দুষ্কালের দুঃখগীত

বসন্ত রায় চৌধুরীBasanta-Roy-Chudhurynew

‘যতটা হয়েছি আলো, তার চেয়ে পুড়ে গেছি বেশি।’ কবিতার লাইনটি ময়ূখ চৌধুরীর লেখা। মনে হয়, মানুষ এ-যাত্রায় বেঁচে গেল। দুঃসহ স্মৃতি তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। স্মৃতিই মানুষকে জাগিয়ে রাখে। বস্ত্রবালিকাদের দুঃসহ স্মৃতি শুধু একবার করে মনে করায় কেমন ছিল রানা প্লাজার সেই দিন? তাজরীন ফ্যাশনসে জ্বলে ওঠা আগুনের ফুলকি? মানুষ কতটা আর বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে ভেবেছে? দিলারা বেগম জলির ‘বয়ন বয়ানে’ আমরা পাঠ করি সেই দিনপঞ্জি। দিলারা বেগম জলির শিল্পভাষায় মানুষের কথা উঠে আসে। স্থির, সিণগ্ধ জীবনযাপন, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, অধিকার, মানবিকতা, সবকিছুতে আবর্তিত হয়ে থাকে মানুষ। আর নারীই এ-চাকা ঘোরায়। সচল চাকায় নারী শ্রম দেয়। তিনটি ভিডিও আর্টের মাঝে শিল্পী নিজেও পারফর্ম করেছেন। আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে নিজের শরীরে বেঁধে দেন দড়ি-সদৃশ কাপড়। একসময় ছিটকে পড়েন। চোখে-মুখে রক্তের  আভা লেগে থাকে, টেনে ধরা সাদা কাপড়ে এই ভিডিও আর্টের শিরোনাম ‘উই’। সময়কাল তিন মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড। এর শুরুতে আছে একদল নারীর অবয়ব। বিপরীত অস্পষ্ট রঙে সচল চলচ্চিত্রের প্রতিবিম্ব বা নেগেটিভ অংশকে জুড়ে দিয়েছেন নিজের অবয়বের সঙ্গে। আটটি পর্যায়ে এ-ভিডিও আর্টে উঠে এসেছে আমরা ও আমাদের মাঝে যাপন করতে থাকা পোশাককর্মীদের জীবন। একটা ভয়, উৎকণ্ঠা, পারিপার্শ্বিক টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে পার করা জীবনযাপনের গল্প এ-ভিডিও আর্টের পটভূমি প্রবল যন্ত্রণার অবিনাশী ধারাপাত উঠে আসে ‘উই’ ভিডিও আর্টে। দ্বিতীয় শিল্পকর্মটি ‘তাজরীননামা’ শুরু হয় কুন্ডলী পাকানো আগুনের দলবদ্ধ হয়ে পুড়ে যাওয়া দিয়ে। এ তো কোনো সীমাহীন অন্তর্গত অগ্নিকুন্ডে জ্বলতে থাকা আগুন প্রত্যক্ষ করছি না শিল্প ও শ্রমিকের সস্তা ঘামের উদ্গিরণ। জলি এ-ছবিতে প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন, আবহ সংগীত ব্যবহার করেছেন মানুষের ক্রমাগত বিলাপের সুরকে। সাত মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডব্যাপী আগুনের  ফুলকির ভেতরে পুড়তে থাকে মানুষ পোশাক ও সুই-সুতা আর কাপড়ের স্ত্তপ।

আমরা এভাবে পেয়ে গিয়েও ঠিক মনে করতে পারি না রানা প্লাজায় কতজন নিখোঁজ। দু-একটি নিখোঁজ সংবাদ সংবলিত নোটিশ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সারি, খাটে বিছানো চাদরের বুকে সে নিখোঁজ সংবাদ সব সময়ই তাড়িয়ে দেয় চোখের ঘুম। এই সভ্যতার সবচেয়ে প্রধান সংকট মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা নির্ণয়। সাহসহীন বুভুক্ষু একদল মানুষ হাতে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পোশাক কারখানার দিকে। দিলারা বেগম জলি সিনথেটিক মাধ্যম রেজিন গলিয়ে আবার জমাট বাঁধিয়ে তৈরি করেছেন থেঁতলানো মানুষের হাত। কাচের বাক্সে বন্দি করে রেখেছেন। শিরোনাম দিয়েছেন ‘অবজেক্ট’। এই পোড়া থেঁতলানো হাতের দিকে তাকিয়ে শিল্পীর ত্রিমাত্রিক অন্য বিষয়গুলোর কথা মনে পড়ে। বেলাশেষে যে বাসন-কোসন ভাত রেখে জীবন বাঁচাত, সে-থেঁতলানো থালা গড়েছেন  ‘রেজিন’ মাধ্যমে। অতিসম্প্রতি গড়ে তোলা ওইসব ব্যবহার্য জিনিসের সঙ্গে রেখেছেন সুতার বান্ডিল। সত্যিই পোশাক তৈরির সরঞ্জাম সেভাবে রানা প্লাজার বাইরে পড়ে ছিল। দিলারা বেগম জলি ধসেপড়া রানা প্লাজার সামনে গিয়েছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন সেই বীভৎস সময়ের আহাজারি। বিষয়ের সঙ্গে অনুভূতির যোগাযোগ গড়ে ওঠা শিল্পকর্ম বৈপ্লবিক নয়, ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিক দায়বদ্ধতা তাকে শক্তিশালী করে তোলে। শ্রমিকের শ্রম-শোষণ ও পুঁজির বিকাশ-নির্ভর মানসিকতায় গড়ে ওঠা বলয়কে চোখে আঙুল দিয়ে মনে করান শিল্পী। রূপকধর্মী সৃষ্টিকর্মে এ-ভাষণ জারিত হয় যে, বৈষম্যকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিজীবনের স্বাভাবিক চেতনা ব্যাহত হয়।

দিলারা বেগম জলির কাজের প্রবণতায় আমরা সাম্প্রতিক শিল্পকলার প্রকরণ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। অভিব্যক্তির চূড়ান্ত প্রকাশের সঙ্গে জলি যুক্ত করেন আবহমান বাংলার নকশি ফোঁড়। নারীর শ্রমের সঙ্গে মিশে আছে হাতে সেলাই করা নকশিকাঁথার নকশার রং। বিষয় তৈরি হয়েছে কাঁথায় দেওয়া ফোঁড়ের মতো করে। কখনো গাঢ়, কখনো হালকা কালির ব্যবহারে বিষয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা স্পষ্ট। নারীর জননাঙ্গের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা নারী অবয়র ও সুতা আর নিখোঁজ সংবাদের নোটিশ প্রকাশ করেছেন। হ্যান্ডমেড পেপারের জমিনে কোনো রং ব্যবহার না করে কোনো কোনো কাজে শুধু সুই ফুটিয়ে মানুষের অবয়ব তৈরি করেছেন। সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের প্রবণতাকে মনে করেই জলি তাঁর শিল্পের কর্মকৌশল প্রয়োগ করেছেন।

কোনো কোনো কাজে ছবির পটভূমিতে উলটো করে দেখিয়েছেন। জলির সরলীকরণের জন্যে দর্শকমনে সেই মুহূর্ত এসে হাজির হয়। বিষয়ের সঙ্গে দর্শক নিজেকে জড়িয়ে নেন। সাদামাটা বিন্দু আর রেখার সমাবেশে গড়ে তোলা অভ্যন্তরস্থ গড়ন শিল্পের মাঝ দিয়ে বার্তা পৌঁছে যায় আমমানুষের কাছে। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জলি সাবধানী হয়ে ক্যানভাসে সাদা ও কালো রঙের মাঝামাঝি একটি স্তর ব্যবহার করে ‘বয়ন-৯’ শিরোনামের কাজে কিছু সংবাদের শব্দ উৎকীর্ণ করেছেন। ১০নং ছবিতে নানা দিক থেকে ছুটে আসা কাঁথা-ফোঁড়ের আদলের নকশা গতি তৈরি করেছে। নারীর মস্তক কাপড়ের বান্ডিলের সঙ্গে ঝুলে আছে। জামার আকৃতি, পাখির অবয়ব, সব অনুষঙ্গ হাজির করেছেন এ-ছবিতে। সুতার বান্ডিলের ঘূর্ণায়মান অবস্থার সঙ্গী হয়ে উঠেছে মানবীর মুখ, দেহখন্ড, সারি সারি লাশ। সাদা-কালো রেখার জট ভেদ করে কোনো কোনো মানুষের অবয়ব ঊর্ধ্বমুখী। শিল্পের প্রয়োজনে জলি ক্যানভাসে কোনো কোনো স্থান শূন্য রেখে দর্শকদের স্বস্তি দিয়েছেন। সাদা-কালো রেখা, বিন্দু আর ফর্মের স্থাপন প্রক্রিয়ায় স্থির পরিকল্পনায় মানুষ ও বয়ন সরঞ্জামসমূহ ছবিতে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনস আমাদের এক শূন্যতা উপহার দিয়েছে। দিলারা বেগম জলির ‘বয়ন বয়ান’ দর্শককে আবার মনে করায় সেই শোকসময়ের বিলাপের স্মৃতি।