বসন্ত রায় চৌধুরী
বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে আধুনিক চিত্রকলার পথিকৃৎ শিল্পী আমিনুল ইসলাম (১৯৩১-২০১১) তারুণ্যের সৃজনী অগ্রযাত্রাকে সাহস যুগিয়েছেন আমৃত্যু। নবীন শিল্পীদের শিল্পকর্মে সৃজিত বিষয় বিন্যাস ও মাধ্যমের বৈচিত্র্যে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস। বাঙালির শেকড়ের সঙ্গে ইউরোপীয় শিল্পধারার যুক্ততার জন্যে বাংলাদেশের শিল্পকলার ধরন পালটেছে। প্রথাগত ক্যানভাস, রং-তুলির বাইরে এসে শিল্পীরা তৈরি করছেন দৃশ্যশিল্পের চলমান মুহূর্ত। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে ভিডিওচিত্র, স্থাপনা শিল্প, পারফরম্যান্স আর্ট। বৈচিত্র্যপূর্ণ এই বিবর্তনে তরুণরা এগিয়ে আছে। অন্যদিকে আরেকদল তরুণ বাস্তবধর্মী নির্মাণের সঙ্গে চিত্রতলের স্পেস ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হয়েছেন, শিল্পী আমিনুল ইসলাম তারুণ্যের এই সৃষ্টিমুখর চিন্তার বিকাশের প্রতি লক্ষ রাখতেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও শিল্পীর পরিবার যৌথভাবে এ প্রতিযোগিতার উদ্যোগ নেন। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ-প্রতিযোগিতা থেকে বাছাই করা দশজন শিল্পীর কাজ নিয়ে গত ৭ নভেম্বর শুরু হয়েছে এ-প্রদর্শনী। এক বছর পরপর এ-প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা রাখেন উদ্যোক্তারা।
মোট ১৪৪ জন শিল্পীর ৩০০টি শিল্পকর্ম থেকে বাছাই করা দুজন শিল্পীর কাজকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত কর প্রণোদনার কথা ভাবতেন। সামাজিক অঙ্গীকার, শিল্প-সাধনায় মগ্ন তারুণ্যের প্রতি মমত্ববোধ তাঁকে ভাবিয়ে তুলত। আমিনুল ইসলামের এই ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিয়েছে তাঁর পরিবার ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এ-প্রদর্শনীর কাজের সংখ্যা একেবারে সীমিত হলেও এ-প্রদর্শনীর শিল্পীদের কাজ থেকে আমরা ইতিমধ্যেই একটি দিকনির্দেশনা পেয়ে যাই। তরুণ শিল্পীদের সমসামায়িক কাজে সময় ভাবনাই প্রধান। শিল্প-নির্মাণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বৈচিত্র্য। বিষয় নির্বাচনে সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই সময়ের সুখ-দুঃখ আর শোক। সমাজের মানুষেরা দুঃসময়ে পথ হাতড়ে চলেন। পীড়ন আর দলননীতি মানুষের হৃদকম্প বাড়িয়ে দেয়। সৃজনী ক্ষমতার প্রয়োগে তরুণ শিল্পীরা সবসময় এগিয়ে। এ-প্রদর্শনীর কাজ তারই বড় উদাহরণ। আমিনুল ইসলাম তরুণ শিল্পী পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল ও হাবিবা আক্তার পাপিয়ার কাজে সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ধরা দেয়। দুজনই সময়ের হাহাকারকে নির্মাণ করেছেন। সামাজিক অস্থিরতার নিত্য-প্রতিচ্ছবি শিল্পীদ্বয়ের কাজে উপস্থিত। হাবিবা আক্তার পাপিয়া ব্রোঞ্জে তৈরি করেছেন একটি বোতল আকৃতি। সোনালি রঙের আলঙ্করিক নকশা ভেদ করে একদল পোকা বেরিয়ে আসছে ওই আকৃতি থেকে। এটি যেন মাটির ভেতরে বাসকরা পোকামাকড়ের ধরণির বুকে বিচরণ। ক্ষয়ে যাওয়া সময়কে উপস্থাপন করেছেন এ দুটি ভাস্কর্যে। তরুণদের তুলিতে সময়কে ধারণ করার আভাস এ-প্রদর্শনীর সবকটি কাজে স্পষ্ট। দগ্ধ, আর্ত মানুষের দেহখন্ড কিংবা মুখাবয়ব স্পষ্ট করে বলে দেয় এই সময়ের গান। পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল রেখার সাবলীল চলাচলে মানবদেহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হাত ও পা এঁকেছেন। সান-দেওয়া ছুরি, স্ক্রু ড্রাইভার, কাঁচি, শকুনের ঠোঁট – ছয়টি ক্যানভাসে হাত ও পায়ের সঙ্গে উপস্থাপন করে আতঙ্কের ভাষা তৈরি করেন, যেটি হলো – আর এমন নয়। এ-শিল্পকর্মগুলোর মাধ্যম কাগজে কলম ও অ্যাক্রিলিক। অপর চারটি গাঢ় কালো রঙের জমিনে সাদা রেখার সাহায্যে মানুষের আর্তনাদ করা দেহভঙ্গি শান্তিহীন সময়ের কথা বলে। আনিসুজ্জামানের সবকটি কাজে মানবমনের আর্তনাদ স্পষ্ট।
আবদুল্লাহ আল বশির উত্তরণ শিরোনামের কাজ করেছেন কাঠ খোদাই মাধ্যমে। বাস্তবধর্মী চিত্র-নির্মাণের অভ্যাস তাঁর কাজে বোঝা যায়। ঘাটে জাহাজের বিশ্রাম নেওয়ার মুহূর্তকে সূক্ষ্ম রেখার সাহায্যে গড়েছেন। ছবির জমিনে আলাদা রং ব্যবহার না করে পুরো চিত্রতলে ছবির বিষয় বিস্তৃত করেছেন। আশরাফুল হাসান বিধ্বস্ত প্রকৃতিকে ছবির বিষয় করে ক্যানভাস গড়েন। বৃক্ষশোভিত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতার শুরু থেকে। প্রকৃতির এই সবুজের হন্তা মানুষ নিজেই। আশরাফুলের কাজে কাটা গাছের আকৃতি মানুষের অবয়ব হয়ে দেখা দেয়। কালো জমিনে বৃক্ষের কাণ্ড-শাখা। দর্শকদের ভাবিয়ে তোলে। বিশ্বজিৎ গোস্বামী মানুষের বন্দিদশা থেকে মানুষকেই মুক্ত করতে চান। ক্যানভাসের বড় অংশজুড়ে ধূসর রঙের প্রলেপ। মানুষের দেহাবয়ব একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে আছে। তীব্র আলো-ছায়ার প্রক্ষেপণ আর মানুষের বাস্তবধর্মী অঙ্কনরীতি ছবিতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। তারুণ্যের শক্তি ভাবনা, বিশেস্নষণ এসে যুক্ত হয়েছে বিশ্বজিতের ক্যানভাসে। এ-প্রদর্শনীতে মানুষের চলতি সময় নিয়ে কাজ করেছেন গোপাল চন্দ্র সাহা। সাধারণ কাগজের ওপর কালো কালি-কলমে মানুষের মুখ, বৌদ্ধমূর্তির মুখাবয়ব, পিস্তলের অবয়ব, খন্ডিত হাত-পায়ের উপস্থিতিকে শিরোনাম দিয়েছেন ‘মানবতা নিম্নমুখী’। গোপালের দুটি কাজ মানুষ ও মানুষের সমাজের মানবিক ক্ষয়ের কথা বলে। মো. আলমগীর হাসান ভিডিওচিত্র নির্মাণ করেছেন গত ২৪ এপ্রিল ২০১৩-তে ধসে যাওয়া রানা পস্নাজা নিয়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছেন তিনি। মানুষের এ-নিয়তিকে ফিরে ফিরে দেখেন দেশের মানুষ। ছবির সঙ্গে কান্না, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ যোগ করেছে মানুষের জন্যে হাহাকার। রুহুল করিম রুমী মানুষের প্রতিকৃতি অাঁকেন ছাপচিত্রে। রং লেপন করে কোনো কোনো মুখে এঁকে দেন বিশেষ চিহ্ন। মানুষের মুখচ্ছবিতে জীবনযাপনের ছাপ তৈরি হয়। ক্লান্তি দেখা দেয় বলিরেখায়। রুহুল করিম রুমী কাঠ খোদাই করে এরকম প্রতিকৃতি দর্শকদের সামনে হাজির করেন। প্রদর্শনীর আরেক শিল্পী সহিদ কাজী সোশ্যাল লাইফ শিরোনামে অাঁকা ছবিতে দুটি গাড়ির অগ্রভাগ দেখিয়েছেন। গাড়ির সঙ্গে একদল মানুষের ছুটে যাওয়া আমাদের সমাজ বাস্তবতার দিক মনে করায়।
বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের এ-উদ্যোগ তরুণ শিল্পীদের নিরীক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সমকালীন শিল্পকলায় বাংলাদেশের তরুণদের শিল্প-নির্মাণের পরিক্রমার আভাস পাওয়া যায়। শিল্পী আমিনুল ইসলামের স্বপ্নের মাঝে তারুণ্যের অগ্রযাত্রা আবারো দর্শক প্রত্যক্ষ করল। গত ৭ নভেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ১৮ নভেম্বর ২০১৩-তে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.