তাঁর কথা

সম্প্রতি এক মনোবিজ্ঞানীর একটি প্রবন্ধ পাঠ করে আমার অভিজ্ঞতার দিগন্ত বিসত্মৃত হয়েছে। যন্ত্রণাহত, বিষাদগ্রস্ত ও নানা কারণে কারোর হৃদয়ক্ষত যদি তীব্র থেকে তীব্র এবং কখনো-সখনো নিঃসঙ্গতাবোধে মানসিক ভারসাম্য বিচলিত হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দেয়, সে-সময় তিনি যদি নির্মাণ ও সৃষ্টিতে ব্যাপৃত হন তাহলে তার স্বরূপ হয়ে ওঠে ভিন্নমাত্রাসঞ্চারী। এই সৃজনের ভেতর দিয়েই তার হৃদয়যন্ত্রণা ও বিষাদময়তা দূরীভূত হয়। দাঙ্গা ও দেশ বিভাগজনিত কারণে বহু মানুষের মধ্যে এই লক্ষণ আমরা দেখেছি। সৃজনের নানা দিকে নিয়োজিত হতে দেখেছি অনেককেই। কষ্ট ও যন্ত্রণা এতে শুধু লাঘব হয় তা নয়, এসব সৃষ্টিও হয়ে ওঠে শিল্পগুণসম্পন্ন।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছিলেন এক ভাস্কর; প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেননি ভাস্কর্যে। তবে ভাস্কর্য সৃজনে নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছেন।  কয়েক বছরের চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে ভাস্কর্যের উদ্যানে অফুরন্ত সৃষ্টি রেখে গেছেন। তাঁর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে ঢাকায়। এসব সৃষ্টিতে জীবনবোধ ও শিল্পের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার কত তীব্র  ছিল, তা প্রতিভাত হয়েছে। প্রিয়ভাষিণীর ছিল যন্ত্রণা ও বুকচাপা কষ্ট, এই যন্ত্রণা যেন কিছুটা লাঘব হয়েছিল সৃজনে ব্যাপৃত হয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি যে নিগৃহীত হয়েছিলেন তা তিনি দীর্ঘদিন বলেননি। রমনা উদ্যানে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার পর তিনি মুখ খুলেছিলেন।

তিনি শুকনো ডালপালা, কুড়িয়ে পাওয়া কাষ্ঠদ-, গুল্মলতা দিয়ে মৃত কাঠে এমন শিল্পিত প্রাণসঞ্চার করে গেছেন, যা হয়ে উঠেছিল ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুণসমৃদ্ধ। এ-কাজে আছে নিঃসঙ্গতা, আর্তনাদ ও আনন্দ। মানুষের অবয়ব গঠনের শৃঙ্খলাও উপেক্ষিত হয়নি এসব সৃজনে। মূর্ত ও বিমূর্ত এই নির্মাণ ও সৃষ্টিতে তাঁর যাপনের যে-চিহ্ন প্রতিফলিত হয়েছে এককথায় তা বাংলাদেশের ভাস্কর্যে ভিন্ন মর্যাদার দাবি রাখে। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এসব ভাস্কর্য শিল্পরসিকদের মধ্যে মর্যাদার আসন অর্জন করেছে।

দীর্ঘদিন তিনি চর্চা করে ভাস্কর্যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। সহজ দৃষ্টিপাতে চেনা যেত এ তাঁর ভাস্কর্য, এ তাঁর শিল্পিত সৃষ্টি।

তিনি চলে গেলেন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। আজ তাঁর রচিত একটি গ্রন্থ এ-প্রসঙ্গে আলোচনা করে তাঁর চরিত্রের দৃঢ় স্বরূপ, কষ্ট, বেদনা ও যাপিত জীবনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করব। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি যে জীবন-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ভাস্কর্য চর্চা ও গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে তা সামান্য হলেও লাঘব হয়েছিল।

দুই

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সে-সময়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কয়েক লাখ নারী সম্ভ্রম হারাতে বাধ্য হন। সে ছিল বড়ই দুঃখের সময়। অন্যদিকে প্রয়োজনে বাঙালির শৌর্য কত যে শিখরস্পর্শী হয়ে ওঠে তা মুক্তিযুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালির দীর্ঘ ইতিহাসে এমন বীরত্ব, এমন অসম সাহসের কোনো পরিচয় আর আছে কি না ঐতিহাসিকরা সে-কথা নানাদিক থেকে বিশেস্নষণ করছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সে-সময়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগঞ্জেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে-হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা মানব-ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ই হয়ে আছে। হত্যাযজ্ঞে তিরিশ লাখ লোক প্রাণ হারান, কয়েক লাখ নারী ধর্ষিত হন।

যুদ্ধশেষে রাষ্ট্র ব্যাপক অর্থে এই নারীদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা সম্মান জানায়নি। তাঁরা দেশের জন্য লাঞ্ছিত হয়েছেন – গর্বভরে এ-কথা উচ্চারণ করে তাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে সামাজিক ও অবহেলাজনিত কারণে অনেকেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেন। যদিও কয়েক বছর থেকে এঁদের অনেককেই রাষ্ট্র ও সমাজ নানাভাবে সম্মান জানাচ্ছে।

যুদ্ধশেষে জানা যায়, বহু নারী আত্মসম্মানে ঘা লাগায় আত্মঘাতী হন। ধর্ষণের শিকার বহু নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এসব মেয়েকে পরিবার গ্রহণ না করায় তাঁরা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে ও হোমে বহু শিশুকে রাখা হয়। অনেক শিশুকে বিদেশে দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক দম্পতিদের প্রদান করা হয়। পাশ্চাত্যের বেশ কয়েকটি দেশেও উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক এই যুদ্ধশিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাদার তেরেসাও এই মানবিক কর্মে এগিয়ে আসেন। তাঁর পরিচালিত হোমে প্রতিপালনের জন্য তিনি কয়েকটি শিশু গ্রহণ করেন। মাতৃ-পিতৃপরিচয়হীন বহু শিশু কালের প্রবাহে পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজো কখনো-সখনো বাংলাদেশ দেখতে আসেন। কে তাঁর মা, তাঁরা জানেন না, তবু দেশমাতৃকা তাঁদের টানে।

বিগত শতকের একাত্তরে যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, সেই দুঃসময়ে, সেই সুসময়ের কথা লিখিত হয়েছে একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটি লিখেছেন এমন একজন নারী, যিনি ভাস্কর; যাঁর কাজ দেখলে অবনঠাকুরের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথাবদ্ধ ভাস্কর্য শিক্ষা নেননি বটে, তবে তাঁর কাজে ভাস্কর্যগুণ আছে। ছন্দ আছে। অন্যদিকে তিনি প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বরও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্যে পাকিস্তানিদের লোমহর্ষক নির্যাতনের সাক্ষ্যও  দিয়েছেন। কীভাবে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সে-কথাও বলেছেন। কতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে লাঞ্ছিত ও সম্ভ্রমহানি করেছিল তাঁর বিবরণ দিয়েছেন তিনি।

ফেব্রম্নয়ারি বইমেলায় শব্দশৈলী প্রকাশনালয় থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী-লিখিত বইটির নাম নিন্দিত নন্দন।  বইটি পাঠ করলে আমাদের হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সকল পর্যায়ের সেনারা মানুষ হত্যার সঙ্গে যে কত নারীলোলুপ হয়ে উঠেছিল তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশে লক্ষ নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছিল এ জানা থাকলেও একজন নারী যখন
সে-অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেন গ্রন্থে, নবীন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেনি, তাদের জন্য এক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে এবং যে-কোনো পাঠক নতুন করে বুঝতে বা জানতে পারবেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা কতভাবে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল  ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী-লিখিত বইটি যেন এক দলিল হয়ে উঠল।

নিন্দিত নন্দন গ্রন্থে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তাঁর সম্ভ্রম হারানোর বেদনা ও কষ্টের কথা লিখেছেন বিস্তারিতভাবে। এ-লেখা যেন হয়ে ওঠে তাঁর মনের ভার লাঘব। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের লালসার বহিঃপ্রকাশ যে কতভাবে হতো, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর বাদে বুকচাপা এক কষ্ট নিয়ে তিনি সে-কথা লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে অধিকৃত সেনাবাহিনী ছলে ও বলে নারী ধর্ষণের ভেতর দিয়ে এক মানসিক উলস্নাসের স্বাদ পেত। বল প্রয়োগ, নির্যাতন ও বন্দুকের নলই ছিল তখন নারীর সম্ভ্রমহানির উপায়। বহু নারী ধর্ষিত হলেও  ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো কেউ এই দুঃসহ কষ্টের কথা লেখেননি। সেদিক থেকে এই বইটি হৃদয়মথিত করা তাৎপর্যময় এক আলেখ্য হয়ে উঠেছে।

প্রথম দিন যেদিন বুকচাপা কান্না নিয়ে ধর্ষিত হন তার বিবরণ পাঠ করার পর মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। পরে বারবার নানা স্থানে তাঁকে সেনাবাহিনী ধর্ষণ করে। এক নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁকে তার বাংলোতে ডেকে পাঠায় এবং বলে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করছেন। ছল করে আটকিয়ে মধ্যবয়সী এই অফিসার তাঁর সম্ভ্রমহানি করে।

জীবন বাঁচানো ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। নানাভাবে বহু লোকের দ্বারা তিনি ধর্ষিত হতে থাকেন। কখনো একজনের হাত থেকে পরিত্রাণ পেলেও আরেকজন যেন ওঁৎ পেতে থাকে ধর্ষণের অভিলাষ নিয়ে। তাঁর রচিত এই গ্রন্থ মনকে বিষণ্ণ ও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। এ বই পাঠ করার পর বিস্মৃতভাবে গুছিয়ে লেখাও অসম্ভব হয়ে ওঠে।

ফেরদৌসী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনার একটি জুট মিলে চাকরি করতেন। অবরুদ্ধ খুলনায় চাকরিতে যোগদানের পর তিনি এক ঘেরাটোপে বন্দি হন ও ধর্ষিত হতে থাকেন। আর ’৭১-এর এপ্রিলের পর থেকে খুলনা ও খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে পাকিস্তানপন্থী অবাঙালি,  রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে নিধন করার যে-যজ্ঞে মেতে উঠেছিল তা বিশদভাবে উঠে এসেছে এই গ্রন্থে।

তাঁর বাল্য ও কৈশোর কেটেছে খুলনায়। খুলনাতেই মায়ের স্নেহে তিনি এক রুচিময় পরিবেশে বড় হয়ে ওঠেন। বাল্য ও কৈশোরকাল তাঁর যে খুব সুখের ছিল, তা নয়।

 

তিন

গ্রন্থটিতে তাঁর বাল্য ও কৈশোরকালের বিকাশপর্ব ধরা আছে সুখ ও দুঃখের আবরণে আচ্ছাদিত নানা ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর বাদে বুকচাপা এক কষ্ট নিয়ে অত্যন্ত সরল ভাষায় তিনি সে-সময়ের কথা বর্ণনা করেছেন। কৈশোরকালের জীবনযুদ্ধের ও বেঁচে থাকার আকুতির কথা আছে একটি অধ্যায়ে। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার খুঁটিনাটি, অসচ্ছলতা ও প্রাত্যহিক নানা অনুষঙ্গ। এতদসত্ত্বেও কৈশোরকালের সে-সময়টা ছিল তাঁর বর্ণময়। গৃহের পরিবেশে ছিল সংস্কৃতিচর্চার আবহ। পিতার চাকরিসূত্রে খালিশপুর ও ঢাকায় অধ্যয়ন করেন তিনি। খুলনা থেকে দৌলতপুর, কখনো ঢাকা, আবার খুলনায় কৈশোরকালে তাঁর যে পরিক্রমা এবং শিক্ষাগ্রহণ ও যে জীবন-অভিজ্ঞতা হয়েছিল, অত্যন্ত মনোগ্রাহী ভাষায় তিনি তা বর্ণনা করেছেন। একসময় মাতামহ যখন প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার হন, তখন ঢাকার স্পিকার ভবনের জৌলুসেও বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। এই ভবনের কেতা এবং জৌলুসেরও কথা আছে বইটিতে। এই ভবনে তিনি বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টিতে যা অবলোকন করেছিলেন তার বর্ণনাও খুব কৌতূহলোদ্দীপক। যদিও রাজনৈতিক কারণে মাতামহ বেশিদিন স্পিকার থাকতে পারেননি। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পাঠ গ্রহণকালে শিক্ষক হিসেবে পান জাহানারা ইমামকে। স্কুলের শিক্ষাশেষে তাঁর বিয়ে হয়। এই বিয়ে খুব একটা সুখের হয়নি। স্বামীর পীড়নের ফলে তাঁর বিবাহিত জীবনও হয়ে পড়েছিল দুর্বিষহ। স্বামী তিন সমত্মান ও স্ত্রীর দায় বহন না করায় ও জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত হতে হতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন খুলনা জুট মিলে অনেক চেষ্টার পর চাকরি পান। এই চাকরি কিছুদিনের জন্য স্বসিত্ম এনেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই স্বসিত্ম অপসৃত হয়। এই সময় অবাঙালি অধ্যুষিত জুট মিলের পরিবেশ ও নানা অভিজ্ঞতার কথা আছে গ্রন্থে।

স্বামীর প্রতারণার কথা তিনি অকপটে বর্ণনা করেছেন। পতি প্রতারক, দায়িত্বহীন হওয়া সত্ত্বেও দশটি বাঙালি রমণীর মতো জীবনসংগ্রামে পর্যুদস্ত না হয়ে একটি পথ খুঁজে নেন। চাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। মা এই সময় তাঁকে সর্বাত্মক সাহায্য করেছিলেন। আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগেকার কথা লিখতে গিয়ে তাঁর মন যে কত বিষণ্ণ ও ফের রক্তাক্ত হয়েছে তা পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায়। সমত্মান পালন ও জীবনধারণের জন্য এই চাকরি যে কত অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল সে-কথাও তিনি বলেছেন এই গ্রন্থে। এই চাকরিজীবনে তাঁকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে।  সে-সময় তিনি দেখতে ছিলেন সুশ্রী ও সুন্দরী। উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভালো বলতে পারতেন বলে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় এবং লোভনীয় এক নারী বলে বিবেচিত হয়েছিলেন।

জীবনসংগ্রাম ও নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর সম্মুখীন হন। তাঁর বাড়ির সম্মুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ব্রাশফায়ারে একসঙ্গে চোদ্দজনকে মেরে ফেলতে দেখেছেন। এই হত্যাযজ্ঞ তাঁর হৃদয়কে দীর্ঘদিন বিষাদগ্রস্ত করে রেখেছিল। এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল খুলনা-খালিশপুরে রাজাকারদের মুক্তিবাহিনীর খোঁজে নানা ধরনের পীড়ন। নবীন-যুবারা কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন, ভয় এবং ত্রাসের মধ্যে জীবনযাপন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও অবাঙালিদের  প্রতাপ নিত্যসঙ্গী ছিল। গ্রন্থটির ’৭১-এর অধ্যায়টিতে তাঁর নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও সম্ভ্রমহানি যেমন বিধৃত হয়েছে, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধ
ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথাও। অবরুদ্ধ খুলনা-খালিশপুরে অস্ত্রে ও মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত একটি আধুনিক বাহিনীর প্রবল তর্জন-গর্জন-হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা সাহসে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তাঁর বিবরণও উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করে এবং সমত্মানদের নিয়ে কিছুদিনের জন্য তাঁর স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হন। পাকিস্তানিদের পীড়ন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ তাঁকে উদ্ভ্রান্ত করে। পালাবারও কোনো পথ খুঁজে পাননি। অসহনীয় পরিবেশ সুস্থ চিমত্মাশক্তিকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। সমত্মানদের জন্য ও সম্ভ্রমহানির এই যে শূন্যতা এসেছিল এবং বেঁচে থাকার সমস্ত অবলম্বন যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, সে-সময় জীবন বিপন্ন জেনেও একজন উদার হৃদয়ের মানুষ নির্ভরতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাঁর জীবনে। পাকিস্তানিরা তাঁকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছে জেনেও পরম বন্ধু হিসেবে যিনি তাঁকে গ্রহণ করেন এবং তিনি তাঁর জীবনসঙ্গী হন। তাঁর সঙ্গে সখ্যেরও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। এই সখ্য আজীবন অব্যাহত ছিল। ভদ্রলোকের পরিবারের নিরাপত্তাসত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারত এক বিশ্বাসবিত্ত পাই আমরা। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর এই জীবনসঙ্গীর প্রণয় ও ঔদার্যগুণও আমাদের মুগ্ধ করে।

এই বই পাঠ করলে যে-কোনো পাঠকের হৃদয়মন বিষাদগ্রস্ত হবেই এবং একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহস ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার দিকটি চোখের সামনে ভেসে উঠবে।