দুটি কবিতা

ভূমেন্দ্র গুহ

বাবা

এক
কাল রাতের বেলা বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন
দরজার চৌকাঠে, আমাদের ডেকেছিলেন।
কোথাও গিয়েছিলেন, আটকে পড়েছিলেন।
জামা-কাপড় পালটাতে আমাদের দেরি হল

কেন-যে জানতুম না। হি-হি শীতের হাওয়া ছিল
সারা-রাত। রাস্তাগুলি লম্বা, কালো, অন্ধকার।
শেষ-অব্দি সেই ছোটো শহরটায় আমরা পৌঁছুলুম –
ভিজে স্যাঁতসেঁতে। রাস্তার গা ঘেঁষে তিনি

ল্যাম্প-পোস্টটা জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালেন।
রাস্তার পাশে শীত, পিছনে শীত, হাওয়া।
আমি আড়চোখে দেখলুম যে, তাঁর পা-এ
ভাঙাচোরা সাবেক কালের জুতো, যে-যুগে

জুতো পরবার রেওয়াজ ছিল না, সে-যুগের।
বিশ-ত্রিশের দশক হবে। তুষের শাল – সে-রকম।
বিড়ি খাচ্ছিলেন। সঙ্গে নিয়ে বেরোতে তিনি
এত দেরি করলেন কেন? হতে পারে যে,

কোনও এক দেশে তিনি আমাদের কোনও
এককালে ভুল ক’রে রেখে এসেছিলেন।
অথবা, আমি নিজে ভুলে গিয়েছিলুম যে,
সেই ছোটো শহরটায় শীত ছিল, তিনি ছিলেন।
দুই
ঘুম থেকে জেগে উঠলেই সমুদ্রের আলোগুলি
মনে করিয়ে দেয় আমাদের পুরোনো বাড়িটা
কী অন্ধকার, কী পুরোনো। আমাদের বাড়িটা।
হৃদয়পুর-এ একবার বেড়িয়ে এলেই ঢের।

ছাতিমতলা-হাতিয়াড়ার মোড়ে খুব শিগগির
ফিরে এলুম, মনে হল আমি দাঁড়িয়ে আছি
লেদ-মেশিনটার গা ঘেঁষে, আমার মৃত বাবা
আমার পাশে। আমরা আস্তে কথা বলছিলুম।

তাঁর চোখ আমার বুকের উপর সেঁটে ছিল।
আমি প্রথমবার বললুম, দ্যাখো তো আমাকে
যখন আমি কথা বলি। ছোটো উষ্ণ কুঠুরিটা
দেখছিলুম আমি, অন্ধকার যন্ত্রপাতি, তেল-কালি

মেঝে, বন্ধ জানালা, মাকড়সার-জাল, সাঁড়াশি।
কিন্তু জানালার বাইরেই রোদ সমুদ্রের আলোর,
হাড়ের আলোর, মাঠের আলোর, মরুভূমির
আলোর কথা বলে। এই আলোই তলোয়ারের,

পদ্মা-মেঘনা মিলে গেলে সেই কবেকার জলের
খাপ খুলে ছিটকে বেরিয়ে আসে, মৃত্যুর আগের
ফ্যাকাশে মুখের থেকেও। বাবা আস্তে বললেন,
‘চোখ তুললেই আমরা ওখানে দাঁড়াব গিয়ে।’