দ্রোহ ও দ্রোহীর সমীকরণ

খোন্দকার আশরাফ হোসেন
বাংলা কবিতার এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ১৯২২ সালে প্রকাশিত যে-কবিতার নববই বছর পূর্ণ হচ্ছে এ-বছর। ‘বিদ্রোহী’র কোনো পূর্বসূরি নেই; বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের মধ্যে এ-কবিতার বীজ নিহিত নেই; ‘বিদ্রোহী’র সার্থক উত্তরাধিকারীও নেই। একক মহিমায়, অননুকরণযোগ্য দৃঢ়তায় একটি মনোলিথের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে কবিতাটি। ‘বিদ্রোহী’কে নিয়ে প্যারোডি করেছেন গোলাম-মোস্তফাদি গৌণ কবিরা, বিদ্রূপ করেছেন শনিবারের চিঠির, নজরুলের নিজের ভাষায়, প্রেয়সী তথা সজনীর দল। (পৃ ১৩৯) (পাঠান্তরে ১৪১) পঙ্ক্তির এই হিমশৈল এক অর্থে নজরুল মানসের একটি শনাক্তিচিহ্ন, অন্য অর্থে বাংলা কবিতায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কথিত ‘শক্তিমন্ত আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্লাবী প্রকাশে’র শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হয়ে রয়েছে। এর স্রষ্টা ধূমকেতুর মতো পুচ্ছে আগুন নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন বাংলা কবিতার অঙ্গনে এবং তাঁর আবেগ ও দ্রোহের অতিরেক তাঁকে এক দশকেই ভেতর থেকে পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছিল – ১৯৩০ সালের পর নজরুলের আত্ম-উৎসারণ
মূলত প্রেমগীতিকার কারুণ্যে। রয়ে গেছে প্রথম-পার্বিক নজরুলের দ্রোহীচেতনার উত্তুঙ্গ প্রকাশ এই ‘বিদ্রোহী’সহ অগ্নিবীণার এবং বিষের বাঁশির কিছু কবিতায়। যে-শিখর তিনি স্পর্শ করেছিলেন ১৯২২ সালের কোনো এক রাতে, তা যেন অলৌকিক মনে হয় এখন।
বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সমালোচক নানাবিধ দিক থেকে এর মূল্যমান, প্রভাব, রাজনৈতিক তাৎপর্য, এর ভাষাবিন্যাস, ছন্দ, বিষয়গৌরব নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি তার পুনরাবৃত্তি করব না। আমি বরং অন্য দুটি প্রসঙ্গে নিজেকে ব্যাপৃত করব। তার একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সঙ্গে একটি বিদেশি ও একটি বহুখ্যাত বাংলা কবিতার কিঞ্চিৎ তুলনাত্মক আলোচনা। অন্যটি হলো, নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রভাব কিংবা তাঁদের সদৃশতার বহুকথিত প্রসঙ্গ।

দুই
ইংরেজ কবি কোলরিজের নিদ্রার ভেতর রচিত হয়েছিল অনন্য এবং কূটাভাসী কবিতা ‘কুবলা খান’, যার ব্যাখ্যা আমাদের অপরিমেয় রহস্যের মধ্যে নিয়ে যায়। আরেকটি তুলনীয় স্বতঃস্ফূর্তি ও অলৌকিকতায় মোড়া সৃষ্টি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। ‘বিদ্রোহী’ এবং এই দুটি কবিতার মধ্যে কিছু সাদৃশ্য শনাক্ত করা অসম্ভব নয়। তিনটি কবিতাই তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ কবিতার লক্ষণচিহ্নিত; রোমান্টিক কল্পনা ও নব-আবিষ্কৃত প্রাণপ্রাবল্যের উদযাপনে তিন কবিই উদ্দীপিত, উচ্চকিত ও উচ্ছল। ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাস’ তিনটি কবিতাতেই সহসা উৎক্ষিপ্ত, ভূগর্ভ থেকে মুক্তি পাওয়া উন্মত্ত স্রোতধারার উপমায় উপমিত হয়েছে।
And from this chasm, with ceaseless turmoil seething,
As if this earth in fast thick pants were breathing,
A mighty fountain momently was forced :
Amid whose swift half-intermitted burst
Huge fragments vaulted like rebounding hail,
Or chaffy grain beneath the thresher’s flail :
And ‘mid these dancing rocks at once and ever
It flung up momently the sacred river.
রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’ একইভাবে অস্তিত্বের গিরিকন্দর থেকে শৈলকাঠিন্য বিস্ফারিত করে প্রবহমান হচ্ছে সৃষ্টির ঝর্ণাধারা :
ওরে উথলি উঠিছে বারি
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
থরথর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
আর নজরুলের বিদ্রোহীও এক পর্যায়ে নিজেকে বর্ণনা করে এভাবে :
আমি প্রভঞ্জনের উল্লাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,…
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল্!
… … …
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায়ও ‘huge fragments vaulted like rebounding hail’ উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে আত্মতার সংজ্ঞামূলক শব্দরাশি – বিশাল পাথরের চাঁই যেন এক-একটা, ‘শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসি’ আর দারুণ রোষে গর্জমান ফেনিল জলোচ্ছ্বাস আঘাত করে পাঠকের কানে, ক্রমাগত, ক্রমাগত। মূলত রুদ্ধশ্বাস হয়ে যেতে হয় পাঠককে, অগ্নিগিরির সধূম উদ্গিরণে যেন, এবং শেষ পঙ্ক্তিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত ওই শব্দরাশি তাকে ঘূর্ণিত, মথিত, চিৎকৃত, স্তম্ভিত, বিস্রস্ত ও বিপর্যস্ত করতে থাকে। অনুপ্রাসসংবলিত ছন্দোময় পঙ্ক্তিরাশির দ্রুত ছুটে চলার সঙ্গে পা মেলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে শিথিল বাক্যবন্ধে অভ্যস্ত বাঙালি পাঠকের : তাস-পাশা খেলা তৈলচিক্কণ শরীরের অলস বাঙালি পাঠককে আরবি তাজী ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করিয়ে পশ্চাতে চাবুক মেরে ছেড়ে দেন নজরুল ইসলাম :
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ-মর্ত্য করতলে,
তাজী বোর্রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি’ ভূমিকম্প।
বাংলা কবিতায় কেন, বিশ্বকবিতায়ও এ-কবিতার জুড়ি মিলবে না। রোমান্টিকের আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে অবশ্যম্ভাবীভাবে থাকে আত্মম্ভরিতাও, নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে, কিংবা একইরকম ধীমান ও প্রচন্ড শয়তানের সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো কোনো কবি; বোদলেয়ারের বিষণ্ণ প্রতীতি, কিংবা হুইটম্যানের বিশ্বাতিক্রমী আত্মসংজ্ঞায়ন কিংবা র্যাঁবোর আর্তচিৎকার – সর্বত্র ব্যক্তির আত্মতা মহামহিম। হুইটম্যানের কথায় একটু পরে আসছি। আপাতত দেখি, আরো কাছের একজন কবি নিজেকে ঘোষণা করছেন অতিবিস্তারিত আত্মতার প্রতিভূ হিসেবে :
আমিহীন বিশ্ব নেই, চরাচরে আমিই বিম্বিত
প্রকৃতি ও কাল শুধু নটনটী, আমি নাট্যকার
এবং দ্রষ্টাও আমি।
এই কবি হলেন বুদ্ধদেব বসু।

কবিতা তিনটির পার্থক্যও অবশ্য বিরাট। উচ্ছলতার প্রাচুর্য শমিত হয়ে যায় কোলরিজ যখন হিমগর্ভ গুহা ও রৌদ্র-ঝলসিত গম্বুজের সমীকরণে স্থিত হন, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন কবির দ্রষ্টারূপকে – তাঁর সহসা উৎক্ষিপ্ত ঝর্ণধারা অবশেষে ‘five miles meandering with a mazy motion’ মৃত্যুর ‘sunless sea’-তে নিরাকৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরও সমুদ্রসন্ধানী : প্রচন্ড শরীরী আক্ষেপের মধ্যে তার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত বিস্তারী সাগরের মধ্যে তারও নির্বাণ :
আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে কোন্ দেশ –
জগতে ঢালিব প্রাণ,
গাহিব করুণা গান,
উদ্বেগ অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে-প্রাণ মিশাব আর সে-গান করিব শেষ।
কিন্তু নজরুলের বিদ্রোহী আদি-মধ্য-অন্তহীন; কোন যুক্তিপরম্পরা, তথা যেহেতু-সুতরাংয়ের রৈখিকতায় প্রলম্বিত নয়; সৃষ্টিবৈরী মহাত্রাস শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রলয়নাচন নেচে যান, যদিও বলেন অনাগত ভবিষ্যতের কথা, যখন তিনি সমাপ্তি টানবেন তাঁর প্রলয় উল্লাসের, ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না -।’ প্রথম থেকে শেষ পঙ্ক্তি পর্যন্ত মহাসাগরের নির্ঘোষ শোনা যায় : ছুটন্ত, ঘূর্ণ্যমান, প্রজ্বলিত, যে-উচ্ছ্বাসের বন্যা তার সবটাই অবশ্য বিধ্বংসী নয়; তার মধ্যে স্বরের উত্থান-পতন আছে, কাঠিন্য ও কারুণ্যের আবর্তন আছে। বিটোফেনের নবম সিম্ফনি যারা শুনেছেন, তারা সহজেই বিদ্রোহীকে তুলিত করতে পারবেন ওই মহাসংগীতের উচ্চাবচ স্বরগ্রামের উন্মন্থন ও ঘূর্ণির সঙ্গে। ‘বিদ্রোহী’ একটি প্রচন্ড নিনাদিত অর্কেস্ট্রা, যার ভেতরে ড্রামবাদ্যের দ্রিমিকি-দ্রিমিকির মধ্যে শোনা যায় বাঁশির করুণ মূর্ছনাও; কিন্তু সব স্বরই একসময় দ্রবীভূত হয়ে যায় উচ্চকণ্ঠের কলরোলের মধ্যে।

তিন
‘বিদ্রোহী’ কবিতার শরীর ১২টি পর্ব এবং একটি প্রান্তিক রাইমিং কাপলেট দ্বারা গঠিত বলে ধারণা হয়। বিভিন্ন গ্রন্থে মুদ্রাকরের খেয়ালখুশিতে পর্বসীমানার হেরফের যে ঘটেনি তা নয়। আমার বিবেচনামতো দ্বাদশ পর্বের প্রারম্ভ-পঙ্ক্তিগুলি নিচে সাজাচ্ছি :
১. বল বীর -/ বল উন্নত মম শির
২. আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত নৃশংস
৩. আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি
৪. আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ
৫. আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস
৬. আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি
৭. আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
৮. আমি, অর্ফিয়াসের বাঁশরী
৯. আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা
১০. আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়
১১. আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
১২. আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবানবুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!
এবং প্রান্তিক সমিল যুগ্ম-পঙ্ক্তি :
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।

পর্ব-একে বীরের প্রতি নির্দেশনা – ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক-দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ তাঁর যে-সমুদ্ধত উত্থান সেটি ঘোষণা করার। এই প্রারম্ভিক ঘোষণার দর্পিত অহং-ই পরবর্তী পর্বগুলোতে নানা লয়ে, নান ভঙ্গিতে দ্যোতিত হয়েছে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে নজরুলের উচ্চারণ সাদৃশ্যও মূলত এই প্রথম পর্বকে ঘিরে। হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেলফ’ রোমান্টিক আত্মতার স্পর্ধিত ঘোষণা নয় নজরুলের মতো; বরং সেখানে প্রশান্ত আত্মবিশ্বাস মরমি মানসের বিশ্বাতিক্রমী ক্ষুৎপিপাসার আবরণে প্রকাশিত হয়েছে। হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেলফে’র সঙ্গে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র তুলনা বহুদূরগামী হয় না। হুইটম্যান মূলত ঋষি; তাঁর বিশ্বদর্শনের সঙ্গে বরং রবীন্দ্রনাথের মিল বেশি। আকাশ-ভরা-সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণের মাঝখানে স্থান পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো হুইটম্যানের প্রাণও বিস্ময়ে জাগ্রত; কিন্তু হুইটম্যান সেখানে না থেমে বিশাল-বিপুল গ্রাসে মহাবিশ্বকেও আত্মস্থ করতে চান; তাঁর সেলফ অন্তহীন সময় ও গ্যালাক্সির নিত্যভ্রাম্যমাণ চক্রসমূহকে শোষণ করে নিতে উদগ্রীব। কালকে তিনি নিরন্তর পরিক্রমণের পৈঠা হিসেবে ব্যবহার করে দাঁড়িয়ে থাকেন :
My feet strike an apex of the apices of the stairs,
On every step bunches of ages, and larger bunches between the steps,
All below duly travel’d, and still I mount and mount.
… … …
Immense have been the preparations for me…
Cycles ferried my cradle, rowing and rowing like cheerful boatmen,
For room to me stars kept aside in their own rings,
They sent influences to look after what was to hold me.
‘বিদ্রোহী’র প্রথম পর্বে হুইটম্যানের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোর অনুরণন অবশ্যই শ্রবণের অগোচর থাকে না; নজরুলও ভূলোক-দ্যুলোক-গোলক ভেদ করে, সৃষ্টিকর্তার আসন ছিন্নভিন্ন করে বিশ্ববিধাত্রীর চিরবিস্ময়রূপে মাথা ওঠাতে চান। কিন্তু এই সাদৃশ্যের অন্ত এখানেই। হুইটম্যানের বিশ্বাতিক্রমী শিরোত্তোলনের মধ্যে বিদ্রোহীর আস্ফালন ও ক্ষণিক অহংতৃপ্তি নেই, আছে প্রশান্ত আত্মউপলব্ধি। সুফিরা যে-আত্মউপলব্ধির মুহূর্তে নিজেকে বিস্তৃত-প্রসৃত করে একসময় সৃষ্টিকর্তার প্রতিস্পর্ধী হয়ে বলে ওঠেন, ‘আনাল হাক্ক!’। বলা বাহুল্য, নজরুল হুইটম্যানের মতো মিস্টিসিজমে পরহেজগার নন (অন্তত এ-পর্যায়ে); সৃষ্টি-পালন-ক্ষয়ের মহাচক্রকে নিজের নাভিকেন্দ্রে ঘূর্ণ্যমান দেখার পরম সাহসিকতা তাঁর আরাধ্যও ছিল না, সাধ্যও ছিল না। কিন্তু নজরুল অবলীলায় সেই মরমি সাহসিকতার শব্দাবলিই ব্যবহার করছেন, এদের গূঢ় তাৎপর্যের কথা না ভেবেই : ‘আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,/ আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়…/ জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য…’
হুইটম্যানের ভেতরে কেউ কেউ বাইবেলের আইজায়া কিংবা ঈজিকিয়েলের মতো পয়গম্বরের ছায়া দেখতে পান; নজরুল ইসলামকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কোনো পয়গম্বরসুলভ আলখাল্লায় আবৃত দেখি না। তাঁকে বরং মনে হয় বিষ্ণুর শেষাবতারের মতো, যিনি ‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায়চ দুষ্কৃতাং’ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্তত বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বরে অ্যাপোক্যালিপ্সের বজ্রনিনাদ :
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড।

পর্ব দুইয়ে বিদ্রোহী নিজেকে তুলিত করছেন শিবের সঙ্গে, তিনি মহাপ্রলয়ের নটরাজ, তিনি মহাভয়, অভিশাপ পৃথ্বীর। তিনি ভেঙে সবকিছু চুরমার করেন এবং দলে যান যত নিয়ম-কানুন শৃঙ্খল। তাঁর এই বিধ্বংসী রূপ প্রথম পর্বেরই বিস্তারণ। কিন্তু তৃতীয় পর্বে এসে যেন দোলা লাগল মুক্ত জীবনানন্দের – ধ্বংসপরায়ণ নটরাজের প্রলয়ঘূর্ণির মধ্যে যেন জেগে উঠছে ললিতবিভঙ্গের মুদ্রা : ‘আমি চলচঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’/ পথ যেতে যেতে চকিতে চমকি’/ ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!/ আমি চপলা-চপল হিন্দোল।’ ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে এখন বরং স্বেচ্ছাচারের অমিত আনন্দ তাঁকে বেশি উচ্ছ্বসিত করে। গ্রিক দেবতা ডায়ানিসাসের উদ্বাহু উন্মত্ততা তাঁকে শত্রুর সঙ্গে গলাগলিতে যেমন উদ্বুদ্ধ করে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা-লড়া বীরত্বাভাসী মহিমাও দান করে। সমগ্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিই অবশ্য ডায়ানিজিয়ান প্রাণপ্রাবল্যের অমিত উচ্ছ্বাসে কম্পমান। অচিরেই, অর্থাৎ চতুর্থ পর্বেই সামনে আসে বাক্কাসের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে সংশ্লিষ্ট মদিরাকাঙ্ক্ষাও : ‘আমি দুর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম্ ভরপুর মদ।’ এর কয়েক পঙ্ক্তি পরেই বিদ্রোহীর অবাক উত্তরণ দ্বিধাখন্ডিত, আপাতবিরোধী, কিন্তু মনোহর আত্মসংজ্ঞায়নে : ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য!’ বোঝা যায়, বিদ্রোহী তার ঐকিক ধ্বংসবিলাস থেকে সরে এসে ডায়ালজিক অবস্থানে স্থিত হয়েছে, ধ্বংস এবং নির্মাণ এখন তার দুই করাঙ্গুলে ধৃত। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে পরের পর্বেই সে ফিরে যাচ্ছে ঐকান্তিক ধ্বংসপ্রিয়তায়। প্রাণখোলা হাসি উল্লাস কিংবা কভু প্রশান্ত হওয়ার বিবৃতিও ‘সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাসের’ ক্রোধকে শমিত করে না। তবু পর্বশেষে ‘উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল – ঊর্মির হিন্দোল্-দোল্ আবার আমাদের পর্বান্তরের জন্য প্রস্ত্তত করে নেয় যেনবা।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার, আমার মতে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছয় নং পর্ব, যার শুরু ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি’ দিয়ে। দ্রোহের তূর্যবাদনের মধ্যে হঠাৎ যেন লঘু সুরের টুংটাং এবং একটু পরেই করুণ বেহালার ছড়ের টান।
বিদ্রোহীর দানব-মুখোশের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে মানবিক মুখ, তার প্রেম, বেদনাবোধ, বঞ্চনার জ্বালা, বৈরাগ্য, ঔদাস্যসহ অন্য আরেক রূপ।
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ
আমি হুতাশীর।
এই স্তবকেই লক্ষ করি নজরুলের ছন্দকুশলতার পরম উদ্ভাসন অবিস্মরণীয়ভাবে শরীরী এবং ইন্দ্রিয়ঘন পঙ্ক্তিটি : ‘চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!’ কিছু হৃৎনিবিড় এবং চিত্ররূপময় বর্ণনা এই স্তবকের সম্পদ : ‘গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি’, ‘চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কন-কন’ থেকে ‘যৌবন-ভীতু পল্লীবালার অাঁচর কাঁচলি নিচোর’ পেরিয়ে ‘পথিক কবির গভীর রাগিনী’ পর্যন্ত আমরা শান্তরসের গীতিময়তা ও শ্যামলিম ছায়াছবির স্নিগ্ধতার ভেতরে আবর্তিত হতে থাকি। আর ঠিক শেষ দুই পঙ্ক্তিতে এসে প্রমত্ত ডায়ানিসাসের প্রবল ঝাঁকুনি এবং টান আমাদেরকে আবার মহাশূন্যে তুলে আছড়ে ফেলে, দেখি বিদ্রোহীর আদি এবং অভ্রান্ত রূপ : ‘আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!/ আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’
গতিকে নজরুল ইসলাম দর্শনীয়ভাবে ব্যবহার করেছেন বিদ্রোহী কবিতায়। গতির এরকম দুর্দমনীয় অভিক্ষেপ ও দ্রুতি সম্ভবত আমরা দেখি সংগীতে এবং কখনো কখনো চিত্রশিল্পীর ব্রাশের দুর্দান্ত স্ট্রোকে। কবিতায়, শুধুমাত্র ধ্বনি দিয়ে সৃষ্ট গতির এরকম প্রবল ও বিধ্বংসী, নজরুলের ভাষায় ‘উচ্চৈঃশ্রবার হিম্মত হ্রেষা’ আর কখনো শোনা যায়নি। বাংলা কবিতায় তো নয়ই, বিশ্বকবিতার যতটুকু জানা, কোথাও এর জুড়ি নেই। অষ্টম পর্বে একই গতিময়তার উদযাপন : ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া/ স্বর্গ-মর্ত্য করতলে’ এবং ‘আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ’। ৯-সংখ্যক পর্বে ফিরে আসে গ্রিক মিথের অর্ফিয়াস তার বাঁশি হাতে এবং বিদ্রোহীর নিখিল-অখিল কল্পনায় দ্রুত শ্যামের হাতের বাঁশরির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। আবার দৃশ্যান্তর, আবার সক্রোধ গতি। ইসলামি মিথের রূপকল্প তাজী বোর্রাক্ আর জিব্রাইলের আগুনের পাখার পর এবারকার উদ্ভাসন – ‘আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,/ ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!’ পরের পর্বেই আবার তুমুল উত্থান ভারতীয় মিথের : ‘বিষ্ণু’, ‘ছিন্নমস্তা চন্ডী’র আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।’ এ-কথা বলা প্রায় বাহুল্যই যে, আর কোনো বাঙালি কবির কবিতায় গ্রিক, আরব্য, ভারতীয় মিথের এরকম সংমিশ্রণ এবং এরকম ব্রীড়াহীন ব্যবহার লক্ষযোগ্য নয়। এর কারণ নজরুলই একমাত্র বাঙালি কবি, যিনি সাম্প্রদায়িকতার গন্ডি এবং সম্প্রদায়জনিত চিন্তনসংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন সহজাত স্বাভাবিকতায়। নজরুলের অন্যান্য কবিতার মতো ‘বিদ্রোহী’ও এ-কারণে বিস্ময়চিহ্ন ধারণ করে আছে।

আমরা এতক্ষণ দেখেছি বিদ্রোহীর দারুণ স্বেচ্ছাচার, তার চিৎপ্রাবল্যের নানা হুংকার; তার প্রবৃত্তির নানা প্রকাশ নানাভাবে। কবিতাটির প্রায় প্রান্তিক পর্বে এসে আমরা তার ভেতরে প্রথম স্বাপ্নিক আদর্শবাদের স্ফুরণ হতে দেখি। সেইসঙ্গে সপ্তম আসমানে উড্ডীন উধাও কবিতাটিকে মাটিতে নোঙর নামাতে দেখি। বিদ্রোহী কবিতার সর্বাধিক বিখ্যাত পঙ্ক্তিগুলো এবং সর্বস্বীকৃত উজ্জ্বল উচ্চারণ রেকম :
মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে
ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

কবিতাটির সমাপ্তি যদি এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ডের শান্তিমন্ত্র উচ্চারণের ঢঙে এখানেই হতো, তবে তা হয়তো তৃপ্ত করত আমাদের, কিন্তু ধ্বংস হতো কবিতাটির সৌন্দর্যের নিটোলতা। তাই নজরুল ইসলাম কবিতাটির যবনিকা টানেন বিদ্রোহীর উদাত্ত, উদগ্র, চন্ড হুংকারকে ফিরিয়ে এনে : ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবানবুকে এঁকে দেবো পদ- চিহ্ন/… আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন’ এবং অতঃপর কর্ণবিদারী খোলকরতাল আর কাংস্যনিনাদের ক্রেসেন্ডো থেকে স্বরগ্রাম নেমে আসে কিছুটা। শিরা ও শোণিতের টানটান উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে যায় এরকম স্থির প্রত্যয়ী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে :
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির। 