মূল : অজিত কৌর
অনুবাদ : পাপড়ি রহমান
সেই দিনগুলো ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, রক্তঝরা আর মৃত্যুর বিস্ময়কর ভয়মাখা। এক দমবদ্ধকর অনুভূতি পৃথিবী থেকে জেগে উঠে আকাশের দিকে যাত্রা করল। যেভাবে একটা কালো বস্ত্র সকলের নিঃশ্বাস রম্নদ্ধ করে ফেলে, ঠিক তেমনিভাবে।
সেটা ছিল নভেম্বর মাস। মাসের একেবারে শুরম্নর দিকের ঘটনা। আর ১৯৮৪ সাল। ৩১ অক্টোবর থেকেই শহরের অবস্থা ছিল শঙ্গা ও আতঙ্কপূর্ণ। যে-মানবী বহু বছর ধরে দেশটিকে শাসন করছিলেন, আবদালির মতো অমৃতসরের হরিমন্দির সাহেবের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন, যিনি দেশটাকে নিজের একামত্ম প্রিয় ভূমি হিসেবে দেখতেন, সেই গুরম্নত্বপূর্ণ সম্রাজ্ঞীকে হত্যা করা হয়েছিল।
বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ নির্মম হত্যা অবশ্যই জঘন্যতম অপরাধ। বিশেষ করে সেই মানবীকে হত্যা করা, যাঁর অমত্মরপ্রদেশ খুবই কোমল। সেই মানবীর বড় বড় আঁখিযুগলের দৃষ্টিতে ছিল – সমসত্ম পৃথিবীই যেন তাঁর অধীন। যাঁর ছিল আশ্চর্যসুন্দর ছোট-ছোট পায়ের পাতা আর ক্ষিপ্রগতিতে চলা হস্তযুগল। সেই অদ্ভুত সুন্দর ও বুদ্ধিমতী মানবীর সঙ্গে ক্যাস্ত্রো এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একই রকম বন্ধুত্ব ছিল, তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অধিষ্ঠাত্রী।
কিন্তু এই দেশে তো পরিকল্পিতভাবে রাজা বা রানিকে হত্যা করার ঘটনা সচরাচরই ঘটে থাকে।
এখানেই তো একদা এক রাজা তার স্বীয় পিতাকে জেলে বন্দি করেছিল, অতঃপর তাকে মেরে ফেলেছিল, এমনকি সহোদর ভাইদেরও হত্যা করেছিল এবং তারপরে সে-দেশের শাসনকার্যে অগ্রসর হয়েছিল।
এই দেশ তো তেমন হত্যাযজ্ঞও দেখেছে, যে-মানুষের জনপ্রিয়তা ছিল পিতার মতো, জাতির পিতার আসনটি তাঁর ছিল এবং এক অসাম্প্রদায়িক জাতির।
কিন্তু এরকম বিভিন্ন হত্যাকা–র পরও মৃত্যু এই দেশের প্রতিরোধহীন ও নির্দোষ মানুষকে কোনোভাবেই দোটানার বাইরে রাখতে পারেনি।
১৯৮৪ সালের কালো নভেম্বরে, জনগণকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো, তা রাসত্মার ওপরেই। নেতাদের নির্দেশ পেয়ে কিছু লোক দলবদ্ধভাবে ঘোরাঘুরি করত। সেস্নাগান দিতে দিতে শহরের অলিগলি তারা চষে বেড়াত। একটি দল বিশেষ একটি গোত্রের লোকদের খুঁজে বের করত শিকার করার জন্য। অতঃপর তারা ওই লোকদের গলায় ছুরি চালাত। আর ছোট ছোট বাচ্চার সম্মুখেই ওই গোত্রের নারীদের ধর্ষণ করত।
ঘরবাড়ি সব লুট করা হচিছল, পোড়ানো হচ্ছিল আর নির্দোষ মানুষদের জবাই করা হচ্ছিল।
এসব এর আগেও বহুবার ঘটেছিল। ঠিক এইরকমভাবেই। যখন এই সম্রাজ্ঞীর পিতা দেশ ভাগ করার জন্য সম্মতি দিয়েছিলেন, দুই ভাগে বিভক্ত। এবং তা করা হয়েছিল একটা ভোঁতা ছুরি দ্বারা। মানুষেরা তখনো বর্বরোচিত পাগলামির মাঝে নিমজ্জিত ছিল। তখনো এখনকার মতো ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছিল। তখনো মানুষের পেটেই ছুরি মারা হতো। আর নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা হতো। তাদের অন্ত্র বের করে রক্তে ডুবে থাকা নর্দমায় ফেলে দেওয়া হতো, খোলা রাসত্মায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হতো, মাঠের মাঝে, এমনকি ফুটপাতেও।
তখন প্রচ- ভয়, ভয় শকুনের মতো শহর আর গ্রামের ওপর চক্কর দিত, এবং ভয় সবকিছুকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছিল।
আজ, ৩৭ বৎসর পরে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছিল।
আমি বাড়ির সমসত্ম দরজা ও জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, বন্ধ করে আমার মেয়ে অর্পনার সঙ্গে ভেতরে বসেছিলাম, ৩১ অক্টোবর এবং নভেম্বরের প্রথম তিনদিন।
প্রতিবেশীরা আমাদের বাড়ির নামফলক নষ্ট করে গেটের নিচে সিঁড়িতে ঝুলিয়ে রেখেছিল। আর বারংবার ফোন কল করে আমাদের আশ্বসত্ম করছিল। ‘চিমত্মা করো না। আমরা তোমাদের রক্ষা করার জন্য এইখানে রয়েছি।’
কিন্তু যখন যমুনাতীরের কলোনিতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন কীভাবে তালাবদ্ধ হয়ে থাকা সম্ভব বাড়ির অভ্যমত্মরে একেবারে কাপুরম্নষের মতো?
টিভি এবং রেডিওতে প্রচার করা হচ্ছিল যে, মিলিটারিরা এই শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু মিলিটারিরা শহর পাহারায় থাকলে আমরা কীভাবে ঘর থেকে বের হবো? ওখানে যেতে হলে আমাদের নদীর উপরের ব্রিজটা পার হতে হবে, অবশ্যই মিলিটারিরা আমাদের থামাবে, আর আমাদের জিজ্ঞাসা করবে আমাদের কী কাজ ওখানে …
আমরা চেষ্টা করতাম। আমরা দেখতাম কতদূর আমরা যেতে পারি, আমরা কাপুরম্নষের মতো বাসার ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারলাম না। যেখানে মানুষদের নির্বিচারে রাসত্মার ওপর হত্যা করা হচ্ছিল, তাদের মাথা লোহার রড দিয়ে বাড়ি মেরে ভোঁতা করে দেওয়া হচ্ছিল, শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, জীবমত্ম অবস্থায়। তাদের গলায় কেরোসিনভর্তি রাবার টিউব এবং টায়ার বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো। আর তাদের বাড়িঘরেও আগুন দেওয়া হচ্ছিল।
পুড়তে থাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন বাড়িগুলো থেকে নারীরা বেরোতে পারলেও রক্ষা ছিল না। তখন তাদের যৌননির্যাতন করা হতো, সেখানেই, ঠিক তার স্বামী ও ছেলেদের মৃতদেহের পাশেই। ওই রক্ত আর কাদামাখা খোলা রাসত্মায়। যেন তারা ওইসব নৃশংসতা ঘটানোর জন্য মরিয়া ছিল।
সমসত্ম বসিত্ম ধ্বংস করা হয়েছিল। মৃত্যু ও দারিদ্রে্যর হাত থেকে তারা কেউ-ই রেহাই পায়নি। এই রকম হত্যাযজ্ঞের মাঝে শুধু নিজেদের রক্ষা করা ছিল অনৈতিক। বিবেকহীন।
টিভি এবং রেডিওতে নিহত সম্রাজ্ঞীর শেষ শব্দগুলো পুনঃপুন একইভাবে বেজে যেত ‘আমার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা। …রক্ত …রক্ত …রক্ত!’
আমরা, আমি আর আমার মেয়ে অর্পনা বাড়ি থেকে বের হলাম। ড্রাইভার আমার নিকট প্রতিবেশী, মনোজ। সে হিন্দু ধর্মের, আমি অনুভব করছিলাম যে, মনোজের হিন্দু হওয়াটাই আমাদের জন্য সুরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ দেবে।
ওই বছর মনে হয় শীত অনেক আগেই পড়েছিল। আমরা কিছু খাবার নেওয়ার সিদ্ধামত্ম নিলাম – চায়ের প্যাকেট, চিনির বসত্মা, গুঁড়ো দুধ আর কিছু কম্বল। আমরা আজাদ মার্কেটের দিকে গেলাম, কারণ ওখানে আর্মিদের ফেলে যাওয়া মোটা কম্বলগুলো পাওয়া যেত।
পাহাড়গঞ্জ থেকে যেই আমরা চিত্রগুপ্ত রোডে ঘুরেছি, ঠিক পাহাড়গঞ্জ পুলিশফাঁড়ির সম্মুখে বিশাল জটলা দেখতে পেলাম। জটলা থেকে তারস্বরে চিৎকার করে সেস্নাগান উঠছে।
‘খুন কা বদলা খুন!’
রক্তের বিনিময়ে রক্ত!
আমাদের গাড়ি জটলার পাশ দিয়ে আসার সময় আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। মনে হলো আমার গলায় যেন কোনো বরফের টুকরা আটকে গেছে।
সেটা ছিল আতঙ্ক!
এক অতীত ভয়!
মৃত্যুভীতি… !
হাত-পা অসাড় হয়ে যাওয়া ভয়, আমার মেয়েকে নিয়ে, যে আমার পাশে বসে আছে, গু-ারা যদি তাকে ধরে নিয়ে যেত…।
কম্বল কেনার পর আমরা যমুনাব্রিজ পেরিয়ে এলাম। কিন্তু কোনো সৈন্য বা পুলিশ দেখতে পেলাম না। এমনকি কোনো সামরিক জামত্মাও নয়। কোনো মিলিটারি নেই। কোনো পুলিশও নেই। উর্দি-পরিহিত কেউ নেই! এমনকি আমরা কোনো পাগড়িও দেখতে পেলাম না। রাসত্মায় একজনও শিখ নেই!
ধীরগতিতে এগিয়ে আমরা গান্ধীনগর স্কুলে পৌঁছলাম। গেটের বাইরে একটা পুলিশের ট্রাক দাঁড়ানো। দুই-তিনজন পুলিশ বিশ্রামরত। চা খেতে খেতে তারা গল্প করছিল। গেটের অভ্যমত্মরে মানবিকতার উপচানো স্রোত। অগণন মানুষ। যারা প্রত্যেকেই স্কুলবিল্ডিংয়ের ভেতরে ঠাসাঠাসি অবস্থায় ছিল। এতটাই ঠাসা যে, ওখানে একটা সুচও ঢুকতে পারবে না।
ভীতসন্ত্রসত্ম মানুষেরা নিঃশব্দে দাঁড়ানো। তারা ছোট ছোট দলে শক্তভাবে জড়ানো, ঘরের প্রতিটি কোনা পূর্ণ করে ধুলোমলিন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে বসা ছিল। নারীরা, বাচ্চারা, পুরম্নষেরা আর বৃদ্ধরা।
মনে হলো ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ আমাকে চিনতে পেরেছে। সে তার দুই হাত উঁচু করে এবং কান্নাজড়ানো শিউরে ওঠা কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা মিশিয়ে বলল, ‘বিবিজি, আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্ত নয়! এখন কুয়াভর্তি রক্ত।’
সে হয়তো আমার স্বর্ণমন্দির আক্রমণের ওপর লেখা নিবন্ধটি পড়ে থাকবে – ‘Puddles of Blood!’
সেই সময় থেকে বড়জোর মাস পাঁচেক সময় গত হয়েছে। এবং এখন… !
গাড়ি রাখার কোনো জায়গা ছিল না। কিন্তু তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাল – গাড়িটা ভেতরে ঢোকান, গেটের ভেতরে। কে জানে বাইরে রাখলে কী হবে? কেউ হয়তো আগুন লাগিয়ে দেবে।
তারা আরো ঘেঁষাঘেঁষি করে একেবারে সংকুচিত হয়ে বসল। সবাই অমত্মত এক ইঞ্চি করে সরল, গাড়ির জন্য যথেষ্ট জায়গা করে দিতে।
অদ্ভুত! মানুষেরা কী বিস্ময়কর। তারা তো নিজেদের যাবতীয় কিছুই হারিয়েছে, কিন্তু আমার গাড়ির চিমত্মায় উদগ্রীব হচ্ছে।
আমরা গাড়ি থেকে সব বের করলাম। তারা বলল, ‘এখানে কিছুরই দরকার নেই। দাঙ্গা এখনো চলছে। যথেষ্ট খাবার আমাদের রয়েছে। আপনাদের এতটা কষ্ট করার দরকার ছিল না…।’
স্কুলবিল্ডিংয়ের পেছনে, যা একদা খেলার মাঠ ছিল, এখানে বড় বড় চুলায় আগুন জ্বলছে। একটাতে ডাল আর আরেকটাতে রম্নটি বানানো চলছিল।
‘কিন্তু এসব এখানে কীভাবে আসে?’
‘ওহ! এখানে একজন কিশেনলালজি আছেন। সকাল আর বিকেলে তিনি বসত্মা ভরে ডাল আর আটা নিয়ে আসেন। দোকানপাট সবই তো বন্ধ। কিন্তু কেউ কেউ বলে যে তিনি ধার করেন বা ভিক্ষা করে এসব আনেন। অথবা দোকানের তালা ভেঙে সবকিছু বের করে আনেন। যেভাবেই হোক আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে…। এখানে প্রায় দশ থেকে পনেরো হাজার মানুষ রয়েছে। কিশেনলালজি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন যাতে আমরা সকলেই খাবার পাই।’
মানুষ জবাই করা হচ্ছিল, কিন্তু মানবতাবোধ তখনো বেঁচে ছিল।
পেছনে খেলার মাঠ, মারাত্মকভাবে আহত ২০-২৫ জন মানুষ, তাদের অধিকাংশই অগ্নিদগ্ধ, ধূলিধূসরিত খোলা জায়গাতে তারা শোয়া ছিল। শুধু একজনের পিঠের নিচে কিছু একটা পেতে দেওয়া ছিল – তার স্ত্রীর ওড়না।
মাথামুখ অনাবৃতভাবেই সে স্বামীর শরীর ঘেঁষে বসা ছিল, দুটো পা ভাঁজ করে বুকের সম্মুখে রাখা, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
সকালবেলা পুলিশের ট্রাকে করে তাদের সবাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এদের ভর্তি নিতে অসম্মতি জানায়। তারা বলে, ওই গু-ারা আমাদের হাসপাতাল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে।
‘ওই গু-ারা’ অর্থাৎ আগ্রাসী জনগণ।
তাদের হাতে ও পায়ে পোড়া ঘায়ের তীব্র ক্ষত ছিল। অনেকেরই মাথা কেটে গিয়েছিল, অনেকের শরীরের নানা অংশ ভেঙেচুরে গিয়েছিল। এসবই ছিল ভীতিজনক দৃশ্য। সেখানে ছিল আশ্চর্যরকম অসহায়ত্ব। আমূল নাড়িয়ে দেওয়া, হাত-পা অবশ করা ভয়। একটা আপত্তিজনক পদত্যাগ।
আমরা কনৌটে ফিরে এলাম। ডেটল, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের টিউব কিনে পুনরায় ফিরে গেলাম। তাদের ক্ষতগুলো যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে যেন পট্টি বেঁধে দিতে পারি।
এবং তারপর, প্রথমবারের মতো বাতাসে বিপস্নবের ঘ্রাণ পাই। কারণ বাতাস তার দিক পরিবর্তন করে ফেলেছিল। যে-মানুষগুলো ঝাঁকাতে রাখা মুরগির বাচ্চাদের মতো খাঁচাবন্দি ছিল, তাদের অবশ্যও কোথাও না কোথাও মুক্তি জরম্নরি ছিল। দালানটি সবদিক থেকেই বদ্ধ অবস্থায় ছিল, শুধু গেট ছাড়া। কিন্তু তারপরও কারো বাইরে বেরোবার সাহস হয়নি।
এটা ছিল ‘গেট্টোর’ মতো। হয়তো এভাবেই ইহুদি সম্প্রদায় বেঁচে ছিল। ভীত ইঁদুরদের মতো লুকিয়ে-চুরিয়ে বেঁচে ছিল। নাৎসিদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এবং দলবেঁধে পোল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে বা যত্রতত্র উদ্বাস্ত্তদের মতো আশ্রয় নিয়েছিল। মৃত্যুর বিভীষিকায়, মাটির তলায় সুয়েজ পাইপে অথবা ম্যানহোলে অথবা পরিত্যক্ত চিলেকোঠাতেও তারা আশ্রয় নিয়েছিল।
রাত্তির যখন ঘন হলো, আমরা ওই জায়গা ছাড়লাম। এবং সরাসরি খুশবমত্ম সিংয়ের বাড়িতে পৌঁছলাম। তখন রাত সাড়ে নয়টার মতো বাজে। ওই সময়ে কোনো আত্মীয় বা বন্ধুও খুশবমত্ম সিংয়ের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পেত না। দর্শনার্থীদের জন্য তার বাড়ির দরোজা নয়টার আগেই বন্ধ হয়ে যেত।
কিন্তু সেটা ছিল বিপর্যয়ের দিন। ওইদিন সমসত্ম আইনকানুন ভেঙে পড়েছিল।
দরজা খুলে দিলো খুশবমত্ম সিং। আমি কখনো কারো সম্মুখে কাঁদি না। কিন্তু ওই রাত্রিতে… সারাদিনের শোকাভার, অসহায়ত্ব, ভয়, আতঙ্ক সবই যেন প্রচ- বেগে ছুটে এলো। আর প্রচ- বেদনায় অশ্রম্ন হয়ে গড়িয়ে নামল। যতটা বহন করা সম্ভব তার চাইতেও কতটা বেশি একজন মানুষ বহন করতে পারে? আমি তার কাঁধে মাথা রেখে অসহায়ের মতো চিৎকার করে কাঁদলাম। আর অর্পনা নিজের ওড়না দিয়ে খুবই নিঃশব্দে চোখ মুছে গেল।
খুশবমত্মকে আমি সব খুলে বললাম। সে চুপ করে সবকিছু শুনে গেল। আমি তাকে বললাম, ‘গান্ধীনগর স্কুলবিল্ডিংয়ের পাশে শ্যামলাল কলেজ বিল্ডিং। সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। আপনি যদি লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে বলেন কলেজ খুলে দিতে, তাহলে হয়তো হাজার হাজার মানুষ বসার জন্য সামান্য জায়গা পায়, বা অল্পস্বল্প হাঁপ ছাড়তে পারে।’
খুশবমত্ম বলল, সে গত তিন-চারদিন ধরে গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এইসব দিনগুলিতে, কি মন্ত্রী, কি পুলিশ অফিসার অথবা কোনো সরকারি কর্মকর্তা, গভর্নরসহ, এমনকি সে ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রপতি হলেও একই জবাব শোনা যাচ্ছিল – সাহেবকে পাওয়া যাবে না।
ওই দিনগুলোতে কাউকেই কোথাও পাওয়া যেত না। কাউকে বাইরেও দেখা যেত না। তাদের সেক্রেটারিরা তোতাপাখির বোলের মতো একই বোল বারংবার শোনাত ‘সাহেবকে এখন পাওয়া যাবে না। সে মিটিংয়ে চলে গেছে।’
এসবই সত্য ছিল। পুরো দেশ যেন প্রচ- ঝড়ের খপ্পরে পড়েছিল। এক ঘূর্ণায়মান অন্ধকার ঘূর্ণিঝড়।
ঘূর্ণিঝড়টি ধুলা উড়াচ্ছিল না, কিন্তু বাতাস ছিল ক্ষিপ্র, কিন্তু রক্ত।
সূর্য হারিয়ে গিয়েছিল। আর আকাশ এক রক্তাক্ত চাদরের তলায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল।
‘আমি পুনরায় চেষ্টা করব’, খুশবমত্ম সিং বলল।
‘আমি আবারো রাতে ফোন দেবো। আমি তার বাড়িতে কল করব। যা ঘটেছে তার চাইতেও বেশি খারাপ তারা আর কী ঘটাতে পারে? এবং আমারই বা আর কী হারানোর আছে? সুইডিশ দূতাবাসে আমি আমার পরিবার নিয়ে দুইদিন আশ্রিত ছিলাম। আজই আমরা বাড়িতে ফিরে এসেছি। কারণ গভর্নমেন্ট বলেছে যে, শহর আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখন নাকি আর কিছুই ঘটবে না।’
‘আর্মি? সারাদিনে আমরা তো কোনো আর্মির চিহ্নই দেখলাম না। গান্ধীনগর স্কুল থেকে কয়েক কদম দূরে, গু-ারা বারোজনকে হত্যা করেছে। আমরা তার সাক্ষী। অসহায়ের মতো দূর থেকে দেখছিলাম। এবং পাঞ্জাবেও কিছু একটা হয়েছে। কারণ রক্তপিপাসুদের একটা দল ওখানেও জমায়েত হয়েছে। আমরা ওদের পেরিয়ে এসেছি। আমরা যমুনাব্রিজ চার-চারবার পারাপার করেছি, কিন্তু কোথাও কোনো মিলিটারি ছিল না। আপনারা সাবধানে থাকবেন। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে রাখবেন।’
ওই রাতে প্রায় আড়াইটার দিকে আমার খেয়াল হলো যে, একজন খুবই আমত্মরিক ভালোমানুষ উঁচুমাপের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ – হরবংশ সিংহ ওয়াসির – ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট জ্ঞানী জেইল সিংহের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। যে-কোনো মানুষ তার নিজের অবস্থান বা পদমর্যাদা নিয়ে অন্ধ হতে পারে, এটা তেমন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু চিকিৎসকের প্রতি তার দুর্বলতা থাকেই, যা সে কখনো উপেক্ষা করতে পারে না –
সুতরাং আমি ডাক্তার ওয়াসিরকে ফোন করলাম।
‘দয়া করে জ্ঞানীজীকে বলবেন যাতে শ্যামলাল কলেজ শরণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এবং হরবংশ, যদি সম্ভব হয় উনাকে বলবেন যাতে পনেরো থেকে বিশটি টেম্পোরারি শৌচাগার বানাবার ব্যবস্থা করে দেন। এবং ওই কয়জন ক্লিনারও দরকার। ক্লিনারদের অমত্মত মাটিতে যেন কয়েকটি গভীর গর্ত খুঁড়তে দেওয়া হয়। কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপক আশংকা রয়েছে। আপনি ওখানে একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে পারেন? বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছে। তারা ক্ষতস্থান উন্মুক্ত অবস্থায় ধুলা-ময়লার ওপর শুয়ে রয়েছে… তাদের গ্যাংরিন হওয়া হয়তো ঠেকানো যাবে। ওই ক্ষতগুলো যে কোনো সময় সেপটিকে রূপ নিতে পারে।’
আমি জানি না, ওটা হরবংশের চেষ্টা ছিল নাকি খুশবমেত্মর প্রভাব। কিন্তু ঠিক তিনদিন পরই শ্যামলাল কলেজের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। অস্থায়ী শৌচাগার নির্মিত হয়েছিল, ক্লিনারও নিযুক্ত করা হয়েছিল।
আহতদের জন্য হরবংশ শুধু একটা অ্যাম্বুলেন্সই পাঠাননি, ডাক্তারদের একটা টিম পাঠিয়েছিলেন।
কয়েকজন শিল্পী, সমাজকর্মী ও নাট্যকর্মী মিলে একটা দল তৈরি করেছিল। তারা খুব ভোরবেলায় লাজপাত ভবনে মিলিত হতো, যা ছিল খাবার, কাপড়, জুতা, কম্বল এবং লেপ সংগ্রহ করার মূল স্থান। তারা সেসব থেকে বাছাই করে, ভ্যানে তুলে শহরের বিভিন্ন ক্যাম্পে পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করত।
অর্পনা ও আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। দলটি নিয়ম মেনে কাজ করত এবং তারা যে সেবা ও সাহায্য দিচ্ছিল তা ছিল সে-সময়ে খুবই দরকারি।
এদের কেউ-ই আবেগপ্রবণ বা স্পর্শকাতর ছিল না। শুধু গভীর মানবিক বোধই তাদের সহানুভূতিশীল হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাদের কেউই আমার মতো কান্নাকাটি করেনি। তারা ছিল একেবারে সহযোদ্ধাদের মতো। বাসাবাড়ির আয়েশি জীবন বাদ দিয়ে, প্রিয়জনদের দূরে ঠেলে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। বর্বর, রক্তপিপাসু গু-াদের ভয়াবহ আক্রমণ থেকে মানবতাকে সুরক্ষা করাই ছিল তাদের অঙ্গীকার।
শ্যামলাল কলেজের গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছিল। এবং রম্নমগুলোও। কিন্তু স্কুলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে কেউ ওখানে যেতে চায়নি। এমনকি স্কুল আর কলেজের মাঝখানের সরম্ন রাসত্মাটাতেও কেউ পা ফেলতে চায়নি। ওই রাসত্মাতে পা ফেলা মানে ছিল মৃত্যুর অন্ধকার রাজ্যে প্রবেশ করা। রাসত্মায় বের হওয়া মানে খুনে জনতার অনুকম্পার ভেতর থাকা। বিপদকে সেধে আমন্ত্রণ জানানো। বিপদের টগবগে ফুটমত্ম কড়াইয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়া।
কী অদ্ভুত সময়! যেখানে কেউ যাতে রাসত্মায় বের না হয় সেজন্যই ভয় দেখানোর কথাও, অথচ তারা নিজেরাই রাসত্মার ভয়ে গুটিসুটি মেরে আছে।
‘চলুন গান্ধীনগর স্কুলের পাশের দেয়ালটা ভেঙে দিই আর কলেজের সাথে সংযোগ তৈরি করি। যাতে করে মানুষগুলোকে আর রাসত্মা পার হতে না হয়।’
আমি প্রসত্মাব রাখি।
‘কিন্তু পুলিশ?’
স্কুলের পেছনের আঙিনায় এক গাছের নিচের উঁচু পস্ন্যাটফর্মে দুজন পুলিশ বসা ছিল। আমি তাদের একপাশে সরিয়ে নিয়ে কথা বললাম –
‘আমাদের এই কাজটা করতেই হবে। আপনারা কত টাকা চান?’
পুলিশ দুটো বেশ অস্বসিত্মতে পড়ল। পাঁচ সেকেন্ড কিছুই না বলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতাকি করল। ‘কিন্তু পরে যদি স্কুল-কলেজের কর্তৃপক্ষ এর বিরোধিতা করে…?’
‘এ নিয়ে চিমত্মা করবেন না। দেয়ালদুটি মেরামত করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’
আমি তাদের টাকা দিলাম। তারা তখন ফের বলল, ‘আপনি যদি দেয়ালগুলো মেরামত না করেন।’
আমি তখন তাদের আমার প্রেসকার্ড দেখালাম এবং আমার নিজের ভিজিটিং কার্ডও তাদের হাতে দিলাম।
‘আমার সামান্য উপকার করবেন। পুলিশের ট্রাকটা ঠিক গেটের সামনে পার্ক করা, দয়া করে এটাকে রাসত্মার মাথায় নিয়ে রাখেন। আমরা দুটো বিল্ডিংয়েরই দরজা বন্ধ করে দেব। যদি কোনো আক্রমণকারী আসেই, তবে তাদের গলির ভেতর দিয়ে আসতে হবে; এবং আপনারা তো গলির সম্মুখেই পাহারা দেবেন। তখন আর কোনো বিপদ থাকবে না।’
তখন মোটামুটি সবাই জানত যে, সবচাইতে বড় বিপদ পুলিশরা নিজেই, কারণ প্রতিটি রক্তপিপাসু গোষ্ঠীকেও পুলিশ নিজেরাই পাহারা দিয়ে রক্ষা করেছে। এমনকি পুলিশের জিপগুলো পেট্রোলের কেনেসত্মারা ও কেরোসিন তেল বহন করে দিত, যাতে করে ওই সন্ত্রাসীরা মানুষের শরীরে আগুন লাগাতে পারে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে পারে। কিছু কিছু পুলিশ লুট ও ধর্ষণের কাজেও লিপ্ত ছিল।
এমনকি অনেক জায়গায় পুলিশই আগে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেছে – বেশিরভাগই কৃপাণ। কখনো রিভলবার ও বন্দুক। তারা বলত যে, শামিত্ম রক্ষার্থেই তারা এতকিছু করছে। যখন মানুষগুলোর হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হতো তারপরই সন্ত্রাসীরা চিৎকার করতে করতে আক্রমণ চালাত…।
হত্যাকা- সংঘটিত হতো চেঙ্গিস খান এবং তৈমুরের স্টাইলে, পুলিশ এ সবই জানত এবং তাতে তাদের আশীর্বাদও থাকত।
কিন্তু কিসের আশীর্বাদ? তারা বলত তাদের ওপর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দেশ তো যে-কোনো সমর্থনের জন্য সবসময়ই পুরস্কার দিয়েছে। হাবিলদার থেকে মন্ত্রী, পিয়ন থেকে প্রধানমন্ত্রী সবাই সমর্থন ব্যবহার করে এবং নিজেদের অংশ বুঝে নেয়। অনুগ্রহে সণাত হওয়া! এবং কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানানো হয় সমসত্ম করম্নণার জন্য।
এই আক্রমণগুলো অতীতের আক্রমণের চাইতে ভিন্ন ছিল – তা চেঙ্গিস খান, তৈমুর কিংবা নাদির শাহ যে-ই হোক না কেন? ওই মানুষগুলোর মাঝে নিজস্ব উচ্চাকাঙক্ষা প্রজ্বলিত ছিল। তারা রাজ্য জয় করছিল, সাম্রাজ্য বিসত্মার করছিল, আর তাদের এলাকা বড় করছিল – এসবই তারা করছিল যশ ও বিজয় হসত্মগত করার লক্ষক্ষ্য, তারা এজন্য রক্তের নদী পাড়ি দিয়েছিল।
কিন্তু তখনকার আক্রমণগুলো শুধু নৃশংসতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ এবং তাদের নিজেদের পশুত্বের জঘন্যতম প্রমাণ। আমি আমার সত্তার খুব গহিন থেকে ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলো পুনরায় অনুভব করলাম। এইসব আক্রমণ, খুন, নাৎসিদের কাজের অনুরূপ এবং ঠান্ডা মাথায় সম্পাদিত। নামের তালিকা ধরে ইহুদিদের খুঁজে বের করা হতো। তারা ইহুদিদের টেনে বের করত – পুরম্নষ, স্ত্রীলোক, শিশুদেরও, যারা ইঁদুরের মতো লুকিয়ে থাকত বর্জ্য, ড্রেন বা ম্যানহোলে, অতঃপর নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে তারা তাদের ভাগ করে নিত। এবং তারপর তাদের বন্দিশালা ও গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হতো। ষাট মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করা হয়।
এবং আজো যখন আমি নভেম্বর ১৯৮৪-র হত্যাকা–র বহু বছর পর লিখছি, এখনো শত শত হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এটা বছরের পর বছর ধরেই চলছে।
আমার নিজের দেশ, ভিওয়ানরি, স্যালালা, গুজরাট, মুম্বাইয়ের রক্তভেজা পাতা আমার চোখের সামনে ওড়ে। যে-পাতাগুলোর জন্য ইতিহাস সবসময় লজ্জিত থাকবে। পাঞ্জাব ও কাশ্মির এবং আসাম ও বিহার – প্রতিটি এলাকা রক্তের গাঢ়-লাল-মেঘে ঢাকা। এবং হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে সেই আত্মা-কাঁপানো স্মৃতি, যা আজো আমাদের লোম জড়িয়ে দেয়।
মানুষ! ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! যাদের মনের অভ্যমত্মরে আজো বর্বর পশুত্ব বেঁচে আছে, আর রক্তের জন্য চিৎকার করছে।
যাই হোক, ইশকুল এবং কলেজের দেয়ালগুলোকে ভাঙা হয়েছিল ওই মানুষগুলোকে একটু বেশি জায়গা দেওয়ার জন্য। তারপরও একেকটা রম্নমে পনেরোটি করে পরিবার ছিল। তারা বারান্দাগুলোতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, এবং উন্মুক্ত জায়গাতেও।
প্রায় একমাস, আমরা, অর্পনা এবং আমি – ওখানে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যমত্ম থাকতাম।
সপ্তম দিনে, মাদার তেরেসার মিশনারিরা নারী এবং শিশুদের জন্য গুঁড়ো দুধের টিন এবং বিস্কুট নিয়ে এসেছিল। তারা সারাদিন থাকত, দিনের পর দিন, ক্ষুধার্তদের খাওয়াত এবং সুস্থদের পরিচর্যা করত।
দশম দিনে একটি তাঁবু খাটানো হয়েছিল। এবং একজন বেঁটে-মোটালোক, সম্ভবত সরকারি অফিসার ওই তাঁবুতে অবস্থান করছিল। প্রায় আধ ডজন পুলিশের লোক দিনে ও রাতে তার চারপাশ ঘিরে থাকত।
সে প্রথমেই যা করল, তা হলো আমাদের স্টোররম্নমে তালা ঝুলিয়ে দিলো। ওই রম্নমে আমরা নিজেদের আনা, কিংবা বন্ধু, আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আনা জিনিস রাখতাম। এই যেমন কম্বল এবং লেপ। খাবার এবং ওষুধের স্টক।
আমরা জেনেছিলাম যে, রাত নয়টার সময় প্রতিটি রম্নমে গিয়ে প্রয়োজনীয় লেপ-কম্বল বিতরণ করতে হবে। এটা খুব সুনিয়ন্ত্রিতভাবে করা হতো। ওই দিনের একটি তালিকা প্রথম করে নেওয়া হতো। তারপর স্টোর থেকে কম্বল বের করে ওই তালিকা ধরে ধরে বিতরণ করা হতো। একটা স্বেচ্ছাসেবী দল কাজের এক একটি অংশ ভাগ করে নিয়েছিল। তারা নিজেদের ভাগে পড়া শরণার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।
ওই রাতে তালিকা যখন তৈরি, আমরা স্টোরে গিয়ে দেখলাম যে, তাতে তালা দেওয়া এবং একজন অস্ত্রধারী পুলিশ সেটা পাহারা দিচ্ছে।
‘এখানে তালা দিলো কে?’ আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘সাহেব দিয়েছে’ – সাহেবের দালাল উদ্ধতভাবে জবাব দিলো।
‘সাহেব! কোন সাহেব?’
‘উনি আজকেই ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি সরকারের সাহেব।’ সে দায়সারাভাবে বলল।
‘উনি কোথায়?’
‘উনার অফিসে গিয়ে খোঁজ করেন।’
‘অফিস কোথায়?’
‘ওইখানে। তাঁবুর ভেতর।’
তাঁবুর ভেতর আরো কিছু অস্ত্রধারী পুলিশ বিশ্রামরত ছিল, তাদের পা টেবিলের ওপর তুলে রাখা, যেন তারা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে।
‘সাহেব কোথায়?’
‘এখানেই কোথাও আছে হয়তো’ – তারা এমনো উপেক্ষার সঙ্গে জবাব দিলো যে, যেন বলছে –
‘বেরিয়ে যাও।’
‘এখানে কোথায়?’ আমি রাগতে শুরম্ন করলাম। এবং সামান্য সাহসও পেলাম। কারণ ইতোমধ্যে আমাদের কিছু লোক সেখানে পৌঁছেছিল। তারা আমাকে চুপিসারে বলল, ‘সাবধান! এই কুত্তার বাচ্চারা খুব খারাপ হতে পারে… তারা আমাদেরও বের করে দিতে পারে। যারা মানুষ মারতে পারে তারা যে-কোনো কিছু করতে পারে।’
‘তারা শুধু হত্যা করতেই জানে। তাই, আরো কয়েকজন খুন হবে!’ আমি ক্ষেপে গেলাম।
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘বলুন উনি কোথায়? সে তো ক্যাম্পে নেই… আমরা পুরোটা ঘুরে এসেছি।’
‘তাহলে উনি রাতের খাবার খেতে গিয়েছেন। এখন রাতের খাবারের সময়। তার তো খেতে হবে, তাই না?’
ওদের একজন গলা চড়িয়ে বলল।
আমরা সাহেবের জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। অবশেষে উনি এলেন। পান চিবুতে চিবুতে ও পানের পিক ফেলতে ফেলতে।
‘আপনিই কি ইনচার্জ? নতুন ইনচার্জ?’
‘হ্যাঁ, আমিই!’ উনি যেন আমাদের ওপর বজ্র ফেললেন।
‘এবং আপনি রাত ১১টা পর্যমত্ম কোথায় ছিলেন?’
‘আমি আপনাকে জবাব দিতে বাধ্য নই।’
ইংরেজিতে বললেন উনি।
‘না, আপনি কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন! আপনি তো সরকার। আর সরকার হলে…’
‘আপনি কী চান?’ উনি কর্কশভাবে জানতে চাইলেন।
‘আপনি স্টোরে তালা লাগিয়েছেন কেন?’
‘আমি তালা লাগাবো না কেন? আমি এই কাজের ইনচার্জ।’
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সব নিরাপত্তা তো আপনার জন্যই। আপনি অবশ্যই একজন ওপরওয়ালা। আপনি কি ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন! কারো কোনো উপকার করেছেন? আপনি একটিও অভিযোগ লিখেছেন বা কোনো প্রতিবেদন? কোনো পরিবারের হারিয়ে যাওয়া কোনো সদস্যকে খুঁজে বের করার জন্য আপনি কি কাউকে নিযুক্ত করেছেন? কোনোটাই আপনি করেননি। আপনি যা করেছেন তা হলো স্টোরে তালা দেওয়া… ! দুই ঘণ্টা পরে এখন পান চিবাতে চিবাতে এসেছেন… !’
‘একজন সরকারি কর্মকর্তাকে অপমান করার জন্য আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি… ’
‘অবশ্যই। কেন নয়? আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন, আপনি আমাকে খতম করে ফেলতে পারেন – জেলে কিংবা ভেতরে। আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে আমার খুব ভালো ধারণা রয়েছে। আপনি যা-ইচ্ছা-তাই করতে পারেন, কিন্তু এখন স্টোরটা খুলে দিন।’
‘স্টোর খোলা হবে না।’
‘স্টোর অবশ্যই খুলতে হবে এবং এখনই।’
আমি জোর প্রতিবাদ করলাম এবং আমার ট্রাম্পকার্ড ছুড়লাম – সেটা আমার প্রেসকার্ড। ‘এখানে আপনি আমার নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে পারেন। আপনার যখন খুশি আমাকে গ্রেপ্তার করবেন। কিন্তু এক্ষুনি তালা খোলেন। স্টোরের একটা পিনও সরকারি সম্পত্তি নয়, যা আছে সব আমাদের নিজেদের টাকাতে কেনা। আমাদের নিজেদের কষ্টের টাকা, ঘুষের টাকা নয়।’
এতক্ষণে তাকে বিচলিত মনে হলো। কারণ এসব কিছুই ঘটছিল তার অধসত্মনদের চোখের সামনে। সে তালা খুলে দিলো এবং হালকাভাবে বলল, ‘আমি আপনাকে দেখে নেব।’
এটা এক ধরনের হুমকি ও মানসিক দুশ্চিমত্মার – এমনই মনে হলো।
ওই ক্যাম্পে দশ থেকে পনেরো হাজার মানুষ ছিল, যাদের অমত্মত দশ থেকে পনেরো হাজার গল্প ছিল বলার জন্য। এই ক্যাম্পে আরো অনেক গল্প ছিল যারা ত্রিলোকপুরি, উত্তমনগর, শাহ দারা এবং সংযুক্ত কলোনিগুলো থেকে এসেছিল, তাদের। আমি আপনাদের সেসব থেকে মাত্র তিনটি গল্প বলব।
এক মহিলা রম্নমের এক কোনায় বসে থাকত, তার চারজন সমত্মান তার চারপাশে জড়ো হয়ে থাকত। তাকে যখনই লঙ্গর থেকে খাবার নিয়ে যেতে বলা হতো সে শুধু তার মাথা নাড়ত। ‘বাচচাদের খাবার? দুধ?’ এ-প্রশ্নের উত্তর ছিল, ‘না।’ একদিন গেল। দুদিন গেল। তিনদিন কেটে গেল। তখন সে আর বসে থাকতে পারছিল না। সে মেঝের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, মৃতের মতো, অসহায়ের মতো। তার সমত্মানেরা তার পা এবং পেটের সঙ্গে সেঁটে থাকত, তাদের পা পেটের কাছে ভাঁজ করে, তাদের মাথা ঝুলে পড়ছিল।
‘সে নিজেও খায় না, বাচ্চাদেরও খেতে দেয় না। আমরা কী করতে পারি?’
আমরা অন্য রম্নমগুলো থেকে লোকজন ডেকে আনলাম, যদি কেউ তাকে চিনতে পারে। অমত্মত তার নিজের কলোনির কেউ তো তাকে চিনবে। শেষ পর্যমত্ম আমরা একজন লোক পেলাম, সে তার কাছে গেল, পাশে বসল এবং তার সঙ্গে কথা বলল : ‘বিবি ওঠো। সাহস সঞ্চয় করো। তুমি তো একাই ভুক্তভোগী নও… সবাই কষ্ট পেয়েছে।’
মহিলাটি চোখদুটো খুলে সামান্য দেখল এবং চিৎকার করে, অসহায়ের মতো অঝোরে কাঁদতে লাগল।
‘ওকে কাঁদতে দাও। যদি সে কাঁদে তাহলেই সে তার বাচ্চাদের দেখতে পাবে। যদি কাঁদে তবেই সে ওদের খাওয়ানোর কথা চিমত্মা করবে।’ এরপর ওই লোক ২ নভেম্বরের ঘটনা বলল, যখন গু-ারা তাদের কলোনিতে আক্রমণ চালিয়েছিল।
‘তারা ওর স্বামীকে টেনে-হিঁচড়ে রাসত্মায় নিয়ে এসেছিল, তার তাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছিল এবং তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্যামত্ম পুড়িয়ে মেরেছিল।
তার চিৎকার ছিল গগনবিদারী। ওর সবচাইতে বড় ছেলে ঘরের ভেতরে রয়ে গিয়েছিল। একটা বড় টিনের ট্রাঙ্কের পেছনে। সে তারা অন্য বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়ে রাসত্মায় বের হয়েছিল…
প্রতিবেশীরা তাকে এবং তার বাচ্চাদের ধরে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল এবং লুকিয়ে রেখেছিল।
এরপর গু-ারা ওর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর সে পাগলের মতো বারংবার দরজা খুলে বের হয়ে যেতে চায়। আর বলতে থাকে, ‘আমার সোহান কোথায়? আমাকে যেতে দাও। আমাকে গিয়ে ওকে আনতে দাও। গু-ারা ওকে মেরে ফেলবে…’
গু-ারা উলস্নাস করতে করতে চলে যাওয়ার পর প্রতিবেশীরা আমাদের এবং বাচ্চাসহ এই মহিলাকে এই ক্যাম্পে নিয়ে আসে।’
‘মাঝরাতে সে বাড়িতে গিয়েছিল ছেলে সোহানকে খুঁজতে। তখন বাড়িটি থেকে ধোঁয়া বের হচিছল এবং বাড়িটি দেখে মনে হচ্ছিল পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এক বিশাল গর্ত।’
‘বাড়ির ভেতরে সে সোহানের অর্ধেক-পুড়ে-যাওয়া শরীর খুঁজে পেয়েছিল। সে ভাবছিল কুকুরেরা এই দেহ খুঁজে পেলে খেয়ে ফেলবে। সে রাতের বাকিটা ওই অর্ধপোড়া দরজা এবং জানালা নামিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়েছিল এবং তার ছেলের মৃতদেহ পোড়ানোর চেষ্টা করছিল।’
‘আমরা পরে প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি যে, সে তাদের কাছে দিয়াশলাই ও কেরোসিন তেল ধার চেয়েছিল।’
‘এই অসহায় মহিলা, যে আধপোড়া কাঠ সংগ্রহ করে তার অর্ধদগ্ধ ছেলের সৎকার করতে চেয়েছিল! তার আর কি-ই বা হতে পারে?’
মহিলা অনবরত কাঁদছিল। আমরা তার জন্য পানি নিয়ে এলাম। সে উঠে পানি পান করল। আমরা তার সামনে খাবারের থালা রাখলাম। সে থালা থেকে কম্পিত হাতে এক লোকমা খাবার তুলে নিল ও সবচাইতে ছোট বাচ্চাটির মুখে দিলো…
আমি এখন দ্বিতীয় গল্পটি বলব। একজন আকর্ষণীয়, সুশ্রী মধ্যবয়স্ক পুরম্নষ ও তার পরিবার বারান্দায় বসেছিল। তার পাশেই ছিল তার সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী ও আকর্ষণীয় স্ত্রী। আর তাদের ছেলে, যার চুল ছিল ঘাসের মতো করে ছেঁটে রাখা। এটা সর্দারনির গল্প।
‘কারখানাটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাড়িটা লুটপাটের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবেশীরা আমাদের লুকিয়ে রেখেছিল। যখন তারা আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে এলো তখন তারা মিনতি করেছিল –
‘বিবিজি তোমার ছেলের জীবন বাঁচাও। ওর চুল কেটে ফেল।’
আমি কেটে ফেলেছি ওর চুল, আমার অভিশপ্ত হাত দিয়ে…’
সে অসম্ভব কাঁদছিল।
এরপর সে দোপাট্টায় চোখ মুছতে মুছতে বলতে লাগল।
‘ফ্যাক্টরি আর বাড়ি কোনো বিষয় নয়। গুরম্নজি ওসব আশীর্বাদ করেছিলেন এবং ফের নিয়ে গিয়েছেন। উনিই সবচাইতে ভালো জানেন… উনিই আমাদের দেখবেন। উনি সেগুলো আবার ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু কাকার চুল! হায়! আমি কতই না যত্ন করতাম এগুলোর। টকদই দিয়ে পরিষ্কার করে দিতাম… ! কি সুন্দর! স্বর্ণাভ বাদামি চুল!’
তৃতীয় গল্পটি একজন বৃদ্ধের, যে-বারান্দার এক কোনায় বসে থাকত। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সে ওখানে বসে ছিল। মাঝে মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমাত, মুখটা সামান্য হাঁ-করা। যখন সে ঠান্ডায় কাঁপত তার সাদা দাড়িগুলোও কাঁপতে থাকত। তার ভ্রম্নজোড়াও ছিল উষ্কখুষ্ক ও সাদা। সে পুরনো পাজামা আর কুর্তা পরে ছিল আর মাথা ছিল অনাবৃত ও সাদা চুলে ঢাকা।
আমরা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে তার চোখ বন্ধ করেই রেখেছিল। মাঝে মাঝে আমরা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি শুনতাম। ‘ওয়েহে গুরম্ন, ওয়েহে গুরম্ন।’ এবং সে দীর্ঘশ্বাস ফেলত।
আমরা জানতে পেরেছিলাম তার দুটো ছেলেই ছিল অটোরিকশাচালক। তারা দুদিন যাবৎ ঘরে ফেরেনি। যখন তাদের কলোনিতে আক্রমণ চালানো হয় সে তার দুই পুত্রবধূ এবং নাতিদের নিয়ে কোনোভাবে ক্যাম্পে পালিয়ে আসে এবং দৌড়ে আক্রমণকারীদের কৌশলে এড়িয়ে।
এর দুইদিন পরই পুত্রবধূরা তাদের স্বামীদের খুঁজতে চলে গিয়েছিল।
‘আর বাচ্চারা?’
‘আমি জানি না ওরা ওদের নিয়ে গিয়েছে কিনা, নাকি ওদের অন্য কারো কাছে রেখে গিয়েছে কিনা? এতসব ভিড়ের মাঝে আমি কীভাবে তাদের খুঁজব…?’ এবং তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যেতে থাকে।
ওই মুহূর্তে আমার দর্জির কথা মনে হয়, আমার বাবা। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এভাবেই কোনায় বসে থাকতেন। তাঁর সাদা দাড়িগুচ্ছও হয়তো এই বৃদ্ধ লোকটার মতো কাঁপত। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম এজন্য যে, উনি এগুলো দেখার পূর্বেই পরলোকগমন করেছেন!
‘বাপুজি!’ আমি উনাকে আলতোভাবে স্পর্শ করলাম, ‘দয়া করে কম্বলটি নিন। এখানে ভয়ানক ঠান্ডা।’
‘না। এটা কোনো অভাবী কাউকে দিন।’
‘কিন্তু যদি আপনার ঠান্ডা লাগে আর জ্বর আসে?’
‘তাহলে ভালোই হবে। আমার বাঁচার মতো আর কিছুই নেই।’
আমি কম্বলটি তার পাশেই রেখে দিলাম। কিন্তু পরদিনও সেটা ওখানেই ছিল, যেখানে আমি রেখেছিলাম। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু উনি কিছুই গ্রহণ করেননি, না-কাপড়, না-কম্বল।
সপ্তম বা অষ্টম দিনে আমি তার জন্য একটা সাদা পাগড়ি নিয়ে গেলাম। মিনিটখানেকের জন্য সে পাগড়িটির দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে। আমি জানি না তার চাহনিতে কী ছিল? কিন্তু আমি যেন ছ্যাঁকা লাগা তাপ অনুভব করলাম। এখনো কোনো কোনো রাতে আমি সেই তাপ অনুভব করি।
সে কম্পিত হাতে পাগড়িটি গ্রহণ করল। অতঃপর ধীরে ধীরে সে ওটার ভাঁজ খুলল, এবং দুই হাত দিয়ে বাঁধতে শুরু করল।
এক ভাঁজের উপর আরেক ভাঁজ। বাঁধা শেষ করে সে ফের আমার দিকে তাকাল। তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ল। অশ্রম্নজলের ধারা তার গালের ভাঁজ বেয়ে নামতে লাগল। মুখাবয়বে ভেজা ছাপ রেখে সেই জলধারা তার দাড়ির অরণ্যে হারিয়ে গেল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.