ধনেখালিতে একদিন

বুলবন ওসমান

 আচ্ছা, সাহানার বর্তমান চেহারাটা কেমন হবে? কিছুতে মিলিয়ে উঠতে পারে না ফজল। ওকে শেষ দেখেছে সেই মুক্তিযুদ্ধের কালে, ১৯৭১ সালে যখন ইয়াহিয়ার গণহত্যার তাড়া খেয়ে ওরা হুড়মুড় করে এক কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবেশ করেছিল। বড়খালার ছেলেমেয়েরা তখন প্রায় সবাই বড়। সাহানাটা সবার ছোট, স্কুলে পড়ছিল। তখন কত হবে ওর বয়স? দশ-এগারো? সন্ধ্যার পর ওদের বাসায় গেলে ও ফিক করে হেসে নিজের পড়ার ঘরে চলে যেত। শ্যামলা রং, মধ্যম-উচ্চতার পানপাতার মতো মুখ, বেশ লাজুক ছিল। মাঝে কেটে গেছে প্রায় চল্লিশটা বছর। ও কি তেমনি লাজুক আছে? নাকি তিন সন্তানের জননী এখন পাকা-গৃহিণী হয়ে উঠেছে? আলাদা করে ওর জন্যে চিন্তার একটা বড় কারণ আছে। বড়খালার ছোট ছেলে জাহান খুবই সুসামাজিক। সে-পরিবারের সবার খবর প্রায়ই দেয় ফজলকে এবং খবর নেয় একসময়ের একসঙ্গে থাকা খালাতো ভাইবোনদের – যারা এখন পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশবাসী। কয়েক মাস আগে সে একটি মর্মান্তিক খবর পরিবেশন করল : সাহানার ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তার স্বামী মৎস্য বিভাগের বড় কর্ণধার, হুগলির ধনেখালিবাসী, খুবই অমায়িক ভদ্রলোক। সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। হঠাৎ পরিবারে বিনামেঘে বজ্রপাত নেমে এলো। সাহানার ছোট ছেলেটি বেছে নিল আত্মহননের পথ। সংসারে সবকিছু যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠছে ঠিক সেই সময় ঘটল অঘটনটা। আরো বড় কথা, আজো এর কোনো কারণ জানা যায়নি। এছাড়া সাহানার বিশ্বাস, তার ছেলে এখনো মরেনি। সে যে-কোনোদিন ফিরে আসবে। এবং এটা তার দৃঢ়বিশ্বাস। কোনোমতে তাকে এই চিন্তা থেকে সরানো যায় না। ফজল বুঝতে পারে, এটা আঘাতজনিত একটা মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা। চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু বাড়ির লোক শুধু তাকে নানা রকম সান্ত্বনা দেয়। কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। এইসব কারণে সাহানার ধনেখালির বাড়িতে যাবার তার আগ্রহটা আরো প্রবল। সে হবি হিসেবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির নানা কেস নিয়ে পড়াশোনা করে। একজন শৌখিন মনস্তাত্ত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। নিজেকে সে কখনো মনোবিশেষজ্ঞ মনে করে না, কিন্তু তার পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রে খুবই কাজ দেয়, তাই অনেকে এই ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার পরামর্শ নেয়। বেশি জটিল কেসে সে বড় কোনো চিকিৎসককে দেখাতে বলে। তার জানা অনেক ডাক্তারবন্ধুও আছে, তাদের কারো একজনের নাম বলে দেয়। কলকাতায় বেশ কিছু নামি মনোবিশেষজ্ঞ আছেন। তাদের মধ্যে আছেন মহিলাও। এদের একজনের সঙ্গে এতোদিন যোগাযোগ করা উচিত ছিল। উচিত ছিল ওকে কলকাতায় নেওয়া।

ফজলের বড়খালুর পরিবারের সব সদস্য থাকে কলকাতায়। এক বিধবা বড়বোন মমতা খালা-খালু মারা যাওয়ার পর থেকে হাওড়ার খাজুরদহ গ্রামে থাকে।

ফজল প্ল্যান করে কলকাতা থেকে জাহানকে সঙ্গে নিয়ে খাজুরদহে বুবুর অতিথি হয়ে তাকেও সঙ্গে নিয়ে ধনেখালি রওনা দেবে।

প্ল্যান অনুযায়ী দুদিন পর অটো ভাড়া করে তারা তিন ভাইবোন সকাল ন’টার দিকে খাজুরদহ থেকে যাত্রা করে। বোনপোর অপঘাতে মৃত্যুর পর মমতা সাহানার কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই সে-ও সহজে রাজি হয়ে যায়।

শীতকাল। খোলা গাড়ি, কিন্তু ঝকঝকে রোদ থাকায় যাত্রা তেমন পীড়াদায়ক নয়। ভালো সর্ষে ফুল ফুটেছে মাঠে। ফুলের মিষ্টি সুবাস মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ধান কাটা হয়ে গেছে। মাঠে খেসারিকলাইয়ে ফুল ফুটেছে। বেগুনি রঙের ফুল নাকছাবির মতো। দু-একটা গাছে নতুন শুঁটিও চোখে পড়ে। ফজলের মনে পড়ে, এই খেসারিকলাই তুলে আগুন ধরিয়ে অর্ধ-সেদ্ধ খেসারি কত খেয়েছে। বাল্যের সেই দিনগুলো তাকে গৃহাভিমুখিনতায় ভোগায়। শহরে বাস করতে করতে এসব থেকে এখন বঞ্চিত। চষা মাঠের সোঁদা গন্ধ তার চিন্তাকে আরো গাঢ় করে তোলে। এমন এক বাড়িতে তারা যাচ্ছে যেখানে জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেছে।

যাত্রাপথে সবাই যার যার মনের গভীরে বিচরণরত। ফজল মমতাবুবুর কাছ থেকে সাহানার অনেকটা খবর সংগ্রহ করেছে। ও দিনের বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকে। কখনো ঘুমিয়ে, কখনো আধোঘুমে… সংসারের কাজ সবই তার স্বামী বারিক দেখাশোনা করে… বড় ছেলে আর মেয়ে যার যার চাকরি ক্ষেত্রে। একজন লিলুয়ায়, একজন বর্ধমানে। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় সমস্যা সমাধানের সুরাহা করাও মুশকিল। সাহানাকে ভালো করে স্নানাহারও করানো যায় না। সব কাজে তার অনীহা।

ধনেখালি রেলস্টেশন পার হয়ে অটো শহরে প্রবেশ করে। একটি রাস্তা সোজা শহর ফুঁড়ে চলে গেছে। দুপাশে ছোট ছোট সব বাড়ি। হুগলির মফস্বল শহরের যে-চরিত্র এখানে তার ব্যতিক্রম নেই।

ধনেখালি থানা অতিক্রমের আগে অটো বাঁয়ে বাঁক নিয়ে গাঢ় গোলাপি রঙের একতলা একটি বাড়ির সামনে থেমে গেল।

প্রবেশপথে আছে কলাপসিবল গেট। অটোর আওয়াজ পেয়ে গৃহকর্তা বারিক বেরিয়ে আসে।

সালামভাই, ফজলকে সম্বোধন করে।

সালাম।

বারিকের পেছনে সাহানা এসে দাঁড়ায়। ফজল যা ভেবেছিল তার চেয়ে সাহানাকে বিধ্বস্ত মনে হলো। শ্যামলা রং বিবর্ণ। চোখে-মুখে একটা নিস্পৃহতা। নতুন লোক দেখে যে-সচেতনতা জাগার কথা তা-ও নেই।

ভালো আছো দাদা?

হ্যাঁ, ভালো রে! ফজল এগিয়ে গিয়ে সাহানার মাথায় হাত রাখে।

ফজল ভেবেছিল সাহানা হয়তো কাঁদবে, কিন্তু তার কোনো বিকার নেই। যেমন নিস্পৃহ ছিল, তেমনি রয়ে গেল। ফজল বুঝতে পারে, সাহানা জটিল মানসিক আবর্তে ডুবে রয়েছে।

সে দ্বিতীয় আর কোনো কথা না বলে সবার সঙ্গে ভেতরে এগিয়ে চলে।

উঠোনে একটা সিঙ্গাপুরি কলাগাছ – ফলন্ত, কলার কাঁদির ওপরদিকটা কালো কাপড়ে ঢাকা। বেশ সুস্বাস্থ্য গাছটার।

বাহ্, গাছটা তো খুব চমৎকার ফল দিয়েছে! আবহাওয়া হালকা করার জন্যে বলে ফজল।

উঠোনে তো জায়গা নেই দাদা, মাত্র তিন কাঠার ওপর বাড়ি… গাছপালা লাগানোর শখ থাকলেও উপায় নেই। গ্রামের বাড়িতে আরো গাছ লাগিয়েছি। আপনি যদি হাতে সময় নিয়ে আসতেন দেশে নিয়ে যেতাম।

কিছু টব আছে দেয়াল ঘেঁষে। নয়নতারা আর সন্ধ্যামালতি আছে কয়েকটা।

ঘরের বারান্দাটা লোহার গ্রিলঘেরা। মাঝখানে রাখা খাবার টেবিল। বারান্দার শেষে রান্নাঘর। এদিকে দুটি শোবারঘর। ঢুকতে বাঁয়ে আছে আরেকটি। বারান্দা ক্রস করে চলে গেছে করিডোর… শেষ মাথায় বাঁয়ে টয়লেট। এখানে দরজা দিয়ে করিডোর বন্ধ করা হয়েছে। বাইরে উঠোনে আরেকটি টয়লেট, দিশি কায়দায়। এটা কাজের লোকেরা ব্যবহার করে। ফজল খেয়াল করে, ঘরদোর খুব একটা গোছানো নয়। আসলে এমনটাই তো হওয়ার কথা।

জামা-কাপড় ছেড়ে সবাই খেতে বসে।

টেবিলে সব খাবার রাখা। তারপরও মমতাবুবু সবার খাবার পরিবেশনে লাগে। সাহানা পাশে দাঁড়িয়ে। কোনো কাজে হাত লাগাচ্ছে না।

একসময় ফজল বেশ জোর দিয়ে বলে, বুবু, তুমি সাহানাকে সব কাজ করতে দাও। এটা ওর বাড়ি, ও সবাইকে সার্ভ করুক। মনে মনে বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানবে। বুবুটা নিজেই সব তদারকি করছে। অথচ যার ঘর সে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে। ওকে তো কাজে নিয়োগ করতে হবে, না হয় সুস্থ হবে কী করে?

বুবু যথেষ্ট ইন্টেলিজেন্ট, তাড়াতাড়ি হাতের খাবারের বাটি আর চামচ সাহানাকে ধরিয়ে দেয়।

তোর ঘর, তুই সামাল দে সাহানা। আসলেই আমার কোনো কাজ করা উচিত নয়। আমি তো মেহমান।

তা-ও আবার উওম্যান মেহমান – রসিকতা করতে ছাড়ে না ফজল। পরিবেশটা সে হালকা রাখতে চায়।

সাহানা ধীরলয়ে কাজ করতে লাগল; কিন্তু মুখে কোনো রা নেই। তবু ভালো লাগে ফজলের। ওকে অন্তত কাজে জড়াতে পেরেছে।

তোমরাও তো আমাদের সঙ্গে বসতে পারতে, বলে ফজল।

আমরা দুবোন পরে বসব, তোমরা খাও, যথারীতি বুবুর ত্বরিত জবাব।

 

শাহানাকে কথোপকথনে জড়াতে চাইলেও তা যে সম্ভব হবে না বুঝতে পারে ফজল।

একটু ডাল দে সাহানা। টমাটো-ডালটা খুব মজার হয়েছে।

সাহানা ধীরলয়ে ডাল পাতে ঢেলে দেয়।

খাওয়া সেরে বারান্দা সংলগ্ন কামরায় বিশ্রাম নিতে প্রবেশ করে ফজল আর জাহান।

ঘরে একটা বড় ডাবল-বেড খাট। দেয়াল ঘেঁষে এক সেট সোফা। একটা ওয়্যারড্রোব… তার ওপর রাখা একটা অত্যাধুনিক কম্পিউটার। পাশে একটা সিডি প্লেয়ার। আছে কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং বই। সবকিছুর ওপর একটা হালকা ধুলোর আস্তরণ। পরিষ্কার হলেও বোঝা যায়, রোজকার যে হাত লাগা তা থেকে বঞ্চিত।

বিছানায় দুই ভাই গা এলিয়ে দেয়।

এটা শরীফের ঘর, বলে জাহান। ওই যে সিলিংয়ে ফ্যানের হুকটা দেখছ, ওটাতেই দড়ি লাগিয়েছিল। এই রকম বেলা আড়াইটা-তিনটের দিকে ও কাজটি করে। পাশের ঘরে শোয়া মা-বাবা শুধু একটা চেয়ার পড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু খেয়াল করেনি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দরজা ভেজানো ছিল। খিল লাগানো ছিল না।

দরজা খোলা ছিল! ফজলের বিস্ময়।

হ্যাঁ। খোলা মানে ভেজানো। খিল লাগানো ছিল না।

তুমি তো দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ একজন পুলিশ অফিসার, তোমার কী মনে হয়?

এটা তো আমার কাছেও একটা ধাঁধা। আত্মহত্যা করতে গেলে লোকে আটঘাট বেঁধে নামে।

ঠিক বলেছ। আত্মহত্যাকারী একটা পয়েন্টে স্থির থাকে যে, তাকে মরতে হবে। কেউ যেন বাঁচাতে না পারে সেদিকে থাকে সচেতন। আফটার অ্যাফেক্ট নিয়ে তারা চিন্তা করে না। কারণ সেটাকে প্রশ্রয় দিলে তো আত্মহত্যা করার মনটা বদলে যেতে পারে। এই উন্মাদ অবস্থাটা মাথায় বলতে গেলে ভূতে পাওয়ার মতো ভর করে থাকে। তাই দরজায় খিল না দেওয়াটা একটা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

হ্যাঁ। আমার মনেও প্রশ্ন জাগে। দরজায় খিল দিলো না কেন?

আচ্ছা মা-বাবার সঙ্গে কি কোনো বাদ-বিবাদ হয়েছিল?

না।

প্রেম-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার?

সেটা তো আমরা জানতে পারিনি। যদি জানতাম তাহলে তো আর অন্য কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না।

তোমরা জানার চেষ্টা করোনি?

তা-ও করেছি, কেউ কোনো ক্লু দিতে পারেনি।

তোমার কি মনে হয় না, ও মরতে চায়নি?

তোমার মতো আমারও তা-ই মনে হয়, কিন্তু স্থির হতে পারিনি। কেননা, মানুষ ভুলও তো করতে পারে? দরজায় খিল দিতে ভুলে গেছে!

হ্যাঁ, ভুলে দরজা বন্ধ না করতে পারে, কিন্তু এরকম ভুল হওয়ার কথা নয় – যদি না মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা থেকে থাকে।

এখন দরজা খুলে রাখাটা ভুল না ইচ্ছাকৃত এ-সম্বন্ধে তো শিওর হতে পারছি না।

ঠিকই। একটা ধাঁধাই বটে।

শীতের বেলা। ঝপাত করে সন্ধ্যাটা নেমে এলো। বারিক অতিথি দুজনকে চা-পান শেষে একতলার ছাদে নিয়ে যায়। গোধূলি তখনো ধনেখালির আকাশে কমলা আভা ছড়াচ্ছে। বাড়ির পশ্চিম পাশে বড় একটা পুকুর। পুকুরের ওপারে মাঠ। দক্ষিণ দিক দিয়ে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে। ইটবোঝাই একটা ট্রলি-ভ্যান ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে শহরে প্রবেশ করছে।

উত্তুরে হাওয়ার একটা প্রবাহ চলছে, বেশ শীতল।

শীত নিয়ে আসছে এই হাওয়া, বলে বারিক। আজ রাত থেকেই মনে হচ্ছে শীত নামবে ধনেখালিতে।

হাওয়ার পিছু ছুটে এলো হালকা কুয়াশা। পশ্চিমের আকাশটা ঢেকে যেতে থাকে।

চলুন, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। শীতের প্রথমদিকে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকে, বলে বারিক সবাইকে নিয়ে নিচে নামে।

শহরটা দেখার ইচ্ছা ছিল, বলে ফজল।

কাল সকালে বেরোব। এখন তো রাত হয়ে গেছে। ছোট মফস্বল শহর, কী আর দেখবেন… তবে এখানে আমাদের বাড়ির পাশেই তাঁতের শাড়ির কারখানা আছে। ধনেখালি শাড়ির নাম নিশ্চয় শুনেছেন?

ধনেখালির শাড়ির নাম শুনেছি…। ছোটবেলায় ছড়ায় পড়েছি ধনেখালির নাম। সেই যে এক তাঁতির ছেলে একটা ব্যাঙ মারে, তারপর তার প্রতিশোধ নিতে ব্যাঙদের সৈন্যরা তাকে আক্রমণ করে… আজিডাঙ্গা কাজীডাঙ্গা মধ্যে ধনেখালি… সেখান থেকে এলো ব্যাঙ চৌদ্দ হাজার ঢালি… তাঁতগুলো কি সন্ধ্যায় খোলে না? জানতে চায় ফজল।

এই সময় পুজো-আর্চার সময়… কাজ বন্ধ থাকতেও পারে। কাল সকালে নাস্তা করে আমরা বেরোব। তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে তিনটের দিকে বেরিয়ে যাবেন। ঘণ্টাদুয়ের মধ্যে বর্ধমান পৌঁছে যাবেন।

বারিক যা বলেছিল তা-ই ফলল। রাতে আচমকা শীত বেড়ে গেল। শুধু চাদরে হলো না, রাতেই কম্বল বের করতে হলো সবাইকে।

পরদিন সকালটা ঘন কুয়াশায় মোড়া। প্রবল ঠান্ডা হাওয়ার স্রোতও চলছে। কুয়াশা এতোটাই ঘন যে, টুপটাপ করে বৃষ্টির মতো ঝরছে।

ন’টার আগে তারা তাঁত দেখতে বেরোতে পারল না।

কুয়াশা একটু হালকা হতেই ফজল আর বারিক বেরিয়ে পড়ে।  রাস্তা পার হয়ে তারা জগন্নাথ ভ্যারাইটি স্টোর ডানে রেখে এগিয়ে চলে। এদিকটা গ্রামের পাড়ার মতো। পেছনে মাঠ দেখা যাচ্ছে।

পাড়ার মাঝে প্রবেশ করে ডানে পেল একটি স্যাকরার দোকান।

বারিক, কোনো তাঁতঘরের সঙ্গে তোমার আলাপ নেই? জানতে চায় ফজল।

না, ঠিক সেভাবে আলাপ নেই। আমরা এখানে এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি।

ফজল স্যাকরার দোকানে বসা বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আপনাদের তাঁতঘরগুলো কোনদিকে?

আপনি আর একটু ভেতরে চলে যান, বাঁয়ে বেশ কয়েকঘর তাঁতির দেখা পাবেন।

ধন্যবাদ জানিয়ে তারা এগিয়ে যায়।

বাঁদিকে একটি বাড়ির মধ্য থেকে তাঁতের খটখট আওয়াজ শুনতে পায়।

জানালা দিয়ে উঁকি মারে ফজল।

চশমা চোখে বয়স্ক এক তাঁতিকে দেখতে পেল, তাঁত চালাচ্ছে।

এই যে দাদা, শুনছেন… ডাক দেয় সুহাস। ভদ্রলোকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। একবার দুবার তিনবার ডেকেও সাড়া পেল না। ভাবে, মাকু চলাচলের খটখটানির জন্যে কি শুনতে পাচ্ছে না?

এই সময় ডানদিকের দরজা দিয়ে একজন জোয়ান লোক বেরিয়ে এসে বলে, বাবু, বাবা কানে শোনেন না।

আমরা আপনাদের তাঁত একটু দেখব… বলে ফজল।

ভেতরে আসুন।

উঠোনে গিয়ে দেখে অনেক সুতো শুকোনো হচ্ছে। সব চরকায় গোটান।

তাঁতঘরে ঢুকে তারা তাঁতে কাপড় বোনা দেখতে থাকে।

আপনার নাম কী? ফজল জোয়ান লোকটিকে জিজ্ঞেস করে।

বিবেকানন্দ দাস।

আর বাবা?

হরিসাধন দাস।

কতদিনের ব্যবসা আপনাদের?

এ চলে আসছে অনেক বংশ ধরে।

আপনাদের এই জায়গার নাম কী?

হাড়পুর।

বাহ্, মজার নাম তো? তাঁতপুর হতে পারত!

এখানে কয় ঘর তাঁত আছে?

তা-ও প্রায় ষাট ঘর হবে।

আপনাদের প্রোডাক্ট কোথায় বিক্রি করেন?

আমরা আমাদের সমবায় সমিতিকে দিয়ে দিই।

বিকেকানন্দ ফজলকে অন্য তাঁতঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তার বোন চন্দনা কাজ করছিল। মা ছায়ারানী সুতো গোটাতে ব্যস্ত। ওদের কাজের পরিবেশ খুবই সাধারণ। অসচ্ছলতার প্রকাশ সর্বত্র। ওরা শাড়ি তৈরি করে, কিন্তু ওদের পরণের শাড়ি খুবই জীর্ণ।

ক্যামেরাটা আনা হলো না, আপনাদের ওপর একটা ফিচার করতে পারতাম। আপনাদের শাড়ির খুব সুনাম শুনেছি।

বিবেকানন্দ তৈরি কিছু শাড়ি এনে দেখাল। সবই কম দামের। ফজল বলেই বসে, দামি শাড়ি করেন না আপনারা?

এগুলো সব সুতির।

দাম কেমন?

একশ থেকে তিনশো।

সবচেয়ে দামি কত টাকার?

তসর হলে সাতশো পর্যন্ত পড়ে। নাইলন আর সিল্কের শাড়ি খুব একটা হয় না। অর্ডার পেলে করি।

তারা আলাপ করছে এমন সময় অদূরে কিছু পটকার আওয়াজ পাওয়া গেল। বারিক বেশ সজাগ হয়ে ওঠে।

ও কিসের শব্দ? জানতে চায় ফজল।

পেটো। পেটো বোঝেন তো?

হাতে তৈরি বোমা। বলে বারিক।

এই সাত-সকালে?

ফজল ভেবে পায় না।

তাদের কথা শেষ হতে না হতে আরো পটকার আওয়াজ এবং বেশ কাছে।

বিবেকানন্দকে বেশ বিচলিত মনে হলো।

দাদা, লক্ষণ ভালো নয় – আপনারা ঘরে চলে যান।

সেই ভালো, বলে বারিক।

ফজল অতটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

বলে, ব্যাপারটা কী?

দুদলে ঝগড়া, বারিক বলে।

কোন কোন দল?

তা তো এখন বলা যাবে না। এখানে নিজ দলের মধ্যেও মারামারি হয়, বলে বারিক।

এই সময় বারিকের ঘর থেকে তার কাজের লোক দৌড়ে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, দাদা, এখনই ঘরে যেতে বলেছে দিদি।

কাদের মধ্যে ঝগড়া রে?

জানতে চায় বারিক।

দাদা, এখনো বুঝতে পারছি না। তবে শুনেছি তৃণমূলের ফিরোজকে মেরে ফেলেছে।

ফিরোজ! চমকে ওঠে বারিক।

চেনো নাকি লোকটাকে? ফজল বলে।

লোক নয়, পঁচিশ বছরের যুবক। আমার শরীফের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।

কাজের লোকটা তাড়া দিতে থাকে।

দাদা, দেরি করবেন না।

গোলাগুলির আওয়াজ আরো বেড়েছে।

তারা বিবেকানন্দদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে লোকজন ছোটাছুটি করছে। অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা।

অবস্থাদৃষ্টে ফজল কিছুটা শঙ্কিত হয়। তবে সে বাইরের লোক, মনে মনে তার এই ভরসা।

দাদা, তাড়াতাড়ি পা চালান, বাইরের লোক দেখলে আরো বিপদ। বলে বারিক।

কেন?

গন্ডগোল পাকানোর এজেন্ট ভাবতে পারে।

খুব দ্রুতলয়ে তারা ঘরে পৌঁছে কলাপসিবল গেটটা লাগিয়ে দেয়।

সাহানাকে খুব বিচলিত মনে হলো।

জানো, আমাদের ফিরোজকে মেরে ফেলেছে! বারিককে বলে সাহানা।

এই সময় একদল পুলিশ দেখা গেল দাঙ্গাকারীদের ধাওয়া করে ছুটছে। কিন্তু গোলাগুলি কমছে না।

কাজের লোকটা এই সময় বাইরে থেকে এলো। ভেতরে এসে বলল, আসলামের গ্রুপ ফিরোজকে মেরেছে।

ও তো তৃণমূলের লিডার। ফিরোজও তো তৃণমূল করত?

কী একটা ব্যাপারে দুজন দুজনের বিরুদ্ধে লাগে… এখন একেবারে খুনোখুনিতে দাঁড়াল।

ফজল দেখে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে এই বাংলার রাজনীতির ধরন একই। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকে। নেতৃত্ব নিয়ে বা টেন্ডার ধরার ব্যাপার নিয়ে বিরোধী দল কমজোরি বলে দ্বন্দ্বে বেশি জড়ায় না। সব জায়গায় আদর্শ আজ জাগতিক চাহিদার কাছে ম্লান।

সাহানা তাদের মধ্যে থেকেও বেশ বিচলিত হয় উঠেছে।

ছেলেটা আর ফিরে আসবে না, বলে সাহানা।

কেন আসবে না, আবার ফিরে আসবে, বলে ফজল।

কী যে বলো দাদা, মরে গেলে কেউ আবার ফিরে আসে নাকি!

আমি বলছি আসবে। জোর দিয়ে বলে ফজল।

মরে গেলে কেউ কি ফিরে আসে দাদা? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাহানা।

কেন, তুই তো বলিস তোর শরীফ ফিরে আসবে!

চমকে উঠল সাহানা।

আমার শরীফ তো মরেনি!

তবে কোথায় গেল?

ফ্যালফ্যাল করে ফজলের দিকে চেয়ে থাকে সাহানা। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা।

ফজল সাহানার মাথায় হাত রাখে।

এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে সাহানা। ফজল ওকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। অদেখা যুবক ভাগনেটার জন্যে তার ভেতরেও কেমন একটা কাঁপন লাগে – আর দুচোখের জলকে বাঁধ মানাতে পারছে না।

নিচুস্বরে বলে, যা গেছে তা ভুলে যা সাহানা। যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো। গৌতম বুদ্ধের বাণীর প্রথম কথা কি জানিস : জীবন দুঃখময়। এর থেকে কারো নিস্তার নেই। দুঃখকে মেনে নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। জীবন একটা ব্যবসার মতো। কখনো লাভ হবে, কখনো হবে লোকসান, কিন্তু তা বলে তো ব্যবসা বন্ধ করা যায় না। জীবন এভাবেই চলবে।

আড়াইটার দিকে ট্যাক্সি দরজায় এসে দাঁড়াল।

জাহান আর ফজল যাবে বর্ধমান। ওখানে সাহানার বড় মেয়ে সরকারি চাকরি করে। ওরা ওখানে উঠবে। মমতাবুবু থেকে গেল। ছোট বোনের কাছে থাকবে কয়েক দিন।

চলি রে, সাহানা, বলে ফজল।

আবার এসো। মাত্র চবিবশ ঘণ্টা থাকলে।

আসব। বারিক, তোমাদের ধনেখালি শহরটা দেখা হলো না।

হ্যাঁ দাদা, আবার আসুন। সব ঘুরে ঘুরে দেখাব। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও নিয়ে যাব। আপনার খুব ভালো লাগবে। ওখানে অনেক গাছপালা লাগিয়েছি।

ফজলের বেশ ভালো লাগে। সাহানা অনেকটা সহজ হয়েছে।

গাড়ি ছেড়ে দেয়।

কিছুদূর গিয়ে জাহান বলে, তুমি ভালো করেছ, সাহানাকে অনেকটা সহজ করতে পেরেছ।

কিন্তু জাহান, একটা ব্যাপার আমার মাথায় এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। শরীফ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগাল না কেন?