নানারূপের রহস্যময়তায়

জাহিদ মুস্তাফা

রূপসাগরে ডুব দেওয়া শিল্পীকে আমরা পেয়ে যাই প্রাচ্যকলার ঘরানায়। প্রথম তাঁর কাজ দেখি সেই ১৯৭৯ সালে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে। ভেজা গায়ে শাপলা হাতে জলাধার থেকে উঠে আসা রূপসী এক গ্রাম্য তরুণীর সেই রূপ আজো আমাদের চোখে লেগে আছে! সেবার বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে সব মাধ্যমে সেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন নাসরীন বেগম। তখনকার স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পরে তিনি ভারতের বরোদা মহারাজ সোয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্রকলায় পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে প্রাচ্যকলার শিক্ষক হিসেবে চারুকলা ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে প্রাচ্যকলার অধ্যাপক এবং আমাদের দেশের একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী। ধোঁয়াশা পদ্ধতিতে জলরং করায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

ঢাকার ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো সম্প্রতি। গত ১৫  থেকে ২৯ মে, ২০১৫ পর্যন্ত চলেছে এ-প্রদর্শনী। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে অাঁকা সাম্প্রতিক সময়ের কাজ এ-প্রদর্শনীতে জায়গা পায়। জলরঙে দক্ষ শিল্পীর অ্যাক্রিলিক রং প্রয়োগ কেমন হয় তা দেখার ইচ্ছায় দুদিন দেখা হলো ‘প্লিজান্ট জার্নি’ বা ‘সুখদ-ভ্রমণ’ শিরোনামের এ-প্রদর্শনী।

প্রদর্শনীর ব্রোশিওরে শিল্পী নাসরীন বেগমের কাজ নিয়ে লিখেছেন বরেণ্য শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও ঢাকায় নিযুক্ত কোরিয়া রিপাবলিকের দূত লি ইয়ুন ইয়ং। গত শতকের নববইয়ের দশকে নাসরীন বেগম নিজের কাজে এমন একটি স্টাইল যোগ করেন যাতে কোনো ফিগার নেই, আছে এক ধরনের নাগরিক দৃশ্যের সাংকেতিক অবতারণা, যাকে বলা যায় উৎসবমঞ্চ। এগুলোর নামকরণ করেছিলেন – উৎসবের পর এবং নতুন দিনের দরজা। শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলাম নাসরীনের এ-দরজাকে ঢাকার এশিয়াটিক সোসাইটির অভ্যন্তরে দেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন সিংহদরজার সঙ্গে তুলনীয় করেছেন তাঁর লেখায়। আমিও তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কারণ, নাসরীন দীর্ঘদিন বাস করেছেন এশিয়াটিক সোসাইটি সংলগ্ন পুরনো জাদুঘর ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসনে। ফলে সিংহদরজার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ থাকাই স্বাভাবিক এবং এর প্রতি শিল্পীর মুগ্ধতা ধরা পড়েছে তাঁর দরজা সিরিজে। এমনই একটি চিত্রকর্মে বৃষ্টির আবহে আমরা দেখতে পাই প্রায় পলেস্তারা খসে পড়া জীর্ণ এক দ্বিতল বাড়ির প্রবেশপথ ও জানালা। হলুদাভ প্রকৃতির আবহে নীলবর্ণের এক সিংহদরজাকে ঘিরে সবুজপাতার দোলা এঁকেছেন শিল্পী, এটি যেন প্রকৃতির রহস্যময়তার ভেতর প্রবেশদ্বার!

ব্রোশিওরে শিল্পী নিজের সামান্য কথায় উল্লেখ করেছেন – গত বছর মার্চে কোরিয়ায় ভ্রমণ ও দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ তাঁর পেইন্টিংয়ে নতুন মাত্রা এনেছে এবং সেই ভ্রমণের অনুপ্রেরণা ফল্গুধারার মতো ছবি অাঁকার গতিপ্রবাহ তৈরি করেছে। তাঁর মতে – ছবি অাঁকায় বিষয় কোনো ব্যাপার নয়, যা ভালো লাগে তাই এঁকেছেন। এটিই তাঁর কাছে শুভযাত্রা। সিউল স্মৃতি নিয়ে           সহজ-বিষয়কে সুখকরভাবে তুলে ধরতে তিনি এঁকেছেন ‘জানালা-১ ও ২’। এক জানালা দিয়ে দূরের সবুজ আশ্বাস দেখা যাচ্ছে, অন্য জানালায় মাকড়সার জালে আবদ্ধ এক লাল মাকড়সা দৃশ্যমান।

সৃজনশিল্পীর হাত যদি হয় ভালো – যে-মাধ্যমেই তিনি হাত দেন না কেন তাতেই তাঁর সৃজন ভালো হওয়ারই কথা। অ্যাক্রিলিক রঙে অাঁকা শিল্পী নাসরীনের কাজগুলোর মধ্যে যেগুলো জলরঙের কায়দায় করা সেগুলো তো মজাদার লাগেই। তবে এ-প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কিছু কাজে কয়েক ক্ষেত্রে নানারঙের মিশেলে রং ভারী হয়ে যাওয়ায় রূপের সেই সাবলীলতা আর থাকেনি। কিছু কাজ যেন শিল্পী নাসরীন বেগমের কুশলী হাতের মনোজ্ঞ স্পর্শ, এমন মনে হয়েছে। এ যাত্রায় সব কাজ সুখকর হয়েছে বলা যাবে না। এ ছাড়াও ব্রোশিওর প্রকাশনার মান বিশেষ করে ছবির মুদ্রণ মান যথাযথ হয়নি।

এবার আসা যাক প্রদর্শনীতে শিল্পীর কাজ প্রসঙ্গে। নিসর্গের রূপ নিয়ে নিরন্তর ছবি অাঁকায় সুখ খুঁজে নিয়েছেন শিল্পী নাসরীন বেগম। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম – সব ছবি অাঁকা নিয়ে। সুখদ-ভ্রমণ শিরোনামের একক প্রদর্শনীতে কতক কাজে শিল্পীর সেই ভালোবাসা-ভালোলাগার শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে। শিল্পী তাঁর স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখে নানা নিরীক্ষায় কিছু কাজে নতুন প্রাণ সঞ্চারের প্রয়াস নিয়েছেন। প্রদর্শনীর প্রথম কক্ষে রাখা ‘জননী’ শিরোনামে অাঁকা চিত্রে এমন নতুন নিরীক্ষার স্বাক্ষর পাওয়া গেল। শাড়ি-আবৃত এক মা তাঁর শিশুকন্যাকে সস্নেহে ধরে আছেন। মজাটা হলো – পুরো শাড়ির জমিনে শিল্পী ব্লক প্রিন্ট করেছেন। এর প্রকাশধরনটি সুখকর-দৃষ্টিনন্দন।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া এক চিত্রে জমি-জিরাতের কচি সবুজ আবহে দূরে কয়েকজন চাষির কাজ ও অবসর নিয়ে সাধারণ একটি বিষয়কে নন্দিতভাবে তুলে ধরেছেন শিল্পী। নানা জটিলতার বাইরে শিল্পীর এটি সহজ-সরল এক রচনা, অনেক ভারী কাজের ভিড়ে এমন কাজ দর্শকদের নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়।

‘পতিত ফুল ১ ও ২’ শিরোনামে ঝরা ফুল ও পাতা নিয়ে দৃষ্টিনন্দন দুটি ছবি এঁকেছেন শিল্পী। সবুজ মাঠে প্রায় হলুদ, শুকনো বিবর্ণ পাতার ওপর ছড়িয়ে থাকা সাদা ফুল নিয়ে অাঁকা চিত্রকর্ম দুটির গঠন ও উপস্থাপনার কুশলতার জন্য দর্শক-চোখকে বেশ টানে। বুনো ফুলের সঙ্গে রমণীয় সখ্যের ছবি এঁকেছেন শিল্পী ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে। এখানে নারী অবয়ব অস্পষ্ট ও রহস্যময়, চোখ যায় শিউলি ফুলের সৌন্দর্যের দিকে। এ ছাড়াও ফুলের লহর নিয়ে আরো অনেক কাজ করেছেন শিল্পী। লম্বাটে ধরনের এর একটি চিত্রপটে লতানো ফুলের লহরের পেছনে যেন দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর আবছায়া অবয়ব ফুলেল সৌন্দর্যের রহস্যময়তাকে ইঙ্গিত করে।

সৌন্দর্যকে শিল্পী হয়তো রহস্যময় মনে করেন। ফুলে যেমন কাঁটা আছে, তেমনি নারীরূপের মাধুর্যের মধ্যেও ক্যাকটাসের  মতো কাঁটার বিঘ্ন দেখেন নাসরীন এবং দর্শককে সেই ইঙ্গিতই তিনি দেন তাঁর এমন বিষয়ের নানা চিত্রকর্মে। তবে কি মানব-মানবীর চিরন্তন সম্পর্কের মাঝখানে তিনি কাঁটার বাধা অবলোকন করে সেটিকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেন আমাদের সতর্কতার জন্য! আবার এর বিপরীত ছবিও আমরা পেয়ে যাই এরই একটি চিত্রে। বর্গাকার আয়তনে অাঁকা ছবিতে দেখা যায় এক ক্যাকটাস মানবীর দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা এক মানব অবয়ব, যেন অপ্রেমের কাঁটা ভেদ করতে পারছে না সে। কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েও প্রেমিকার প্রতি তাঁর আকর্ষণ যেন দুর্নিবার! নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর শেষ অবধি এটি শিল্পীর জীবনমুখী মনোভাবকেই তুলে ধরেছে।