দেহতরী

মণীশ রায়

 

কার বিয়ে হচ্ছে আজ?

শীতের ঘোলা আকাশজুড়ে কে ছড়াচ্ছে রঙিন আতশবাজির ফুলকি?

কার মনে এতো আনন্দ?

অথচ পাশের ঘর থেকে একটু পরপর ভেসে আসছে মায়ের কণ্ঠের বিলাপধ্বনি।

অমিয় বুঝতে পারে না, এসব বিলাপ কিংবা কান্নাগুলো সত্যি সত্যি হৃদয়-নিংড়ানো কিনা।

ওর মা পরমা কি সত্যি সত্যি ভালোবাসতেন ওর বাবাকে?

সে খাটের পাখনার ওপর উঁচু করে বালিশ বিছিয়ে তাতে মাথা রেখে ছাদের দিকে তাকায়; একটু বাদে চোখ বুজে খানিকটা পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করে।

ঝগড়া হচ্ছে প্রচন্ড।

কোনো এক নারী তার স্বামীকে অকর্মণ্য-অপদার্থ বলে গালি দিচ্ছে আর একজন নিরীহ গোবেচারা টাইপ পুরুষ একমাত্র সন্তানের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বিব্রত হচ্ছে।

লোকটি নারীটির গালাগালের সারাংশকে যেমন অস্বীকার করতে পারে না, তেমনি চিৎকার-চেঁচামেচিগুলোকে আলিঙ্গন করতেও বাধছে।

সে একটা সময় ঘর ছেড়ে চলে যায়।

পেছন থেকে স্ত্রী নামের নারীটির কণ্ঠ আরো উচ্চকিত হয়ে স্বামীটির পেছনে হুল ফোটায়, ‘সত্যি কথা কইছি তো। এখন তো ভাগবাই। বিয়া করণের সময় মনে আছিল না? ভন্ড, প্রতারক।’

বারো-তেরো বছরের কিশোরটি হতবাক; সে তার মায়ের ক্রুদ্ধ চেহারার দিকে তাকায়; পরক্ষণে চোখ চলে যায় এক ভাঙাচোরা পুরুষের চলে যাওয়ার দিকে ।

একটু পর সেই কিশোর দেখতে পায় তার মা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন।

অমিয় বুঝতে পারে না এসবের অর্থ।

খানিকক্ষণ থমকে থাকার পর সে চলে যায় শীতে শুকিয়ে যাওয়া বাড়ির পাশের খটখটে নদীটার ধারে।

নদীপাড়ের চেনা কড়ইগাছটা ওকে ডাকে, ‘আয়, আয়। আমার ছায়ায় এসে বোস।’

অমিয় তবু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নদীর ওপর ছড়িয়ে থাকা সকালবেলাকার রোদমাখানো ঘন কুয়াশায় ঢাকা দেয়ালে সে চোখ রাখে। দূর থেকে মনে হচ্ছে, একটা বিশাল আকৃতির মহিষ পুরো নদীটা আগলে রেখেছে। নিজেকে বড় একা লাগে অমিয়র। গাছটাকে সে প্রশ্ন করে, ‘বাবাকে মা এতো বকে কেন?’

‘তোমার মায়ের বিয়ের গয়নাগুলো বেচে দিয়েছে তোমার বাবা।’

অমিয় তবু বুঝতে পারে না। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর সে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন ওর মনে হয়, ওর বাবা একটা খারাপ লোক; তাকে ওর মা কোনোদিন আদর দেবে না।

কৈশোরের সেই খারাপ লোকটা গতকাল ষাট বছর বয়স পার করে মারা গেছেন। তারই জন্যে মা এরকমভাবে থেকে থেকে কঁকিয়ে উঠছেন।

অথচ অমিয়কে পৃথিবীতে আনার পর ওর মা আর কোনোদিন এই লোকটার সন্তান ধারণ করেননি। স্থানীয় ফ্যামিলি প্ল­্যানিং অফিসে চাকরি জোগাড় করে নিজেকে স্বামী নামের এই লোকটির কাছ থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছিলেন।

অমিয় আর ওর মা থাকত ভেতরঘরে। আর বাইরের একটা ভাঙা বেড়ার ঘরে ঠাঁই হয়েছিল ওর বাবার। সারাদিনে একটাও কথা হতো না। মাসে-বছরে কিংবা পাঁচ বছরে মাত্র পাঁচটা-ছটা কথা। খাওয়ার সময় অমিয়কে সিলভারের একটা টিফিন-ক্যারিয়ার দিয়ে পাঠিয়ে দিত ওর মা; বলতেন, ‘বাবারে দিয়া আয়।’

সে এই কাজটা মোটেই পছন্দ করত না; তবু মায়ের নির্দেশে কাজটা ওকে করতে হতো।

বাবা ওকে দেখলেই যেন কেমন করে উঠতেন। ভুতুড়ে চোখ দুটো টলোমলো করে উঠত; কলাগাছের  বিছার মতো সিগারেট খাওয়া কালো পুষ্ট দুটো ঠোঁট কেবল নড়ত।

ও যখন ঘরের মাঝখানে আলগোছে টিফিন-ক্যারিয়ারটি রেখে বেরিয়ে আসত তখন মানুষটা বলে উঠতেন, ‘একটুখানি বইবি বাপ?’ বলে তেল-চিটচিটে বিছানাটা ছেড়ে দুহাত বাড়িয়ে নেমে আসতে চাইতেন মানুষটা।

সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠত, ‘আমার সময় নাই।’

আর কোনো কথা বলতেন না তিনি।

অথচ সেই অর্ধপরিচিত মানুষটার মৃত্যু হওয়ায় মায়ের কান্না কদিন ধরে থামতেই চাইছে না!

অমিয় চলে যায় নদীপাড়ের কড়ইগাছটার কাছে। শীতের শুকনো তিতাস গাছটার ঠিক নিচে মিনমিন করছে।

ঢেউয়ের তাকত নেই; অপুষ্ট শিশুর দুর্বল কান্নার মতো  সেই শব্দ; অমিয় তবু হাঁটুর ওপর মাথা রেখে গাছটাকে নদী কী বলতে চায় তা বোঝার চেষ্টা করে। মাথার ওপর সবুজ ছাতার ফাঁক-ফোকরে লুকানো আশ্রিত পাখিদের কিচিরমিচিরে কান রাখে। শব্দতরঙ্গের এক ঘোর ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে কিছুক্ষণ।

সহসা মনে হলো, কে যেন গভীর রাতের নীরবতা ভেঙে  অবিরাম চেঁচিয়ে চলছে, ‘আমি তর কেউ লাগি না? বুঝবি, একদিন তুই ঠিক বুঝবি। পোলাডারে পর্যন্ত আলগা করছিস আমার কাছ থেইক্যা। আমি কেউ না । আমি তরার কেউ না? খ্যাতা পুড়ি তরার।’

ঝনঝন করে শব্দ হলো; সম্ভবত কাচের কোনো পাত্র ভেঙে গেছে।

অমিয় মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘মা এইডা কি বাবা?’

‘চুপ, চুপ।’ মা মুখ চেপে ধরে ছেলের।

ছেলেটার চোখ বিস্ফারিত। সবকিছু ফেলে সে চলে যেতে চায় তিতাসপাড়ে; বৃক্ষকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা এইরকম করে ক্যান?’

‘তোমার বাবা একা।’

‘বাবা কি ভালো মানুষ?’

‘বাবাকে জিজ্ঞাসা কর।’

অমিয় চোখ বুজে ফেলে। মায়ের কঠিন নিষ্পেষণ ওকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ও কেবল ওর মায়ের; বাবার নয়।

এ-সময় ঘরে প্রবেশ  করে  অনামিকা, ওর স্ত্রী।

‘জীবনবীমার চেকটা কি তুমি পাবে?’ দাঁড়ানো অবস্থায় প্রশ্ন করে অনামিকা।

সঙ্গে সঙ্গে  চমকে  ওঠে অমিয়। অনামিকার চোখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

না, ওর চোখ আর দশজন বোকা-সোকা গৃহিণীর মতোই বাধ্য ও বিনয়ী। স্বামীদের কোনোরূপ আয়-রোজগারের পথ সুগম হলে যেমন ওরা উৎফুল্ল বোধ করে, তেমনি সামান্য দুঃখ-কষ্ট ওদের বড় কাঁদায়। সেই জায়গায় বসেই অনামিকার কৌতূহল ।

‘যা পাওনের তা তো পামুই।’  বলে অমিয় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

‘দেখো। তোমার মা-বাবার মতো আমার অতো কষ্ট করতে ইচ্ছা করে না।’

‘তবু কষ্ট করণ লাগে। সবুর করো। চেকটা ক্যাশ হইলেই সব কষ্ট চলে যাবে।’ আশ্বস্ত করে নিজের স্ত্রীকে।

অনামিকার মুখভরা হাসি। দেহতনুতে হিল্লোল তুলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

অমিয় জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। শীতের আকাশটা মাঝে মাঝে আতশবাজির আদর পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে হেসে উঠে পরক্ষণেই মুখ গোমড়া করে ফেলছে। নিরীহ গোবেচারা যে-গাছগুলো প্রবাসী অর্থের তাকত নিয়ে নতুন হওয়া দোতলা-তিনতলার ফাঁকে-ফোকরে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আতশবাজির ছোঁয়া পেয়ে ওরাও আর মুখ লুকাতে পারছে না; পুরো মফস্বল শহরটাই যেন আচমকা মুখ দেখিয়ে লজ্জা পেয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচেছ।

বিএ পাশ করার পর অমিয়র বাবা একদিন ওকে কাছে ডেকে নিলেন। কাছে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে কোনোদিনই হয়নি ওর। কারণ, এই নোংরা লোকটার কাছে গেলেই কেমন একটা বিটকেলে দুর্গন্ধ  নাকে আসতে শুরু করে; পচা শামুকের গায়ের গন্ধ; চোখদুটো ঢুলুঢুলু; মুখের চামড়া নারকেল-দড়ির মতো খসখসে আর ঢেউ-খেলানো; তাকালেই মনে হয় মানুষটা আর বাঁচবে না। একটুখানি করুণা আদায়ের জন্যে রাস্তার ধারে কাঙালের মতো কেবল গোঙাচ্ছে!

‘কী?’

‘তুই বিএ পাশ করছস, খুশি অইছি। অহন বিদেশ যাইগ্গা। বাঁচবি। ’

এ-কথায় শরীরে আগুন ধরে যাওয়ার মতো জ্বলুনি শুরু হয়ে যায় ওর; চোখ ভরা ঘেন্না নিয়ে উত্তর দেয়, ‘তুমিও তো বিএ পাশ আছিলা। বিদেশ গেলা না ক্যান?’

‘আমার ত ট্যাকা আছিল না রে বাপ।’ এমন নিচু আর নরম গলায় কথার উত্তর দিচ্ছেন যে, বোঝা দায় ঠিক এই লোকটাই রাতের বেলায় বাংলা মদে উদরপূর্তি করে পুরো পাড়া চেঁচিয়ে মাথায় তোলেন। তখন আর কারো প্রতি বিদ্বেষ বা রাগ তোলা থাকে না মানুষটার; যা কিছু গালাগাল আর চিৎকার-চেঁচামেচি সব কেবল মাকে ঘিরে।

আর সে-কারণেই অমিয় ওর বাবাকে আরো দেখতে পারে না। মনে হয় লোকটা একটা বিষাক্ত বৃক্ষ; এর ছায়াও সংক্রামক রোগ ছড়ায়; ওর আশেপাশে যারা রয়েছে এদের সবাই সেই সংক্রমণ নিয়ে বেড়ে উঠবে।

বড়ো হওয়ার পর মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে লোকটাকে বাড়ি থেকে সে তাড়িয়ে দেবে কিংবা গুন্ডা ডেকে এমন মার দেবে যে, কোনোদিন তার পক্ষে মাথা তুলে কারো সামনে কথা বলা আর সম্ভব হবে না।

অথচ যখনই সে এরকম করতে এগিয়েছে, তখনই ওর মা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সামনে।

‘বাদ দে। লোকটা  কদিন আর বাঁচব।’ ভেজা গলায়  এক কথা বারবার করে বলতে শুরু করেন মা।

অমিয় অবাক বিস্ময়ে তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছে; বোঝার চেষ্টা করেছে; কিন্তু কিছুই বুঝতে না পেরে সে ছুটে গেছে তিতাসপাড়ের সেই কড়ইগাছতলায়। কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও কী ভেবে সে থেমে গেছে। নদীর ওপর শূন্যদৃষ্টি কিছুক্ষণ ছড়িয়ে তারপর ফিরে এসেছে। ধীরে ধীরে ভেতরকার প্রশান্তি সে ফিরে পেয়েছে সত্য; কিন্তু  রাগ আর ক্ষোভটুকু মরে যায়নি কখনো।

মানুষটার কাছ থেকে উত্তর ফেরত পেয়ে সে আরো ফুঁসে ওঠে, ‘তাইলে আমি ট্যাকা পামু কই  বিদেশ যাওনের? জমিদারি আছে আমরার?’

অমিয়র চোখের সামনে তখন ওদের ভাঙাচোরা বাড়িটা; মায়ের পাওয়া দুই হাজার টাকার চাকরি আর সংসারবিচ্ছিন্ন বাবার দেওয়া রহস্যময় মাসোহারা, যা কেবল মা-ই জানেন।

আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল মানুষটাকে; কিন্তু কিছু বলার আগেই অমিয়র বাবা ওর হাতে আচানক একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এইখানে এক লাখ ট্যাকা আছে। তুই বিদেশে চইলা যা বাপ। নইলে আমার মতন অবস্থা হইব। যাইগ্গা।’ বলে ফের ছেলের সামনে কয়েদির মতো মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

অমিয় বিস্মিত, হতবাক। বীমা কোম্পানির দালাল হিসেবে মফস্বল শহরে কুখ্যাত, কান্ডজ্ঞানহীন, দায়িত্বজ্ঞানরহিত,  নেশাখোর একটা মানুষ ওকে এক লাখ টাকা তুলে দিচ্ছেন  শুধু ওর নিরবচ্ছিন্ন সুখের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্যে?

অমিয় টাকাটা নিয়ে ছুটে এলো মায়ের কাছে। ওর মা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, ‘আমি সব বুঝি। আমারে তর থেইক্যা বিচ্ছিন্ন করবার চায়। সারাডা জীবন জ্বালাইয়াও আশ মিডে নাই। অহন শেষ কামড়ডা বসাইছে।’

অমিয় কোন দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারে না; সে সরাসরি মাকে প্রশ্ন করে, ‘ট্যাকাটা তাইলে ফেরত দিয়া দিই?’

মা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর উত্তর দিলেন, ‘ট্যাকা তুই ফেরত দিবি ক্যান? তুই চেষ্টা কর বিদেশে যাওনের।’

‘এই লোকটার থেইক্যা ট্যাকা নিতে যে মন চায় না মা?’ অমিয়র শেষ চেষ্টা নিজেকে দায়মুক্ত রাখার।

‘মানুষটা তর বাপ। আর কেউ না।’ চাপা গলায় মা বলে উঠলেন।

আর একটিও কথা না বলে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন-রচনায় মেতে উঠল অমিয়।

পাকা আপেলের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃক্ষের মতো লোভনীয় যে বিদেশ, এর হাতছানিকে কি সে অস্বীকার করতে পারে?

ঘরে এবার একমাত্র কন্যা পারমিতা ঢুকল।

পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে প্রথম প্রশ্ন ওর, ‘বাপি, আমরা কবে কানাডা যাবো?’

মেয়েটা ওখানে এ-লেভেল করলেও একেবারেই এদেশীয়; আবেগগুলোর চেহারা দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ও পুরো বাঙালি।

‘দাদুর শ্রাদ্ধশান্তিডা অইয়া গেলেই।’

‘নাইস। ঠাকুমা যাবে আমাদের সঙ্গে?’

‘আমরা ওখানে বাড়ি কেনবার পর ঠাকুমাকে নিয়ে যাবার কথা চিন্তা করব।’

‘এখন ঠাক্মা থাকবেন কোথায়?’

‘পরে ভাবব।’ বলে অমিয় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে মাথার ওপরকার ফ্যানটায় চোখ রাখে। মরিচা পড়ে পড়ে এখন বোঝা দায় এর আদি রং। কোনো একসময় বাবা শখ করে এই ফ্যানটি কিনেছিলেন।  এ-ঘরটাই ছিল মা-বাবার বিয়ের পর স্বপ্ন-রচনার  প্রথম ডেরা। অমিয় নামের যে-স্বপ্নটি আজ কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটি নিশ্চয়ই এই সেমি-পাকা  ঘরটাতেই রচিত; তারপর দুঃস্বপ্নের আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অমিয় ওর মাকে নিয়ে এ-ঘরেই কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটিয়েছে। অদ্ভুত একটা ঘোর মিশে আছে এই ঘরটার সঙ্গে ওর। বিদেশ থেকে  যখনই দেশে আসা হয় ওর, তখন সে এ-ঘরটাতেই বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে, বোধের সঙ্গে এ-ঘরটার অস্তিত্ব; এখানে পা রাখলেই সে নিজেকে দেখতে পায়। ভালো-মন্দ, প্রেম-অপ্রেম সব ছায়া ফেলতে থাকে ছোটবেলায় বাক্সের ভেতর বায়োস্কোপ দেখার মতো।

ওর বউ আবার প্রবেশ করে; কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট করে বলে ওঠে, ‘তুমি এইবার আমারে অবশ্যই বাড়ি করে দিবা কানাডায়।’

অমিয় মুচকি হাসে, ‘ক্যামনে? মফস্বলের এই বাড়ি বিক্রির ট্যাকা দিয়া তুমি কানাডায় বাড়ি করনের স্বপ্ন দেখো?’

‘বাবার দেওয়া জীবনবীমার চেক? মনে করো আমি কিছু জানি না?’

‘কী জানো তুমি?’ পালটা প্রশ্ন অমিয়র। সন্দেহে চোখদুটো  ছোট দেখায় ওর;  ভালো করে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না স্ত্রীর দিকে। তীব্র কুণ্ঠা আর অপরাধবোধে বিদ্ধ হতে হতে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘অনামিকা কদ্দুর জানে? কী জানে?’

‘আমি সব জানি। সব বুঝি।’ বলে ও আর দাঁড়ায় না। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

এ-সময় পাশের ঘর থেকে মা কঁকিয়ে ওঠেন, ‘তুমি কই গেলা আমারে ফালাইয়া। ও হো।’

অমিয়র পেছনে শীতের ঘন অন্ধকার জড়ানো আকাশজুড়ে আতশবাজির রাজত্ব; একটি ফুলকি অন্যটির ওপর পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনোটা ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে; ছুটতে ছুটতে পৃথিবীর খুব কাছে চলে এলেই দম ফুরিয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে, ঠিক জীবনের মতো।

পুরনো ভাবনায় পানকৌড়ি হয়ে ডুব দেয় অমিয়।

‘তর কি খুব কষ্ট অইতাছে কানাডায়?’ বাবা নামের কর্কশ মানুষটা প্রশ্ন করে ওকে।

‘না, ওইখানে আমার শ্বশুরবাড়ি আছে; জামাই-আদরে রাখছে আমারে।’ তীব্র ক্ষোভ আর উষ্মায় ওর বিদেশফেরত বাদামি চেহারাটা লাল হয়ে ওঠে। বিদেশের মাটিতে একা একা ও আর কত টানবে সংসার-জোয়াল? অন্যদের স্ত্রীরা কিছু কাজকর্ম করে সংসার-ইয়টটিকে চালানোর চেষ্টা করলেও ওর স্ত্রী অনামিকার নাকি লজ্জা লাগে ছোটখাটো কাজ করে আয়-রোজগার করতে। অথচ উচ্চাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জমান এক নারী সে; বাড়ি করে দাও বলে ওর মাথা খারাপ করে দিলেও এক্ষেত্রে নিজের অনুদান একেবারে জিরো।

অপ্রকাশিত সেই রাগ এখন বাবা নামের উটকো এই মানুষটির ওপর!

‘এই কাগজটা রাখ।’ মানুষটা ওর হাতে তুলে দেন একটি বীমা-দলিল।

‘আমি কী করুম?’

‘আমি মারা গেলে চল্লিশ লাখ পাইবি। আর যদি দুর্ঘটনায় মরি তো আশি লাখ।’ মানুষটার মাথা আগের মতোই নোয়ানো; মনে হচ্ছে বড় কোনো অপরাধ করে তিনি এর প্রায়শ্চিত্ত করার কথা চিন্তা করছেন।

‘কী কইতেছ এইসব?’ বাবার ঘরের মাঝখানে দাঁড়ানো সে; ওর হাতে ধরা বীমা-দলিল আর কণ্ঠে ও দৃষ্টিতে বিস্ময়।  যে-মানুষটাকে ওর কোনোদিনই পড়া হয়নি; নিজের বিয়ের সময় অসম্মান হবে ভেবে যার ওপর সে ঘর থেকে না বেরোনোর মার্শাল ল’ জারি করে রেখেছিল; সারাজীবনে যার সঙ্গে দুই পৃষ্ঠা কথা হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে; যাকে শৈশব থেকে এক অপাঙ্ক্তেয় পরিচ্ছদ হিসেবে জেনেছে, এই প্রথম সে মানুষটির চালশে পড়া ঘোলা চোখের দিকে তাকাল। লোকটা বয়সের অনেক আগেই অনাদর, অবহেলা আর অবিরাম আত্মপীড়নে বুড়োটে হয়ে গেছেন। তবু সে বুঝতে পারল মানুষটা কিছু বলতে চাইছেন।

‘আমার কতা শোন। এরপর যহন আমার মরণের খবর হুইন্যা এই বাড়িত আইবি, তহন একটা ট্রাক-ড্রাইভার আনিছ লগে। ওইডার নিচে পড়লে আমার দাম আশি লাখ। হেঃ হেঃ হেঃ।’

মানুষটা হাসার চেষ্টা করলেন। খুব কদর্য সেই হাসি। তাকানোর মতো নয়। একটা নোংরা লোক ছাড়া এভাবে ভাবতে পারে কখনো?

এ-কথা ভাবার পরও কেন যেন আশি লাখ টাকায় ভরা একটা ব্রিফকেস ওকে তাড়িত করতে থাকে। কিছুতেই সে লোভনীয় ব্রিফকেসটি থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে না!

সে ছুটে সেই ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসে; নিজেকে বড়-বেশি  জীর্ণ আর কাঙাল বলে মনে হচ্ছে এ-সময়।

সে-রাতে বাবা আবার মাতাল হয়ে বকতে শুরু করলেন। বকাবকির মূল লক্ষ্য অমিয়র মা। এই মহিলাই নাকি উনাকে ছেলের কাছ থেকে দূরে  ঠেলে দিয়েছেন; বাবাকে বানিয়েছেন ভিলেন; এই কাজ করেছেন সে তার গোপন প্রেমিককে খুশি করার জন্যে। তারপর শুরু হলো অভিশাপ; একটার পর একটা কঠিন সব অভিশাপ ওর কণ্ঠ থেকে বেরোতে লাগল। পুরো পাড়া গরম হয়ে ওঠে এই এলোমেলো জড়ানো বাক্যজ্বালায় ।

অনামিকা ঘরে ঢুকে নাক-মুখ কুঁচকে মন্তব্য ঝাড়ল, ‘কী বাজে। এখানে আর কদিন থাকলে আমার ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যেতে বাধ্য। এর চেয়ে ডাস্টবিনে নাক গুঁজে বসে থাকা অনেক ভালো। ছিঃ।’

অমিয়র মনে হলো একটা বাঁশ হাতে নিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে মাথায় বসাতে। আর ভালো লাগে না। এরকম একটা বিষফোঁড়াকে জোর করে গলিয়ে দিলে কার কী বলার আছে?

অমিয়র মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। প্রেশার বেড়ে যায়। তীব্র এক অশান্তি কানাডার তুষারপাতের মতো নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে অসার করে তোলে।

সে দুদিন পরই তাড়াহুড়ো করে কানাডায় পাড়ি জমায়; যাওয়ার সময় বীমা-দলিলটা নিতে ভোলে না।

একরাশ দমকা হাওয়া হয়ে অনামিকা প্রবেশ করে অমিয়র ঘরে। চোখে-মুখে অস্থিরতা; ওর  গা-ঘেঁষে এসে বিছানায় বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে। এরকম স্থির অথচ অনুসন্ধানী দৃষ্টির কী অর্থ তা সে সহজেই বুঝতে পারে। অনামিকার কৌতূহল ও বাস্তবতা-জ্ঞান কেন ওকে  বারবার করে  ওর কাছেই নিয়ে আসছে তা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর রয়েছে। কিন্তু সে কী বলবে উত্তরে?

‘তুমি এভাবে তাকায়া রইছ কেন? আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবা?’

‘না।’

‘কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবা না?’

‘না।’

ঠিক এসময় অমিয়র একমাত্র মেয়ে পারমিতা একটি বাঁধানো ছবি এনে বাবার হাতে দেয়, ‘কেমন হইছে বাপি? নাইস না?’

‘হু।’ গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় অমিয়।

‘এই ঘরে টাঙাবো। কী বলো?’ বলে বাবা-মায়ের দিকে সরল দৃষ্টি মেলে ধরে ওদের একমাত্র মেয়ে।

অমিয় ওর বাবার ছবিটার দিকে একঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনে হচ্ছে নিজের চোখ-দুটো পুড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। একজন মৃত মানুষের ছবিও কি এভাবে দংশন করতে পারে কাউকে?

মাথা ঝিমঝিম করছে; বাইরের আকাশে উড়ন্ত আতশবাজিগুলো এক-একটি বিশাল আকারের ট্রাক হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে চলেছে ওর অস্থি-মজ্জা-তন্ত্রীসহ সমস্ত সত্তা।

সে এই নির্যাতন থেকে একটুকু প্রশান্তি পেতে পাশে বসা স্ত্রীর দিকে তাকায়।

কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ জমিয়ে অনামিকা বলে ওঠে, ‘ছিঃ।’