দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবন, সাহিত্য, সংগীত বিষয়ে আমাদের জানা-বোঝার সীমা এত সংকীর্ণ যে, সেই সীমাবদ্ধতা থেকে আজো আমরা মুক্ত হতে পারিনি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে পঞ্চকবি, পঞ্চভাস্করের গান শিরোনামে গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। পঞ্চকবির মামুলি পরিচয়ে পরিচিত হন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, পাঁচজনের মধ্যে সম্ভবত সব থেকে কম মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি। দ্বিজেন্দ্রগীতির নিয়মিত শিল্পী আমাদের নেই বললেই চলে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান বাংলা কাব্যসংগীতের ধারায় বাঙালির এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার, এ-কথা আমরা ভুলেই ছিলাম। কবি, গীতিকার, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল সম্পর্কে তাঁর সময়ে এবং পরেও বাঙালি আগ্রহ, উচ্ছ্বাস প্রকাশে অনীহা দেখিয়ে এসেছে। নাটকগুলির অভিনয়ই কেবল তাঁর পরিচয় কিছুদিন ধরে রাখতে পেরেছিল। নাটকে নতুন কোনো আঙ্গিক কিংবা বিষয়গত বৈচিত্র্য উদ্ভাবন করতে পারেননি তিনি। তাঁর হাসির গান, স্বদেশি গান, প্রেমের গানের বিচিত্র গৌরবময় ধারাটি তাঁর জীবৎকালেই হারিয়ে যেতে বসেছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের স্মৃতি ক্রমশ ঝাপসা, অস্পষ্ট হয়ে আসছিল। অথচ বাংলা সংগীতে তাঁর এমন কিছু অবদান আছে, যা অন্য কারো সংগীতে পাওয়া যায় না।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, দ্বিজেন্দ্রলাল বিষয়ে আমার অজ্ঞতাও কম নয়। মুগ্ধ হয়ে শুনেছি তাঁর গান, বিশেষ করে তাঁর মীড়বহুল, বিস্তারধর্মী গানগুলি, কালেভদ্রে কখনো গাইতে গিয়ে যেটুকু জানতে হয়েছে সেই সম্বলটুকু নিয়েই এই লেখার চেষ্টা করেছি।

মৃত্যুর আগে পুত্রের কাছে নিজের সৃষ্ট সংগীত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পুত্র দিলীপকুমার রায়কে বলেছিলেন, ‘না রে না, আমাকে কি রবিবাবুকে ভুলে যাবে না। আর কেন যাবে না জানিস? – এই জন্যে যে আমরা রেখে যাচ্ছি যা বাঙালির প্রাণের জিনিস – সুরে বাঁধা গান। আমি যে কী সব গান বেঁধে গেলাম সেদিন তুইও বুঝবিই বুঝবি।’ নিজের গান সম্পর্কে পুত্রের কাছে                       যে-আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি বলেছিলেন, তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। বেঁচে থাকতেই, বলা যায়, বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি। হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর অসাধারণ সংগীত। এভাবে বিস্মৃত হওয়ার পেছনে কারণও ছিল। তাঁর বিলিতি ধরনের হাসির গান এবং টপ খেয়াল আর যৎ তালে নিবদ্ধ বিস্তারধর্মী গান গাওয়া কোনো মাঝারি মাপের শিল্পীর জন্য ছিল খুবই কঠিন। তাঁর গান স্বরলিপিবদ্ধ হয়ে সংরক্ষিত হয়নি কিংবা পরম্পরাবাহিত হয়ে প্রচারের আলোয় আসতে পারেনি। তিনি বেঁচে থাকতে, তাঁর মৃত্যুর পরেও, এই দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

পরবর্তীদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন অবহেলা। তাঁর সময়ে তাঁর গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন এমন কোনো শিল্পীর নাম পাওয়া যায় না। নাটকের গানেই কেবল কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং সুশীলা সুন্দরী – এই দুটি নাম পাওয়া যায় যাঁরা তৎকালীন                 সংগীত-রসিকদের মধ্যে তাঁর গান জনপ্রিয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে এসব গানের সুর, গায়কি আর যথাযথ থাকেনি। মঞ্চে অভিনয়ের জন্য যে-সুরে, ভঙ্গিতে তাঁর গান গাওয়া হয়েছে, তাতে তাঁর গানের মূল সুর বিকৃত হয়ে আসল সংগীতরূপটি হারিয়ে গেছে – এ-কথা বলেছেন অনেকে। সর্বোপরি ছিল তাঁর স্বভাবগত উদাসীনতা। গান বেঁধেছেন, গেয়ে আনন্দ পেয়েছেন, বহু শ্রোতাকে আনন্দ দিয়েছেন, কখনো ভাবেননি সে-গান সংরক্ষণের কথা। যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় পরবর্তীকালে তাঁর গানের সুর, তাল এবং স্বরলিপি নিয়ে অধিকাংশ সময়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

১৯১৩ সালে দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর ১৯২৪ সালে তাঁর প্রথম স্বরলিপির বই বেরোয়। এ-বইয়ে ৪৩টি গান ছিল। বইটির নাম দ্বিজেন্দ্রগীতি প্রথম খন্ড। সম্পাদনা করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র দিলীপকুমার রায়। এরপর দিলীপকুমার রায়ের করা স্বরলিপি এবং তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দ্বিজেন্দ্রগীতি দ্বিতীয় খন্ড। দ্বিতীয় খন্ডে ৩৪টি গান ছিল। বইদুটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ার পর দিলীপকুমার রায়ের স্বরলিপি এবং সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে এক খন্ডে ৭৬টি গানের একটি সংকলন।

দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যু হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রথম দিকে। (১৮৬৩–১৯১৩) মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন। স্বরলিপিবদ্ধ গানের সংখ্যা মাত্র ১৩২। ধরে নিতে পারি, তাঁর সংগীতের রচনাকালও সেই সময়। বাংলা গানে তখন নতুন এক আন্দোলনের সবেমাত্র সূচনা হয়েছে। সেই যুগের তুলনায় তিনি কতটা আধুনিক ছিলেন তাঁর রচিত এবং সুরারোপিত গানই তার প্রমাণ। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে, প্রাচীনপন্থীদের বাধার মুখে দাঁড়িয়ে, সেই বাধা উপেক্ষা করে তাঁকে এগোতে হয়েছে। তাঁর গানের দৃপ্তভঙ্গি, পৌরুষ, ভাবগত বৈচিত্র্য ও মীড়বহুল বিস্তারধর্মী কারুকাজ বাংলা সংগীতে নতুন এক সংগীতধারার সূচনা করেছিল। বাংলায় তখন প্রচলিত সংগীতের মধ্যে হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গান, গুরুগম্ভীর ব্রহ্মসংগীত, টপ্পা আর বিনোদনের জন্য বাঈজিদের স্থূল অরুচিকর গানে সংগীত পরিবেশ মুখর ছিল। সংগীতের প্রচলিত বিষয় ছিল প্রেম, প্রণয়, বিরহ ইত্যাদি। সেকালের ভদ্র সম্প্রদায়ের কাছে এসব গান ছিল রুচিবিরুদ্ধ। এসব গান থেকে তাঁরা দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করতেন। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় বলা যায়, তাঁরা ছিলেন ‘সংগীতছুট’। গানের বিষয় এবং বাণী কত হালকা এবং অকিঞ্চিৎকর ছিল তার একটি নমুনা এরকম –

শান্তিপুরের খালের ভিতর জাহাজ ডুবেছে

বজরা ভেসে উঠেছে,

সাহেব বলে, ‘তোবা তোবা’

বিবি বলে, ‘জান গেল’

আর একটা পাখি বলে, ‘চোখ গেল।’

(উদ্ধৃতি : আত্মকথা, প্রমথ চৌধুরী)

এরকম সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা গানের জগতে নতুন এক ধারা নিয়ে এলেন। তাঁরা নিজেরা গান লিখলেন, সুর দিলেন এবং নিজেরাই সে-গান গেয়ে সেকালের ভদ্র, শিক্ষিত, রুচিশীল শ্রোতাদের নতুন এক সংগীত উপহার দিলেন। খামখেয়ালি সভায় দুজনেই একসময় গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিতেন।

বাবা ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। শুধু সংগীতজ্ঞ ছিলেন না তিনি, কৃষ্ণনগর রাজসরকারের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছেলেবেলা থেকে পিতার কণ্ঠে হিন্দুস্তানি গান শুনেই গানের জগতে প্রথম প্রবেশ ঘটেছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। দুর্ভাগ্য, পিতার কাছে সে-গান শেখার সুযোগ তাঁর হয়নি। পিতার হিন্দুস্তানি সংগীত প্রাণভরে শুনলেও অসুস্থতা এবং লেখাপড়ার চাপে তাঁর কাছ থেকে সংগীতের শিক্ষা তাঁর নেওয়া হয়নি। শৈশব থেকেই ছিলেন সংগীতপ্রিয় এবং সুকণ্ঠের অধিকারী। মাত্র বারো বছর বয়সে চাঁদ দেখে গান লিখেছিলেন –

গগন ভূষণ তুমি জনগণমনোহারী।

কোথা যাও নিশানাথ হে নীল নভোবিহারী?

হেসে হেসে, ভেসে ভেসে,

চ’লে যাও কোন দেশে,

চারিধারে তারাহারে, রহে ঘিরে সারি সারি।

হেলে দুলে ঢলে ঢলে,

পড়িছ গগন তলে –

কি মধুর মনোহর শশধর বলিহারি!

বারো বছর বয়সে গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, পিতাকে সে-গান শুনিয়ে তাঁর আশীর্বাদধন্য হয়েছেন। গান তিনি বুঝতেন, সমঝদারও ছিলেন গানের। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে বিশুদ্ধ তাল-লয়-জ্ঞানের বোধ তাঁর গড়ে উঠতে পারেনি। কারণ ছেলেবেলায় যৌবনের প্রারম্ভে, ছাত্রাবস্থায়, সংগীতানুশীলনের সময় কিংবা সুযোগ তাঁর হয়নি। নিয়মমাফিক সংগীতের তালিম তিনি প্রথম পান মুঙ্গেরে। ১৮৮৮ সালে কার্যোপলক্ষে সেখানে বদলি হয়ে যাওয়ার পর। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ, সদ্যবিবাহিত। ততদিনে বাংলার সংগীতজগতে হাসির গানের রাজা হিসেবে তিনি অভিষিক্ত হয়ে গেছেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতজীবন বিভাজিত করা যায় কয়েকটি পর্বে। প্রথম হাসির গান, সমাজ ও সমসাময়িক জীবনকে তির্যকভাবে দেখাতে গিয়ে রচনা করেছেন হাসির গান। দ্বিতীয় পর্বে ব্যক্তিজীবনের গভীর আবেগ আর উচ্ছল প্রেমের আত্মমগ্নতায় সৃষ্টি হয়েছে প্রেমের গান। তৃতীয়ত, তাঁর স্বদেশি গান। স্বদেশি গানের উৎস ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। এরপর তাঁর গান রচনার চতুর্থ পর্বে কলকাতার রঙ্গমঞ্চকে ঘিরে রচিত হয়েছে নাটকের গান। সবশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষটি জীবনের শেষ আশ্রয় হিসেবে ভক্তি-রসাশ্রিত গানের আশ্রয় বেছে নেন। পঞ্চাশ বছরের সৃষ্টিশীল জীবন এভাবেই সাজানো। সংগীত রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল যত সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ছিলেন, এমনটি আর কিছুতে নয়। সংগীত সৃষ্টির প্রথম পর্ব শুরু হয় হাসির গানের ফুলঝুরি ছড়িয়ে। বাঙালি শ্রোতার কাছে তিনি হাসির গানের রাজা হয়ে উঠেছিলেন। সদ্য বিলাত-প্রত্যাগত অপূর্ব কণ্ঠের অধিকারী দ্বিজেন্দ্রলালের কণ্ঠে হাসির গান শোনার জন্য শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। হাসির গানের মতো নতুন আঙ্গিকের বাংলা গান বাঙালি এর আগে এভাবে কখনো শোনেনি। তাঁর হাসির গান শুধু বিনোদন কিংবা স্ফূর্তির জন্য ছিল না, সে-গানে ছিল কৌতুক, বিদ্রূপ এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য বাক্-চাতুর্য। গানের মধ্যে দিয়ে হাস্যরস পরিবেশনের জন্য যে প্রবল সমাজচেতনা, সূক্ষ্ম বাস্তবদৃষ্টি এবং নিপুণ ভাষাবিন্যাস প্রয়োজন, তার সবই তাঁর হাসির গানে ছিল। পাশ্চাত্যে সংগীতের যে-শিক্ষা তিনি বিলাতে গ্রহণ করেছিলেন, বাংলা গানে দক্ষতা এবং সততার সঙ্গে পাশ্চাত্য সেই সংগীতশৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য ঢঙের প্রয়োগ তাঁর হাসির গানগুলিকে অসম্ভব জনপ্রিয় করেছিল।

হাসির গানের স্ফূর্তি তাৎক্ষণিক, ফুরিয়ে যায় সহজে। এ-গানের স্রষ্টাকে গভীরভাবে কেউই বুঝতে চাইতো না। হাসির গানের জনপ্রিয়তা সংগীতকার হিসেবে ভালোর চেয়ে তাঁর ক্ষতিই বেশি করেছিল। হাসির গান দিয়ে তিনি যে শুরু করেছিলেন এবং জনপ্রিয় হয়েছিলেন সেটা তাঁর জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল। এ-গান তাঁকে লঘু গানের রচয়িতার দুর্নাম এনে দিয়েছিল। হাসির গান যখন রচনা করেছিলেন, নিজে সে-গান গেয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছেন, তখন কি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সেই অনবদ্য সৃষ্টি তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হবে। গভীর পরিতাপের সঙ্গে তাঁকে পরে বলতে হবে, ‘হাস্য ক’রে অর্ধ জীবন করেছি তো অপচয়।’ হাসির গানের অনবদ্য স্রষ্টা হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলালের নাম সংগীত-ইতিহাসে অম্লান থাকলেও সে-ধারাটিকে বহমান রাখা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ-গানের জন্য যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ, গায়কি, সুরবিন্যাস, স্বরপ্রক্ষেপণে দক্ষতার প্রয়োজন, সাধারণ শিল্পীর পক্ষে তা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। তাঁর গানে বিদেশি সুরের প্রয়োগ অনুধাবন করাও সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর হাসির গান যে হারিয়ে গেল তার কারণ এ-গান গাইবার মতো উপযুক্ত শিল্পী পরবর্তীকালে আর তৈরি হয়নি।

দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান শোনার সুযোগ হয়নি। বহু আগে নলিনীকান্ত সরকারের কণ্ঠে রেকর্ডে ধারণ করা কিছু হাসির গান শুনেছিলাম। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান তার মধ্যে ছিল কিনা আজ আর তা মনে নেই। তবে হাসির গান গাওয়া যে মোটেই সহজ নয় সেটা বুঝেছিলাম। তাঁর যে-গান অন্তর্মগ্ন করুণ ও মধুর রসে সিঞ্চিত, টপ-খেয়ালের গায়নরীতিতে নিবদ্ধ, যে-গান আত্মমগ্নতায়, অন্তর্মুখীনতায় আপ্লুত করে তা হলো তাঁর কাব্যসংগীত। যে-বিষয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। তার কারণ বোধহয় অনেকেই তাঁকে শুধু স্বদেশি এবং হাসির গানের রচয়িতা হিসেবেই জানতেন। হাসির গান থেকে কাব্যসংগীত, প্রেমের গানে উত্তরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যক্তিজীবনের বিশেষ দুটি ঘটনা। ১৮৮৭-তে বিবাহ এবং ১৮৮৮-র জানুয়ারিতে মুঙ্গেরে বদলি হওয়া ছিল তাঁর জীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই দুটি ঘটনা তাঁর জীবনে যে-পরিবর্তন নিয়ে এলো তা তাঁর সংগীতজীবনকে নতুন এক দিকনির্দেশনার সন্ধান দিলো। সুখী দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য এবং প্রেমের সূক্ষ্ম বোধের উদ্বোধন মুঙ্গেরে এসেই তাঁর হয়। দাম্পত্য প্রেমের উষ্ণতায় ভরা দিনগুলি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এমনসব গান রচনায়, যা পরবর্তীকালে কাব্যসংগীতের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ষোলো বছর। এই সময় তিনি বহু গান লিখেছেন ব্যক্তিগত অনুভূতির তুচ্ছ উপলক্ষ থেকে। স্ত্রী-বিয়োগের পর হাসির গান কিংবা প্রেমের গান তিনি আর লেখেননি।

দ্বিজেন্দ্রলালের কাব্যসংগীতগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার দৃপ্তভঙ্গি, আবেগ এবং সুরবিস্তারের সহজ, সুন্দর, স্বাভাবিক একটি রূপ। প্রেমের উচ্ছলতা, আবেগ আর সুরের বৈচিত্র্যে অসাধারণ একটি গানের নমুনা এরকম, –

এসো এসো বঁধু বাঁধি বাহুডোরে, এসো বুকে ক’রে রাখি।

বুকে ধরে মোর আধ ঘুম ঘোরে সুখে ভোর হ’য়ে থাকি।

মুছে থাক চোখে এ নিখিল সব,

প্রাণে প্রাণে আজ করি অনুভব

মিলিত হৃদির মৃদু গীতিরব – আধ নিমীলিত আঁখি।

বহুক বাহিরে পবন বেগে,

করুক গর্জ্জন অশনি মেঘে,

রবি শশী তারা হ’য়ে যাক্ হারা, অাঁধারে ফেলুক ঢাকি।

আমি তোমার বঁধু, তুমি আমার বঁধু, এই শুধু নিয়ে থাকি,

বিশ্ব হ’তে সব লুপ্ত হ’য়ে যাক আর যা রহিল বাকি।

প্রেমের উচ্ছ্বাস, আবেগ কত প্রাণবন্ত হলে এমন অনুভূতি প্রকাশ করা যায় গানটি তার একটি উদাহরণ। ভৈরবী রাগে চতুর্মাত্রিক ছন্দে বাঁধা গানটিতে তানের যে-ব্যবহার তাতেও আছে অভিনবত্ব। গানের বাণী, সুরের প্রয়োগ থেকে সুরস্রষ্টা হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলালকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। পিতার গান প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায় বলেছিলেন – তাঁর মধ্যে আছে সুরের আগুন আর গানের গোলাপ। গান গোলাপ হয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর প্রেমের গানে। প্রেমের গানে তাঁর প্রতিভা নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল। সুর ও বাণীর মিলনই শুধু নয়, ‘গানগুলির মধ্যে কবির প্রতিভা, ছান্দসিকের ছন্দকুশলতা ও প্রেমিকের আন্তরিকতার ত্রিবেণীসঙ্গম হয়েছে।’ তাঁর স্বদেশি গানে আছে তেজোদীপ্ত উদ্দীপনা আর অন্তর্মগ্ন প্রেম-ভাবনার গানগুলিতে বিষাদের সুরের ছোঁয়া মনে একরকম মধুর কারুণ্যের সঞ্চার করে। তাঁর প্রেমের গানে যেন কোনো ‘প্রেমিক হৃদয়ের তৃষিত অন্তর ব্যথা’ লেগে আছে। প্রসঙ্গত তাঁর এরকম কিছু গানের কথা মনে আসে : ১. তুমি বাঁধিয়ে কী দিয়ে রেখেছ হৃদি এ, ২. এ জীবনে পূরিল না সাধ ভালোবাসি, ৩. সারা সকালটি বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি, ৪. আজি তোমার কাছে ভাসিয়া যায়, ৫. যাও হে সুখ পাও যেখানে সেই ঠাঁই।

এসব গানে আবেগের সঙ্গে টপ খেয়ালের বিস্তারধর্মী চরিত্র সমন্বয়ে স্নিগ্ধ এবং মর্মস্পর্শী আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে।

পিতার কণ্ঠে হিন্দুস্তানি সংগীত শুনে বড় হওয়া দ্বিজেন্দ্রলালের জন্য স্বাভাবিক ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। বিলাতে পড়তে গিয়ে অর্থ ব্যয় করে পাশ্চাত্য সংগীত শিখলেন। সেই অভিজ্ঞতাকে দক্ষতার সঙ্গে বাংলা গানে প্রয়োগ করলেন, তৎকালীন শ্রোতা সমাদরে সে-সংগীত গ্রহণ করেছিল। একজন সংগীতস্রষ্টার জন্য সব থেকে প্রয়োজনীয় হলো তাঁর নিজস্ব প্রকাশশৈলী খুঁজে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের জন্য ধ্রুপদকে বেছে নিয়েছিলেন, অতুলপ্রসাদ তাঁর গানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন উত্তর ভারতের ‘লচা’ ঠুংরির ধরন। মুঙ্গেরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানের জন্য সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারেননি। মুঙ্গেরে প্রখ্যাত খেয়ালিয়া সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে তিনি তাঁর সংগীতের উপযোগী সঠিক ঘরানা বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। নিয়মমাফিক তালিমের অভাবে তাঁর মধ্যে ভারতীয় সংগীতের ব্যাকরণগত দিকগুলি যেমন রাগ-রাগিণী, বিশুদ্ধ তাল-লয় জ্ঞান, টেকনিকে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার তাঁকে ভারতীয় সংগীতের বিশুদ্ধতা এবং গভীর অন্তর্মুখী চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শুরু হয় সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কাছে তাঁর ভারতীয় মার্গ সংগীতের শিক্ষাগ্রহণ। বাংলা গানে নিজের গায়কি এবং ঘরানা বেছে নিতে সুরেন্দ্রনাথই তাঁকে পথ দেখিয়ে দেন। মুঙ্গেরে সুরেন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে রাগের মিশ্রণে হয়ে উঠলেন দক্ষ, গায়নপদ্ধতিতে নমনীয়তার সঙ্গে দৃঢ়তার সহজ এবং সুন্দর সমন্বয় ঘটালেন। আর্যগাথা দ্বিতীয় খন্ড এই সময়েই তিনি প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় খন্ডের গানগুলি ছিল অনেক পরিণত, আকারে ছোট এবং গীতিধর্মী। গানগুলিতে রাগ ও তালের উল্লেখও নির্দিষ্টভাবে করা ছিল। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রসিদ্ধ গায়ক সুরেন্দ্রনাথের খেয়াল বা টপ খেয়াল যারা শুনেছেন তাদের মতে, তাঁর গান ছিল অদ্বিতীয় এক সৃষ্টি যা শুনলে সম্মোহিত হতে হতো। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর বাংলা গানে টপ খেয়ালের প্রয়োগ ঘটিয়ে সুরে নতুনত্ব এবং বৈচিত্র্য নিয়ে এলেন। টপ খেয়ালে নিবদ্ধ তাঁর গানগুলি হয়ে উঠল অনবদ্য এক সৃষ্টি। টপ খেয়ালের মাঝে টপ্পার সম্পর্কের কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে আসতে পারে। টপ খেয়ালের বৈশিষ্ট্য হলো, এ-গানে কোনো তীব্র উচ্চকিত তালের ব্যবহার নেই, টানা একটা সুরের চলন চলতে থাকে, সঙ্গে থাকে সাত মাত্রার যৎ তাল, পরতে পরতে টপ্পার দানার সঙ্গে মিশে প্রাণে মধুর এক কারুণ্যের সৃষ্টি করে। আত্মপ্রকাশের জন্য টপ খেয়ালের বিস্তারধর্মী চরিত্র ক্রমশ দ্বিজেন্দ্রলালের জন্য হয়ে ওঠে অপরিহার্য। বাণী এবং সুরের সম্মিলনে তাঁর এমনই একটি প্রেমসংগীত হলো –

মলয় আসিয়া ক’য়ে গেছে কানে, প্রিয়তম তুমি আসিবে।

মম তৃষিত অন্তর ব্যথা সযতনে তুমি নাশিবে।

রবি শশী তারা সুনীল আকাশ,

সকলে দিয়েছে তোমার আভাস,

গোপনে হৃদয়ে করেছে প্রকাশ, তুমি এসে ভাল বাসিবে।

মম মর্ম মুকুরে দূর হ’তে সখা পড়েছে তোমার ছায়া,

সেথা অন্তরলোকে প্রেমপুলকে গড়েছি স্বপন কায়া।

আমার সকল চিত্ত প্রণয়ে বিকশি,

তোমার লাগিয়া উঠেছে উছসি,

কবে তুমি আসি অধর পরশি, মুখপানে চেয়ে হাসিবে।

এ-গানে আবেগের সঙ্গে মিশেছে টপ খেয়ালের বিস্তারধর্মী চরিত্র এবং তাতে স্নিগ্ধ এবং মর্মস্পর্শী আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। গানটি নটমল্লার রাগে এবং যৎ তালে নিবদ্ধ। গানটির একটি তালফেরতা ক্রিমাত্রিক রূপও আছে। যে-বৈশিষ্ট্যটি তাঁর গানকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে রাখে সেটি হলো আবেগ। ‘মলয় আসিয়া ক’য়ে গেছে কানে’ – গানটির আরোহণে বিস্তারধর্মিতার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব কত সহজ দক্ষতায় প্রয়োগ করা হয়েছে তার একটি অনুপম নিদর্শন এ-গানটি। তাঁর গানকে অন্য সবার সৃষ্টি থেকে আলাদা করে রাখে যে-বৈশিষ্ট্য, আগেই  বলেছি, সেটি হলো আবেগ। স্নিগ্ধ, মনকে নাড়া দেওয়া এক আকুলতা এ-গানের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে ছড়িয়ে আছে। এই বৈশিষ্ট্যেই তাঁর গানকে অন্য সবার সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। এমনই আরো একটি গান –

তুমি, বাঁধিয়ে কি দিয়ে রেখেছ হৃদি এ

(আমি) পারি না যে যেতে ছাড়ায়ে

এ যে বিচিত্র নিগূঢ় নিগড় মধুর –

(কী) প্রিয় বাঞ্ছিত কারা এ।

বেহাগ খাম্বাজে বাঁধা এ-গানে বিস্তারধর্মী কারুকাজ সূক্ষ্ম টপ্পার দানার সঙ্গে মিশে সুরের যে অপার্থিব আবহ সৃষ্টি করে, দক্ষ শিল্পীর কণ্ঠে শুনলে তার আবেদন হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আছড়ে পড়ে। টপ্পার দানার সূক্ষ্ম, শিল্পিত কারুকাজে, মীড়বহুল বিস্তারধর্মিতায়           এ-গান স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মনকে ছুঁয়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রিয় রাগ ছিল ভৈরবী, ইমন, বেহাগ, বাগেশ্রী, খাম্বাজ ও ঝিঁঝিট। তাঁর স্বদেশি গান এবং হাসির গানে যেভাবে বিদেশি স্বরপ্রয়োগ ও সুরকাঠামোর মিশ্রণ ঘটেছে, প্রেমসংগীতগুলি তা থেকে একেবারে মুক্ত বলা যায়। একই গানের গায়ন-পদ্ধতিতে তিনি নমনীয়তার সঙ্গে দৃপ্ত ভঙ্গির সমন্বয় সাধন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। স্নিগ্ধ কোমল মনকে ছুঁয়ে যাওয়া আকুলতা অন্য সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে তাঁর গানকে। প্রেমসংগীতে এবং ভক্তিগীতিগুলিতে এই ভাব অনন্য ভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা একান্তই তাঁর নিজস্ব গায়নভঙ্গি। আরো একটি গানের কথা মনে পড়ছে। আর্যগাথা দ্বিতীয় খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল গানটি। মনে করা হয় বিদেশিনী প্রেমিকার স্মৃতিতে গানটি লিখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। গানটির একটি পাঠান্তরও আছে। টপ খেয়ালে নিবদ্ধ গানটি আমার অসম্ভব ভালোলাগার একটি গান, একসময় বারবার গেয়েছি, গানটির প্রচলিত সম্পূর্ণ পাঠটি উদ্ধৃত করছি –

আজি তোমার কাছে

ভাসিয়া যায় অন্তর আমার

আজি সহসা ঝরিল :

চোখে কেন বারিধার?

স্মৃতি-জোয়ারে দু’-কূল ছেয়ে,

দশ বরষ উজান বেয়ে

চলেছে প্রাণ তোমারই কাছে

মানে না বাধা আর।

 

আজি আমার কাছে

বর্তমান ভেঙে ও ভেসে যায়,

আজি আমার কাছে

অতীত হয় নূতন পুনরায়।

আজি আমার নয়ন পাশে,

এ কি অাঁধার ঘেরিয়া আসে,

আজি পাষাণ – ভার চাপিয়া ধরে

হৃদয়ে বারেবার।

 

গানটি রচনার উপলক্ষ মৃত পত্নী অথবা বিদেশিনী প্রেমিকার স্মৃতি এ-বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও গভীর এক স্মৃতিকাতরতা গানটি রচনার সময় কবিকে যে আকুল করেছিল গানের বাণী সেই সত্যের স্মারক হয়ে আছে। সঞ্চারীতে বর্তমানের অর্থহীনতা, অতীতের স্মৃতিময়তা নূতন হয়ে ফিরে এসেছে কবির কাছে। শেষ অন্তরায় একাকী জীবনের অন্ধকার অস্তিত্ব পাষাণভার সমতুল্য মনে হয়েছে তাঁর কাছে। গানটি দুঃখের গান, লোকের গান। ঝিঁঝিট রাগে নিবদ্ধ গানটিতে টপ্পার যে সূক্ষ্ম কারুকাজ একজন দক্ষ শিল্পীর পক্ষেই কেবল তার শিল্পিত প্রকাশ সম্ভব। প্রেমের গানে মীড়বহুল বিস্তারধর্মিতা, টপ্পার সূক্ষ্ম কাজ, ধীরগতির তাল ও লয় তাঁর এই গানগুলিকে করেছে অনন্য এবং একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। গান রচনায় তাঁর প্রতিভা সব থেকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো তাঁর গানের কিছু কথা কানে এসে বাধে। সুরে বাঁধা যায় না এমন কথাকে তিনি সহজেই গানে বসিয়েছেন। যেমন এই গানটিরই সঞ্চারীর অংশটি –

আজি আমার কাছে বর্তমান ভেঙে ও ভেসে যায়,

আজি আমার কাছে অতীত হয় নূতন পুনরায়।

গানের বাণীর কবিত্বের ঘাটতিকে তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন সুরের আশ্চর্য জাদুতে। মনের একই ভাবনাকে একাধিক রূপ দিয়েছেন। এ থেকেও মনে হয় গানের কবিত্বের দিকের চেয়েও সুরের দিকটিই তাঁর কাছে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর গানের কোনো কোনো অংশে ভাব ও সুরের বৈচিত্র্য চমকে দেয়। যেমন ‘মলয় আসিয়া ক’য়ে গেছে কানে’ প্রেমের গান। এ-গানের শেষ অংশে বিলাতি সুরের প্রয়োগ বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাঁর অনেক স্বদেশি গানে, প্রেমের গানেও সুর প্রয়োগের ধরনটি এরকম, – বিলাতি গানের ধরনে ক্রমশ টেম্পো উঠতে থাকে এবং গানের ভাব অনুযায়ী সুর চরম পর্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। এসবই বাংলা গানের দ্বিজেন্দ্রলালের অবদান। বাংলা গানে বিলাতি সুরের প্রয়োগ দ্বিজেন্দ্রলাল জীবনভর এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁর গানে সে নূতন ঢং এবং সুরের সৃষ্টি তিনি করে গেছেন সে-সুর তাঁর অবচেতনে দেশি এবং বিলাতি সুরের নিবিড় মিলনে সৃষ্ট।

অধিকাংশ মানুষই দ্বিজেন্দ্রলালকে হাসির গান এবং স্বদেশি সংগীত-রচয়িতা হিসেবেই জানেন। গানের জগতে তাঁর প্রথম আবির্ভাব হাসির গানের রচয়িতা হিসেবে। হাসির গানে তিনি যে বিলাতি সুরের প্রয়োগ করেছেন তার যথার্থ স্বরূপ বুঝতে গেলে বিলাতি গান সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ, অনুরাগ ও প্রয়াসকে ভালো করে জানতে হবে। তাত্ত্বিক কোনো ধ্যান-ধারণার মনোভাব থেকে তিনি তাঁর গানে বিলাতি সুরের ব্যবহার করেননি। যদিও তাঁর হাসির গানের বিষয় ছিল সোশ্যাল স্যাটায়ার। বিলাত থেকে ফিরে তিনি গান রচনা শুরু করেছিলেন প্রধানত শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের কথা মাথায় রেখেই। হাসির গান গাইতে হবে, লোককে হাসাতে হবে এই চিন্তা মাথায় রেখেই তিনি হাসির গানে বিলাতি গানের সুর প্রয়োগ করেছিলেন।

প্রথমেই বলেছি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিষয়ে আমাদের জানার সীমাবদ্ধতা এতটাই সংকীর্ণ যে, তা দিয়ে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা অন্তত আমার জন্য দুঃসাহস ছাড়া কিছু নয়। জীবন আর গান বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তার ওপর যদি তিনি হন দ্বিজেন্দ্রলালের মতো মানুষ, একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার এবং শিল্পী। স্বভাবে নির্জনতাপ্রিয়, প্রকৃতিপ্রেমী, নিঃসঙ্গ, একজন মানুষের জন্য সংগীত যে হবে তাঁর আত্মপ্রকাশের উৎস, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ব্যক্তি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জীবনে কতটা সংগঠিত, পরিকল্পিত জীবনবোধের অধিকারী ছিলেন তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। নতুন গান সৃষ্টির তাৎক্ষণিক আনন্দে মেতে উঠে পরক্ষণেই সে-গানের কথা কি তিনি বিস্মৃত হতেন! কেন তাঁর পাঁচ শতাধিক গানের মধ্যে এক শতাধিক গানের এক-চতুর্থাংশও স্বরলিপিবদ্ধ হলো না! অতুল প্রসাদ সারাজীবনে মাত্র দুশো আটখানি গান লিখেছিলেন, তিনি যতখানি স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তার ধারেকাছেও দ্বিজেন্দ্রলাল কেন যেতে পারলেন না! তবে কি তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি কোনো মমতা ছিল না? যদি তা থাকতো তবে তিনি নিশ্চয় তাঁর সেরা সৃষ্টি তাঁর গানের স্বরলিপি প্রণয়নে, সংরক্ষণে এবং প্রচারে সচেষ্ট হতেন। জীবনের শেষ দশ বছরের সমস্ত সৃষ্টিশীল প্রয়াস কেন্দ্রীভূত হলো নাটক এবং নাটকের গানে। ষোলো বছরের বিবাহিত জীবন, নিবিড় প্রেম আর আবেগের উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ ছিল, প্রেমের গান রচনার যে-জোয়ার এসেছিল তখন, স্ত্রী সুরবালা দেবীর মৃত্যুর পর তা স্তব্ধ হয়ে গেল। কেন যেন মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর নিজেরই চারিত্রিক অসংগতি, সিদ্ধান্তহীনতা এবং ব্যক্তিজীবনের নৈরাশ্য। তাঁর গান যতই আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে থাক, বাঙালি-হৃদয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল আজো অবহেলিত, উপেক্ষিত হয়েই আছেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের গান বিষয়ে লিখতে গেলে তাঁর কীর্তিমান পুত্র দিলীপকুমার রায়ের নামটি অনিবার্যভাবে এসে যায়। গভীর সংগীতবোধ এবং অধিকাংশ দ্বিজেন্দ্রগীতিকে তাঁর সংগীতবিবেক দিয়ে পুনর্বিন্যস্ত করে বারবার গেয়ে শুনিয়ে প্রায় বিস্মৃত দ্বিজেন্দ্রগীতি সম্ভারকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিল্পী এবং শ্রোতাদের জন্য অসাধারণ একটি কাজ করে গেছেন। নানা পর্যায়ের গান নিয়ে ছিয়াত্তরটি গানের স্বরলিপি করে গ্রন্থাকারে তিনি প্রকাশ করেন। পিতার বত্রিশটি হাসির গানেরও স্বরলিপি করে ছেপেছেন তিনি। দ্বিজেন্দ্রলালের গানে ওজস্বিতা, দৃপ্তভঙ্গি, আবেগ, সুর বিস্তারের পদ্ধতি কত সহজ, স্বাভাবিক ও সুন্দর, আবার এটাও সত্য, এ-গান গাওয়া সহজ নয়। মাঝারিমাপের মামুলি গায়নভঙ্গির গান দ্বিজেন্দ্রগীতি নয়, দ্বিজেন্দ্রলালের গানের যথার্থ আবেদন শুধু দরাজ, সুরেলা, খোলামেলা কণ্ঠেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তিনি এমন কিছু জিনিস আমাদের সংগীতে দিয়ে গেছেন যা আর কোনো সংগীত রচয়িতার কাছে পাওয়া যাবে না। বাংলার সংগীতকে জানতে হলে তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের জানা সম্পূর্ণ হবে না।

তাঁর গান নিয়ে যেটুকু লিখলাম না –  লেখা রয়ে গেল প্রায় সবটাই। সে আমার অসমর্থতা। দ্বিজেন্দ্রগীতি সম্পর্কে আমাদের জানার কথা সহজে শেষ হওয়ার নয়, কারণ বাঙালি এখনো তাঁর গান সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না।