তার নাম কি বাণী

বো র হা ন উ দ্দি ন  খা ন  জা হা ঙ্গী র

আর্মি গলফ ক্লাবের ভিতর আমি তোমাকে নিয়ে হাঁটছিলাম। গলফ ক্লাবের মাঠ তৈরির  আগে জায়গাটা ছিল পাহাড়িয়া : উঁচু-নিচু বড়ো বড়ো গাছপালায় ছাওয়া, শাল গজারি জাম জারুল গাছের অরণ্য, এই অরণ্য যেখানে শেষ সেখানে নদী ঢেউ তুলে তুলে ধলেশ্বরীতে মিশেছে।

আমার গ্রাম আর তোমার গ্রাম পাশাপাশি। আসলে দুটো গ্রাম না, একটা গ্রাম, কালক্রমে দুটো হয়েছে। একটা গ্রামের বাসিন্দা তুমি : বড়ো গ্রাম। অন্য গ্রামের বাসিন্দা আমি : মধ্যম গ্রাম। কেন যে দুই গ্রাম হলো, জানি না। বড়ো গ্রামের বাসিন্দা মিয়া সাহেবরা। তাদের অবস্থা পড়তির দিকে। তুমি মিয়া সাহেবদের, লতানো-পাতানো বংশধর। আমার গ্রামের লোকজন ঢাকার দিকে চলে গেছে। তাদের অধিকাংশই গ্রামছাড়া।

দুই গ্রামই লোকজনশূন্য। আমরা ঘুরে বেড়াই শূন্যের মধ্যে। আমাদের ওপর নজরদারি করার লোকজন নেই। মিয়া সাহেবদের একটা সাদা ঘোড়া আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। কখনো কখনো হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর দিকে যাই। নদীতে জেলেদের নৌকো, পারাপারের নৌকো, আমার ইচ্ছা করে নদীতে তোমাকে নিয়ে ভেসে যাই। আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূরের গ্রামে।

বহুদূরে কী আছে? গ্রাম, জনপদ, নদী, নৌকো, বৃক্ষরাজি কিংবা আমি এবং তুমি, নদীর মধ্যে চরের ভাসান দিয়ে ওঠা যেখানে মানুষের ফের বসত। আমি এসব ভাবি, তোমাকে নিয়ে এসব ভাবি।

দুই

নদীর ঢাল বেয়ে রাস্তা পাকা সড়কে উঠেছে। পাকা সড়ক একদিকে মানিকগঞ্জের দিকে দৌড় দিয়েছে। অন্যদিকে দৌড় থামিয়ে ঘোড়াপীরের মাজারে উঠেছে। তারপর ফের গ্রামের দিকে রাস্তা।

আমি প্রায় সময় তোমাকে ঘোড়াপীরের মাজারে নিয়ে বসে থাকি। বিরাট বটগাছ, নিচে মাজার, অসংখ্য মাটির ঘোড়া এদিক-সেদিক ছড়ানো। কেন মাটির ঘোড়া মাজার ভরা, জানি না।

মধ্যে মধ্যে কোথাকার এক দরবেশ মাজারে এসে হাজির হয়। এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টার মতো থাকে, যাবার সময় ঝোলাভর্তি মাটির ঘোড়া নিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে তার বাক্যালাপ নেই। যাবার সময় আমাদেরকে শুধু বলে : সালাম, সালাম নেবেন।

আমি তোমাকে নিয়ে দরবেশকে সালাম জানাই আর দূরের দিকে তাকিয়ে থাকি। দরবেশের সামনে আমরা যেন দুই শিশু। আমাদের ঘিরে দিগন্ত আর নদীর বিস্তার : সুবিশালতা। আর একটি বিশালতা আছে : আকাশ।

তোমার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, মেয়েমানুষের শরীরের কোন অংশ তার নিজের, কোন অংশ পুরুষের চোখের। কোথায় একটা রহস্য আছে মেয়েমানুষের শরীরের, একটা রহস্য তাকে ঘিরে রাখে।

তোমার দিকে তাকিয়ে এসব বুঝি। তুমি যখন চলাফেরা করো তখন তোমার শাড়ি থেকে একটা রহস্য, একটা লাবণ্য ঝরতে থাকে। আমি অবাক হয়ে এই রহস্যের দিকে তাকিয়ে থাকি।

 

তিন

কখনো কখনো মনে হয় আর কেউ আমার ও বাণীর মধ্যে বসে আছে, পৃথিবী ও নক্ষত্রের মধ্যে। কখনো কখনো মনে হয় তুমিও তাই, এই গ্রামে যারা জন্মেছে তারা গ্রাম ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে, তারা কখনো আর ফিরবে না। তাদের অনেকের নাম জানি, কারো নাম ভুলে গেছি, তারা আমাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কোন দূরে, মধ্যপ্রাচ্যের কোন গ্রামে, কোন শহরে হারিয়ে গেছে। আমরা তাদের বাড়িঘরে উঁকি মারি, যেন অন্য কোনো মানুষের ঘরবাড়ি। এভাবে একটা গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়, পরিত্যক্ত হয়, যাকে আমরা ছাড়াবাড়ি বলি, তাই হয়ে যায়।

 

চার

মধ্যে মধ্যে আমার মৃত্যুর কথা মনে হয়। আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমি দশ বছরের ছোট। আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মা বাবার বুকের ওপর শুয়েছিলেন। বুকটা তখনো গরম। আমি বাবার মুখের দিকে, মার মুখের দিকে চেয়েছিলাম। ঘরভর্তি মানুষ, কান্নার রোল, রোদনে রোদনে ঘর ছেয়ে আছে। আস্তে আস্তে বাবার শরীর শীতল হয়ে যায়। শরীর থেকে উত্তাপ চলে যাওয়া কি মৃত্যু? আমাকে কারা যেন ঘর থেকে বার করে দেয়। আমি উঠানে বসে কাঁদতে থাকি। আমার মা-ও কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন। ঘরের ভেতর থেকে, উঠান থেকে আহাজারি শোনা যায়। মুর্দাকে গোসল করানো হবে। সরে যান সরে যান।

আমি কোথায় সরে যাব। কোথায়? আমার কাঁদনে কাঁদনে চোখ অন্ধ হয়ে যায়।

 

পাঁচ

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর, বাণী হঠাৎ বিয়ে করে বসে। আর আমি দুবাইতে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে চলে যাই।

মধ্যে মধ্যে টেলিফোনে কথা হতো। কখনো ঢাকা, কখনো দুবাই। এই পর্যন্তই। মনে হতো আমি দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছি। মনে হতো বাণী-ও দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছে। অথচ আমরা কতো কাছের মানুষ ছিলাম। এখন কতো দূরে চলে গেছি। একটা টেলিফোনের কথা কখনো ভুলতে পারি না। যদি আমার একটা বউ থাকত, তাহলে এখানে আমি থাকতাম না, এই মরুভূমির দেশে। আমি বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চাইতাম। তার বদলে আমি এখানে পড়ে আছি। একটা নিঃসঙ্গতা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেন তোমার স্বামী তোমার সঙ্গে থাকছে না? যদি তুমি আমার বউ হতে, তোমার পাশে আমি থাকতাম। একটা দিন-ও আমি নষ্ট হতে দিতাম না। যদি তোমার জন্য আমার ভালোবাসা থাকত, ভালোবাসার কতো কথা আমরা বলেছি, সবই তো মনে পড়ে, হোটেলের বিছানায়, শুয়ে শুয়ে।

তোমার তো একটা মেয়ে হয়েছে, তখনো তোমার স্বামী ভিনদেশে পড়ে আছে। ইংল্যান্ডে, তোমার দুঃখ, তোমার যন্ত্রণার ভেতর। আমি এসব বুঝি না। বিয়ের ব্যাপার-স্যাপার আমার ধারণার বাইরে।

আমি কী বলব, বলো। সব বলা শেষ। এখন শুধু মনে পড়া।

স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই। স্মৃতি তো কোনো কাজে লাগে না। শুধু দুঃখ বাড়ায়।

 

ছয়

বাণীকে বহুবার বলেছি দুবাই আসতে। বাণী আসব আসব করে : কখনো আসেনি।

বাণী টেলিফোনে একবার বলেছে : জানো মানুষকে খ- খ- করে ধ্বংস করা যায়।

আমাকে ধ্বংস করে তোমার কী লাভ বলো। আমি মরে গেছি।

আমাকে দেখতে ছাড়াবাড়ির মতো মনে হয়। বালির মতো চকচক করছে ছাড়াবাড়ি।

ছাড়াবাড়িতে কেউ থাকে না। ভূত-প্রেত বাদে। আমিও তাই।

তোমার মনে আছে আমার চাচির হারিয়ে যাবার কথা?

 

সাত

আমরা তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের দুই গ্রামের কিংবা দুই বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর মহিলা ছিলেন আমার চাচি। একবার চাচি বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। কতো জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। আমরা ঘোড়াপীরের মাজারে কতোবার গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। আল্লাহ চাচিকে ফিরিয়ে দাও। দরবেশের কাছে দোয়া চেয়েছি। দরবেশ একবার শুধু বলেছেন : তোদের চাচিকে তোরা দেখতে পাবি।

সেই দেখতে পাওয়ার কষ্ট কখনো ভুলিনি।

কোনো একসময় আমি কবিতা লিখতাম। কবিতা লিখতে লিখতে আমি শিখেছি : কোনো কিছু আমার না, শস্য, নক্ষত্র, বৃক্ষরাজি, তোমার গলা, তোমার শরীর, কিছুই আমার না।

নদীর পাড়ে জঙ্গলের মতো গাছপালা ভর্তি। সেদিকে কেউ যেত না। সাপখোপের ভয়ে।

সেখানে হঠাৎ আবিষ্কার করি চাচির দেহকে। দুজন লোক গর্ত করে চাচিকে গর্তের ভেতর ফেলে দিয়েছে। আর দেখি চাচাকে, জবরদস্ত লোকটা হুকুম দিচ্ছে লোকদুটিকে। গর্তের ভেতর চাচিকে পুঁতে চাচা লোকদুটিকে নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যায়। আমি আর বাণী কখনো বুঝিনি চাচির অপরাধ কী! চাচি সুন্দর বলে। চাচি অন্য কারো সঙ্গে ভালোবাসা করেছে বলে। কোনোটাই সত্য নয়।

বছর শেষে চাচা বাড়ির রাঁধুনিকে বিয়ে করে নেয়।

আমি আর বাণী নক্ষত্রের মধ্যে, গাছপালার মধ্যে চাচির মুখ সবসময় দেখতাম।

হায়রে আমাদের সুন্দর চাচি। আমাদের চাচি, কোথায় হারিয়ে গেল।

আমরা কেঁদেছি। আমাদের হাহাকার কেবল দরবেশ শুনেছেন।

দরবেশ বলেছেন, দেখা হয়েছে চাচির সঙ্গে? দেখা হয়েছে। দরবেশের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয়নি।

 

আট

কখনো কখনো বাণী বলত, জানো শাড়িটারি খুলে আমার বনজঙ্গলের মধ্যে শুয়ে থাকার ইচ্ছা করে। নিজের শরীরের সুবাস নিতে। এ হচ্ছে আমার বাড়িঘর। বাণী আমাকে খুঁচিয়ে শোনাত : তুমি কি বোঝ আমার শখ। জানি বোঝ না।

আমি দুবাই চলে যাবার আগে আমাদের নদীর পাড়ে বেড়াতে এসেছি। ঘোড়াপীরের মাজারটা দেখার ইচ্ছা করেছে।

এসব ছেড়ে আমি কোথায় চলে যাচ্ছি। এসব ভাবতেই আমার চোখে পানি এসে গেল।

কিছুদিনের মধ্যে বাণীর বিয়ে হয়ে যাবে। বুঝি বাণীর সঙ্গে বিয়ে হলে দুই পরিবার খুশি হতো। শেষ মুহূর্তে বাণী পিছিয়ে গেছে। কেন জানি না। বাণী আমার কাছে কিছু প্রমিজ চেয়েছে। যেমন তুমি কি চাচির কথা ভুলে যাবে না তো। দুবাই গেলে একটা মানুষকে তুমি ভুলে যাবে না তো। বিয়ে করলে মানুষ তো অনেক কিছু ভুলে যায়।

আমি হেসে বলেছি, মানুষ কি ভুলে যাবার জন্য বিয়ে করে?

বাণী হেসে বলেছে, সেজন্যই মানুষ বিয়ে করে। বাণী ফের বলেছে। থাক আমাকে বিয়ে করতে হবে না।

ফের বাণী বলে উঠেছে, মধ্যে মধ্যে নদীর পাড়ে বেড়াতে যেও। মধ্যে মধ্যে মাজারের কাছ থেকে ঘুরে এসো। যদি দরবেশের সঙ্গে দেখা হয়, তার কাছ থেকে দোয়া নিও।

আমি দুবাই চলে যাই। বাণী ইংল্যান্ডে চলে যায়। কিছুদিন পর শুনি বাণীদের বিয়ে ভেঙে গেছে। বাণী নক্ষত্ররাজির মতো, বৃক্ষরাজির মতো, নদীর স্রোতের মতো একলা হয়ে গেছে।

নয়

দুবাই থাকতে থাকতে আমি অন্য একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরির অফার পাই। দরখাস্ত করি। চাকরিটা হয়ে যায়। আসওয়ান ড্যামে। ওখানে কেউ থাকতে চায় না। মরুর দেশ, পানির কষ্ট। কাছের শহর বহুদূর।

মহান ফেরাও রামসেসের মূর্তি সরাতে হবে। দুটো মন্দির। একটা হচ্ছে রামসেসের বিশাল মন্দির, অন্যটি হচ্ছে ছোট, তার স্ত্রী, নেফারটারির মন্দির। প্রতিটি রামসেসের ওজন চবিবশ টনের বেশি। বসে আছে হাঁটুর ওপর হাত রেখে, বিশ মিটার উঁচু।

হাজার হাজার বছর আগে, আসওয়ানে মন্দির তৈরির হুকুম দিয়েছিলেন ফেরাও; কিংবা আবু সিম্বলে রামসেস তাঁর প্রতিভূ নির্মাণের আগে, নাইলের পাদদেশে নুবিয়া মরুর কেন্দ্রে এসব কিছুকে পবিত্র মনে করা হতো। নদীর উচ্চতায় আর একটি প্রতিভূ নির্মাণের প্রচেষ্টার আগে, আমি এই পবিত্র ভূমি থেকে পালিয়ে যাই।

আমি পালাই : ঐতিহাসিক কিংবা প্রাগৈতিহাসিক মন্দিরের পবিত্র ভূমি থেকে।

আমি পালাই বলে এখনো বেঁচে আছি।

আমি দুবাই থেকে পালিয়ে আসওয়ান এসেছি। আবার আসওয়ান থেকে পালিয়ে দুবাই ফিরে আসি।

 

দশ

যেসব প্রমিজ তুমি করেছ সেসব কি তুমি ভঙ্গ করতে পার? যা কিছু পবিত্র তাকে নষ্ট করতে পার? পৃথিবীর যে-কোণায় তোমার কবর হয়েছে সেখান থেকে সরে যেতে পার? চিরন্তন নিঃসঙ্গতার কথা কি আমি বলছি? নিঃসঙ্গতা তোমাকে ঘিরে আছে, সেজন্য তুমি পালিয়েছ। না পালালে তোমার জীবনে সূর্য উঠত না, সূর্য ডুবত না।

 

এগারো

নদীর কোলাহল আমার জীবনে আছে। দুবাই থেকে মধ্যে মধ্যে আমি নদীর কোলাহল শুনতে বাড়ি যেতাম। বাণীর কথা মনে পড়ে যেত। বাণী হাত থেকে, চোখ থেকে চুল সরিয়ে দিত। আমার বোধ হতো এই দেখা কখনো ফুরাবে না। আমি কেবল দেখেই যাব। এ যেন একটা অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতার অর্থ বাণীকে দেখার অধিকার আমারই, আর কারো না।

 

বারো

আমি দুবাই থেকে ফিরে এলে, গ্রামের গোলাঘরে, নদীর পাড়ের গাছপালায়, মাজারে, লিখে রাখি :

আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কাকে জানি না।

কেন জানি না।

একটা শব্দ অন্য একটা ব্যক্তির জন্য। ওই ব্যক্তিটা পৃথিবীর কোন পাড়ে আছে, জানি না।

তার নাম কি বাণী? r