নবিতুন বেওয়ার দুই আনা

মঞ্জু সরকার

বাথরুমে ঢুকে আজই নাতি আকরামের কথা মনে পড়ে নবিতুনের।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শরীরের কল্পিত ধুলাবালি ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন হওয়ার পুরনো অভ্যাসে বাথরুমে যায় রোজ। আজ বাথরুমে ঢুকে বুকের কাপড় খোলার সময় বুকের দিকে তাকিয়ে নবিতুন দেখে, তার বুকই নেই আসলে। বুকের জায়গায় দুটি শুঁটকি কালো চামচিকে ঝুলে আছে। দেখে নিজেরই ভয় লাগে। তিন কাল ধরে রান্নাঘরে থাকায় চুলের আগুনের তাপেই শুকিয়ে এমন হয়েছে বোধহয়। ক্ষতস্থানের জ্বালা মুছে ফেলার সতর্কতায় আঁচল বুকে আলতো ঘষে নবিতুন, আর ভাবে, এমন মরা চামচিকে দেখে পেটের সন্তানও বিশ্বাস করবে কি, এই মাই চুষেই তারা দুনিয়ায় আজ এত বড় হয়েছে? স্বামী বেঁচে থাকলেও বুড়ির বুক দেখে লজ্জা পেত আজ। দুনিয়ার সেরা ফল ভেবে
হাতানোর জন্য কতো না কাণ্ডকীর্তি করেছিল।
হারানো বুকের জন্য হাহাকার জাগানো স্মৃতিভাবনার উদাসীনতায় নাতি আকরামের কথাগুলো মনে পড়ে আবার।
‘ও দাদি, তোর দুই আনা সম্পত্তি পোলামাইয়ার লাইগা রাইখা দিলে কাউরেই লাভ হইব না। ক্যাচাল বাড়ব। তার চাইতে আমার নামে লেইখা দে, দুইজনেরই কপাল ফিরব।’
ঠাট্টা ভেবে ঠাট্টা করেই জবাব দিয়েছে নবিতুন, ‘ক্যা, তোর নামে লিইখা দিমু ক্যা? তোর দাদায় মরণের পর তোরে কি লাং ধরছি আমি?’
‘কোটি টাকার সম্পদ রইতেও কোনো পোলার সংসারেই সুখ নাই তোর। বউয়েরা আপদ-জঞ্জাল ভাবে। পোলারা মুখে মাওজননী কইয়া দরদ দেখায় কেন জানস? অহন তোর দুই আনাও প্রত্যেকে নিজের নামে লেইখা নেওয়ার তালে আছে। তার চাইতে আমার নামে লেইখা দে, তোরে রাজরানির মতো সুখে রাখার সব বন্দোবস্ত করব আমি।’
‘কী বন্দোবস্ত করবি তুই?’
‘তোরে নিয়া আলাদা বাসা নেব। সেই সংসারের মালিক হবি তুই। প্রথমে বিদেশে নিয়া প্লাস্টিক সার্জারি কইরা তোর চেহারাই পালটে দেব। ভরা বুক আর নকল দাঁতের সারি নিয়াও যুবতী নারীর মতো হবি আবার। এমন বিদেশি দাওয়াই খাওয়ামু, শরীলে বিষ-ব্যারাম থাকব না। সাদা চুলেও রং লাগাবি, সাইজাগুইজা স্বাধীনভাবে ঘুরবি, যখন যা ইচ্ছে হয় খাবি।’
নাতি আকরাম ছোট থেকেই আজগুবি কথা বলে লোক হাসানোর ওস্তাদ। তবে দাদির জীবনে সুখ আনার এসব কথা নিছক ঠাট্টামশকরা নয় সম্ভবত। দুই বছর বিদেশে ছিল। বিদেশে বুড়া-বুড়ির শেষকালটা কেমন সুখে কাটে, পোলাপানরা কীরকম সেবা করে মায়ের, তা নিজের চোখে দেখে এসেছে নিশ্চয়। দেশে থেকেও নবিতুনের পোলারা মাকে মা ডাকটা শোনানোর টাইম পর্যন্ত পায় না, কিন্তু বিদেশ গিয়েও আকরাম দাদির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে দুবার। কপাল খারাপ ছেলেটার, বিদেশে যাওয়ার খরচ না উঠতেই কী কারণে যেন চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছে। এখন বেকার। বাপ ছেলেকে নিজের দোকানে বসতে বলে। কিন্তু আকরাম স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চায়। এজন্য ম্যালা পুঁজি দরকার। বাবা ছেলেকে এক টাকাও দেবে না আর। তাই যে-কোনো নীরস পাত্রীর উপযুক্ত পিতাকে শ্বশুর বানিয়ে আকরাম শ্বশুরের টাকায় ব্যবসা করবে কিংবা বিদেশে যাবে আবার। টাকার জন্য কোনো কানা-লেংড়িকে বিয়া করতে চায় যে, বুড়ি দাদির দায়িত্ব নেওয়ার শর্তে দুই আনা সম্পত্তি নিজের নামে লিখে চাওয়ার প্রস্তাবটিও তার ঠাট্টা নয় মোটেও।
কোটি টাকার সম্পত্তি থাকতেও নবিতুনের ফকিরনি দশাও মিছে নয় আসলে। কোটি টাকার সম্পত্তির হকদার তিন ছেলে ও চার মেয়ে। প্রত্যেকের আলাদা ঘরসংসার। মাকে টানাটানি করে সবাই, কিন্তু কারো সংসারে গিয়াই টানা এক মাসের বেশি থাকতে পারে না নবিতুন। শরীরে নয়, মনের ভেতরেও কতরকম পিঁপড়া যে কুটকুট কামড়ায়! আর টাকা-পয়সা থাক আর না থাক, নানারকম বিষ-পিঁপড়ায় ভরা সব পোলা-মাইয়ার সংসার।
এখন মেজ পোলার বাসায় আছে নবিতুন। ছেলেদের মধ্যে মেজ চারতলা বাড়ি করেছে। বাপের সম্পত্তির ভাগ আদায় ছাড়াও জায়গাজমির ব্যবসা করে মেলা টাকার মালিক হয়েছে। টাকার গরমে মেজবউ শরীরে সোনার জিনিস নিয়াও মার্কেটিং করে। বাসায় থাকলে সারাদিনই টিভি দেখে, মোবাইলে প্যাচাল পাড়ে। নিজের সংসারের কামে হাত লাগালে জাত যায় তার, মেজর বাসায় এলে নবিতুন তাই বউয়ের হয়ে রান্নাঘরে থাকে অনেকটা সময়। কাজের বুয়াটা ভালো মানুষ, তাকে টুকটাক সাহায্য করে, সুখ-দুঃখের কথাও বলে তার সঙ্গে। কিন্তু মেজ বউয়ের ধারণা, কাজের বুয়ার কাছে বসে বসে শাশুড়ি সারাদিন তার গিবত গায়। নিজে যে ফোনে সে শাশুড়ির বিরুদ্ধে জা ও বোনদের কাছে কত কথা বলে! সাক্ষীসাবুদ পেলেও ছেলেবউয়ের সঙ্গে কখনো ঝগড়া করে না নবিতুন। কিন্তু মেজ বউ অকারণেও প্রায়ই কাজের বুয়াটার ওপর এমন ঝাল ঝাড়ে, সেই ঝাল নবিতুনের বুকেও পিঁপড়া ছেড়ে দেয়। তার ওপর মুখেও অনেক সময় ঝামটা দেয়, ‘কাম নাই তো জায়নামাজে বইসা থাকলেও আল্লা দুইটা ছওয়াব বেশি দিব, কিচেনের কামে আপনারে হাত লাগাইতে কে কইছে?’
মেজ ছেলে মায়ের জন্য খরচাপাতি কম করে না। তারপরও বড়লোক ছেলের বাসায় টানা পনেরো দিনও মন টেকে না নবিতুনের। তুলনায় ছোট ছেলে ও বউ বুড়ির মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে বেশি। ছেলেদের মধ্যে ছোটটার অবস্থা নীরস। বাপের সম্পত্তির ভাগ পেয়ে ছোটখাটো বাড়ি করলেও চাকরির বেতনে ভালো চলে না। মায়ের দুই আনাও তাই নিজের নামে চাওয়ার যুক্তির অভাব নেই। তার ওপর মায়ের চোখে সব সন্তান সমান হওয়ার পুরনো সংস্কারটি ভাঙতে বড় ভাইদের বদনামি গায় মায়ের কাছে, ‘ভাবির কথা ছাড়ো মা, ছোটলোকের মাইয়া টাকার গরমে শরমধরমের ধার ধারে না। কিন্তু বড় ভাই আর মেজ ভাই কি মানুষ আছে মনে করো? এমন লোভ, এমন স্বার্থপর মানুষ আমি দুনিয়ায় আর একটাও দেখি নাই। টাকার লোভে ওরা তোর-আমার মতো আপনাজনরে খুন করতে পারে, তেমনি মানুষের গু চাটতেও জিহ্বা বাইর কইরা আছে। জানোয়ারের অধম।’
ছোটটা বড়দের মতো রুজিরোজগার করতে পারে না। তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে নবিতুন নিজের দুই আনা তাকে দিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে। কিন্তু মায়ের গোপন পক্ষপাত আন্দাজ করে, ঠেকানোর জন্য সতর্ক হয়েছে সব ভাইবোনই। ছোটর বাসায় বেশিদিন থাকাটাও তাই কারো সহ্য হয় না। তারপরও নবিতুন ছোট ছেলের বাসায় কিছুট স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু ছোট বউ তার পান-জর্দা খাওয়াটা একদম পছন্দ করে না। ডাক্তার নিষেধ করেছে বলে স্বামীকে কিনে দিতে নিষেধ করেছে। নিজের টাকায় কাজের মেয়েকে দিয়ে কিনে এনেছিল নবিতুন, সেই জর্দার কৌটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। নাতনিটা দাদির দেখাদেখি একদিন পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছিল বলে বুড়ির দিকে এমন চোখে তাকিয়েছিল, সেই চোখে বিষ-পিঁপড়ার বাসা নবিতুন চশমা ছাড়াও দেখতে পেয়েছে।
ডাক্তার ও ছেলেবউ তো নিষেধ করেই খালাস, এদিকে পান-জর্দা না খেলে যে তার পায়খানাও বন্ধ হয়ে যায়, মাথা ঝিমঝিম করে, এটা সে কাউকে বলতেও পারে না। প্রমাণ দেওয়ার জন্য দুদিন জর্দা ছাড়া পান খেয়ে সে যখন টয়লেটে ঘণ্টা দুয়েক বসে থেকেও এক নাদি পায়খানাও করতে পারে না, তার ওপর মাথার ঝিমঝিমানি বেড়ে যায়, বিছানা নেয় তখন। ছেলে অফিস ফেলে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছোটে। বড় ভাইদের কাছে সত্যি খবরটা জানানোর পরও কে যেন রটিয়ে দিয়েছে, মাকে নিয়ে ছোট গেছে আসলে রেজিস্ট্রি অফিসে। মেজবউ ফোন করে তিন ননদের বাসাতেও জানিয়েছে খবরটি। মেজ ছেলে ও বড় জামাই নবিতুনের কোটি টাকার সম্পদ রক্ষার জন্য ছুটে গিয়েছিল রেজিস্ট্রি অফিসে। বড় ছেলে নিজের ব্যবসা নিয়ে মহাব্যস্ত, তারপরও নিজেই ছোট ভাইয়ের বাসায় এসে মাকে নিয়ে গেছে, আকরামের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার কথা বলে।
বড় ছেলে ভাগে পৈতৃক মূল বাড়ি ও দোকানটা পেয়েছে বলে তার বাড়িতেই শেষ জীবনটা কাটানোর কথা ভেবেছিল নবিতুন। কিন্তু ছেলে মায়ের পুরনো সংসার ও গেরস্থালির কোনো চিহ্ন রাখেনি। বাপের ব্যবসা যেমন বদল করেছে, তেমনি বাড়িটাও ভেঙেচুরে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছে। নিজের সংসারে থেকেও সারাক্ষণ বড় বউয়ের খবরদারি আর কাঁহাতক সহ্য হয়। তার ওপর পিতৃপুরুষের হালগেরস্তির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যেটুকু জমি নবিতুনের নামে দেওয়া হয়েছে, তার ওপরেও বড় ছেলে ও নাতি আকরামের শকুনদৃষ্টি তাদের চোখের দিকে না তাকিয়েও টের পায় নবিতুন। মন টেকে না বড় ছেলের বাড়িতেও।
বাপ মরার পর বোনদের ন্যায্য হক না দিয়ে তিন ছেলে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিল তাবৎ পৈতৃক বিষয়সম্পত্তি। বড় মেয়ে কেস করে দিয়েছিল ভাইদের নামে। তারপর কোর্টকাছারি এবং বছরখানেক নানা দেনদরবার করে সম্পত্তির ন্যায্য বণ্টননামা হয়েছে ওয়ারিশদের মধ্যে। এক বোন ভাইদের কাছে বেচে দিলেও বাকি দুই বোন জমি নিয়েছে বাড়ি করবে বলে। ওই সময়ে সবাই মিলে মায়ের প্রাপ্য দুই আনা নবিতুনের নামে আলাদা করে দিয়েছে। সব ভাইবোনই তখন একমত হয়েছিল, মায়ের প্রাপ্য অংশ মায়ের নামে থাকলে তার দেখভাল করতেও উৎসাহী হবে সবাই। আর মা মরে গেলে আইন অনুযায়ী সব ছেলেমেয়েই সমানভাবে ভাগ করে নেবে। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির ওপর স্বামীর নামের জমিতে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা এবং নবিতুনের জমিতে সাত ছেলেমেয়ের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার এই বন্দোবস্ত ভালো লেগেছিল নবিতুনের। মৃত্যুর আগে স্বামী স্ত্রীর নামে আলাদা করে কিছুই দিয়ে যায়নি। ছেলেমেয়েরা বাপের সম্পত্তিতে মায়ের হক আদায় করে দেওয়ায় খুশি হয়েছিল সে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমৃত্যু সন্তানদের জন্যই আমানত রাখবে তাদের বাপ-দাদার জমিটুকু।
শ্বশুরের আবাদি জমির পরিমাণ হিসাব করেই গেরস্ত ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল নবিতুনের বাপ। স্বামী বাপের সম্পত্তির যে ভাগ পেয়েছিল, তা চাষাবাদ করতে পারলে নিজের সংসারে ভাতের অভাব থাকত না। কিন্তু কৃষিকামে পরতা নেই বলে স্বামী এক বিঘা আবাদি জমি বেচে বাজারে গালামালের দোকান দিয়েছিল। বাকি যেটুকু জমি ছিল, তা যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিল নবিতুনই। সেই জমি বর্গা দিয়েও প্রতি মৌসুমে বাড়িতে যে-ধান উঠত, সেটুকুই ছিল নবিতুনের নিজস্ব সম্পদ। ছেলেমেয়েদের আবাদি ধানের ভাত ছাড়াও নিজের লাগানো লাউ-কুমড়া, পোষা হাঁস-মুরগির ডিম খাওয়াত সারাবছর। এখন বড় ছেলে যেখানটায় পাকা রান্নাঘর তুলেছে, সেখানে ছিল নবিতুনের লাউয়ের জাংলা। আম-কাঁঠালের গাছও ছিল তিনটি। নিজের এসব সম্পদ ছিল বলেই স্বামীর দোকানের আয়-উন্নতি নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তার তহবিলে হাত ঢুকিয়ে নগদ একটি টাকাও সরায়নি কোনোদিন। অবশ্য না চাইতেও সংসারের জন্য খরচ করতে কৃপণতা করেনি মানুষটা। প্রতি ঈদেই বউয়ের জন্য শাড়ি ও ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনার কথা বলতে হতো না তাকে। এক ঈদে বউকে যে দামি বালুচরি শাড়িখান দিয়েছিল, তা ট্রাঙ্কে আছে এখনো।
শহরের উপকণ্ঠে এ-গ্রামটাতেও শহর ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকলে ফসলের জায়গাজমিতেও নতুন নতুন বাড়িঘর গজাতে শুরু করেছিল নবিতুনের স্বামী বেঁচে থাকতেই। ধানিজমির দামও তখন হু-হু করে বাড়তে শুরু করেছিল। তারপরও আবাদি জমি বেচে বাড়িঘর পাকা কিংবা ব্যবসা বাড়ানোর চিন্তা করেনি মানুষটা। পৈতৃক সম্পত্তি ধরে রাখার জন্য নবিতুনই তাকে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু বাপের মৃত্যুর পর ছেলেরা মায়ের মতামতের তোয়াক্কা করেনি কেউ। ভাগাভাগি করে নিয়ে সবাই আলাদা বাড়ি-ব্যবসা ফেঁদেছে। নবিতুন বাপের বাড়ির যেটুকু ভাগ পেত ভাইদের কাছে, তাও মামাদের হালারপো বলে গাল দিয়া আদায় করে নিয়েছে ছেলেরা। মায়ের সম্পত্তির সমান ভাগ না পাওয়া নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে মনকষাকষি আছে এখনো। স্বামীর সম্পত্তির যেটুকু হিস্যা ছেলেমেয়েরাই একদিন মাতৃভক্তি দেখিয়ে মায়ের নামে দিয়েছে, এখন সেটাও কামড়াকামড়ি করে খাওয়ার অপেক্ষায় তর সইছে না কারো।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় নবিতুনকে তার জমির দাম সম্পর্কেও সচেতন ও সতর্ক রাখার চেষ্টা করে ছেলেরা।
‘ও মা, তোমার নামে যে জমিটুকু দিছি, বেচলে এখন কত দাম পাইবা জানো? কম কইরাও এক কোটি বিশ লাখ! কী করবা তুমি এত টাকার সম্পত্তি দিয়া?’
‘তোর বাবায় নিয়া যাইতে পারে নাই, আমি কি আর সাড়ে তিন হাতের বেশি কবরে নিয়া যাইতে পারুম? আমি মইরা গেইলে তোরা সব ভাইবইন সমান ভাগ কইরা নিবি।’
‘তোমার নীতি ঠিক আছে, সরকারি আইনও এই কথাই কইব। কিন্তু ইনসাফ কইরা কও, তোমার সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার সমান যোগ্যতা কি তোমার সাত পোলামাইয়ার সমান আছে?’
সুযোগ পেলেই ছেলেরা প্রত্যেকে নিজেকে মায়ের মহাভক্ত ও যোগ্য প্রমাণ করতে অন্যদের ছোট করতে যেসব যুক্তি দেয়, তা অনেক সময় অস্বীকার করতে পারে না নবিতুন। আবার স্বীকার করেও কোনো একজনকে আঁকড়ে তার সংসারে টিকতে পারে না বেশিদিন। সবার কাছে শুনে শুনে জমিনের ওপর পড়ে থাকা কোটি টাকা হাওয়ায় উড়তে দেখে কখনো-বা, কল্পিত টাকার কথা মনে রেখে পান-জর্দা কেনার জন্য ছেলেদের কাছে দশ-বিশ টাকা বেশি চাইলে, মাকে আরো কিছু বেশি দিয়েও খুশি রাখে তারা।

কোটি টাকা একত্রে করলে টাকার বান্ডিল কত উঁচু হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না নবিতুনের। লাখো-কোটি কেন, জীবনে নিজের সঞ্চয়ে হাজার টাকাও রাখেনি কখনো। সাত সন্তানকেই সাত রাজার ধন ভেবে খুশি থেকেছে। একের পর এক সাতটিকে গর্ভে ও বুকে আগলে রাখতেই কেটে গেছে যৌবনকালটা। স্বামী-সন্তান নির্ভরতার বাইরে তার নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধি কিংবা নগদ টাকা সঞ্চয়ের গরজ কোনোকালেই ছিল না। একদিন নিজে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হবে, এমন স্বপ্ন ভুলেও দেখেনি। বিয়ের পর সেই যে রান্নাঘরে ঢুকেছিল, এখনো রান্নাঘর আর সংসার সামলানো ছাড়া নারীজীবনের সার্থকতা খুঁজে পায় না নবিতুন। সংসারের প্রয়োজন ছাড়া টাকা দিয়ে শুধু নিজের জন্য সোনার জিনিস কি হাজারো সুখভোগ কেনার চিন্তাও করেনি কখনো। স্বামী শখ করে যা কিনে দিয়েছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। এখন ছেলেমেয়েরা মায়ের কাপড়চোপড়, ওষুধপথ্য, জর্দা-পান Ñ চাইলেই কিনে দেয় সবাই। নবিতুন যে নিজেও কোটি টাকার মানুষ, এ-কথাটা নিজেরই মনে থাকে না তার। মনে থাকে না বলে ছেলে ও বউদের কাছে ফকিরনির মতো হাত পাতে অনেক সময়।
নাতি আকরাম ঠাট্টা-মশকরা যতই করুক, তার উচিত কথাগুলো ভুলতে পারে না নবিতুন। নিজে ফকিরনির জীবনযাপন করে কোটি টাকার সম্পদ দুনিয়ায় রেখে দিয়ে কবরে গেলে লাভটা হবে কার? মায়ের সম্পত্তির ভাগ পেয়ে ছেলেমেয়েদের সংসারে কী সুখশান্তি বাড়বে? বউদের খাইখাই লোলা বাড়বে বরং। নাতনিগুলোও ফ্যাশান-ক্যাটাং করতে গিয়ে এই বয়সে মায়েদেরও ছাড়িয়ে গেছে। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ, পারলে শরীরের প্রতিটি লোমের জন্য পয়সা খরচা করে কতোরকম যে তেলক্রিম মাখে! মায়ের সম্পত্তির ভাগ পেলে ভাইবোনের মধ্যে মিলমহব্বত বাড়বে? মোটেই না, বরং আরো স্বার্থপর হবে তারা। হিংসাহিংসি-কামড়াকামড়ি বাড়বে।
এরচেয়ে নবিতুন দুই আনার পুরোটাই আল্লাহর ঘরে দান করে গেলেও পরকালে আল্লাহ নিশ্চয় পুরস্কার দেবে। সম্পত্তি বেচে কোটি টাকা মায়ের হাতে তুলে দিত যদি ছেলেরা, নিজের হাতে ইচ্ছেমতো দানখয়রাত করে গেলেও কবরে শুয়ে শান্তি পেত। মেজ বউয়ের কাজের বুয়াটি টাকার অভাবে পোলার চিকিৎসা করাইতে পারে না। তারেও কিছু টাকা দিয়ে গেলে জীবনভর মনে রাখত। আর আকরাম বাপের কাছে টাকা না পেয়ে না পারছে বিদেশ যেতে, না পারছে স্বাধীন ব্যবসা করতে। দাদির ব্যাংকে কোটি টাকা ক্যাশ আছে জানলে সে হয়তো বুড়িকে নিয়েই বিদেশ রওনা দেবে।
নিজের নামে কোটি টাকার সম্পত্তির সদ্ব্যবহার নিয়ে নবিতুন মাঝেমধ্যে আকাশপাতাল ভাবে। কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারে না। জমির ওপরে উড়তে থাকা কোটি টাকার ভারেই কি না কে জানে, শরীরটাও আবার দ্রুত বিগড়ে যেতে থাকে। মুখে সারাক্ষণ জর্দা-পানও পায়খানার রাস্তা খুলে দিতে পারে না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে মা শয্যাশায়ী হলে ছেলে বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার ব্লাড প্রেশার-ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে দেখে। মাথার ওপরে স্যালাইনের প্যাকেট ঝোলায়, ওষুধপথ্য দেয় নানারকম।
খবর পেয়ে নবিতুনের বাকি ছেলেমেয়েরাও সপরিবার ছুটে আসতে থাকে। অবস্থা তেমন সংকটজনক নয় জেনেও মাকে বড় ডাক্তার, বড় হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ছোটরা। মেয়েরাও মায়ের জন্য তার পছন্দের তরকারি, গরম স্যুপ ও নানারকম ফলফলারি নিয়ে আসে। বড় মেয়ে ঘর ফাঁকা হতেই কানে কানে মাকে জানায়, ‘ভাই-ভাবিরা মুখে যতই দরদ দেখাক, মনে মনে আল্লাহরে কইতাছে তুমি তাড়াতাড়ি মরো। হেইডাই ওরা চায়। ভালো চিকিৎসা করাইব না, আবার মাইয়াগো বাসায় যাইতে দিব না। আবারো কইতাছি মা, ভাইয়েরা কোনো কাগজে টিপছাপ্পড় চাইলে দিবা না কিন্তু।’
চারদিন পর অবশেষে মায়ের পায়খানা হওয়ার স্বস্তি এবং হাইপ্রেশার ও ডায়াবেটিস স্বাভাবিক হতে দেখে উদ্বেগমুক্ত মেয়েরা যে যার সংসারে ফিরে যায়। আগের মতো নিজেই বাথরুমে যেতে পারে নবিতুন, লুকিয়ে পান-জর্দাও একটু মুখে দেয়। রাতে তিন ছেলেকেই আবার মায়ের বিছানায় আসতে দেখে উদ্বেগ বাড়ে নবিতুনের।
‘এখন কেমুন আছো মা? বুকের ধড়ফড়ানিটা কমছে নি?’
নবিতুন ভালো আছে শুনেও ছেলেদের মুখের উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার ছায়া কমে না। বড় ছেলেই তার কারণ ব্যাখ্যা করে।
‘আমরা তিন ভাই আজ তোমার ব্যাপার লইয়া ডাক্তারের লগে আলাপ করছি।’
‘কী কইল ডাক্তারে?’
‘বয়স অনেক হইল। শরীল-স্বাস্থ্যের গতিক সুবিধা নয়। ডাক্তার কয়, এই বয়সে যে-কোনো সময় অঘটন একটা ঘটতেই পারে।’
‘তুমি চিন্তা কইরো না, তোমার জন্য যত বড় ডাক্তার আর ভালো চিকিৎসা দরকার, সব ব্যবস্থাই আমরা করমু। আল্লাহ যতদিন হায়াত রাখছে দুনিয়ায়, মনে সুখশান্তি নিয়া যেন বাঁচতে পারো।’
নবিতুন সব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও মায়ের জন্য তাদের সমবেত দরদ-উদ্বেগের কারণটা বুঝতে পারে না। কতদিন তিন ছেলেকে একসঙ্গে দেখেনি! সত্যই কি তবে মরণ শিয়রে ঘনিয়ে আসছে বলেই মরার আগে আজ একটু ভালো বোধ করছে নবিতুন?
বড় ছেলেই আবার সিদ্ধান্ত জানায়, ‘ও মা, আমরা তিন ভাই আলাপ-আলোচনা কইরা এক হইছি, দুনিয়া থাইকা যাওয়ার আগে তুমি তোমার দুই আনা সম্পত্তির শৃঙ্খলা কইরা দিয়া যাও। তার আগে আল্লায় তোমারে তুইলা নিলে তোমার দুই আনা লইয়া ভাইবইনদের মধ্যে ফাটাফাটি ঝগড়া হউক, তা আমরা চাই না।’
‘কী শৃঙ্খলা করুম আমি?’
‘মায়ের কাছে সব পোলাই সমান। তুমি তিন পোলার নামেই তোমার অংশ লেইখা দিয়া যাও। বইনগো তো বাপের সম্পত্তির ভাগ দিছি, কিন্তু মায়ের ভাগ তাদের দেব না আমরা। দিতে গেলেই গ্যাঞ্জাম আরো বাড়ব, যে বইন মইরা গেছে তার পোলাও ভাগ ছাড়ব না। কেস কইরা দিতে পারে মামাদের নামে। তুমি মইরা যাওয়ার পর সম্পত্তি লইয়া ভাইবইনগো মাঝে খুনাখুনি ক্যাচাল লাগুক, তুমি অবশ্যই তা চাও না।’
‘কাইলকাই দলিল করতে তিন ভাই তোমারে রেজিস্ট্রি অফিস লইয়া যামু আমরা।’
নবিতুন তিন ছেলের মুখ নয়নভরে দেখার পর মুখ ফিরিয়ে নেয়। স্বাভাবিক কণ্ঠে যেমন কথা বলে, তার চেয়ে জোরালো কণ্ঠে সিদ্ধান্ত জানায়।
‘ডাক্তার যাই কউক, আমি অহনই মরুম না।’
‘এইডা তো খুশির কথা মা, তুমি আরো একশ বছর বাঁচলেই আমরা খুশি।’
‘আমি আমার সম্পত্তি কোনো পোলারেই লেইখা দিমু না। যারেই দেই, তার কাছে নগদ দেড় কোটি টাকা আগে নিজ হাতে গুইনা নিমু।’
ছেলেরা মায়ের কথাও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। বোঝার জন্য মায়ের ওপর সবাই ঝুঁকে পড়ে।
‘ও মা, কী করবা তুমি এত টাকা নিয়া? আমরা পোলারা কি তোমার যখন যেটা দরকার, করতাছি না? কিসের অভাব তোমার?’
‘নিজের লাভটা ছাড়া আর কিছু বোঝস না তোরা। শেষ বয়সে আমার কি শখ আহ্লাদ নাই? তোর বাপ যে দুই আনা আমার জন্য রাইখা গেছে তার ষোল আনাই আমি স্বাধীনভাবে ভোগ করুম। এই আমার শেষ কথা।’
তিন ভাই-ই তাদের গর্ভধারিণীকে আজ চিনতে পারে না যেন। চোখে অবিশ্বাস ও বিস্ময়মাখা প্রশ্ন নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়।