দেহমন্দিরে যোগ্য পুরোহিত

মঈন শেখ
বাংলা সাহিত্যের কাব্যধারার প্রধান উপাদান প্রেম। প্রেমের বিচিত্র রূপ এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। আর সে-সূত্রেই আমরা পেয়েছি কবির এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য। তবে এ-প্রেমের মাত্রা সর্বোচ্চতা পেয়েছে মানবপ্রেমে। আর মানবপ্রেমর যে-দিকটা প্রাধান্য পেয়েছে, তা নর-নারীর প্রেম, যার লক্ষ্য থাকে মিলনে। এই মিলন প্রেমিক যুগলকে দেয় তাদের প্রেমের সার্থকতা, পূর্ণতা দেয় কামনা-বাসনা বা যৌনতার রস আস্বাদনে। তাহলে কি প্রেমকাব্য মানেই যৌনতা? না, অবশ্যই নয়। তাহলে প্রেম মানে যৌনতা? না, তাও নয়। আমি বলছি, প্রেমের লক্ষ্য মিলনকে সামনে রেখে হয়। প্রেম শব্দটা সবসময় পবিত্র। মিলনও।
বাংলা কবিতার আদিপর্ব থেকে আজ পর্যন্ত কাব্যকর্মে বেশিরভাগ কবিই নারীর রূপ ও তার আবেদনময়তা নিরীক্ষণে তুমুল অনুরাগী। তাঁরা মূলত নারীকে সৌন্দর্যের আধার, দেহমন্দির এবং রক্ত-মাংসময় ভোগায়তন করে প্রশংসা, নয়তো নিন্দার ঝড় তুলেছেন। আর কবি স্বয়ং সেই দেবীর বা মন্দিরের পূজারি বা পুরোহিত। এও সত্যি, যুগে-যুগে নারী-সৌন্দর্যের যে-আবেদন তৈরি হয়েছে তাতে কবিকুলের ভূমিকা সর্বাগ্রে। নারীর সৌন্দর্যমূল্য যেভাবে নিরূপণ করেছে সমাজ, সেখানেও কবির ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। আর তাই স্বাভাবিক সুন্দরের মাঝেও নারী আরো বেশি রূপসী, রমণী, কামিনী বা কলাবতী হওয়ার সাধনায় ব্যাপৃত হয়েছে। ফলে ‘মানুষ নারী’ স্বাভাবিকভাবেই নি®প্রভ হয়েছে সুন্দরী তথা যৌনাবেদনময়ী নারীর কাছে।
কবিকুল নারীর রূপ ও কাম বর্ণনাই যে শুধু করেছেন, তা নয়। গুণেরও তারিফ করেছেন। মধ্যযুগের কবিতায় যার লক্ষণ স্পষ্ট। জ্ঞানদাসের কবিতায় যা এসেছে এভাবে –
রূপ লাগি আখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ॥
আধুনিক যুগে এসে এই বলার ভঙ্গিমা আরো মুক্ত হলো। কারণ ভাষা বিন্যাস, বর্ণনা ও রুচি এখানে মুক্ত। আসলে তুলনামূলকভাবে আরো বেশি নান্দনিক, চিত্রকলাসমৃদ্ধ ও শব্দ-প্রয়োগের চাতুর্যে সমুজ্জ্বল। আর এই ক্রমধারায় সর্বশেষ, সর্বাধুনিক সংযোজন ঘটালেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। এই দেহকাব্যের এক আকর গ্রন্থ ভালোবাসার রাতে। এখানে কবি দেহমন্দিরে দেবীমূর্তি নির্মাণে যতটা কারিগর, ততটাই পূজারি। আবার কখনো যোগ্য পুরোহিতও বটে।
নারী, রমণ, রমণীয় – এই তিনটি শব্দের সমন্বয়ে নির্মিত ভালোবাসার রাতে গ্রন্থটি। একজন রমণী একজন রমকের কাছে যখন ক্রমশ আলগা হয়, তখন রমকও জ্বলে ওঠে নক্ষত্র হয়ে। একে একে লক্ষ-কোটি নক্ষত্রের স্ফুটন শুরু হয় তার কামুক দেহে। নারীশরীর আর শরীর থাকে না, হয়ে ওঠে নক্ষত্রের বাগান। কবির রমণী তখন হয়ে ওঠে এমন –
যখন দু’স্তন মেলে ডেকে নিলে বুকের ওপরে,
স্বর্গের জঘন খুলে দেখালে যে-দীপ্তির প্রকাশ,
তখন কী হলো আমি কোন্ ভাষে বলবো কী করে?
মুহূর্তেই ঘুচে গেলো তৃষিতের অপেক্ষার ত্রাস।
(‘ভালোবাসার রাতে-২’)
একজন কবি একজন নারীকে কীভাবে পূর্ণতা দিতে পারেন, ভালোবাসার রাতে তার প্রমাণ। একে রমণীর রমণপূর্ণতার আকরও বলা যেতে পারে। নারীর স্তনের ব্যাপ্তি শুধু স্তনে নয়, তার অপার সৌন্দর্য নক্ষত্রকে ছাড়িয়ে। আর তাই তিনি বলতে পেরেছেন – না-লেখা কবিতা এক দীপ্তিমান নক্ষত্র শরীরে। এখানে নারীশরীর শুধু শরীর নয়, কবিতালেখ্য। আমার জানা নেই, বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ আছে নাকি, নারীশরীর যেখানে স্বয়ং কাব্যদেবী। যোগ্য দেবী। আর এর মাঝে প্রস্ফুটিত হয়েছে কবির দেহবাদ, সৌন্দর্যবাদ আর কামবাদের রমণীয়তা, যা ভালোবাসার রাতের কাব্যফসল।
কবি নারীদেহে তাঁর অঙ্কশাস্ত্র ফলিয়েছেন সার্থকভাবে। জ্যামিতির হিসাবে কবি পাকা। কবির নারী জ্যামিতির বই হয়ে ফুটে ওঠে সম্মুখে। নারীতে আছে বৃত্ত, আছে ত্রিভুজ ও সমতল। আছে চাঁদাও। কবি আরও বলেছেন –
সমকোণ? সেও গড়ে ওঠে খুব নিখুঁত আকারে,
যখন শয্যায় তুমি অসম্মত আড় হয়ে শোও –
যখন ফিরিয়ে মুখ পড়ে আছি দু’জন দু’ধারে,
যখন রতির মাঠে বিচ্ছেদের ধান তুমি রোও।
(‘ভালোবাসার রাতে-৫’)
আবার কবি নিজেকে মূর্খ বলেছেন জ্যামিতি বিষয়ে। পাকা চাষি সেজেছেন চাষবাসে। যেখানে দেহ আর মাঠ একাকার। এ চাষি বীজের বপন ঋতু ব্যর্থতায় বয়ে যেতে দিতে পারেন না। তাহলে দেহের ভাগ্যে নির্ঘাত জুটবে অনাহার। এখানে কবি নারীকে দেখেছেন জো ধরা ভূমিরূপে। কবি হয়ে ওঠেন সার্থক কৃষক। যদিও এ-চিন্তা নতুন নয়। কবিকুল বারবার নারীকে উর্বর ভূমির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঋতুমতী নারী আর বর্ষার ভূমি যেন একে অপরে একাকার। কবি আল মাহমুদ যেমন বলেছেন –
আমি পুরুষ বটে।
পুরুষ চালায় হাল আল ভেঙে ঠেলে যায় ফাল
মাটিকে মাখন করে গোঁজে বীজ, গোঁজে জন্মকণা
নারীর কোষের মাঝে রাখে কীট
কালোত্তীর্ণ প্রাণের কীটাণু।
…   …   …
চাষীর বিষয় নারী
উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।
(‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না : কবির বিষয়’)
আসলে কাব্যভুবনে প্রকৃতি আর নারী একাকার হয়েছে যুগে-যুগে। জমিন, বৃষ্টি, ফসল যখন একে অপরের পরিপূরক, তেমনি কামনার আকাশ হতে ঝরা বৃষ্টিতে নারীর উর্বর জমিন হয়েছে সিক্ত। এ জমিন যোগ্য কৃষককে আহ্বান করে বপনের জন্যে। কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের ভাষ্য এমন –
মাঠও রমণীর মত। সহজে সে হয় না তোমার
সদ্য পরিণীতা কোন ভয়ে কাঠ-কিশোরীর প্রায়
তাকেও জাগাতে হয় জলসেচে, মৃদু বলাধানে
পটিয়ে পটিয়ে হয় ফলনের যোগ্য করে নিতে।
(‘ধান ও মাঠের কবিতা’)
কিন্তু আমাদের আলোচ্য গ্রন্থে সৈয়দ শামসুল হকের উপস্থাপন অন্য মাত্রা পেয়েছে। এত বেশি আলগা আর এত বেশি রসদ উচ্চারণময়ী কবিকে এর আগে কখনো দেখিনি। এ যেন আরেক পরানের গহীন ভেতর থেকে ঝরে-পড়া রসদমঞ্জরি। কবি দেখিয়েছেন – খরার মাঠ যখন বৃষ্টিতে ভিজে ওঠে, তখন কীভাবে যোগ্য কৃষক হয়ে উঠতে হয়। কবির উচ্চারণ –
এখন সে বৃষ্টিকাল দেখে হাতে তুলে নেয় বীজ
রোপণের তাড়নায় নেমে পড়ে পিচ্ছিল কাদায়।
যখন খুলছো তুমি দেহ থেকে শাড়ি ও শেমিজ
তখন উদ্বেল কেউ হয়ে ওঠে কৃষি-প্রতিভায়।
(‘ভালোবাসার রাতে-৬’)
এ বৃষ্টি থামবার নয়। খামতিও নেই বপনের। কৃষকের চোখে-মুখে উন্মত্ততা। তার একটাই ইচ্ছা, অঙ্কুরোদ্গমে বীজ সফল হোক বা না হোক বৃষ্টিটা থাক বারো মাস। তবেই কৃষক ফসল আর জমিনের খুনসুটি জমে উঠবে। ঠিক একইভাবে আরো বেশ কিছু কবিতায় কৃষক ও জমিন ভিজেছে একই বৃষ্টিতে। অবশেষে কবির অতৃপ্ত মনের আকুতি – যে ভালোবেসেছে সে-ই শুধু জানে রতির স্মৃতিবীজ অঙ্কুরিত হয় যুগল দেহেই। প্রজননক্ষম ধরার তুল্য হয়ে উঠেছে নারী। রমণী যেন ফসলপুষ্ট উর্বর মাঠ। উর্বর শস্যক্ষেত্র তো বটেই, বিচিত্র ভাণ্ডারে সজ্জিত একটি দেশও। সৈয়দ আলী আহসানও দেখেছেন ঠিক একইভাবে –
তোমার দেহের বর্ণনা কী করে করি,
কত বিচিত্র সম্ভার নিয়ে একটি দেশ,
সেখানে বৃক্ষশাখায় পুষ্প ভরি,
কতো আলাপের ইতিহাস নিয়ে কথার শেষ।
(‘তোমাকে-২’)
সত্য কথা বলতে কী, প্রিয় রমণী কবির প্রিয় খাতার মতো। প্রিয় জমিনও বটে। সৈয়দ হক যে-জমিতে সহজেই জো আনতে পারেন। চষতেও পারেন ফসল বপনের উপযোগী করে, খরিপ কিংবা রবি। শুধু ফসল আর ফসল। খলবলিয়ে হাসাতে পারেন ওই জমিনকে। তবু কোথায় যেন খামতি থেকে যায়। কারণ এ যে নারীদেহ। তার নির্মাণগত শৈলী অফুরান সৌন্দর্যে ঢাকা। এ যেন অসংখ্য কবিতা-সূচিত আদিম কবিতার পাণ্ডুলিপি, যা উদ্ধারের ভার এখানে নিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক নিজেই।
ভালোবাসার রাতে  গ্রন্থের ১২ নম্বর কবিতাটি ভিন্নমাত্রার। সাধারণ নিয়মেই নারী ঋতুমতী হন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মাঝে যে কত আকুতি, কত আকাক্সক্ষা লাল নিষিদ্ধ নিশানের তলে মাথা কুটে, তা স্পষ্ট হয়েছে এখানে। তারপরও কামনার তাপ অগ্রসর হয় সেদিকেই। কবির সহজ উক্তি –
বৃষ্টিও বৃষ্টি তো নয় – জরায়ুর রক্তিম ক্রন্দন।
আজ তিনদিন থেকে অবিরাম, ক্ষান্তি নেই তার।
নিষেধ পতাকা লাল, পতাকায় শরীরী স্পন্দন
তবুও তবুও জাগে, জাগে ইচ্ছা সেখানে যাবার।
শত বাধা সত্ত্বেও থামতে পারে না কামুক পুরুষ। দুজনের দেহ ছিঁড়ে বের হয় দুধ-পূর্ণিমা। আর তা নেমে আসে স্তনের চূড়ায়। বাড়তে থাকে কামনার জ্বর। আর জ্বরতপ্ত হাত কুড়ায় কামনার ফুল। এ  টান শুধু এক পক্ষের নয়। সমানতালে দুজনের। অবশেষ ভেঙে যায় বাঁধ –
তবে ভিজে যাক সব, বৃষ্টি থাক, এসো ভিজে যাই –
জ্বরের আগুনে দেহ লাল বৃষ্টিধারায় ভেজাই॥
সৈয়দ শামসুল হকের সামনে নারীদেহ যখন দেবীমূর্তি রূপে মূর্ত হয়ে ওঠে, তখন শয়নকক্ষ হয়ে ওঠে মন্দির। আর পুরোহিত কবি। আসলে যোগ্য কামুক পুরুষই পারে সেই মন্ত্র পাঠ করতে। কামনার ফুলে জাগিয়ে তুলতে পারে দেবীকে। কবির সামনে নারী যেন এক মেটে দেহ, যা কুমোরের উঠোনে কাঠামোসদৃশ। তাই কবির সহজ উক্তি –
দেবী তুমি দাঁড়িয়ে রইলে, আমি চুম্বনের ফুলে
সারাদেহ ঢেকে দিয়ে পূজাপাঠ শুরু করলাম।
তুমি তো মাটি নও – ছুঁয়ে আমি দেখেছি আঙুলে,
তবুও মন্দিরে ঢুকে প্রথমেই তোমাকে প্রণাম।
(‘ভালোবাসার রাতে-২৯’)
এ পুরোহিত দেবীর বুকে বুক রেখে করতে চান স্তোত্রপাঠ। উচ্চারণ করতে চান একটি মাত্র শব্দ – ভালোবাসি, ভালোবাসি। প্রেমিক নিজেকে বারবার ঘোষণা দেয় যোগ্য পুরোহিত বলে, কারণ প্রেমিকা তার কাছে ঈশ্বরী। আরো ঘোষণা দেয় নিজেকে কাম-দেবতার পুত্র বলে। আর তখনই শরীর ধুনুচি হয়ে কামরূপ ধূপগন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত ঘর। তবে এই সত্যকারের পুরোহিত হয়ে ওঠার মন্ত্র নেওয়ার পালা শুরু হয়েছে বলতে গেলে পরানের গহীন ভিতর ও এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি  গ্রন্থের মাধ্যমে। ভালোবাসার রাতের বীজ মূলত অঙ্কুরিত হয়েছে সেখানেই। যার স্পষ্টতা আমরা এখানে দেখতে পাই –
তোমার খামচির দাগ এখনো কি টকটকা লাল
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
(‘পরানের গহীন ভিতর-৬’)
এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি  গ্রন্থে সৈয়দ শামসুল হককে আমরা পাই আরেকটু অন্য মেজাজে। ভিন্ন উচ্চারণে সেই একই সুর। এটা ভালোবাসার রাতের  খুব কাছাকাছি –
আমি তোমার যতটা দেখি, তা ভালো;
যা দেখি না, সম্ভবত তা আরো ভালো।
এবং মাঝরাতে ইচ্ছার আলো
ঐ সব ভেবে হয় ভীষণ জোরালো॥
(‘এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি-৮’)
কবি নারী আর কবিতাকে আলাদা করে দেখেননি। এখানে সৈয়দ শামসুল হকের নারী কবিতা আবার কবিতাই নারী। আসলে এই গ্রন্থে কবি, কবিতা আর নারীই একসূত্রে গ্রথিত। একাকার। আর তাই কবি সমস্ত কোলাহল, সমস্ত শব্দের জঞ্জাল পেরিয়ে পেতে চান নির্জনতা। আর প্রিয়ার ঠোঁট থেকে শুনতে চান একটি মাত্র শব্দ ‘ভালোবাসি’। যে-উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কেঁপে উঠবে। কিন্তু এর স্থিরতা কোথায়? কবি খুঁজে চলে আরেক ‘তুমি’কে। যে-তুমি থাকে ভেতর-সত্তায়। কবির প্রশ্ন –
আরো এক ‘তুমি’ বাস করে নাকি তোমার ভেতরে? –
সেই অতি মানবীর খোঁজে এই শরীর মথন।
(‘ভালোবাসার রাতে-২১’)
যার জন্যে কবির এত আয়োজন সে সারাক্ষণ থেকে যায় চোখের আড়ালে। সেই ‘তুমি’ নিজেকে গোপন রেখে আজীবন পলাতক থাকে। কেবল রতির কোলে হঠাৎ কখনো সেই মুখ দেখা দেয়। যদিও এ-দেখা দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য – কাম, আকাক্সক্ষা আরো জাগিয়ে তোলা। তবে এও সত্য, প্রেমিক তথা কামুক পুরুষের কাছে শেষ বলে কিছু নেই। রাতের রমণ শেষে তাদের একটিই প্রার্থনা, রাত যেন শেষ না হয়। তার নেই কোনো ক্লান্তি। শুধু একটাই ভাবনা – এ যুদ্ধের এখনো অনেক বাকি। কারণ প্রেমিকের আকাক্সক্ষার শেষ বলে কিছু নেই। লেহন, মর্দন সমস্ত পর্বই শেষ হয়, তবু খুঁজে পান না তার অধরাকে। আসলে প্রেমিক চান আরো আরো। তাই তো তার সহজ আকুতি –
তোমার প্রতেœর খোঁজে ফিরে ফিরে এত বারবার
রতির শয্যায় আসা, বস্ত্র খুলে দেখার তাড়না –
তুমি তো তবুও দূর, কাছে তুমি আসতে পারো না?
হতে কি পারো না তুমি ধরা ছোঁয়া অবাধ অপার?
(‘ভালোবাসার রাতে-৬৯’)
এ যেন প্রিয়ার ভেতরে প্রিয়াকে খোঁজা। আসলে সৌন্দর্যানুভূতি যখন চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, তখন কোনো বৈশিষ্ট্য দিয়ে তার বিচার করতে কবি অপারগ। সেই সৌন্দর্য-আকাক্সক্ষা জগৎ বস্তুর কোনো সৌন্দর্যই মেটাতে পারে না। তাই তো কবিদের কণ্ঠে কথাগুলো ফিরে এসেছে বারবার –
ছুঁয়েও কিছুতে আমি তোমাকে পাবো না
হে নগ্নিকা, হে সুন্দর।
(‘নগ্নিকা’, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
আবদুল মান্নান সৈয়দ স্বীকার করেছেন, প্রকৃতি যে নিরাভরণ নারীকে উপহার দিয়েছে সেই অনিঃশেষ রূপমাধুরী একমাত্র ঈশ্বরই নির্মাণ করতে পারেন। নির্মাণ তো দূরের কথা, সে-সৌন্দর্য ভাষায় অনুবাদের অযোগ্য। আসলে রক্ত-মাংসের কাঠামো স্পর্শযোগ্য হলেও নারী-সৌন্দর্যের অন্তর্গত মহিমা অধরা থেকেই যায়। নারী রূপ, লাবণ্য, ত্বক, ঠোঁট, চিবুক, বক্ষ ইত্যাদি দেহ কাঠামো বিষয়ের অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায় সুন্দর বস্তু হিসেবে। আর সে-অর্থেই সৈয়দ শামসুল হকের তৃষ্ণা অতৃপ্তই থেকে যায় তাঁর মুষ্টির মধ্যে থাকা অধরা বস্তুর নিরিখে। কারণ, নারী নিজেই রহস্যময়ী কিংবা রহস্যের অন্য নামমাত্র। আর সে-থেকেই কবির কল্পনা আর নারীর রহস্য পরস্পর সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয় কাব্যপ্রতিমা। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবীর সকল দুর্বল প্রাণীর মধ্যেই রহস্য সৃষ্টির অভিপ্রায় লক্ষণীয়। অন্য কথায় মূল্য দিয়ে টিকে থাকার একটি কৌশল। এ অর্থেও নারী রহস্যময়ী, বিশেষত যৌবনকালে। আর এই রহস্যময়ী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে পুরুষ। যে-কারণে সংবেদনশীল কবিকুল এই রহস্যের মুখোমুখি হয়ে সৃষ্টিশীল কল্পনায় মেতে ওঠেন। অন্যপক্ষে নারীও হয়ে ওঠে আরো অচেনা, আরো দুর্বোধ্য। যেমন –
বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না,
তুমি প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর :
আবার কখনো ভাবি অপার্থিব কিনা।
(‘তুমি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
এই রোমান্টিক কল্পনা অনেকটা বাস্তববিচ্যুত হলেও আলো-আঁধারির এখানে বেশ মিশেল। অন্যদিকে কবি আল মাহমুদ সুন্দরের পরিপূর্ণতার বিভাস দেখেছেন নারীতে। নারীশরীরের ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পেতে চেয়েছেন তাবৎ আনন্দ ও সুখ। তারপরও কবির কেন জানি মনে হয়, নারী তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু। তাঁর ভাষ্য – ‘নারী দেহের চেয়ে নর্ম্য কিছু নেই পৃথিবীতে’। বলেছেন – ‘মাতা বধূ কন্যা হে, নারী এক রহস্যের নাম’। আবু হেনা  মোস্তফা কামাল নারীকে দেখেছেন নির্জন দ্বীপের বুকে রাত্রির প্রদীপ হিসেবে; যে শুধু জ্বলে ওঠে একা একা। কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় নারীকে দেখেছেন আরো বড় করে। তাঁর চোখে, পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য-রহস্য, মোটকথা যা কিছু লুকিয়ে আছে নারীশরীরে। তাঁর সোজা কথা –
একটুখানি ভেবে দেখলে রমণীর শরীর মানেই পৃথিবী,
জল ভাবলেই জল,
জাহাজের মতো ভাসলে পারো।
(‘রমণীর উপমা, মা নিষাদ’)
আমাদের কবি সৈয়দ শামসুল হকের নারীদেহের উপস্থাপন, গতি-ভঙ্গির আবেদন, চাহনীর কটাক্ষ, সাংগীতিক উচ্চারণসহ ইত্যাদির মাধ্যমে নারী শুধু নন্দন প্রতিমা হয়েই থাকেনি, হয়েছে শোভন সামগ্রীও। আর এতে কবির রূপতৃষ্ণা মিটল না। কবির কল্পনা ধাবিত হয় অন্য কোথাও। কাম প্রেমে চূড়ান্ত যৌবনবতীর জন্য সে এক অনিঃশেষ অন্বেষণ। আর এই কল্পিত সুন্দরীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে চিরযৌবনা, অতুল লাবণ্য ও কামজ আবেদনের আকর। এই নিপুণ সৌন্দর্য বর্ণনার মাধ্যমে নারী হয়ে ওঠে যৌনভূমিকার শোভামণ্ডিত রহস্যের আধার। বাংলা সাহিত্যে রমণী বরাবরই রহস্যমধুরা। এখানেও কবি কল্পনায় যে-নারীর বসবাস, সে-নারী রূপজ ও কামজ রহস্য মহিমার এক জমাট আকৃতি বলা যেতে পারে। যার বর্ণ, লাবণ্য, বঙ্কিমতা কেবলই বাসনাকে উদ্দীপ্ত করে। প্ররোচিত করে কাম-চেতনাকে। নারী ক্রমেই হয়ে ওঠে রমণী। আর তখনই কবি বাস্তবতা ছেড়ে হয়ে ওঠেন কল্পবিহারী। বিচরণ করেন স্বপ্নলোকে, আর নারীকে তখন মনে করেন স্বপ্নসহচরী। এখানে নারী অর্ধেক রক্ত-মাংসের আর অর্ধেক ভাবের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মানসী’ এখানে মিলে যায় – ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’। প্রাচীন কবিরা নারীকে যেমন দেহসর্বস্ব করে গড়েছেন, আধুনিক কবিরা সেখানে থাকেননি। তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন মনকে। বলেছেন – ‘নারীর মন সহস্র বছরের সাধনার ধন’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আমার মনে হয়, এই মতবাদেই বিশ্বাসী পরবর্তী কবিগণ। তাঁদের বর্ণনার মর্মসার কতকটা এমন – নারীকে অবলোকন করা যায়, ছোঁয়া যায়, বন্দি করা যায় প্রেমে বা কামজ আলিঙ্গনে। কিন্তু মন থেকে যায় দুর্লভ হয়েই। কবি রফিক আজাদের কথায় আরেকটু খোলামেলা বলা যায়। তিনি নারীকে বলেছেন – ‘নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তবতা’। এ-বাস্তবতার অবস্থান দৈহিক। আর দেহের গহিনেই মনের বসবাস। কাজেই ভিন্ন করে মনের তালাশ না করাই ভালো। সেই অর্থেই হয়তো লোককবিরা নারীকণ্ঠে শুনিয়েছেন – ‘দেহ দিলাম মন দিলাম, আর নাই কিছু বাকি’। দেহ দিলে নারীর আর কিছু বাকি থাকে না। এখানেও প্রমাণিত, সহস্র বছর মনের জন্যে সাধনা না করাই উত্তম। বরং সেটি অধরা বা অচেনা থাকলে নারী সহজে রমণী-কামিনীতে স্থিত হতে পারে। তাছাড়া নারী যদি মেনে নেয়, তার অর্ধেক অস্তিত্বকে পুরুষ কল্পনা দিয়ে সঞ্চারিত করে, তাহলে রহস্যময়তার আড়ালে তাকে অবস্থান নিতেই হয়। পুরুষ তাকে ‘রহস্যময়ী’ বলে যতই নিন্দা করুক, সে নিরুপায়। আর তাই হয়তো অটুট থেকেছে নারীর আদি পরিচয় – সুন্দরের আধার আর ভোগের আয়তন হিসেবে। সৈয়দ শামসুল হকও সেটা দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বলেছেনও বটে – দেহদেশে কবে কোন্ সেনাপতি হয়েছে বিজেতা!
এবার এর শিল্পমূল্য নিয়ে দু-কথা না বললে বলায় অপূর্ণতা থাকবে। যদিও আমার উদ্দেশ্য তা নয়। ভালোবাসার রাতে  গ্রন্থটি বর্তমান কবিকুল বা কাব্যভুবনে একটি বিস্ফোরণ বলা যেতে পারে। যখন তথাকথিত তরুণ কবিরা গদ্যছন্দের পূজারি, প্রকৃত ছন্দকে থোড়াই কেয়ার করছেন, ঠিক তখনই চপেটাঘাত হানলেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি দেখিয়ে দিলেন ছন্দ কবিতাকে কত বেশি মহিমান্বিত করে। নিটোল সনেটগুলো পাঠের সময় পাঠক রোমাঞ্চিত না হয়ে পারেন না। আট-দশ মাত্রায়, যা কানায় কানায় পূর্ণ। অন্ত্যমিলেও খামতি নেই। এখানে রয়েছে ৭৫টি সনেট। এই সনেটগুচ্ছে আমরা পেয়েছি কবিতা শিল্পের দায় মেটাতে যা-যা প্রয়োজন তার সব। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস, বক্রোক্তি, শ্লেষ প্রভৃতিতে ষোলোকলা পূর্ণ। যেমন –
এমন পূর্ণিমা রাত, তার চেয়ে বেশি জ্যোৎস্না ওই
তোমার বিথর দেহে প্রতি স্বেদবিন্দুতে হীরক –
প্রতিটি চুম্বনে দাও দীপ্তিকণা তুমি থইথই,
স্বর্গের দরোজা খোল, বন্ধ করে রেখো না কীলক।
(‘ভালোবাসার রাতে-৬৮’)
এই গ্রন্থে বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী বা ব্যভিচারী ভাবের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়। যার পরিপূর্ণতা আনতে গিয়ে প্রতিটি শাখা-প্রশাখা – যেমন আলম্বন, উদ্দীপন, অলঙ্কার, উদ্ভাসর, বাচিকসহ অন্যান্য বিষয়ের সক্রিয় উপস্থিতি গ্রন্থটিকে আরো বেশি জীবন্ত করে তুলেছে। এ-গ্রন্থের মূলরস শৃঙ্গার বা মধুর। বিষয়গুলো প্রমাণের জন্য উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধটিকে আর দীর্ঘায়িত না করি। এ-ভার পাঠককেই দিলাম।
ভালোবাসার রাতে গ্রন্থের কিছু কবিতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, একই তারিখে একাধিক কবিতা রচিত হয়েছে। মজার ব্যাপার, কবিতা দুটিতে অত্যুক্তি বলে কিছু নেই। যা আছে তা বিস্ময়। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা রচনার সময় তিনি কবিতা রচনা করেছেন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। যে-কবি প্রত্যহ দীর্ঘ সময় নিয়ে এমন কবিতা রচনা করতে পারেন, তার পক্ষে এটাও সম্ভব। ভালোবাসার রাতেও আমরা পেয়েছি বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা  কিংবা পরানের গহীন ভিতরের পরম্পরা হিসেবে, যদিও এর স্বাদ আলাদা ও স্বতন্ত্র। এখানে সৈয়দ শামসুল হক যতটা দেবী-নির্মাতা, ততটাই পূজারি। আবার কখনো যোগ্য পুরোহিতও বটে।