নাজিম হিক্মতের রুবাই

ভূমিকা ও অনুবাদ : কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

[১৯৪৫-এর ডিসেম্বর মাসে নাজিম হিক্মত তাঁর স্ত্রীর কাছে লিখলেন, ‘প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সাহিত্যে কখনো যা করা হয়নি, আমি তা-ই করার চেষ্টা করতে যাচ্ছি – রুবাইয়াতের আঙ্গিকে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদকে হাজির করা।’ একটি সনাতন আঙ্গিককে নূতন বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে মেলানোর শৈলীগত সমস্যা প্রথম থেকেই হিক্মতকে আকৃষ্ট করে রেখেছিল। সৎপুত্র মেমেত্ ফুয়াত্কে লেখা এক চিঠিতে তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, এক্ষেত্রে আদি আঙ্গিকটি কাজ করে একটি আদলের : ‘নিজেদের শিল্পকে যারা আয়ত্ত করেছেন এমন যথার্থ কবিরা কিছু একটা ছক কিংবা ছন্দ ছাড়া কখনো লেখেন না – যদিও তাঁরা তা অস্বীকার করতে পারেন – কারণ, যদি তাঁরা তা করতেন, তাহলে তো তাঁরা গদ্যই লিখতেন। চতুষ্পদী লেখার বেলায় গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্ত্যমিল; কারণ, রুবাইয়াত – এমন কি তন্মধ্যে যা সর্বাধিক দার্শনিক কিংবা গীতল – কাব্যে তা মতবিরোধী, শিক্ষামূলক (polemical, didactic) একটি ধারা। সেগুলোকে সহজে মুখস্থ করার যোগ্য হতেই হবে; সেগুলো হবে মিতভাষী। চিরায়ত ছন্দকল্প [aaba] এরূপ সবকিছুকেই সম্ভব করে। তবে, কখনো-কখনো ছন্দের কোনো আধুনিক ব্যবহার চিরায়ত ছন্দছকের স্থান নিয়ে নিতে পারে।’ হিক্মত জানান যে, প্রথম কয়েকটি রুবাইতে তিনি গা-গরম করার মতো করে চিরায়ত আঙ্গিককে রক্ষা করার জন্যে কাজ করেছেন; পরবর্তী সময়ে নিজের নূতন বিষয়বস্ত্ত ধারণ করানোর জন্যে তাতে আনেন পরিবর্তন।] – ‘নাজিম হিক্মতের রুবাই’ সম্পর্কে নিউইয়র্কের পার্সিয়া বুকস-প্রকাশিত পোয়ে্ম্স অফ নাজিম হিক্মতের সম্পাদক রান্ডি ব্লেসিং এবং মুট্লু কোনুক এই পরিচিতি দিয়েছেন। –
ভাষান্তরকারী।
প্রথম ধারা

এক
রুমি, তোমার দেখা পৃথিবীটা বাস্তব – ভৌতিক কিছু নয়;
অশেষ আর অ-সৃষ্ট, মহাতাড়নকারীর কোনো কান্ড তা নয়।
আর তোমার জ্বলন্ত সত্তা যে শ্রেষ্ঠ রুবাই আমাদের জন্যে রেখে গেছে,
তা নয় ‘সকল অঙ্গই ছায়া-ছায়া,’ ইত্যাদি…

দুই
সে-রূপসীর জন্মের আগে আমার আত্মা ছিল না; তেমনি সে
যে-রহস্য নয়,
তাতে আমার আত্মা উত্তীর্ণও নয় :
আমার আত্মা তার ছবি, আমার মধ্যে প্রতিফলিত বহির্বিশ্বের প্রতিচ্ছবি সে।
আর, আদি সত্তার সর্বাধিক দূর এবং নিকট ছবি
হলো আমাকে উদ্ভাসিত-করা আমার প্রেমের সৌন্দর্য…

তিন
আয়নায় আমার প্রিয়ার ছায়া কথা বলতো :
সে আমাকে একদিন বললো, ‘সে সত্য নয় – সত্য আমি’।
আমি আঘাত করলাম, আয়নাটা ভেঙে গেল, তার প্রতিবিম্ব কোথায় লুকলো,
কিন্তু, রক্ষা, আমার প্রিয়া থেকে গেল তার আগের জায়গায়…

চার
ক্যানভাসে তোমাকে এঁকেছি মাত্র একবার;
কিন্তু, মনে-মনে প্রতিদিন তোমার ছবি অাঁকি হাজারখানা।
বিস্ময়কর হলো, ক্যানভাসেই তোমার ছবি টিকে যাবে :
আমার চেয়ে তার আয়ু বেশি…

পাঁচ
আমি তোমার ছবিকে তো চুমু খেতে পারি না, ছবির সঙ্গে সঙ্গম করতে,
কিন্তু, নগরে সেখানে তুমি রক্ত-মাংসের নারী,
এবং সেখানে তোমার রক্তিম মুখ, আমার নাগালের বাইরের মধু, তোমার বিশালাক্ষী,
আর তোড়ের জলের মতো তোমার আত্মনিবেদন, তোমার সেই শুভ্র
যাকে আমি ছুঁতেও পারি না…

ছয়
সে আমাকে চুম্বন করলো : ‘এই ঠোঁটদুটো মহাবিশ্বের মতো,’ সে বললো।
সে বললো, ‘এ সৌগন্ধ তোমার উদ্ভাবন নয়, আমার চুল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে।’
‘আসমানে কিংবা আমার চোখে তাদেরে দেখো :
অন্ধরা তাদেরকে না দেখতে পেতে পারে, কিন্তু তারারা সেখানে রয়েছে,’ সে বললো…

সাত
এই বাগান, এই আর্দ্র মাটি, এই জুঁই-সৌগন্ধ, চন্দ্রালোকিত এই রাত –
ঝলমল করবে এরা এই আলো থেকে আমার নিষ্ক্রমণ পর্যন্ত,
কারণ, এরা এসেছে আমার আসার আগে, এবং তারপরে আর আমার অংশীদার ছিল না –
এই আদির কেবল একটি অনুকৃতি আমার মধ্যে হাজির হয়েছিল…

আট
একদিন জননী প্রকৃতি বলবে, ‘বিদায় নেবার বেলা উপস্থিত, বাছারে; আর নয় হাসি কিংবা কান্না…’
আর, অশেষ আবার তা শুরু হবে :
যে-জীবন দেখে না, বলে না, কিংবা ভাবে না…

নয়
প্রতিদিন বিচ্ছেদ আরো কাছে আসে :
বিদায়, সুন্দর পৃথিবী,
আর, হেই-ই,
মহাবিশ্ব…

দশ
পূর্ণ মৌচাক –
অর্থাৎ, সূর্যভরা তোমার চোখ…
প্রিয়তমা আমার, আগামীকাল তোমার ঐ চোখদুটোই ধুলো হয়ে যাবে,
মধুপূর্ণ করে তুলবে অন্য চাককে…

এগারো
তারা আলোও নয়,
মাটিও নয়;
প্রিয়া আমার, তার বিড়াল, এবং গলার পুঁতি :
এ-সব মিলেই দলাই-মলাই; তাল-বানানোর উপকরণ কিন্তু একই…

বারো
বাঁধাকপি, গাড়ি, প্লেগের জীবাণু, আকাশের তারা :
আমরা সব আত্মীয়-স্বজন।
আমার সূর্যাক্ষ প্রিয়া, ‘আমি ভাবি; অতএব, আমি আছি’ নয়,
বরং, এই সম্মানিত পরিবারে আমরা ভাবি, কারণ আমরা আছি…

তেরো
আমাদের মধ্যে তফাৎ শুধু মাত্রার –
ও আমার ক্যানারি পাখি, এটাই ব্যাপার :
তুমি পাখাধারী পাখি, চিন্তাবর্জিত,
আর, আমার হাত আছে; আমি একজন মানুষ যে চিন্তা করে…

দ্বিতীয় ধারা

এক
খৈয়াম বলেছিলেন, ‘ধুলায় পূর্ণ হওয়ার আগে সুরায় পূর্ণ করে নাও তোমার পেয়ালা’।
তাঁর গোলাপ-বাগানে হাড্ডিপ্রধান নাকের খালি-পা এক লোক তাঁর দিকে
তীব্র তাকালো :
‘তারার অপেক্ষা বেশিসংখ্যক আশীর্বাদের এই দুনিয়ায়,’ লোকটা বললো,

‘আমি ভুখা,
মদ তো দূরস্থান, রুটি কেনার টাকাও আমার নেই…’

দুই
মৃত্যু আর জীবনের সংক্ষিপ্ততা নিয়ে মিঠা দুঃখে ভাবা,
চাঁদের আলোয় টিউলিপ-বাগানে মদ্যপান…
নগরীর বাইরের একটি কয়লা-কালো বাড়ির ভূগর্ভস্থ-কক্ষে
সারাজীবনেও এমন মিঠা দুঃখ আমি বোধ করিনি…

তিন
জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে – জাগরণহীন ঘুম ঘুমানোর আগে তুমি সময়ের ফসলকে ধরো।
স্ফটিকের পানপাত্রকে ভরে নাও পদ্মরাগমণি মদে – যুবক, এখন প্রত্যুষ, জাগো…
তার শূন্য, ঠান্ডা ঘরে যুবক জেগে উঠলো ফ্যাক্টরির সুতীব্র হুইস্লে,
তা তো আর কোনো বিলম্বকে ক্ষমা করবে না…

চার
অতীতের দিনগুলোকে আমি হারিয়ে ফেলিনি
– বসন্তের একটি রাত ব্যতিরেকে –
এবং আমার চোখের শেষ নীল ঝিলিক
তোমাকে দেবে অনাগত দিনের বার্তা…

পাঁচ
আমি, একজন মানব, তুর্কি কবি
নাজিম হিক্মত,
মাথা থেকে পায়ের আঙুল অবধি আমি ইমান –
মাথা থেকে পায়ের আঙুল অবধি সংগ্রাম আর আশা…

ছয়
আমি, ঘোষক, কথা বলি,
একটি বীজের মতো গম্ভীর আর নগ্ন আমার কণ্ঠস্বর :
আমার হৃদয়ের সময় আমি বেঁধে দিই,
আর যে স্বরে ভোর হবে…
তৃতীয় ধারা

এক
হয় মানুষ তোমাকে ভালোবাসে,
নচেৎ তারা তোমার দুশমন।
হয় তারা তোমাকে ভুলে যাবে, যেন তুমি ছিলেই না,
নচেৎ তারা তোমাকে এক মিনিট ভুলবে না…

দুই
কাচের মতো, শীতের অমলিন একটি দিনের মতো,
একটি স্বাস্থ্যবান আপেলের দৃঢ়-শুভ্র ত্বকে কামড়ানোর মতো!
প্রিয়তমা, তোমার সঙ্গে এই প্রেম-ক্রীড়া,
এ হলো তুষারাচ্ছন্ন পাইন-বনে নিশ্বাস নেওয়ার আনন্দ…

তিন
কে বলতে পারে, দূর থেকে পরস্পরকে দেখতে না পেলে
আমরা হয়তো পরস্পরকে এতোটা ভালোবাসতামই না।
কে জানে, নিয়তি আমাদেরকে দূরে সরিয়ে না দিলে
আমরা কখনো এতোটা কাছে আসতাম কি-না…

চার
রাত ম্লান হয়, দিন ফোটে।
জল স্থির হওয়ার মতো, সবকিছু পরিষ্কার হয়, স্বচ্ছ।
প্রিয়তমা আমার, যেন আমরা অকস্মাৎ মুখোমুখি হয়েছি :
যা কিছু দেখতে পাই, আলো, শুধু আলো …

 

চতুর্থ ধারা

এক
হৃদয়ে, বইয়ে আর সড়কে মিথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই –
মা’র ঘুমপাড়ানি গানে এবং ঘোষকের সংবাদে;
জানাটা – প্রিয়তমা আমার, এ বড় সুখ –
জানা যে, কী হয়েছিল আর কী হবে…

দুই
আমাদের বাহুগুলো ফলে-পূর্ণ ডালপালা :
শত্রুরা আমাদেরকে ঝাঁকাচ্ছে আর ঝাঁকাচ্ছে,
আর আমাদের ফলগুলো আরো ভালোভাবে পেড়ে নিতে
তারা বাঁধছে আমাদের পা নয়, মাথা…

তিন
যতোক্ষণ ভালোবাসো
আর ভালোবাসো যতোটা সম্ভব বেশি,
যতোক্ষণ প্রেমিককে দিচ্ছো সবটুকু
এবং দিচ্ছো যতোটা সম্ভব বেশি, ততোক্ষণ তুমি যৌবনবতী…

চার
আমি ইয়াহিয়া কেমালের কথা ভাবি, অটোমানের রাজকবি :
আমি তাকে দেখি একটি ভাঁড়ারের জানালায়, মোটা এবং কাতরাচ্ছেন।
আর, কিছু কারণে হঠাৎ আমি ভাবি
খঞ্জ বায়রন গ্রিসের পাহাড়ে মারা যাচ্ছেন…

পাঁচ
আমি একজন সহিষ্ণু মালী,
সাত বছরে একবার ফোটে তুমি আমার তেমন গোলাপ।
তুমি এতোটা দুর্লভ বলে আমি আশা হারাই না –
ভাবি, হয়তো সে-কারণেই তুমি এতোটা দামি…

ছয়
এই লেনদেনে তোমাকে হতেই হবে শক্ত আর একটু গরবিনী :
নির্মমতা নয়, বিষাদ কিংবা দুঃখ –
শুধুই মৃত্যু বরং
তোমাকে আত্মসমর্পণে আনে…

সাত
আমি বড়াই করতে চাই না, তবে আমি
দশ বছরের বন্দিদশাকে বুলেটের মতো ফুঁড়ে গেছি।
আর, আমার যকৃতের বেদনাকে উপেক্ষা ক’রে,
আমার হৃদয় এখনো সেই হৃদয়, মগজ এখনো সেই মগজ…। 