১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলে মুক্তির দাবিতে অনশন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জেল থেকে মুক্তিলাভের ঠিক পাঁচ দিন পর জীর্ণ-শীর্ণ অসুস্থ বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে তাঁর নিজ বাড়িতে পৌঁছলেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন ফজিলাতুন্নেছা। দীর্ঘ অপেক্ষা আর অভিমানের আতিশয্যে বললেন, ‘কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারো কথাও মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কী করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের কী অবস্থা হতো? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হতো না! মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কীভাবে করতা?’ আবেগে পরিপূর্ণ পরিণত অথচ কী পরিণত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ! আবেগ, ভালোবাসা ও প্রবল কর্তব্যবোধের সংমিশ্রণে গড়া ফজিলাতুন্নেছা ঘটনা-পরিক্রমায় এভাবেই বারবার চিত্রিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চোখে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে।
ফজিলাতুন্নেছার ডাকনাম রেণু। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রেণু নামেই ডাকতেন। মাত্র তিন বছর বয়সে বৈবাহিক সম্পর্কের পথ ধরে যে-শিশুটি বঙ্গবন্ধুর জীবনে সঙ্গী হয়ে এসেছিলেন, সেই শিশুটিই সময়ের পরিক্রমায় একসময় পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে; যে-কেন্দ্রবিন্দুতে ভর করে বঙ্গবন্ধু জয় করেছিলেন এক পৃথিবী মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে বসিয়েছিলেন শ্রদ্ধা আর সম্মানের আসনে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে চেনার ও তাঁর চোখে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে জানার অসামান্য এক দলিল অসমাপ্ত আত্মজীবনী লেখার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা। জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর জন্য তাঁর রেখে যাওয়া খাতার পাতায় ভর করে রচিত হয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় পাঠক দেখেছে শিশু ‘রেণু’র পরিণত হয়ে ওঠাকে। যে-রেণু মাত্র তিন বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে পাঠক তাঁকে চিনেছে আত্মবিশ্বাসী ও পরিণত এক নারী হিসেবে; যিনি তৎকালীন সময় এবং সমাজের সীমানার মাঝে দাঁড়িয়ে দেখেছেন অসীম ভবিষ্যৎ, নিয়েছেন দূরদর্শী ও সাহসী নানা সিদ্ধান্ত। আত্মপ্রত্যয়ী ও অনুভূতিশীল রেণুর এই ব্যক্তিত্বকে শেখ মুজিব পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গা থেকে। এর মধ্যে নেই কোনো বাহুল্য কিংবা মেকি আয়োজন। এই শ্রদ্ধাবোধ যদি বঙ্গবন্ধুর অন্তরলালিত না হতো, তবে কখনোই তা এমন নিখুঁতভাবে চিত্রিত হতো না।
নারীর প্রতি, নারীর সক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই শ্রদ্ধাবোধ যে শুধু ফজিলাতুন্নেছার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। বরং এই গ্রন্থের প্রতিটি নারী চরিত্র বর্ণনায় নারীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গাটুকু অটুট ছিল। এই গ্রন্থে যে খুব বেশি নারী চরিত্রের দেখা পাঠক পেয়েছে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু যে-কয়টি নারীচরিত্রের সঙ্গে পাঠক পরিচিত হয়েছে তাঁদের প্রত্যেককে তিনি এঁকেছেন গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গা থেকে। তাঁদের প্রতি সামান্যতম অবজ্ঞা কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কোথাও নজরে পড়েনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনাদর্শে নারী-পুরুষ সমতার সত্যকে ধারণ ও লালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনকে পাঠক পেয়েছে নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল আত্মবিশ্বাসী এক নারী হিসেবে। তিনি গ্রামের বাড়িতে তাঁর বাবার সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা যখন কাজের প্রয়োজনে শহরে আসেন, তখন তিনি শহরে বাস কতে রাজি হননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় তাঁর মা সায়েরা খাতুনকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।’
বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথপরিক্রমায় গুরুত্বপূর্ণ নানা ভূমিকায় দেখা গেছে নারীকে। তাঁদের অবদানে বারবার আন্দোলন গতি পেয়েছে। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়, সেখানে অংশগ্রহণকারী একমাত্র ছাত্রী নাদেরা বেগমের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান সমর্থক ছাত্রদের দ্বারা নাদেরা বেগমকে হয়রানি করার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। নারী নির্যাতনকে সবসময়ই ঘৃণার চোখে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, করেছেন এর প্রতিবাদ। বিহারে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় নারী নির্যাতন সম্পর্কে মাহাত্মা গান্ধীকে ধারণা দিতে ফটোগ্রাফের যে-প্যাকেটটি তিনি তৈরি করেছিলেন, তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল নারী নির্যাতনের ছবি।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে নারীরা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলমানদের সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের সাত জন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে সাত জনই জয়ী হন। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই এই সাত জন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, কারণ বঙ্গবন্ধু চাইতেন রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। বদরুন্নেসা আহমদ, আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মমতাজ বেগমসহ অনেক নারী নেত্রীর বিকশিত হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ছায়াতেই এই নারীরা রাজনীতির মাঠে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা ও ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে জেল খেটেছেন বদরুন্নেসা আহমদ। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়ার আগে আমেনা বেগমকে দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মনোনীত করেছিলেন। বেগম সাজেদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘গোবরা নার্সিং ক্যাম্প’-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু নারীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এনে প্রমাণ করেছিলেন, রাজনীতির মাঠেও যোগ্য হতে পারেন নারীরা, যদি তাঁদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়। সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্ব কিংবা আত্মবিশ^াস কোনোটিতেই নারীদের পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। যে-নেতারা রাজনীতির মাঠে নারীর উপস্থিতি দেখে শঙ্কিত ছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার। নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার রয়েছে এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও।’
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষের অবস্থানকে কখনোই তিনি আলাদা করে দেখেননি। বঙ্গবন্ধুর জীবনসংগ্রামের গল্পে কোথাও নারী ও পুরুষের ভিন্ন অবস্থান চোখে পড়ে না। তিনি জানতেন, নারী-পুরুষের সমতা, সম সুযোগ, সমমর্যাদাবোধ ও উন্নয়ন একটি দেশের তথা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই যেহেতু নারী, তাই তাদের উন্নয়ন ছাড়া যে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। তাই তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর পথচলা শুরুই করেছিলেন যুদ্ধের হিংস্রতার শিকার নারীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রায় দুই লাখ নারীকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর কোনো দেশেই যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের এ ধরনের উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। সেই সময় ও বাস্তবতায় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কী অবলীলায় তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কী!’ ধর্ষণ যে যুদ্ধজয়ের একটি ঘৃণ্য কৌশল এবং এই কৌশলে যে নারীর কোনো অপরাধ নেই – এই বিষয়টি তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘নষ্ট নারী’ আখ্যা দেওয়া সমাজে বেড়ে ওঠা একজন বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেওয়ার বিষয়টি ছিল অভাবনীয় ও অকল্পনীয়। ‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ বীর নারী। এই একটি খেতাবের মাধ্যমে তিনি এসব নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের দায় থেকে তাঁদের মুক্তি দেন, তাঁদের ত্যাগকে স্বাধীনতার জন্য অনন্য এক অবদান বলে মর্যাদা দেন, তাঁদের সকল শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে সম্মান জানান এবং তাঁদের অপরাধবোধের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের যখন তাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নিতে চায়নি, তখন তাঁদের সম্মান জানিয়ে দরদমাখা কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘ধর্ষিত মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও আর ঠিকানা লেখো ধানমন্ডি ৩২। মুক্তিযুদ্ধে তোমরা যা দিয়েছ, তার ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?’ শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, ফজিলাতুন্নেসাও এই নারীদের প্রতি বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। তাঁর প্রচেষ্টায় ১০ জন বীরাঙ্গনা নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করা হয়।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নারীমুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধান। ১৯৭২-এর সংবিধানের বিভিন্ন ধারা রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়; যেখানে সন্নিবেশিত হয় নারীবিষয়ক বিভিন্ন ধারা ও উপধারা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ১৯৭৩-১৯৭৮-এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। তাঁর সময়েই সংবিধানের আলোকে নারীর ক্ষমতায়নে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে নারীর জন্য ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে যে নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে অংশ নেন নারীরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। এরপর পেরিয়ে গেছে ৪৭টি বছর। নারী ও পুরুষের সমতাপূর্ণ যে বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করেছিলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও সে-যাত্রায় কতখানি এগোতে পেরেছি আমরা! বলার অপেক্ষা রাখে না, গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের ভূমিকায় নারীর নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নেরই সফল বাস্তবায়ন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, বিগত তিন দশকে নারী নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীদের কী আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না? ১৯৭৩ সালে গঠিত মন্ত্রিসভায় দুজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় মাত্র পাঁচজন নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়। জাতীয় সংসদে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের সংখ্যা মাত্র ২২ জন। দুর্ভাগ্য জাতীয় সংসদে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আজো নারীর আসন সংরক্ষণ করতে হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে বঙ্গবন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই পথটি খুব বেশি প্রসারিত হতে দেখা যায় না। রাজনীতিতে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নীতিমালা প্রণয়ন বা দলগুলির মধ্যে তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশের বেশি নারীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে মাত্র সাত শতাংশ নারী আছেন। আবার যেসব পেশায় বিপুলসংখ্যক নারী অংশ নিচ্ছেন তারাই বা কেমন আছেন? পোশাক শিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৬ লাখই নারী। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যে নারীদের হাতে গতিশীল হয়েছে, পোশাকশিল্পের সেই নারী শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
দেশে আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা। ঘরের মধ্যেই নারী সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। প্রতিদিন পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী নির্যাতনের নতুন ধরন ও মাত্রা। সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ নারী তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতনের মধ্যে আছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন। ২০২২ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। বাল্যবিয়ের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম; যেখানে প্রায় ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। এদেশে ৯৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে এবং ৮২ শতাংশ নারী জনসমাগমস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়। ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৫৩ শতাংশই এদেশে সাইবার অপরাধের শিকার হয়। অথচ এত নারী নির্যাতনের ঘটনার বিপরীতে দেখা যায় সহিংসতার শিকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পর্যায়ে যায় না বা গেলেও তথ্য-প্রমাণের অভাবে বাতিল হয়ে যায়। মাত্র তিন শতাংশ ভুক্তভোগী নারী নিজেদের পক্ষে বিচার পান। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বাধা এবং হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব, ঘরে এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব এবং মামলার ধীরগতির কারণে ভুক্তভোগীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে চায় না। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার পরও কিছুমাত্র কমেনি এর ব্যাপকতা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২০ সালে মোট এক হাজার ৬২৭ জন নারী ও এক হাজার ১৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ তো কোনো যুদ্ধাবস্থায় নেই। তাহলে স¦াধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে হাজারো নারী প্রতিবছর কেন এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হবে? ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের যে-কোনো ঘটনায় এখনো নারীদের দিকেই আঙুল তোলা হয়, নারীকেই বারবার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। নির্যাতনের শিকার নারীকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে কোথাও খুঁজে পাই না বঙ্গবন্ধুর সেই উদার দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর পোশাক-চলাফেরা-কথাবার্তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যেন ফুরাতেই চায় না।
আশার কথা, এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘বৈশ্বিক লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রতিবেদন’ অনুযায়ী ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম, যা ২০২১ সালে ছিল ৫০তম। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ, শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতি ইত্যাদির কথা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হলেও দেশে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র এই ধরনের প্রশংসনীয় অর্জনকে অনেকটাই মøান করে দিচ্ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে হলে নারীর শিক্ষিত ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই। যদিও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, তবু ঊর্ধ্বতন পদগুলি এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। কাজের জন্য নারীদের নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। এদেশের মোট কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া কাজ করেন। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে এখনো হাজারো বাধা। এমনকি উপার্জিত অর্থের ওপরও নিয়ন্ত্রণ নেই অনেক নারীর। নারী-পুরুষের সমান সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অধিকার থাকার পরও এদেশে মাত্র চার শতাংশ নারীর ভূসম্পত্তির ওপর মালিকানা আছে। অথচ নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে যদি সামগ্রিকভাবে আমরা চিন্তা করি, তবে সেই চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করার অন্যতম বড় হাতিয়ার হলো দেশের জনগণ। অর্থাৎ দেশের জনগণকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই রচিত হতে পারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, আর এজন্য চাই দক্ষ জনশক্তি। দেশের অর্ধেক জনগণ যেহেতু নারী, তাই নারীর সমান অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর সেই অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নারীর জন্য শঙ্কামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নারী নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে, যেখানে একজন নারীও ধর্ষণের শিকার হবে না, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হবে না, গণপরিবহনে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে কোনো নোংরা হাত নারীর শরীর ছুঁয়ে যাবে না, ডিজিটাল প্লাটফর্মে নারী হয়রানির শিকার হবে না, কোনো কন্যাশিশু হবে না বাল্যবিয়ের শিকার। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই যে দেশে আইন শুধু বাক্সবন্দি হয়ে নারীকে নিরাপত্তার গল্প শোনাবে না; বরং আইনের কঠোর প্রয়োগই হবে নারীর রক্ষাকবচ। নারী শিক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কর্মদক্ষতায় এগিয়ে যাবে দৃপ্ত পদক্ষেপে, পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কোনো ধর্মান্ধতা কিংবা কুসংস্কার নারীর গতি কিংবা কণ্ঠ রোধ করবে না, নারীর মেধা এবং যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে নারীকে বাধাগ্রস্ত করবে না। নারী হাসবে, খেলবে, সাজবে, গাইবে, কথা বলবে এবং স্বাধীন মানুষ হিসেবে তার পূর্ণ অধিকারটুকু নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোগ করবে। বঙ্গবন্ধু যে দৃষ্টিতে নারীকে দেখেছেন, সেই শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে নারী অঙ্কিত হোক আগামী প্রজন্মের কাছে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষায় যে সাহসী উদ্যোগগুলি নিয়েছিলেন, আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও তার আংশিক বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়ার বাস্তবতাটি বড় কষ্টের। তবু আশায় বুক বাঁধি আমরা। যা কিছু ভালো হয়েছে তাকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাই আমরা। নারীর অগ্রযাত্রা সমন্বিত হোক, গতিশীল হোক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় নারীর পথচলা হোক আলোকিত ও পুষ্পিত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.