দারিও ফোর পোপের কন্যা আধা-উপন্যাস, আধা-ইতিহাস

হাসান ফেরদৌস

দারিও ফো উপন্যাস লিখেছেন, এ-খবরটি ইউরোপে এবং অংশত আমেরিকায় পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। ১৯৯৭ সালের নোবেল বিজয়ী ফো তাঁর রাজনৈতিক নাটকসমূহের জন্যই পরিচিত। অবশ্য শুধু নাট্যকার নন তিনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের নাটকের মুখ্য অভিনেতা ও সে-নাটকের পরিচালকও তিনি।  নিজেকে ‘ভাঁড়’ হিসেবে পরিচয় দিতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। সার্কাসের ক্লাউন, উচ্চকণ্ঠ ও কারো কারো কাছে বিরক্তিকর এই ফো গত অর্ধশতক ধরে আমাদের হাসাচ্ছেন, সুড়সুড়ি দিচ্ছেন, ভাবাচ্ছেন।  কমেডিকে তিনি নিজের বামঘেঁষা সামাজিক কমেন্টারির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন সফলভাবে। সেই ফো উপন্যাস লিখেছেন, ব্যাপারটা আমাদের দারম্নণ উদ্দীপ্ত করেছিল।

কিন্তু হলফ করে বলছি, ফোর প্রথম উপন্যাস, ইংরেজিতে দি পোপ’স ডটার, পাঠক হিসেবে আমাকে ঠিক খুশি করতে পারেনি।  ফোর পরিচিত সব বৈশিষ্ট্যই এতে আছে, এমনকি নাটকের টেকনিক্যাল ভাষা পর্যমত্ম। কিন্তু গ্রন্থটি ইতালীয় ইতিহাসে যথেষ্ট অভিজ্ঞ নয়, এমন পাঠকের জন্য বড়জোর মনোরঞ্জনমূলক ও বহুবর্ণিল একটি অভিজ্ঞতা। উপন্যাসের ব্যাপ্তি আছে ঠিকই, কিন্তু  গভীরতা নেই। শিক্ষকের মতো ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে ফো আমাদের অনবরত ঠিক-বেঠিক ধরিয়ে দেন, তাতে ইতিহাসের জটিলতা উদ্ধার সহজ হয়, কিন্তু উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা পূর্ণতা পায় না।

ফো আমাদের কাছে পরিচিত প্রধানত তাঁর দুটি নাটক –  অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ অব অ্যান অ্যানারকিস্ট এবং হারলেকিনের জন্য।  প্রথমটি প্রবল রকম রাজনৈতিক, পুলিশি নির্যাতনের প্রতীকে ধনতান্ত্রিক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে সকল ভিন্নমত ও প্রতিবাদকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে, তার ক্রুদ্ধ, তিক্ত এবং প্রথাবিরম্নদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিবাদ।  অন্যটি একটি ফারস, শুধু প্রহসন হিসেবে যা অনায়াসে উপভোগ করা যায়, আবার তাঁর রাজনৈতিক ও নৈতিক বক্তব্য উদ্ধার যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা সে-নাটকের এই দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিও পুরোপুরি উপভোগে সমর্থ।

ফোর নাটকের হাস্যরস তার পরিলেখে বেশ স্থূল, সচেতনভাবেই ফো কমেদিয়া দেলাআর্তের মডেলটি অনুসরণ করে থাকেন। এর একটি কারণ, খুব পরিশীলিত দর্শক তাঁর টার্গেট নয়। খেটে খাওয়া মানুষ, শহুরে প্রামত্মবর্তী মানুষ, ফো আশা করেন, তাঁরাই এই নাটক দেখতে আসবে। তাঁর নাটকের গল্পও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমন মানুষদের ঘিরেই।  রাজনীতি ও কমেডি – এই দুইয়ের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত সংমিশ্রণে তাঁর পারঙ্গমতার জন্য ফোকে ব্রেখটের ক্লাউন বলে অভিহিত করা হয়েছে। ফোর একটি অলক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, নিকট-দূরত্ব থেকে নিজেদের যাপিত বাসত্মবতার নাটকীয় রূপায়ণ দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর নিম্নবর্গের দর্শকদের রাজনৈতিকভাবে অধিকতর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করবে। ব্রেখটের মতো ফোও তাঁর নাটককে ‘এপিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেখানে সচেতনভাবে মঞ্চায়িত নাটকের সঙ্গে নাটক যারা দেখছে তাদের মধ্যে একধরনের ‘বিচ্ছিন্নতা’ অর্জনের লক্ষ্য তিনি অনুসরণ করেন।  মঞ্চে যা দেখছি তা আমার জীবনের কাহিনি বটে, কিন্তু সে-কাহিনি পরিবর্তনযোগ্য, পরিবর্তনের পক্ষে এই অনুভূতি নিয়ে দর্শক ঘরে ফিরবে, ফো তা-ই আশা করেন। নাটক নয়, যেন সামাজিক কমেন্টারি, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতার কলাম লেখক, এভাবে ফোর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই মুখ্য অভিনেতা, শুধু কথা নয়, সার্কাসের ক্লাউনের মতো অঙ্গভঙ্গি তাঁর অভিনয়ের প্রধান হাতিয়ার।  ফলে অভিনয় বাদ দিয়ে শুধু সংলাপ অনুসরণ করে ফোকে উদ্ধার অসম্ভব।

পোপের কন্যা উপন্যাসে ফোর অভিনয় নেই, এই গল্প বুঝতে আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হচ্ছে তাঁর কথকতায়। ফলে মঞ্চনাটকে যে-কমেন্টারি শুধু শিক্ষণীয় নয়, তা প্রবল রকম মনোরঞ্জনমূলক বলে আমরা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করি, ছাপা বইয়ের পাতায় তাকে কিছুটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষকতা মনে হয়। অনুমান করি, এমন একটা বিপদের ব্যাপারে সচেতন হয়েই ফো উপন্যাস রচনার এই বিশেষ ফর্মটি নির্বাচন করেছেন। শুধু গল্প বলা নয়, গত পাঁচশো বছর ধরে আমাদের পরিচিত ইতিহাস তিনি সংশোধনে উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে তা যদি কোথাও-কোথাও ক্লাসরম্নম লেকচারে পরিণত হয়, ফো তাতে আপত্তির কোনো কারণ দেখেননি।

পোপের কন্যা উপন্যাসের বিষয় ভ্যাটিকানের পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দারের কন্যা লুক্রেজিয়া। নানা কারণে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার ও তাঁর এই কন্যা ইতিহাসে সুপরিচিত, তবে সেসব কারণের কোনোটাই খুব প্রশসিত্মমূলক নয়। ফো ইতিহাসের এই পরিচিত রায়টি বদলে লুক্রেজিয়াকে নতুন এক সদর্থক চেহারায় আমাদের সঙ্গে পরিচিত করাতে চান।

লুক্রেজিয়াকে নিয়ে এই প্রথম গ্রন্থ রচিত হলো, তা নয়। বস্ত্তত, মধ্যযুগে ভ্যাটিকানের রাজনৈতিক ইতিহাস যাঁরাই লিখেছেন, তাঁদের হাতে অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে লুক্রেজিয়ার নাম। ভিক্তর উগো তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে অপেরা লিখেছেন রাফায়েল সাবাতিনি। সেই সতেরো শতকেই জন ফোর্ড মঞ্চনাটক লিখেছেন, ইটস এ পিটি শি ইস এ হোর। নাম থেকেই বোঝা যায় ভেতরের গল্প কী। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন টেলিভিশনে দুটি সফল সোপ অপেরা নির্মিত হয়েছে বরজিয়াদের নিয়ে, যেখানে সকল কাহিনি আবর্তিত হয় পোপ আলেকজান্দার ও তাঁর এই কন্যাটিকে ঘিরে। প্রায় সর্বত্র লুক্রেজিয়া একজন অতিনষ্টা মেয়ে। সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু যিনি নিজের রূপ ও যৌবনকে ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনে ব্যবহারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। একাধিকবার বিয়ে করেছেন, প্রেমিকের সংখ্যা অগুনতি, তাদের তালিকায় নিজের পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও রয়েছেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে অতিনিপুণা ও শত্রম্নর প্রতি নিষ্ঠুর। কিন্তু এই লুক্রেজিয়া নয়, ফো আমাদের এক ভিন্ন লুক্রেজিয়ার কথা বলতে চান, যিনি পিতা ও ভ্রাতার রাজনৈতিক চক্রামেত্মর শিকার হওয়া সত্ত্বেও নিজের মানবতাকে ধরে রাখতে সমর্থ।

ভূমিকাতেই ফো তাঁর উপন্যাসের নায়িকা বিষয়ে নিজের সহানুভূতি গোপন রাখেন না। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ইতিহাসের প্রতি বাঁকে বাঁকে, তাঁর শৈশব থেকেই লুক্রেজিয়াকে অন্যের স্বার্থ অর্জনের ঘুঁটি বানানো হয়েছে, তাঁকে যেমন খুশি বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।  বিন্দুমাত্র নৈতিক সংশয় ছাড়া এই কিশোরী মেয়েটিকে ব্যবহার করা হয়েছে, তিনি কী ভাবছেন, তা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, কোনো বিবেচনা নেই। ‘লুক্রেজিয়া তো শুধু একটি নারী’, অতএব তাঁর নিজস্ব বিবেচনাবোধ হিসাবের মধ্যে রাখার প্রয়োজন কোথায়!  অতিধার্মিক ভ্যাটিকান বিশেষজ্ঞদের প্রতি বিদ্রূপের স্বরে ফো লিখেছেন, গল্প-নাটকে লুক্রেজিয়ার যে চিত্র, তাতে ‘তিনি শুধু চমৎকার সত্মনের ও নিতম্বের অধিকারী, এ ছাড়া আর কিছু নয়।’

মনে রাখা দরকার, আমরা বলছি পঞ্চদশ শতকের শেষ – ষোড়শ শতকের গোড়ার কথা।  সে এমন একটা সময় যখন ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন – এই তিন দেশ একে অপরের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য পরস্পরকে খুবলে খাচ্ছে। এই তিনজনের মাঝখানে রয়েছেন ভ্যাটিকানের পোপ, তিনি একাধারে ক্যাথলিক বিশ্বের ধর্মীয় নেতা, অন্যদিকে বিভক্ত রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। ÿুদ্র-ÿুদ্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী নৃপতিবৃন্দকে তিনি ইচ্ছামতো ওপরে ওঠান, নীচে নামান। বিপুল ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের অধিকারী পোপ স্বাভাবিকভাবেই দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠেন। তাঁকে ঘিরেই চলে ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্র, হত্যা ও গুম-খুনের রাজনীতি।  আর ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে যা আসে তা হলো যৌন-স্বেচ্ছাচার। এখন যেমন, সে-সময়েও পোপ বিয়ে করতে পারতেন না, কিন্তু তাই বলে নারীসঙ্গ ভোগে তাঁর কোনো সমস্যা হত না। পোপ আলেকজান্দারের পূর্বসূরি পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট সম্বন্ধে একজন ঐতিহাসিকের কথা উদ্ধৃত করে ফো ভূমিকায় লিখছেন :

‘পোপ পরিচিত ছিলেন বহু নারী পরিবৃত হয়ে যৌন উলস্নাসের জন্য।  খুব নামিদামি বেশ্যাদের সাড়ম্বরে নিমন্ত্রণ জানানো হত নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। এই প্রতিযোগিতার একটি উলেস্নখযোগ্য দিক ছিল, নর্তকীরা নিতম্ব দুলিয়ে মেঝে পর্যমত্ম নেমে আসবে, যেখানে জ্বালানো থাকত সুবাসিত বিভিন্ন মোমবাতি। নর্তকীদের কাজ ছিল, যার-যার ঘাগরা পোশাক তুলে সেই মোমবাতি নেভানো, তারপর যার-যার নিতম্বের মাঝখানে সেই মোমবাতি তুলে আনা। যারা নিজেদের নিতম্ব-দ্বারে সে মোমবাতি তুলতে সমর্থ হতো, তাদের জন্য ছিল বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালি।’

এই পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট, যাঁর মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে রচিত হয়েছে পোপ’স ডটার, তাঁর সম্বন্ধে একজন সমসাময়িক ধর্মগুরম্নর মমত্মব্য ছিল, এই লোকটির ভেতর নিষ্পাপ হল একমাত্র তাঁর নামের ‘ইনোসেন্ট’ অংশটুকু।

উপন্যাসের শুরম্নতেই ফো আমাদের জানিয়ে দেন অষ্টম ইনোসেন্ট মারা গেছেন, এখন তাঁর স্থান দখল করবেন সেই ব্যক্তি, লটারিতে জেতার জন্য যিনি সবচেয়ে অধিক উৎকোচ দিতে সমর্থ। স্পেনের রাজপরিবারের বদান্যতায় সেই পুরস্কার জিতে নিলেন কার্ডিনাল রদরিগো বরজিয়া, ক্ষমতাগ্রহণের পর তাঁর নাম হলো পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার। এই আলেকজান্দারের দ্বিতীয় পুত্র হলেন সিজার, পিতার নাম ব্যবহার করে যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন।  খুন, অর্থ, অপহরণ, প্রতিবেশী রাজ্য আক্রমণ ও ক্ষমতা দখল, হেন অপকর্ম নেই যা তাঁর করায়ত্ত ছিল না। এই সিজারের কথা মনে রেখেই ম্যাকিয়াভেলি লিখেছিলেন তাঁর রাজন্যবর্গের দুষ্কর্মের ম্যানুয়েল, দি প্রিন্স নামে চটি বইখানা।

খ্রিষ্টের সেবায় আত্মোৎসর্গকৃত অন্য সকল যাজকের মতোই রদরিগো বরজিয়া অবিবাহিত ছিলেন, তবে পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য অনুসরণ করে তিনিও একাধিক রক্ষিতার ভরণপোষণের দায়িত্ব বহন করতেন। এঁদের একজন ভনোজ্জা, তাঁরই গর্ভে আলেকজান্দারের চার সমত্মানের জন্ম, যার অন্যতম পুত্র সিজার ও কন্যা লুক্রেজিয়া। ফো আমাদের জানাচ্ছেন, বিবাহবহির্ভূত হলেও তাঁর সমত্মানেরা যাতে স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশে বড় হতে পারে সেজন্য কার্ডিনাল রদরিগো চেষ্টার কসুর করেননি। অর্থ ও গৃহের ব্যবস্থা তো ছিলই, তিনি লোক-দেখানো একজন ‘বাবা’ও তাদের জন্য বন্দোবসত্ম করেছিলেন। নিজে সাজলেন চাচা, আর নিজের এক অধসত্মন কর্মচারীকে নিয়মিত বেতন দিয়ে বানালেন বাবা। রদরিগো প্রায় প্রতিরাতেই পেছন দরজা দিয়ে প্রিয় রক্ষিতার ঘরে ঢুকতেন। তাঁর আসার আগেই নকল বাবা গৃহত্যাগ করতেন, বিছানায় স্ত্রীর পাশে তখন জায়গা নিতেন চাচা রদরিগো। আবার সকাল হতে না হতেই খিড়কিপথে চাচার প্রস্থান ও নকল পিতার পুনঃপ্রবেশ। পুরো ব্যাপারটা ফোর বিবেচনায়, অতিউত্তম কমেদিয়া দেলাআর্ত।  নকল পিতা/ স্বামীর প্রতি তিনি যে কিছুটা অধিক সহানুভূতিশীল, ফো সেকথাও গোপন রাখেন না। একদিকে মনিব কার্ডিনালকে খুশি রাখা, অন্যদিকে একই শয্যায় থাকা সত্ত্বেও মনিব-স্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখা, তদুপরি চার-চারটে ছেলেমেয়ের সঙ্গে পিতার ভূমিকায় অভিনয় করে যাওয়া, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়। এমনও নিশ্চয় ঘটেছে যে, কোনো কারণে মাকে খুঁজতে এসে কোনো ছেলে বা মেয়ে দেখে মায়ের বিছানায় বাবার বদলে চাচা শুয়ে।  এমন অবস্থায় সব দিক সামলে চলা, উহ্, কী কঠিন কাজ!  এরপর কমেদিয়া দেলাআর্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ এক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করে সেই নকল পিতা মারা গেলেন। বিব্রত হওয়ার মতো মানুষ নন রদরিগো, তিনি অনতিবিলম্বে তাঁর আরেক অধসত্মন কর্মচারীকে নকল পিতার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচন করলেন।

আরো ছয় বছর এভাবে কেটে যাবে। পোপ ইনোসেন্ট মারা গেলে ভাগ্য খুলে গেল রদরিগোর। ১৪৭২ সালে তিনি পোপ হিসেবে ভ্যাটিকানের সিংহাসনে সমাসীন হলেন। এবার রদরিগো ঠিক করলেন, আর নয়, এবার ছেলেমেয়েদের কাছে নিজের পরিচয়-রহস্য তুলে ধরবেন। চার ছেলেমেয়েকে ডেকে তিনি জানালেন, যাকে তারা বাবা বলে জেনেছে সে বাবা নয়। যাকে তারা চাচা বলে জেনেছে সে-ই আসল বাবা।  আর হ্যাঁ, আর এই বাবাই এখন ভ্যাটিকানের সর্বেসর্বা পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার।  সে-সময় জ্যেষ্ঠ পুত্র হুয়ানের বয়স ১৮, দ্বিতীয় পুত্র সিজার ১৬, কন্যা লুক্রেজিয়া ১২ এবং কনিষ্ঠ কন্যা জফরে ১০।

তাঁর কথা শুনে ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই হতভম্ব। সিজার কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘তার মানে আপনারা সবাই এখানে কোনো না কোনো ভূমিকায় অভিনয় করছেন মাত্র। তাহলে আপনি কে?’

রদরিগোর জবাব, ‘আমি তোমাদের পিতা, শুধু আত্মিক পিতা নই, প্রকৃত পিতা।’ সিজারের পালটা প্রশ্ন, ‘তাহলে এতদিন সেকথা বলেননি কেন?’ রদরিগোর জবাব, ‘সর্বনাশ, তাহলে কী স্ক্যান্ডাল হতো ভেবে দেখো। আমি সহকারী পোপ, আমার শুধু প্রেমিকা রয়েছে তাই নয়, চার-চারটে ছেলেমেয়েও রয়েছে। তোমরাই বা সেকথা কীভাবে গ্রহণ করতে, বলো?’  লুক্রেজিয়া চোখের জল নাকের জল এক করে বললেন, ‘কিন্তু আপনি তো এতদিন বলে এসেছেন মিথ্যা কথা বলতে নেই।’ পোপের কাছে লুক্রেজিয়ার প্রশ্ন, তাঁদের একজন নয়, তাঁদের দুজন পিতা, একথা নিয়ে টিটকারি করে যদি তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা জিজ্ঞেস করে, তোর বাবারা সব কেমন আছে, তাহলে কী জবাব দেব?

রদরিগো শামত্মস্বরে বললেন, ‘শোনো, কেউ এই প্রশ্ন করলে শুধু তাদের জিজ্ঞেস করবে, তাদের বাবারা কেমন আছে? বাছারা, জেনে রেখো যে, ভ্যাটিকান ও তার আশপাশে অবৈধ নয় এমন ছেলেপুলে খুব সামান্যই আছে। বিয়ে হয়েছে এমন মহিলার সংখ্যাও তথৈবচ।’

এই উদ্বোধনী অধ্যায় থেকে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না ফো ভ্যাটিকানের কলুষতামাখা প্রবল অন্ধকারময় এক ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করাচ্ছেন। বস্ত্তত, উপন্যাসটির নাম যদিও পোপের কন্যা, এর কেন্দ্রে লুক্রেজিয়া নামের মেয়েটি, কিন্তু ফো চিত্তের যাবতীয় ঝাল মিটিয়ে পোপ আলেকজান্দার ও তাঁর সমসাময়িকদের নষ্টামির সুবিসত্মৃত বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা সে-বর্ণনায় যাব না। পোপের নিষ্ঠুর ও দুর্বৃত্ত পুত্র সিজারের গল্প বলেও আমরা সময় নষ্ট করব না। উভয়ের বল্গাহীন পাপাচারের নাটকীয় বিবরণ প্রকৃত ইতিহাসবিদেরাই দিয়েছেন। এমনকি দি বরজিয়াস টিভি সিরিজেও সে-নষ্টামির বিবরণ বেশ বস্ত্তনিষ্ঠভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। ফোর আসল উদ্দেশ্য এই দুই নষ্ট গোপালের কুকীর্তির সাড়ম্বর বর্ণনার পটভূমিতে লুক্রেজিয়াকে বুদ্ধিমতী, সৎ ও ন্যায়বতী হিসেবে প্রতিষ্ঠা।

পিতা ও ভ্রাতার রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের অসহায় পুতুল হিসেবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে লুক্রেজিয়ার প্রথম বিবাহ। ভ্রাতার নির্দেশে সে বিয়ে বাতিল হয়ে যায় এই অদ্ভুত যুক্তিতে যে, স্বামী নপুংসক হওয়ার কারণে তাদের বিয়ে আদতে সম্পন্নই হয়নি।  লুক্রেজিয়া সেই স্বামীকে ভালোবাসতেন কি না আমরা সে-কথা ঠাহর করার আগেই তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। দ্বিতীয় স্বামী তরম্নণ আলফনসোকে লুক্রেজিয়া যথার্থই ভালোবাসতেন, কিন্তু এবারেও নাক গলালেন সিজার। তাঁর নির্দেশে খুন হলেন আলফনসো। এরপর তাঁর বিয়ে হয় করদ রাজ্য ফেরারার রাজপুত্র আরেফ আলফনসোর সঙ্গে। সে-বিয়ে যে শেষ পর্যমত্ম টিকে যায় তার কারণ কোনো অঘটনের আগেই পোপ আলেকজান্দার মারা যান এবং তার কয়েক বছরের মধ্যে সিজার নৃশংসভাবে নিহত হন। বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে অবশ্য লুক্রেজিয়া একাধিক প্রেমিক গ্রহণ করেছিলেন, সেদিক দিয়ে তিনি পিতা ও ভ্রাতার চেয়ে খুব পিছিয়ে ছিলেন না।

ফো এই রাজনৈতিক উপন্যাসে বরজিয়া পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাস-বর্ণনা বেশ রসিয়ে রসিয়ে করেন। ভ্যাটিকানের আপাত নীতিপরায়ণ ও ঈশ্বরপ্রেমে উৎসর্গীকৃত পোপ ও কার্ডিনালের  জীবনযাপনের যে-গালগপ্প শুনে আমরা অভ্যসত্ম, তার পুরোটাই যে সাজানো, ফোর ইতিহাসভিত্তিক এই নির্মাণ থেকে তা আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। ফো অবশ্য কোথাও একথা বলেন না যে, আজকের ভ্যাটিকান এখনো আগের মতো নষ্টামির আখড়া। কারণ, অনুমান করি, লেখক আশা করেন তাঁর প্রস্ত্তত ইতিহাসের এই ভিত্তিভূমি থেকে যথাযথ উপসংহারে আমরা নিজেরাই পৌঁছাতে পারব।

ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ টেনে নামানোর এই কাজটি ফোর অলক্ষ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। কিন্তু আশু উদ্দেশ্য হলো, লুক্রেজিয়াকে ইতিহাসের নর্দমা থেকে উদ্ধার। ফো নিজেই জানিয়েছেন, লুক্রেজিয়া চিত্রণের সময় তাঁর নিজের স্ত্রী ফ্রাঙ্কে রামার কথা মনে পড়েছে।  ফ্রাঙ্কে ফোর দীর্ঘদিনের সহকর্মী; শুধু নাটকের ক্ষেত্রে নয়, ফোর রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গেও তাঁর ছিল অভিন্নতা। ফোর সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ অব অ্যান অ্যানারকিস্টের মাধ্যমে ইতালির পুলিশব্যবস্থার নৃশংসতা তুলে ধরেছিলেন। পুলিশি হেফাজতে থাকার সময় একজন রেলশ্রমিককে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলার সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে নাটকটি রচিত। ইতালির পুলিশ ও সে-দেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের ধারণা, ফো নয় – ফ্রাঙ্কে রামাই এই গোপন তথ্যটি উদ্ধার করেছিলেন। তাদেরই নির্দেশে ফ্রাঙ্কেকে অপহরণ করা ও রোমের কাছে এক পরিত্যক্ত ভ্যানে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়। তারপরেও ফ্রাঙ্কে মোটেও নুয়ে পড়েননি। সুস্থ হওয়া মাত্রই নতুন নাটক নিয়ে তিনি ও ফো রোমের নাট্যমঞ্চে হাজির হন, সে-নাটকের নাম দি রেপ

ফ্রাঙ্কে রামার অমিত জীবনীশক্তি ও প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বের ছাপ ফো দেখেছিলেন লুক্রেজিয়ায়। এই উপন্যাসে শেষ পর্যমত্ম যে লুক্রেজিয়াকে আমরা পাই তিনি দয়ালু, নীতিবতী, অসীম সাহসী এবং কাব্যপ্রেমী। নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন একাধিক রাজ্য তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন পোপ আলেকজান্দার। স্বামীর করদ রাজ্যটিও লুক্রেজিয়াই শাসন করতেন। পিতা ও ভ্রাতাকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে লুক্রেজিয়া নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। আলেকজান্দারের সময়, তাঁর যাবতীয় অনৈতিক কূটকলা সত্ত্বেও ইতালি শিল্প-সংস্কৃতিতে বিপুল সাফল্য অর্জন করে।  ফোর বিবরণ থেকে মনে হয়, এর পেছনে অধিক কৃতিত্ব পোপের এই তৃতীয় সমত্মান, লুক্রেজিয়ার। এই সময়ে সবচেয়ে প্রসার ঘটে স্থাপত্যকলার। লুক্রেজিয়ার আর্থিক সমর্থন যে এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে সে-তথ্য ফো আমাদের জানাতে ভোলেন না।

লুক্রেজিয়াকে নতুন আলোকে উপস্থিত করার এই ব্যক্তিগত প্রকল্পে ফো অংশত সফল হন, একথা বলা অন্যায় হবে না। তিনি যে গল্প বলছেন তার ভিত্তিতে যে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস, সে-কথা প্রমাণের জন্য ফো গ্রন্থশেষে দীর্ঘ গ্রন্থ-তালিকা দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, শুধু একটি ইতিহাস গ্রন্থ হলে, আমরা পোপের কন্যার মূল্যায়ন করতাম একভাবে, উপন্যাস আরেকভাবে। ফোর কাছ থেকে যে রাজনৈতিক প্রহসন পেয়ে আমরা অভ্যসত্ম, তার বদলে এখানে পাওয়া গেল এমন এক গ্রন্থ, যা বড়জোর আধা-উপন্যাস আধা-ইতিহাস। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত আমাদের পায়ের পাতার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে তা ঠিক, কিন্তু যে চরিত্রসমূহ দিয়ে সে ঘটনার নির্মাণ, তার কোনোটাই চারিত্রিক পূর্ণতা পায় না। পোপ আলেকজান্দার বা সিজার এখানে যেভাবে প্রকাশিত হয়, তাতে তাঁদের বড়জোর কার্টুন বলে মনে হয়। এমনকি লুক্রেজিয়াও, যাঁর প্রতি নিজের সহানুভূতি ও পক্ষপাতিত্ব ফো কখনোই গোপন রাখেন না, তাঁকেও ঠিক রক্ত-মাংসের মানুষ বলে মনে হয় না, বরং ইতিহাসের রহস্যময়ী এক চরিত্র হিসেবে প্রতীয়মান হন। শুধু একপর্যায়ে, যখন লুক্রেজিয়া ও ইতালীয় কবি পিয়েত্রো বেম্বোর মধ্যে প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন মনে হয়, এই মহিলার বুকের ভেতর এক অজ্ঞাত নিঃস্বতা রয়েছে, তিনি প্রেমের কাঙাল।

এই বইয়ের এক অতিরিক্ত প্রাপ্তি ফোর নিজের হাতে অাঁকা প্রতিটি প্রধান চরিত্রের চমৎকার পোর্ট্রেট।