ডায়াসপোরা সাহিত্য : উত্তর আমেরিকায় বাঙালি

হাসান ফেরদৌস
প্র
থমেই বলে নিই প্রবাসী সাহিত্য বলে সাহিত্যের আলাদা কোনো শাখা বা বিশেষ কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই। এখানে যে-সাহিত্যধারা নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি, সেখানে প্রবাসী শব্দটি শুধু অবস্থানগত বা লোকেশন অর্থে। বাঙালি দেশে-বিদেশে যেখানেই গেছে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতকে সে ধারণ করে থেকেছে। এটি তার অসিত্মত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সাহিত্য ও সংগীত রয়েছে তার ডিএনএতে।
প্রবাসে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে সাহিত্যচর্চা খুব পুরনো ব্যাপার। মনে পড়ছে অতুলপ্রসাদ সেনের কথা। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী এই খ্যাতনামা গীতিকার নিজের কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেন বাংলা থেকে অনেক দূরে লখনৌতে। সেখানে তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। দীর্ঘদিন প্রবাসী হলেও অতুলপ্রাসাদ নিজেকে কখনো প্রবাসী ভাবেননি, নিজেকে বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ পর্যমত্ম স্বীকার করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ধারা ধরে রেখেছিলেন অতুলপ্রসাদ। ১৯২২ সালে বেনারসে প্রথম প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবিগুরু, তিনি স্বমুখে প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
আমরা যাঁরা প্রবাসে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছি, গুণগত অর্থে অতুলপ্রসাদের চেয়ে আমাদের অবস্থান মোটেই ভিন্নতর নয়। যতদিনই দেশের বাইরে থাকি না কেন, নিজেদের কখনোই আমরা উন্মূল বলে ভাবি না। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে, অথচ স্মৃতিতে-চেতনায় অহর্নিশ আমরা বহন করি স্বদেশকে। ফলে, যখন সাহিত্যচর্চায় প্রবৃত্ত হই, অনিবার্যভাবে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে স্বদেশ। এর দুটি কারণ রয়েছে বলে আমি অনুমান করি। প্রবাসে আমাদের যে যাপিত জীবন, তা কখনোই আমাদের চৈতন্যের নিকটবর্তী হয় না, নির্বাচিত নতুন দেশকে আমরা রাজনৈতিক অথবা ব্যবহারিকভাবে গ্রহণ করলেও তার জীবনচর্চা ও নৈয়ায়িক অভিজ্ঞতা আমাদের সহজাত হয়ে ওঠে না। অন্য কারণ, সব সাহিত্যেই স্মৃতি একটি প্রধান অবলম্বন। বাঙালি যখন কলম তুলে নেয়, তার স্মৃতিতে ফিরে আসে ফেলে-আসা শৈশব অথবা অপূর্ণ যৌবন।
এটি যে কেবল বাঙালিদের বেলায় প্রযোজ্য, তা মোটেই নয়। প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যদের জন্য তাদের স্বদেশ একটাই, ফেলে-আসা স্বদেশভূমি, যা সে স্মৃতিতে, বুকের ভেতর, তার সযত্নে লালিত চৈতন্যে টিকে থাকে। এই স্মরিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই রচিত হয় ডায়াসপোরা সাহিত্য।
উদাহরণ হিসেবে ভাবুন পোলিশ লেখক আইজাক সিঙ্গারের কথা। ১৯৩৫ থেকে ১৯৯১ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যমত্ম সিঙ্গার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন, অথচ এই পুরো সময় তিনি তাঁর শৈশবের ভাষা ইড্ডিসে লিখেছেন, এবং তাঁর রচনার বিষয়বস্ত্ত হিসেবে অনিবার্যভাবে তাঁর যাপিত ও স্মরিত জীবনের গল্পই করে গেছেন। অথবা রুশ লেখক আইভান বুনিন, তিনিও দীর্ঘ প্রবাস-জীবনে রুশ ভাষাতেই লিখেছেন, সেসবের অধিকাংশই ফেলে-আসা স্বদেশের স্মৃতি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলা ভাষায় কি কোনো ডায়াসপোরা সাহিত্য রয়েছে? আলোচনার সুবিধার্থে ডায়াসপোরা কথাটির একটি ব্যবহারিক সংজ্ঞা দেওয়া যাক। ডায়াসপোরা শব্দটি গ্রিক, যার অর্থ বীজের ছড়িয়ে-পড়া। নিজ দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ভিন্ন স্থানে বসতি গড়েছে, এমন লোকদেরই আমরা ডায়াসপোরার মানুষ – দেশহীন মানুষ বলে চিহ্নিত করতে পারি। হিব্রম্ন বাইবেল বিশ্বের প্রথম ডায়াসপোরা সাহিত্য বলে বিবেচিত হয়, কারণ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের হাতে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
ডায়াসপোরার এই মৌল সংজ্ঞা পরবর্তীতে সম্প্রসারিত হয়েছে। শুধু বাধ্য হয়ে যারা দেশ ছেড়েছে, তারাই নয়, যারা স্বেচ্ছায় ভাগ্যান্বেষণে অথবা অন্য কারণে দেশামত্মরি হয়েছে, তারাও কার্যত ডায়াসপোরার অংশ। অন্য কথায়, নিজ দেশের বাইরে যারাই স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে, তারাই এই ডায়াসপোরার অংশ। সেই অর্থে আমরা, যারা দেশের বাইরে, অর্থাৎ এই উত্তর আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত, তাদের সৃষ্ট সাহিত্য ডায়াসপোরা সাহিত্যেরই অংশ। সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, জিয়া হায়দার হাসান বা মনিকা আলী, এঁরা প্রত্যেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরার সদস্য, তাঁদের নির্মিত সাহিত্য সে ডায়াসপোরার প্রতিবিম্ব। চিমত্মায় ও অভিজ্ঞতায় আমত্মঃমহাদেশীয় হওয়া সত্ত্বেও, এঁদের প্রত্যেকের সব অর্থপূর্ণ সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে ‘বাসভূমি’র ধারণাটি।
মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে আরো একটি বিষয়ের নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। নির্বাসিত, অর্থাৎ exiled, এবং উন্মূল বা diasporic সাহিত্য, এই দুয়ের মধ্যে একটি গুণগত প্রভেদ রয়েছে। বিশ শতকের আগে, স্বেচ্ছা অভিবাসন যখন তার গুচ্ছ চরিত্র অর্জন করেনি, ডায়াসপোরার সদস্য এক বা একাধিক বিচ্ছিন্ন জনপদে আশ্রয় গ্রহণ করলেও অমত্মর্গত অর্থে তাদের সত্তা ছিল একরৈখিক। তারা সবাই যার-যার ফেলে-আসা জনপদের নাগরিক, সেই জনপদে প্রত্যাবর্তন প্রতীক্ষা তাদের সবাইকে যূথবদ্ধ করে। তাদের প্রত্যেকের থাকে অপস্রিয়মাণ যাপিত জীবনের
কোনো-না-কোনো প্রতীক চিহ্ন, কোনো ছবি, ভাঙা সুটকেস, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো অলংকার, অ্যাডওয়ার্ড সায়ীদ যাকে ‘ইন্টিমেট মেমেন্টোস অফ দি পাস্ট’ নামে অভিহিত করেছেন। নির্বাসিত ডায়াসপোরার লেখক সে-মেমেন্টোকেই তাঁর নির্মিত সাহিত্যে অবিরত ধারণ করেন।
অন্য কথায়, বিগত স্মৃতি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আকুলতা, এমনকি যখন সে-প্রত্যাবর্তন যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়, তখনো ডায়াসপোরা সাহিত্যের কেন্দ্রে তা প্রোথিত থাকে। স্বদেশের এই ধারণাটি কোনো বিমূর্ত চেতনা নয়, এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক চরিত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিজ শহর, গ্রাম অথবা বাসগৃহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
অন্যদিকে বিশ-একুশ শতকের ডায়াসপোরার সদস্যের বাসভূমের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বারবার স্মৃতিতে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজন নেই, প্রত্যাবর্তন তার জন্য দুর্লঙ্ঘ্য কোনো বাস্তবতা নয়। এমনকি তার কাছে স্বদেশের ধারণাটিও পরিবহনক্ষম ও স্থানামত্মরযোগ্য একটি অভিজ্ঞতা, বই অন্য কিছু নয়। ‘অনুপস্থিতি’র বেদনা তাঁকে নিত্যদিন বহন করতে হয় না, বরং, তার জন্য অধিকতর নিকট-সংকট সৃষ্টি করে নির্বাচিত বাসভূমির সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েনেশন। এই কারণে, আমার বিবেচনায়, বিশ-একুশ শতকীয় ডায়াসপোরিক লেখকের চরিত্র যতটা না উন্মূল, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিবাসীয়। তাই আধুনিক ডায়াসপোরা যতটা দৈহিক/ ভৌগোলিক, তার চেয়ে অধিক মানসিক।
এই দুয়ের তারতম্য নির্দেশের জন্য বাঙালি কবি দাউদ হায়দারের কথা বিবেচনা করা যাক। দাউদ একজন নির্বাসিত লেখক, তাঁর দেশত্যাগ স্বেচ্ছায় নয়, সকল নির্বাসিত লেখকের মতো তাঁর প্রায় প্রতিটি উলেস্নখযোগ্য কবিতাতেই রয়েছে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নিরমত্মর অপেক্ষা ও রক্তক্ষরণ। নির্বাসনের প্রথম দশকে লেখা তাঁর কবিতার এই কয়েকটি বাক্য লক্ষ করুন :
হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দেখাব বলে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষমাণ –
এক যুগ কেটে গেল, কলকাতায়
এখনো আশা বসে আছি
যদি কেউ ফেরাত সস্নেহে, পিতৃদেশে।
এর প্রায় তিরিশ বছর পরেও, দাউদের কবিতায় শুনি সেই একই নিয়ত নির্বাসনের বিষাদময় রোদন :
আনত নদীর বুকে
বরষা-আকাশ সুখে
ঝরে অবিরাম
পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমে
বিদ্যুৎ যায় থেমে
শুনি শুধু তোমা-নাম।
বলা বাহুল্য, এই তোমা-নাম বাংলাদেশের, অন্য কারো নয়। নির্বাসিত লেখক কেবল স্মৃতিতে তাঁর ফেলে-আসা স্বদেশকে আবক্ষ ধারণই করেন না, নিরমত্মর অপেক্ষা করেন সেই পিতৃভূমে প্রত্যাবর্তনের। আধুনিক বাঙালি ডায়াসপোরিক লেখকের অবস্থান ভিন্ন, তিনি স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করেছেন এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তন তাঁর জন্য কোনো বন্ধ দরোজা নয়। তা সত্ত্বেও সাহিত্য নির্মাণকালে তাঁকেও অনিবার্য নিয়তির মতো ফিরে যেতে হয় সেই স্বদেশেই। ইকবাল হাসান প্রায় চলিস্নশ বছর প্রবাসে, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে, পরে কানাডায়। নিয়মিত দেশেও ফিরেছেন। অথচ কাব্য-রচনার সময় তাঁর অবিরত, অনিঃশেষ খেদ এই বিষয়ে যে, কেন, কোন যুক্তিহীন নিয়তির করাল-কোপে তাঁকে দেশের বাইরে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
সবকিছু ছেড়ে কেন এখানে এসেছি? এত দূরে?
কথা ছিল, জ্যোৎস্নার চিত্রকলা আমাকে শেখাবে
প্রতিশ্রম্নতি ভুলে গেছে পূর্ণিমার ধবল বিস্তার
অসহ্য এখন এই অন্ধকার, বিরুদ্ধবাদিতা।
(‘জ্যোৎস্নার চিত্রকলা’)

নির্বাসিত লেখক তাঁর নির্বাসনকে অনিবার্য নিয়তি বলে মানেন না এবং সেই কারণে তাঁর নতুন আশ্রয়স্থলকে কেবল একটি অস্থায়ী ঠিকানা ভিন্ন অন্য কিছু ভাবেন না। কিন্তু উন্মূল বা ডায়াসপোরিক লেখক এক সময় এই সত্যতে নির্দিষ্ট হন যে, এই নতুন ঠিকানাই তাঁর একমাত্র স্থায়ী নিবাস, কারণ এখানে লালিত হচ্ছে তাঁর আত্মজবৃন্দ। পশ্চাতে ক্রমঃঅপস্রিয়মাণ স্বদেশ তাঁর স্মৃতিকে তাড়িত করে, কিন্তু তাঁর স্মৃতির বাক্সে রয়েছে নতুন বাসভূমের অনেক দৃশ্যকাব্য। স্বেচ্ছা অভিবাসন হেতু তাঁর স্মরিত জীবন ও যাপিত-জীবন, এই দুয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। থাকার কথা নয় কোনো বৈপরীত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই অপরাধবোধ থেকে অভিবাসী বাঙালি লেখকের পরিত্রাণ নেই, যে-বাসভূমিকে নতুন স্বদেশ বলে তিনি নির্বাচন করেছেন, সে-সিদ্ধামত্ম আসলে একইসঙ্গে স্বদেশভূমি ও নির্বাচিত নতুন বাসভূমির প্রতি প্রতারণা। কারণ একথা তিনি নিশ্চিত জানেন, এই বিদেশ, এই পরবাস কখনোই তাঁর আপন হবে না।
নিউইয়র্ক প্রবাসী কবি শামস আল-মমীনের এই কবিতাটি লক্ষ করুন :
সংসারে করে নিত্য
নরোম চাঁদের আলো। তুমি
শুনবে না ফেরিওলার মচমচা ডাক, পাখিদের
কিচির মিচির কিম্বা বলের পেছনে ধাবমান বালকের
একরোখা দৌড়।
ফ্রেমে বাঁধা নীরব ছবির মতো বড়
হবে ছেলেমেয়ে। প্রতিবেশীর অসুস্থ প্রীতি
ওদের কোমল মুখে ছায়া হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
এদেশ সোনার, অফুরমত্ম ফসলের এবং সম্ভাবনা;
কিন্তু এর কতটা তোমার।
কোনো-কোনো লেখকের জন্য, দীর্ঘ প্রবাস-জীবনের পরেও প্রবাস শুধু পরবাসই হয়ে থাকে। যাপিত জীবনে তাঁরা সর্বার্থেই প্রবাসী, অথচ কলম হাতে তাঁরা অনবরত কেবল সেই জীবনের কথাই বলেন, যা তাঁর দূরায়ত স্মৃতির গহবর থেকে তুলে আনা। বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি শহীদ কাদরী, প্রায় চার দশক তিনি দেশের বাইরে, তাঁর সকল স্মৃতি ও নির্মাণের প্রায় অনিবার্য লক্ষ্য ও পরিণতি এখনো ফেলে-আসা স্বদেশ। আর নতুন কিছু বলার নেই, এই অভিমান থেকে তিনি দীর্ঘকাল কবিতা রচনা থেকে বিরত ছিলেন। অবশেষে, প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে যখন কলম তুলে নিলেন, কবিতা হলো তাঁর আক্ষেপ ও ক্ষতের শুশ্রূষা। যে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ তিনি নিউইয়র্কে বসে লিখেছেন, আমার
চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও, তাও সেই অবিনাশী স্বদেশকে প্রণত পুষ্পাঞ্জলি। কেন তিনি দীর্ঘকাল এই স্বনির্বাচিত নির্বাসনে, যার অবসান তাঁর নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে নয়, সে-উদ্বেগ ও অসমর্থতা কবিকে কুরে-কুরে খায়। তাই তাঁর স্বগতোক্তি :
কোন নির্বাসনই কাম্য নয় আর
ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে
পুকুরের যৌথ সণান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুমে
… … …
কাম্য নয় আপন ভদ্রাসন থেকে ভাড়াটে-ফ্লাটে
এই স্বাদু শোল মাছের ঝোল থেকে
স্বাদমুক্ত চিকেন সুপ আর ডিনার রোলে –
না, কোন নির্বাসনই কাম্য নয় আর।
লক্ষ করুন, কবি এই কবিতার প্রতি স্তবকে নির্বাসন কাম্য নয় আর এই ধুয়া বা রিফ্রেইন ব্যবহার করেছেন। নির্বাসন, বিদেশে আশ্রয় গ্রহণ এই অর্থে একসময় যদি তা কাম্য অথবা গ্রহণযোগ্য হয়েও থাকে, এখন আর তা কাম্য নয়। এই মনস্তাপ ও বিষাদিত উচ্চারণ রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন ছত্রে, রোমকূপে।
একই বিষাদময় মনস্তাপ দেখি বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রধান লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের রচনায়। দূরদেশ স্বদেশ এই নামের গদ্যগ্রন্থে সে মনস্তাপের অসংকোচ উচ্চারণ রয়েছে। গত পনেরো-বিশ বছরে প্রায় একডজনের মতো গল্পগ্রন্থ লিখেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, যেখানে বারবার তিনি ফিরে গেছেন শুধু তাঁর স্মরিত জীবনে। এ-যেন এক অনিঃশেষ অনিবার্য প্রত্যাবর্তন, যা শুধু একজন লেখকের করোটি ও ব্যক্তিগত চৈতন্যে অহর্নিশ জেগে থাকে, যার এক ধরনের পরিণতি দেখি তাঁর স্মৃতিকথা, শৈশবের সাদা দেয়াল গ্রন্থে। বস্ত্তত, প্রায় সাড়ে চার দশক স্থায়ী তাঁর প্রবাস জীবনে জ্যোতিপ্রকাশ অনবরত ফিরে গেছেন চোখে-দেখা দৃশ্য স্মৃতির রূপামত্মরে, অথবা তার পাত্রামত্মরে। তাঁর গল্পগ্রন্থ ফিরে যাও জ্যোৎসণায়, উড়িয়ে নিয়ে যা কালমেঘ, অথবা জলপরী তো নাচবেই, তাতে বর্তমান যে নেই, তা নয়, কিন্তু বর্তমানকে বোঝার জন্যও তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় স্মৃতিতে। যেহেতু তাঁর অধিকাংশ লেখাই প্রতীকী, সরাসরি না বলে তিনি ইঙ্গিতে নিজের কথাটি বলে যান, ফলে অনেক সময়ই স্মৃতি ও সম্মোহনের এক দোলাচলে তিনি বাস্তবতার পরিলেখটি নির্মাণ করেন।
পূরবী বসুর ছোটগল্পেও দেখি স্মরিত জীবনে পুনঃপুন প্রত্যাবর্তন। তাঁর গল্পগ্রন্থ জোছনা করেছে আড়ি বা নিরুদ্ধ সমীরণে সে-কথার সাক্ষ্যভাষ্য রয়েছে। রাজনৈতিক-সচেতন নাগরিক তিনি, কিন্তু দীর্ঘ প্রবাস সত্ত্বেও তাঁর নির্বাচিত নতুন বাসগৃহ, নতুন দেশ তাঁকে খুব সামান্যই আন্দোলিত করে। আত্মজদের অভিজ্ঞতা তাঁর রচনায় যে নেই, তা নয়, কখনো-কখনো প্রবাসী অভিজ্ঞতাকে তিনি সাহিত্য নির্মাণের উপজীব্য করেছেন, কিন্তু দেশ ও বিদেশ, স্বদেশ ও প্রবাস – এই দুই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন-ভিন্ন দুটি কম্পার্টমেন্টে মুড়ে রাখায় তিনি অভ্যস্ত। বিপরীত ও বিরুদ্ধ এই দুই বাস্তবতা কোনো বিশেষ দ্বন্দ্ব বা আততির কারণ ঘটায় না।
স্মরিত ও যাপিত জীবন, সাহিত্য নির্মাণের জন্য এই দুই রসদ ছাড়া লেখকের তূণে রয়েছে তৃতীয় একটি তীর। আমি তাকে বলব উপলব্ধ জীবন। উন্মূল লেখকের জন্য এই তৃতীয় জীবন – যা বস্ত্তত স্মরিত ও যাপিত জীবনের সংশেস্নষণ – ক্রমশ সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর প্রধান আশ্রয় ও অবলম্বন। স্মরিত জীবন তাঁকে পিছে নিয়ে যায়, যাপিত জীবন তাঁকে ঠায় দাঁড় করিয়ে দেয় বর্তমানে। এই দুই অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় উপলব্ধ জীবন।
দিলারা হাসেম সম্ভবত সেইসব লেখকের একজন, যিনি প্রবাসী অভিজ্ঞতাকে তাঁর সাহিত্যের একটি কেন্দ্রীয় পটভূমি হিসেবে সচেতনভাবে নির্বাচন করেছেন। প্রবাস জীবনের প্রথম দুই দশক তাঁর সাহিত্যে স্মরিত জীবনই কেন্দ্রীয়। যেমন স্তব্ধতার কানে কানে বা কাকতালীয়। কিন্তু প্রবাস জীবন যত দীর্ঘায়িত হয়েছে, তত তিনি নিজের যাপিত জীবনের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছেন, অতীত রোমন্থনের বদলে তাকে ব্যবহার করেছেন নিজের উপলব্ধ অভিজ্ঞতার আত্ম-বিশেস্নষণে। যেমন তাঁর সদর অন্দর উপন্যাসটি। ঘটনাস্থল – তার লোকেশন – এখানে আর গুরুত্বপূর্ণ থাকেনি, যতটা গুরুত্বপূর্ণ যাপিত-স্মরিত জীবনে সমন্বয়ে নির্মিত উপলব্ধ জীবনাভিজ্ঞতায়।
ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার ফেরদৌস সাজেদিনের রচনায় এই মধ্যবর্তী জীবন বা উপলব্ধ জীবন কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। যেমন দেখি তাঁর উপন্যাস পুরুষ, শশীকলা, বা স্বপ্নকক্ষ-এ। এই লেখকের মতো তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোও উন্মূল, অথচ দেশের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তাঁরা নিবিড়ভাবে অন্বিত। তাঁদের জীবনের দুটি স্পষ্ট ধারা ভিন্ন-ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলেও অবশেষে অভিন্ন স্রোতধারা নিমজ্জিত হয়। মনে হয়, লেখক এই সত্যে প্রবল আস্থাবান যে, ঘর ও বাহির – দেশ ও বিদেশ – এই দুয়ের মধ্যে বাহ্যিক অনৈক্য থাকলেও তাঁরা অমত্মর্গতভাবে অভিন্ন। নবীন লেখক দর্পণ কবীর, যদিও নিজের প্রবাস জীবন নাতিদীর্ঘ, তাঁর উপন্যাসেও দেখি প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে অনুসরণের প্রয়াস, বিগত ও বর্তমানের একটি স্বপ্নচারী সেতু নির্মাণ যে প্রয়াসের আরেক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তাঁর জলপ্রপাত পুরোটাই নিউইয়র্কের ঘটনা, অথচ যে আহত, একাকী ও স্বপ্নচারী মানুষের মানচিত্র তিনি নির্মাণ করেন, তাঁদের প্রত্যেকের গমত্মব্য সেই অসম্ভব-অবাস্তব অপহৃত যৌবন।
এই ধারা থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ে আবু রায়হানের প্রবাস-ভিত্তিক নকশা-জাতীয় দুই পর্বে বসতবাড়ির নিউইয়র্ক ও নিউইয়র্কে বসতি এবং আদনান সৈয়দের আমেরিকানামা গ্রন্থে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আয়নায় নির্মিত এই গল্প অথবা তাঁদের বরং কাহিনি বলি – শুধু যে জীবন-ঘনিষ্ঠ তাই নয়, সাহিত্য লাবণ্যেও সমৃদ্ধ। যে-মানব-মানবীর কাহিনি তাঁরা বিবৃত করেন, প্রবাস তাঁদের অধিকাংশের কাছেই আহত, দংশিত ও অহর্নিশ আক্ষেপের। যে-স্বপ্ন নির্মাণের আশায় তাঁদের আমেরিকায় আসা, সে-স্বপ্ন এখন নিদারুণ দুঃস্বপ্ন। উভয় গ্রন্থের এই মোদ্দা উপসংহার অভিবাসনের রোমান্টিক আস্তরণ উচ্ছিষ্টে পরিণত করে।
প্রবাসের অনেক লেখক আছেন যাঁরা সময় ও সমাজের কাছে নিজেদের দায়বদ্ধতা বিষয়ে প্রবল সচেতন। তাঁদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ একটি জীবমত্ম চেতনা, যাকে শুধু স্মৃতির তোরঙ্গে নয়, চৈতন্যের গভীরে সুপ্রতিষ্ঠিত করা নিজেদের দায়িত্ব। এঁদের অন্যতম, নূরন নবী, যাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি স্মৃতিকথা – বুলেটস অব ১৯৭১ ও জন্মেছি এই দেশে – তাতে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এক ধরনের সাক্ষ্যভাষ্যভিত্তিক সাহিত্য নির্মিত হয়েছে। বাঙালি ডায়াসপোরার মন-মানচিত্রটি বুঝতে নূরন নবীর গ্রন্থদুটি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল অভিবাসী, পেশাদার ও সামাজিক উভয় অর্থেই এই লেখক তাঁর ব্যক্তিজীবনের প্রেরণার সব উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন মুক্তিযুদ্ধকে, সে-যুদ্ধের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরায় তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। শিক্ষকের নিষ্ঠায় ও সাংবাদিকের অভিনিবেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধের যে-ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছেন, সেখানে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমষ্টি একটি কেন্দ্রীয় ভর অর্জন করে।
অন্যদিকে আশরাফ আহমেদ তাঁর সাম্প্রতিক তিনটি গ্রন্থ – কলাচ্ছলে বলা, জলপরী ও প্রাণপ্রভা এবং অন্যচোখে বাংলাদেশ। তাতে নিজের দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্মৃতিচারণের পাশাপাশি স্বদেশভূমির কাছে নিজের আজন্ম ঋণের কথা স্মরণ করেছেন। এই জাতীয় রচনার সময়গত সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্রবাসী বাঙালির উদ্বেগ ও আগ্রহের একটি নিকট চিত্র মেলে, যার গুরুত্ব সামান্য নয়।
বস্ত্তনিষ্ঠ সাংবাদিকের একাগ্রতায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস তাঁর গদ্যে-পদ্যে অনবরত লিখে চলেছেন ফকির ইলিয়াস। তিনি বাস করেন বর্তমানে ও কলমকে ব্যবহার করেন হাতিয়ার হিসেবে আগামীকালের স্বপ্ন-সম্ভবের কাহিনি নির্মাণে। সেই অর্থে তিনি প্রকৃতই একজন কলমসৈনিক। সে-কথার অনুরণন পাই এই কাব্য-ছত্রগুলোয় :
আরেকটি মোমবাতি চাই। সুতোর শক্তি থেকে উৎসারিত
ভোরের দেয়ালে রেখে যেতে চাই আমাদের আলোকিত স্মৃতি,
গলে পড়া লাভার চিহ্নভরা অগ্নিগিরির, পাশঘেঁষা নদীর মতো –
কলকল ধ্বনিরেখা এঁকে হতে চাই বিদগ্ধ চিত্রকর।
… … …
মোমের মোহন ভোরে আরেকটি কবিতা লিখতে চাই।
চাই আরেকটি সূর্যের সমবায়ী খামার, কিছু শস্য ফলাবো বলে।

একইভাবে বাংলাদেশকে নিজের দৈনন্দিন আত্ম-আবিষ্কারের উপাদান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন তমিজ উদদিন লোদী। তাঁর কাব্যগ্রন্থ, আমাদের কোনো পস্নাতেরো ছিল না, ব্যক্তিগত আত্মবীক্ষণের পাশাপাশি স্মৃতি ও জাগরণে যে-বাংলাদেশকে তিনি আরাধ্য বলে বিবেচনা করেন, তার প্রতি ভালোবাসা ও অভিমানের জল সিঞ্চন রয়েছে। এই কবি, প্রবাসে বসবাসরত আরো অনেক কবি ও কথাকারের মতো বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করেন রাজনৈতিক সমীক্ষকের অভিনিবেশ ও ভগ্নহৃদয় রোমান্টিকের আত্মনিপীড়নে। সে-কথার প্রমাণ পাই তার সদ্য প্রকাশিত কবিতা ‘তাড়া আছে, চলি,’ এই কবিতায়।
যুবকটি দৌড়চ্ছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে। পেছনে চাপাতি বাহিনী।
সারিবদ্ধ মানুষেরা উৎসুক। আহা মানুষটা মরে যাবে।
তা যাক। আমার খুব তাড়া আছে, চলি।

অন্ধগলি থেকে কারা উঠে আসে।
কারা রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে।
করাতকলের মতো কারা ফালাফালা করে দিচ্ছে সব
কারা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে রং-তুলি-কাগজ-কলম।
কারা হার্মাদের মতো উঠে আসছে উন্মুক্ত রাস্তায়, তাতে কি?
শেষ কথা : দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য, পাশাপাশি একটি বসবাসযোগ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রবাসের সকল বাঙালির। তাঁদের নির্মিত সাহিত্যে সে-স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সযত্ন ছাপ রয়েছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা য়ায়। যে-যাপিত জীবনের তাঁরা অংশীদার, অনেক ক্ষেত্রেই তার পূর্ণ প্রকাশ এই সাহিত্যে নেই, এমন একটি আক্ষেপ হয়তো করা যায়। অভিবাসনকে এঁরা এখনো একটি অস্থায়ী বাস্তবতা হিসেবেই বিবেচনা করেন, এমন একটি সিদ্ধামেত্মও আমরা পৌঁছাতে পারি। এই দুয়ের ভেতর যে অমত্মর্ভেদী আততি বর্তমান, তাঁদের নির্মিত সাহিত্যে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
প্রবাসে বসে আমরা যা লিখছি তার সবটাই যে বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতধারার সঙ্গে অন্বিত হবে, এমন উচ্চারণ আমি করি না। কিন্তু তাকে এককথায় উপেক্ষা করব, কারো কাছ থেকে এমন মূর্খতাও আমি গ্রহণযোগ্য মনে করি না।