নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

\ ৩৬ \

গোপালের মা সর্পদংশনে তার গোপালের মৃত্যুটাকেই মনে রেখেছে, সর্পের কথা তার স্মৃতিতে নাই। সন্তানের মৃত্যুটাই কেবল জননীর কাছে সন্তাপ ও সত্যের, কীভাবে তার মৃত্যু জননী ভুলে যায় অচিরে। হাওয়ার ভেতরে তখন কেবল হাহাকার ভেসে থাকে – নাই, নাই, নাই। মানুষের এই আসা আর যাওয়া! জন্মের অনন্য একটিই মাত্র দরোজা, মৃত্যুর দরোজা সংখ্যাহীন। তবে, জলেশ্বরীতে মৃত্যুর এই এক দরোজা – সর্পাঘাত। বলা হয়ে থাকে, মানুষের চেয়ে এই এলাকায় গোক্ষুর সাপের সংখ্যা অধিক। সর্পদংশনে নিত্যই এখানে

প্রাণ হারায় মানুষেরা। কোথায় না দেখা যায় গোক্ষুর? এই তো সেদিন ফুটফুটে জোছনা দেখে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের বাংলাবাড়ির বাবুর্চি আলাউদ্দিন হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিল নদীর পাড়ে এসে শেষ হওয়া রেললাইনের কাছে, ভেবেছিল কালভার্টের ওপর বসে সিগারেট ধরিয়ে চন্দ্রসুখ ভোগ করবে। বসেও ছিল সে, হঠাৎ কীসের সরসর শব্দ আর আতপ চালের মতো মিহি মিঠে ঘ্রাণ যেন বাতাসে। তাকিয়ে দেখে বিশাল এক গোক্ষুর রেললাইনের ওপার থেকে এপারে বুক ঠেলে আসছে। সাপটি মানুষের ঠাহর পেয়ে থমকে যায়। মানুষটাও জানে, এখন একেবারে নিশ্চল হয়ে না থাকলেই সাপটি ফণা তুলবে। আলাউদ্দিন বসে থাকে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে। সাপটি কিন্তু ফণা তোলে তবুও। ফণা যে তোলে, দংশনের জন্যে তার ভেতরে প্রেরণা দেখা যায় না। যেন সাপটিও জোছনার এই অপরূপ ধবলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে চাঁদের দিকে তার ফণা তুলেছে। তারপর বুঝি তার জোছনাসুধা পান করা হয়ে গেলে আবার বুক টেনে নেমে গিয়ে শটিবনের ভেতরে গা লুকোয়। এ-গল্প আলাউদ্দিন এখন জমিয়ে বলে। – আমার মানিকগঞ্জেও সাপ আছে হে, তবে এমন সাপ দেখি নাই যে চান্দের দিকে তাকায়া থাকে মানুষের মতোন। – কন কী বাহে? বড় বাঁচা বাঁচি গেইছো! আলাউদ্দিন তখন বলে, হায়াত মউত আল্লার হাতে, তবে আল্লা একখান সাপ আমাকে দেখাইছে বটে। ছাই-ছাই রং তার, ফণার বা কী বাহার, চক্ষুরে বা কী দৃষ্টি য্যান চান্দের আলো মানুষেই অবাক হয়া দেখতে আছে!

কিন্তু আরো এক সাপ আছে। এ কাল সাপেরই কাল। আর, সে-সাপ জোছনার আলো দেখে মুগ্ধ হয়ে ফণা তোলে নাই। ঝটাৎ করেই দংশন করেছে। দেশটা ভাগ হয়ে গেছে। নদীর পানি নীল হয়ে গেছে। আর, সে-নদীও যে কার ভাগে পড়েছে তারও কোনো নির্ণয় নাই! আমরা নদীর পাড়ে সেই বালকটির কথা ভুলি নাই। মুকুল! মুকুলের মা তাকে নদী পার হয়ে হিন্দুস্থানে যাবার জন্যে পাঠায়। মুকুল দৌড়তে থাকে, দৌড়ে যায়, আমরা সে ছবিটি ভুলি নাই।

আমরা ভুলি নাই যে মুকুলের বিধবা মা পূজার থালা নিয়ে মন্দিরে গিয়েছিল, কিন্তু পূজা সে দিতে পারে নাই, মন্দিরে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। অপবাদ! অপবাদ তাকে দেয়া হয়েছিল যে ফরোয়ার্ড ব্লকের তরুণদের সঙ্গে তার রাতের সম্পর্ক হয়েছিল। আহ, কত সহজেই না নারীকে এমতো দোষা যায়! আর কত সহজেই না নারীর এমতো অপবাদ মানুষেরা সত্য বলে ধরে নেয়। ফরোয়ার্ড ব্লক, সুভাষ বসুর দল, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে  এসে তাঁর এই দল গঠন। আহ, আজ যদি সুভাষ বসু থাকতেন তবে কি দেশভাগ হতে পারতো? যদি থাকতেন চিত্তরঞ্জন দাশ? রবীন্দ্রনাথ? নজরুল? কিংবা তাদের আগের কালে যে সৈয়দ আহমদ ছিলেন তিনিই বা কী বলতেন? সেই তিনিই তো বলেছিলেন, আমি         আন্তরিকভাবে আমার দেশ ও জাতির সেবা করতে চাই। জাতি কথাটি দিয়ে আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কেই বোঝাতে চাইছি, কেননা জাতি কথাটির এইটিই একমাত্র অর্থ। তিনি কাব্য করে এতটাও তো বলেছিলেন, আমাদের স্মরণ হবে যে, হিন্দু এবং মুসলমান এক সুন্দরী নারীর দুটি চোখের মতো। কোনো আঘাতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে অপরটিও নষ্ট হয়ে যাবে!  কী হলো সেই কথাটি শেষ পর্যন্ত? একই মুখাবয়ব থেকে দুটি চোখ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তবে? তবে সেই মুখাবয়ব আর অটুট থাকলো কীভাবে? আমরা বাংলায় বড় দিশেহারা বোধ করি। বাংলাই আমার দেশ। সেই দেশটি তো সাতচল্লিশে প্রথম নয়, এর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগেও ভাগ করা হয়েছিল একবার। ব্রিটিশ শাসকেরা তখন বলেছিল, ঐক্যবদ্ধ বাংলা একটি শক্তি, বিভক্ত বাংলা যা নয়, আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য একে বিভক্ত করা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের দুর্বল করে তোলা। বিরোধী, না স্বাধীনতা সংগ্রামী? আর বাংলাকেই ভাগ করে দুর্বল করা, না সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাগ করে এক বিপুল জনগোষ্ঠীর মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া?

কিন্তু এ-প্রশ্ন সাতচল্লিশে আর নয়, সাতচল্লিশে এখন দেশ বিভাগ সম্পন্ন হয়ে গেছে, ভারতবর্ষ আর নয় – হিন্দুস্থান পাকিস্তান। রবীন্দ্রনাথ চিতাভস্মে পরিণত। নজরুল উন্মাদ। সুভাষ নিখোঁজ। আর চিত্তরঞ্জন বহু আগেই গত। দেশভাগের মাত্রই মাসাবধি আগে অখন্ড বাংলার স্বাধীন সার্বভৌম এক বাংলার স্বপ্ন যে গুটিকয় মানুষ দেখেছিলেন তাদের একজন সোহরাওয়ার্দীও হন তাঁর বীর্যহীনকালে পতিত।

মুকুলের মাকে আমরা ভুলি নাই। জলেশ্বরীর কাছারি মাঠে যখন পাকিস্তানের নিশান সদ্য তোলা হয়েছে আর শহরের হিন্দু নেতারা যখন দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখছে, মুকুলের মা তখন আধকোশা নদীর দিকে ছুটে চলেছে। আমরা তাকে অনুসরণ করি। এই নারী আজ এমতো উদ্ভ্রান্ত কেন, এ-প্রশ্ন কেবল জলেশ্বরীর হাই ইংলিশ ইশ্কুলের হেড মাস্টার শ্রী যতীন্দ্রমোহন গাঙ্গুলির নয়, আমাদেরও। মুকুলের মা কি আত্মহত্যা করতেই নদীর দিকে যাচ্ছে? ওই তার পরনের শাড়ি স্খলিত, ধুলায় অাঁচল লুটাচ্ছে, মাথায় কাপড় নাই, খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। উন্মাদ এক নারীরই তো রূপ? না, উন্মাদ সে নয়। মিথ্যা অপবাদ তাকে ভাঙে নাই, বরং তাকে আগুনের মতো জ্বলে উঠতে সাহায্য করেছে। আগুন? সে কি দগ্ধ করতে? হ্যাঁ, যদি পারতো, তাহলে দগ্ধই সে করতো এই বাস্তবতাকে, এই দেশবিভাগকে, মুহূর্তেই এই পায়ের নিচের মাটি অপরের হয়ে যাওয়াটিকে। কিন্তু একা এই অবলা নারী, সুভাষ বসুর দলকে নিজ বাড়ি ভাড়া দেয়ার কারণে চরিত্রের অপবাদ মাথায় এই নারী, কি-বা সাধ্য তার এ-সকল খন্ডন করে?

খন্ডন করতে না-ই পারুক, বর্জন তো করতে পারে। মুকুলের মা সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সে এ-দেশ ত্যাগ করবে। আরো অনেক হিন্দুর মতোই মুকুলের মা-ও পাকিস্তান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখবো, শহরের হিন্দুরা যখন দূরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের নিশান তোলা দেখছে, যখন তাদের মনের মধ্যে এতটুকু উদিত হয় নাই যে, এ-দেশ থেকে তারা চলে যাবে – যদিও অচিরে তারা যাবে, তখন সবার আগে মুকুলের মায়ের মনেই কথাটা উঠবে – এ-দেশ আর তার নয়, হিন্দুও নয় মুসলমানও নয় – কেউ তার পাশে দাঁড়াবে না, কেউ তাকে রক্ষা করবে না, এ-দেশ থেকে তাকে চলে যেতে হবে।

বড় কষ্ট করে ছেলেকে সে মানুষ করছিল। মুকুলের বাবা বসন্ত রোগে মারা যাওয়ার পর সম্বল শুধু ছিল সুপারির বাগানঘেরা বাড়িটি। বাগান ইজারা দিয়ে, বাড়ির প্রায় সবটাই ভাড়া দিয়ে, মুকুলকে মানুষ করছিল বিধবা মা। মুসলমানের বিধবা হলে আবার বিয়ে বসতে পারতো। হিন্দু বিধবার সে-পথ খোলা নাই। নাই বটে, কিন্তু মুসলমান বিধবার তুলনায় বিপদ তার আরো বেশি। শহরের সিগারেট ব্যবসায়ী, কাঁচি মার্কা সিগারেটের সোল এজেন্ট, কেরোসিন তেলের একমাত্র কারবারি, হরিহর সাহা তাকে তো প্রস্তাবই দিয়েছিল রক্ষিতা হয়ে যেতে। প্রস্তাবটা সরাসরি দেয় নাই; প্রথমে বাড়ির সদর ঘরখানা ভাড়া নিয়েছিল, ভাড়া সে চলতি হারের তুলনায় অনেক বেশি দিয়েই ঘরে উঠেছিল, অফিস বসিয়েছিল, আলাপে আলাপে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল – আরে, হিন্দুর বিধবা হিন্দু না দেখিলে দেখিবে কাঁই! – মুকুলের মায়ের মনে খচখচ ছিল, এত বেশি ভাড়া নিজে সেধে লোকটা কেন দিতে চেয়েছিল? নারীর মনে নারীর সম্ভ্রম চিন্তা শুকপাখির মতো ঘোর অাঁধারে ডানা ঝাপটায়, ঘটনা ঘটার আগেই ঘটনার সংকেত দেয়। অচিরে হরিহর সাহা মুকুলের মা-র হাত ধরে ফেলে; পূজার প্রসাদ যাচ্ঞা করেছিল হরিহর – হামার ব্যবসা বড় মনদা যাইচ্ছে যুদ্ধের গতিকে, দেবতার আশিববাদ না পাইলে আর বাঁচিবার গতিক নাই! কোন্ যুদ্ধ? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ! সবারই তখন উথাল পাথাল অবস্থা। যুদ্ধের গতিকে তখন কেউ রাতারাতি বড়লোক, কেউবা ফকির; কিন্তু হরিহর সাহার সে-সম্ভাবনা নাই, কেননা সিগারেট আর কেরাসিনের চাহিদা কখনো ফুরায় না, বরং যুদ্ধের কালেই তার বেশি রমরমা। কিন্তু এতশত বিধবা ভাবে নাই; তার মন নরোম হয়েছিল হরিহরের দুঃখের কথা শুনে; সেইসূত্রে প্রসাদি ফুল হরিহরকে সে দিতে যায়। আর সেই তখন মুকুলের মায়ের হাত খপ করে ধরে ফেলে হরিহর, বলে, আর কতকাল বা কষ্ট করিবে? ইচ্ছা করিলে রাজরানীর মতো তোমাকে – কথাটা শেষ করতে পারে নাই হরিহর, পূজার থালা তুলে তার কপালে ততক্ষণে আঘাত করে বসেছে বিধবা। দরদর করে রক্ত। – আই বাপ্! আই!

হাঁ, বিধবার রূপ থাকাও অভিশাপ। রূপ না থাকলেই বা কী! কুরূপা বিধবাও কি পুরুষের নজর থেকে রেহাই পায়! মুকুলের মা রূপবতী, মুকুলের মা যুবতী, মুকুলের মা নিঃসঙ্গ বিধবা – কতজনে কত টোকা তাকে দেয় ও দিয়েছে, কিন্তু সে পতিত হয় নাই। তার একমাত্র চিন্তা মৃত স্বামীর চিহ্ন এই সন্তানকে সে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। দেশভাগের এই মুহূর্তে, পাকিস্তানের নিশান এই প্রথম আজ জলেশ্বরীতে ওড়ার মুহূর্তে, মুকুলের মা পথে নামে। তার বাড়িঘর ফেলে সে পথে নামে, হিন্দুস্থানের উদ্দেশে সে ঘর ছাড়ে। পড়ে থাকুক তার বাড়ি, পড়ে থাকুক তার সুপারি বাগান, খাক! বারোভূতে খাক! শুনেছে সে, ফরোয়ার্ড ব্লকের ছেলেরা তাকে গতরাতেই বলেছে, মাসি, নদীর এপারে পাকিস্তান, ওপার গেইছে হিন্দুস্থানে, এপারে আর আশা নাই, ওপারেই এখন আমাদের সমুদয়!

ভোররাতেই মুকুলকে সে রওনা করিয়ে দিয়েছে। – যা বাপ, নদী পার হয়া ওপারে যা। একখান খেওয়া নাও ধরি ওপারে যায়া বসি থাক। আমি পাছে পাছে আইসোঁ। – একো সাথে যাই না কেনে, মা? – না, বাপ, একোসাথে গেইলে সবার নজরে পড়িবে। তুই আগোতে যা। – তুমি? – মুঁই পাছে পাছে। – জিনিশপত্তর? বালক হলে কী হয়, মুকুলের বিষয়জ্ঞান টনটনে। অবোধ বয়সেই যে ছেলে পিতৃহারা হয়, বিষয়জ্ঞান তার আপনা থেকেই আসে। মা বলে, বিষয়ের কি-বা আছে! আইজ হউক কাইল হউক বাড়ি যাইবে মোছলমানের ভোগে! বাড়ি তো আর বগলে করি নিয়া যাবার নয়! – বাসনকোসন! – বাসনকোসন প্রাণে বাঁচিলে আবার হইবে। তবু মাটির ওপর পা অাঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুকুল। তখন গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় মা। – অলক্ষ্মীর ঝাড়! মোছলমানের হাতে বিনাশ হবার ঝইন্যে তাল তুলিছিস!

মুকুল এখন নদীর কিনারে। পেছনে জলেশ্বরী শহর। এই নদী আধকোশা! এ নদী এখন হিন্দুস্থানে। জলেশ্বরীর পাকিস্তানের মাটি থেকে পা তুলে নদীর জলে নামে মুকুল। হাঁটু পর্যন্ত নামে। তার হাফপ্যান্ট ভিজে যায়, কিন্তু লক্ষ নাই। তার কাছে মনে হয় নদীর জল কী শীতল! কত শীতল! কত আপন! মায়ের হাতের সেই চড় – চড়ের তোড়ে তার গাল এখনো রাঙা, এখনো জ্বলুনি তার যায় নাই। বাড়ি ছেড়ে আসবার কালে আর কিছু নয়, তার বইখাতা নিয়ে এসেছিল; বইগুলো পাড়ে নামিয়ে মুকুল দুই হাতে নদীর জল তোলে, অাঁজলা ভরে তোলে আর গালের ওপর ঝাপটে ঝাপটে মারে। আহ, শীতল! শীতল হয় চড়ের জ্বলুনি, মুকুল শীতল হতে থাকে। নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, অাঁজলায় জল তুলছে আর গাল ভেজাচ্ছে। আহ্, এই না হলে হিন্দুস্থানের নদী, হিন্দুস্থানের জল! শীতল! কী শীতল!

আধকোশার জল বড় শীতল মনে হয় বালক মুকুলের, চোখেমুখে সে জলের ঝাপট মারে, তারপর অাঁজলা ভরে পান করে, তার ভেতরটাও শীতল হয়ে যায়। ভোরে জলখাবার তার জোটে নাই, মা আজ হেঁসেলে প্রবেশ করে নাই; আধকোশার জল তাকে ক্ষুধার মুখে তৃপ্তি দেয়, সে উদ্গার তোলে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে মইনুল হোসেন মোক্তার নদীর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে; রোজার মুখে তার ওই বালকের জল পান শিহর তোলে, তৃষ্ণা গজগজ করে ওঠে। – শালার শালা, কী হইবে মোর রোজা রাখিয়া? কিসের আশায় রোজা? পরকালে বেহেশতে হামাক শরাবন তহুরা পান করাইবে, তারে ঝইন্যে এই নিদয়া খর কালে খাদ্য পানি উপাস? পুটকি মারো মুই রমজানের!

হ্যাঁ, আমরা মইনুল হোসেন মোক্তারের কথা ভুলি নাই। ভুলি নাই যে এই নদীতেই তার মৃত্যু হয়েছিল – আত্মহত্যা কি অপঘাত, এখনো তার নির্ণয় নাই তার পুত্র বাংলাদেশের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনের কাছে। সত্যটা আবিষ্কার করবার জন্যেই তো মকবুল এসেছে জলেশ্বরীতে, আমরা তাকে অচিরে দেখতে পাবো জলেশ্বরীর প্রবীণ মানুষদের কাছে যেতে, প্রশ্ন করে করে তাদের কাছ থেকে বাবার মৃত্যু বিষয়ে জানতে।

হাকিম নেয়ামতউল্লাহ ছারপোকার বিষকামড়ে অস্থির হয়ে দোতলায় উঠে যাওয়ার পর মন্মথ দারোগা ভাবতে থাকে। এসেছিল সে হরিষালে ওয়াহেদ ডাক্তার যে নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করে বসে আছে, খাজনা তুলছে, আর বিচারের নামে নিজেই একটা রায় দিয়ে একজনকে ফাঁসি দিয়েছে, সেই তার বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চালাবার হুকুম নিতে। কিন্তু কথাটা হাকিম কানেই নিলেন না। তিনি বরং শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগবে, লাগবে কি এর মধ্যেই দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, এই কথা বলে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবার তাগিদ দিলেন। তবে, পাকিস্তানের বুকের ওপরেই এক ব্যাটা যে নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করেছে, সেটা এই মুসলমান হাকিমের কাছে কোনো বিষয়ই নয়! কিসের সে মুসলমান তবে! হ্যাঁ, মন্মথ দারোগার কাছে শোনা-শোন এ-কথাটা তো ছিলই যে হাকিম নেয়ামতউল্লাহ খাঁটি মুসলমান নয়, মুসলমানের পয়গম্বরের পরেও নাকি পাঞ্জাবে জন্ম নেয়া আরেক পয়গম্বরকে তিনি মানেন। আর এটাও দারোগার কানে এসেছে যে, মুসলিম লীগের নেতা নজির মিয়া বলাবলি করছেন, নেয়ামতউল্লাহকে বিশ্বাস করা যায় না, পাকিস্তানে নাকি তার জায়গা নাই!

আতান্তরে পড়ে যায় মন্মথ দারোগা। তবে তারই বা এত উতলা হবার কী দরকার! পাকিস্তানের বুকের ওপরেই যদি আরেক মুসলমান শালা নিজেকে রাজা-বাদশা ঘোষণা করেছে তো করুক! তাকে পাকড়াও করবার জন্যে তারই বা কী এত মাথাব্যথা! আসলে, মন্মথ দারোগা সেই ব্রিটিশ আমলের এক দারোগা যার কাছে সরকার হচ্ছে সরকার, সরকারের প্রসারেই তার প্রসার। তাই না সে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করেছে তাদের পিছু নিয়েছে, পাকড়াও করেছে, রামধোলাই দিয়েছে নিজের হাতে। সে ভুলে গেছে যে এখন আর ইংরেজ নাই, এখন পাকিস্তান, পাকিস্তানেরই সরকার এখন, অতএব এই সরকারের বিরুদ্ধে যে সেও মন্মথ দারোগার হিসাবে এক শত্রু। কিন্তু খোদ পাকিস্তানের এক হাকিমই যখন ওয়াহেদ ডাক্তারকে শত্রু মনে করছে না, তারই বা কীসের এত ঠেকা!

দারোগার মনে পড়ে যায় তার গৃহিণী সেই জুলাই মাস থেকেই প্যানপ্যান করছে – চলো যাই, ইন্ডিয়ায় যাই, ইন্ডিয়ায় যাবার কাগজে সই করো! কিন্তু মন্মথ দারোগার কাছে খবর আছে অন্যরকম – কংগ্রেসের রাজেনবাবু বলাবলি করছে, এ-পাকিস্তান টিকিবার নয় হে! বড়জোর মাস দুই, তারপর সমুদয় ফির ভারত হয়া যাইবে, জিন্নাহ ফির লন্ডন পলাইবে যেমন একদিন পলাইছিল। তাকে ফির লন্ডন হতে মোসলমানেরা ডাকি আনিয়াই তো পাকিস্তান করিলে! দুই মাস! তবে দুই মাসের অধিক নয় পাকিস্তানের আয়ু! রাজেনবাবুরা গলা নামিয়ে বলেন, হয়! হয়! জহরলাল নিজে এ-কথা কইছে! তবে রেডিওতে প্রচার হয় নাই!

জহরলাল! জহরলাল নেহেরু! ভারতের প্রধানমন্ত্রী! তাঁর কথা! তবে আর কথা কী! হামার চায়া তাঁই অধিক জানে-বোঝে। তাঁই যদি কয়া থাকে যে পাকিস্তান দুই মাসের অধিক টিকিবে না, তবে ইন্ডিয়া যাবার কাগজে সই করিয়া মোর দরকার নাই! সব ইন্ডিয়া হয়া যখন যাইবে, মোরে বা অ্যাতো উতলা হয়া ইন্ডিয়া যাবার দরকার কী! গভীর ভাবতে থাকে মন্মথ দারোগা। তার কাছে সব কুয়াশা হয়ে যায়। ওয়াহেদ ডাক্তার স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করে নিজেকে তার রাজা বলছে, বলুক। খাজনা তুলছে, তুলুক। লোক ধরে ফাঁসি দিচ্ছে, দিক। এ বরং ভালোই – পাকিস্তান ভাঙছে। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা? লাগে লাগুক। না, মন্মথ দারোগা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, বাধা দেবে না। লাগুক দাঙ্গা। সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার মনে হয়, বরং এখান থেকে বেরিয়ে অর্জুন যুবকটিকে খোঁজ করা যাক, দাঙ্গায় তো অর্জুনের মতো হিন্দু যুবকই পুরোভাগে থাকবে।

থানার যে ভোজপুরি সিপাহিটি সঙ্গে এসেছিল, হাকিমের বাংলো মাঠে যে ঘোড়ার লাগামটি ধরে দাঁড়িয়েছিল, সে হঠাৎ ডাক দিয়ে ওঠে, হজৌর! তার গমগমে কণ্ঠস্বরে মন্মথ দারোগার চৈতন্য ফেরে। লাফ দিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। বলে, তুম থানা মে চলা যাও। হাম থোড়া ঘুমকে আতা। ঘোড়ার পিঠে বসেই গোড়ালি দিয়ে ঘোড়াকে তাড়া দেবার চাপট দিতে গিয়ে দারোগা পা সামলে নেয়, ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে ফিসফিস করে সিপাহিকে বলে, অর্জুন কা ঘর মালুম? – কৌন আরজুন, হজৌর? – আরে গাধ্ধা, ওহি জো বাজার মে চায়ে কা দোকান করতা। সিপাহীটির তবু বোধে আসে না কার কথা বলা হচ্ছে। তখন মন্মথ দারোগা গলা আরো খানিক নামিয়ে বলে, ওহি জো দোকান মে ইন্ডিয়া কা নিশান উড়ায়া থা! সিপাহীর তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায়। হাঁ হাঁ, চারোতরফ যব পাকিস্তান কা নিশান, ওহি ছোকরা আপনা দোকান মে হিন্দুস্থান কা ফ্ল্যাগ লাগায়া থা।

আসলে, ওটি ছিল কংগ্রেসের পতাকা। গেরুয়া শাদা সবুজ তিন-রঙা নিশানে শাদা জমিনে চরকা! কিন্তু অতো তলিয়ে কে দেখে! তিন রঙা পতাকা মানেই হিন্দুস্থানের পতাকা তখন। অনেক কষ্টে গোলমালটা থামানো গিয়েছিল তখন। থানায় অর্জুন আর মজিবর, হিন্দু-মুসলমান যুবকদের দুই পান্ডাকে ডেকে আনা হয়েছিল, একটা আপসরফাও হয়েছিল। পাকিস্তান হয়েছে বলেই তো দল হিসেবে কংগ্রেস মুছে যায় নাই, আর ঘোষণাও আসে নাই যে পাকিস্তানে কংগ্রেস থাকবে না। অতএব, কংগ্রেস যারা করে তাদের অধিকারও বহাল আছে কংগ্রেসের নিশান ওড়াবার। তবে, রফাটা এই হয় যে, তেরঙা নিশানটা ওড়ালে – প্রকাশ্যে নয়, দোকান বা বাড়ির মাথায় নয়, ঘরের ভেতরে!

মন্মথ দারোগা বলে, ওহি অর্জুন! আব মালুম হুয়া? হাঁ, উসকো খবর দেও কে হামারা সাথ চুপসে মোলাকাৎ করে, আভি! দের না করে! – হজৌর! বলেই সিপাহিটি ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনা হয়ে যায়। ঘোড়ার পেটে মন্মথ দারোগার চাপট পড়ে। ঘোড়া ছুটে চলে। হাজার হোক, দারোগার রক্ত তার শরীরে। শহরটা একবার ঘুরে আসা দরকার। দেখা দরকার দাঙ্গা লাগার পরিস্থিতি সত্যি সত্যি শহরে কিনা। দাপটে ছুটে চলে ঘোড়া। ছুটতে ছুটতে বাবা শাহ সৈয়দ কুতুবুদ্দিনের মাজারের কাছে এসে রাশ টেনে ধরে দারোগা, মুহূর্তে ঘোড়ার গতি লয় পেয়ে দুলকি চলন পায়। না, আমরা যদি মনে করি মন্মথ দারোগা বাবার মাজারের সম্মানে ঘোড়ার গতি কমায়, তবে ভুল হবে। ঘোড়ার গতি সে কমায় মুসলমান যুবকদের খবর নিতে। তারা কোনো মিছিল বা জমায়েত করবার আগে এই মাজারে এসে সমবেত হয়, এখান থেকেই তারা শুরু করে তাদের প্রতিটি রাজনৈতিক যাত্রা।

কিন্তু না। সুনসান সব। মাজারে পৌঁছুবার সিঁড়িটি যে-রাস্তা থেকে উঠে গেছে, যে-সিঁড়িতে সবসময়ই দশ বিশজনকে দেখা যায় উঠছে বা নামছে, আজ ভোরে একেবারেই ফাঁকা। কেবল সেই প্রাচীন নারীটি কাত হয়ে একপাশে শুয়ে আছে, যার শরীরে কখনোই কোনো বস্ত্র থাকে না। একেবারে উদোম। কেউ কখনো যদি একফালি কাপড় এনে দেয় কি একটা চটের বস্তাই, নারীটি মুহূর্তে তা ছুড়ে ফেলে দেয়। আমরা জন্ম নিই নগ্ন, জগৎ থেকে বিদায় নেবার কালেও আমরা সেই নগ্নই। তবে আর বস্ত্রে আমাদের প্রয়োজন কী! নারীটিও মাঝে মাঝেই চিৎকার করে ওঠে, আইসাছি ন্যাংটা, যাইবো ন্যাংটা, হি হি হি! চিৎকারটি এক অনুপম প্রতিভায় খিলখিল হাসিতে যে সে বদলে নেয়, পথিকেরা বিস্মিত হয়ে যায়।

কিন্তু এই যে সব ফাঁকা ও সুনসান, এটাও খুব আশ্বস্তকর বলে মন্মথ দারোগার মনে হয় না। বরং থমথমে বলেই মনে হয় তার। মনে হয়, ভয়ানক কিছু একটা ঘটবার প্রাক্কালেই এমন সাঁ-সাঁ করতে থাকে নির্জনতা, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে থাকে পাথরের মতো স্তব্ধতা। ঘোড়া থেকে নামবে কিনা, দারোগা ভাবে। নেমেই পড়ে সে। ঘোড়াটিকে সে মাজার সিঁড়ির পাশে বুড়ো বটগাছের একটা মোটা ঝুরির সঙ্গে বাঁধে। তারপর উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেই নিচে যে-মাজারপ্রাঙ্গণ তার চোখে পড়ে, সেখানেও সে কাউকে দেখতে পায় না। গুমগুম সুমসুম করছে প্রাঙ্গণটি। ওই তো, অদূরে ওই কবরটি। কুতুবুদ্দিনের কবর। জরির পাড় সবুজ চাদরে ঢাকা। ওই তো জ্বলছে ধূপকাঠি। ওই তো ধূপের গুরুগন্ধে বাতাস হয়ে আছে ভারী। মন্মথ দারোগা হিন্দু হলেও মুসলমান এক পীরের এই মাজার যে জাগ্রত সে ভোলে না, ভুলতে পারে না যে হিন্দুরাও এখানে এসে ভক্তি জানায়, সিন্নি চড়ায়। মন্মথ দারোগা সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যায়। তার হাত দুটি করজোড় হয়ে ওঠে আপনা থেকেই। মাজারের প্রাচীন দরোজাটি সে স্পর্শ করে। আর, ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে!

চোখে পড়ে এক নারীকে। নারীর পায়ের পাতা প্রকাশিত হয়ে ছিল বলেই নারী বলে ঠাহর হয়। পরণে শাদা থান। তবে বিধবা! একেবারে গুটিয়ে আছে মাজারের ওপাশটায়, মাটির ওপরে নত হয়ে আছে তার মাথাটি। কোনো মানুষ বলেই ঠাহর হয় না, যেন একটি শাদা কাপড় গোল হয়ে পড়ে আছে কবরটির উত্তর-পশ্চিম কোণে। মন্মথ দারোগা মাজারের দরোজায় হাত রেখে নিজের বুকে ছোঁয়ায়, কপাল ছুঁতেই তার হাত চাইছিল, কিন্তু সে সচেতনভাবে তা ঠেকায়, বুকের ওপরে ক্ষণকালের জন্যে রাখে, কিন্তু চোখ তার পড়ে থাকে নারীটির দিকে।

অচিরেই নারীটি মাথা তোলে। আর, তখনই চমকে ওঠে মন্মথ দারোগা। চেহারাটি তার অচেনা নয়। অনিন্দ্যসুন্দর এই যুবতী বিধবাকে তার মনে পড়ে যায়। এরই বাড়িতে, বাড়ির সমুখঘরটি ভাড়া নিয়ে, সুভাষ বসুর দল ফরোয়ার্ড ব্লক অফিস বসায়। হ্যাঁ, এরই বালক ছেলেটির নাম মুকুল – দারোগার মনে পড়ে। মুকুলকে ইন্ডিয়ার দিকে রওনা করে দিয়ে বিধবা এই মা যখন বাড়ির সব গুটিয়ে নিজেও ইন্ডিয়ার দিকে যাত্রা করে, আধকোশা নদীটি পার হওয়ার জন্যে খেয়াঘাটে যায়, তখন তাকে বাধা দেয় মজিবরের দল, তাকে নৌকায় উঠতে দেয় না। একটা হুজ্জতই বেঁধে যায়। নারী ওপারে যাবেই। মজিবররাও তাকে উঠতে দেবে না। একপর্যায়ে নারীটির হাত ধরে তারা টেনে ঘাটের কাছে ব্যাপারীদের চালায় নিয়ে তোলে।

অর্জুনদের দল থানায় এসে হাঁফাতে হাঁফাতে সংবাদ দেয়, নদীর ঘাটে হিন্দু নারী! মোসলমানের হাতে! দলেবলে তারা ভোগ করিচ্ছে! পাকিস্তানের মাটিতে হিন্দু নারীর ইজ্জত আর নাই! (চলবে)