দেখার নানা রূপ

দেখা : মাহমুদুল হোসেন-সম্পাদিত

আহমেদ খালেদা

বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাটি গড়ে উঠেছে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সোপান বেয়ে। এ-আন্দোলনের সঙ্গে বরাবর যুক্ত ছিলেন মাহমুদুল হোসেন; খুব তরুণ বয়স থেকেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে এসেছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তানভীর মোকাম্মেলের সহযোগী হিসেবে পরিচালনা করেছেন ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদের কর্মকাণ্ড। সেইসঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখালেখিতে। বাংলাদেশে খুব গুরুত্বের সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে লিখে চলেছেন যে-কজন মুষ্টিমেয় লেখক মাহমুদুল হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এবং নানা সভা-সেমিনারে পঠিত তাঁর লেখাগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মূল্যবান এক সংকলনগ্রন্থ। আর এবার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও দৃশ্যমাধ্যমের অনুরাগী পাঠকেরা হাতে পেলেন তাঁর সম্পাদিত দৃশ্যশিল্প-বিষয়ক অনন্য সংকলন দেখা।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি দৃশ্যমাধ্যমের অন্যান্য শাখার প্রতিও তাঁর আগ্রহ কম নয়। আর উৎকৃষ্টমানের সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুল হোসেনকে আমরা পেয়েছি এর আগেও। বাংলাদেশে দৃশ্যশিল্পবিষয়ক পত্রিকা-প্রকাশনার ইতিহাসে জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত হিসেবে এখনো ভাস্বর তাঁর সম্পাদিত দৃশ্যরূপ পত্রিকাটি। ছোট কাগজের চারিত্র্য অনুযায়ী শুরু থেকেই সে-পত্রিকার প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। আর, যা হয়, সামষ্টিক উৎকৃষ্ট আর সকল প্রয়াসের মতো এ-কাগজটিও প্রকাশের কিয়ৎকাল পরেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ওইরকমেরই আরো একটি প্রকাশনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার একরকম ছটফটানি আর তাড়না তাঁর মধ্যে নিশ্চয়ই কাজ করেছিল পরবর্তী বছরগুলোয়। তারই সফলতা  হিসেবে গুণগ্রাহী পাঠক হাতে পেলেন দৃশ্যশিল্প জগতের নানা শাখার ওপর সমৃদ্ধ রচনার এ সংকলন-ভাণ্ডার দেখা।
দৃশ্যশিল্পের মোট চারটি মাধ্যমের ওপর লেখা সন্নিবিষ্ট হয়েছে এ-গ্রন্থে। মাধ্যমগুলো যথাক্রমে : চলচ্চিত্র, চারুকলা, আলোকচিত্র ও স্থাপত্য। আরো একটি মাধ্যম, নাট্যকলাকেও, অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা ছিল – গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন সম্পাদক। একটিমাত্র লেখার কথাই ভেবেছিলেন তিনি; কিন্তু দীর্ঘ এক বছর চেষ্টা করেও সে-লেখা হাতে পাননি, জানাচ্ছেন এমনটাই। ‘লেখা, ভালো বা মূল্যবান লেখা, ক্রমাগত একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে’ – সম্পাদকের দীর্ঘশ্বাসমথিত এই উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে, সচেতন ও আগ্রহী পাঠকের বুকেও শঙ্কার ঢাক বেজে ওঠে।
দৃশ্যমাধ্যমের শাখাগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্রের প্রতিই সম্পাদকের টান সর্বাধিক। সে-টান স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকও। স্বভাবতই দেখার প্রথম রচনাসমষ্টির বিষয় চলচ্চিত্র। অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের স্মৃতি ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদিত হয়েছে বেশ কয়েকটি রচনা। ছোট একটি লেখায় মোরশেদুল ইসলাম স্মরণ করেছেন বন্ধু-সহযোদ্ধা তারেক মাসুদকে। স্মৃতিচারণের অনুষঙ্গ ধরে এসে গেছে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বিকল্প চলচ্চিত্র-আন্দোলনের ইতিহাস, বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম গঠনের পটভূমিসহ আরো নানা কথা : কীভাবে আজ থেকে তিরিশ বছরেরও আগে, ১৯৮১ সালে, ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভস আয়োজিত তিন মাসমেয়াদি ফিল্ম-অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সকে কেন্দ্র করে, কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরকে ঘিরে, সৃষ্টির উৎসবে মেতে উঠেছিলেন সিনেমাপ্রেমী ও নির্মাণে আগ্রহী একঝাঁক তরুণ! সেরকমই এক তরুণ ছিলেন তারেক মাসুদ – নিজের জীবন সঁপে দিয়েছিলেন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের বন্ধুর-মায়াবী পথপরিক্রমায় – অমূল্য জীবনটি সমর্পণ করে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের বেদিতেই। বন্ধু-সহযোদ্ধার স্মৃতিচারণে, থেকে থেকে, আবেগঘন হয়ে উঠেছে মোরশেদুল ইসলামের কলম। তাঁর লেখনীর ভাষা ঝরঝরে, সাবলীল, সুখপাঠ্য। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি আরো লিখুন, সচেতন পাঠকমাত্র আশা করবেন এমনটাই।
ফিল্ম আর্কাইভসের সে-কোর্সটির কথা, সঙ্গে সঙ্গে, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, বিকল্প-স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ আন্দোলন, বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম গঠন এবং এর কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতির ইতিহাসসহ আরো নানান গল্পগাছা, আরো বিশদ, আরো প্রাঞ্জলভাবে, ফুটে উঠেছে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের কলমে – তাঁর তারেক মাসুদ : টুকরো ভাবনা শীর্ষক রচনাতে। এসকল প্রসঙ্গের অবতারণা আর বিস্তৃতি ঘটেছে, অবশ্যই, তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রজগতে আবির্ভাব ও তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাতা-জীবনের ধারাবিবরণের অনুক্রমে। কী প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে টগবগ করতেন সবসময়, কত পরিপূর্ণ ছিল চলচ্চিত্রের পাদপীঠে তারেক মাসুদের জীবন-সমর্পণ – সেসব কথা আরো একবার স্মরণে আসে এ-লেখা পড়ে – বিষাদের কালো ছায়া, আরো-একবার, এসে ঢেকে দেয় পাঠকের মন। রচনাটি একাধারে স্মৃতিতর্পণ, শ্রদ্ধার্ঘ্য, সমালোচনা, আর কিছুটা আত্মবয়ান। তারেক মাসুদের জীবনকথনের পাশাপাশি লেখক বলেছেন ‘নিজের গল্পটি’ও। সাধারণ পাঠকের কাছে শাহাদুজ্জামানের পরিচয় নিবেদিত এক কথাসাহিত্যিক হিসেবে; বোধ করি, চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর একসময়কার মোহগ্রস্ততা, আর সেইসব মাতাল দিনের স্মৃতি, আর সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আগ্রহ থেকেই লেখাটি এমন আকার নিয়েছে। পুরো লেখার শ্রদ্ধামিশ্রিত স্মৃতিচারণের একেবারে শেষপাদে, দুটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদে, যে চলচ্চিত্র-সমালোচনা উপস্থাপিত হয়েছে তা নির্মোহ, আর কিছুটা নির্মমও বটে। লেখার মেজাজ এখানে হঠাৎই ভিন্ন চেহারা নিয়েছে; তারেক মাসুদের সামগ্রিক চলচ্চিত্র-সৃষ্টির এই মূল্যায়ন কিছুটা ভিন্নভাবেও উপস্থাপিত হতে পারত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র-বিষয়ে অধ্যাপনা করেন জাকির হোসেন রাজু। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন একসময়ে, নিজে চলচ্চিত্র নির্মাণও করেছেন; পরবর্তীকালে বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন ধরে; একাধিক চলচ্চিত্র-বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। দেখায় সংকলিত হয়েছে তাঁর ‘সিনেমায় গল্প বলা ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ : প্রসঙ্গ মুক্তির গান’ শীর্ষক রচনাটি। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কীভাবে কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের দুটি ভিন্ন ঘরানার উৎপত্তি হলো আর কীভাবে এ দুই ধারার ছবিগুলো যথাক্রমে গল্প ও অগল্প ধারার ছবিতে পর্যবসিত হলো – সে-বয়ানটি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন তিনি এ-রচনায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার ঘটিয়েছেন গল্পের প্রতি মানুষের সনাতন আগ্রহের সূত্রটির; সে-আগ্রহকে পুঁজি করে কী করে পালটে গেছে চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালচিত্র, বিশ্বময় শুনিয়েছেন সে-কাহিনিও। সেইসঙ্গে পাঠক অবগত হন চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মূল সোপানগুলো সম্পর্কে। রচনার দ্বিতীয় অংশে তিনি তারেক মাসুদের মুক্তির গান ছবিটিকে ‘টেক্সট’ হিসেবে নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে অগল্প ছবির ঘরানাতেও গল্প এসে বাসা বাঁধে – সে-গল্পের কাঠামো কীভাবে ছবিকে করে তোলে সমৃদ্ধতর – কীভাবে গল্প ও অগল্প ছবির বাঁধাধরা ছক ভেঙেচুরে, মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তারেক ও ক্যাথেরিন মাসুদের সচেতন নির্মাণপ্রয়াসে। এ-অনুষঙ্গে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, ‘ডিরেক্ট সিনেমা’ ও ‘সিনেমা ভেরিতে’ ধারার ছবি নির্মাণের কাহিনি লেখক তুলে আনেন পরম পারঙ্গমতায়। আর লিয়ার লেভিনের ক্যামেরার চোখটি যে ছিল মূলত পর্যবেক্ষণমূলক কিন্তু তারেক ও ক্যাথেরিন মাসুদ তাঁদের ‘ফাউন্ড ফুটেজ’ চলচ্চিত্রের রূপদানে, শৈলী হিসেবে, যে-অবয়বটি বেছে নিয়েছেন তা যে ‘সিনেমা ভেরিতে’ ঘরানার অনেক কাছাকাছি – লেখকের এ-অবলোকন চিত্তাকর্ষক ও চমৎকার। তবে একটি কথা না বললেই নয়। মুক্তির গান ছবিটিকে একটি ‘গল্প ছবি’ হিসেবে রূপায়ণের প্রচেষ্টার পেছনে মূল যে উদ্দেশ্য ছিল – তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন, তা নিঃসন্দেহে সার্থক; কিন্তু, গল্প-আরোপের জন্য তথ্যের প্রামাণ্যতার ক্ষেত্রে যে-সংকট তৈরি হয়, যা এ-ছবিতেও হয়েছে সে-বিষয়ে লেখক পুরো রচনায় সম্পূর্ণ নীরব।
তারেক মাসুদকে নিবেদিত রচনাসমষ্টি ছাড়া এ-গ্রন্থে অন্য যে দুজন বাংলাদেশি নির্মাতার ছবি নিয়ে আলোচনা রয়েছে, তাঁরা হলেন তানভীর মোকাম্মেল ও ফৌজিয়া খান। এ-গ্রন্থে, চলচ্চিত্র-আলোচনায়, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এবং  প্রামাণ্য ছবি নির্মাণকেই প্রাধান্য দেবেন, এমন কথা ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছেন সম্পাদক। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কাজ কী? মাহমুদুল হোসেন তাঁর তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্যছবি : স্বদেশের সত্যকোষ শীর্ষক রচনাতে জানান দর্শককে সত্য সম্পর্কে সচেতন করে প্রামাণ্যচিত্র; আবার, কোনো কোনো প্রামাণ্যচিত্র সব সত্যের সীমানা পেরিয়ে যায়, ‘সংবেদনের এবং জ্ঞানের এক নতুন উপত্যকায় পৌঁছে দেয় দর্শককে’। তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্যছবিগুলোয় সত্য-নির্মাণের এই প্রয়াস কতটা সার্থকভাবে সংঘটিত হয়েছে, সে-সত্য উন্মোচনেরই চেষ্টা করেছেন লেখক। এ-প্রচেষ্টায় তানভীর মোকাম্মেলের সবকটি প্রামাণ্যচিত্র থেকে তিনটি ছবি নির্বাচন করেছেন তিনি; জানাচ্ছেন, ‘এ নির্বাচনে ব্যক্তিগত ভালো-লাগাবোধই প্রাধান্য পেয়েছে।’ বহু বছর ধরে কাছ থেকে দেখেছেন তিনি এই বিশিষ্ট চলচ্চিত্রযোদ্ধাকে, চলচ্চিত্র  সংসদ-আন্দোলনে নানাভাবে সহযোগী-যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন নিজেও। তারপরও নির্বাচিত ভালো-লাগার ছবিগুলোর আলোচনায় নির্মোহ দৃষ্টিপাত করতে পেরেছেন, ছবিগুলোর সীমাবদ্ধতা আর নির্মাণ-পর্যায়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে পেরেছেন মুক্তকণ্ঠ হতে। কাঠামোর সারল্য আর ‘কেজো ধারাবর্ণনা’ অনেকসময়ই ছবিগুলোর দৃশ্যময়তার সম্ভাবনার ডানা-ছেঁটে দিয়েছে; ক্যামেরার ভাষার আরো পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার ছবিগুলোকে ‘ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের’ ছবিতে পরিণত করতে পারত, এরকম আরো কিছু মন্তব্যে বিচ্ছুরিত হয়েছে লেখকের তীক্ষè-মেধাবী দৃষ্টি ও মনন। এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্যছবিগুলো হয়ে উঠেছে ‘স্বদেশের সত্যকোষ’ – ‘নির্মোহ সত্যেই’ ছবিগুলোর দায়বদ্ধতা – এমনই মূল্যায়ন লেখকের। এ লেখার ঠিক পরবর্তী রচনাতেই, ফৌজিয়া খানের প্রামাণ্যচিত্র আমাকে বলতে দাও সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তপন কুমার পাল। লেখাটি তুলনামূলকভাবে সাদামাটা; আর, লেখকের ভাষা-ব্যবহারে সাবলীলতার অভাব এবং দৃশ্যশিল্পের মাধ্যমগুলোর বহুমাত্রিক আস্বাদনের আপাত সীমাবদ্ধতা লেখাটিকে কিছুটা দুর্বল করে তুলেছে।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, ব্যতিক্রমী-মেধাবী চলচ্চিত্রকারদের তালিকায়, মনি কাউলের অবস্থান নিশ্চিতভাবেই শীর্ষদেশে। দেখার চলচ্চিত্রবিষয়ক রচনাসমষ্টির শেষ নিবেদন : মনি কাউলের ওপর একটি রচনা এবং তাঁর একটি সাক্ষাৎকার। মনি কাউলের সার্বিক চলচ্চিত্র সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছেন চে হুসাইন। দারুণ স্বাদু গদ্যে, নাতিদীর্ঘ এ-লেখায় উঠে এসেছে মনি কাউলের অনন্য মানসপট ও সৃষ্টি : তাঁর ‘অন্তর্ভেদী চিত্রময়তা, অনিশ্চিত, অনিরূপেয় চিত্রল দেখা’র মাধ্যমে সৃষ্ট ছবিগুলো যে কেবল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নয়, বরং পুরো বিশ্বের চলচ্চিত্র-ভাণ্ডারে অনন্য সংযোজন, রচনাটিতে এ-সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। আর মনি কাউলের সৃষ্টির ধারাপাত যে পশ্চিমি রেনেসাঁর সৃষ্টিজগতের একেবারে বিপরীত এক উৎসমূল থেকে উৎসারিত – এ-বোধ পাঠকের মনে আনে দারুণ এক অহংবোধ আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি। এ-রচনার লাগোয়া সাক্ষাৎকারটির অনুবাদও করেছেন চে হুসাইন। মূল সাক্ষাৎকারটি সিনেমায়া পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল; সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ষোলো বছর বয়েসি ইনকা যামিনী রায়। ইডিয়ট ছবির প্রদর্শনের পরপরই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত, আর এর আলোচনার প্রায় অনেকটা জুড়ে আছে এ-ছবির বিষয় ও চরিত্রের রূপায়ণ; আর, তরুণ সাক্ষাৎকারগ্রহীতা যে দস্তয়েভস্কির মূল উপন্যাসটি পড়েননি – এ- কথা জানার পরপর পাঠকের মনে এ-সাক্ষাৎকার বিষয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। তবে সাক্ষাৎকারটিতে পাঠকের অনন্য এক প্রাপ্তি মনি কাউলের স্বকণ্ঠে তাঁর চলচ্চিত্র-ধারণার ব্যাখ্যান : চলচ্চিত্রে চরিত্রায়ণের প্রতি তাঁর অনীহা; কেন্দ্রহীন-কাঠামোহীন এক নির্মাণের অভিপ্রায়, যার অবস্থান পশ্চিমা রেনেসাঁস-আশ্রিত শিল্পধারার ঠিক বিপরীতমুখী; আর, সর্বোপরি, দর্শককে নতুনভাবে চিন্তা করানোই যে তাঁর সৃষ্টির মূল প্রেরণা – বিষয়গুলো সাক্ষাৎকারে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। তবে, অনুবাদের ভাষা বেশ আড়ষ্ট। বিশেষ করে, একই লেখকের মূল রচনায় ভাষার লালিত্য যখন রীতিমতো কাব্যময়, অনুবাদে সে-ভাষা কিছুটা মুখ থুবড়ে পড়েছে, বলা চলে এমনই।
দেখার দ্বিতীয় ভাগে সন্নিবিষ্ট হয়েছে চারুকলা বিষয়ক রচনা। প্রথমেই আছে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া ও আমিনুল ইসলামকে নিয়ে দুটি লেখা। এই দুই মহৎ শিল্পীকেই হারিয়েছি আমরা বিগত বছরে। কীভাবে মোহাম্মদ কিবরিয়ার চিত্রকলা, ষাটের দশক থেকে, ধীরে ধীরে বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন হলো, সে-ধারাবর্ণনা আছে ইমতিয়ার শামীমের রচনায়; পাশাপাশি, কিবরিয়ার ছবিতে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্মসূত্রটির অনুসন্ধান করেছেন তিনি। দ্বিতীয় রচনায়, আমিনুল ইসলামকে স্মরণ করেছেন তৈয়বা বেগম লিপি; শিল্পীকে কাছ থেকে, ঘনিষ্ঠভাবে, জেনেছেন অনেক বছর ধরে – ঘরোয়া ভঙ্গিতে স্মৃতিচারণ করেছেন সেসব দিনের। ইমতিয়ার শামীমের আরো একটি রচনা আছে এ-গ্রন্থে। কিবরিয়ার ওপর লেখাটি অনেকাংশে অন্য লেখাটির পরিপূরক; আর দুটি লেখাই খুব গুরুত্বপূর্ণ – বাংলাদেশের চিত্রকলার আলোচনায়, নিঃসন্দেহে, উল্লেখযোগ্য সংযোজন। দ্বিতীয় দীর্ঘ রচনাটিতে, এদেশের চিত্রকলার বিমূর্তধারার বন্ধুর পথপরিক্রমা ও বিকাশের পটচিত্রটি তিনি এঁকেছেন পরম পারঙ্গমতায়, মননশীল বিশ্লেষণে, মনোগ্রাহী ভাষায়। বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে বিমূর্তশিল্পের পথচলা এতটা সমস্যাসংকুল হওয়ার কথা ছিল না। এদেশে, নাগরিক শিল্পধারার বিকাশের পেছনে সবসময়ই শক্তি জুগিয়েছে ‘লোকশিল্পের পুরাতত্ত্ব’ – আর ‘প্রাচ্যের লোকশিল্প, ধর্মজবোধ, শিল্পসাধন রীতি কিংবা আত্মার মুক্তির অনুসন্ধানপথ সব কিছুতেই এক শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করেছে বিমূর্ততা ও বিমূর্ততার বোধ’। তারপরও, ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরবর্তী অনেকগুলো বছর পর্যন্ত বিমূর্তশিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পধারার মর্যাদা পেতে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। কেন? সে-প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন ইমতিয়ার শামীম মননঋদ্ধ এ-রচনায়। মেধাবী সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সুপরিচিত; বাংলাদেশের চিত্রকলার ওপর লেখালেখির ঊষরপ্রান্তরে তাঁর লেখনী জলসিঞ্চন করুক আরো – সচেতন পাঠকমাত্রেই সে-আশা করবেন।
চারুকলাবিষয়ক রচনাসমষ্টির, তথা সমগ্র সংকলনগ্রন্থটির, অন্যতম সংযোজন শিল্পী মনসুর উল করিমের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। শিল্পীর সঙ্গে ঘরোয়া এক বৈঠকের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে, শিল্পীর বাসায়, এসে হাজির হয়েছিলেন মাহমুদুল হোসেন ও মানজারেহাসীন মুরাদ; তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের অপর দুই শিল্পী-শিক্ষক আবুল মনসুর ও ঢালী আল মামুন। আড্ডার মেজাজে, দীর্ঘ সময় ধরে, মনসুর উল করিমের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়েছেন এঁরা সকলে। আর এ-কথোপকথনের সোপান বেয়ে উঠে এসেছে শিল্পীর জীবনকথা, তাঁর মননভূমি ও সৃষ্টিজগতের নানা বিরল সত্য; ফুটে উঠেছে শিল্পীর একাকী, বেদনাবিধুর সৃষ্টিপ্রয়াসের নানা অনুষঙ্গ; সেইসঙ্গে চারুকলা, শিল্পকলা, শিল্প ও শিল্পী, শিল্পের দায়বদ্ধতা, শিল্পশিক্ষা, শিল্পের মনোজগৎ ও এর পরিস্ফুটন বিষয়ে নানা অমূল্য কথন। এ-গ্রন্থের চারুকলাবিষয়ক আর আর সব লেখার সঙ্গে এ-কথোপকথনকে মিলিয়ে পড়লে, বাংলাদেশের চারুকলাচর্চার সামগ্রিক চালচিত্রটি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন কলারসিক সকল পাঠক।
চারুকলাবিষয়ক রচনাদলে আরো স্থান পেয়েছে বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্টের চর্চা নিয়ে একটি ‘খসড়া’ লেখা; লিখেছেন শাওন আকন্দ। আর সবশেষে  সৌম্য মাহমুদ আলোচনা করেছেন নাসিমা হক মিতুর ভাস্কর্যে ‘ধারণার ত্রিমাত্রিকতা ও উদযাপিত সম্পর্ক’ বিষয়ে। মিতুর ভাস্কর্য বিষয়ে বিশদ কোনো আলোচনা এর আগে বোধহয় হয়নি। হওয়া যে উচিত ছিল তার সাক্ষ্য দেয় এ-রচনার সঙ্গে সন্নিবিষ্ট ভাস্কর্যের চিত্রমালা। নিজস্ব এক শক্তিতে ভাস্বর প্রতিটি কাজ; এমনকি ছবির মধ্যে দিয়েও সে-শক্তি অভিঘাত ফেলে দর্শকের ইন্দ্রিয়ে-ইন্দ্র্রিয়ে। বাংলাদেশে ভাস্কর্যশিল্পের যাত্রার শুরুটাই ছিল ভাস্কর নভেরা আহমেদের অনন্য প্রতিভার তিলকখচিত। সে-যাত্রার ধারাবাহিকতার দায়ভার বেশ সবলহাতেই বয়ে চলেছেন ভাস্কর নাসিমা হক মিতু।
আলোকচিত্র বিষয়ে দুটি রচনা স্থান পেয়েছে দেখায়। একটি অনুবাদ, আর অন্যটি মূলত ‘একগুচ্ছ আলোকচিত্রের সমাহার’। সুসান সনটাগের আলোকচিত্র বিষয়ক বিশ্বখ্যাত বই অন ফটোগ্রাফি। বইটির প্রথম অধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ করেছেন শান্ত সায়ন্তন। সেইসঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বেশকিছু অমূল্য ছবি; এগুলোর মধ্যে যেমন আছে অসাধারণ আলোকচিত্রীদের তোলা আলোকচিত্র, তেমনি আছে বিখ্যাত কিছু চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া স্থিরচিত্র, সেইসঙ্গে, কয়েকটি ক্যামেরার ছবিও। আলোচনার অনুষঙ্গেই সংযোজন ঘটেছে ছবিগুলোর –  ফলে মূল্যবান এ-রচনাটির পাঠ আরো সমৃদ্ধ হয়েছে, নিঃসন্দেহে। আর, ভূমিকায় যেমন ইঙ্গিত করেছেন সম্পাদক, তাতে, অন ফটোগ্রাফি বইটির সম্পূর্ণ অনুবাদও আমরা হাতে পাবো অচিরেই, এমন আশাও হয়তো করা যায়। সুসান সনটাগের লেখা পড়বার পরপরই তামাকশিল্প ও তামাকশ্রমিকদের ওপর সৈয়দ আসিফ মাহমুদের তোলা অসাধারণ-শিল্পিত ছবিগুলোকে পাঠক একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন – ভিন্ন এক চেতনায় আরক্ত হয়ে উঠবে সে-দেখা – এমনটা আশা করাই যায়।
দেখার শেষ নিবেদন ‘স্থাপত্য বিষয়ে একটি ফিচার, পুরান ঢাকা বাঁচাও’। প্রায় এক দশক ধরে পুরান ঢাকার স্থাপত্য-ঐতিহ্য সংরক্ষণে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে আসছে স্থপতিদের প্রতিষ্ঠান ‘আরবান স্টাডি গ্রুপ’। ২০১১ সালে জাতীয় জাদুঘরে তাঁরা আয়োজন করেন এক প্রদর্শনীর; প্রদর্শনীতে দেখানো হয় – পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনলে ওই অঞ্চলের মহল্লাগুলোর চেহারা কেমন দাঁড়াবে। ওই প্রদর্শনীতে দেখানো পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মহল্লার পরিচিতিমূলক ভাষ্য ও ছবি, সেইসঙ্গে এসব মহল্লার পুনর্গঠিত চেহারার ছবি, বর্তমান নিবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে আরো একবার। উর্দু রোড, শাঁখারিবাজার, আবুল খায়রাত রোড, হৃষিকেশ দাস রোড, কালীচরণ সাহা স্ট্রিট, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, ফরাশগঞ্জের বি কে দাস রোড, আমলিগোলা, উত্তর মৈশুণ্ডী – পুরান ঢাকার এইসব মহল্লার ‘অসাধারণ স্থাপত্য, বাসস্থান আর দোকানঘরের ঘনিষ্ঠ অবস্থান’ আর ‘স্পন্দিত জনপদের খাঁটি জীবনযাপন’ আরো একবার সবাক ও সপ্রাণ হয়ে উঠুক, হয়ে উঠুক ঢাকাবাসীর ‘উত্তরাধিকার দর্শনের স্থান’, ‘আরবান স্টাডি গ্র“পে’র সদস্যদের মতো আর সব পাঠকের মনেও জ্বলে উঠবে একই কামনার আগুন, এমন প্রত্যাশা তো করাই যায়!
দেখার মতো এমন গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা রীতিমতো দুরূহ এক কাজ; পরিশ্রমসাধ্য তো বটেই, সেইসঙ্গে দরকার মেধাবী মননের। দুটি বিষয়ে, তারপরও, মন্তব্য না করলেই নয়। প্রথমত, সংকলনটিকে ছোটপত্রিকা বা ‘লিটল ম্যাগাজিন’ না বলে গ্রন্থ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তি কিছু দায়ভার এসে যায় সম্পাদকের ওপর, সেইসঙ্গে প্রকাশকের ওপরও। আশা করি, সে-সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন তাঁরা। আর, দ্বিতীয় অবলোকনটি এ-বইয়ের মুদ্রণ সম্পর্কে। এমন চমৎকার বাঁধাই, প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা যে প্রকাশনার – এত চমৎকার কাগজে ছাপা – যেটি হাতে নিলেই পাঠকের মন অন্যরকম এক অনুভূতিতে সচকিত হয়ে ওঠে – তাতে এত মুদ্রণত্র“টি কেন থাকবে, তা বোধগম্য নয়। ভালো একজন ‘কপি-এডিটর’কে দিয়ে বানানসহ অন্য সকল প্রমাদ সংশোধন করিয়ে নেওয়া ভীষণ জরুরি ছিল; পবইজুড়ে, চাঁদের কলঙ্কের মতো, দাঁত বের করে হাসছে বিরক্তিকর এসব ত্র“টি।
তবে, সব মিলিয়ে, দৃশ্যশিল্প বিষয়ে অনন্য এক সংকলন দেখা। দৃশ্যশিল্পের মাধ্যমগুলোর একের সঙ্গে অপরের অন্তর্লীন যোগাযোগ ও সম্পর্ক চিরকালীন। এক মাধ্যম প্রভাবিত করে অন্য মাধ্যমকে; অনুপ্রাণিত করে, পথ দেখায়। আবার, একাধিক মাধ্যমের সাহচর্যে গড়ে ওঠে দৃশ্যশিল্পের নতুন কোনো শাখা। তাই, দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন শাখার ওপর সাধারণ ও সামগ্রিক আলোকপাত জরুরি; জরুরি সম্পূরক আলোচনা ও সমালোচনা। আর, গভীর-গম্ভীর এ-দায়িত্বটি পালনেই এগিয়ে এসেছে দেখা। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতেই, অনুরাগী পাঠক হাতে পেয়ে যাবেন দেখার দ্বিতীয় খণ্ড!