নানির কবর

বুলবন ওসমান

 এসপ্লানেডে সিটিসির বাস ধরার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হলো ষাটোর্ধ্ব দুই মাসতুতো ভাই জাহান আর ফজলকে। ফজল জাহানের চেয়ে বেশ কিছুটা বড়। জাহান কলকাতা পুলিশের অফিসার হিসেবে বছরখানেক হলো অবসর নিয়েছে। কলেজশিক্ষক ফজল ঢাকা থেকে গেছে হাওড়া জেলায় অবস্থিত মামাবাড়ি ঝামটিয়া যাবে বলে। জাহানদের বাড়ি ঝামটিয়ার পাশের গ্রাম। ওরা উঠবে খাজুরদহে। তারপর সময় বুঝে যাবে ঝামটিয়া। ওখানে না ওঠার কারণ, ওদের মামাবাড়িতে এখন কেউ বসবাস করে না। এমনকি কোনো কেয়ারটেকারও নেই। বেশ কয়েক বছর পোড়োবাড়ি হিসেবে তিনতলা পাকাবাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, না ধসে পড়েছে তা-ও কেউ জানে না। কারণ কলকাতা বসবাসকারী জাহানও পাঁচ-ছয় বছর

নিজেদের গ্রামে যায়নি। সুতরাং তার কাছেও কোনো তথ্য নেই। একমাত্র খাজুরদহে পৌঁছে বড় বোন মমতার কাছ থেকে সবকিছু জানতে পারবে।

সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে দুভাই দুসিটের একটি আসনে জায়গা পেয়ে গেল। ফজলের খুব ভালো লাগে বয়স্ক মানুষদের জন্যে এ-ব্যবস্থাপনাটা, যেটা বাংলাদেশে এখনো সূচিত হয়নি। নানা ফোরামে সে এটা আলোচনা করে। সবাই সায় দেয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে, বা জনগণের পক্ষে থেকে জোরালো কোনো দাবিও ওঠেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে সজল নিজে নিজে এটা আরোপ করে সবার সায় পেয়েছে। মানুষ তৈরি, কিন্তু সরকারের কোনো চিন্তা নেই।

শীতের প্রারম্ভ। দুই সিনিয়র সিটিজেন তবু ভালো প্রস্ত্ততি নিয়েছে। মাথায় পশমি টুপি, গলায় মাফলার। গায়ে কোট। মাঝারি সাইজের হাতব্যাগ, প্রয়োজনীয় উপকরণে ঠাসা। পায়ের কাছে ব্যাগদুটো রাখা। বাস শুধু ভরে গেল নয়, একদম কানায় কানায় পূর্ণ। বসতে না পারলে দম বেরিয়ে যেত দুই সিনিয়র সিটিজেনের। তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। আর সহাস্য মুখে আলাপচারিতায় মাতে। অনেকদিন পর একজন আরেকজনকে পেয়ে খুব খুশি। পুরনো সেই দিনের কথা মন খুলে আলাপ চালিয়ে যায়।

১২টার দিকে বাস বাগনান বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে। চারদিক ধুলোয় ধূসরিত। ১৯৯২ সালে ফজল বাগনান এসেছিল। তখন খুব ছিমছাম ছিল পুরো বাগনান স্টেশন। এখন অসম্ভব জনাকীর্ণ ও বিপণিতে ঠাসা হয়ে গেছে। সরু সরু গলি তৈরি হয়েছে। এত শ্রীহীনভাবে সবকিছু গড়ে উঠেছে যে, সে কিছুটা আহত হয়। তার সেই চল্লিশের দশকে বাল্যের দেখা রূপকথার জগৎ থেকে সে যেন এক রাক্ষসপুরীতে পৌঁছে গেছে। ধুলোর চাপে নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হয়।

সে শুনেছিল, তার মামাতো ভাই সাবের ঝামটিয়া ছেড়ে বাগনানে বাড়ি বানিয়েছে। ঠিকানাটাও লেখা আছে; কিন্তু জাহান যেহেতু আগে থেকেই বাড়ি পৌঁছানোর জন্যে অটো ঠিক করে রেখেছে, তাই এদিকের চিন্তাটা বিয়োগ করে।

জাহান পরিচিত অটোকে ফোনে বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে তরুণ যুবক সুবীর হাজির। তার অটোটাও তারই মতো ঝকঝকে। মালপত্র উঠিয়ে তারা রওনা দেয়।

বাগনান শহর পার হয়ে তারা ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে যেতে থাকে। দুদিকে মাঠে ধান পেকে উঠেছে।

ফসল এবার ভালো হবে, কী বলো সুবীর? জাহানের প্রশ্ন।

হ্যাঁ দাদা। বেশ ভালো ফসল হয়েছে।

তোমার এটা তো নিজের গাড়ি, তাই না?

হ্যাঁ। এটা নতুন কিনেছি। পুরনোটা আরেকজনকে দিয়ে ভাড়ায় খাটাই।

বাহ্, ভালো। আচ্ছা, আমার মামাতো ভাই সাবেরের বাসা তুমি চেনো?

হ্যাঁ, চিনি।

আরে আগে খেয়াল করিনি। চট করে ওর বাড়িটা দেখে আসতাম। শুনেছি খুব ভালো বাড়ি বানিয়েছে?

হ্যাঁ। বেশ বড় বাড়ি। পাশে আবার একটা জায়গা কিনেছে। বাগান করবে। আর ঘরের চারপাশে লাগিয়েছে পেয়ারাগাছ, সব গাছে পেয়ারা পেকে রয়েছে। দেখার মতো।

ভালো বাড়ি বানিয়ে চৌদ্দোপুরুষের ভিটেটাকে একেবারে পরিত্যক্ত করে দিলো! ফজল তাদের কথার মধ্যে কথা জোড়ে। সুবীর, তুমি কি জানো, ঝামটিয়ার বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, না ধসে পড়েছে?

না, দাদা, জানি না। আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, আর ওদিকে যাওয়াও হয় না, তাই ঠিক বলতে পারব না। বাড়িতে গেলে বড়দি আপনাদের সব খবর দিতে পারবেন।

তা ঠিক বলেছ, বলে জাহান। বড়বু এ-অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সবাই ওকে খুব মান্য করে।

এটা আর বলতে! বড়দিকে ওই অঞ্চলের কে না চেনে!

জাহান, এক কাজ কর, বুবুকে ভোটে দাঁড় করিয়ে দে, বলে ফজল।

আরে তুমি জানো না, লোকজন একবার বুবুকে ধরেছিল; কিন্তু বুবু রাজি হয়নি। আর রাজি না হবার কারণ তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তার ইমেজটা এখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু যে-ই কোনো দলে যোগ দেবে, অমনি অন্যরা তাকে শত্রু ভাববে।

কোনোমতেই বুবুকে রাজি করানো যায়নি, বলে জাহান।

খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুবু, দুই বাংলার রাজনীতির যে-চেহারা… এখন ঘেন্না ধরে গেছে রাজনীতির ওপর… গজগজ করতে থাকে ফজল।

নদী পার হয়ে অটো তখন ঝাউতলা এসে গেছে। সামনের দোকানগুলোর কাছে সুবীরকে গাড়ি থামাতে বলে ফজল। গাড়ি থেকে নেমে একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে দুরকম মিষ্টি কেনে। কুটুমবাড়ি যেতে গেলে হাতে মিষ্টির হাঁড়ি থাকত আগে, এখন কাগজের প্যাকেট।

খালনার বন্যানিরোধক বাঁধ থেকে ঝামটিয়ার দক্ষিণপাড়া দেখা যেত। বিশেষ করে  ফজলের মামাবাড়িটা সর্বদক্ষিণে হওয়ায় ওটা সবসময় নজরে পড়ত। ফজল ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ। তবে কি বাড়িটা ধসে পড়েছে? তার ভেতর একরকম শঙ্কা কাজ করে।

খালনার বসত এলাকার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত করে অটো বেগুনবাড়িতে থেমে গেল।

আমরা এসে গেছি, বলে জাহান।

এরই মধ্যে বুবুর পালক-ছেলে সমর আর তার তেরো-চৌদ্দো বছরের সন্তান সাগর হাজির। তারা হাতে হাতে সব লাগেজ উঠিয়ে নেয়। ফজল মিষ্টির প্যাকেটটা সাগরের হাতে দেয়।

দুপাশে ঘন বাঁশঝাড়। জায়গাটা ছায়াঢাকা। বাঁশপাতা জমে ইটবাঁধানো রাস্তাটা কার্পেটের মতো নরম। ভিটেয় ওঠার আগে জাহান বলে, ডাইনে ওই যে কবরটা দেখছ, ওটা আমার ছোট চাচাতো ভাইয়ের। ও তো তোমার সঙ্গে পড়ত?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মামুন! এটা ওর কবর!

হ্যাঁ।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ফজলের। কী সুন্দর পেটানো শরীর ছিল মামুনের। কালো চেহারা চিকচিক করত তারুণ্যে। ব্যায়ামপুষ্ট চওড়া ছাতি, রীতিমতো ঈর্ষণীয় ছিল।

কতদিন হলো, ও মারা গেছে?

তাও বছর পনেরো হবে।

আমি জানতাম না।

ভিটের দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ে বড়বুবু মমতা। ফজল যা ভেবেছিল তা নয়, পঁচাত্তর বছরের বুবু বেশ শক্ত আছে। শুধু চুলগুলো একটু বেশি সাদা লাগছে। আরো জানতে পারে, বুবুর না আছে প্রেসার, না ডায়াবেটিস।

দোতলায় পৌঁছে ফজল বলে, বুবু, বড় খালু তো তিন বছরের জন্য সেঞ্চুরিটা মিস করল। তুমি অন্তত এটা পূর্ণ করো!

দেখা যাক, ব্যাটিংটা ভালো করে করতে হবে তো! তাছাড়া নার্ভাস নাইনটি বলে একটা কথা আছে না!

তা আছে। তবে তোমার তো কোনো অসুস্থতা নেই, সুতরাং ব্যাটিংটা চালিয়ে যাও, নির্ভয়ে। দেখো, মেজখালার ছিল পঁচাশি বছর। মা পার করল ছিয়াশি… সুতরাং তোমাদের ধারায় দীর্ঘায়ু আছে। অবশ্য বড়খালা একটু আগে আগে চলে গেলেন।

বুঝলে, তিন বোন একইভাবে মারা গেছে। তিনজনই হার্ট অ্যাটাকে পড়েছে।

মামা-নানা-হালিমভাই তারাও তো গেছে একইভাবে।

হ্যাঁ। উচ্চচাপ ছিল ওদের বংশধারা। তুমি এখনো মুক্ত আছো বুবু, আমি কিন্তু মুক্ত নই। রেগুলার ওষুধ খেতে হয়।

তবে তুমি পাতলা মানুষ।

আরে পাতলা-মোটায় কিছু এসে যায় না। একে বলাই হয় সাইলেন্ট কিলার – নীরব ঘাতক। কোনো কিছু বোঝার আগেই বাবা খরীশসাপের ছোবল।

খরীশসাপ তোমার এখনো মনে আছে?

থাকবে না। নানিকে কত খরীশসাপ মারতে দেখেছি। এই কেউটেগুলো ছিল ভয়াবহ।

হ্যাঁ, নানির সাহস ছিল বটে। সবাই ভয়ে পালালে কী হবে, নানি লাঠি নিয়ে ঠিকই পিছু নিত এবং মেরেও ছাড়ত।

হ্যাঁ, ভালো কথা মনে পড়েছে, আমাদের বাড়িটা আছে না ধসে পড়েছে? আমি তো বড় বাঁধ থেকে দেখতে পেলাম না।

দেখতে পাবে কী করে? পুরো বাড়িজুড়ে তো নানারকম লতাপাতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ঘরের কাছে ঘেঁষাই দায়। যদ্দুর জানি, এখনো ওটা ধসে পড়েনি। মাঝে মাঝে ভাবি, পরিষ্কার করাই। আবার ভাবি, যাদের জিনিস তারাই যখন কিছু করছে না তখন আমার কিছু করার অধিকার কোথায়!

দেখি বিকেলে বেরোব।

না। শীতের দিন বেলা ছোট। ওখানে খরীশসাপের আড্ডা। কাল সকালে নাস্তা করে সঙ্গে সমরকে নিয়ে যেও। একা একা ওখানে যাবে না। জাহান যেতে চাইলে ওকেও সঙ্গে নিতে পারো।

ঠিক আছে।

রাতে ঘুমটা ভালো হয় ফজলের, যাক বাড়িটা ধসে পড়েনি।

সকালে নাস্তা সেরে ফজল জাহান আর সমরকে নিয়ে ঝামটিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয়। বেগুনবাড়ি থেকে ইটবিছানো রাস্তাটা ঝামটিয়া প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে কোম্পানি পুকুরের পাশ দিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে। একটা বাঁশের সাঁকো ধরে তারা দক্ষিণপাড়ার দিকে এগোয়। দুপাশে রবিশস্যের মেলা। কি সতেজ! ফজল ফিরে যায় ষাট বছর আগের দৃশ্যে। গ্রামটা এত সুন্দর! একেবারে জলরংচিত্রের মতো। এবার ডানে বাঁক নিয়ে তারা দক্ষিণপাড়ার পাকা বাড়ির সারের দেখা পায়। প্রায় বাড়িই তিনতলা। এখনো তেমন পরিত্যক্ত মনে হয় না। বেশিরভাগ বাড়িতে জানালা-কপাট আছে, রংও ফিকে নয়। মনে  হয় দু-একজন যারা আছে যত্ন নেয়। জমির তল থেকে ভিটে দশ-বারো ফুট উঁচু বাঁয়ে গেল বড়পুকুর। এটা উত্তরদিক। দক্ষিণদিক আর পূর্বদিকে কোনো ঘাট নেই। এখানে ঘাটটা বাঁধানো। পুকুরের জল বেশ স্বচ্ছ। গোটা পুকুর কলমি আর ঘাসে ভরা। ঘাটের কাছটুকু যত্ন করে ঠিক রাখা হয়েছে। ভিটেয় উঠে প্রথমেই পেল মেজনানা মনোয়ার আলির বাড়ি। দরজায় তালা। বাঁয়ের বাড়িটা খুদু মামাদের। তার লাগোয়া জনা মামার বাড়ি। তারা বাড়ি বিক্রি করে দেয় সামাদ মামার কাছে। সম্প্রতি সামাদ মামাও মারা গেছে। ও-বাড়িতেও তালা ঝুলছে। খুদু মামার বাড়ির সীমানা-দেয়ালের মধ্যে দরজাটা আধো খোলা। এই সময় বছর চল্লিশ বয়সের এক লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। ফজল তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে থাকে লোকটিকে। লুঙি আর শার্টে লোকটিকে যেন খুব চেনা  মনে হয়। সে এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ করে বলে, আমি যদি ভুল না করি, আপনি কি খুদু মামার ছেলে?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি আপনার আবদুল চাচার ছোট বোনের ছেলে ফজল।

ও আপনি ফজলদা। আপনাদের কথা আববা-আম্মার কাছে কত শুনেছি। আপনার আববা রহমান ছোট পিসানের নাম জানে না, এমন লোক এখানে একজনও নেই। আপনারা চার ভাই এক বোন আবদুল চাচাদের বাড়িতে দশ বছর দাপিয়ে রাজত্ব করে গেছেন… আজ বাড়িটা তারা যদি শুধু একজন কেয়ারটেকার রেখে দিত, তাহলে আজ এই দশা হতো না। বাপদাদার ভিটে কেউ এমন করে ফেলে দিয়ে যায় এমনটা আমি শুনিনি। আপনি আমাকে তুমি বললে খুশি হবো। আপনারা আমার চেয়ে অনেক বড়। উনি নিশ্চয় জাহান দাদা। আমি খোকন।

হ্যাঁ। আর সমরকে নিশ্চয় চেনো। ও তো আবার বিয়ে করেছে ঝামটিয়ায়। ও তোমার জামাই মানুষ।

হ্যাঁ, ওকে চিনি।

চলো, এবার মামাবাড়ি দেখতে যাই, ফজল তাড়া দেয়।

বাড়িতে তো ঢুকতে পারবেন না।

প্রথমত, অনেকে খালি বাড়ি পেয়ে পাকাটি ভরে রেখেছে দরজা অবধি। তাছাড়া এমন ঝোপ-জঙ্গল হয়েছে যে, সাপের ভয় আছে।

তা বললে তো হবে না খোকন। এতদূর আসা ঘুরে ঘুরে সব দেখব বলে। দরকার হলে লোক লাগিয়ে সব পরিষ্কার করাব। আর যাদের পাকাটি তাদের আজই সরাতে বলো। আমি কাল ছবি তুলব। ক্যামেরার ব্যাটারি ডাউন বলে ওটা সঙ্গে আনিনি। আজ বাগনান থেকে ব্যাটারি আনিয়ে নেব।

ফজলের জোরদার কথা শুনে অগত্যা খোকনকে পথপ্রদর্শক হতে হয়। লতা-গুল্ম ঠেলে তারা বাড়ির পুবপাশ দিয়ে এগোয়। মোট এগারোটি মুসলিম পরিবার এই দক্ষিণপাড়ায়। গ্রামে বাকি পরিবার সবাই হিন্দু সম্প্রদায়। আর বলতে গেলে ওরা সবাই ছিল দক্ষিণপাড়ার প্রজা।

ফজলের নানা রওশন আলী আর তার পাতানো ভাই সাহেদের বাড়ি একসঙ্গে সাঁটা। দূর থেকে একটা বাড়ি মনে হলেও বাড়ি আসলে দুটি এবং প্রায় অভেদাকৃতির। আইডেনটিক্যাল টুইনের মতো। পূর্বদিকটা পাঁচিলঘেরা নয়। দরজা-কপাট নেই। পশ্চিম দিকটা উঁচু পাঁচিলঘেরা। এটাতেই ফজলরা দশ বছর কাটিয়েছে। বাকুলটা (উঠোন) ঘেরা ঠিকই আছে। দুটি দরজা ছিল, একটি দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে। দরজার ফাঁকটুকু আছে কিন্তু নানারকম গুল্ম ঝুলছে। সারা বাকুল আকন্দ আর ভাঁটগাছে ছাওয়া। অনেক কষ্টে তারা বারান্দায় ওঠে। বাড়ির প্রধান ফটকের মধ্যে ঠাসা পাকাটি। পাশের কামরাটায় উঁকি দেয় ফজল, কারা ঘুঁটের বস্তায় ঘর অর্ধেক ভরে ফেলেছে। পাকাটি না সরালে ঘরের ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়।

ফজল বারান্দার লাগোয়া কামরাটা দেখিয়ে জাহানকে বলে, জানো, এ-কামরাটা একটা ঐতিহাসিক কামরা!

কেন? জানতে চায় জাহান। এই কামরাটায় পরপর আমরা পাঁচ ভাইবোন জন্মগ্রহণ করেছি। মানে আরো বিশেষভাবে বললে বলতে হয়, ভূমিষ্ঠ হয়েছি। আমরা ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ জন্মায়নি। মায়ের জন্মের তিন বছর পর এ-বাড়িটা তৈরি হয়। তোমরাও কেউ এখানে জন্মাওনি। সত্যিই তো! ঐতিহাসিক স্থান তো বলতেই হবে, জাহান পক্ষ নেয়।

এই সময় এক কিশোরীর আগমন ঘটে।

আববা, মা তোমাকে ডাকছে।

আমার মেয়ে। শারমিন। তোমার দুই চাচা। জাহান চাচাকে  তো চেনো। কিন্তু এই ফজল চাচা এসেছে ঢাকা থেকে। ওরা পাঁচ ভাইবোন এই বাড়িতে জন্মেছেন।

তাই! শারমিনের চোখে বিস্ময়।

আমি এখনি আসছি, বলে খোকন মেয়েকে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে।

কাজ তো হলো না হে জাহান!

ভেতরে তো যাওয়া যাবে না, বলে ফজল।

আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সমর, তুই কয়েকজনকে জোগাড় করে আজকের মধ্যে সব পরিষ্কার করাবি। টাকা যা চায় দেওয়া যাবে। কাল আমরা ফটো তুলব, বলে জাহান –

দেখি, মাথা চুলকোয় সমর।

কী হলো তোর?

এখন ধান কাটার সময়… লোক পাওয়া…

আরে বিনা পয়সায় কাজ করাব নাকি! যা বললাম তার ব্যবস্থা কর।

তুই এখনি ধাড়াপাড়া যা। হারানদাকে খুঁজে বের কর, সব সুরাহা হয়ে যাবে। বলবি ফজলদা এসেছেন, তোমাকে ডাকছে।

চলো জাহান, ওপরে তো আজ আর যাওয়া যাবে না, আমরা সামনে গিয়ে একটা লং ভিউ দেখি।

বাকুল থেকে বেরিয়ে তারা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলে। শখানেক গজ এগিয়ে ফজল জাহানকে বলে, এবার দাঁড়াও। মনে করো ক্যামেরা প্যান করছ। প্রথমে বাঁদিক থেকে এগিয়ে মাঝখানে গিয়ে ফিক্সড করলে। ওই যে দোতলার বারান্দা, ওটা এখন ভাঙা, আমাদের সময় ঝকঝক করত।

এইবার তুমি দৃশ্যটা ধারণ করো।

ফজল চিৎকার করে  হাঁক দেয়, নানি… নানি… নানি…

ভাঙা বারান্দাটা মুহূর্তে নতুন  হয়ে গেল। আর বারান্দায় রেলিং ধরে ঝুঁকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়সী নানিকে দেখা গেল।

কী হলো? বলে নানি।

পুকুরের পুবপাড়ের দিকে খেজুরগাছ বরাবর একটা কলাগাছে কলায় পাক ধরেছে।

কোন গাছটা? কাঁঠালিচাঁপা… না

বিচিকলা…

দাঁড়াও, আমি এখনি আসছি।

খানিক পর নানিকে দেখা গেল।

বাকুলের দক্ষিণ-দরজা দিয়ে বেরোতে। হাতে একটা কাটারি। আর সঙ্গে নিয়েছে ফজলের ছোট দুভাই সজল আর কাজলকে। কাছে আসার পর তারা তিনভাই নানির সঙ্গে লেফট-রাইট করে বাগানের দিকে এগিয়ে চলে।

এই লেফ্ট-রাইট করার পেছনে একটা ঘটনা আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফজলের একমাত্র মামা আবদুল ব্রিটিশ সোলজারদের সঙ্গে চলে গেল সিঙ্গাপুর-জাপানিদের ঠেকাতে। যুদ্ধ শেষ হলো ১৯৪৫ সালে; কিন্তু আবদুলের কোনো খোঁজ নেই। ছেলের খোঁজে রওশন আলী পাগলের মতো সব জায়গায় খোঁজ নিচ্ছে… ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করত… তাই অনেক বড় বড় অফিসারের সঙ্গে আলাপ ছিল… কিন্তু কোনো খোঁজ নেই… প্রায় বছরখানেক হতে চলল… হঠাৎ একদিন খোঁজ পাওয়া গেল… আবদুল সিঙ্গাপুরে এক আর্মি হসপিটালে আছে… পায়ে গুলি লেগেছে… এখন ভালোর দিকে… অল্পদিনের মধ্যে দেশে ফিরবে। সেই আবদুল যেদিন ফিরল, সারা গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে তাকে দেখতে… মায়ের সঙ্গে ফজল আর তার মেজভাই দুজন মায়ের সঙ্গে সবার পেছনে দাঁড়িয়ে মামাকে দেখবে… মামা তাদের সঙ্গে থাকবে… ফজলের মনে আছে দীর্ঘদেহী এক সোলজার আসছে… পেছনে অনেক লোক… সবাইকে ছাড়িয়ে ফেস্ট হ্যাটপরা মামার মাথা দেখা যাচ্ছে… ফর্সা… একেবারে গোরা সোলজারদের মতো… শুধু বাঁ-পাটা একটু টেনে হাঁটছে… মামা ওদের কোলে তুলে নিয়েছিল… পরে ওরা মামার পায়ের গুলি লাগার জায়গাটাও দেখেছে… গুলি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে বেরিয়েছিল।… তাতেই রক্ষা… না-হয় পা কেটে ফেলতে হতো… তখন থেকে মামার কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ওরা তিন সৈনিক – লেফ্ট…রাইট করা শিখেছে… নানি হলো তাদের কলার কাঁদি নামার ক্যাপ্টেন… তারা গাছের কাছে পৌঁছে… নানি সবাইকে সরে যেতে বলে… তারপর গাছের দুদিকে দুকোপ… গাছ ঘাড় কাত করে নেমে এলো… তখন নানি অর্ডার দিলে, এবার পাতা ধরে টান মারো… টানের চোটে কলার কাঁদি নেমে আসে একেবারে হাতের নাগালে… নাতি কাঁদিটা কেটে বলে, নিতে পারবে? আমরা বলি, পারব। কিন্তু কাজের সময় তিন সোলজার পরাজিত… নানি কাঁদিটা হাতে নিল, আমরা নিলাম কাটারি।

জাহান, ক্যামেরা অফ করেছ তো?

হ্যাঁ।

আবার ওপেন করো। এবার তোমার অনেক বাতি লাগবে। এবারের দৃশ্য গভীর রাতের। অমাবস্যার রাত। ঘন নিকশ অাঁধার। শরৎচন্দ্র-বর্ণিত অাঁধারের রূপের মতো। ভাদ্র মাস… বেশ গরম… মশারির মধ্যে প্রায় আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে… এই সময় পিঠে টোকা… কে? চাপাস্বরে নানি বললে, আমি – চল, তাল কুড়োতে যাব… হাঁড়িতালগাছের একটা তাল পড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। আমি তড়াক করে উঠে পড়ি। মা যাতে জানতে না পারে সেভাবে আমরা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরোই। দেখি নানির হাতে একটা হুড়কো… হুড়কো বোঝো তো? জানি, দরজার দুপাশের গর্তে লাগানোর মোটা বাঁশ বা কাঠের বাতা… হ্যাঁ, আমি এটা ভেবে পেলাম না নানির হাতে  হুড়কো কেন… চোর-ডাকাতের ভয় তখন ছিল না… তবে কি ভূত মারার জন্যে? কিন্তু ভূতের সঙ্গে কি যুদ্ধ করা যায়? যাক গে সে-ভাবনা… বড়পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনো হাঁড়িতালগাছটা… ওর গোড়ায় একটা তাল পেলাম… নানি ঠিকই এর শব্দ শুনতে পেয়েছিল… আরো দুটো তাল পেলাম অন্য গাছের… তিন-তিনটে তাল পাওয়া, মহাআনন্দের ব্যাপার। পাকা তালের কী মিষ্টি গন্ধ।

যাক তোমার ক্যামেরা এবার বন্ধ করো। এরকম এত দৃশ্য আছে যে, তুমি ধারণ করে শেষ করতে পারবে না। এটা করতে তোমার ডিজিটাল ক্যামেরা লাগবে। এই সময় খোকন হাজির।

বললে, দাদারা, আপনাদের বউমার নির্দেশ, এখনি ঘরে চলুন, চা খেতে হবে।

আরে সে হবেখন… আগে চলো পশ্চিমডাঙায় ঘুরে আসি। কবরস্থানটা জিয়ারত করে ফিরে আসব। সবাই দক্ষিণদিকের রাস্তার পর ডানে মোড় নেয়। এখানে বড় অশত্থগাছ তলায় ঈদগাহর চিহ্ন নিয়ে তিনটি সিঁড়ি নীরবে দাঁড়িয়ে। রেড-অক্সাইডের রংটা কিছুটা জ্বলে গেছে। মামাবাড়ি ডানে রেখে ফজলরা উত্তরদিকে এগোয়। এখানে ডানের পুকুরটা এখন পানাভরা।

ফজল বলে, এই পুকুরটা এমন ছিল না। ছিল পরিষ্কার। জোয়ারের জল এসে এই  পুকুরটাতে পড়ত। খুব বাগদা চিংড়ি পাওয়া যেত। নানি প্রায়ই কুড়োজাল ফেলত, আর বড় বড় বাগদা চিংড়ি ধরা পড়ত। ঘুষোমাছ (ইচামাছ) নানিকে কখনো কিনতে দেখিনি। একবার নানা পুকুরটাকে খুব গভীর করে কাটালেন। জল ছেঁচা শেষ। আছে শুধু পাঁক। বাগদিপাড়ার ছেলেরা করল কী সব পাঁক সমান করে লেপে দিলো। পরদিন আমি খুব সকালে উঠে দেখি কী, পাঁকাল মাছ সব মাথা উঁচু করে রয়েছে। পাঁকে তো আমি আর নামতে পারি না, নামলে উঠতে পারব না… তখন হারান আর ওর বড় ভাই শীতলদা, এরা এসে মাছ ধরল। সে অনেক মাছ। ছোট নানা হোসেন সাহেবের বাড়ি ডানে রেখে সজল কবরস্থানের পুকুরটার ঘাটটা খুঁজে পায় না। ওটা চমৎকার বাঁধানো ছিল। এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। কবরস্থানটা অনেকটা তেমনি আছে, শুধু শ্যাওলা জমেছে বাঁধানো কবরগুলোয়। খোকন আবদুল মামার কবরটা দেখাল ফজলকে। অন্যসব কবরের চেয়ে এ-কবরটা বড়। যেমন ছিল লোকটা, চেহারাটাও তেমনি। ফজল নানা রওশন আলীর কবরটাও খুঁজে পেল। কিন্তু তার মাথায় তখন ঘুরছে নানির কবর।

সে খোকনকে বলে, নানির কবরটা কোথায়?

বড় দাদির কবরের কথা আমি বলতে পারব না। আমি তো তখন জন্মাইনি। কে বলতে পারবে? খোকন, তুমি কষ্ট করে হারানদাকে ডেকে আনো। হারানদা বলতে পারবে। একটু পর হারান, খোকন আর জমির হাজির।

আরে ফজল, তুমি কখন এলে? বলে হারান।

গতকাল।

তুমি আছ কেমন? খুব একটা ভালো নেই। বয়স হয়েছে। আজ কিন্তু লোক পাবে না। সব ধান কাটতে চলে গেছে। কালকে কাজে লাগিয়ে দেবো।

ঠিক আছে। কিন্তু হারান, একটা সমস্যায় পড়েছি, নানির কবর কোনটা? সব কবরে তো নেমপ্লেট ছিল, এখন দেখছি একটাতেও প্লেট নেই।

ওইসব পাথরের নেমপ্লেট ছেলে-ছোকরারা খুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু বড়দির তো কবর বাঁধানো হয়নি।

বলো কী?

হ্যাঁ। আমি তোমাকে আবদুল চাচা আর বড় দাদার কবর চিনিয়ে দিতে পারি।

আরে ওগুলো তো খোকন আমাকে আগেই দেখিয়েছে… আমি খুঁজছি নানির কবর। না, ফজল ভাই, আমি যদ্দুর জানি, বড়দির কবর বাঁধানো হয়নি। বেশ জোর দিয়েই বলে হারান।

হতাশ হয় ফজল।

সে তো জানত যে, তার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দেখা সে আর কোনোদিন পাবে না; কিন্তু কবরটা তো জিয়ারত করতে পারবে। তাহলে… কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা, হারানদা, কোন জায়গায় কবর দেওয়া হয়েছিল সেটা তোমার মনে আছে?

সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। ওই যে যেবার জয়বাংলা হলো। তখন ছোট ঝির সঙ্গে তোমরাও তো এসেছিলে। তোমরা যাবার কিছুদিন পরই তো বড়দি মারা যায়। কিন্তু কোন জায়গাটায় যে কবর দেওয়া হয়েছিল সেটা আমি দেখিনি। আর ফি বছর দুবার-তিনবার করে বান হয়… সব চটান হয়ে গেছে।

গুম মেরে যায় ফজল।

এই সময় উত্তরে হাওয়ার একটা দমকা বয়ে যায়। শীতের আগমনবার্তা। কবরস্থানের তাল-খেজুর আর বাঁশগাছের শিরশির শব্দ ফজলের কানের কাছে যেন ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। সে-স্বর যেন নানির কণ্ঠ। কানের কাছে নানি চাপাস্বরে বলছে, দাদা, এ-সংসারে আমরা তো আসি খাটাখাটনির জন্যে… আমাদের কবর কে বাঁধাবে?

তোমার কবর আমি বাঁধাব নানি! কিন্তু তোমার কবরটা যে কোন জায়গায় তা-ই তো খুঁজে পাচ্ছি না!

আমার কবর তোমাকে বাঁধাতে হবে না ভাই। তুমি যে আমাকে মনে করে এতদূর এসেছ, এতেই আমার আত্মার শান্তি। দাদাভাই, মন খারাপ করো না। দোয়া করি তুমি দীর্ঘজীবী হও। আমি তো তোমার চারপাশেই আছি।

চমকে ওঠে ফজল। তবে কি ও নানির কবরের ওপরই  দাঁড়িয়ে?