নদী যার মাতা

মুহম্মদ নূরুল হুদা

 

নদী যার মাতা জাতিভূমি সেই বাংলাদেশে

নদীগুলি ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে তার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে,

ঘাট ছেড়ে খাত ছেড়ে চর ছেড়ে ধারা ছেড়ে ঢেউ ছেড়ে

কেউ কেউ উঠে এসেছে এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, নানা প্রশাসনিক ভবনে;

আজ জয়পুরহাটের এই সার্কিট হাউসেও দেখি ধরা পড়েছে গোটা আটেক নদী,

পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কপোতাক্ষ, করতোয়া, তিস্তা, তুলসীগঙ্গা, কর্ণফুলী :

কেউ ভিভিআইপি, কেউ ভিআইপি, কেউ শুধু আইপি, তবে খোপে খোপে

ওরা নাব্যতা ছেড়ে গতি ছেড়ে স্থির হয়ে আছে এক-একটি কক্ষের ঘেরাটোপে,

আর ভ্রমণক্রমে আমি ঠাঁই পেয়েছি তেমনি এক কক্ষনদীর বহতা শয্যায়;

কী ভাগ্য আমার, এই নদী সেই নদী যে নদীর নাম আধুনিক বাংলা কবিতা,

এই নদী সেই নদী যে নদীর নাম জাহ্নবীর কোল ছেড়ে পুত্রের অনির্দেশ যাত্রা,

এই নদী সেই নদী যার গন্তব্য জগতের সব সাগর-জলধির মিলনমোহনা,

এই নদী সেই নদী যার বুকে বিদায়ী বজরা ভাসিয়েছিলেন

বাংলার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন রোরুদ্যবদন,

এই নদী সেই নদী যার অশ্রুস্রোতে বিশ্ববাঙালির নান্দনিক উত্তরণ;

 

সারারাত আমি কাটিয়ে দিলাম সেই নদীর বুকে, যার নাম কপোতাক্ষ

যার মায়া আমাকে কয়েদি রাখবে অনাদিকাল, যার গবাক্ষ দেবে সাক্ষ্য

নদী থেকে পলি, পলি থেকে এই দেশ, সেই দেশে পলল মানুষ

সেই মানুষেরা বহুবর্ণ, বহুধর্ম, বহু কৃতি, বহু সংস্কৃতি আর বহুকর্মে বহমান

তাদের সাম্যবাদী সর্বনাম বাঙালি, যদিও ব্যক্তিনাম

মনু, ভুসুকু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দ

নদীর স্রোতের উৎসে নিষিক্ত যাদের গর্ভবেদনা,

নদীর জলডানায় উন্মুক্ত যাদের প্রসবানন্দ;

 

যশোরের মাতৃগবাক্ষ হে কপোতাক্ষ, জেলা পর্যায়ে প্রায় প্রতিটি সার্কিট হাউসের শয্যাকক্ষ হে কপোতাক্ষ,

বাংলার প্রতি ধূলিঅশ্রুতে নিত্যজায়মান হে কপোতাক্ষ, বাঙালির মৌলসত্তার স্তন্যধারা হে কপোতাক্ষ,

তুমি বয়ে চলো আমার মধ্যে, আমাদের মধ্যে, আগত অনাগত তাবৎ বাঙালি কবির মধ্যে, কবিতার মধ্যে

তুমি ভাষাবাঙালির ঘরে ফেরার হাতছানি, তুমি তার নবায়নপ্রবণ জাতিবৈচিত্র্যের কলস্বর, নও শুধু কুলুকুলু উলুধ্বনি,

তুমি তুমি বয়ে চলেছো জাতিবাঙালির জন্ম পেরিয়ে, মৃত্যু পেরিয়ে, পুনর্জন্ম পেরিয়ে, সৃষ্টির পৌনঃপুনিক উৎস অবধি

 

জয়পুরহাট সার্কিট হাউস, ২১.০৯.২০১৩, সকাল ৮-১০টা