নদী আমায় ডাকে

কাইয়ুম চৌধুরী

হাতের আঙুলের মতো নদী বাংলাদেশজুড়ে। তবু, অনেকের নিজের একটা নদী থাকে, অনেকের থাকে না। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও কবি মোহাম্মদ রফিক বলেছেন তাঁদের নদীর গল্প।

নদী আমাকে হাতছানি দেয়, ডাকে

আমি প্রলুব্ধ যৌবনবতীর আহবানে,

ভেসে যাই তার

দুকূল প্লাবিত যৌবনের টানে।

আমি অবগাহন করি –

দুহাতে উন্মোচিত করি তার উদ্দাম বদেশ,

কি উচ্ছঠল উচ্ছ্বাসে –

কি সুখের আলিঙ্গনে যাই ভেসে।

সেই কৈশোরকালে নদীতীরে বাস। সকালে নদীর কুয়াশাঢাকা রূপ, দুপুরে রৌদ্রস্নাত নদীতে নৌকোর আনাগোনা, বিকেলে পড়ন্তবেলায় কিংবা অলস মধ্যাহ্নে নদী কেমন ঝিমোয়। রাত্রে নদীতে শুধু টিমটিমে আলোয় দাঁড়ের ছপছপ আর মাঝিমাল্লার টুকরো সংলাপ, যা প্রায়ই অস্পষ্ট কথামালা, মাঝেমধ্যে ভাটিয়ালি সুরের দূরাগত ধ্বনি আমার মর্মে গেঁথে আছে। কোজাগরী পূর্ণিমায় নদীর নয়ন-ভোলানো রূপ, আমি মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে থাকি। আমার নয়ন ভোলানো এলে, কী হেরিলাম হূদয় মাঝে – রবীন্দ্রনাথের সুর আমাকে কোন ভুবনে নিয়ে যায়। তখনো ছিন্নপত্র পড়িনি, রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কখনো মনের মধ্যে আলোড়ন তোলেনি কিন্তু তাঁর অনুভব নদী আমাকে এনে দিয়েছে – ‘কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী আর বলব। কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না; ওই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিকঝিক করছে।’ সেই জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি এখনো আমাকে পাগল করে। এখনো সুযোগ পেলে আমি নদীপথে ভেসে যাই ঢাকা থেকে খুলনা – রকেটে। হয়তো আমার কাজ বরিশালে। খুলনা হয়ে বরিশালে আসি। সেই একই দৃশ্য, একই জ্যোৎস্না, একই নৌকো – প্রতিবারই নতুন মনে হয়। মনের মধ্যে ছবি অআঁকি। ক্যানভাসে, কাগজে ছড়ায় সেই ছবি। রবীন্দ্রনাথ আমার সফরসঙ্গী। গানে, কবিতায় দুর্লভ মুহূর্তগুলো ভেসে যায়। ‘নদী একেবারে কানায় কানায় ভরে এসেছে। ওপারটা প্রায় দেখা যায় না। জল এক-এক জায়গায় টগবগ করে ফুটছে। আবার এক-এক জায়গায় কে যেন অস্থির জলকে দুই হাত দিয়ে চেপে চেপে সমান করে মেলে দিয়ে যাচ্ছে।’ কেমন যেন একটা সুর হূদয়তন্ত্রীতে টোকা দিয়ে যাচ্ছে – ‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা। আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু/ গন্ধভরে তন্দ্রাহারা।’ সেই কৈশোরকালে কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে চিত্রা নদীতীরে। নড়াইলে। শয়নকক্ষ থেকে নদী দেখা যেত। গ্রীষ্মের নদী, বর্ষার নদী, শীতের নদী – এক-এক ঋতুতে এক-এক রূপ। নড়াইলের স্টিমারঘাটটি যেখানটায় ছিল, তার পরেই এসডিওর বাংলো। নদী এখানটায় বাঁক নিয়ে চলে গেছে মাগুরার দিকে। সেই বাঁকের ওপরই ছিল আমাদের বাসা। একটি বড় শিমুলগাছ ছিল। শিমুলগাছের গোড়া দিয়েই পাড় থেকে নদীর কাছে। নদীতে গোসল করতাম। নৌকা বাঁধা থাকত ঘাটে। টাবুরে নৌকো। ছোট্ট। মাঝিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল। নৌকোতেই তাদের রাত্রিযাপন। নৌকোতেই রাঁধাবাড়া। বেশ মজা লাগত। আহারে অংশ নেওয়ার জন্য তাদের আহবান। সানকিতে খাওয়া ডাল-ভাত-মাছ অমৃতের মতো যেন। ঘরে বসে যখন নৌকো দেখতাম – দেখতাম নৌকোর পাটাতনে রান্না চাপিয়েছে তোলা চুলোয়। ধোঁয়া উড়ছে। সে-সময় হয়তো নদীর মাঝবরাবর দিয়ে মাগুরাগামী আরএসএন কোম্পানির স্টিমার ভামো ঢেউ তুলে চলে গেল তোলা চুলো নিয়ে টাবুরে নৌকোকে দুলিয়ে দিয়ে। সেই দুলুনির মধ্যেই সরা তুলে মাঝি ভাত টিপে দেখছে, ভাত হলো কি না। সে-সময় চিত্রা নদী বেয়ে এখনকার রকেট স্টিমার তখনকার আরএসএন কোম্পানির জাহাজ অস্ট্রিচ, লেপচা, টার্ন, কিউই, ভামো চলাচল করত। কমলা রঙের জাহাজ, সেই জাহাজ এখনো ঢাকা-খুলনায় চলে। আমি ভীষণ আলোড়িত হই সেই প্যাডলচালিত জাহাজ দেখে। কৈশোরে ফিরে যাই।

চিত্রা নদীতে তখন জোয়ার-ভাটা খেলত। কচুরিপানা ভেসে বেড়াত। টাবুরে নৌকো ছাড়া অন্য নৌকো কখনো দেখিনি। আমি ও আমার বড় ভাই নদীতে সাঁতার কাটতাম আরো অনেকের সঙ্গে। খুব আনন্দ হতো, যখন ঢেউয়ের দুলুনির মধ্যে পড়তাম। দুলুনির ধাক্কায় আবার পাড়ে ফিরে আসা। ভরা বর্ষায় আবার নদীর অন্য চেহারা। ঝুপ ঝুপ ঝুপ ঝুপ অঝোরধারায় বৃষ্টি। টাবুরে নৌকোর মধ্যে বসে নদীতে বৃষ্টির আওয়াজ, একটু শীত শীত, কাঁথা গায়ে কোনো রূপকথার রাজ্যে চলে যেতাম! চরাচর বৃষ্টিধারায় ঝাপসা, এমনকি পারে আমাদের বাসাটিও অদৃশ্য। শুধু মাঝেমধ্যে নৌকোর দুলুনিতে বুঝতে পারতাম স্টিমার গেল ঘাটের দিকে। মাগুরা থেকে স্টিমার একটা বাঁক নিয়ে আমাদের বাসার দিকে যখন মুখ ফেরাত, তখন একটা ভোঁ দিত। সেই বাঁকের ওপরেও একটা ঘাট ছিল, নামটা মনে নেই। সেখানে যাত্রী নামিয়ে বা উঠিয়ে আমাদের দিকে রওনা হওয়ার আগে আরেকটা ভোঁ। আমাদের বাসা থেকে যাওয়া যাত্রী তখন সুটকেস, বেডিং নিয়ে রওনা হতেন ঘাটের দিকে। এই স্টিমারে চড়েই নড়াইলে আসা। প্রথম যেদিন সেই স্টিমারে চড়ি, সেই অপার আনন্দ এখনো অনুভব করি। প্রথম শ্রেণির ডেকে চেয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম দুই ধারের দৃশ্যরূপ দেখতে দেখতে। এখনো যখন গাবখান চ্যানেল দিয়ে যাই, দুই ধারের গ্রামদৃশ্য দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের কথা মনে হয়। খড়ে-ছাওয়া বাড়ির উঠানে বউ-ঝিরা ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে। কেউ হয়তো গরুটাকে নদীতে নামিয়ে গোসল করাচ্ছে। ঘরের বেড়ায় হলুদ রঙের শাড়ি শুকোতে দিয়েছে – এসব দেখতে দেখতে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসি। স্টিমারে সে-সময়ে লোভনীয় খাবার পাওয়া যেত ব্রিটিশ কায়দায় – ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তবে মাটন কাটলেট আর ক্যারামেল পুডিংয়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এখনো কিছুটা মেলে সেই খাবার, তবে সেই স্বাদ? সময় অনেক পালটেছে।

নড়াইলে থাকতে তার বাণিজ্যিক কায়কারবার ছিল রূপগঞ্জে। নড়াইল থেকে রূপগঞ্জে যেতে রাস্তা দিয়ে অনেকটা সময় লেগে যেত। নদীর পাড় দিয়ে শর্টকাট একটা রাস্তা ছিল, সেই রাস্তা ধরে স্কুল থেকে টিফিনের পয়সা হাতে করে বই কিনতে ছুটতাম। নদীর ভাঙনে সেই রাস্তা কখনো কখনো দুর্গম হয়ে পড়ত। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পার হতে হতো। সেই চিত্রা নদীর চেহারা পালটে যেত দুর্গাপূজার সময়। রূপগঞ্জের জমিদারদের বাঁধানো ঘাট থেকে প্রতিমা বিসর্জনের নৌকো যেত মাঝনদী বরাবর। হাজার হাজার নৌকো। সেকি হুটোপুটি! কথিত আছে, জমিদারবাবুদের প্রতিমার সঙ্গে আসল সোনার গয়না থাকত। পরনে দামি শাড়ি থাকত। সেই শাড়ি-গয়নার টানে নৌকোয় নৌকোয় হুলস্থূল বেঁধে যেত। সেই বাঁধানো ঘাটটি এখনো আছে আগের গরিমায়। সংস্কার করা হয়েছে ইদানীং ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদে। চিত্রা নদীর আগের যৌবন নেই। নেই আগের মতো জৌলুস, তবুও চিত্রা এখনো মোহময়ী। নৌকাবাইচের অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়, সেই দুর্গাপূজার জমকালো অনুষ্ঠান যেন অন্যভাবে বজায় রাখছে।

খুলনা থেকে ফিরছি একবার। জাহাজের ডেকে বসে আছি। দিগন্ত-বিস্তৃত নদী। একদিকের পাড় দেখা যায় না। ইলিশের নৌকো ইতস্তত ছড়ানো। ছোট নৌকোও আছে। একজনই জেলে বা মাঝি। জাল টানছে গলুইয়ে বসে। আর পা দিয়ে বৈঠা বাইছে নৌকোর গতি ঠিক রাখার জন্য। অবাক চোখে দেখি। এমনি সময়ে পশ্চিমাকাশ কালো করে মেঘ ছুটে এলো। তারপর ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি। চোখের সামনে থেকে ইলিশের নৌকো অদৃশ্য। তারপর নদী। বৃষ্টির ছাট জাহাজের ডেক ধুয়ে দিচেছ। উথালপাথাল ঢেউ নদীতে। হঠাৎ হঠাৎ দৃশ্যপটে ইলিশের নৌকো ভেসে উঠছে। জাল টানছে মাঝি। ছোট্ট একটি ছেলে বৈঠা নিয়ে নৌকো সামলাচ্ছে। আবার বৃষ্টির তোড়ে নৌকো অদৃশ্য। বিশালাকায় নদীতে এ-রকম ভরা বর্ষা কী যে এক অনির্বচনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করল, মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইলাম। একসময় বৃষ্টির তোড় কমে এলো, চারদিক পরিষ্কার হয়ে এলো। নদীতীরের খুব কাছ দিয়ে জাহাজ চলেছে। একটানা সুপারিগাছ। তারই নিচে গাছপালাঘেরা বাড়ি। ঘাটে নৌকো বাঁধা। এ রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। ক্লান্ত হওয়ার প্রশ্ন জাগে না। শুধু ভাবি, এ-নদীটার নাম কী এখানে। নদী নাম পালটায়। একই নদী। চলতে চলতে পদ্মা দিয়ে কখন আড়িয়াল খাঁয় পৌঁছে গেছি, টের পাইনি। সেই কাকভোরে বরিশালে ছিলাম কীর্তনখোলা নদীতে। চোখ মুছতে মুছতে দপদপিয়া ফেরিঘাট ঘুরে সুগন্ধায় পৌঁছে গেছি। খুব মজা পাই। কী মিষ্টি রোদ চতুর্দিকে! সোনার আলোয় ভরে উঠেছে দিগ্বিদিক। কিচেনের বেয়ারা হাতে গরম চা ধরিয়ে দিয়ে গেল। ধোঁয়া ওঠা কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবি, এই যে বাংলা নামে দেশ। বিধাতা কী সুন্দরভাবে তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য। অপার বিস্তৃত নদীপথ, সোনালি চরে সবুজ ধান, আকাশ নেমে এসেছে ধানক্ষেতে, গরু চরছে ইতস্তত। নদীকূলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মধ্যে মেয়েরা শাড়ির অআঁচল পেতে পোনা ধরছে। কিশোর বয়সীরা নদীর পাড় থেকে দিগম্বর হয়ে লাফিয়ে পড়ছে নদীজলে। এই তাদের আনন্দ, নদীজলে কিছুক্ষণ খেলা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘এখানে আমি একলা খুব মুগ্ধ এবং তদ্গত চিত্তে অর্ধনিমীলিত নেত্রে গেয়ে থাকি এবং জীবন ও পৃথিবীটা একটি সূর্যকরোজ্জ্বল অতি সূক্ষ্ম অশ্রু বাষ্পে আবৃত হয়ে, সাতরঙা ইন্দ্রধনু রেখায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দেয়।’

নদী আমায় ডাকে, এখনো ডাকে।

 

প্রথম প্রকাশ : সাহিত্য সাময়িকী, প্রথম আলো, ৮ অক্টোবর ২০১০