ত্রিমাত্রিক বাস্তু-উন্নয়ন চিন্তক

নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের পথপ্রদর্শক মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় বা সান্নিধ্যলাভের অনেক আগেই আমি তাঁর স্থাপত্যকৃতিকে অভিজ্ঞতায় ধারণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেমন পেয়েছিলেন আমার মতো আরো অনেকে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ক্লাসের ছাত্র হয়ে ঢুকি ১৯৫৮ সালে। আমাদের ভূগোল বিভাগটি ছিল কার্জন হল সংলগ্ন একই স্টাইলে নির্মিত ছোট একটি দোতলা ভবনের একতলায়। সামনে ছোট খোলা প্রাঙ্গণ, তার সামনে প্রাক-মোগল আমলের মুসা খানের মসজিদ। চমৎকার স্থাপত্য নিদর্শন, যদিও তখন যেমন এখনো অনেকটা অনাদরেই  দাঁড়িয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কার্জন হল প্রাঙ্গণের বাইরে আমাদের বেশিরভাগ সময় কাটত তৎকালীন সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরিতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ছিল পুরনো কলাভবনের একতলায়, এক অন্ধকার অনাকর্ষণীয় হলঘরে। সে-তুলনায় পাবলিক লাইব্রেরির পাঠকক্ষ ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও সুসজ্জিত। খোলা শেলফ থেকে ইচ্ছামতো বই নামিয়ে পড়া যেত। আমাদের কয়েকজনের জন্য এ-লাইব্রেরিটি আরো আকর্ষণীয় ছিল এ-কারণে যে, এর একজন সহকারী ছিলেন আমাদের বন্ধু রম্য লেখক ও কবি হুমায়ুন খান। পছন্দের বই পেতে একেবারেই কষ্ট করতে হতো না, আর শরিফ মিঞার ক্যান্টিন  বা চায়ের দোকান তো পাশেই ছিল। মোট কথা, সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি ভবন ছিল আমাদের অতিপ্রিয় জায়গা।
লাইব্রেরিটি শুধু একটি ভবন হিসেবেই যে ডিজাইন করা হয়েছিল তা নয়। দুটো পরস্পর সংলগ্ন তিনতলা ভবন আধুনিক স্থাপত্যিক ডিজাইনে ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচারের সুন্দর উদাহরণ বলে চিহ্নিত। এটিকে একটি ছোট ক্যাম্পাস  হিসেবে সাজানো হয়েছিল। দক্ষিণ দিকে অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে এখন নিয়মিত বার্ষিক কবিতা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। পশ্চিম দিকটাও খোলামেলা, দুই ভবনের মাঝখানে গোলমতো ছোট্ট নাটমণ্ডল। চারদিকে গাছপালা, সবমিলিয়ে ভারি চমৎকার পরিবেশ। পাবলিক লাইব্রেরির স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ক্যাম্পাস বা কার্জন হল বা সলিমুল্লাহ হল ছিল ব্রিটিশ আমলের অসাধারণ সুন্দর ক্যাম্পাস পরিকল্পনা ও স্থাপত্য, মাজহারুল ইসলামের পাবলিক লাইব্রেরির স্থাপত্য ছিল ব্যতিক্রমী, আধুনিক ও নতুন। এ ভবনের আরেক সৌন্দর্য, এতে সংযোজিত হয়েছিল শিল্পী হামিদুর রাহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদের দেয়াল-শিল্পকর্মসমূহ। সিমেন্টের রিলিফ ও ফ্রেস্কো চিত্র। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য তথা দেয়ালচিত্রের সমন্বিত উদাহরণ। ছাত্র হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে  নভেরা আহমেদের প্রথম ও শেষ একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী দেখার, সেটি ১৯৬০ সালে।
আমাদের আরেকটি সৌভাগ্য পাবলিক লাইব্রেরির পাশেই নির্মিত চারুকলা ইনস্টিটিউটশন ক্যাম্পাস দেখার সুযোগ। এটিও স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায় গড়ে তোলা হয়েছে। ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচারের আরেকটি সুন্দর উদাহরণ। পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের তুলনায় আরো বেশি খোলামেলা, আরো রোমান্টিক। প্রশাসনিক অংশটুকুই শুধু দোতলা, একাডেমিক অংশ দীর্ঘ, ক্রিসেন্ট আকৃতির ভবন, একপাশে বিশাল চওড়া বারান্দা, আলো-বাতাসের অবাধ সুযোগ, ভবন নির্মাণে দেশীয় উপকরণ ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুযোগ রাখা হয়েছিল। মূল অ্যাকাডেমিক ভবনের পেছনদিকে মস্ত একটি গোল পুকুর খনন করা হয়েছিল, সঠিক ভূতাত্ত্বিক তথ্যসমৃদ্ধ না হওয়ার কারণে এর খনন খুব একটা কার্যকর হয়নি। এটি শেষ পর্যন্ত একটা মস্ত ‘হোল’ বা গর্তমতোই রয়ে গেছে।
চারুকলা ইনস্টিটিউশন বহু বছর পর্যন্ত ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রথমে ইনস্টিটিউশন, পরে কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ নয়, সে-কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এত কাছাকাছি অবস্থান সত্ত্বেও এর ছাত্র-শিক্ষকরা খুব বেশি চারুকলায় প্রবেশ করতেন না। তবে প্রদর্শনীর সময় কলেজের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত।
আমার সুযোগ ছিল প্রায় যখন-তখন চারুকলায় যাওয়া-আসার। এর একজন প্রথম দিককার ছাত্র, পরে আজীবন শিক্ষক, ছিলেন আমার ছোট চাচা শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। তাছাড়া চারুকলার প্রতিষ্ঠাতা-প্রিন্সিপাল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পেয়েছি আমি। তাঁর কাছেই জেনেছি, তিনি এবং স্থপতি মাজহারুল ইসলাম কীভাবে একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে চারুকলা ক্যাম্পাসে কতটা খোলা জায়গা রাখবেন, কোন কোন গাছ রাখবেন, কোন গাছ নতুন করে লাগাবেন ইত্যাদি বিষয়। তাঁদের যৌথ নান্দনিক চিন্তার কারণেই চারুকলার বকুলতলা এখন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
পাবলিক লাইব্রেরি বা চারুকলা ভবন, কোনোটিতেই এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, এমনকি বিদ্যুৎ না থাকলেও স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ এগুলো ছিল একেবারেই জলবায়ু বা আবহাওয়াবান্ধব স্থাপত্য। অবশ্য ভবনের ডিজাইনে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা যে ছিল না তা হয়তো নয়। আমরা যারা স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র নই তাদের কাছেও মনে হতে পারত চারুকলার অধ্যক্ষের মূল অফিসকক্ষটি, যেখানে শিল্পাচার্য নিজেও বসতেন, কিংবা শিক্ষকদের বসার কক্ষটি (বর্তমানে ডিন মহোদয়ের কক্ষ) খুব আদর্শ নয়, বিশেষ করে কক্ষের মধ্যে পিলার রাখার কারণে। তবে চারুকলার ঘোরানো সিঁড়ি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরির র‌্যাম্প বেশ লাগত।
মাজহারুল ইসলাম পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি বা চারুকলা ভবনের (এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি ভবন) নকশায় যে স্থাপত্যিক দৃষ্টান্ত এনেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে এদেশের স্থাপত্যচিন্তাকে নতুনত্ব দিয়েছে। অবশ্য একজন নগরবিদ হিসেবে এখন আমার মনে হয়, এসব ভবন বা ক্যাম্পাস নির্মাণের সময় মাজহারুল ইসলাম সম্ভবত ঢাকা শহরের দূরবর্তী ভবিষ্যৎ ততটা আমলে আনতে পারেননি। নগরের প্রায় কেন্দ্রীয় অবস্থানে এতটা নিচু উচ্চতার ভবনাদি নির্মাণের যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ।
মাজহারুল ইসলামের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ডিজাইন ও ভবনাদির স্থাপত্যিক নকশা। প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি সম্মান রেখে এ-দুটো ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে, ভবনসমূহের নির্মাণ উপাদান নির্বাচন করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোর সংস্কারাকৃত সংরক্ষণ অবশ্যই প্রশংসনীয় ও অনুসরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেশাগত কারণেই আমার এসব ক্যাম্পাসে বারবার বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে এবং প্রতিবারই স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মৌলিক অবদানের কথা মনে পড়েছে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে বিভিন্ন সময় স্বল্পকালীন আলাপের কিছু কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। তবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শুধু আমরা দুজন একসঙ্গে ঢাকা-জাকার্তা ও জাকার্তা-ঢাকা ভ্রমণের এবং প্রায় চারদিন জাকার্তায় এক পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করার। এটি ছিল ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত একটি হাউজিং সেমিনার। আয়োজক ছিল আগা খান ফাউন্ডেশন ফর আর্কিটেকচার। গৃহায়নের স্থাপত্যিক দিক ছাড়াও আর্থ-সামাজিক নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল এ-সেমিনারে। প্রিন্স করিম আগা খান ও বেগম আগা খান পুরো সময়টাতেই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। মাজহারুল ইসলাম খ্যাতিমান স্থপতি হিসেবেই আগা খানের শ্রদ্ধালাভ করেছেন। তিনি আগা খান অ্যাওয়ার্ড ইন আর্কিটেকচারের সম্মানিত জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি ছিলাম পুরস্কারের একাধিক পর্বে মনোনয়নকারীদের একজন।
এই ভ্রমণের সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামের চেয়ে বয়সে ও মেধায় তাঁর অনেক জুনিয়র ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও আমার প্রতি তাঁর অত্যন্ত বিনয়ী ও সস্নেহ ব্যবহারে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলাম।
এই ভ্রমণকালে এবং পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জনপদ বিন্যাস ও বাস্তুব্যবস্থা নিয়ে তাঁর  চিন্তা-চেতনার কথা জেনেছি। তিনি ‘ত্রিমাত্রিক’ পরিকল্পনা ও বাস্তু-উন্নয়নের কথা বলতেন। গোটা দেশটির শহর-গ্রাম জনপদের সমন্বিত উন্নয়নের কথা বলতেন। আমি নিজেও এরকম ধারণা পোষণ করি। এত ছোট দেশে এত বিশাল জনসংখ্যা – এখানে প্রতি বর্গইঞ্চি ভূমি সুপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে খুবই সংকটময়। শুধু একটি ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণ নয়, শুধু শহর বিশেষের পরিকল্পিত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, গোটা দেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন চিন্তার বিকল্প নেই। মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মাজহারুল ইসলামের উন্নয়ন-দর্শন তো এমনটাই ছিল।