নারীর ভাষিক জগৎ

মানুষ ভাষিক প্রাণী। মূকপ্রতিবন্ধী না-হলে জন্মের অব্যবহিত পর থেকে মানুষ ভাষা ব্যবহার করে বস্ত্ত ও ভাবময় বিশ্বকে প্রকাশ করে। আর এই ভাষিক জগৎ হলো কোডিং, ডিকোডিং ও এনকোডিংয়ের জগৎ। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতীক, প্রতীকের অর্থময়তা ও সেই অর্থময়তাকে বুদ্ধিমত্তার মধ্যে ধারণ করে ভাষিক জগৎ তৈরি করে। মানবীয় বিশ্ব বলতে মূলত এই ভাষিক জগৎকে বোঝায়। ভাষা ছাড়া চিন্তার কোনো রূপ তৈরি হতে পারে না। সুতরাং চিন্তার বাহন হলো ভাষা। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত যাই হোক না কেন, ভাষা ছাড়া মানুষ ভাবতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। তাই ভাষার মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষের মানবীয় অসিন্তত্বের রকমফের। মানুষের অর্থনৈতিক পরিচয়, সামাজিক মর্যাদার পরিচয়, সংস্কৃতিগত অবস্থার পরিচয় এবং বিশেষ করে লৈঙ্গিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়  ভাষিক জগৎ। সুতরাং নারী ও পুরুষের ভাষিক জগৎ যে এক হতে পারে না, এ-বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। বিশেষ করে যে-সমাজে জেন্ডার-বৈষম্য চরম, যেখানে ক্ষমতায়নের পাল্লা পুরুষমুখী, সে-সমাজে ভাষিক জগতেও তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

সুপ্রাচীন কাল থেকে নারীরা প্রামিন্তক জনগোষ্ঠী এবং ন্যূনতম ক্ষমতা থেকেও বঞ্চিত। ফলে তাদের ভাবনা ও ভাবনা-প্রকাশ চিরকালই দ্বৈরথে নিমজ্জিত। গভীর অনুভব ও তীব্র স্পর্শকাতরতার যে-জগৎ তারা লালন করে তা চিরকালই অবহেলিত এবং তাদের অনিশ্চয়তার ভাষা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে একটি স্থায়ী কাঠামো লাভ করেছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রবিন লেকফ ‘Language and woman’s place’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন :

In appropriate women’s speech, strong expression of feeling is avoided, expression of uncertainty is favored, and means of expression in regard to subject-matter deemed ‘trivial’ to the ‘real’ world are elaborated. Speech about women implies an object, whose sexual nature requires euphemism, and whose social roles are derivative and dependent in relation to men. The personal identity of women thus is linguistically submerged; the language works against treatment of women, as serious persons with individual views.

তার মানে প্রতিটি ভাষারই একটি লৈঙ্গিক পরিচয় আছে এবং এই পরিচয় নির্ধারিত হয় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংসৃকতিক পটভূমির আলোকে এবং এই পটভূমিতে পুরুষগণ চিরকালই অসামান্য প্রাধিকারপ্রাপ্ত। শুধু তাই নয়, ভাষা সংগঠনের যে নিরবচ্ছিন্ন ধারাক্রম সেই ধারা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত। অতি সাম্প্রতিককালে ভাষাতাত্ত্বিক ডেবোরা টানেন (Deborah Tannen), একেই জেন্ডারলেক্ট (Genderlect) বলে অবহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, নারী-পুরুষের ভাষা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ, ঊর্ধ্বতন কি অধস্তন সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, তাদের ভাষা আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ এতটাই যে, একজন ব্রিটিশ ও একজন জাপানির সংস্কৃতিগত ভিন্নতার জন্য বাচনে যে ভিন্নতা দেখা যায় নারী ও পুরুষের বাচনে সেরূপ ভিন্নতা পরিলক্ষেত হয়। এই ভিন্নতার পরিচয় উল্লেখ করা যায়।

নারীর বাচনে সংলগ্নতার পরিচয় আর পুরুষের বাচনে মর্যাদার ইঙ্গিত নারী সংলগ্নতা চায়। তার কথা বলার মধ্যে এই সংলগ্নতার পরিচয় নানাভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মীয়তান্ত্রিক যে বাঙালি সমাজব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন, তার মূলে আছে নারীর এই চিরকালীন সংযোগ স্থাপনের ঐতিহ্য। পারিবারিক বন্ধনের যে-সংস্কৃতি আমাদের সমাজে আজো টিকে আছে তার মূলে আছে নারীর মনোগড়ন ও ভাষিক জগতের যোগাযোগপূর্ণ সংবন্ধন। নারীর বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, উচ্চারণে অনুভবপুঞ্জের স্পর্শময়তা এবং বস্ত্তনিচয় ও ভাবময়তার শব্দপ্রতীক নির্বাচনে তার এই সংলগ্নতার পরিচয় বিধৃত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত গল্প ‘মধ্যবর্তিনী’। এই গল্পে সন্তানহীনা রমণী হরসুন্দরী। বিস্ময়কর একটি বেদনা ও নিঃসঙ্গতার বোধ তিনি লালন করেন অতি সংগোপনে। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা ও বেদনাবোধকে অতিক্রম করে যায় তার সংলগ্নতার তীব্র আকাঙক্ষা। স্বামীকে তাই তিনি আর একটি বিয়ে

করার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবের মধ্যে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আছে; কিন্তু স্বামীকে তিনি তা বুঝতে দেন না। স্বামী নিবারণ বারবার অনুরুদ্ধ হয়ে :

একদিন নিজেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া কহিল, ‘বুড়াবয়সে একটি কচি খুকিকে বিবাহ করিয়া আমি মানুষ করিতে পারিব না।’

হরসুন্দরী কহিল, ‘সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না। মানুষ করিবার ভার আমার উপর রহিল।’ বলিতে বলিতে এই সন্তানহীনা রমণীর মনে একটি কিশোরবয়স্কা, সুকুমারী, লজ্জাশীলা, মাতৃক্রোড় হইতে সদ্যোচ্যুতা নববধূর মুখচ্ছবি উদয় হইল এবং হৃদয় স্নেহে বিগলিত হইয়া গেল।

নিবারণ কহিল, ‘আমার আফিস আছে, কাজ আছে, কচি মেয়ের আবদার শুনিবার অবসর আমি পাইব না।’

এই উদ্ধৃতির মধ্যে দুটি কণ্ঠস্বর বেশ স্পষ্ট অনুভব করা যায়। এর একটি নারীকণ্ঠ এবং অন্যটি পুরুষকণ্ঠ। ‘মানুষ করিবার ভার আমার উপর রহিল’ – এ হলো নারীর চিরকালের স্বরূপ। সমাজের যে ছোট সংগঠনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই সংগঠনের বুনিয়াদ রচনা করেন নারী। এবং হাজার বছর ধরে পরিবার নামক সংগঠনটি টিকে আছে নারীর বিস্ময়কর এক সংবদ্ধতার প্রেরণা থেকে। ফলে লক্ষ করা যায় যে, যে-পরিবারে পিতার অকালমৃত্যু ঘটে, সেই পরিবার সাধারণত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। আর্থিক কোনো ভিত্তি না থাকলেও মা তার সন্তান-স্ততিদের নিয়ে অবিশ্বাস্য ত্যাগ স্বীকার করে সংসারটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। নারীর অসিন্তত্বের মধ্যেই আছে যূথবদ্ধতার এই নিয়তি। সন্তান জন্ম দেওয়ার নিয়তি যেমন নারীর, তেমনি পরিবার ও সমাজের মধ্যে বন্ধন তৈরি করার গোপন এক সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া নারীর যোগাযোগ কৌশলে সাধিত হয়ে থাকে।

‘আমি মানুষ করিতে পারিব না।’ – এই মনোগড়ন অবশ্যই পুরুষের। কাউকে মানুষ করার দায়কখনোই পুরুষগণ বহন করতে চান না। টাকাকড়ি ও আর্থিক সচ্ছলতাই যে মানুষ করার অপরিহার্য বিষয় নয়, এই বোধ অনেক সময় পুরুষের মাঝে থাকে না। তারা মনে করেন টাকাই সব। শুধু তাই নয়, সম্বন্ধ স্থাপনের মধ্যে পুরুষেরা কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, সম্পর্ক স্থাপনে পুরুষরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেই সত্য নয়। বরং সম্পর্ক ছিন্নের এক গোপন মনোগড়ন পুরুষের মধ্যে আছে। এর কারণ হলো, পৌরুষ জাহির করা এবং নিজের সামাজিক মর্যাদার বিষয়ে সর্বদা সচেতন থাকা। নিবারণ বলেন, ‘আমার আফিস আছে, কাজ আছে, কচি মেয়ের আবদার শুনিবার অবসর আমি পাইব না।’ এই উক্তির মধ্যে নিবারণ প্রতিনিধিত্ব করছেন সমগ্র পুরুষজাতির। ‘অফিস’ এবং ‘কাজ’ – এ হলো পুরুষদের মর্যাদার প্রতীক। সুতরাং তাদের বাচনের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে অফিসের কথা আসবে, কাজের কথা আসবে। অফিস যদি না-থাকল, কাজ যদি  না-থাকল তা হলে সে আর কিসের পুরুষ? অর্থাৎ পুরুষগণ যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে আসুক না কেন মর্যাদার বিষয়ে তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল। Deborah Tannen যথার্থই বলেছেন যে, Women seek human connection, whereas men are concerned mainly with status. While women are focused on cultivating a sense that they’re in touch, men are working hard to preserve their independence as the jockey for position on a hierarchy of competitive accomplishment. When they’re together, women’s longing for intimacy threatens, men’s desire for freedom and sidetracks the masculine quest to be one up in all relationships.

ডেবোরা টানেন যথার্থই বলেছেন, প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা, মর্যাদা ইত্যাদি পুরুষদের ভাষিক জগতের অপরিহার্য বিষয়। আর নারীদের বিষয় হলো সম্বন্ধ স্থাপন ও সংবদ্ধতা তৈরি। কিন্তু এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় যে, নারীরা ক্ষমতার জন্য কাজ করছেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মর্যাদাকর স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন আর অন্যদিকে পুরুষগণ সংযোগ ও বন্ধনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এও সত্য যে, নারীরা মনে করেন তাদের সঙ্গীরা তাদের ভালবাসুক এবং পুরুষরা মনে করে তাদের সঙ্গীরা তাদের সম্মান করুক।

 

নারীরা আত্মিক যোগাযোগে বিশ্বাসী আর পুরুষেরা প্রতিবেদনিক যোগাযোগে অভ্যস্ত

জগদীশ গুপ্তের লঘুগুরু উপন্যাসের উত্তম ও বিশ্বম্ভর বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে একেবারেই নতুন দুই নারী-পুরুষ। স্বামী বিশ্বম্ভর ও তার বন্ধুরা মদপানের আসরে মত্ত ছিল। গর্ভবতী স্ত্রীকে কীসের জন্য তাড়া দিলে পালাতে গিয়ে পড়ে যায় সে এবং মেয়ে টুকীকে জন্ম দিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করে টুকীর মা। তারপর যে নারীকে নিয়ে বিশ্বম্ভর ঘর বাঁধে সে তার বিবাহিত স্ত্রী নয়। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আশি বছরের দীর্ঘজীবনে এ-উপন্যাস নিয়ে কঠিন সমালোচনা করেছিলেন, যা উপন্যাসকে ছাপিয়ে লেখক পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। নারী ও পুরুষের বাচন প্রক্রিয়ায় আন্তিক যোগাযোগ ও প্রতিবেদনিক যোগাযোগের তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ হলো এই দুটি চরিত্র। উত্তম যৌনকর্মী। অসাধারণ মেধাবী, শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক, হৃদয়বান ও রুচিশীল মানুষ। ‘রূপ ও সুখপিপাসু লোকের অজস্র গমনাগমন হইয়াছে [তার জীবনে], কিন্তু আত্মার অক্ষয় সঙ্গী হইয়া ওঠে নাই কেউ -’।  এখন সে বিশ্বম্ভরের রক্ষিতা। উত্তম সম্পর্কে বিশ্বম্ভরের ধারণা হল, ‘উত্তমকে সে যে বস্ত্ত মনে করিয়াছিল সে বস্ত্ত সে নয় – এ বাধ্য করিতে জানে এবং বাধ্য করিবার কাজে অনাস্বাদিতপূবর্ব একটা মাধুর্য্য ঢালিতে জানে, তাহা উপভোগ করাইতে জানে। স্ত্রী সে নয়; বিশ্বম্ভর অনুভব করিতে লাগিল, স্ত্রীর নবতর এবং উৎকৃষ্টতর একটা রূপ সে।’

কিন্তু বিশ্বম্ভরের এই অনুভব তার পুরুষোচিত স্বভাবকে খুব বেশি আলোড়িত করে না। এর পরিচয় পাওয়া যায় টুকীর বিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়। এর আগে টুকীকে নিয়ে উত্তমের ভাবনার ভাষা উল্লেখ করা যায়।

এ মেয়েটি তার পেটের মেয়ে নয় – একেবারে পর – কিন্তু ইহার দিকে চাহিয়া ইহার ভবিষ্যৎ ভাবিয়া তার দেহ যেন শীতল হইতে থাকে – চিরন্তনী কন্যা এ – বধূ, – স্ত্রী, জননী – শরতের আকাশ যেমন অনাবিল, ইহার জীবনও আদি প্রান্ত হইতে কল্পনায় যতদূর দেখা যায় সেই শেষতম প্রান্ত পর্যন্ত তেমনি ছায়াহীন অনাবিল – পৃথিবীর কাহারো দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতে তাহার সঙ্কোচের সীমা নাই –

অসাধারণ এক মমত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে মেয়েটিকে মানুষ করেছে এই উত্তম। কিন্তু এর যখন বিয়ের প্রস্তাব আসে, তখন বিশ্বম্ভর ও উত্তমের মধ্যকার কিছু সংলাপ উল্লেখ করি।

উত্তম আপত্তি করিল, – ছেলের বয়স যে বেশি বল্ছ?

-তা হোক, মেয়ের বিয়ে কবে হয়ে যেত’ – তোমার জন্যই তো যত ইয়ে আমার, যত কষ্ট; তোমার কথা আমি শুনবা না। […]

– কিন্তু আমার ওপর বিরক্ত হ’য়ে মেয়ের সুখ দেখবো না।

আমার মেয়ের সুখ আমি দেখব, তুমি থাম। – মাথা নেই তার মাথা ব্যাথা

বিশ্বম্ভরের এই অনুভবশক্তি নেই যে, সে মেয়ের ‘অধিকারী’ বটে কিন্তু ‘কৃতি’ নয়। টুকী যে আজ তার পিতৃচক্ষুর কাছে তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে তার সবটুকু কৃতিত্ব উত্তমের। বিশ্বম্ভরের সংসারে এই রূপোপজীবিনীর আগমন না-ঘটলে কোথায় থাকত বিশ্বম্ভর নিজে আর কোথায় থাকত তার কন্যা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পিতার নিষ্ঠুর কথা আড়াল থেকে শুনতে পেয়ে টুকী কষ্ট পায়। চোখ মুছে টুকী উত্তমকে বলে, ‘মা, তুমি বাবাকে ক্ষমা করো; বাবা কিছু বোঝে না।’

উলিস্নখিত পাঠের মধ্যে নারী-পুরুষের ভাষিক জগতের অন্য এক পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে, আর তা হলো, নারীর ভাষিক জগৎ আত্মীয়তার অনুষঙ্গী আর পুরুষের সেই জগৎ প্রতিবেদনধর্মী। বিশ্বম্ভরের ভাষিক আচরণের মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণতা নিহিত যার প্রকাশ ঘটে আবেগ ও উষ্ণতাবিবর্জিত ভাষায়। অন্যদিকে উত্তমের ভাষিক জগৎ হৃদয়ের উষ্ণতা ও সম্পর্কমুখরতায় প্রাণবন্ত। সেই সম্পর্কের প্রচ- টানে টুকী হয়ে ওঠে অন্য এক জীবনদর্শনের মানুষ। তাই মাকে যে-ভাষায় সে সান্তবনা দেয় তার মধ্যেও নারীর আত্মীয়তান্ত্রিক জীবনাকাঙক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বম্ভরের ভাষায় আবেগবিবর্জিতভাবে সমস্যা সমাধানের কৌশল লক্ষ করা যায়। এবং এই দুই শ্রেণির শব্দ চয়ন, বাক্যগঠন ও স্বরের মাত্রান্তর তাদের মনোগড়নের ভিন্নতাকে স্পষ্ট করে তোলে।

 

একান্ত আলাপচারিতা ও প্রকাশ্য বক্তব্য

একান্ত আলাপচারিতা ও প্রকাশ্য বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য নারী-পুরুষের মধ্যে তো বটেই, এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তিই একান্ত আলাপচারিতা ও প্রকাশ্য বক্তব্যে বাচনগত ভিন্নতা সৃষ্টি করে। তবে একান্ত আলাপচারিতায় নারীদের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের কৌতুক প্রচলিত আছে। যেমন, একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে, ‘গত দশ বছর ধরে তুমি আমাকে তোমার কেনো মতামত দাওনি।ৎ এজন্য ইংরেজিতে নারীদের বলা হয় ‘wordy women’ অর্থাৎ বাচাল নারী এবং পুরুষদের বলা হয় ‘mute male’ অর্থাৎ মূক পুরুষ। সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর গার্হস্থ্য পরিবেশে এ-ধরনের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি গবেষণায় এই বাস্তবতা লক্ষ করা গেছে যে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পুরুষদের চেয়ে নারীরা অনেক বেশি কথা বলে। নারীদের বেশি কথা বলার এই স্বভাবের জন্য বলা হয় যে, মেয়েরা ছেলেদের প্রেমে পড়ে কারণ ছেলেদের আছে ‘a giant ear’। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক লু অ্যান ব্রাজ্যানডাইন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, মহিলারা প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার শব্দ ব্যবহার করেন এবং পুরুষরা ব্যবহার করেন মাত্র ৭ হাজার শব্দ। কিন্তু প্রকাশ্য বক্তব্যে পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলে।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মহিলারা কেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে? এর কারণ হলো, একটি অন্তরঙ্গ পারিবারিক পরিবেশ বা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ নারীদের মনস্তাত্ত্বিক গড়নের সঙ্গে ভালভাবে খাপ খায়। সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার নানা পটভূমিতে পুরুষকে বাচনে কৌশল অবলম্বন করতে হয়; কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নারীদের সে-ধরনের কোনো কৌশল অবলম্বন করতে হয় না। ফলে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, আনন্দে-বেদনায় অধিকাংশ নারী প্রচুর কথা বলে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) রম্যরচনা ‘বিদ্যাধরীর অরুচি’। এ-গল্পে বিদ্যাধরী কেন্দ্রীয় চরিত্র। নিরন্তর কথা বলে যাওয়া তার স্বভাবের অপরিহার্য অংশ। দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিই। গোলাপী ঝি বলল,

দেখ বিদ্যাধরী! বাবুর মুখে তুমি আর চুনকালি দিও না। আমাদের বাবু একজন বড় উকীল। নীলাম্বর ঘোষের নাম কে না জানে? তাঁর বাড়ির ঝি হইয়া তুমি মুদীর দোকানে একটু গুড়, উড়ের দোকানে একটি ফুলুরী, ময়রার দোকানে একটু চিনির রস, রায় বামনীর কাছে একটু মোচার ঘণ্ট, যার তার কাছে যা তা জিনিস মাগিয়া বেড়াইলে বাবুর অপমান হয়। বাবুর কথা দূরে থাক্, আমাদের পর্য্যন্ত ঘাড় হেট হয়। তোমার মাগার জ্বালায় লোকের কাছে আমরা মুখ তুলিয়া কথা কহিতে পারি না।

গোলাপী ঝিয়ের এই কথায়  বিদ্যাধরী রেগে যায়, এবং বলে,

তোমরা সকলতাতেই আমার ছল ধর। মা আমাকে একটু ভালবাসেন, তাই সকলে তোমরা ফাটিয়া মর। আমার অরুচি, মুখে কিছু ভাল লাগে না। চড়াই পাখীর আহার। না খাইয়া যেন দড়ি হইয়া যাইতেছি। গতর না থাকিলে পরের বাড়ী কাজ করিব কি করিয়া? তাই তেঁতুল দিয়া, গুড় দিয়া যা দিয়া পারি এক মুঠা ভাত খাইতে চেষ্টা করি। আমি গরীব মানুষ। পয়সা কোথা পাইব যে, সন্দেশ রসগোল্লা কিনিব? মুদী আমাকে ভালবাসে, তাই সে দিন সে আমাকে একটু গুড় দিয়াছিল। ময়রা আমাকে ভালবাসে, তাই সে দিন আমাকে শালপাতের ঠোঙা করিয়া রসগোল্লার খানিক রস দিয়াছিল। তাতে তোমরা হিংসায় ফাটিয়া মর কেন বল দেখি?

বিদ্যাধরী ও গোলাপী গৃহকর্মী। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি রমণীদের পড়াশোনা তেমন ছিল না। আর গৃহকর্মীদের পড়ালেখা আজো সুদূরপরাহত। সে হিসেবে বিদ্যাধরী ও গোলাপী অশিক্ষেত ও নিম্নশ্রেণির মানুষ। এদের মধ্যে অক্লান্ত কথা বলে যাওয়ার প্রবণতা আছে। শুধু এরাই নয়, বালিকা থেকে বৃদ্ধা – সব বয়সের এবং সব শ্রেণির নারীর মধ্যে গার্হস্থ্য পরিবেশে ও একান্ত আলাপচারিতায় অনর্গল কথা বলে যাওয়ার স্বভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, দুটি কথোপকথনের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ-অনুযোগের বিষয় থাকলেও এই আলাপচারিতার মধ্যেও এক ধরনের কোমলতা ও বন্ধনের মনোগড়ন মূর্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ আছে, আক্রমণ নেই। আর বাক্যের গড়ন ও শব্দচয়নের প্রকৃতি সম্পূর্ণই পুরুষদের থেকে আলাদা। পুরুষরা যখন কথা বলে তখন তাদের আশা-আকাঙক্ষা ও মূল্যবোধের বিষয়গুলোর প্রতিফলন কোনো-না-কোনোভাবে ঘটতে দেখা যায়। এর জন্য তারা আশ্রয় নেয় গল্প ও কৌতুকের। বিশেষ করে যখন তারা মজা করতে চায় কিংবা মজার ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চায়, তখন এমন গল্পের আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে যেখানে গল্পের কেন্দ্রে সে নিজে এবং খুব সাফল্যের সঙ্গেই কোনো সমস্যার সমাধান করা গেছে।

জগদীশ গুপ্তের একটি বিখ্যাত গল্পের নাম বেলোয়ারী টোপ। এই গল্পে পুরুষের ভাষিক জগতের সঙ্গে তার উত্তমর্ণতার অভিপ্রায় লক্ষ করা যায়। উত্তমপুরুষে লেখা গল্পের ব্যক্তিটি পিরুদাসকে গ্রামের নাম ‘পোড়াবৌ হ’র কেন? জানতে চেয়ে বলে,

আচ্ছা, পিরু, আমাদের এই গ্রামের নাম পোড়াবৌ হ’ল কেন? এমন সব ভাল ভাল নাম থাক্তে কিনা পোড়াবৌ! – কাঞ্চনপুর, সুবর্ণগ্রাম, রতনপুর, রামচন্দ্রপুর, হরিহরনগর কেমন প্রাণ ভরা চমৎকার সব নাম; ভোরবেলা উঠে গ্রামের নাম করলেই কত পুণ্যি! সব থাকতে কিনা পোড়াবৌ; আর লোকে গ্রামের নাম করে না, বলে – হাঁড়ি ফাটে। […]

পিরু বলিল, – এ-গ্রামের নাম পূর্বে পোড়াবৌ ছিল না, বাবু; কেন হ’ল তা যদি শোনেন ত’ নিবেদন করি। […] মানবের মনের দিশে পেলাম না বাবু, এত বয়েস হ’ল। মানুষ যে কি চায় আর কি  না চায় তা’ আজও আমার ঠাহর হ’ল না – […]

এই যে বাছুরটা চর্ছে দেখ্ছেন, পেট ভরানো ছাড়া এর আর কোনো কাজ কি আছে? নাই; পেট ভরলেই এ নিশ্চিন্দি, কিন্তুক বাবু, মানুষের খাই-খাই আর মেটে না; ভরা পেটেও যেমন তার খাই-খাই, খালি পেটেও তেমনি; একদ-ও সে নিশ্চিন্দি না; কত যে খাবে, তার কত যে ক্ষিদে তা’ যেন সে নিজেও জানে না। সে জ্ঞাতির সর্বস্ব খায়, নিজের মাথা খায়, পরের পরকাল খায়, তবু তার আশ মেটে না। বলুন বাবু, হ্যাঁ কি না? […]

কিন্তু আর একটা কথা ভাবুন বাবু, পেটের ক্ষিদেয় মানুষ যত পাগল না হয়, চোখের ক্ষিদেয় আর মনের ক্ষিদেয় হয় তার চতুগু্যণ। মান্ষের এই মন নিয়েই ত’ যত মারামারি, কাটাকাটি, পাপের কার্য।

উত্তমপুরুষ ব্যক্তি ও পিরুর বক্তব্যের এই গড়ন কিছুতেই নারীর নয়। পুরুষবাচকতার সব চিহ্ন মুছে দিলেও যে-কেউ অনুমান করতে পারবে যে, এই ভাষা অবশ্যই পুরুষের। তাহলে এই ভাষার গড়নের মধ্যে পুরুষবাচকতার উপকরণগুলো কী? প্রথমত, ভাষার মধ্যে লোকজ গল্পগাথার কোনো চিহ্ন নেই যা নারীর বাচনসংস্কৃতির অন্যতম উপকরণ। দ্বিতীয়ত, এই ভাষার মধ্যে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে আত্যমিন্তক কোনো সংযোগ স্থাপিত হয় না। তৃতীয়ত, এই ভাষার মধ্যে যে দার্শনিক প্রত্যয় প্রবলভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে নারীদের ভাষায় তা কখনোই সম্ভব নয়। এবং সর্বোপরি গল্প বলতে গিয়ে বারবার নিজের পান্ডিত্য ও অস্তিত্ব জাহির করা হয়েছে, যা নারীর ভাষিক সংস্কৃতির সম্পর্ক পরিপন্থী।

নারীদের মধ্যেও গল্প করার প্রবণতা আছে; কিন্তু তার পটভূমি ভিন্ন। সেই গল্প নিজেকে জাহির জাহির করার জন্য নয়, বরং অন্যকে বিচিত্র মাত্রায় উপস্থাপনের জন্য। তবে অধিকাংশ সময়ই তাদের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে লোকজ জীবনের গল্পকথার আমেজ লক্ষ করা যায়। কখনো কখনো শ্রোতার স্তরে নিজেকে নিয়ে এসে পারস্পরিক বোধগম্য ও বোঝাপড়ার একটি সমান আনুভূমিক ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য তারা গল্পের মধ্যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করার স্বভাবসুলভ কৌশলের আশ্রয় নেয়। এতে তার প্রতি শ্রোতার অন্তরঙ্গতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়।

নারী ও পুরুষের শোনার ভাষাও আলাদা। নারীদের শোনার ভাষা সহযোগিতামূলক। কেননা, তারা যখন কোনো গল্প বা বিবরণ শোনে তখন সম্মতিসূচক যেসব শব্দ ব্যবহার করে তার মানে ‘আমি তোমার কথা শুনছি’ কিংবা ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি’ কিংবা ‘তুমি চমৎকার বলছ’ ইত্যাদি। এসব সম্মতিজ্ঞাপক মনোভাব ব্যক্ত করতে তারা সহযোগিতামূলক বিঘ্নের (Co-operative overlap বা, Supportive interruption) আশ্রয় গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে পুরুষগণ মাঝপথে কথা বলে – সহযোগিতার জন্য নয়, বরং আধিপত্য বিস্তার ও উত্তমর্ণতা প্রতিপন্ন করার জন্য। তবে কখনো কখনো পুরুষগণও সহযোগিতামূলক বিঘ্নের আশ্রয় গ্রহণ করে। বিশেষ করে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে যদি সম্পর্ক হয় উত্তমর্ণ ও অধমর্ণের। গ্রামীণ জীবনে অতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও লক্ষ করা যায় যে, সহজাত এক আনুগত্য ও নিরাপত্তাবোধের প্রেরণা থেকে পুরুষেরা বাচন-সংস্কৃতির এই অনুশাসন মেনে চলে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ক্ষমতাহীন নারীদের মধ্যে বাচন-সংস্কৃতির অন্য এক বিধান প্রচলিত আছে। আর তা হলো, ব্যক্তি পর্যায় থেকে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত বন্ধনের এক গোপন প্রেরণা থেকে তারা কথনবিশ্বে চিরকাল সহযোগী। তত্ত্ব নয়, তথ্য নয়, বিদ্যা নয়, বুদ্ধি নয়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাও নয় – শুধু স্থিতিশীলতা ও বন্ধনের গোপন অনুভব থেকে নারীরা শেষ পর্যন্ত সহযোগিতার ভূমিকায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

সুকুমার সেন পশ্চিমবঙ্গের নারীদের ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘বাঙলায় নারীদের ভাষা’। তিনি সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে না-দেখে মূলত ব্যাকরণের আলোকে নারীদের ভাষার অনন্য স্বরূপ বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে :

প্রাচীন যুগ থেকে আরম্ভ করে আজ অবধি সব সমাজেই নারী ও পুরুষের মধ্যে যথেষ্ট সামাজিক ব্যবধান আছে। অবশ্য এই ব্যবধান সবর্বত্র সমান নয়। পুরুষ ও নারীর কর্ম্মক্ষেত্র আর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূণ্যরূপে আলাদা ব’লেই এই পার্থক্যের উদ্ভব। আর এই জন্যে সকল দেশেই নারী ও পুরুষের ভাষায় কমবেশী পার্থক্য র’য়ে গিয়েছে। কোথাও কম আর কোথাও বেশী। সভ্য জগতে, যেখানে নারী ও পুরুষের কর্ম্মক্ষেত্র প্রায় এক হ’য়ে এসেছে বা আসছে, সেখানে এই পার্থক্য খুবই কম দেখা যায়। কিন্তু অসভ্য সমাজে যেমন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে এই পার্থক্য খুবই সুস্পষ্ট।

ভাষা-ব্যবহারে নারীরা অনেক বেশি রক্ষণশীল

নারীদের সামাজিক গ– ও বিচরণক্ষেত্র খুবই সীমাবদ্ধ। ফলে জীবনের বহুবিধ রক্ষণশীলতার মত ভাষা-ব্যবহারেও নারীরা রক্ষণশীল ও প্রাচীনপন্থী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসের কৃষ্ণদয়াল ও তার স্ত্রী আনন্দময়ীর মধ্যকার সংলাপ বিবেচনা করলে ভাষা-ব্যবহারে নারীদের প্রাচীন পন্থার বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। শব্দচয়নে তো বটেই বাক্য গঠনে এবং সামগ্রিক বাচন-কৌশলে নারীদের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। উদাহরণ দিই :

কৃষ্ণদয়াল। না, ওকে একেবারে বঞ্চিত করব না, জায়গিরটা ওকে দিয়ে দেব – কালে তার মুনাফা বছরে হাজার টাকা হতে পারবে। এখন ভাবনা হচ্ছে ওর [গোরা] বিবাহ দেওয়া নিয়ে। পূর্বে যা করেছি তা করেছি – কিন্তু এখন তো হিন্দুমতে ব্রাহ্মণের ঘরে ওর বিয়ে দিতে পারব না – তা এতে তুমি তাই কর আর যাই কর।

আনন্দময়ী। হায় হায়, তুমি মনে কর তোমার মতো পৃথিবীময় গঙ্গাজল আর গোবর ছিটিয়ে বেড়াই নে বলে আমার ধর্মজ্ঞান নেই। ব্রাহ্মণের ঘরে ওর বিয়েই বা দেব কেন, আর রাগ করবই বা কী জন্যে?

লক্ষণীয় যে, কৃষ্ণদয়ালের ভাষার শব্দচয়ন ও বাক্য-গঠনে এক ধরনের নির্মেদ, প্রত্যক্ষতা ও স্পষ্টতা আছে। এ হলো আধুনিক ভাষা-সংগঠনের পূর্বশর্ত। কিন্তু আনন্দময়ী যখন ব্যবহার করেন ‘হায় হায়’, ‘পৃথিবীময়’, ‘বেড়াই নে’ তখন বুঝতে হবে যে ভাষার এই সংগঠন কিছুটা পুরনো ধাঁচের।

 

ভাষা-ব্যবহারে নারীদের মধ্যে শুচিতাবোধ প্রখর

পুরুষরা যেভাবে অবলীলায় অকথ্য শব্দ (slang), অশস্নীল শব্দ কিংবা অমঙ্গলজনক শব্দ ব্যবহার করে থাকে, নারীরা তা করে না। এ ক্ষেত্রে তারা খুবই সংবেদনশীল। বিশেষ করে অন্তরঙ্গ বন্ধুমহল ছাড়া লোকসাধারণের মধ্যে তারা এ-ধরনের শব্দের ব্যবহার করে না বললেই চলে। সুভাষিত শব্দের ঐতিহ্য নারীদের অবদান বললে ভুল বলা হবে না। ‘ঘরে চাল নেই’ বলা শোভন নয় বলে একসময় নারীরা বলতেন ‘ঘরে চাল বাড়ন্ত’, বিদায়ের সময় ‘যাই’ না-বলে ‘আসি’ বলার ক্ষেত্রেও নারীদের কল্যাণকামনার ভাবনা জড়িত।

বিরল কিছু অপশব্দ ছাড়া নারীরা অপশব্দ ব্যবহার করে না। অশস্নীলভাবে হাসা অর্থে ‘কেলানো’, প্রহার করা অর্থে ‘প্যাদানো’, চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতে ‘ফোটো’, অলস সময় পার করা অর্থে ‘গ্যাঁজানো’, নকল করা অর্থে ‘টুকলিফাই’, দুষ্টপ্রকৃতির অর্থে ‘লাফাঙ্গা’, বাড়াবাড়ি অর্থে ‘তাফালিং’, অবাক হওয়া অর্থে ‘টাসকি খাওয়া’, অকারণ প্রশংসা করা অর্থে ‘পট্টি মারা’, আড্ডা দেওয়া অর্থে ‘টাংকি মারা’, দারুণ অর্থে ‘ফাটাফাটি’/ ‘জোস’/ ‘হ্যাবিব’/ ‘জটিল’, অসত্য বলা অর্থে ‘গুল মারা’/ ‘ফাঁপর মারা’ ইতাদি শব্দ ছেলেদের মধ্যে বিপুলভাবে প্রচলিত। এ-ধরনের অভব্য শব্দ মেয়েরা সাধারণত ব্যবহার করে না। তবে অযথা অর্থে ‘আজাইরা’, পা–ত্য প্রদর্শন অর্থে ‘কেরদানি’, ইত্যাদি দু-একটি অপশব্দ মেয়েদের মধ্যে ব্যবহার করতে শোনা যায়। অবশ্য অশিক্ষেত, হতদরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির মহিলাদের মধ্যে অকথ্য ভাষা ও অপশব্দ প্রচুর পরিমাণে ব্যবহারের পরিচয় পাওয়া যায়।

অপরাধজগতের ভাষা, সহিংসতার ভাষা, যৌনতা ও অশস্নীলতার ভাষা নারীর ভাষিক জগতে চিরকালই অপাঙ্ক্তেয়। সহজাত লজ্জাশীলতা, মানবিকতা ও শামিন্তপ্রিয় বলে নারীদের মধ্যে পরিশীলিত ও প্রমিত
ভাষা-ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। এসব বিবেচনায় নারীদের আলাদা ভাষিক শ্রেণির (speech community) সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন অনেক ভাষাবিজ্ঞানী। বাংলা ভাষায় নারীদের এই ভাষিক জগৎ নিয়ে আজ অবধি তেমন কোনো গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই। তবে এ-ক্ষেত্রটির স্বরূপ উন্মোচন করা গেলে নারীর মনোজগৎ ও সাংস্কৃতিক পরিম-ল গভীরভাবে জানা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।