নগরজীবনের চালচিত্র

Zahid KMজাহিদ মুস্তাফা

তাঁর পরিচয় অনেক। তিনি চিত্রকর, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রগ্রাহক, সংগঠক। এক মানুষের ভেতর অনেকগুলো গুণের অস্তিত্ব। তিনি খালিদ মাহমুদ মিঠু। তাঁর সঙ্গে আমার চেনাজানার তিন যুগ হচ্ছে। ঢাকার চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর প্রবেশ ১৯৭৮ সালে, আমার প্রবেশ ঠিক তাঁর পরেই। সুস্থ একটা প্রতিযোগিতা ছিল সমবয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো ফলাফল করা ও সার্থক আঁকিয়ে হওয়ার। মিঠু এ-কাজে অগ্রণী ছিলেন আরো কজনের মধ্যে। নিজেকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেলেন – ফটোগ্রাফি শিখতে শিখতে। ক্যামেরার পেছনে শিল্পীর চোখ থাকায় তাঁর তোলা ফটোগ্রাফি হয়েছে আর দশজনের চেয়ে আলাদা।

পারিবারিক পরিচয় ও এর ঐতিহ্যও সহায়ক হয়েছে তাঁর বিকাশে। মা সাবেক শিক্ষক ও বিশিষ্ট নাট্যকার। মামা আলমগীর কবীর ছিলেন বরেণ্য চলচ্চিত্র-নির্মাতা। শিশুকাল থেকেই সংস্কৃতিচর্চায় বিশেষ আগ্রহ ছিল মিঠুর। সৃজনশীলতার মধ্যে নিজেকে যুক্ত করে এরই মাঝ থেকে খুঁজে নিয়েছেন আনন্দ। নিজ বাড়ির পরিবেশটাও অনুকূল। সহধর্মিণী কনক চাঁপা চাকমা স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী, তাঁদের দুই সন্তানও ছবি আঁকিয়ে ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা।

শিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠুর কাজের দুরকম দুটি প্রদর্শনী চলছে। ঢাকার অ্যাথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে চলছে একক চিত্র-প্রদর্শনী এবং দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলছে তাঁর তৈরি চলচ্চিত্র জোনাকির আলো। একাদশতম একক এ চিত্র-প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ডিকনস্ট্রাকটিং’।

এতে শিল্পীর সাম্প্রতিক সময়ে আঁকা শতাধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। মিশ্রমাধ্যম, অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে অাঁকা চিত্রকর্মের পাশাপাশি বেশকিছু ছাপচিত্রও করেছেন শিল্পী।

বিশাল এ-প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো দেখতে দেখতে সহসাই মনে পড়ে যায় এখন থেকে প্রায় চৌত্রিশ বছর আগের নবীন মিঠুকে। পেনসিলে, কালি ও কলমে, জলরঙে সতীর্থদের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে বিপুল বিক্রমে কাজ করতে দেখেছি তাঁকে। নিজেকে মেলে ধরার তুমুল ইচ্ছাশক্তি ক্রমশ তাঁকে পরিণত করেছে।

অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়ে খালিদ মাহমুদ মিঠু ছবি আঁকায় নিজের ধরন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে চালাতে ইমেজের ভেতর তাঁর চোখ স্থির হয়। তাঁর চিত্রপটে নানারকম ইমেজ জড়ো হতে থাকে। এগুলোকে তিনি স্থাপন করেন নানা রঙের আলিম্পনের সামনে অথবা বর্ণবুনটের গভীরে।                   এ-ধরনটা অনেক শিল্পীর কাজেই আমরা পেয়ে যাই। প্রায় নৈর্ব্যক্তিক চিত্রকাঠামোর ভেতর আকস্মিক বাস্তবানুগ ফর্মের উপস্থিতি চিত্রতলের সৌন্দর্যকে কি ম্লান করে না? তা হয়তো করে, তবে গোটা চিত্রকর্ম দৃষ্টিনন্দন হয়ে ধরা দেয় এবং উপভোগ্য হয় বলেই মনে করি।

চিত্রতলকে নানা বর্ণে আর টেক্সচারে সমৃদ্ধ করেছেন প্রয়াত শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। রং আর নিসর্গের নানা রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তুমুল দক্ষতায় তাঁর মেধা আর জ্ঞানের বিশালতা দিয়ে। আমাদের দেশে প্রকাশবাদী বিমূর্ততার প্রধান উদ্গাতা হয়ে এখনো প্রাধান্য অটুট তাঁর মহাপ্রয়াণেও। তাঁকে অনুসরণ করেছেন কিছুকাল কাজী আবদুল বাসেত, শামসুল ইসলাম নিজামী প্রমুখ। পরে এ-ধারায় এসে যুক্ত হয়েছেন মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, মাহমুদুল হক, বীরেন সোম, মোহাম্মদ ইউনুস ও খালিদ মাহমুদ মিঠু। শেষোক্ত দুজনের চিত্রকর্মে আমরা দেখি ইমেজের আনাগোনা। মিঠু ক্রমান্বয়ে সুর তোলার যন্ত্র অর্থাৎ মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টকে স্থাপন করেছেন তাঁর চিত্রপটে। গিটার, স্যাক্সোফোন, হারমোনিয়াম রিড এসব ইমেজ তুলে এনে সংগীতের বিশালতার প্রতি শিল্পীর শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তুলেছেন।

প্রকাশবাদী বিমূর্ততার জনক হিসেবে খ্যাত ভ্যাসিলি কান্দিনিস্কি মনে করতেন, সংগীত মুক্তি খোঁজে কালের বিশালতায়। তার এই বৈভবকে তিনি চিত্রপটে অনুবাদ করার প্রয়াস পেয়েছেন। বিমূর্ত সংগীতের প্রভাবে গড়ে উঠেছে চিত্রকলায় বিমূর্ততার প্রকাশ। সংগীত উপকরণ প্রয়োগ করে মিঠু কি কান্দিনিস্কিকে স্মরণ করেছেন? নাকি সংগীতের বিশাল ক্যানভাসকে তিনি ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন প্রথমত. নিজের সত্তায় এবং তার অনুরণন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শিল্পের দর্শক-সমঝদারদের কাছে। ‘ট্রাঙ্কুইল ব্লু’ শিরোনামের চিত্রটিতে বেহালার ইমেজ ও প্রশান্তির সুর চিত্রিত করেছেন শিল্পী।

এবারের প্রদর্শনীতে দেখলাম – শিল্পী এমন কিছু কাজ করেছেন যেগুলোর ইমেজ হিসেবে উঠে এসেছে বেলচা। পাথরকুচি, বালু আর সিমেন্টের মিশ্রণে এটির ব্যবহার করেন রাজমিস্ত্রিরা। তাহলে কি মিঠু নগরায়ণের তীব্রতাকে তুলে এনেছেন বেলচার রূপকে, নাকি এটি একটি মজার ফর্ম হিসেবেই এসেছে। প্রথমোক্ত কারণটিই বোধকরি যথার্থ। তাঁর উপস্থাপনা ও উপকরণ প্রয়োগেও এই ইঙ্গিত পেয়ে যাই কোনো কোনো চিত্রে। যেমন ‘স্টোরি বিল্ডার’। বেলচার ইমেজ দিয়ে মিঠু তৈরি করেছেন আরেক চিত্র ‘বায়োগ্রাফি’। মিশ্রমাধ্যমে লম্বাটে ক্যানভাসে লম্বা আড়াআড়িভাবে বেলচা দাঁড়ানো, নিচে কংক্রিট মশলার মতো স্তূপ। গোটা চিত্রপটকে শিল্পী তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন – শীর্ষে নীল, দ্বিতীয়াংশে সাদা ও ছাইরঙের বুনট, নিচে হলুদাভ জমিন। বায়োগ্রাফি নামকরণে সহজ চিত্রটিতেও বিশেষ ভাবব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে।

দৈনিক পত্রিকার পাতাকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন শিল্পী। পত্রিকা কেটে কাপ-পিরিচ বানিয়েছেন। বানিয়েছেন বোতল, মানুষের ফিগার, অবয়ব ইত্যাদি। খবরের কাগজ নাগরিক সভ্যতার এক অন্যতম মাধ্যম মত ও পথ প্রকাশের। যোগাযোগের এই মাধ্যম আমাদের সমাজে এখনো বেশ জনপ্রিয়। শিল্পী পত্রিকার সংবাদ ছাপা হওয়া কাগজ কেটে তার চিত্রপটে প্রয়োগ করে কি নাগরিক জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরেছেন, নাকি ক্রমান্বয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে পত্রিকা পাঠের সংস্কৃতির বিস্তারে কাগজে ছাপা সংবাদপত্রকে স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

ভালো লাগছে সম্প্রতি শিল্পী তাঁর প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে ছাপচিত্রকে গ্রহণ করেছেন। সৃজনশিল্পী নানা মাধ্যমে আঁকলে যেমন নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তেমনি দর্শকরাও নতুন ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন শিল্পীর ছাপচিত্র দর্শনে। ‘অন্তর্জ্বালা’, ‘সীমাবদ্ধতা’, ‘খেলার পরের কাহিনী’, ‘হতাশা’, ‘অন্যরকম ছোঁয়া’, ‘জোনাকির আলো’ – এসব শিরোনামে অনেকগুলো প্রিন্ট নিয়েছেন। এবং আমার কাছে মনে হয়েছে, এই মাধ্যমটি নিয়ে তাঁর কাজ বেশ মজাদার। তাঁর সামনে যাওয়ার প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়েছে। সৃজনশীল এ-মানুষটির সৃজনধ্যান অনুকরণীয় আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্যে।