অ্যান্ড দেন ওয়ান ডেঃ বৈঠকি চালে অভিনেতার অন্দরমহলের চাবিকাঠি

ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষীয়ান অভিনেতাদের মধ্যে অমিতাভ বচ্চন যে সবচেয়ে ডাকসাইটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারে না কাটলেও এহেন অমিতাভকে যিনি ধারে কাটার হিম্মত রাখেন, তিনি নাসিরউদ্দিন শাহ। না, একসঙ্গে কোনোদিন রুপোলি পর্দায় দেখা যায়নি তাঁদের। তবু কতক নিপাতনে সিদ্ধর মতো নাসিরউদ্দিনের মাথায় নটসম্রাটের তাজ পরিয়েছে সমঝদার মহল। অমিতাভের মতোই নয় নয় করে পাঁচ দশক ধরে অজস্র স্মরণীয় চরিত্র-চিত্রণ করেছেন তিনি। জনগণমন অধিনায়ক না হলেও ক্রিটিকস চয়েস হিসেবে তাঁর জায়গাটা পাকাপোক্ত। তাছাড়া সিনেমা আর থিয়েটার এই দুই ময়দানেই একই সঙ্গে ছড়ি ঘুরিয়ে অমিতাভকে টেক্কা দিয়েছেন তিনি। টেলিভিশনেও মুখ দেখিয়েছেন। কোনো এলিতেলির রোলে নয়, খোদ মির্জা গালিবের কিরদারে!

এহেন নাসিরউদ্দিন শাহ যখন নিজের মুখে নিজের কথা বলতে বসেন, তখন নড়েচড়ে বসতে হয় বইকি! আর সেই বই যখন খানদানি বুকশপ থেকে পাটোয়ারি ওয়েবসাইটের বেস্টসেলার লিস্টের মাথায় চড়ে তখন কৌতূহলে ফেটে পড়াটাই স্বাভাবিক। নটবর নাসিরউদ্দিন তাঁর এই আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে। ভারিক্কি চালের বালাই নেই। সোজাসাপটা মজলিসি মৌতাত। এতেই বইয়ের জাত চেনা যাচ্ছে।

প্রাককথনে নাসিরউদ্দিন জানিয়েছেন যে, এই আত্মজীবনী তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন আজ থেকে বছরপনেরো আগে। ২০০২ সালে। শন কনারির সঙ্গে হলিউডের ছবির শুটিং করতে ঝাড়া ছ-মাসের জন্য আউটডোরে গিয়ে এত বোর হচ্ছিলেন যে, হুট করে একটা ল্যাপটপ কিনে এনে একজনকে ধরে বেঁধে মোটামুটি কাজ চালানোর মতো বিদ্যে হাসিল করে ‘আই ওয়াজ বর্ন ইন…’ টাইপ করা ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। তারপর গদাইলস্করি চালে দশ-বারো বছর ধরে রয়েসয়ে এ-লেখা চলেছে। কে পড়বে কে পড়বে না ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মনের আনন্দে শৈশব-কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিরোমন্থন করেছিলেন নাসিরউদ্দিন। বাকিটা সামলে নিয়েছে কুলীন প্রকাশক পেঙ্গুইন বুকসের ঘরের ছেলে হ্যামিশ হ্যামিলটন। ছাপাখানা থেকে বেরোনোর পর মুড়ি-মুড়কির মতো বিকিয়েছে অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে। আজো বিকোচ্ছে। সত্যি বলতে কী এই উপমহাদেশের আর কোনো অভিনেতার আত্মজীবনী এমন পাঠকসমাদর পায়নি।

এমন সমাদরের হেতু?

অনেক।

প্রথমত, রচনার প্রসাদগুণ। নাসিরউদ্দিনের লেখার মধ্যে একটা মজলিসি মেজাজ আছে। ভাবটা এমন যে, পাঠক সামনে বসে আছেন আর নাসিরউদ্দিন পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে বালিশটা কোলে চেপে জম্পেশ করে তাঁর যাপিতজীবনের কথা ও কাহিনি শোনাচ্ছেন। সেই কথা ও কাহিনির বিষয়বস্ত্ত এতই আকর্ষণীয় আর ভঙ্গি এতই অনর্গল যে, একবার পড়তে শুরু করলে বই নামিয়ে রাখা দায়! কারণ খালি নিজের কথা নয়। চারপাশে আলগা হয়ে উটকো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হরেকরকম লোক, তাদের সবাইকে জড়িয়ে থাকা দেশ কাল সমাজ সংস্কৃতির একটা তরতাজা তসবির ফুটে উঠেছে এই বইয়ে। এমন দরাজ হাত, এমন দিলখোলা জবান, এমন দিলচস্তআন্দাজ এক জায়গায় এলে যা হয় তাই হয়েছে। অতীব সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে। ৩১৬ পাতার বই।

কাগজ বা বাঁধাই কোনোটাই তেমন পদের নয়। সম্পাদনাও অথৈবচ। কিন্তু নাসিরউদ্দিনের ইংরেজি এতই আটপৌরে যে, মুখের ভাষা হামেশাই লেখার ভাষার ওড়না সরিয়ে ভেতরটাকে দেখে নিচ্ছে।

বইয়ের শুরু থেকেই এই আড়াল সরানোর খেল চালু করেছেন নাসিরউদ্দিন। এই সমালোচকের বাংলা তরজমায় তা এরকম-

‘আমি জন্মেছিলাম লখনউয়ের কাছে বরাবাঁকি নামে একটা ছোট শহরে ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে বা ১৯৫০ সালের অগাস্টে। ঠিক কবে যে জন্মেছিলাম সেটা আমার আম্মি ফারুক সুলতানও কোনোদিন হলফ করে বলতে পারেনি। ‘তুম রমজান মে পয়দা হুয়ে থে’ শুনে সেটা বের করা দায়। তাছাড়া সে আমলে গুটিবসমেত্মর মড়ক লেগেই থাকত। টাইফয়েড কম খতরনাক ছিল না। ম্যালেরিয়া, কলেরা তো ছিল রোজকার ব্যাপার। কটা ছেলেপুলেই বা মায়ের কোল ছেড়ে নামতে পারত। হামেশাই রোগে ভুগে বা ফাইন্যাল এগজামে ফেল করে দুয়েক বছর নষ্ট হত। কতক অবধারিতভাবেই বাচ্চাদের জন্মের তারিখ পালটে যেত। ইশকুলে নাম লেখানোর সময় দুয়েক বছর আগুপিছু করাটাই ছিল দস্ত্তর। এর জন্যেই নাকি স্রেফ ভুলে গেছিলেন বলে আমার বাবা আলে মহম্মদ শাহ আমার জন্মসাল ১৯৫০ লিখিয়েছিলেন সে কথা দিব্যি কেটে বলতে পারি না। তাছাড়া ২০ জুলাই বদলে কেন যে ১৬ অগাস্ট করা হল সেটাও হেঁয়ালি রয়ে গেছে।’

লুকোছাপা দূর অস্ত, এই আত্মজীবনী এই রকম চাঁছাছোলা। আগাগোড়া।

দ্বিতীয়ত, আটপৌরে এই গদ্যের গায়ে আদি ও অকৃত্রিম ব্রিটিশ হিউমারের গয়না পরিয়েছেন নাসিরউদ্দিন। রসেবশে থেকেছেন। নিজেকে নিয়ে এমত্মার হাটিঠাট্টা করে গেছেন। নিজেকে মগডালে চড়াতে গিয়ে খামোকা কাউকে টেনে নিচে নামিয়ে এনে আশ মিটিয়ে মনের জ্বালা মেটানোর দুরভিসন্ধি তাঁর নেই।

এমন অনেক কথা আছে এই আত্মজীবনীতে, যা ব্যক্তি নাসিরউদ্দিনের একান্ত নিজস্ব বলেই গণ্য হতে পারে। বাবা আলে মহম্মদ শাহর সঙ্গে তাঁর ভাঙাচোরা সম্পর্ক কোনোদিন জোড়েনি। কী করেই বা জুড়বে? রাশভারী পিতার কোনো সাধই বেপরোয়া পুত্র পূর্ণ করেননি। তাই বলে সাহেবিয়ানায় আদ্যন্ত ডুবে থাকা এই সিভিল সার্ভেন্টের কোনো দানবিক প্রতিকৃতি আঁকেননি নাসিরউদ্দিন। পিতাপুত্রের সম্পর্কের গভীর ক্ষতস্থান খুলে পাওয়া-না-পাওয়ার খতিয়ান দেওয়ার পাশাপাশি নৈনিতালের বোর্ডিং ইশকুলের বেশিরভাগ সময়টাই তিনি যে হাঁদা গঙ্গারাম গোছের এক জীব ছিলেন, দুই চৌকস দাদার কেরামতি যে তাকে আরো কোণঠাসা করেছিল সে-কথা অমস্নানবদনে জাহির করেছেন। আজকাল মোটালি থিয়েটার গ্রম্নপ নিয়ে মুম্বাই তো বটেই, থেকে থেকে দিলিস্ন, কলকাতা এমনকি ঢাকাতেও আনাগোনা হয় নাসিরউদ্দিনের ইসমাত আপা কে নামে পুরো শাহ খানদানকেই মঞ্চে দেখা যায়। সেই দলে স্ত্রী রত্না পাঠক শাহ আর দুই জোয়ান ছেলের পাশাপাশি হিনা শাহকে দেখে কেউ ভাবেন মহিলা নাসিরউদ্দিনের ছোট বোন, কেউ ভাবেন ভাইজি। হিনা তাঁর মেয়ে শুনলে অনেকের চোখ কপালে ওঠে। অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে পড়লে উঠবে না।

কারণ আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে মেজর নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার সময় অসমবয়সী পারভীন-মোরাদের প্রেমে পড়েছিলেন উনিশ বছরের নাসিরউদ্দিন। পারভীন আদতে পাক নাগরিক। বাবা পাকিস্তানি, মা ভারতীয় এবং তারা বিবাহবিচ্ছিন্ন। এই প্রেম এসেছিল সশব্দচরণে। ডাক্তারির ছাত্রী হলেও শিল্পসাহিত্যে পারভীনের প্রগাঢ় অনুরাগ এই রসায়নে গতিসঞ্চার করেছিল। ইংরেজির প্রফেসর জাহিদা জাইদির নির্দেশনায় ডিপার্টমেন্টাল থিয়েটারে একটার পর একটা নাটকের রিহার্সাল দিতে দিতে, কেনেডি অডিটরিয়ামে শো করতে করতে প্রেম আরো নিবিড় হয়েছিল। নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘এতদিনে এমন একজনকে পেলাম আমাকে ছাড়া যার একটুও চলে না। এমন একজন যাকে আমি নিজের বলতে পারি, যে আমাকে নিজের বলতে পারে।’ এই উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। এরপরই নাসিরউদ্দিন বলছেন, ‘কিন্তু ওকে আনন্দ দেবার, আনন্দে রাখার ক্ষমতা আমার আছে কিনা সেটা একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি। আসবে কী করে, আমার বয়স তখন উনিশ, ঐ বয়সে নিজেরটা ছাড়া আর কারোর আনন্দের কথা ভাবার ফুরসত আমার ছিল না।’ এমন অকপট স্বীকারোক্তি সবাই করতে পারেন না।

মেঘে মেঘে বেলা হলো। ১৯৬৯ শেষ হয়ে আসছে। পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে টানাপড়েনের জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সুর চড়ছে। দেখতে দেখতে ভারতে পড়তে আসা পাকিস্তানিদের ওপর কড়া নজরদারি শুরু হলো। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ফুরিয়ে এলো পারভীনের ভারতে থাকার মেয়াদ। পরিস্থিতি এতই ঘোরালো হলো যে, ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য পারভীন দিলিস্নতে দরবার করলেও মঞ্জুর হওয়ার উপায় ছিল না। ভারতে থাকার একমাত্র উপায় কোনো ভারতীয় নাগরিককে নিকে করা। তাই হলো। মাশুকাকে কাছে রাখতে নাসিরউদ্দিন এতই মাধোশ ছিলেন যে, আববা-আম্মিকে জানানোর ন্যূনতম সৌজন্যকে গুলি মেরে এক কথায় কাবিননামায় সই করে দিলেন। আলিগড়ে এই ঝড়ো শাদির খবর অচিরেই পৌঁছে গেল মিরাট ছুঁয়ে মিসৌরিতে। এসব ব্যাপারস্যাপার দেখে আববা-আম্মি কতটা হকচকিয়ে গেলেন, কী অনাড়ম্বরভাবে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে নিশুতি রাতে নববধূ পতিগৃহে গেলেন ও ফিরে এলেন এবং কী নিস্পৃহভাবে পারভীন অমত্মঃসত্ত্বা হলেন ও আসন্ন পিতৃত্বের সংবাদে নাসিরউদ্দিন কতখানি উদাসীন রইলেন – এসবই দিলখোলা আন্দাজে বয়ান হয়েছে আত্মজীবনীতে। বিবির গর্ভাবস্থায় মিঞা যে দিলিস্নতে পাড়ি দিলেন, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় ভর্তি হয়ে আলিগড়কে বেমালুম ভুলে গেলেন, নতুন শহরে এসেই নতুন মাশুকাতে মশগুল হলেন তাও হাত খুলে লিখেছেন নাসিরউদ্দিন। নবদম্পতির সমত্মান হিবা জন্মানোর পরও যে পিতার কোনো হেলদোল হন না, বরং পারভিন মোরাদের জন্য নাসিরউদ্দিনের মনে যে প্রেম ছিল তা আরো বড়সড় আকার নিয়ে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার অধ্যক্ষ ইব্রাহিম আলকাজির পদতলে নিবেদিত হলো – তাও খোলসা করা হয়েছে। বইয়ের ১২৭ পাতায় নাসিরউদ্দিন লিখছেন যে, এই কথাগুলো পড়ার পর তাঁর সম্পর্কে পাঠকের মনোভাব কতখানি বদলে যাবে তিনি জানেন না। কিন্তু এতদিন বাদে এই কথাগুলো কবুল করা তাঁর দরকারি মনে হচ্ছে।

আত্মজীবনী যে একাধারে আত্মক-ূয়ন ও আত্মোন্মোচন অ্যান্ড দেন ওয়ান ডের পাতায় পাতায় এভাবেই তার প্রমাণ দাখিল হয়েছে। হামেশাই না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে শস্নীল-অশস্নীলের বিপজ্জনক আলপথে হেলেদুলে এমন চলতে শুরু করে অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে যে পড়তে পড়তে শিউরে ওঠেন পাঠক। কজন পুরুষপুঙ্গব পারবেন পনেরো বছর বয়সে আজমির থেকে সাইকেলে কিষেনগড় গিয়ে দু-টাকার বিনিময়ে যাযাবর নটনিদের তাঁবুতে ঢুকে ‘বড় হয়ে ওঠার’ বৃত্তান্ত শোনাতে? নিষিদ্ধ মাদক সেবনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে পাতার পর পাতা ভরাতে? গালিবের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নিজের সম্পর্কে ভূরি ভূরি মিথ্যে সাজিয়ে গুলজারকে চিঠি লেখার কথা কবুল করতে? কিংবা ‘আর’ আদ্যাক্ষরের আড়ালে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার এক প্রাক্তনীর সঙ্গে তাঁর উথালপাথাল প্রেমের গল্প শোনাতে? এমন রোমহর্ষক গদ্য কোনো বকলমা নেওয়া কলমচির হাত থেকে বেরোবে না বলেই নাসিরউদ্দিনের আগের প্রজন্মের সব ভারতীয় অভিনেতার আত্মজীবনী আদতে আমসি-অম্বলের চুষিকাঠি, আর অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে রয়েসয়ে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো কেতাব।

পাঠকের মনোজগতে এই রচনার পটভূমি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টার কসুর করেননি নাসিরউদ্দিন। যেভাবে তিল তিল করে অভিনয়ে একেকটা চরিত্রকে তিলোত্তমা করে তোলেন, সেভাবেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পারিবারিক ইতিহাসের গুহাকন্দরে ঢুকতে দিয়েছেন আমাদের। আমরা জেনেছি তাঁর দেহে আফগান রক্ত বইছে। তাঁর বাবার ঠাকুরদাদা ছিলেন মিরাটের কাছে সারদানা নামের এক মহলস্নার নবাব বাহাদুর শাহ। তাঁর মায়ের পরিবারের সঙ্গে লতায়-পাতায় জুড়ে ছিল বাবার পরিবার। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির দৌলতে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে উত্তর ভারতের রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে যে খোলা হাওয়া বইছিল দুই পরিবারই তাতে ভাসতে পেরেছিল। কাবুলের মসনদ টলে উঠলে আফগান সুলতান আমানুলস্নাহ যেই লন্ডনে ঘর পাতলেন, নাসিরউদ্দিনের বাবা তাঁর মেয়ের ইংলিশ টিউটর হয়ে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এতে করে তাঁর সাহেবিয়ানা আর বাইরে না থেকে ভেতরেও মৌরশি পাট্টা গেড়েছিল। পশতু আর ফারসি জবান তাঁকে ছেড়ে গেল না ঠিকই, কিন্তু ‘আংরেজি’ আন্দাজ তাঁর ধ্যানজ্ঞানপ্রেম হয়ে রইল।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আর দেশভাগ যেই হাত ধরাধরি করে এলো, বাবার দুই ভাই এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। মায়ের আত্মীয়দের কেউ চলে গেলেন, কেউ রয়ে গেলেন। তাঁর বাবা যে সদ্যস্বাধীন ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এ থেকে গেলেন তার দুটো কারণ দর্শেছেন নাসিরউদ্দিন। এক, নিজের নামে কোনো জমিজমা না থাকায় ওপারে গিয়ে থাকা-খাওয়ার সুবিধা তাঁর হতো না। দুই, মাঝবয়সে পৌঁছে প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস অফিসারের চাকরির নিরাপত্তা ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না। বদলির চাকরি বলে ছেলেবেলার অনেকটাই হুড়ুমতালে কেটেছে নাসিরউদ্দিনদের। এরই ফাঁকে একবার কার একটা কোলে বসে নৌটঙ্কি কিংবা রামলীলা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা খোলা মাঠে নাকি তাঁবু খাটিয়ে হয়েছিল মনে নেই কিন্তু এটাই যে তাঁর আদি শৈশবস্মৃতি সে-কথা বুক ঠুকে জানান দিয়েছেন নাসিরউদ্দিন।

লখনউ থেকে বেরেলি হয়ে হলদোয়ানি ছুঁয়ে নৈনিতালে থিতু হওয়ার পর তিন ছেলে জাহির, জমির আর নাসিরকে পাক্কা সাহেব বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁর বাবা। এই সুবাদে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে নৈনিতালের দুটো নামী বোর্ডিং স্কুলের অন্দরমহলে অনেক সময় আমাদের কাটাতে দিয়েছেন নাসিরইদ্দিন। খ্রিষ্টান মিশনারি ঘরানার যে স্কুলিং তখন আগমার্কা আইরিশদের হাতে ছিল তার কিয়দংশ এখনো বর্ণসংকরদের বদান্যতায় টিকে আছে। সেন্ট জোসেফস কলেজ বা সেন্ট আনসেলেমের মতো এসব খানদানি ইশকুলে সাহেবিয়ানার যে হদ্দমুদ্দ হতো, হিন্দি ক্লাসেও যে প্রাণ খুলে হিন্দি বলা যেত না সে-কথা ফলাও করে লিখেছেন নাসিরউদ্দিন।

আমাদের ছুঁয়ে গেছে এরই মধ্যে অভিনেতা হওয়ার আকাঙক্ষা কীভাবে তাঁর ভেতরে ঢুকে গেল তার নিঃসংকোচ ধারাবিবরণী। সেন্ট জোসেফসে ফি হপ্তায় একটা কি দুটো করে ইংরেজি ছবি দেখানোর চল ছিল। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই ওয়াল্ট ডিজনি, চার্লি চ্যাপলিন থেকে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ইলিয়া কাজান দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছিলেন নাসিরউদ্দিন। ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি দেখে তো তাঁর ভূতগ্রস্তদশা হয়েছি। যখন দেখতেন তখন বুঁদ হয়ে থাকতেন। যখন দেখতেন না তখন কোনো না কোনো ফিল্মের মধ্যে ঢুকে পড়ে কল্পনার পাখা মেলে দিতেন। তার ওপর চুটিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। লুকিয়ে-চুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতেন। গরমের ছুটিতে আজমিরের বাবা-মায়ের কাছে গিয়েও সিনেমার পোকা মাথা থেকে বেরোত না। এক রবিবারের সকালে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে নিউ ম্যাজেস্টিকে টু উইমেন দেখতে গিয়ে টিকিট কাউন্টারে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসার গপ্পোও বলেছেন। এসব সামলে-সুমলে পড়াশোনোর যে বিশেষ সুবিধে হয়নি তা বলাই বাহুল্য! তার ওপর ক্লাস নাইনের পরীক্ষায় গোলস্না খেয়ে ইশকুল ছাড়তে হয়েছিল। লজ্জাশরমের বালাই না রেখে সেসব কথাও লিখেছেন নাসিরউদ্দিন।

অ্যান্ড দেন ওয়ান ডের সোনার হাতে সোনার কাঁকন সাহেবি ঘরানার যে-থিয়েটার আজ বিলীয়মান তার অন্দরমহলের কথা। বোর্ডিং স্কুলে সিনেমার পাশাপাশি যে গুছিয়ে থিয়েটার হতো তার সাতকাহন করেছেন নাসিরউদ্দিন। স্টুডেন্টস থিয়েটার তো বটেই, শেক্সপিয়ারায়ানার মতো কিংবদন্তিপ্রতিম ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলও ঘুরে যেত সেন্ট জোসেফস, সেন্ট আনসেলেমের মতো চত্বর। এই সুবাদে জেফ্রি কেন্ডেলের একলব্য-শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন নাসিরউদ্দিন। ওই সেন্ট আনসেলেমে পড়ার সময় কীভাবে হঠাৎ আমত্মঃশ্রেণি নাটক প্রতিযোগিতায় নাম দিলেন, তিনজনের দল বানিয়ে জেফ্রি কেন্ডেলের নকলনবিশি করে শাইলক সেজে সবার নজর কেড়ে নিলেন আর এভাবেই যে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল, তার মনোজ্ঞ বিবরণ আছে অ্যান্ড দেন ওয়ান ডের পাতায়।

হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোয় নাসিরউদ্দিনের জুড়ি নেই। আবার ছোট ছোট তুলির আঁচড়ে একটা বড় ক্যানভাস ভরাতেও তিনি কম দড় নন। সত্তরের দশকে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা বা ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার হালচাল কেমন ছিল, কীভাবে শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনিদের হাত ধরে খুলে যাচ্ছিল হিন্দি সিনেমার সমান্তরাল স্রোতধারা তার চমৎকার ছবি ধরা পড়েছে এই বইয়ে। তিনি নিজে কীভাবে কেন্ডেল স্কুলিং ভাঙিয়ে ইব্রাহিম আলকাজির পদতলে মাথা রাখলেন, রোশন তানেজার খপ্পরে পড়ে স্তানিসস্নাভস্কি সিস্টেমের কাছে দাসখত লিখে দিলেন, আচমকা গ্রোটোস্কির ল্যাবে গিয়ে বেকুব বনে ফিরে এলেন, কিছুই বাদ পড়েনি। ছবিলদাস হল থেকে পৃথ্বী থিয়েটারের যাত্রাপথে যাদের যাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন সেই সত্যদেব দুবে, অমরেশ পুরি, সুলভা দেশপা–, শেখর কাপুর, বেঞ্জামিন গিলানির মতো অনেককেই কাছ থেকে চিনিয়ে দিয়েছেন। চিনিয়েছেন ওম পুরিকে। এবং যশপালকে। এনএসডি আর এফটিটিআইর এই তিন হুজুরের অমস্ন-মধুর-তিক্ত-ভাষায় কথা এই বইয়ের অনেকখানি জুড়ে রেখেছে।

থিয়েটারে কোনো অ্যাকশন রিপেস্ন হয় না, সিনেমায় হয়। তাই এই বই পড়তে পড়তে ইচ্ছা করে নিশান্ত বা মির্চ মসালা দেখতে। শ্যাম বেনেগালের জুনুন বা জেমস আইভরির শেক্সপিয়ারওয়ালায় জেফ্রি কেন্ডেলের অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য খুঁজতে। মাসুম বা স্পর্শের বৃত্তে ফিরতে।

পড়তে পড়তে দাম্ভিক নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে ছোটি সি মুলাকাতও হয়। সত্যি বলতে কী এই বইয়ের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নাসিরউদ্দিনের খাপখোলা মতামত। যে-মুম্বাই ফিল্মে অ্যাক্টো করবেন বলে কিশোরবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন আর কোনোরকমে দু-একটা ফিল্মে এক্সট্রা সেজে ঘরের ছেলে হয়ে ঘরে ফিরেছিলেন সেই ইন্ডাস্ট্রির কিনার থেকে কিনারায় তাঁর যাতায়াত বুঝি ফুরোনোর নয়। ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফাংশনগুলোকে ‘অ্যানুয়াল অর্জি অব মিউচুয়াল জার্কিং অব’ বলে ধূলিসাৎ করে বা তাঁর চলচ্চিত্র চরিত্রায়ণের অষ্টাঙ্গিক মার্গে একজন ভারতীয়কেও ঠাঁই না দিয়ে তিনি ক্ষান্ত হননি। একমাত্র বলরাজ সাহনিকে মাথায় রেখেছেন নাসিরউদ্দিন। দিলীপ কুমারকে মোটের ওপর পাশ নম্বর দিলেও রাজ কাপুরকে একেবারেই ভ্যাবলাকান্ত মনে হয়েছে তাঁর। গাইড ছাড়া দেব আনন্দের আর কোনো ছবিকে পাত্তা দেননি, অথচ শাম্মি কাপুরের নিরন্তর খ্যাপামি বা দারা সিংয়ের সেলুলয়েড কুসিত্মর আখড়াকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন। বাঙালি হৃদয়ে শেল বিঁধে কিশোরকুমারকে হিন্দি ফিল্মের ‘সার্টিফায়েড ম্যাড ম্যান’ বলে মশকরা করেছেন। নার্গিস, ওয়াহিদা, নূতন, মধুবালা, হেলেন, হেমা মালিনীদের নিয়ে কিঞ্চিৎ আদিখ্যেতা করলেও স্মিতা পাতিলকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে শাবানা আজমির অশেষ গুণকীর্তন করেছেন। সৈয়দ মির্জার আলবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়ে – কাজ করবেন কথা দিয়েছেন বলে তৎকালীন এক মুভি মোগলের কাছ থেকে পড়ে পাওয়া মোগলাই অফার যে ছুড়ে ফেলেছিলেন সে-কথা জমাটি করে শুনিয়েছেন আমাদের।

আক্ষেপ যে, আশির দশকের গোড়ায় রত্না পাঠকের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা বলে আর প্রথম পক্ষের মেয়ে হিনার সঙ্গে ভাব হওয়ার কিসসা শুনিয়েই নটেগাছটি মুড়িয়ে ফেলেছেন নাসিরউদ্দিন।
আশির দশকের শেষ দিক থেকে ত্রিদেব ইত্যাদি মুম্বাই ঘরানার মসালা ছায়াছবিতে জান লড়িয়ে ‘ওয়ে ওয়ে’ উলস্নাসে উন্নতবক্ষ ক্ষীণকটি গুরুনিতম্বিনীদের পেছনে ছোটাছুটি করেছেন যে নাসিরউদ্দিন, যে নাসিরউদ্দিন এই একুশ শতকেও উদ্দাম ‘হু লা লা হু লা লা’ বলে ডার্টি পিকচারে মাতোয়ারা হয়েছেন সেই মানুষটাকে দু-মলাটের মধ্যে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না সেই অভিনেতাকে, যিনি এ-মুহূর্তে নিরীক্ষাধর্মী তরুণ চলচ্চিত্রকারদের অগতির গতি।

অর্ধেক জীবন তো পড়া হলো। বাকি অর্ধেক কি কখনো লিখবেন তিনি?

আকাঙঙ্ক্ষা ও আশঙ্কায় আতুর হয়ে রইলেন তাঁর গুণগ্রাহীরা।