটকায় না।
টিকি বলল, কিন্তু মাকড়সাটা যদি নিজেই বড় হয়, আর যদি আমাদের মতো বাচ্চা টিকটিকিকে খেয়ে ফেলে?
টিকটিকা বুক চিতিয়ে বলল, মাকড়সা আমার সঙ্গে পারবেই না।
ঠিকি বলল, যদি খুব বড় মাকড়সা হয়। তুই তো ভাইয়া এতটুকুন? মাকড়সা যদি তোকে খেয়ে ফেলে?
টিকটিকা বলল, আরে আমার লেজ আছে না। আমাকে ধরতে এলেই আমি লেজটা দেব খসিয়ে। মাকড়সা আমার লেজটা ধরবে, লেজটা খাওয়ার চেষ্টা করবে। ততক্ষণে আমি পালিয়ে যাব নিরাপদ দূরত্বে।

চার ভাইবোন চলল শিকার ধরতে। দেয়ালের ওপরে একটা ফিলিপস ৬০ পাওয়ারের বাল্ব। সেখানেই তাদের শিকারের পালা চলবে।

নিচে মানুষেরা কাজ করছে। হায়দারের আম্মা কামিজের জন্য হাতের কাজ করছেন। তার চোখে চশমা। হায়দারের আম্মার নাম শবনম। তার বয়স ৩৫। বড় ছেলে আফজাল। বয়স ১৫। মেজ ছেলে হায়দার। বয়স ১১। আর ছোটটা মেয়ে। নাম নূরী। তার বয়স আট। বড় ছেলেটা এরই মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছে। তার খুব ঝোঁক ক্রিকেটের দিকে। সে প্রায়ই ক্রিকেটের গল্প করে। এই ঘরের মধ্যেই একটা ছোট্ট রঙিন টেলিভিশনও আছে। রান্নাবান্নার কাজও এই ঘরটাতেই হয়। শবনম, তার স্বামী জাহাঙ্গীর, তার তিন ছেলেমেয়ে আফজাল, হায়দার, নূরী Ñ সবাই এই একটা ঘরেই থাকে। নূরী মেয়েটা খুবই শান্ত আর কাজের। আম্মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে।
এখন যেমন করছে। নূরী বসে বসে তরকারি কুটছে।

মাথার ওপরে চারটা ছোট ছোট বাচ্চা টিকটিকি শিকার ধরার আশায় ওত পেতে বসে আছে।

একটা একটা করে পোকা বাল্বের আলোর টানে চলে এসেছে। তারা উড়ছে। এখন চুপ করে থাকতে হবে।
কিন্তু টিকটিকা তো মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। সে বলে, আচ্ছা টিকি, বল তো, মানুষেরা কেন রান্না করে খায়? আমরা কেন রান্না করে খাই না?
টিকি বলে, চুপ। আমরা কথা বললে একটা পোকাও আর কাছে আসবে না।
টিকটিকা বলে, আমার প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা নাই। তা স্বীকার করে নিলেই পারো।
ঠিকি বলল, এই রে, পোকাটা প্রায় কাছেই এসেছিল। কথা শুনে ভয়েই চলে গেল।
টিকটিকা বলল, আসলে মানুষ হলো অসভ্য প্রাণী। তাই তারা সবকিছু রান্না করে খায়।
ডিকি বলল, যাহ। সভ্য হলেই না প্রাণীরা রান্না করে। মানুষ হলো সভ্য। তাই তারা রান্না করে খায়।
টিকটিকা বলল, কক্ষনো না। আমরা তো পোকা খাই। তাই বলে আমরা কি পোকাটাকে ধরে মেরে ফেলে তাকে পোড়াই? স্যাকা দিই? আগুনে ঝলসাই? আমরা কখনো আমাদের শিকারকে কষ্ট দিয়ে মারি? মানুষ হলো অসভ্য। তাই তারা এমন করে।
টিকি বলল, এই চুপ কর তো টিকটিকা। একেবারে চুপ। এখনো একটা শিকারও আমরা ধরতে পারলাম না। আব্বা এসে দেখলে কী রকম বকা দেবেন?

এই সময় বাইরে হল্লাচিল্লা শুরু হলো।
শবনম উঠলেন। কী হলো আবার এই ক্যাম্পে?
বাইরে থেকে ফিরে এলেন তিনি খানিক পরে।
নূরী বলল, কী হইসে আম্মা?
শবনম বললেন, আরে বুঝলাম না। মনে হয়, ওই পাশের বস্তিতে কারেন্ট নিতে চায়। আমাদের ক্যাম্প থেকে লাইন নিতে চায়। তাই নিয়া ফ্যাসাদ।
নূরী বলল, আমার কেমন ডরডর লাগে আম্মা।
শবনম বলল, ডরের কী হলো?

বাবা টিকটিকি আর মা টিকটিকি এই বিষয়টা নিয়ে গল্প করছেন।
টিকি, ঠিকি, ডিকি আর টিকটিকা সেই গল্প শোনে। তারা কথা বলে না। এটা বড়দের গল্প।
বাবা টিকটিকি বলেন, এই ঘরটা যেমন আমাদের ঘর হয়েও আমাদের ঘর না। এটা আসলে মানুষের বানানো ঘর। আমরা এখানে আশ্রিত। তেমনি এই যে পাড়াটা, এইটার বাসিন্দারা এই পাড়াতে থাকলেও এই পাড়াটা তাদের না। তারাও আশ্রিত।
মা টিকটিকি বলেন, তা কী করে হয়?
বাবা বলেন, হয়। কারণ এরা বিহারি।
মা টিকটিকি বলেন, বিহারি মানে?
বাবা টিকটিকি বলেন, এরা এই দেশের অরিজিনাল না। এরা এসেছে বিহার থেকে। এদের ভাষা বাংলা না।
মা টিকটিকি বলেন, কিন্তু আমি তো এদের বাংলা বলতেই শুনি।
বাবা টিকটিকি বলেন, শুনবেই তো। এই যে নিচে রান্না করছে শবনম, তার বয়স কত। ৩২ হবে বড়জোর। তার মানে বাংলাদেশ হওয়ারও ১১ বছর পরে তার জন্ম। আর এই যে বাচ্চা মেয়েটা, নূরী, তার বয়স আট।
মা টিকটিকি বলেন, তাহলে তো তারা বাংলাদেশেরই।
বাবা টিকটিকি বলেন, তা হতে পারে, কিন্তু এদের দাদা, কিংবা দাদার বাবা, ইন্ডিয়া থেকে এই দেশে এসেছিল। কারণ তখন ইন্ডিয়া ভাগ হয়ে দুটো দেশ হলো। ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান। এরা ইন্ডিয়া ছেড়ে এলো, কারণ তারা মনে করল, ইন্ডিয়া তাদের দেশ না। কারণ তারা মুসলমান। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান।
মা টিকটিকি বললেন, তারা কি ইচ্ছা করে এসেছিল?
বাবা টিকটিকি বললেন, না ইচ্ছা করে আসেনি। বাধ্য হয়ে এসেছিল। কারণ রায়ট লেগে গিয়েছিল। বিহারে অনেক বড় রায়ট হয়। সেখানকার মুসলমানরা মার খেয়ে কলকাতা আর পূর্ব বাংলায় চলে আসে।
মা টিকটিকি বললেন, মার খেয়ে চলে এসেছে। চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।
বাবা টিকটিকি বললেন, কিন্তু এই পূর্ব বাংলা কিছুদিনের মধ্যেই আর পাকিস্তান থাকতে চাইল না। তারা বলল, আমরা বাঙালি। আমাদের দেশ হবে বাংলাদেশ। তখন উর্দুওয়ালা বিহারি বা ভারতীয়রা পড়ল মুশকিলে। ভারত তাদের দেশ নয়। পূব পাকিস্তানও তাদের দেশ নয়। তাহলে তারা যাবে কোথায়? তারা বলল, আমাদের করাচি নিয়ে যাও। খুব যুদ্ধ হলো বাঙালি আর পাকিস্তানিদের। বিহারিরা বেশির ভাগই পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নিল। কিন্তু কোনো কোনো বিহারি মুক্তিযুদ্ধে যোগও দিলো। কোনো কোনো বিহারি মুজিবের পক্ষে রইল। কবিতা লিখল। যাই হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। তখন বিহারিরা পড়ল মুশকিলে। পাকিস্তানে যেতে চায় তারা। পাকিস্তান তাদের নেয় না। বাঙালিরা তাদের দেখতে পারে না। ভারতে ফিরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা দেশহীন মানুষ হয়ে রইল। এই যে শবনম, তার স্বামী জাহাঙ্গীর, এই যে আট বছরের নূরী, এই যে হায়দার, আফজাল Ñ এরা হলো তেমনি মানুষ। এদের কোনো দেশ নাই।
মা টিকটিকি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি, আফজাল ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সাপোর্ট করে। সে বাংলাদেশের জাতীয় দলে চান্স পাবে, এই স্বপ্নের কথা বলে বেড়ায়।
বাবা টিকটিকি বললেন, সে তো আমিও জানি। আমরা হলাম টিকটিকি। আমরা হলাম ত্রিকালদর্শী। কী ঘটবে, না ঘটবে, তা আমরা আগে থেকেই জানি। তাই তো আমরা মানুষের কথা শুনে যদি বুঝি এটা ঠিক কথা, তখন ঠিক ঠিক বলে ডেকে উঠি।
টিকি, ঠিকি, ডিকি, টিকটিকা সব শুনে কিছু বুঝল। কিছু বুঝল না। তারা খুব মন খারাপ করে রইল।

তখন টিকটিকা করুণ সুরে গান গাইল :

‘আমি কেন টিকটিকি হইলাম?
পাখি হয়ে জন্ম নিলে কত ভালো রহিতাম।
আমি কেন টিকটিকি হইলাম।

টিকটিকিরা সবই জানে মনে তাদের দুখ।
সকল কথা জানলে পরে রয় না মনে সুখ।
পরের জায়গা পরের জমি তাতে কেন রহিলাম?
আমি কেন টিকটিকি হইলাম।

শুনে মা টিকটিকি বলল, এমন করে গান করিস না টিকটিকা। গান দুঃখ ডেকে আনে।

রাত বাড়ল।
হায়দার ফিরে এলো বাড়িতে। আফজাল এলো। তাদের আব্বা জাহাঙ্গীর ফিরে এলেন। তারা সবাই মিলে গোল হয়ে খেতে বসল।
শবনম বললেন, আমার কেমন যেন ডরডর লাগে। কারেন্টের লাইন নিয়া মনে হয় ক্যাম্পে কাজিয়া ফ্যাসাদ হইতেসে।
হায়দার বললেন, আরে আমাদের এই জায়গাটার ওপরে চোখ পড়সে। এখন তো জমি সোনার চাইতেও দামি। কোনো রকমে আমাদের ক্যাম্পটা তুইলা দিতে পারলে কত কোটি কোটি টাকা পাইব।
আফজাল বলল, কে আসবে আমাদের ক্যাম্প তুলতে? আসুক না। ব্যাট দিয়া পিটায়া তক্তা বানায়া দেব।

বাইরে চাঁদ উঠেছে। নীরব-নিথর রাত। ভেতরে পাঁচটা মানুষ শুয়ে পড়েছে। মশারির নিচে সবাই। নিজের নিজের আড়াল তৈরি করে নিয়েছে। এরই মধ্যে হায়দার গান ধরল :

পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানায়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।

টিকটিকি পাঁচ জনও ঘুমিয়ে পড়েছিল।
চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল মা টিকটিকির।
তিনি বুঝে ফেললেন বিপদ। গান দুঃখ বয়ে নিয়ে এসেছে।
ঘরে আগুন লেগে গেছে। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। তিনি বাবা টিকটিকিকে ডাকতে লাগলেন। এই জাগো জাগো, ঘরে আগুন লেগেছে। পালাতে হবে। বাচ্চাগুলোকে ডেকে তোলো।
টিকি ওঠ।
ঠিকি ওঠ।
ডিকি ওঠ।
টিকটিকা ওঠ।
কী হয়েছে মা?
আগুন। আগুন। আমাদের পালাতে হবে। তা না হলে আমরা সবাই মারা মরব।
টিকি আর ঠিকি। তোরা আমার পিঠে ওঠ।
ডিকি আর টিকটিকা তোরা দুজন তোদের বাবার পিঠে ওঠ।
টিকি আর ঠিকি মার পিঠে উঠল।
ডিকি তার বাবার পিঠে উঠল।
টিকটিকা বলল, আমি নিজেই দৌড়াতে পারব। আমাকে পিঠে নিতে হবে না।
মা টিকটিকি আগে আগে ছুটছেন। দেয়াল বেয়ে। ওইদিকে আগুন। বিপরীত দিকে যেতে হবে। পিঠে টিকি আর ঠিকি।
বাবা টিকটিকি তার পেছন পেছন ছুটছেন। তার পিঠে ডিকি।
টিকটিকা ছুটছে তার পেছনে পেছনে।
আগুন। উফ। এত তাপ। এই বুঝি টিকটিকিগুলো পুড়ে কাবাব হয়ে যায়।
তারা জানালার ধারে এসে পড়েছে। এখনই তারা বেরিয়ে যেতে পারবে জানালাপথে বাইরে। ভেতরে ঘরের ভেতরে মশারি পুড়ছে। বিছানা পুড়ছে। কামিজের স্তূপ পুড়ছে। টেলিভিশন পুড়ছে। চকি পুড়ছে। ক্রিকেট ব্যাট পুড়ছে। চাল পুড়ছে। আটা পুড়ছে।
বাবা টিকটিকি আগে আগে ছুটে মাটিতে নেমে পড়েছেন।
মা টিকটিকি তার পেছনে।
টিকটিকা কই? সে দেয়াল থেকে পড়ে গেছে। ব্যথা পেয়েছে। সে আর দৌড়াতে পারছে না। আগুন তার দিকে ধেয়ে আসছে।
মা টিকটিকি বললেন, টিকি তুই নাম। ঠিকি, তুইও নাম। তোরা বাবার পিঠে চড়। আমি টিকটিকাকে আনতে যাই।
মা ছুটে গেলেন একা একা। টিকটিকা কাঁদছে, আমার পা ভেঙে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। মা আমাকে বাঁচাও।
মা গেলেন কাছে।
কিন্তু পৌঁছাতে পারলেন না। কোত্থেকে আগুনের একটা হল্কা এসে লাগল টিকটিকার লেজে। লেজ খসে পড়ল।
টিকটিকা ভাঙা পা নিয়ে চেষ্টা করছে এগোতে। সে বলল, আমি বলেছিলাম কিনা, মানুষ একটা অসভ্য প্রাণী। তারা তাদের শিকারকে আগুনে পুড়িয়ে খায়।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আগুন তাকে ঘিরে ধরল।

মা টিকটিকি ছুটে গেলেন তার কাছে। বললেন, তুই আমার পিঠে চড়। আমি দেখি কী করতে পারি। আগুন পেরিয়ে আসতে গিয়ে তার গায়ের একটা অংশ ঝলসে গেছে।

মা টিকটিকাকে পিঠে নিয়ে ছুটছেন।

মা উঠে গেলেন আরেক পাশের দেয়ালে। উঠে গেলেন ছাদে। নিচে আগুন। এই আগুনটা পার হতে হবে। তারপর তিনি ছাদ থেকে লাফ দেবেন।

লাফ দিলেন তিনি। নিচে পড়লেন। পিঠে টিকটিকা।
নিচে পড়েই তার বুক গেল থেঁতলে। ওখানেই পড়ে রইলেন তিনি।
টিকটিকা বেঁচে গেল।
বাবা বললেন, টিকটিকা পালা।
টিকি বলল, ভাইয়া পালা।
ঠিকি বলল, ভাইয়া পালা।
ঢিকি বলল, পালাও।
টিকটিকা বলল, না, মাকে রেখে আমি যাব না। তোরা যা।
বাবা বললেন, তোদের মা মারা যাচ্ছে টিকটিকা। তার জন্য বসে রইলে আমরা সবাই আগুনে পুড়ে মারা যাব। পালা।
মা বললেন, তোদের পায়ে পড়ি। তোরা পালা। তোরা বেঁচে থাকলেই আমি সুখী হবো। পালা।
বাবা জোর করে টিকটিকাকে পিঠে তুলে নিলেন।
ওরা সবাই নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছে। পেছনে ওদের মা টিকটিকির গায়ে আগুন লেগে গেছে।
আর ভেতরে পুড়ছে বালিশ। তার ওপরে নূরীর মাথা।
ভেতরে পুড়ছে বালিশ। তার ওপরে শবনমের মাথা।
ভেতরে পুড়ছে বালিশ। তার ওপরে হায়দারের গানের গলা।
ভেতরে পুড়ছে কাঁথা। তার ওপরে আফজালের ক্রিকেট ব্যাট আর বল আর বল ঘোরানোর কনুই।
ভেতরে পুড়ছে কাঁথা। তার নিচে শবনম। তার চামড়া। তার হাড়। তার হাতের কারুকার্য।
পুড়ছে জাহাঙ্গীর। তার চুলকাটা হাত দুটো।
নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে টিকি, ঠিকি, ডিকি। তাদের বাবা। আর টিকটিকা। তারা আরেকটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।
সেই ঘরের মানুষগুলো ঘুমাতে পারছে না। খেতে পারছে না। কাজ করতে পারছে না। তাদের আশঙ্কা, এই ঘরেও আগুন দেওয়া হবে।
টিকটিকার মনে অনেক দুঃখ। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মা মারা গেছেন। তার মনে হচ্ছে, সে একটা গান গায়।
মা তুমি কেন আমাকে বাঁচাতে গেলে?
আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে তো মরে গেলে।
কিন্তু সে গান গাইবে না। কারণ গান দুঃখ ডেকে আনে। টিকটিকির চোখে জল আসে না। কিন্তু টিকটিকা চাইছে তার চোখ ফেটে জল গড়াক।