নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হকসৈয়দ শামসুল হক

\ ৩১ \

 সেই ওয়াহেদ ডাক্তারের কথা আমরা ভুলি নাই। রাতের জলেশ্বরীর ভুতভুতুম সড়কে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের কেয়ারটেকার সোলেমান এখন বুড়ির চরের পথে, গন্তব্য তার হাফেজ আবুল কাশেম বলরামপুরীর নিবাসে। মনিবের তাগাদা তাকে ধরি আনো। ধরি আনো মানে পারিলে তাকে বান্ধি আনো। হয়, হয়, বান্ধি আনিবারই কাম বটে। এত রাইতে কুসমির ঘরে মনিব! আর এটাও সোলেমান কেয়ারটেকারের অজানা নাই যে, কুসমির পুত্রসন্তান শ্রীচরণই এখন তামাম সম্পত্তির হকদার, সেই সম্পত্তির দিকে অঢেল চোখ তার মনিবের,যে-প্রকারেই হোক এ-সম্পত্তি তার হস্তগত করা চাই-ই চাই। সোলেমানের রোমাঞ্চ হয় ভেবে যে, হয়তো আজ রাতেই তার মনিব নিকা করবেন কুসমিকে। অনেকদিন থেকেই মনিবের ভাবসাব সে লক্ষ করছিলো, ধমকে না হয়, আদালতের পরিষ্কার কাগজে না হয়, কেল্লা ফতে হয় সম্পত্তির আসল হকদার নাবালক ছেলের বিধবা মাকে নিকা করতে পারলেই। কুসমি বোধহয় আজ রাজি হয়েছে, আর তাই মনিবের হুকুম বিয়া পড়ানোর কাজী বলরামপুরীকে ধরি আনো।

সোলেমান তো বুড়ির চরের দিকে চলেছে, ওদিকে কুসমির বাড়িতে নিশীথরাত গভীরে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান শুরু করেছে ওয়াহেদ ডাক্তারের গল্প। হ্যাঁ, ওয়াহেদ ডাক্তার! তার কথা শোনো তবে! হিন্দুস্থান পাকিস্তানের গতিকে মানুষ ক্যামন পাগলা হয়া গেইছিলো তারে বয়ান তবে শোনো। এত বলে কন্ট্রাক্টর ওয়াহেদ ডাক্তারের গভীরে প্রবেশ করে।

ওয়াহেদ ডাক্তারের সম্বল চামড়ার এক বাক্সো, তাতে ওষুধের ছোট ছোট শিশি, এক থার্মোমিটার আর গলায় নলি সাপের মতো প্যাঁচ দেওয়া স্টেথোস্কোপ। কিন্তু হাতের কী গুণ! ধন্বন্তরি বলিলেও কম কওয়া হয় হে। হরিষালের আশেপাশে পাঁচ-সাত ক্রোশ পর্যন্ত তাঁর নামডাক। সেই মান্দারবাড়ি হস্তিবাড়ি থেকেও তাঁর কাছে রোগী আসে ধূলিসড়ক ভেঙে। এমনকি জলেশ্বরী পর্যন্ত তাঁর ডাক পড়ে মানুষের নিদানকালে। শেষ চিকিৎসা তাঁরই হাতে। মরণের হেঁচকি টান উঠেছে। অ্যালোপাথি কবিরাজি ফেল। শেষ ভরসা, ডাকো ওয়াহেদ ডাক্তারকে। জীবন ফিরিয়ে দিতে না পারুক, রোগীর শেষ যন্ত্রণা কমাতে তাঁর জুড়ি নাই। মরণোন্মুখ অস্থির এপাশ-ওপাশ করা মানুষের গায়ে ওয়াহেদ ডাক্তার এসে একবার হাত রাখলেই –  শান্ত, নিঃশ্বাস মুহূর্তে সরল। – আল্লার নাম করেন। যাবার সময় কান্দিয়া না সাগর করেন। জগতে মানুষ আসে, মানুষ যায়। ইয়ার তো ব্যত্যয় নাই। তারপর রোগীর গা থেকে ধীরে হাত সরিয়ে বাক্সো তালাশ করে লাল এক ফোঁটা ওষুধ আঙুলের ডগায় তুলে রোগীর মুখে দিলেন। যেন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মুখে ওষুধ নয়, নবজাত শিশুর মুখে মধু চাখালেন। – ওষুধ উয়াকে নয়, আজরাইলকে দিলোম, তার ভয়ভীতির কালা আলখাল্লা অঙ্গ হতে এইবার খসি পড়িবে, তাঁই দ্যাখেন কেনে শান্তিতে এলা জান কবচ করিবে, আল্লার মাল আল্লার কাছে পালকের বিছানায় তুলি নিয়া যাইবে। মানুষটা তখন আকুল চোখে বিশ্বচরাচর একবার দেখে নিয়ে শেষবারের মতো চোখ বোঁজে। যেন সোনার শিশু ঘুমে ঢলে পড়ে। – ন্যান এলা, শেষকাজের জোগাড় করেন। মানুষ যখন আসে, জগৎ হাসে। যখন যায়, জগৎ কান্দে। এমন হৃদয়ছোঁয়া কথায় স্বজনের কান্না বাঁধ ভেঙে প্লাবিত করে মাটি। ডাক্তার ভিজিট না নিয়ে সাইকেলে উঠে চলে যান। মরণের ঘরে ভিজিট নিতে তাঁর হাত সরে না। পরে বাড়িতে পৌঁছে দিলেও ফিরিয়ে দেন। এ তো জলেশ্বরীর সবার চোখে দেখা ঘটনা।

তবে আরো শোনেন। হ্যাঁ, বাচ্চার কান্দন থামে না। নদীর জল থেকে বাচ্চা রোহিত মাছ যেন জালে ধরা পড়েছে, কেবলি তার লেজের আছাড়িবিছাড়ি। মাছের ভাষা নাই, মানুষের আছে। মানুষের প্রথম ভাষা – কান্না। আহ, জগৎ কেঁদে ওঠে শিশু যখন কাঁদে। হাতে কাঠের রাঙা নোলা ধরিয়ে দিলে ভোলে না। মুখ মাই গুঁজে দিলেও থামে না। যান তবে, ওয়াহেদ ডাক্তারের কাছে বাচ্চাকে ধরি যান। একবার এক পলক দেখিয়াই তাঁই এক ফোঁটা ওষুধ বাচ্চার মুখে টস্ করি ঢালি দিবে। তারপর ওই এক ফোঁটা, মুখে ঢেলে দিতেই – শান্ত, মুহূর্তে বাচ্চার মুখে হাসি। কী, প্রসবব্যথা উঠেছে পোয়াতির। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায়, খালাশ আর হয় না। নারীরা তাদের স্মরণাতীত কালের সকল চেষ্টা সাধ্য করে ব্যর্থ, এখন তারা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে পোয়াতির দিকে। ভয় কী! ওয়াহেদ ডাক্তার আছে! ডাকো তাকে। রাতদুপুর হোক কি অবেলাই হোক। ডাক পাঠালেই সাইকেল ঠেলে চলে আসবেন তিনি। সাইকেল তো নয় – ঘোড়া! ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে তিনি সাইকেলে লাফ দিয়ে উঠে বসবেন। প্রথমে কিছুক্ষণ সাইকেলটাকে ঠেলবেন আর ঠেলবেন, আর সাথে সাথে হ্যান্ডেল ধরে দৌড়ুবেন, তারপর সেই এক লাফ, ব্যস, সাইকেলের পিঠে! ভুটানি ঘোড়ার মতোই তার সাইকেল আল মাঠ পাগাড় পাথার আদাড়বাদাড় ভেঙে অবলীলায় ছোটে। বর্ষা কি রোদ্দুর তার গ্রাহ্যি নাই। এসে গেছে ডাক্তার। এলা দ্যাখেন কী হয়! আসিয়া তিনি পোয়াতিকে মা বলিয়া ডাক দিতেই অর্ধেক আরাম। পোয়াতি চোখ মেলে ব্যাটাছাওয়া ডাক্তার দেখে যদিবা শরম করে, আবার গাঢ় গলায় মা বলিয়া ডাকি উঠলেন তাঁই। তারপর পেটের ওপর হাত রেখে চক্রাকারে একবার দুবার মালিশ করলেন, দিলেন এক ফোঁটা ওষুধ। ব্যস – অ্যালা জননীরা আসেন, মুঁই বাইর বাড়িতে রইলোম, বাচ্চার কান্দন শুনিয়া ফির যামো। তেমন হলে বাচ্চার কানে আজানটাও দিয়ে দেন ওয়াহেদ ডাক্তার। – নব বাচ্চা বলিয়া কথা, বেহেশত হতে গজবের দুনিয়ায় আসিছে, আজান শুনিয়া আল্লা নাম শুনিয়া ভবযাত্রা শুরু করুক।

জলেশ্বরীতেও তাঁর ডাক আসে, তবে কালেভদ্রে। আসলে সেখানে তাঁকে যেতে হয় ট্রেন ধরতে। রংপুরের ট্রেন। সেখান থেকে পার্বতীপুর হয়ে কোলকাতা। রাতের দার্জিলিং মেল ধরে কোলকাতা পরদিন ভোরে, সারাদিন কোলকাতায় থেকে আবার সন্ধ্যার দার্জিলিং মেল ধরে, ওই পার্বতীপুর হয়ে রংপুর, রংপুর থেকে জলেশ্বরী আসতে আসতে রাত্রিকাল। যাত্রার সময় স্টেশনেই মাস্টারবাবুর জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন সাইকেল। রাতেই আধকোশা পাড়ি দিয়ে ধুম নিশীথের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে শেষরাতের দিকে হরিষাল। আবার কোনো কোনোদিন মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়িতে রাতটা থেকে যান। কিংবা মোখলেছুর রহমান দালালের কাছে। তবে মোক্তারের সঙ্গে তার বিশেষ ভাব, অনেকদিনের বন্ধুত্ব। সেই কিশোরবেলা থেকে। একবার সেই কিশোরবেলায় বাড়ি পালিয়েছিলেন দুজন। সোজা কোলকাতায় গিয়ে উঠেছিলেন। ফিরে এসেছিলেন চারদিন পরে। কোলকাতায় প্রথম যাবার সেই স্মৃতি এখনো দুই বন্ধুর মনে উজ্জ্বল। এখনো তাদের সে কথার বিরাম নাই। যেন তাদের বয়সই এখনো হয় নাই। যেন এখনো তারা হদ্দ পড়াগাঁর সেই কিশোর দুজন যারা ব্রিটিশ বাংলার রাজধানী কোলকাতায় গিয়ে উপস্থিত।

যেদিন কোলকাতা থেকে ফিরে ওয়াহেদ ডাক্তার মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়িতে ওঠেন, মনে হয় বহুদিন পরে আরামের স্থলে রাত্রিবাস করতে এসেছেন। ভাতটাত খাবার পরে দুজনে যখন উঠানে কাঁঠালগাছের তলায় চেয়ার পেতে বসেন, রাত গাঢ় হতে থাকে, নিঝুম নিশীথ যেন শরীর ধরে হাওয়ার আঙুলে যখন দুজনের গায়ে পরশ বুলোয়, তখন কোলকাতার কথা ওঠে। সদ্য কোলকাতা ফেরত ওয়াহেদকে দেখে নদীর গভীর জলে মাছের ঘাই মারার মতো কোলকাতা আলোড়ন তোলে মোখলেছ দালালের মনে।

শিয়ালদহের সামনে ভাতের হোটেলটা কি আছে, ওহেদ? মনে আছে তোমার, খায়াদায়া পাইসা দেবার কালে দ্যাঁখো পাইসা শর্ট, শেষকালে জামাকাপড় খুলি নেয় আরকী! মুঁই তো কান্দিয়া ভাসাও। – হা হা হা, আর মোরও তখন মুতিয়া, হা হা হা। – সেইকালে এক ভদ্দরলোক পকেট হতে পাইসা দিয়া যে হামাকে উদ্ধার করিলে, কও এলা? ত্যামোন ভালোমানুষ এ জমানায় দুনিয়ায় বড় দুষ্কর, হয় কি নয়! তা কী করিলেন কলিকাতায় এ যাত্রা। – পর্তিবার ঝাঁ করো তাই, ওষুধ কিনিলোম মহেশ ভট্টাচারজের দোকান হতে। আমেরিকার বিটি কোম্পানির অরিজিনাল ওষুধ, আমদানি করি আনে। ডিস্টিল ওয়াটার কিনিলোম। গ্লোবিউল কিনিলোম। হেথায় গেরামের মানুষ গ্লোবিউলকে কয় টিকটিকির ডিম। ঘ্যাগের ওষুধও কিনিলোম। আইজকাল ঘ্যাগ বড়ো বাড়ি গেইছে হামার দ্যাশে। পানির দোষ। আয়রনের পানি খায়া এই হাল সববার! অ্যাতো কই, তাও মানুষে শোনে না যে পানি তুলিয়া ফিটকিরি দিয়া শোধন করি ব্যবহার করেন, তা কাঁই শোনে। মহেশবাবুর দোকানের মানুষও হামাকে শরম দিয়া কইলে, ঘ্যাগ কি তোমার দ্যাশে পারমানেন্ট হয়া গেইলো! – তারা কলিকাতার মানুষ, সুবুদ্ধি দিতে কার্পণ্য নাই। ধরমতলায় না দোকানখান? – হয় হয়। লাইন ধরি ওষুধ নিতে হয়। গাহাকের সুমার নাই। দোকান রবরবা! দেখিলে না প্রত্যয় হয়। কুমিল্লা হতে আসি মহেশবাবু দোকানখান দিছিলো বলিয়া হানিমানের হোমিওপ্যাথি এলাও ভারত বাংলাদেশে গৌরব ধরি আছে। – নাখোদা মজ্জিদে কী গেইছিলেন? সেই বারান্দাখান কি তেমনই আছে? সেই যেইখানে দুইভাই রাইত কাটাই? – নাহ্, এইবার যাওয়া পড়ে নাই। নামাজের গাফিলতির জন্যে শরমিন্দা হবার ধাত নয় ওয়াহেদ ডাক্তারের। বুক চিতিয়ে বলেন, নমাজ তো তেমন পড়ো না। শুক্কুরবার হইলেও কথা ছিলো। হয় হয়, গত যাত্রায় দেখি আসিছোঁ, বারান্দাখান তেমনে আছে – ঝকঝকা, শীতল। – নমাজ পড়িলে? – নাহ্, সামোনে যে-হোটেলখান আছে, পরোটা গোশত বড় বাদশাহী তৈয়ার করে। সেই কারণে! প্যাট ভরি হাউস পুরা করি খাঁইছে। তোমার কথাও মনে পড়িছিলো।

তখন মইনুল হোসেন সোৎসাহে বলে ওঠে, হয়, হয়, পরথমবার যে গেইলোম, সুবাসে প্যাটের নাড়ি পাক দিয়া উঠিছিলো। মনে আছে। পাইসা নাই, জিভায় পানি আসিলেও উপায় নাই। হা হা হা। আরেক কথা মনে পড়িলো। হোটেলের সামোন হতে মজ্জিদে গিয়া উঠিলোম দুই ভাই। মনে আছে তোমার? দোতলায় হাউজের কাছে গেইলোম যে পানি খায়া প্যাট পূরণ করি। দেখি, এক হুজুর, তার সামনে বসা এক বেটিছাওয়া, ছবির মতো সুরত, বড়ঘরের হয় বা! তার বাচ্চা হয় না। তাবিজ নিবার আসিছিলো। হুজুরে কয়, হইবে হইবে, আল্লার উপরে ভরসা রাখেন আম্মা। বেটিছাওয়া উঠিতে যায়া হামার পায়ে লাগিলো তার পাঁও। মুঁই তো অকুল হয়া গেইলোম। বেটিছাওয়া নিরিখ করি হামাক দুইঝনে বেবন্দোবস্ত দেখিয়া বুঝি মায়া উথলি উঠিলো। কইলে ঝে, দুফরে খাও নাই কিছু, মুখখান শুকনা দ্যাঁখো। এই বলিয়া বটুয়া খুলি নোট দিলে – যাও কিছু খায়া আইসো। – হয়, মনে আছে হে। তোমারে তো বুদ্ধিখান ছিলো ঝে ইয়াকে বলিলে রিটান টিকিটের পাইসাটাও দিবার পারে। – দিছিলো তো! বড় দয়া করিছিলো। তাবিজ যে নিলে, আল্লায় ঝানে তার বাচ্চা হয় কিনা! একজন বলে, একজন শোনে। দুজনের দীর্ঘনিঃশ্বাস একসাথে পড়ে। আমাদেরও।

আমাদের কত কিছুই যে জীবনে আর জানা হয় না! পথেঘাটে হঠাৎ দেখা একেকটা ঘটনা আমাদের মনে দাগ কেটে বসে যায়। হয়তো কাউকে কাঁদতে দেখেছি। কিংবা নতুন কোনো বরবৌ দেখেছি। অথবা, কাউকে উদাস একা বসে থাকতে দেখেছি। আর ভুলতে পারি নাই। জানতে ইচ্ছা করে, সে যে কেঁদেছিলো, কেন কেঁদেছিলো? সেই যে বরবউ, ভীত চকিত সেই যে বউটির চাউনি, এখন সে নিশ্চয়ই দজ্জাল গিন্নি। কল্পনা করতে ইচ্ছা করে কেমন সংসার তার! আর, সেই যে লোকটি উদাস বসেছিলো, তার গল্পটাই বা কী! জানা হয় না। জানবার কোনো সুসার পথ নাই। মনের মধ্যে ছবি শুধু। সে ছবি স্থির নয়, আবার, চলচ্চিত্রের মতো সে ছবি কোনো পরিণতির দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে না। নাখোদা মসজিদে দেখা – সেই মহিলার সন্তান হয়েছিলো কিনা, কতবার যে ওয়াহেদ ডাক্তার আর মইনুল হোসেন মোক্তার স্মরণ করেছে আর বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে ভেবে! মহিলাটির কথা মনে পড়ে তিনি যে তাদের ট্রেনভাড়া দিয়েছিলেন, সেই কারণে? নাকি তার সন্তান কামনায় তাবিজ-কবচের জন্যে আসা বলে? নাকি, যে-হরিষালের মাজারে বাঁজা নারীরা আসে সন্তান কামনায় প্রার্থনা নিয়ে, গাছের ডালে লাল সুতা বেঁধে তারা যে মানত করে, সেই লাল সুতায় সুতায় যে অশথ গাছটা ভরে উঠেছে, সেটাই কি তাদের ভুলতে দেয় না কোলকাতার সেই মহিলাকে?

শুধু কি মইনুল হোসেন মোক্তারের সঙ্গে কোলকাতা-ফেরত সে গল্পগুজবে রাত কাটায়? ওয়াহেদ ডাক্তারের আরো একজন প্রাণের বন্ধু আছে, অথবা ছিলো, মোখলেছুর রহমান। কিন্তু মোখলেছ দালালের কাছে যেতে আজকাল তাঁর মন চায় না। গেলেই রাজনীতির কথা। সেই মুসলিম লীগ, সেই জিন্নাহ। নতুন এক ধুন উঠেছে – হাতে বিড়ি মুখে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কবুল মোদের জানপরান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। মোখলেছ দালাল সুর করে বলেন আর হাসতে হাসতে দাবাড় দেন, দ্যাখেন না কেনে পাকিস্তান হইলে মোছলমানের উন্নতি কাঁইও না আর রুখিবার পারিবে। মোছলমানের আসল কাঁটা বিটিশ নয়, হিন্দু হিন্দু। হিন্দু একবার দ্যাশ হতে গেইলেই সোনার ঘর হইবে তোমার।

ওয়াহেদ ডাক্তার চুপ করে বসে থাকেন। তারপর বলেন, আমি ডাক্তার, আমার কাছে রোগী রোগী, রোগীর কোনো হিন্দু মুসলমান নাই। এ-কথা শুনে মোখলেছ কিছুক্ষণ নিরিখ করে ডাক্তারকে দেখে নিয়ে বলেন, তোমার ভাষা যে হিন্দুর মতো হয়া আসিছে! – না! ভাষারও কোনো হিন্দু মুসলমান নাই! – কলিকাতা হতে আসিছেন তো! হিন্দুর রসে ভাসি আছেন। পুটকি যখন মারিবে তখন টের পাইবেন! শেষ পর্যন্ত ঝগড়ার গতি হয় দুই বন্ধুর। না, মোখলেছ দালালের কাছে আজকাল আর, বিশেষ করে পাকিস্তানের ধুন ওঠার পর থেকে, বিশেষ আর যাতায়াত নাই ওয়াহেদ ডাক্তারের।

না, দালাল মোখলেছের পারিবারিক পদবি নয়, ওটা তার পেশা পরিচয়। মাড়োয়ারিদের পাটের গদিতে বসতো, পাটচাষিদের কাছ থেকে পাট কিনতো মাড়োয়ারিদের জন্যে। সোজা বাংলায় যাকে বলে দালালি। চাষীরা তাকে সম্ভ্রম করে রহমান মিয়া বলে ডাকলেও, বাজারে মুখে মুখে তার নাম হয়ে পড়েছিলো মোখলেছ দালাল। তারপর পাকিস্তান হলে মাড়োয়ারিরা জলেশ্বরী ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলে মোখলেছুর রহমান নিজেই মহাজন হয়ে গদি খোলে। পাটের মহাজন। ফাঁকা সময়ে দুদিনেই তার কারবার জমে ওঠে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে মিলিটারি কিছু জিপগাড়ি নিলাম হতে থাকে। মোখলেছুর রহমান একটা জিপ কিনে ফেলে। জিপ চড়ে শহরে ঘোরাফেরার অবকাশ নাই। ছোট শহর। জিপখানা হাতির মতোই বাড়ির সদরে বাঁধা থাকে। পাটচাষিরা ভড়কে থাকে তাঁর জিপ হবার সুবাদে। পাটের দামাদামি অধিক করতে সাহস পায় না। যে যেখানে যা করছে সবই পাকিস্তান হবার আতরগন্ধী গরবে। হ্যাঁ, আতরই বটে। পাকিস্তানের সেই আওয়াজ তোলা বছরে বাতাসেও যেন আতরের খোশবাই। তবে, দুর্গন্ধের মধ্যে ওইটুকু – দালাল নাম মোখলেছুর রহমানের ঘোচে নাই।

সেই মোখলেছ দালালের সঙ্গে একবার, হিসেবমতো দ্বিতীয়বার, ওয়াহেদ কোলকাতা যায় তার নবীন বয়সে। গিয়েছিলো এক মাড়োয়ারি যুবকের অঘোষিত পাহারাদার হয়ে। তাও ঠিক নয়। আসল পাহারাদার ছিলো মোখলেছ দালাল, দুনো সাবধানতার জন্যে নিজের খরচে বন্ধু ওয়াহেদকে সে সঙ্গে নেয়। না, ওয়াহেদ তখনো ডাক্তার হয় নাই। ব্যাপারটা এই – সেকালে এখান থেকে ওখানে মোটা টাকা পাঠাবার নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যবস্থা ব্রিটিশ বাংলায় ছিলো না, বিশেষ করে জলেশ্বরীর মতো দূরপ্রান্তের ছোট শহর থেকে। আমরা ব্যাংকের কথা যদি তুলি – কেন, ব্যাংক মারফত টাকা পাঠানো যেতো না? হা কপাল! জলেশ্বরীতে তখন পর্যন্ত ব্যাংক থাকা দূরে থাক, ব্যাংক যে কী বস্ত্ত ভালো করে কেউ জানেও না। আলামোহন দাসের ছিলো দাস ব্যাংক। আর ছিলো, হাজরাদি ব্যাংক নামে এক ব্যাংক। দুটোই ছিলো প্রাইভেট ব্যাংক। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার নথিভুক্ত ছিলো না এর কোনোটাই। ব্যাংক যদি ফেল করে কি হঠাৎ পাততাড়ি গুটায় তো জমাকারীদের মাথায় হাত। একদিন তো হঠাৎ করেই দেখা গেলো রংপুরের হাজরাদি ব্যাংকে তালা ঝুলছে। লোকজন সব লাপাত্তা। ব্যাংকে যারা টাকা রেখেছিলো তারাও এক মুহূর্তে পথের ভিখিরি। অতএব, ব্যাংকের প্রশ্ন অবান্তর। সেকালে তখন টাকা পাঠাতে হলে এক-আধশর জন্যে ছিলো মানিঅর্ডার, আর দু-পাঁচশো পাঠাতে ডাকঘরের মারফত ইনশিউর করা খামে। সে ইনশিউর নিয়েও কত সাবধানতা। একশ টাকার নোট সমান ভাঁজ করে ছুরি দিয়ে কেটে দুভাগ করা হতো। তারপর একভাগ পাঠানো হতো এক খামে, আরেকভাগ দ্বিতীয় আরেকটা খামে। প্রাপক যখন পেতো, দুটো খাম খুলে নোটগুলো আবার জোড়া দিতো। কিন্তু জোড়া দেওয়া নোট তো বাজারে কেউ নেবে না। তাই সেগুলো ট্রেজারিতে গিয়ে বদলে নেওয়া হতো। কিন্তু হাজার কি লক্ষ টাকা? তার বেলায়? তখন লোক মারফত পাঠানো ছাড়া উপায় ছিলো না।

সেবার মোখলেছ দালালের মালিক মাড়োয়ারির কী কারণে যেন দরকার হয়ে পড়ে মোটা একটা টাকা কোলকাতা পাঠানোর। টাকা নিয়ে যাবে মাড়োয়ারি এক যুবক। পথে যদি কোনো আপদবিপদ হয়, তার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে মোখলেছ। ট্রেনে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতা তার একটু ভালো রকমই ছিলো। পাটের দালালি ধরবার আগে কিছুদিন সে ক্যানভাসারি করেছে অম্রুতাঞ্জন মালিশ মলমের। রংপুর থেকে ঈশ্বরদি পর্যন্ত তার যাতায়াত ছিলো ট্রেনে ট্রেনে। বড় জবর মলম ছিলো অম্রুতাঞ্জন। মাথা ধরেছে? কপালে দুপাশে লাগাও, মাথা ধরা নিমেষে উধাও। চোট পেয়েছো পিঠে কি হাতে পায়ে, রগড়ে একবার মালিশ করলেই বিষবেদনা নাশ। অবশ্য মোখলেছকে তার মালিক বলে নাই যে, ভাতিজাকে টাকা দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। শুধু বলা হয়, ছোকরা একা যাচ্ছে, তুমি সাথে যাও। একদিন পরে তাকে আরো বলা হয়, ছোকরা যাচ্ছে শাদি করতে। তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসা পর্যন্তই তার কাজ। শাদির খোয়াবে বিভোর যুবক, দার্জিলিং মেল পার্বতীপুরে বেশিক্ষণ দাঁড়ায়ও না, যাত্রীরও ভিড় অসম্ভব, পাছে ট্রেন ফেল করে, যুবকের সঙ্গে তাই লোক থাকা ভালো। মোখলেছ মুহূর্তে রাজি। কতকাল ট্রেনে চড়া হয় নাই। তাও হেথা থাকিয়া কলিকাতা!

বাতাসে ওড়ে মোখলেছ। ব্রিটিশ বাংলার রাজধানী কোলকাতা। আরে বাস! খবরটা দিতে হয় প্রাণের বন্ধু ওয়াহেদকে। খুঁজতে খুঁজতে ওয়াহেদের সঙ্গে কাছারির মাঠে দেখা। হরিষালের ছেলে, জলেশ্বরীতে এসে বেওয়ারিশ থাকে। মাড়োয়ারিপট্টিতে গুদামের বারান্দায় কিছুদিন রাত কাটায়। তারপর কাছারির মাঠে মসজিদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলো। সেখান থেকে কাছারির বটগাছের নিচে উমেশবাবুর চায়ের দোকান, সেখানে বিস্কুট সাপ্লাই দেয় হাফেজমিয়া, সেই হাফেজমিয়ার বাড়িতে কী করে আশ্রয় জুটে যায় ওয়াহেদের। বন্ধুত্বও হয়ে যায় মোখলেছের সঙ্গে ওই উমেশের চায়ের দোকানেই। ওয়াহেদের মুখে সারাক্ষণ অদ্ভুত একটা ক্ষুধার্ত ছাপ। চোখের ভেতরে বিদ্যুতের ঝিলিক। কী যেন সন্ধান করছে, কিন্তু পাই-পাই করে পাচ্ছে না, কেবলি ফসকে যাচ্ছে, চোখের ভেতরে তারই যেন তড়াস সর্বদা। মোখলেছের মাঝে মাঝে উন্মাদ মনে হয় তাকে। তবু বন্ধুত্ব ছাড়ে না। কী যেন একটা আকর্ষণ আছে ছেলেটার। অবসর পেলেই মোখলেছ ঘুরেফিরেই ওয়াহেদের সন্ধান করে। আজো কোলকাতা যাবার খুশিতে সে কাছারির মাঠে আসে। দ্যাখে, ওয়াহেদের হাত মুঠো করা, সেই মুঠোর দিকে নিজেই সে তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। মোখলেছকে দেখেই সে বলে, বল মোর মুঠিতে কী? মোখলেছ নিশ্চুপ। তখন চোখ পাকিয়ে ওয়াহেদ বলে, সোনা! মোর মুঠিতে সোনা! মোখলেছ হাঁ! পাগলা বলে কী! ঝপ করে মুঠি খুলে দেখায় ওয়াহেদ। মুঠোর ভেতরে মাটি! মোখলেছ বলে, এই তোমার সোনা? – কেনে নয়? মাটি হতেই সোনা, হয় কি নয়? – তোর মাথা বিগড়ি গেইছে। জলেশ্বরীর মাটিতে মংগা লাগি আছে। সোনা কোনঠে? তুই সোনা দেখলু? আকাল অভাগা লাগিয়াই আছে হেথা। সোনা যদি থাকে তবে আছে কলিকাতায়। জলেশ্বরীতে তুই পচিয়া মর্, মুঁই কলিকাতা চননু।

কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ওয়াহেদ। তার হাতের মুঠি আলগা হয়ে পড়ে। ঝুরঝুর করে মাটি ঝরে পড়ে। সেদিকে লক্ষ নাই সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মোখলেছের দিকে। তার চোখের বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সেই যে সে কিশোর বয়সে একবার কোলকাতা গিয়েছিলো মইনুল হোসেনের সঙ্গে, সেই কোলকাতার ঘ্রাণ বাতাস তার হৃদয়ের ভেতরে আছড়ে পড়ে। দুম করে সে উঠে দাঁড়ায়, মোখলেছের হাত চেপে ধরে বলে, তবে হামাক সাথে নেও না কেনে? হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মোখলেছ হেঁ-হেঁ করে হেসে ওঠে। – মুঁই এক কামে যাঁও। মাড়োয়ারি হামাক পাঠাইচ্ছে এক দায়িত্ব দিয়া। এই যামো আর পরদিন ঘুরি আসমো। তোমাক সাথে নিলে ফির যদি তারা গোসা হয়। – হবার নয়। মুঁই নিলীন হয়া তোমার সাথে থাকমো। যাত্রী হয়া যামো। কলিকাতা হতে পরের দিন আসিবে ক্যানে? দুই ভাই ঘুরিঘারি শহর দেখমো।

কথাটা মনে ধরে মোখলেছের। বন্ধুকে সে সঙ্গে নেয়। তবে প্রকাশ করে না যে তাকে সে ডেকে নিয়েছে। যেন ওয়াহেদও কোলকাতায় যাচ্ছে, ইস্টিশানে হঠাৎ দেখা, অতএব একসঙ্গে ট্রেনে ওঠা। শহর দেখার উত্তেজনায় বিভোর ছিলো মোখলেছ – গড়ের মাঠ, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, নাখোদা মসজিদ, ট্রাম – আহ, কী তাজ্জব দ্যাখো, সড়কের উপর ঝ্যান টেরেন চলিচ্ছে! আর, বিল্ডিং বা কী উঁচা! বিল্ডিংয়ের মাথা লক্ষ্য করিতে মাথার পাগড়ি খসি পড়ে! বৈঠকখানায় ছিলো জলেশ্বরীর এক পরিচিত মানুষ – হাবিবুল্লা। বহুদিন থেকে কোলকাতায় তার বাস। পোর্ট অফিসে চাকরি করে। বৈঠকখানা রোডে পুস্তক বাঁধাইকারীদের আড্ডা। তারা সব মানিকগঞ্জের মানুষ। পরিবার কেউ আনে নাই, থাকে ঘরভাড়া নিয়ে। হাবিবুল্লা তাদের ওখানেই বহুদিন থেকে থিতু। তারও পরিবার জলেশ্বরীতে, একা সে কোলকাতায়। বছরে দুবার বাড়ি যায়। এখানে মানিকগঞ্জী মানুষের হিসাবকিতাব দেখা, চিঠিপত্র লেখা কি মানিঅর্ডারের ফরম পূরণ করা তার সন্ধ্যাকালের কাজ। এর বিনিময়ে বিনাভাড়া বিনা খাইখরচে হাবিবুল্লার দিন চলে। মাহিনার টাকা আর তাকে থাকাখাওয়া বাবদ ভাঙতে হয় না।

সেই হাবিবুল্লাকে কী কুক্ষণেই যে খুঁজে বের করেছিলো মোখলেছ। – আইসো, আইসো, কলিকাতায় তবে আসিলে! কাকে আনিছো সাথে? – হামার দোস্ত। হরিষালে বাড়ি, থাকে জলেশ্বরী। নাম ওয়াহেদ। – তোমারে মতো পাটের দালালি করে? – ভেরেন্ডা ভাজে! হাতে মাটির মুষ্টি তুলিয়া কয় বোলে – সোনা! হা হা হা! মোখলেছের সে-হাসিতে যোগ না দিয়ে হাবিবুল্লা তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, সোনাই তো! দ্যাশ যাঁই ছাড়িছে তাঁই ঝানে দ্যাশের মাটি কতখান বা সোনা! মোখলেছ কি জানতো, তার ওই কথা এতখানি আলোড়ন তুলবে হাবিবুল্লার মনে? – আমি যে কলিকাতায় আছি, সর্বসময় জলেশ্বরী আমার পাছে পাছে হাঁটে। জলেশ্বরী ভিতরে আমার বুদবুদ কাটে। আধকোশার পানি বুকের ভিতর উথলি ওঠে। তারপর এ-কথা সে-কথা, সুখদুঃখের কথা। একসময় মোখলেছ লক্ষ করে হাবিবুল্লা কথা বলছে ওয়াহেদকে উদ্দেশ করে। সম্পর্কের ভাতিজা যে মোখলেছ, তাকে ছেড়ে হাবিবুল্লা যেন ওয়াহেদকেই আপন করে নেয়।

কলকাতার গল্পে মোখলেছ আর ওয়াহেদের গল্পে ওয়াহেদের হোমিও ডাক্তার হয়ে ওঠার গল্পে বিভোর আচ্ছন্ন রাত্রির ঘন ঘোর লাগা শেয়াল ডাকা গাছের ডালে হঠাৎ ঝটপট করে ওঠা কুসমির বারান্দা উঠান। কুসমি মোড়ায় বসে, কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান চেয়ারে, পায়ের কাছে স্তিমিত লণ্ঠন, কুসমির হাতে হাতপাখার বাতাস, গল্প হঠাৎ থামিয়ে সাইদুর রহমান আভোল চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন কুসমির দিকে।

কুসমি বলে, থামিলেন কেনে? তার বাদে কী হইলো? মোখলেছ কি অহেদ ডাক্তারকে কলিকাত্তায় রাখি দ্যাশে আসিলো? কিন্তু আর সে-প্রসঙ্গ যেন বাতাসে নাই, সাইদুর রহমান নিরুত্তর থাকেন অনেকক্ষণ। তখন কুসমি বলে, অনেকটা ওই বিহবল দৃষ্টির সমুখ থেকে সরে যাবার তাড়নাতেই বুঝি, তবে চা করি দেমো এক কাপ? এর উত্তরও খুব ভাবনা করে দেন সাইদুর রহমান, যেন অকুল এক সমস্যার সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, দেও! যদিকালে কষ্ট না মনে করো! কুসমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, কষ্ট বা কিসের? এ সকল হামার কষ্ট নয়, কষ্ট যদি শুনিবার চান ত মহাভারত হয়া যাইবে। – মহাভারত! সাইদুর রহমান দুলে দুলে অল্প অল্প হাসেন। – মহাভারত! ইন্ডিয়ার টেলিভিশনে সিরিয়াল নাটক দেখার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। তাঁর ঘরের স্ত্রী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, তিরিশ দিনের রোজা, আর হজে যাওয়ার বায়না তো লেগেই আছে বছরের পর বছর – পাপের সংসার হতে হামাকে মুক্তি দ্যান, আল্লার ঘরে নিয়া যান – সেই স্ত্রী কী মশগুল হয়েই না মহাভারতের সিরিয়াল দেখতো, তার দেখাদেখি সাইদুর রহমানও একরাতে টিভির সামনে বসে যান, অচিরে তাঁরও মন বসে যায় মহাভারতে, তিনিও সে কাহিনির টানে রাতের পর রাত বহুদূর পর্যন্ত ভেসে যান। তিনি যে মুসলমান ঘরের, হিন্দুর এ সকল কাহিনি যে তাঁর জন্যে অপকথা, এমন কথা একবিন্দু মনে ওঠে নাই – যেন এও সত্য, ওও সত্য, কিংবা সত্যমিথ্যার কথা নয়, দুই-ই আছে পাশাপাশি, যেমন দুই প্রতিবেশী, অধিক কি – বিবাদ যদি লাগে তবে তা দুই সতীনের মতো মাঝে মাঝে, তখন সতীনও যেমন সত্য, তাদের বিবাদও সত্য, এক শরীরের নিচেই দুইয়ের শয়ান! মুগ্ধ হয়ে সিরিয়ালটা দেখেছেন সাইদুর রহমান স্ত্রীর পাশে বসে, রাতের পর রাত। তারপর সিরিয়ালটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় যেদিন, কেমন একটা বলশালী শূন্যতা নেমে আসে ঝপ করে, যেন উড়ে চলেছিলেন পরী দানব দেবতার দেশে, ঝপাং করে ভূতলে পতিত হন। তিনি হাসতে থাকেন। বলেন, হা রে, সেই যে কিস্সাকথা তোদের ঘরের? এক নারীর পাঁচ পাঁচজন ভাতার?

সাইদুর রহমান কুসমিকে বলছিলেন বটে কলকাতায় ওয়াহেদ ডাক্তারের ডাক্তার হয়ে ওঠার গল্প, কিন্তু সে কেবল তার ডাক্তার হওয়ার গল্প তো নয়, দেশভাগের সময়ে অনেক উন্মাদের ভেতরে ওয়াহেদ ডাক্তারও যে উন্মাদ হয়ে যায়, সেই গল্পেরই এসব ছিলো ভূমিকা মাত্র। দেশভাগের সময় আরেক উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন মইনুল হোসেন মোক্তার। লোকটা যখন হামার নদী হামার নদী বলে আধকোশা নদীটির আষাঢ় উন্মত্ত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

গল্প মানুষ মুখে মুখে বলে যায় ঘটনাগুলো ধারাবাহিক সাজাতে সাজাতে, কিন্তু করোটির ভেতরে ঘটনা থাকে না ধারাবাহিক অনুক্রমে, লাবড়া রন্ধনকালে আগুনের ওপর হাঁড়িতে টগবগ পানির ভেতরে হরেক সবজির মতো বগবগ উথালপাথাল করতে থাকে ঘটনাগুলো। এই গাজর ভেসে উঠলো তো ওই ফুলকপি, এই শাকপাতা তো ওই শালগম। উপুড় তলান করতেই থাকে তারা। ওয়াহেদ ডাক্তারের গল্প করতে করতে সাইদুর রহমানের করোটির ভেতরে হরিষালের মাজার ভেসে ওঠে, সেই মাজার যেখানে বন্ধ্যা নারীরা যায়, সন্তান কামনায় বুড়ো বটগাছের ডালে লাল সুতো বাঁধে, তাগা তাবিজ পরিধান করে। হ্যাঁ, হোমিও ডাক্তার হলে কী হয়, ওয়াহেদ ডাক্তার সেই তাগা তাবিজও দিতো বন্ধ্যা নারীকে।

আমরা ওয়াহেদ ডাক্তারের কথা ভুলি নাই বা ভুলবো না। কাছারির মাঠে পাকিস্তানের নিশান তুলে হাকিম নেয়ামতউল্লাহ্ যে বলেছিলেন, এই আজাদির দিনে পাকিস্তানের জন্যে আজ মন্দির মসজিদে প্রার্থনা হবে পূজা হবে শুকরিয়ার নফল নামাজ পড়া হবে মোনাজাত হবে – আমাদের মনে পড়বে সে-কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠেছিলো ওয়াহেদ ডাক্তার, হরিষালের সেই ওয়াহেদ – হোমিওপ্যাথি করে, তাগা-তাবিজও দেয় – কলকাতা থেকে কোন্ কামেল পীরের কাছে চেলাগিরি করে একদিন যে হরিষালে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলো, যার ওষুধ কি তাগা-তাবিজেই বা, আর হরিষালের মাজারে লালসুতা বাঁধার বরকতেই না হয়, বন্ধ্যা নারী গর্ভে ধরে ওঠে সন্তান, সুনাম যার দশ বিশ পঞ্চাশ মাইল বৃত্তজুড়ে, এমনকি দূরের রংপুর থেকেও নাকি রমণীরা আসে তার কাছে সন্তান কামনায়, সেই ওয়াহেদ ডাক্তার নেয়ামতউল্লাহ্র কথা শুনে বলে ওঠে, আমাদের মনে পড়বে – পাকিস্তানে হিন্দুর মন্দিরে পূজাপাঠ হইবে পাকিস্তানের তরক্কি কামনা করি! বোঝেন তবে লীলাখান!

চোদ্দই আগস্ট সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তানের নিশান পয়লা উত্তোলনকালে মোখলেছ কাছারির মাঠে জামগাছ তলায় বসে ছিলো। ওয়াহেদ ডাক্তার তার পাশে বসে এক কথার উত্থাপন করে। – এই যে বিটিশ দ্যাশ হতে চলি গেইলো, এই যে হাকিম সায়েবে কইলো আজ ছে আপলোগ আজাদ হ্যয় – কথাটা কী বুঝিলো তুঁই? কিছুক্ষণ থম্ ধরে থেকে মোখলেছ বলে, যা বোঝার তা বুঝিছোঁ। – না, তুই বুঝিস নাই। বুঝিবি দুইদিন বাদে। আমি হরিষাল ফিরি যাই। সেথা হতে আজাদির নয়া ঘোষণা মুঁই দেমো। আমরা আতান্তরে পড়ে যাবো ওয়াহেদ ডাক্তারের এ-কথা শুনে। ওই তাকে এখন আমরা দেখবো নদীর পাড়ে খেয়ার নৌকায় উঠতে। ওপারে সে যাবে। খেয়ার মাঝিকে সে তাড়া দেয়, চলেক্। মাঝি বলে, সবুর করি যাই, আরো যাত্রী আসিবে! – যাত্রীর গুষ্টি মারো মুঁই। নদীর এপারে আইজ হতে পাকিস্তান, ওপারে হিন্দুস্থান, খবর রাখিস? পার হতে কাঁই আসিবে!

মাঝি বিভোল স্বরে বলে, কন কী তোমরা? পাকিস্তান এপারে হিন্দুস্থান ওপারে? নদীর এপার ওপার দুই দ্যাশ তবে! – হয়, হয়। পাকিস্তানেরও গুষ্টি মারো মুঁই। জিন্নাহ্র পুটকিতে আছোলা বাঁশ। গান্ধীর পুটকিতেও। আর ইংরাজের ঝাঁই রাজা, তার মায়েকে চোদং মুঁই। চল্ হামাকে নিয়া আইজ একায় মুঁই প্যাসেঞ্জার। দ্যাখ আজাদি কাকে কয়! আজাদি তো মোর হাতে। মাঝি বিমূঢ় হয়ে যায় ওয়াহেদ ডাক্তারের কথা শুনে।

অচিরে কানেকান শোনা যায় হরিষাল গিয়ে হোমিও ডাক্তার ওয়াহেদ মিয়া ঘোষণা দিয়েছে, শোনো তবে। পরিষ্কার একখান কথা কই। ইংরাজ এ-দ্যাশ ছাড়ি যাবার কালে কয় তোমার দ্যাশ এলা তোমার। তো জিন্না কইলে মোর তবে পাকিস্তান! আর গান্ধী কইলে মোর তবে হিন্দুস্থান! সীমানা নিশানা নাই, আন্দাজি এক খুঁটি গাড়ি ইংরাজ নিলে বিদায়। আমিও তবে দাবি ছাড়ি ক্যানে। মোর পূর্বপুরুষ মীরজুমলার সিপাহির সাথে আসাম দখল করিবার যুদ্ধে যায়, হেথায় আসি মীরজুমলার ধরিলো প্যাটের আমাশা অসুখ। তাঁই কববরে গেইলো সেই অসুখে। তাঁর সেনাপতি মোর বড়দাদা রয়া গেইলো এই হরিষাল বরাবর জায়গা জুড়ি, প্রতিষ্ঠা করিলে তাঁই তাঁর স্বাধীন রাজ্য। তারবাদে ইংরাজ আসি হটাইলে তাকে। আমি তার একালের সন্তান, মুঁই নিশান তুলিলোম সেই বড়দাদার নামে। এই এলাকা হামার। আমি ইয়ার বাদশাহ।

জলেশ্বরীতে খবর আসে। থানার মন্মথ দারোগা, বামুনের ব্যাটা, পৌনে চাইর হাত লাশ তার, মোচের কী বাহার, তাঁই কইলে – বাদশাগিরি ছুটামো তোমার! কিন্তু ততদিনে স্বাধীন এলাকার স্বাধীন বাদশার মতো বিচার-আচার শুরু করে দিয়েছে ওয়াহেদ ডাক্তার। দরবার তার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে বসে সকাল বিকাল। চমকানো একেকটা খবর পাওয়া যায়। কোথায় কে নাকি জমি দখলের দাঙ্গায় কাকে খুন করেছে। – হাজির! আসামি হাজির! এক কথা কি দুকথা, তারপরেই ওয়াহেদ ডাক্তারের ঘোষণা – মোর রাজ্যে খুন চলিবে না। তোকে ফাঁসির হুকুম দিলোম!

দন্ডের সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যে পরিণত করা। স্কুলের বারান্দায় হাই বেঞ্চের ওপর আসামিকে দাঁড় করিয়ে গলায় তার রশি জড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপরেই নে বেঞ্চখানা টেনে! ঝুলে পড়লো আসামি। বেরিয়ে পড়লো জিভ। জলেশ্বরীতে হুংকার দিয়ে উঠলেন মন্মথ দারোগা। লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন তাঁর ঘোড়ায়। পিছনে লাল পাগড়িবাঁধা ভোজপুরী বিহারি সিপাহির দল। ওয়াহেদ ডাক্তারের তবে আর নিস্তার নাই!  (চলবে)