নতুন শিল্পসত্যের সন্ধিৎসা

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

 

সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ইতিহাস বদলে যেতে থাকে। ইতিহাসের চিহ্নসমূহ আমাদের সাক্ষ্য দেয় ঢালী আল মামুন অতীত সময়, ইতিহাস, বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরেছেন তাঁর এ-প্রদর্শনীর ষোলোটি কাজে।

মামুন সমাজ ও রাজনীতি-সচেতন শিল্পী। তাঁর শিল্পকর্মকে তিনি দৃষ্টিনন্দন বৈঠকখানার শোভাবর্ধনের উপকরণ হিসেবে দেখেন না। তিনি দর্শকদের একটি সুনির্দিষ্ট বার্তা দিয়ে দেন, যা থেকে শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে দর্শককে সচেতন করার উপকরণ।

শিল্পে সত্য বলার সঙ্গে একটি শুভ ইঙ্গিত দিতে ভুল করেন না ঢালী আল মামুন। দর্শক আকৃষ্ট করে সুবিধাবাদের গায়ে আঘাত করতে চান তিনি। পুঁজিবাদী সমাজ, ব্যক্তি যখন নুয়ে পড়ে, তখন মানুষের শিরদাঁড়ায় টান পড়ে। মানুষ লক্ষক্ষ্যর দিকে যেতে চায়। বাঁচার জন্যে শিরা টানটান করে। ঢালী আল মামুনের শিল্পের ভাষা এবং উপস্থাপনার ঢং ভিন্ন।

প্রদর্শনীর কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন – চিত্রকলা, ভিডিও, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, শব্দ ও আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে বিষয় উপস্থাপন।

বিষয় হিসেবে এ-প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে রাজনীতির একেবারে সাম্প্রতিক ভাষা। পরিবেশ নিয়ে ভিডিওচিত্র প্রদর্শন। রেসিন, স্টোন ডাস্ট, ইলেকট্রিক মোটর, স্টিল ও চলমান ছবি ব্যবহারে চিত্রকল্প নির্মাণ। প্রতীকী উপস্থাপনার মধ্যে সরাসরি বিষয় বর্ণনা করা না হলেও একটি কাজ থেকে আরেকটি কাজের দিকে দৃষ্টি ফেললে দেখা যায়, ভাষা একই, কিন্তু নির্মাণের মাধ্যম ভিন্ন। গ্যালারিতে প্রবেশের মুহূর্তে দুই খ– আলাদা করা চেয়ারের

আকৃতির নাম – ‘লাটসাহেবের চেয়ার’। এটি দুই ভাগ করা। একভাগে রং ও গঠন আধুনিক; কিন্তু নকশা ও নির্মাণশৈলীতে পৌরাণিক ধাঁচ স্পষ্ট। অন্য অংশে মানবদেহের হাড়ের টুকরো যুক্ত করে তৈরি করা

আকৃতি বোঝা যায়। লাটসাহেব চরিত্রটি আমাদের কাছে মিথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সমাজে লাটসাহেব এখনো রয়েছে। শুধু লাটসাহেবের বেশভূষা আর বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন এসেছে। ‘লাটসাহেবের চেয়ার’ স্থাপনাশিল্পটি তৈরি হয়েছে রেসিন, স্টোন ডাস্ট, ফাইবার ও টেক্সটাইল ব্যবহার করে। গ্যালারির মূল ভবনের দুই দেয়ালে রয়েছে দুটি ভিডিও আর্ট। একটিতে গাছের শুকনো ডাল ভেদ করে ভিডিওর আলো পড়ছে পর্দায়। ছবিতে জলজ প্রাণীর আনাগোনা স্পষ্ট।

লুপ্তপ্রায় জলের প্রাণীকে শিল্পী ভিডিওতে উপস্থাপন করেছেন। অন্য ভিডিও আর্টে দুটি পাতার আকৃতি ঘুরছে। দেয়ালের ভিডিও আর্টে দেখা যায় নানা বর্ণের পাতার চলমান শব্দ। বিলুপ্ত সবুজের সঙ্গে কৃত্রিম দুটি পাতার যোগাযোগ তৈরি হয়েছে এ-ভিডিওচিত্রে।

প্রদর্শনীকক্ষের ভেতরে শিল্পকর্মের সঙ্গে-সঙ্গে গ্যালারির দেয়ালের আস্তর তুলে ইটের আকৃতি দেখানো হয়েছে। দেয়ালের আস্তরটি উলস্নম্ব আকৃতির ফর্ম। এ ফর্মের মাধ্যমে মানুষের মনের ভেতর তৈরি হওয়া এ-ভগ্নদশাকে উন্মুক্ত করে দিতে চান ঢালী আল মামুন।

‘লস্ট মেমোরিস’ শিরোনামের কাজগুলোতে স্মৃতিতে গেঁথে থাকা ছোট চিহ্নগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত শোকগাথা প্রকাশ পেয়েছে এ-কয়টি কাজে। মানবদেহের মেরুদ–র হাড়ই সবচেয়ে বেশি শক্তি ধারণ করে। দেহের নবম কশেরুকাসহ অন্য হাড়ের আকৃতি এসে হাজির হয়েছে এই পস্নাটফর্মে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে আমাদের কাজের ক্ষমতাও বেড়েছে। সে-ক্ষমতার সাক্ষ্য দিচ্ছে এ-কাজগুলো। ঢালী আল মামুন আলো ও বস্ত্তর ভেতরকার শক্তির ভাষা দর্শকদের এভাবে জানিয়ে দেন। ইতিপূর্বে প্রদর্শিত ‘অপনয়ন’ শিরোনামের প্রদর্শনীর স্থাপনাশিল্পে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি ও শক্তির প্রতীক নির্মাণ করেছিলেন। এ-প্রদর্শনীতে সেসব বিষয়কে এক না করলেও এখানে নির্মাণ করেছেন – চলমান সময়, অতীত ইতিহাস ও হারিয়ে যাওয়া সময়কে। গ্যালারির পশ্চিম দেয়ালে মিম্বর আকৃতি তৈরি করে তাতে কাচ ও আলোর বিচ্ছুরণ দেখান শিল্পী। ঠিকরে বের হওয়া আলোক রশ্মি দর্শককে কখনো আঘাত করে, আবার কখনো আনন্দে উদ্বেল করে। ঢালীর এ-শিল্পভাষা আমাদের উৎকণ্ঠার কথা মনে করিয়ে দেয়। দেয়ালে চলমান চিত্রে মানুষের কর্তিত মাথা হেলেদুলে আসতে থাকে। গা-ছমছম করা ভীতি তৈরি করে। এটি কি সত্যিই আমাদের চলতি সমাজঅবস্থার ছায়া? হয়তো তাই। ঢালী আল মামুন ব্যঙ্গ করেন সময়ের সঙ্গে চলতে থাকা মানুষের অবস্থার চিহ্নকে। অন্য একটি শিল্পকর্মে  ফুলের সারি-সারি আকৃতির সঙ্গে বেয়ে পড়ে জলের ফোয়ারা। ধবধবে সাদা

আকৃতির ফুলগুলো গ্যালারি আলোকিত করে তোলে। আলো বয়নশৈলী, আলোক প্রক্ষেপণের মাঝে তৈরি হওয়া বাস্তবের প্রতিচ্ছবিতে ঢালী আল মামুন নির্মাণ করেন শুদ্ধ মানবিকসত্তা। ‘টাইম, কোইনসিডেন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি’ শিরোনামের এ-প্রদর্শনী গত ২৮ জানুয়ারি শুরু হয় বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে এবং শেষ হয় ১৯ মার্চ।