নারীগণ

আবু সাঈদ তুলু

সম্প্রতি বাংলাদেশের তারুণ্যদীপ্ত নাট্যদল ‘পালাকার’ মঞ্চে এনেছে নারীগণ শিরোনামে নাট্য। নাটকটি রচনা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং নির্দেশনায় আতাউর রহমান। গত ১৩ অক্টোবর, ২০১২ ঢাকার সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে উপনিবেশ সৃষ্টিস্বরূপ, নাট্যবস্ত্ত, উপস্থাপন-কৌশল, শিল্পমূল্য ও উপস্থাপন-মনস্তত্ত্ব অনুসন্ধানই লেখাটির লক্ষ্য বা অভীষ্ট।
সৈয়দ শামসুল হকের নারীগণ অনন্যসাধারণ রচনা। এতে নবাব মহলের অন্তঃপুরে বন্দি নারীদের নানা উপলব্ধির অভিব্যক্তিক উপস্থাপনা সাধারণ দর্শককে ইতিহাসচিন্তা ও গভীর জীবন-বিশ্লেষণে তাড়িত করে। নারীগণ নাটকটি এক রাতের ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে জাফরগঞ্জ প্রাসাদের নির্জন কক্ষে মীরনের নির্দেশে হত্যা করা হয়। হত্যার পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার লাশ হাতির পিঠে তুলে সমস্ত মুর্শিদাবাদ নগরী প্রদক্ষিণ করানো হয়। এ সময় মীরন, মোহাম্মদী বেগ ও খান-ই-মুর্শিদ ব্রিটিশদের দোসরীয় আনন্দে উল্লসিত মিছিল করে। ওই রাতে প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ নারীগণ বিশেষত সিরাজের নানি শরিফুন্নেছা, মা আমিনা বেগম, স্ত্রী লুৎফুন্নেছা, কন্যা উম্মে জোহরা ও দাসীদের কী অবস্থা হয়েছিল তা নাটকের আখ্যান। যুদ্ধে পরাজিত হেরেমের বন্দি নারীদের স্মৃতিদগ্ধতা, কথোপকথন ও পরিস্থিতি-পরিবেশের মধ্য দিয়ে যুদ্ধোত্তর নারীর পরিণতি, বীভৎসতা, সমাজ-রাজনীতি, বাস্তবতা, ভুল পরিণতির সম্ভাব্যতায় আবর্তিত নাটকটি।
ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপনের ইতিহাস দীর্ঘ ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের। ভারত উপনিবেশের ইতিহাস পর্তুগিজদের বসতি থেকে ধরা হয়ে থাকে (উইকিপিডিয়া)। ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কো দা গামার দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কালীঘাট বন্দরে অবতরণের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে। ওই সময়ে ইউরোপ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতার মূল কারণ ছিল দুটো – এক. ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যটি ধর্মান্তরকরণ। যারা ইউরোপ-বহির্গামী হতো তাদের বেশিরভাগই ছিল দুষ্টু বা দাগি আসামি। উল্লেখ্য, শুধু অভিবাসিত হলেই উপনিবেশ সংজ্ঞায়িত হয় না। উপনিবেশকে দুভাগে দেখা যেতে পারে। একটি বস্ত্তগত এবং অন্যটি অবস্ত্তগত। বস্ত্তগত উপনিবেশের সঙ্গে শাসন-শোষণের সম্পর্ক থাকলেও অবস্ত্তগত উপনিবেশের সঙ্গে জ্ঞানতাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, মানস পরিবর্তন, মানস সংস্কৃতি ও অনুকৃতি ইত্যাদি অত্যন্ত সম্পর্কযুক্ত। স্পিরিচুয়াল পলিটিক্স অতিপ্রাকৃত বিধায় তা তথ্যবদ্ধ করা দুরূহ। সেজন্য সার্বিক বিবেচনায় অবস্ত্তগত উপনিবেশই অত্যন্ত ভয়ংকর। ভারতে উপনিবেশ স্থাপন দৃশ্যত ব্যবসায়ী স্বার্থে হলেও নেপথ্যে শোষণ-শাসন ও ধর্মান্তরকরণই প্রধান ছিল। পর্তুগিজরা ব্যবসার আড়ালে দস্যুবৃত্তিসহ জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ করত। (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ‘রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি’ খন্ড, সম্পাদনা-এমাজউদ্দীন আহমদ ও হারুন অর রশীদ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৭, পৃ ৫৯)। বিকল্পে বিশৃঙ্খল ও দরিদ্রজীবনযাপন। উত্তরসময়ের প্রকাশনা ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, কৃপা শাস্ত্রের অর্থভেদ তার প্রমাণকেই প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের তৎকালীন সমৃদ্ধি সম্পর্কে ১৬২৮ বা ১৬২৯ সালে যাজক সেবাস্টিন মানরিকের বক্তব্যে ভারতবর্ষ স্বনির্ভর, স্বাস্থ্যকর, প্রচুর ফলনশীল ও পোশাক শিল্পসহ নানাদিকে সমৃদ্ধতার পরিচয় বিধৃত করে। (বাংলা ও বাঙালির কথা, আবুল মোমেন, সাহিত্য প্রকাশ, ২০১০, পৃ ৩৪)। কিন্তু পরবর্তী চিত্র সচেতন পাঠকমাত্রই কমবেশি জানেন। উপনিবেশ শাসনের প্রথমেই সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে যে-সংখ্যক লোক মারা যায় তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। উল্লেখ্য, ১৬৬৬ সালের দিকে যখন নানা অত্যাচারে মোঘল শাসন জর্জরিত এবং শাহজাহান নানাভাবে দমন করে চলছিলেন তখন যাজক জে কাবরালের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, সম্রাট নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছেন ভারতবর্ষ না জানি বেদখলেই চলে যায়। (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ‘রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি’ খন্ড, পৃ ৫৯)। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, উপনিবেশ সৃষ্টির নেপথ্যে ছিল কারা? দেশটাকে নানাভাবে ভোগদখল, নিপীড়ন-নির্যাতন, অতীত-বিনষ্টি, শোষণ, দারিদ্র্যসহ বস্ত্তগত ও মানসশৃঙ্খলের সুযোগ করে দিয়েছিল কারা? এভাবে প্রায় দুশো বছর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শাসন-শোষণ, আধিপত্য ও ধর্মান্তরকরণের ভিত সুদৃঢ় ও অবাধকরণ হয় এবং পাঞ্জাব দখলের মধ্য দিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষ ব্রিটিশরা করায়ত্ত করে। অথচ আশ্চর্য যে, ক্ষমতা দখলের পর মেকলে, জোন্স, যাজক কেরি ও তাঁদের সৃষ্ট দোসর তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাস-রচয়িতাদের মন্তব্যে ভারতবর্ষকে অসভ্য, বর্বর বলে প্রতীয়মান করা হাস্যকর উপস্থাপন। সুসমৃদ্ধ সভ্যতা, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। উপনিবেশের বসবাসের প্রধানতম ঘাঁটি ছিল গোয়া, হুগলি, পরে কৃষ্ণনগর, শ্রীরামপুর, কলকাতা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম। প্রধানত গোয়া ও পরে হুগলি থেকে মুঘল শাসনকালীন উপনিবেশে নানা ধরনের কর্ম পরিচালিত করত। (প্রাগুক্ত, পৃ ৫৮ ও এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ : মিথ ও বাস্তবতা, শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ঢাকা, ২০০৯, পৃ ১৯)
১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে নানা বুদ্ধিভিত্তিক ও উপঢৌকনীয় কৌশলে ‘টমাস রো’ দিয়ে সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে উপনিবেশের স্থায়ী অভিযাত্রা শুরু হয়। ‘টমাস রো’ কূটকৌশলে উপনিবেশের স্থায়ী বসতির সুযোগ সৃষ্টি করে। সম্ভবত উপঢৌকন তথা ঘুষ প্রথাটি মুঘল শাসনামলে ইংরেজরাই প্রচলন করে দিয়েছিল যা আজও বর্তমান। দুর্নীতির সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় বলে সহজেই অনুমেয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর-শাজাহান থেকে শুরু হয় মোগল শাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বেষ-কোন্দল। উপনিবেশের নানা কৌশলে শোষণ, দস্যুবৃত্তি ও ধর্মান্তরকরণে অস্থির করে তোলে চারদিক। (পূর্বোক্ত ‘রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি’ খন্ড, পৃ ২০২, ২১১, ৩৪৬ এবং পূর্বোক্ত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ : মিথ ও বাস্তবতা, পৃ ১৯-২০)। সুলতানি আমলে ধর্মপ্রচার থাকলেও জোরপূর্বক বা কৌশলে ধর্মান্তরকরণ ছিল না। মোগল শাসন ছিল এক্ষেত্রে আরো ব্যতিক্রম। বেশিরভাগ প্রজা সনাতনী হওয়া সত্ত্বেও কখনই ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করতেন না। (মোঘল সাম্রাজ্যের খন্ড চিত্র, হাসান শরীফ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স, ২০১০, পৃ ১৩)। উপরন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মপালনের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ফতেপুর সিক্রি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। সুলতানি-মোগল শাসনামলেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, পদাবলির মতো মহাকাব্যিক ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। অত্যন্ত হাস্যকর যে, মুগল সম্রাট শাজাহানের ফুলহস্ত সৌগন্ধগ্রহণীয় ছবি কোনো শৌর্য-বীর্যবান সম্রাটের হতে পারে! এ মনোবৈকল্য পৃথিবীর ইতিহাসে পুনঃবিশ্লেষণের দাবি রাখে। সেজন্য ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ ‘স্টেরিওটাইপ’ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। ধীরে ধীরে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত হয়ে ওঠে মোগল শাসন। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বজনদের মধ্যেকার কোন্দল মুগল শাসনামলেই উপনিবেশ দ্বারা সৃষ্ট বলে সহজে অনুমেয়। যতটুকু জানা যায়, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে ক্ষমতা দখলে হত্যা থাকলেও কোনো স্বজনীয় কোন্দল বা দ্বেষ ছিল – এমন মনোবৈকল্য পর্যায়ে ছিল না। আশ্চর্য যে, পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতবর্ষেই প্রথম শশাঙ্ককে স্বাধীন সার্বভৌম রাজা ও গোপালকে জনগণই নির্বাচিত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। এমন গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যা হোক, এ মোগল শাসনে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কোন্দল উপনিবেশ থেকেই পরম্পরায় চলতে থাকে। ক্রমশ জর্জরিত হয়ে উঠছিল মোগল শাসন। আওরঙ্গজেব, দারা, সুজাদের মনোবৈকল্য ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ইতিহাসে মর্মস্পর্শী। সে-ধারাবাহিকতায় শায়েস্তা খাঁ-আলীবর্দি হয়ে নবাব সিরাজের সভাসদ ও স্বজনরাও অভ্যন্তরীণ কোন্দল পরিবৃত।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা (প্রকৃত নাম মিরজা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা, জন্ম আনুমানিক ১৭৩৩, মৃত্যু ১৭৫৭) মাত্র একবছর দুমাস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বজনদের অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত ছিল সিরাজের পরিবার। পাটনার নবাব আলীবর্দি খাঁর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। ছিল মাত্র তিনটি কন্যাসন্তান। অল্প বয়সেই সিরাজউদ্দৌলা পাটনার কুচক্রী ও দুর্বৃত্তদের কঠোরহস্তে দমন করে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেজন্য নবাব আলীবর্দি খাঁ সেদিনই দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমার পরে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে।’ সে পরিপ্রেক্ষিতে আলীবর্দি খাঁর স্নেহভাজন নাতি সিরাজউদ্দৌলার উত্তরাধিকার প্রাপ্তি ঘটে। চারদিকে চক্রান্ত, যড়যন্ত্র ও প্রচন্ড দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আলীবর্দি খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে নবাবরূপে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অন্যটি ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একটি ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষাবলম্বী এবং অন্যটি নবাবের বিপক্ষে। শুরুতেই নবাব দেখেন ঢাকার রাজকোষের সমস্ত অর্থই চলে গেছে ইংরেজদের হাতে; তা আবার তারই বিরুদ্ধাচারী তৎপরতায়। বয়স অল্প হলেও অত্যন্ত বিচক্ষণতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন আত্মীয়ের মধ্যে বড় খালা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে ইংরেজদের গভীর সম্পর্ক। ঘসেটি বেগমের চাওয়া-পাওয়ায় দুর্বলতায় ইংরেজরা সুযোগ নিচ্ছে। সে-পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মতিঝিল প্রাসাদ থেকে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতায় কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ, কলকাতার চক্রান্ত দমন ও নবাবগঞ্জের যুদ্ধে সফলতা লাভ করেন। এতে ইংরেজরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রাসাদ অভ্যন্তরে চক্রান্তে জাল ক্রমশ বিস্তৃৃতি লাভ করতে থাকে। এ গৃহবিবাদের সুযোগ ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে নবাব-ইংরেজদের মধ্যকার যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে বেনিয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসন শুরু থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ ভাগ ছিল নবাবের বিরুদ্ধাচারী ও ফরাসি ভাগ ছিল নবাবের সহযোগী। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন পরিবার-পরিষদসহ চারদিকের নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকার। (বাংলাপিডিয়া, খন্ড-১৩, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১১, পৃ ৪৬৫)। প্রকৃত অর্থে এ পলাশীর যুদ্ধটাই ছিল একটি নাটক বা সাজানো ঘটনা যা নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেননি। যা হোক যুদ্ধের সময় বিবদমান পক্ষ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিপরীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
নবাবের পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন – দেওয়ান মোহন লাল, মীরমদন, মীর জাফর আলী খান, খুদা ইয়ার লুফুৎ খান, রায় দুর্লভ ও মঁশিয়ে সিনফে; এদের মধ্যে অধিকাংশই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মীরজাফর আলী খান, খুদা ইয়ার লুফুৎ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ। মঁশিয়ের প্রকৃত নাম Monsieur de St. Frais। ব্রিটিশদের পক্ষে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, সেজর কিনপ্যাট্রিক, মেজর গ্র্যান্ট, মেজর আইরি কুট, ক্যাপ্টেন গপ, ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। যা হোক, নবাবের পক্ষের অমাত্যদের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিস্পৃহতায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী মুর্শিদাবাদ রক্ষার জন্য এলেও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। বরং উলটো হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। সে-পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজউদ্দৌলা সহধর্মিণী লুৎফুন্নেছা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তরদিকে যাত্রা করেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই নাজিরপুর মোহনায় এসে খাবার সংগ্রহের জন্য মসজিদ নিকটবর্তী বাজারে প্রবেশ করলে নবাব ধৃত হন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই, মতান্তরে ৪ জুলাই, নবাবকে হত্যা করে মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। তারপর মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলীবর্দি খাঁর কবরের পাশে তার লাশ সমাধিস্থ করা হয়। এসময় নানি শরিফুন্নেছা, মা আমিনা, খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা ও শিশুকন্যা উম্মে জহুরাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। পরে ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়। নবাবের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা তারপর দীর্ঘ ৩৪ বছর বেঁচেছিলেন ইংরেজদের দক্ষিণায় এবং প্রতিদিন স্বামীর কবরের পাশে বসে কাঁদতেন। নবাবের মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে নগর প্রদক্ষিণ এবং লুৎফুন্নেছাকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাবাসীকে কী শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা সচেতন পাঠক মাত্রই বোঝেন। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম মনে করেন। যদিও সত্যিকার ইতিহাস বিশ্লেষণে ‘বিশ্বের অন্যতম’ তাৎপর্য মূল্যায়নের নববিবেচনায় উদ্দীপিত করে। ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে; ১৭০৭-১৮০১ সাল পর্যন্ত সাদার মধ্যে লাল রেখা-অঙ্কিত বাঁ উচ্চকোণে ব্যবহৃত একটি ক্রুশ ও ১৮০১-৫৮ পর্যন্ত ব্যবহৃত দুটি ক্রুশ। ১৭৫৭-পরবর্তী ভারতবর্ষে কী ঘটেছিল তা অনুসন্ধিৎষুগণ সবাই কম বেশি জানেন।
নাটকটির প্রচারপত্রে উল্লেখ – ‘পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হয়েছিল ষড়যন্ত্রের শক্তিতে এবং অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার মধ্য দিয়ে ২০০ বছর ব্রিটিশ গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয় এ উপমহাদেশ। …যে কোনো যুদ্ধের বাস্তবতা এই-যুদ্ধ করে পুরুষেরা। বিজয়ী বা পরাজিত কোনো পক্ষে নারীযোদ্ধা নেই। যুদ্ধে নারী লুণ্ঠিত হয়, নারী ধর্ষিত হয়, শত্রুপক্ষ যুদ্ধে নারীধর্ষণের তান্ডব চালায়। কারণ, নারীরা হয় অধিকার স্থাপনের চূড়ান্ত উপায়। যুদ্ধের প্রান্তরে নয়, জয়-পরাজয় নারীর শরীরে হয় নির্ধারিত। …নবাব হত্যার পর রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে নারীমহলে কী ঘটনা ঘটেছিল সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই। এই সাহসী কাজটাই সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক-কবি-নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক। …নারীগণ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর নবাব মহলের অন্তঃপুরে বন্দি নারীদের নানান উপলব্ধি। নবাব সিরাজের বন্দি নানি, মা, পত্নীর জবানে উঠে আসে তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা, রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ, নারীর মর্যাদা ও ইচ্ছার স্বাধীনতাসহ অনেক বিষয়; অবমাননার হাত থেকে বাঁচতে এই বন্দি নারীরা আত্মহত্যাও করতে পারেন না। কারণ তাঁদের আত্মহননের পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অঙ্গুরির বিষ কেড়ে নেওয়া হয়, কেড়ে নেওয়া হয় খঞ্জর। প্রহরীর রূঢ় হাত তাদের শরীর স্পর্শ করে। তাঁদের বন্দি করার মধ্য দিয়েই ঘটনার শেষ হয় না। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এবং বিদ্রোহের পথ রুদ্ধ করতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এইসব নারীকে হত্যাও করা হয়।’
আবহমান বাংলার বর্ণনাত্মক রীতিতে নাটকটি উপস্থাপিত। বর্ণনা ও চরিত্রাভিনয়ের মধ্য দিয়ে উপনিবেশের প্রকৃতি, যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পরিণতি চমৎকারভাবে বিধৃত। এক্ষেত্রে নাট্যকারের গভীর অনুধ্যান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অত্যন্ত চমৎকার বাণীবিন্যাসে কাহিনি আবর্তিত। আবার পরস্পরের মানসিক দ্বন্দ্বও প্রতিভাত। সিরাজের নানি শরিফুন্নেছার উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে উপনিবেশ প্রকৃতি, বর্গির অত্যাচার ও বেপরোয়ার চিত্র প্রস্ফুটিত। বর্গিদের সামান্য সুযোগে কীভাবে বৃহত্তর আকার, শক্তি ও চক্রান্তের বীজ বহন করেছে তা অত্যন্ত নিখুঁত ও পরিমিত মাত্রায় শিল্প-মাধুর্যে ব্যাখ্যাত। মানবীয় আবেগে উপস্থাপিত হয়ে উঠেছে বর্গীয় নানা যন্ত্রণা। শেষ পর্যন্ত কৌশলে বহু মূল্যবান বোতাম উপঢৌকনের মাধ্যমে ঘসেটি বেগমকে ধরিয়ে আনাও শৈল্পিকতার মাত্রায় উপস্থাপিত। এ-নাটকে নারীদের বিলাপই প্রধান হয়ে উঠেছে। সিরাজের মা আমেনা বেগম যুদ্ধের ভয়াবহতায় স্বজন হারানো নারীদের পরিণতিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের পরিণতিতে নারীদের কীরকম বীভৎসতা তৈরি হয় বা কীরকম অত্যাচারিত হতে হয় তা আমেনা বেগমের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। শরিফুন্নেছা ও আমেনা বেগমের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ঘসেটি বেগমকে কেন্দ্র করে নারীত্বের স্বরূপ চমৎকারভাবে বিধৃত। উপনিবেশের সুযোগ সৃষ্টি ও লোভলালসার পরিণতিও ব্যাখ্যাত। শেষ পর্যন্ত দার্শনিক ভাষ্যে উপনীত হয়ে ওঠে ‘নারীর ধর্ম নারীর রক্ষায়’। বন্দি নারীদের প্রতি সৈনিকদের ভোগলিপ্সাতুর দৃষ্টিতে নারীদের আর্তচিৎকার এক মানবিক বোধে উদ্বেলিত করে তোলে। লুৎফুন্নেছা চরিত্রের মধ্য দিয়ে সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধোত্তর নানা ঘটনা ও বিষয় ব্যাখ্যাত। সিরাজের সঙ্গে সম্পর্ক ও স্মৃতিচারণায় বিলাপগ্রস্ত লুৎফুন্নেছা। নবাবের মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না তিনি। একধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্যে সর্বক্ষণই জর্জরিত লুৎফুন্নেছা। লুৎফুন্নেছার কল্পনার মধ্য দিয়ে সিরাজের শৌর্য-বীর্য ও ঘটনাবলি উপস্থাপিত। বিভিন্ন চরিত্রের উক্তি-প্রত্ত্যুক্তির মধ্য দিয়ে পারিবারিক ও মনোজাগতিক দ্বন্দ্বগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে নাটকে। ক্ষমতার অন্ধ অনুকরণ ও চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণে কুতুবদের ভূমিকা অনবদ্য। সিরাজউদ্দৌলাকে আরো অপমান করতে মীরনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবও দেয় উপনিবেশ-সহযোগী। উপনিবেশ ইতিহাস সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রের কলঙ্কছাপ ও দুর্বলতার চিত্র উপস্থাপিত করলেও নাটকে শরিফুন্নেছা, আমিনা বেগম ও লুৎফুন্নেছা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সিরাজ চরিত্রের বিশুদ্ধতার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। মঞ্চে ছয়জন নারী চরিত্র সর্বক্ষণ উপস্থিত। কোনো কাহিনির পরিভ্রমণীয় নাটকীয়তার চেয়ে যুদ্ধবন্দি নারীদের স্মৃতিচারণ ও বিলাপই প্রধান। শেষে প্রতীকী সিরাজচেতনার নবজাগরণের মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি ঘটে।
ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকে মঞ্চরীতিতে চারদিকের দর্শক পরিবেষ্টিত মধ্যমঞ্চে উপস্থাপিত নারীগণ নাটকটি। এ এরিনামঞ্চে উপস্থাপনের মধ্যেও একটি বিশেষ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। দর্শকের আসনের পেছনে হালকা কালো রঙের পর্দায় ঘেরা চারদিক দর্শক চলাচলের চৌপথের পরে দর্শকের পেছনে এ-পর্দা ব্যবহারের স্থান। এ কালো পর্দা দুটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে – একটি যুদ্ধে বন্দিকৃত নারীদের সমবেদনার কালো বা শোকের আবহ। অন্যটি ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম নাট্যধারায় ব্যবহৃত পর্দা ব্যবহারের প্রকাশ যা আমাদের বাংলা নাট্যশিল্পেও ব্যবহার্য। এ-পর্দা একদিকে যেমন মঞ্চকে অলংকৃত করেছে, সেরূপ আবার দর্শক চলাচলের মধ্যকার কিছুটা বিরক্তিও সৃষ্টি করেছে। হয়তো অল্পসংখ্যক দর্শকের ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য হবে না। মঞ্চমধ্যে তিনটি নৈর্ব্যক্তিক সাজেশন রয়েছে। তিনটি উপকরণ তিনটির বেশি মাত্রা ও বিষয় প্রকাশ করেছে। প্রথম মধ্যমঞ্চে প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ থামের সাজেশন। যেটিকে অভিনয়-কুশলতায় হারেমের অভ্যন্তর স্মৃতিচারণে প্রাসাদের অভ্যন্তর, নাটকের শুরু ও শেষে সিরাজের পরিষদের উদ্দেশে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। মঞ্চের একপাশে লাল-বেগুনি পর্দা ঝোলানো। তাতে আলোক-প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে রাজপ্রাসাদের দরজার অলংকৃত দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে। প্রতিচ্ছাপই স্পষ্ট করে তোলে এটি প্রাসাদের সাজেশন। মঞ্চের মধ্যে কয়েকটি উঁচু পাটাতন ব্যবহার করা হয়েছে, যা অভিনয় ও বিষয়ের গুরুত্বে নানা মাত্রিকতায় ব্যবহৃত।
নাটকটি শুরু হয় নারীদের বীভৎসময় চিৎকারের শব্দানুরণনের ও সিরাজউদ্দৌলার বিখ্যাত সেই উক্তি ‘বলেছিলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিবে না…’ ইত্যাদি। চৌকোনা মঞ্চের একপাশে রাজপ্রাসাদের সাজেশন এবং অন্যপাশে সংগীতদল বসা। সংগীতকর্মীদের পোশাকও কালো আবহে আচ্ছাদিত। নাট্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধ্রুপদি ঢং ও তাল-লয়ের আশ্রয়ে আবহ হিসেবে উপস্থাপিত। নাট্যের উচ্চাঙ্গসংগীত অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপিত বিষয়ক্ষণের আবেগ প্রকাশ করেছে। কখনো কখনো অভিনয়ের মাত্রাকে ছাড়িয়ে উচ্চাঙ্গের নিনাদে দর্শক আবেগে অনুরণিত হয়ে উঠেছে। প্রারম্ভের পর নৃত্যপটীয়সীর সিরাজকে মুগ্ধকরণে ক্লাসিক্যাল নৃত্য পরিবেশন করেছে। শুরুতে এ-নৃত্যশিল্পীর পরিচয় নাটকে না-পাওয়া গেলেও নাটকের শেষ পর্যায়ে সিরাজের প্রতি ভালোবাসা ও সিরাজের পরিবারের নারীদের সম্মান রক্ষার্থে পলায়ন-উদ্যোগী সহযোগী ভূমিকা তাকে মহৎ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ঠিক একইভবে প্রথমদিকে কুতুবদের চিন্তা তুচ্ছতর মনে হলেও নাটকের অন্তিম পর্যায়ে এ নগররক্ষী কুতুবদের চিন্তন তাদের মহত্ত্বর হিসেবে প্রতীয়মান করে তুলেছে। নাট্যকার ও নির্দেশকের এ-নাটকীয়তা সৃষ্টি নিঃসন্দেহে দর্শককে ভাবিত করেছে। আলোকের ব্যবহারও জোনভিত্তিক, অনেকাংশে পরিবেশ সৃষ্টিতে যথার্থ ভূমিকা সৃষ্টি করেছে। আলো স্পার্কিং করে নারীদের আর্তচিৎকার ও পলায়ন-চেষ্টা দর্শককে মানবিকবোধে তাড়িত করে। অভিনয়ে অনেকের ক্ষেত্রেই সাত্ত্বিকতা যথা বিশ্বাস ও বোধের পরিচয় ফুটে ওঠেনি। বিশেষত লুৎফুন্নেছা চরিত্রে অভিনয় অত্যন্ত মেকি বা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি ওই প্রদর্শনীতে। সিরাজের নানি চরিত্রের অভিনয়ে ভেতরের আবেগ ও বিশ্বাসের চেয়ে বাইরের আড়ম্বরটাই বেশি প্রস্ফুটিত ছিল প্রদর্শনীতে। লুৎফুন্নেছার স্মৃতিদগ্ধতা রূপায়ণে নান্দনিতার পরিচয় বিধৃত। সংলাপ ও বর্ণনায় ভঙ্গি সহজ ও সাবলীল। কুতুবদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন রাজকীয় ভাষা ফার্সির তথ্যটিও উদ্ঘাটিত। আলীবর্দি খাঁর চিঠির ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার হয়েছে। অভিনয়শিল্পীরা শুধু মধ্যমঞ্চ নয়, সমস্ত নাট্যগৃহ-অভ্যন্তরটিই উপস্থাপনায় ব্যবহার করেছেন। তাতে দর্শক নানা মাত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আন্দোলনের রসাস্বাদন প্রাপ্তি ও বিষয়ের মধ্য আন্তরিকভাবে অবগাহিত রেখেছে সারাক্ষণ। পাশ্চাত্যের ঘরানায় নাটকের মাঝে ১০ মিনিটের বিরতিও প্রদান করা হয়েছে। নাটকে নারীদের বন্দি করে খাঁচায় তোলা ও সৈনিকদের মদ্যপ লাম্পট্য চরিত্রাভিনয় দর্শককে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে বা যুদ্ধে জয়লাভকারীদের সাধারণ দর্শককে ক্ষোভ-তাড়িত করে তোলে। যুদ্ধের ভয়াবহ ও নগ্নতা প্রকাশে অংশগুলো অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তবে, এ কুচক্রী ও লাম্পট্য চিত্র-প্রকাশে নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের আশ্রয় নিলে দর্শক হয়তো সুখ-প্রদায়িত হতো। এতে একধরনের মানসিক যন্ত্রণাও বোধকরি সৃষ্টি করতে পারে দর্শকদের মধ্যে। নাট্যের শেষে হেরেমের সেবাদাসীদের আত্মসম্মানবোধ দর্শককে মানবিক স্পর্শে নিয়ে যায়। সাধারণত সমাজে মোগল হেরেম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় এটি ভোগবিলাসের স্থান ও নারীদের আবাস। অনেকে বিনোদনস্থল, আবার কেউ কেউ বেশ্যালয়ও বলে থাকেন। কিন্তু এ-নাটকে এ-ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। হেরেম মোগল নারীদের ও গৃহকর্মীদের আবাসস্থল। অত্যন্ত সম্মানীয় স্থান হেরেম। যতটুকু জানা যায়, হেরেমকে বেশ্যালয় হিসেবে প্রতিঠিত করেছে, ধ্রুপদি নৃত্যকে বাইজি নৃত্যে রূপান্তর ও প্রতিষ্ঠিত করেছে ঔপনিবেশক ও তাদের দোসররা। নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনা বা নাটকীয়তার গতিপরম্পরা একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকর মনে হয়েছে প্রদর্শনীতে। এ-বিষয় দুটি দিক থেকে বিশ্লেষিত হতে পারে – প্রথমত, নাট্য ঘটন বা বস্ত্তটি এক রাতের ঘটনা; অতএব এক রাতে কতগুলো ঘটনাই ঘটতে পারে। অন্যটি নাট্যকার ও নির্দেশকের দূরদৃষ্টি ও উপস্থাপনীয় পয়েন্ট ভাবনায় অবহেলা। যা হোক, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বগতির ঘটনীয় পরম্পরায় কাহিনি গতিমান ও নাটকীয় বৈচিত্র্য সৃষ্টি হলে নাটকটি আরো অনবদ্য হয়ে উঠতো।
নাটকটির নির্দেশনা প্রসঙ্গে নির্দেশক আতাউর রহমান বলেন, ‘বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব নৃশংসভাবে ইংরেজ শাসকদের চক্রান্তে নিহত হন ১৭৫৭ সালে। তাঁর নারীরা, অর্থাৎ সিরাজের মাতামহী (আলীবর্দি খাঁর স্ত্রী), মা, স্ত্রী, খালা ঘসেটি বেগম, অন্দরমহলের অন্যান্য নারীসহ দেশপ্রেমিক এক নর্তকী বন্দি হন চক্রান্তকারীদের হাতে। তাঁরা নির্বাসিত হন ঢাকার জিঞ্জিরার দুর্গে। সিরাজের কন্যাকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান দানা বেঁধে উঠতে থাকে; কিন্তু তা অচিরেই নস্যাৎ করা হয় এক নৌকাডুবির মাধ্যমে। একটি যুদ্ধ, সংঘর্ষ অথবা সংঘাতে নারীরাই সর্বাধিক মূল্য দিয়ে থাকে। এই মূলসুরই নাটকটিকে ঘিরে অনুরণিত হয়েছে। নারীরা স্বামী-ছেলে-প্রিয়জনকে যুদ্ধে পাঠিয়ে সর্বহারা হন। বিজিত হলে শত্রুপক্ষের হাতে তাদেরই সম্ভ্রম লুট হয়। সামাজিক এবং জাতীয় জীবনে একজন নারীর ভূমিকা পুরুষের তুলনায় যে কোনো অংশে গৌণ নয়, এ-সত্যবোধটি নারীগণ মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রকাশিত হোক – এ-প্রত্যাশা নিয়ে আমি সৈয়দ শামসুল হকের নারীগণ নাটকের নির্দেশনায় প্রয়াসী হয়েছি। সঙ্গে আছে ‘পালাকারে’র মতো সৃজনশীল নাট্যদল। আমি নারীগণ নাটকের মঞ্চসাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদী।’
‘পালাকার’ বাংলাদেশের মঞ্চে পরিশ্রমী, তারুণ্যদীপ্ত ও সম্ভাবনাময় নাট্যদল। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইতোমধ্যে ডাকঘর, রাইফেল, বাংলার মাটি বাংলার জল, রথের রশি ইত্যাদি প্রযোজনা দিয়ে নাট্যজগতে নানাভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত। দলের পরিচিতি সম্পর্কে সুভ্যেনিরে উল্লেখ – বাংলার লোকনাট্যরীতিতে পালাকার খুব জনপ্রিয় একটি শব্দ। পালা আমাদের আদি লোকজ নাট্যধারা, আর পালাকার তিনি, যিনি পালাটি পরিবেশন করেন। বিভিন্ন রসের ভাবে দর্শকদের গল্পে মাতিয়ে তোলেন একজন পালাকার। এই সূত্রে নাট্যদল পালাকার বাংলাদেশের গল্পবলিয়ে। ইতোমধ্যে পালাকার মূলধারার নিজস্ব নাট্য-প্রযোজনার পাশাপাশি একটি নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার স্টুডিও নির্মাণ করে তাতে নাট্য-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল সফলভাবে। এছাড়াও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ডেভেলপমেন্ট থিয়েটারের ভিন্ন-ভিন্ন প্রয়োগ নিয়ে দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করছে। বৈচিত্র্যসন্ধানী নাট্যদল পালাকারের অন্যতম উদ্দেশ্য বাংলাদেশে পেশাদার থিয়েটার তৈরি করা এবং সে-লক্ষ্যেই পালাকার গত ১০ বছর ধরে প্রতিনিয়ত পেশাদার থিয়েটার তৈরির পথ আবিষ্কার করছে। পালাকার বিশ্বাস করে, এভাবেই নতুন নতুন নিরীক্ষার মাধ্যমে থিয়েটারকে সমগ্র মানুষের দৈনন্দিন শিক্ষা, চেতনা ও বিনোদনের চাহিদা হিসেবে তৈরি করে তোলা সম্ভব।
নারীগণ নাটকটির সহযোগী নির্দেশক ও ‘পালাকারে’র প্রধান আমিনুর রহমান মুকুল বলেন, ‘সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকান্ড বাংলার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইতোমধ্যে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মঞ্চকে বারবার আলোড়িত করেছেন। সেই সুবাদে আমরা ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্ত চরিত্রকে চিনি-জানি। আমরা মীরজাফরকে যেমনভাবে চিনি, তেমনি জানি ঘসেটি বেগমকে; জানি সিরাজের নানি শরিফুন্নেছাকে, মা আমিনাকে ও স্ত্রী লুৎফাকে। কিন্তু সিরাজকে যখন হত্যা করা হয়, তখন সেই নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। তারই নতুন দিক উন্মোচন করেছেন নারীগণ নাটকের নাট্যকার। যেহেতু ‘পালাকার’ একটি বৈচিত্র্যসন্ধানী নাট্যসংগঠন, তাই এই গল্প বলার সুযোগ আমরা হাতছাড়া করতে চাইনি। সে-কারণে আমাদের নারীগণ মঞ্চায়ন।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ হলেও শিক্ষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতির কোনো ক্ষেত্রেই উপনিবেশ বেড়াজাল থেকে বের হয়ে স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা পায়নি। মুক্ত হতে পারেনি উপনিবেশসৃষ্ট বিভ্রান্তি থেকে। আবহমান বাংলার নিজস্ব পরিবেশনারীতিতে উপস্থাপিত নারীগণ নাটকটি। নাটকটি অনেক শ্রমসাপেক্ষ ও শৈল্পিক উপস্থাপনা। রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন বাঁকপরিবর্তনীয় বিষয় নিয়ে হাজার বছরের বহমান নাট্যবৈশিষ্ট্যে নারীগণ নাটকটি উপস্থাপনার জন্য ‘পালাকার’ নাট্যদল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
নারীগণ নাটকের কুশীলববৃন্দ হচ্ছেন – অভিনয়ে-ফারহানা মিঠু, দীপ্তা রক্ষিত লাভলী, তানিয়া হোসাইন, আরজুমান্দ আরা বকুল, জয়িতা মহলানবীশ, উম্মে সালমা রিমু, তিথি দাশ সাথী, কাজী ফয়সল, শামীম সাগর, সানসি ফারুক, শামীম সুফি, প্রণব দাস, গোপীনাথ বাগচী, মিরাজুল ইসলাম মিঠুন, জাহিদ হাসান, সবুজ গাজী, নিপুণ আহম্মেদ, লিয়াকত লিকু, মুরারী সরকার, ইমরান প্রমুখ। নেপথ্যে : মঞ্চ-পরিকল্পনা- অনিকেত পাল বাবু, আলোক পরিকল্পনা- ঠান্ডু রায়হান, সংগীত-পরিকল্পনা- অজয় দাশ, সংগীতদল- অপর্ণা আহম্মেদ, রেজাউল করিম হিটলু, আবদুর রহমান, ফাইজুর মিল্টন, অমিত বাগচী, সবুজ গাজী, আরিফ রেজা চৌধুরী, গোপীনাথ বাগচী, পোশাক-পরিকল্পনা- লুসী তৃপ্তি গোমেজ, মঞ্চ ব্যবস্থাপনা- কাজী ফয়সল, সানসী ফারুক ও সহযোগী নির্দেশক- আমিনুর রহমান মুকুল। 

Published :


Comments

Leave a Reply