নিখোঁজ

হাসান আজিজুল হক

মার-খাওয়া নেড়ি কুকুরের দশা সবুরের। যেন এইমাত্র পাছায় দু-ঘা দিয়েছে গেরস্থ, কেঁউ-কেঁউ করে সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই পড়েছে পাড়ার নেড়ি কুকুরগুলোর পাল্লায়, তারা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে একটা পচা ডোবায়, নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। তারপর থেকে সে ল্যাজ নামিয়ে বেশারতুল্লার দেওয়া গরুর গাড়িতে মাঠে-মাঠে কেবলই ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরীরটা পচা পানিতে ভিজে ন্যাতা, ল্যাজটা দু-পায়ের মাঝখানে চেপে ধরে রাখা, পাশে একটা ঠান্ডা হিম অকহতব্য সুন্দর শরীরের বোমা। যে-কোনো সময়ে তার ভেতরের ভয়ানক আগুনে ফেটে পড়বে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্ক কি হয় যে কাছের মানুষের কাছে থাকাটাই হয়ে যায় অস্বস্তিকর, আতঙ্ক, ভয় আর বিপদের? একইসঙ্গে বরফ আর আগুন হয়ে যেতে পারে মানুষের সামান্য শরীর? সবুর ভাবতেই থাকে, কতো মধু খেয়েছিলাম কবে – মাতাল হয়ে মধু খাওয়া আর মধু খেয়ে মাতাল হওয়া? দুটোই কি? একইসঙ্গে?
কিছু জমা নেই তার ভেতরে অথচ কী ভারি এই ভার! বইতেও পারছে না, একবারের জন্যে ফেলতেও পারছে না। তার মনে নেই যে এর মধ্যে দু-একরাতে ভোরবেলার নিরিবিলির মধ্যে সাবিত্রীর শরীরে ঢুকে পড়েছিল সে। কোনো বাধা দেয়নি সাবিত্রী, যেমন করে শুইয়ে দিলে সুবিধে হয়, তেমনি করে তাকে শুইয়ে দিতে এতটুকু বাধা দেয়নি। বদলে সবুর পেয়েছিল শুধু শুকনো একটি মাংসে-গড়া গহ্বর, শক্ত সাদা পাথরের মতো একজোড়া বুক। অনেকক্ষণ পরে-পরে তার মুখে এসে পড়ছিল একটি করে ঠান্ডা নিশ্বাস। সবুর এই মেয়েমানুষটাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারছে না, কোথাও গচ্ছিত রেখে পালানোর পথ নেই তার। গলায় পাথর-বাঁধা সে স্রোতের নদীতে পড়েছে। একে ছেড়ে যাওয়ার উপায় তার নেই। তার ভাবনার কথা পর্যন্ত একে জানানোর উপায় নেই। সকাল থেকে পাশাপাশিই বসে রয়েছে তারা, সাবিত্রী কথা তো বলবেই না, সবুরও একটি কথা বলতে পারে না তাকে। এখন সে শুধু দু-একটি ঘোষণা জানাচ্ছে যখন দরকার পড়ে; এই গাঁয়ে এক খালাতো ভাই থাকে, মায়ের আপন বোনের ছেলে নয় অবিশ্যি। তার বাড়িতে যাচ্ছি। সে এই এলাকার পীর, অনেক মুরিদ তার, খুব ভালো মানুষ।
না, বেলাত আলী ঠিক পীর নয়, পীর ছিল তার দাদা, বাবার বাবা। সেইজন্যে এই বাড়ি হচ্ছে পীরবাড়ি আর বেলাত হচ্ছে প্রায়-পীর। কোনো একদিন একজন পীর ছিল এই বাড়িতে, তখনই অবস্থা ফিরে গিয়েছিল পীর সাহেবের। বড়ো গেরস্থ হয়ে উঠেছিলেন সেই পীর। তাঁর ছেলে পীর হয়নি, হয়েছিল ভালো চাষি-গেরস্থ।
এই বাড়িটা প্রায় সারা পাড়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাড়া-ছাড়া একটা দুটো করে মাটির ঘর, নানা আকারের উঠোন। কোনোটায় এখনো ঝাঁটপাট পড়ে, কোনোটা ঘাস-জঙ্গলে ভরা। অনেক ঘরই এখন ফাঁকা, শূন্য। খড়ের চাল ভেঙে পড়েছে, মাটির দেয়ালগুলো ন্যাড়া, চারধার ঘেরা পাঁচিলগুলো হাওয়ায় বৃষ্টিতে রোদে-তাপে ক্ষয়ে প্রায় শেষ। এরই মধ্যে একটি-দুটি ঘর এখানে-ওখানে পরিপাটি রয়েছে। পীরের নাতি যে আবার তার বাবাকে ডিঙিয়ে একটা     পীর-পীর ভাব পেয়েছে! মানুষটা সে মাঝারি চাষি-গেরস্থ। কিছু জমি, অনেকটা জায়গাজুড়ে বসতবাড়ি, তার একটা অংশে নিজেদের বাস করার পাঁচিলঘেরা ঘরগুলি – এসব নিয়ে সে বড়ো ভালোমানুষ আর একটু-একটু পীর। মুরিদ, মানে যারা তার কাছে নানা জায়গা থেকে দ্বীন-ইসলাম আখেরাতের সওয়াব-গুনাহ নিয়ে কথা শুনতে আসে তারাই মুরিদ। বেলাত পীরকে হাতে মাটি লাগাতে হয় না অথচ গেরস্থবাড়ির গরু-মোষ গাড়ি, লাঙল সবই তার আছে।
অনেক আগে সবুর একবার এসেছিল তার এই ভাইয়ের বাড়িতে। বয়সে বেলাত তার চেয়ে ১০-১২ বছরের বড়ো। সবুরের গাড়ি যখন বার-বাড়িতে এসে দাঁড়াল, তখন বেলাত তার দহলিজে – যাকে আজকাল মানুষ খানকাই বলে। লোকজন নিয়ে কথা বলছিল। গাড়ি দেখেই সে নেমে এলো। এতদিন পরে বেলাতকে দেখছে সবুর, চিনতে পারা কঠিন। পরনে একটা পরিষ্কার সাদা লুঙি, গায়ে তেমনিই একটা হালকা ফতুয়া, গাঁয়ের চাষার চিহ্নমাত্র নেই চেহারায় বা পোশাকে। যেটুকু ছিল মুছে ফেলেছে সেটা। পীর মানুষ কিন্তু দাড়ি নেই, চাঁছা মুখ, একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালে সবুরের চোখে পড়ল কড়াপড়া তার হাতদুটো, দু-পায়ের চ্যাপ্টা বড়ো বড়ো নখ। খুব নিচু গলায় বলল সে, কে? ঠিক চিনতে পারছি না?
বেলাত ভাই চিনতে পারছ না, আমি সবুর, বিয়ে করেছি, বউ দেখাতে নিয়ে এলাম।
সেটাই খুব দরকার পড়ল বুঝি?
কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল সবুর। কী বলবে বুঝতে পারল না। বেলাতই আবার বলল, কখনো কোনো যোগাযোগ তো রাখোনি? তোমার বিয়ের বয়স কবে হলো তাই তো জানি না। তোমার বাপও জানায়নি বিয়ে হচ্ছে ছেলের।
এই যে বউ – সবুরের চোখের ইশারায় এক-পা এক-পা করে গাড়ি থেকে নেমে এলো সাবিত্রী। নতুন বউয়ের হাঁটা নয়, ঘড়ির কাঁটার মতো একটানে এগিয়ে আসে সে। হাত-ভরা কাঁচের চুড়ি, গলায় একটা তাবিজ। বেশারতুল্লার ছোট বউ দিয়েছে। হাতের তালুতে নখে মেহেদির রং, বাতাসে মেহেদির সোঁদা গন্ধ। সাবিত্রীর চোখে স্থিরদৃষ্টি, চোখ নামায়নি সে। মুসলমানের নতুন কনে কি এমনভাবে তাকিয়ে দেখে পরপুরুষকে?
বেলাত একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। তারপর সবুরের দিকে চেয়ে বলল, অত জানতে চাই না আমি। ভাই বেরাদার হলেও মানব না আমি তোমাকে। ধরে নিচ্ছি বিপদে-পড়া একজন মানুষ এই গাঁয়ে আমার বাড়িতে এসেছে। শোনো সবুর, বলি তোমাকে, আমি পীর নই, পীরগিরি করি না, ঝাড়ফুঁক করি না, পানিপড়া দিই না, তাবিজ-কবজও না। মানুষে এই বাড়িকে পীরবাড়ি বলে, আমি দ্বীন-আখেরাত নিয়ে কথা বলি লোকের সঙ্গে। ওরাও বসে, আমিও বসি। যদি কিছু বুঝতে পারি আমরা কী করি, কী করা উচিত আমাদের। আমি মেহমান বলে মেনে নিচ্ছি তোমাকে। তোমরা থাকো এখানে। ঠিক সাতদিন, আজ শুক্রবার থেকে সামনের শুক্রবার। আমার সঙ্গে আবার দেখা হোক আর না হোক, সামনের শুক্রবার গাড়ি আসতে বলে দাও। ওইদিন চলে যাবে। আর একটা কথা, এই মেয়ে বা তোমার কনে যা-ই হোক, ও শোবে আমার বিবি যে ঘরে শোয়, তার পাশের ঘরে। আর তুমি থাকবে বাইরের কোনো একটা ঘরে। বেলাত চারদিকে পড়ো, ভাঙা, আধভাঙা, আস্ত ঘরগুলির দিকে চেয়ে মোটামুটি পরিষ্কার উঠোনওয়ালা একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো।
আর শোনো, ঘর থেকে বেরোবে-টেরোবে না বেশি। কারও চোখে পড়ার দরকার নেই। মেয়েটি অন্দরে ঠিক থাকবে।
এই ব্যবস্থায় রাগে-দুঃখে পুড়তে লাগল সবুরের বুক। কেমন একটা দারুণ আফসোস, ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল, আবার সাথে সাথেই কি অপার স্বস্তি। একটানা পীড়ন-পেষণ থেকে মুক্তি। সারাদিন রাতের জন্যে নেমে গেছে পাষাণভার!
সাবিত্রীকে অন্দরে পৌঁছে দিলো বেলাত নিজেই। একটা লোক এসে নিয়ে গেল সবুরকে। সবচেয়ে দূরের উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরটায়। তার উত্তর-পশ্চিমে সীমানা পাঁচিল। ন্যাড়া, সাদা, ভাঙা, পাঁচিলের বড়ো বড়ো ফাটলের ফাঁক দিয়ে ওদিকের মাঠ দেখা যায়। উঠোনে ঘাস নেই। রাগী বিরক্ত একটা বেলগাছ এককোণে, তাতে চিরকালই বেল ধরে আছে, কোনোদিন পাকে না। একটিই ঘর, তিনটে মাটির সিঁড়ি বেয়ে সোজা ঘরে ঢুকতে হয়। সেখানে শক্তপোক্ত একটা চৌকি, তাতে শীতলপাটি বিছানো। পানি, খাবার সব আমি নিয়ে আসব – বলে লোকটা চলে গেল। সবুরের মাথার ভেতরে বাতাস থমকে আছে, যেন ১০ মণ ভারী, বুকের মধ্যে জমাট বাতাসের অনেক তলায় ধাঁই ধাঁই করে বিস্মিল্লাহ হাতুড়ি পিটোচ্ছে আর মাথার মধ্যে যেসব শিরা উপশিরা ধমনি øায়ু, øায়ুকোষের জটিল সরুমোটা সুতোর জাল আছে, সেখানে মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে বিদ্যুৎ-চিকুর।
এদিকে বাড়ির ভেতরে এসে সাবিত্রী দেখল অন্দর ফাঁকা, একটি প্রাণী নেই। উঠোনের এককোণে ডালিম গাছে একটা টুনটুনি কেন যে একটা ঠ্যাং উঁচিয়ে আছে কে জানে আর দেয়ালে বসে এক কাক কান চুলকোচ্ছে। বেলাত কারো সঙ্গে কথা না বলে তাকে অন্দরে ঢুকিয়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল। একা দাঁড়িয়ে সাবিত্রী উঠোনের মাঝখানে। তখন সামনের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক ডানাকাটা পরী। এ কী রূপ রে তার বাবা! সাবিত্রী চোখের বিস্ফার যতোটা সম্ভব বড়ো করে চেয়ে রইল। এই রূপকে পিথিমির রোদ ছায়া হাওয়া যেন কোনোদিন ছোঁয়নি, এইমাত্র তা আকাশ থেকে নেমে এসেছে। মেয়েটার নাক এত ধারালো যেন ছোট সুন্দর একটি ক্ষুর উলটে রাখা আছে আর সেটা এতই পাতলা যে তাতে আলো বাজছে। নাকে একটা সাদা মুক্তো। কাছে এসে যখন সাবিত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে হাসল, সাবিত্রী দেখল আরো অনেক ভালো ভালো মুক্তো তার এমনিতেই রয়েছে। সেগুলোর চারটে চারটে আটটা মাত্র সে দেখল ওর হাসির অছিলায়। এসো, তোমাকে ঘরে নিয়ে যাই। একটা বড়ো ঘরের পাশে এক-দরজা এক-জানালাওলা ছোট আরেকটা ঘর। সেখানে চিকন সুজনি-পাতা বিছানা, লাল সুতোয় গোলাপ ফুল-তোলা ওয়ার ঢাকা দেওয়া বালিশ।
সেদিন রাতে আরব্য উপন্যাসের ছেঁড়া কোনো পাতা থেকে বেরিয়ে এই ইরানি রাজকুমারী তার স্বামীর বিছানা ছেড়ে সাবিত্রীর কাছে এসে শুয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা কথাও শুধোব না, আমার মনে হচ্ছে বহুদিন ঘুম নাই তোমার, ঘুমোলেই যে ঘুম হয় না, তা জানো না বুঝি? এসো, তোমার চুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুমি ঘুমোও।
এ হাড়িদিদি নয়, বয়সেও তার চেয়ে কম। চোখদুটোও কালো নয়, বরং একটু কটাই। তুমি আমার কে, তুমি আমার কে – ভাবতে ভাবতেই সাবিত্রী চোখ বুজল। কেউ নও তুমি, কে আবার হবে? বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতেই ঘুম এলো তার চোখে আর গলতে শুরু করল সেই আশ্চর্য হিম পাথর যা জমাট ছিল। কার স্পর্শে সেটা গলতে শুরু করে কে বলতে পারে? ফোঁটায় ফোঁটায় বা সরু স্রোতে বেরিয়ে এলো গরম তরল। ঘুমে ঢাকা চোখের পাতার নিচে তার চোখদুটি গলছেই শুধু, ক্ষয়ে মণিদুটি ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
একটু বেশি সংসারের দাগ-লাগা ইরানি রাজকুমারীর কোলের মধ্যে জড়ো হয়ে থাকা তার শাড়ি ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

এই রাত শেষ মাঘের, বেশ ঠান্ডা। পূর্ণিমা হয়ে গেছে কদিন আগে – চাঁদ উঠছে অনেকটা দেরিতে। এই ঘরে সবুর বালিশ তো পেয়েছেই, একটা পুরনো লেপও পেয়েছে। তবে ঝকঝকে তারাভরা অন্ধকার এই রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে তার ভালো লাগল না। ধারালো ঠান্ডা বাতাস স্থির হয়ে রয়েছে। অন্ধকার তার চেয়েও ধারালো, তারার আলোয় অনেক বেড়েছে এই ধার। সবুরের এখন জুড়িয়ে যাওয়া দরকার। ঘরের বাইরে এসেই সে তাপ ছাড়তে শুরু করে। আকাশের দিকে তাকায়, হিমে কাঁপে। সাবিত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। সে আর নেই ঘাড়ে। তার শরীর ঘাঁটাঘাঁটি করার কথা মনে আসে না। ঘুম-বিশ্রাম তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে যে-জ্বালা শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তা এখন ঝিমোচ্ছে।
সাতটা দিন আর সাতটা রাত কেটে যাওয়ার পর বেলাতের ডাকে তার বৈঠকখানার সামনে এসে গাড়োয়ান ছেলেটা আর বেশারতুল্লার গরুর গাড়ি দেখে সে যেন ভূত দেখল। বেলাত বলল, কোনো কথা তোমাকে আমি জিগ্গেস করিনি। যে মুসাফির দুদিন আশ্রয় চায়, অকাজ-কুকাজের মধ্যেও একটুখানি ফাঁক চায়, তাকে বাড়ির মালিক কিছুই জিগ্গেস করে না, শুধু আশ্রয়টুকু দেয়। তুমি একটি মেয়ে সঙ্গে করে এনেছ, তোমাকে কিন্তুক বেলেল্লাপনা করার কোনো সুযোগ দিইনি, কিছু জানতেও চাইনি, শুধু ক-দিন জায়গা দিয়েছি। তুমিও কদিন ঘরেই চুপ করে বসে ছিলে, আমার মান বাঁচিয়েছ। আমি ঠিক করেছি না অন্যায় করেছি, সে বিচার আল্লা করবেন। যাও, এখন ঘরে গিয়ে পানি-টানি খেয়ে তৈরি হয়ে নাও। মেয়েটিও এখুনি আসবে। তোমরা চলে যেও, আমার সঙ্গে আর কথা হবে না।
বেলাত বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সাবিত্রী এর মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে একটা ঘন সবুজ রঙের শাড়ি, বেলাতের বউ তাকে দিয়েছে। এই রঙের শাড়ি হিঁদু মেয়েরা পরে না, এই রং খাঁটি মুসলমানি, হিঁদুরা পরলে কিছুতেই মানাবে না। বেলাতের বউ একদিন গা ধুয়ে এই শাড়িটা পরেছিল, তাকে চেয়ে চেয়ে দেখেছিল সাবিত্রী। এত ফর্সা রঙে ওই সবুজ শাড়ি, শীত-দুপুরের রোদ, টিকোলো নাকে আলোর ঝলক, একটু কটাশে চোখ – পিথিমিতে এমন মেয়ে কি আসতে পারে! সাবিত্রী কোনোদিন এমন রূপ দেখেনি। শুধু মুসলমানি রূপ, এই যা! বয়স যতোটা কম মনে হয়েছিল তার, অতোটা কম নয়। কপালে খুব সরু দু-একটি রেখা। সামান্য শুকিয়েছে এতো রূপের শরীর।
এই শাড়িটাই সাবিত্রীকে দিয়েছে সে। সাবিত্রী কিছুতেই নিতে চায়নি। শাড়ি চায় না সে, কী করবে শাড়ি নিয়ে? যে একমাত্র শাড়িটা তার আছে, সেটাও যে কতোবার খুলে ফেলতে হয়েছে তাকে! বারবার শতছিদ্রে ভরা চামড়াটাই তার সত্যিকার পোশাক, শাড়ি নিয়ে হবে কী? বলতে তো পারেনি এই কথা, জিগ্গেসও করেনি তাকে বেলাতের বউ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে-থাকা সাবিত্রীর হাতে শাড়িটা দিয়ে ওটা পরে আসতে বলেছে ঘরে গিয়ে।
দুদিনের জন্যে এক বুবু পেয়েছিল, সেই-ই দিয়েছে শাড়িটা। আজ এখন যাওয়ার সময় নিজের শাড়িটা পুঁটুলি বেঁধে বুকের কাছে ধরে সবুজ শাড়িটা পরে রয়েছে সাবিত্রী। ঘোমটা সে কখনো দেয় না, আজো দেয়নি, চোখ কখনো নামায় না, আজো নয়, একদৃষ্টে সে চেয়ে রইল বেলাতের বউয়ের দিকে। কিন্তু চোখে তার একফোঁটা জল নেই।
বেলাত তাকে বাইরে যেতে বলেছিল, নিজে সঙ্গে আসেনি। কথা বলল না সে একটা। বেরিয়ে আসার ঠিক আগে সাবিত্রী পেছন ফিরে চেয়ে দেখল চারটে একসঙ্গে গাঁথা মুক্তো একটু-একটু দুলছে, কাঁপছে।
বেশারতুল্লার বাড়িতে প্রথম আসার দিন যা ঘটেছিল, আজও ঘটল ঠিক তাই। মাঠে পড়েই কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়োয়ান ছেলেটা রাস্তা হারিয়ে ফেলল। আজকের রাতটা গতরাতের মতোই, কনকনে ধারালো হাওয়া, শান দেওয়া চকচকে অন্ধকার আর তারাভরা উধাও আকাশ। ঘরবাড়ির মধ্যে থাকলে বেশ পুব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ বোঝা যায়, মাঠে এসে পড়লেই দুনিয়া হয়ে যায় গোল, পুব-দক্ষিণ গুলিয়ে যায়। মাঠে একচোখওলা হাসকুটে কালো বদ্-হাওয়া আছে একটা, সে যেদিকে খুশি টেনে নিয়ে যায়, ইচ্ছে হলে ঘুরিয়ে মারে। হয়রান হয়ে কেউ-কেউ নিজে-নিজেই মরে। প্রায় সারারাত সাবিত্রীদের নিয়ে গরুর গাড়ি ঘুরতে থাকে। গাড়োয়ান ছেলেটা জেগে আছে না বসে-বসেই মরে গিয়েছে বোঝা যায় না। গরু দুটো গাড়ির সঙ্গে আছে কিনা সেটাও বোঝা যায় না। একেবারে ভোরবেলায় সামান্য আলো ফুটলে দেখা যায় গাড়ি গাঁয়ে ঢুকছে, গাছপালা বাড়িঘর ঘাটপুকুর আবছা বোঝা যাচ্ছে। সবুজ শাড়ি-পরা অন্য এক সাবিত্রী ঠিক পাথরের মূর্তি, স্থির মেলেই আছে তার চিরকালের জেগে-থাকা চোখ, সবুরের মাথা দুই হাঁটুর মধ্যে গোঁজা। সে জেগে না ঘুমিয়ে বলা কঠিন। হাঁটু থেকে যখন মুখ তুললো, তার চোখদুটো করমচার মতো লাল। একটুও আলো সেই চোখে নেই।
বেশারতুল্লার ঘরের চাবি তার সঙ্গেই ছিল। গাড়োয়ান ছেলেটাকে সে গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যেতে বলল, তারপর টলতে-টলতে ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। ঘরের মেঝেয় খেজুরপাতার বড়ো পাটিটা পাতাই রয়েছে, হাত-পা ভেঙে হুড়মুড় করে সেখানে পড়ল সবুর। সাবিত্রী এগিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পাটিতে না বসে মেঝেতেই বসে পড়ল আসনপিঁড়ি হয়ে।
সন্ধের একটু আগে, ঝিকমিক করতে-করতে সুয্যি আকাশ থেকে ঝটপট নেমে পড়তে চাইছে, বেশারতুল্লা ঘরে ঢুকে দেখল দুপুরবেলায় তার বড়োবিবি ওদের জন্যে যে খাবার রেখে গিয়েছিল, তা তখনো তেমনি পড়ে রয়েছে। সাবিত্রী মাটিতে কেন্নোর মতো গুটিয়ে শুয়ে আছে। বেশারতুল্লা সবুরকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে খুব ঘুমিয়েছ বাবাজি। এখন উঠে বসো, কিছু-মিছু খেয়ে নাও, নাহলে মারা পড়ে যাবে। বোর্ড পেসিডেন সয়েদ সায়েব এয়েছে। কথা বলতেই হবে বাবাজি, উপায় নাই। এসো।

[মাঠে একটা লোকের সহিত আমাদের দেখা হইল, সে সবুরকে জিজ্ঞাসা করিল, এত রাত্রে সে কোথায় যাইতেছে। সবুর উত্তর করিল যে, তাহার মামি খুবই অসুস্থ, তাহাকে দেখিতে যাইতেছে। তাহার পর আমাকে বেলগাঁর ইশাহাকের বাড়ি লইয়া যাওয়া হইল। তখন ভোর হইতেছিল। সেখানে আমি সকালবেলায় রোদ পোহাইতে ছিলাম। একজন বোষ্টুমি সেখানে আসিল। সে আমার হাতের নোয়া শাঁখা খুলিয়া লইল এবং কাঁচের চুড়ি পরাইয়া দিলো। আমি কাঁদিতেছিলাম কিন্তু যেহেতু আমি মোসলমান মেয়েদের মধ্যে বসিয়াছিলাম, সেজন্য ভয়ে কোনো কথা বলিতে পারিলাম না। বিকালবেলায় সবুর আমাকে তার মামা তিনু মুনশির বাড়ি লইয়া গেল। সেখানে আমি দুইদিন ছিলাম। এর মধ্যে একদিন সেই বোষ্টুমির দেখা পাইলাম। তাহার নাম আমি জানি না। আমি তাহাকে বলিলাম যে, আমি বামুনের মেয়ে। শ্রীকেষ্টপুর আমার বাড়ি। আমার দাদাকে খবর দিলে আমি উদ্ধার পাইতে পারি। সে বলিল, খবর সে দিবে।
সেখান হইতে সবুর ওই একই গ্রামে আমাকে তাহার বাবার বাড়ি লইয়া গেল। সেখানে আমি দুইদিন ছিলাম।    তাহার পর আমাকে সবুরের মেসো বেশারতুল্লার বাড়ি লইয়া যাওয়া হইল। এইভাবে আমাকে গরুর গাড়িতে এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় যাইতে হইল। বেশারতুল্লার বাড়িতে আমি চার-পাঁচদিন থাকিলাম।
ইহার পর আমাকে বড়ো পলসোনা গ্রামে সবুরের আত্মীয় বেলাতের বাড়িতে নেওয়া হইল। বেলাত পীর হিসাবে পরিচিত ছিল। সেই সময় একবার সবুরের বাবা আমার সহিত দেখা করিয়াছিল। তাহার পর আবার ধারসোনা গ্রামে বেশারতুল্লার বাড়ি আসিলাম। খুব সকালে সেখানে পৌঁছাইয়া ছিলাম। বিকালে ধান্যগ্রামের সৈয়দ আসিলেন। তাঁহার সঙ্গে একজন লোক ছিলেন। সৈয়দ আমাকে আমার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন…]
(সাবিত্রীর এজাহারের অংশ, অনুবাদ আমার)

বাইরের দিকের দরজাটা খুলে সাবিত্রীকে নিয়ে সবুর বেরিয়ে এলো। রাস্তার ঠিক উলটো দিকেই বেশারতুল্লার একটা ছোট্ট মাটির ঘর আছে। ঘর বলা চলে না, একদিকে গাদা করা কিছু খড়, পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে গরুর জাবনা কাটার করাত-মুখের একটা বঁটি, দেয়ালে দুতিনটে হুঁকো ঠেসানো, আগুন ধরানোর জন্যে খড়ের বিড়ে। এখানে রাখালরা জাবনা কাটে, বেশারতুল্লা কখনো বসে হুঁকো খায়। ঘরে আর কোনো কাজ হয় না। তবে বাইরের উঁচু  ধারি-ওলা দাওয়াটা বেশ কাজের। লোকজন আরাম করে বসে কথাবার্তা বলতে পারে।
এখন সেখানে মাঝবয়েসি একজন বসে আছেন। গাঁয়ের ভদ্রলোকেরা যেমন হয়, তার চাইতে একটু অন্যরকম। চোখে চশমা আছে, মাথার মাঝখানে সিঁথি আছে, পরনের ধুতি জামাটা পরিষ্কার আর দামি। এমন মুখওলা মানুষকে দেখলেই ভালো লাগে।  হালকা-পাতলা মাঝারি মানুষ, মুখটা সুন্দর কিন্তু কপালে বদমেজাজের ভাঁজ।
লোকটার সামনে দাঁড়িয়েই সবুর মাথা নিচু করল। সাবিত্রী সোজা চেয়ে রইল তার দিকে। মানুষটাও সোজা সাবিত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, তোমার নাম কী?
সাবিত্রী তার নাম বলতে যাচ্ছে – নড়েচড়ে উঠল সবুর, সাবিত্রীর মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল, ওর নাম শিবানী সরকার।
নামটা ওকে বলতে দিলে না কেন – লোকটার কপালে দুটো ভাঁজ পড়ল, কাদের মেয়ে ও? যে লোকটা পেছনে দাঁড়িয়েছিল তার খাটো ময়লা ধুতির ওপর একটা মোটা নীল হাফ-শার্ট আর কোমরে বাঁধা চওড়া একটা চামড়ার বেল্ট, তাতে পেতলের চকচকে বক্লেসের ওপর ইংরেজিতে কী যেন লেখা। লোকটার হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। মনে হয় চৌকিদার। তার দিকে তাকাতেই সে একটা ছোট খাতা আর কাঠপেনসিল বাড়িয়ে ধরল মোড়ায় বসে থাকা মানুষটার দিকে। তিনি কিছু লিখলেন খাতায়, লিখতে-লিখতেই বললেন, সবুর, কাদের মেয়ে বলো?
কোটালদের মেয়ে।
এ কোটালের মেয়ে? ঠিক করে বলো।
হ্যাঁ সৈয়দ চাচা, শিবানী ওর নাম। কোটালদের মেয়ে।
সবুর চাচা-ফাচা এখন বাদ দাও। আমি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। খোঁজ নিতে এসেছি, গভ্মেন্টকে জানাতে হবে কাকে নিয়ে এসেছ তুমি।
আমি ঠিক বলছি পেসিডেন সায়েব।
আচ্ছা। আর কিছু জানার নেই আমার। মোড়া থেকে উঠে পড়লেন তিনি। চৌকিদারটা তটস্থ হয়ে দাঁড়াল। সাবিত্রী যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনি দাঁড়িয়েই থাকল, দেখল সবুরকে একপাশে ডেকে নিয়ে নিচুগলায় কথা বলছেন পেসিডেন।
বাঁচতে পারবি না সবুর। এই কাজের মাফ নাই, গভ্মেন্ট ফাঁসি পজ্জন্ত দিতে পারে।
তা আমি জানি চাচা, তবে ফাঁসি গেলে আমি কি একা যাবো?
ওসব পরের কথা। এখন নিজের কথাই ভাবো। বাকিরা এখনো কেউ ধরা পড়ে নাই। তুমি মনে করলে, আমি তেমন কিছু শুধুলাম না, একটা নামকাওয়াস্ত এনকোয়ারি করতে এয়েছি। আমার যে শুধুবার কিছু নাই রে, আমি সব জানি। গাঁয়ে গাঁয়ে হিঁদু ভদ্দরলোকেরা লোকের মনে বিষ ছড়াচ্ছে। তোমরা তো মাথামোটা নেড়েজাত, শুধু জানো হোঁকামো করতে আর লাঠি আনতে। গভ্মেন্টের টোটা বন্দুক দেখেছ? এলাকায় হিঁদু-মোসলমান দাঙ্গা হয়ে যেতে পারে। ভদ্দরলোকেরা তাই চায়। ওরা শুধু ফন্দি-ফিকির খুঁজছে। ভালো একটা ফিকির বানিয়ে দিয়েছিস।
বাঁচব না জানি, সেইজন্যেই তো আপনি ভরসা চাচা।
লোকজনের সামনে চাচা ফলিয়ো না। মেয়েটাকে এখানে আর একটা রাতও রাখা চলবে না। ওকে স্রেফ লুকিয়ে ফেলতে হবে। কেস হলে আমি কিন্তু মিছে কথা লিখতে পারব না।
তাইলে কোথা রাখি মেয়েটাকে আজ রাতে? সবুরের মুখ চরচরে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আজ সন্ধের পর একটু রাত হলে ধানগাঁয়ে আয়। দেখি আমি কী করতে পারি। রাস্তাতেই আমাকে দেখতে পাবি – কথা শেষ করে সৈয়দ হাঁক দিলেন, এই বেশারতুল্লা। এইবার যাবো।
বেশারতুল্লা এতক্ষণ এখানে ছিল না। কাজ কি ঝক্কি-ঝামেলায়? যা হওয়ার তা তো হবেই। সে বাড়ির ভেতর থেকে কাঁসার ছোট থালায় একটা ডিমপোচ নিয়ে বেরিয়ে এলো, জি, পেসিডেন সায়েব। এই একটু! চা-তো বিবিরা করতে পারে না।
কিছু দরকার নাই। তা বেশারতুল্লা, আছ কেমন?
ভালোই আছি সয়েদ সায়েব।
লেঠেলি ছেড়ে দিয়েছ?
তা একরকম তাই। আর কতোকাল লোকের মাথা ফাটিয়ে বেড়াব? বাবুরা মিয়ারা দেওয়া-থোওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
দরকার পড়লে লাঠি ধরতে পারবে তো?
একবার হুকুম দিয়েই দেখেন না! বেশারতুল্লা তার শাল-কাঠের পাটার মতো কাঁচাপাকা লোমভরা বুকে হাত রাখল।
সাবাস বেশারতুল্লা। চল্ অনিল। চৌকিদারকে সঙ্গে নিয়ে ছোটখাটো সুন্দর মানুষটি পথে পা দিলেন।
একটা মাঝারি মাঠ পেরোলেই ধানগাঁ। সন্ধে উজিয়ে রাতটা আর একটু ঘন হওয়ার অপেক্ষা করছিল সবুর। বেশি দেরি করার দরকার নেই। এই শীতের দিনে গাঁগুলোয় সন্ধের একটু পরেই নিশিরাত। ভূতের মতো গা-মাথা ঢেকে সাবিত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো সবুর। বেশারতুল্লাকে আর ডাকেনি। তাকে ডাকতে বারণ করেছিল সে, যাওয়ার সময় আর আমাকে ডেকো না বাবাজি। ইয়ার মধ্যেই যেটুকুনি পাঁক আমাকে মাখিয়ে দিয়েছ আর নিজে যতো পাঁক ঘাঁটাঘাঁটি করেছ তাতে মনে হচ্ছে লাঠি বার করতে হবে। সব লাঠিই তেল মাখিয়ে রেখে দিয়েছি, ধুলো-ময়লায় পেছল হয়ে আছে বাপ! চাবি ধনকোঠায় রেখে চলে যেও।
সবুর সাবিত্রীকে নিয়ে মাঠে বেরিয়ে এসে দেখে চাঁদ ওঠার আগের ভারি আঁধার এখন, নিঃসাড়ে ডুবে আছে মাঠ। জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুজনে। সাবিত্রীর কাছ থেকে একটি কথাও আশা করা বৃথা। ঝুপঝুপ করে কুয়াশা নামছে সমস্ত মাঠে। তবে চোখ সয়ে এলো। রাতের ছায়ার চেয়ে এক পোঁচ বেশি কালো ছায়া হয়ে ধানগাঁ ফুটে উঠল পশ্চিমদিকে, পায়ের তলায় একটা সাদা পায়ে-চলা পথও দেখা গেল। অর্ধেক রাস্তা পেরিয়েছে, ওরা মুখোমুখি হলো সৈয়দের। পাতলা ছিপছিপে সাদা পোশাক-পরা মানুষটিকে খানিকটা দূর থেকেই তো দেখতে পাওয়ার কথা, অন্ধকার লুকিয়ে রেখেছিল কেন ওকে?
বেশারতুল্লা আসতে চেয়েছিল তোমাদের সাথে?
না। বরং আসার সময় তাকে ডাকতে বারণ করেছিল।
বুদ্ধি আছে বেশারতুল্লার। সকালে উঠেই তার প্রথম কাজ হবে তোমরা যে-ঘরটায় ছিলে সেটার ময়লা দাগ-টাগ সাফ-সুতর করা। ওকে আর কোনোমতেই জড়ানো যাবে না।
বাকি পথটুকু শিগগির ফুরিয়ে এলো। গাঁয়ের কেউ ঘরে আলো জ্বালিয়ে ঘুমোয় না। ওরা নিজেদের সঙ্গে-সঙ্গে বাড়িটাকেও ঘুমুতে দেয়, বাতাসটাও শব্দ করে না। রেড়ির তেলের পিদিম একটা টিমটিম করে জ্বলতে পারে আঁতুড়ঘরে কচি শিশুর নাই সেঁকার জন্যে।
এ-গাঁয়েও মোসলমান আছে তবে ধারসোনার মতো পুরো গাঁ মোসলমানের নয়। বরং উলটো, ৯০ ভাগ এখানে হিন্দু। মোসলমানপাড়ায় খুব ঘন বসতি। দুই মাটির বাড়ির গলির মধ্যে একটা মানুষ ঢোকাও কঠিন। বেড়াল, কুকুর আর গায়ে তেল মাখানো চোররা শুধু যাতায়াত করতে পারে। সৈয়দরা থাকেন পাড়ার পশ্চিম সীমানায় প্রায় মাঠের ধারে ছড়ানো-ছিটানো বড়োবাড়িতে। সেদিকে নিয়ে গেল না সবুরদের। সবুর জানে আলাদা একটা ভিটেবাড়ি কিনেছেন সৈয়দ। সে অবশ্য দেখেনি কোনোদিন।
মোসলমানপাড়া শেষ হয়ে গেল। একটা ফাঁকা ভিটে এলো, একটা জঙ্গুলে ইট ঘটিংয়ে ভরা ফাঁকা মাঠের ভেতর থেকে শুকনো বিষ্ঠার গন্ধ এলো। তারপরে চারপাশে পাঁচিল-তোলা চৌকো ভিটেয় তালা-লাগানো দরজার সামনে এসে তারা দাঁড়াল। এটাই শেষ বাড়ি, বামুনদের বাড়ি দিয়ে হিঁদুপাড়ার শুরু।
সৈয়দ দরজার তালা খুললেন। ঘাসে-ভরা বড়ো চৌকো উঠোন, দু-কোণে দুটি ডুমুর আর পুব দেয়াল ঘেঁষে একটা বড়ো পেয়ারা গাছ। বাস করার বাড়ি এটা নয়। পুব-উত্তর কোণে         দক্ষিণ-বারান্দাওয়ালা ছোট ছোট দু-কামরার একটি মাত্র ঘর। সৈয়দ একটা ঘরের দরজা খুললেন। আশ্চর্য, এই বুনো, একানে, ঠোঁটে-আঙুল দেওয়া চুপ ভিটের ওপর ঘর দুটিতে কেউ সন্ধেবেলাতেই পানি ছিটিয়ে ধুলো মেরে ঝাঁটপাট দিয়ে রেখে গিয়েছে। ভিজে ধুলোর গন্ধ। এককোণে একটা হারিকেন জ্বলছে। তার বাতি কমানো। কাচটা পরিষ্কার ঝকঝকে। ঘরের কোণে একটা খেজুর পাতার চিকন পাটি, সুজনি আর বালিশ। অন্য কোণে খাবার জলের কলসি আর আধময়লা একটা কাঁসার গ্লাস। বাড়িটার বুনো চেহারা, লতাপাতার কাঁচা গন্ধভরা পাতলা অন্ধকারের জন্যে মনে হয়েছিল কেউ এখানে থাকে না। কিন্তু ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ-কেউ হয়তো থাকে কখনো-কখনো। ঘরসংসারের কোনো চিহ্ন নেই, কোনো কোমলতাও নেই, মায়ের আঁচল বিছিয়ে শোওয়ার চিহ্ন নেই, শিশুর পায়ের ছাপও নেই। তামাক বিড়ি-খাওয়া কোনো মানুষ হয়তো কখনো এখানে মাঝে-মাঝে বাস করেছে।
অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। সবুরের দিকে ফিরে সৈয়দ বললেন, আমি এখন যাচ্ছি। এখানে কেউ আসেনি, এই ঘরে থাকেনি – এই হলো কথা। মনে থাকবে? তোমরা কেউ           এ-বাড়ি আসোনি, কোনোদিন থাকোওনি। আজ আর অন্য কোনো ব্যবস্থাই হবে না। কী করব সবুর, উপায় নেই, কাল সকালে দেখা যাবে। বাইরের দরজায় আমি তালা দিয়ে যাচ্ছি, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। হারিকেনটা নিভিয়ে রাখাই ভালো হবে।
সৈয়দের কথাগুলো যেন কতো দূর থেকে আসছে, এখন থেকে যা কিছু ঘটুক না, আমি সবসময়ে বলব এই বাড়িতে শিবানী বলে কোনো মেয়ে কখনো আসেনি, কোনো মেয়েই কখনো আসেনি। সৈয়দ অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেল। বাইরের দরজায় জং-ধরা বড়ো তালা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া গেল।
সবুর জিগ্গেস করল, রাতে কি কিছু খেতেই হবে? ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সবুর। শীতল-পাটিটা মেঝেয় পেতে নিয়েছিল, হারিকেনের বাতিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতক্ষণে সাবিত্রীর মুখ দেখতে পেল সবুর। কথা শুনে সাবিত্রী চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় ঠিকই, তবে সে তার মুখ দেখতে পেয়েছিল কিনা বলা যাবে না। কথার কোনো জবাব সে দেয় না। জবাব পাওনাও নেই সবুরের। রাতে কি কিছু খেতেই হবে? এই কথায় শুধু একবার সবুরের দিকে চেয়ে দেখল সাবিত্রী।
রাত বেড়ে যাওয়ার চম্চম্ আওয়াজ সাবিত্রী কানে শুনছে না কিন্তু বুকের ভিতরে টের পাচ্ছে। একবার শিউরে উঠল সে।
রাতে আর কোনো ঝামেলা হবে না। এখানে আসবে না কেউ। দিনের বেলাতেই দেয়ালঘেরা এই ভিটেয় কেউ আসে না আর এখন তো নিশুতি রাত।
আসলে কী হবে?
সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে যাবে। এ-গাঁয়ের প্রায় সবই হিঁদু। পিটিয়ে লাশ করে ফেলবে।
আমি বামুনের মেয়ে।
তোমার নাম শিবানী সরকার। তুমি কোটালের মেয়ে।
আমি বাঁড়–জ্জে বামুনের মেয়ে।
ও কথা বলা চলবে না। খবরদার।
আবার বলছি আমি বামুনের মেয়ে। আমার কী হবে?
পিটিয়ে পাটপাট করে মাটিতে পুঁতে দেবে।
তোমাকে। তাতে আমার কী?
তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভেবেছো।
আমি বামুনের বাড়ির কন্যে বলছি তো!
তোমার জাত গিয়েছে। তুমি এখন সাত জাত।
খাঁটি বামুনের জাত যায় না।
সবাইকে তাইলে বুঝিয়ো সেই কথা।
আমার কোনো দরকার নেই। যাকে নিয়ে ঘুরছো, ফিরছো, দিনে রাতে শুচ্ছো। সে আবার বেঁচে আছে নাকি যে মরবে? মরবে তুমি, তোমার থাকার জন্যে ভগোবান কি বেবস্থা করবেন তাই ভাবি আমি। হাড়িদিদি তো নেই, থাকলে কখন মুখে নুড়ো জ্বেলে দিত। আঁশবঁটির এককোপে দু-খণ্ড হয়ে এখানে পড়ে থাকতে। ধক্ করে আগুন জ্বলে উঠল সাবিত্রীর দু-চোখে, কী জন্যে কথা বলছ?
হ্যাঁ, আমি এখন শুয়ে পড়ব। একটাই বালিশ – তুমি মাথায় দাও। সবুর বালিশটা একদিকে সরিয়ে দিলো।
আমি এখন শোব না, বালিশ লাগবে না, এই শেতল-পাটিও আমার লাগবে না। আমি আঁচল পেতে মাটিতেই শুয়ে থাকব।
সবুর আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। আলো জ্বালানো যাবে না – বলে সে হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা আঁধারে এমন বুজে গেল যে সাবিত্রী ডান হাতটা দু-চোখের সামনে তার নাকের সঙ্গে ঠেকিয়ে ধরেও কিছু দেখতে পেল না। ঘন ক্বাথের মতো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে, খোলা দরজা দিয়ে বাইরের একটু ফিকে আঁধারও সে দেখতে পেল না। অনেকটা পরে সে বুঝতে পারে খোলা দরজাটা ঠিক কোথায়। ঘরের বাইরের সামান্য সাদা অন্ধকারই তাকে খোলা দরজাটা দেখিয়ে দেয়।
এখুনি কি সে এই ভীষণ ঠান্ডা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়বে? পেটে যে খিদে সেটাও ভালো লাগছে, খিদে বেয়ে যেন শান্তিই নামছে শরীরে। এই হিমঠান্ডাও যে বুকভরা শান্তির সঙ্গে মিশে নেমে যাচ্ছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত! ঘরে আর কেউ নেই, সে একা আছে এখানে। বড়ো একটা পাথর পড়ে থাকা যা, সবুরের এখানে থাকা তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। জ্যান্ত মানুষকে কখনো কখনো কড়কড়ে ঠান্ডা লাশও চেপে ধরে, সাবিত্রী শুতে চাইল না। শাড়ির ওপর আলোয়ানটা – যেটাকে সে কখনো ছাড়েনি – জড়িয়ে ঘরের বাইরে দক্ষিণের বারান্দায় এলো। আসনপিঁড়ি হয়ে বসল চৌকো খুঁটিটায় পিঠ দিয়ে।
পাঁচিরঘেরা উঠোনটা ঝোপঝাড়ে ভরা, অন্ধকার যেখানে পেরেছে সেখানেই ঢুকে চুপ হয়ে আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত বেশি অন্ধকার হয়। প্রতিরাতে চাঁদ উঠতে যতো দেরি হবে, রাতের আকাশ ততোই কালো কুচকুচে পাষাণ হয়ে যাবে। তখন         তারা-নক্ষত্রগুলি  নিষ্ঠুরতা নিয়ে তীব্র ধারালো তীর পাঠায় পৃথিবীর দিকে। সাবিত্রীর চিরকাল মনে হয়েছে তারাভরা আকাশের একটুও দয়া নেই, এবারে জেনে গেছে সাদা জ্যোৎøা আরও নিষ্ঠুর, আরও নির্লজ্জ। ন্যাংটো উদোম সাবিত্রীর দিকে সে আগাগোড়া চেয়েছিল।
আজ চাঁদ উঠবে আরও দেরি করে। খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে-থাকতে আঁধার চোখে খানিকটা সয়ে এলো। ঝোপঝাড়ের দিকে চোখ চলে না বটে তবে ঝাঁকে-ঝাঁকে জোনাকি জ্বলছে যেসব জায়গায়, তাদের জ্বলা-নেভার ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকারের নকশা একবার একবার চোখে পড়ছে বইকি।
নিস্তব্ধতার সংগত শব্দ। শব্দেই স্তব্ধতা নির্দিষ্ট রূপ পায়। একগাদা পেঁচা ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে একসঙ্গে ডেকে উঠল, কতোদূরের কোনো জঙ্গুলে পুকুর থেকে হঠাৎ কোলাহল করে উঠল ডাহুকের দল, মাথার ওপর দিয়ে শনশন শব্দে উড়ে গেল একটা বড়ো বাদুড়, কানে ঝালাপালা ধরিয়ে দিলো ঝিঁঝি পোকাদের ডানাঘষার টানা র্কির্কি আওয়াজ। এরা যেন সবাই সংগতের কাজ করছে।
সাবিত্রী ভাবছিল, মনটা তার এত শান্ত লাগছে কেন? উনুনের গনগনে আগুনে জল ঢেলে দিয়েছে কি কেউ? খুব ঠান্ডা জল, আগুন যাকে একটুও গরম করে তুলতে পারেনি? এরকম মনে হচ্ছে কেন? শুধুমাত্র কয়েকটি দিনরাত্রি পার হয়ে গেল বলে? ছোটবেলায় একবার মুড়ি-ভাজার গরম বালি পড়ে গিয়েছিল তার পায়ে। দগদগে ঘা হয়ে গিয়ে কী যে যন্ত্রণা! যখন আস্তে আস্তে শুকিয়ে গেল ঘা, যন্ত্রণা চলে গেল, ভুলে গেল সে পুড়ে যাওয়ার কথাটাই। এখন একমাত্র দাগটা দেখলে মনে পড়ে কোন যন্ত্রণার দাগ এটা। আসলে যন্ত্রণা ভুলেছে সে, না তার দেহ? দেহে চিহ্ন থাকলেই কষ্ট আছে, না থাকলে নেই। সাবিত্রী ভাবছিল, তাহলে তার পায়ের পাতাই ভুলে গেছে এই ক্ষত। দেহে যখন কিছু থাকে, দেহই সেটা মনে করিয়ে দেয়, দেহ থেকে বিদায় নিলে আর নেই। তার দেহে যা কিছু তাণ্ডব ঘটে গেছে, তাতে তার কী হয়েছে? সে কি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, না, সে যেমন ছিল, যা ছিল, তেমনি আছে, তাই আছে? সেই যে সাবিত্রী সে অটুট আছে, অক্ষত, শুদ্ধ আছে। তার বুকে কামড়ের দাগ আছে, তার ঊরুর ভেতরের দিকে নখের আঁচড়। তার যোনি ছিন্নভিন্ন তছনছ হয়ে গিয়েছিল মাত্র, জঙ্গলের বাঘ এসে একটা থাবায় তার একটা বুক ছিঁড়ে নিয়ে গেলে বা কামড়ে যোনিটাকেই ছিঁড়ে নিয়ে গেল কী হতো তার? পিথিমির যা কিছু যেখানকার তেমনি আছে। সাবিত্রীর মতো তার মন থাকলেও যা, না থাকলেও তাই। কেন সে মরে গিয়েছে মনে করছে, কেনই বা কখনো-কখনো নিজেকে মেরে ফেলতে চাইছে? দুকড়ি কেমন আছে, দাদা কেমন আছে, হাড়িদিদি – আমি হারিয়ে যাওয়ার পরদিন যেমন ছিল, আজও কি তেমনি আছে? নাকি সব সয়ে যাচ্ছে এখন? তারা          কেউ-ই বাঁচা বাদ দেবে না। তাহলে সেই-বা দেবে কেন। বেঁচে-থাকা মানুষ লড়াই করে, প্রতিকার করে, নিরুপায় হয়ে গেলে ঘটনা যা ঘটার ঘটে যায়, আত্মরক্ষা না করতে পারলেও মেনে নেয় না, হার স্বীকার করে না।
দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত চাঁদ উঠল, লাল আলোয় সাবিত্রীর পিথিমি বদলে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। সাবিত্রীও বদলাল, যা ভাবছিল তার হাজাররকম সুতো ভেসে বেড়াতে লাগল, উবে গেল, ফিরে এলো, কিন্তু তাতে সে একটুও উচাটন হলো না।
সকালটাকে বুকের মধ্যে নিল সে বড়ো শান্তির সঙ্গে। আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘেরা উঠোনজুড়ে। পুবদিকের আকাশের একেবারে নিচে একটা গোলক থেকে গোলাপি লাল আলো এই ভূ-ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে, শীতে কুঁকড়ে-যাওয়া লতাপাতা, মরা-মরা ঘাস, ফোঁপরা ধুলোটে মাটি সেই আলো যেন ঝিমঝিম সিমসিম শব্দে শুষে নিচ্ছে। ঘন ঝোপঝাড়ের তলার ঘন ছায়া হালকা হয়ে এসেছে।
তখনই পুব-উত্তর কোণের সবচেয়ে বড়ো কাঁটা জঙ্গলের তলা থেকে বেরিয়ে এলো একটা বেজি। সাবিত্রী দেখল ছোট-ছোট পায়ে দৌড়ে চোখের পলকে সে ঝোপের বাইরে এসেই পেছনের             দু-পায়ের ওপর ভর দিয়ে দু-হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে গেল। এটা সোনালি ছাইরঙের শীতে লোমগুলো কাঁটা হয়ে ছিল, এখন একটু রোদ পুইয়ে নিচ্ছে। একটা চোখের ওপর পড়েছে আলো, ঝিকমিক করছে সেটা। দুই-থাবা জোড় করে দাঁড়িয়েই রয়েছে। তখন সাবিত্রী দেখতে পায় দক্ষিণদিকের দেয়ালের পাশে স্তূপাকার সাদা ফাঁপা মাটির মধ্যে থেকে গম-রঙের বিরাট এক বিষধর সাপ বেরিয়ে এলো। তরতর করে এগিয়ে আসছে সে। আলো ঝলকাচ্ছে তার দেহ থেকে। কে এমন নিঃসাড়ে এগিয়ে আসতে পারে? মৃত্যু কি? তবে সে এত সুন্দর কি? আঁকাবাঁকা ঝরনাস্রোতের চলন তার। এত শীতে তো কখনো বেরোয় না তারা! জমে গেছে, একটু রোদ চাই তার। ঠিক এইসময় চার চোখের মিলন – একই মৃত্যু দুই দিক থেকে। বেজি দেখছে তার দু-চোখ দিয়ে। সাপের চোখের পর্দা কাচের মতোই সাদা – থাকা না থাকা এক কথা। বেজিটা শক্ত হয়ে গেল, সরু ছুঁচলো মুখটা স্থির। একদম ছোট মুখ তো – হাঁ করলে কতো বড়ো হতে পারে? সাপটাও তাকে দেখল হঠাৎ। একটু ইতস্তত করছে বটে কিন্তু সে অতি সামান্য, তখনই ফণা মেলে অর্ধেক শরীর তুলে দাঁড়াল সে। পলক পড়ছে না সাবিত্রীর চোখে। বিশাল ফণাটা দোলাচ্ছে, নিখুঁত মাপমতো ডানে-বাঁয়ে। ফণায় চক্করটা আছে কিনা দেখতে পাচ্ছে না সাবিত্রী। সে দেখতে পাচ্ছে ওর একদিকের চোখ। তাতে খুব ঠান্ডা হিংসা, এই রোদের তাপেও তা স্থির জমাট।
কে বেশি সময় নিল? দারুণ ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে এলো বেজিটা। একেবারে মুখোমুখি। একটুও দেরি করল না সাপ, তীব্র একটা ছোবল বসিয়ে দিলো বেজিটার ঘাড়ে। দেখা গেল না সাপের ছোবল কখন পড়ল, দেখা গেল না বেজি কখন সরে গিয়ে ব্যর্থ করে দিলো সেটা। সাবিত্রী ভগোমানের পিথিমির আশ্চর্যতম ঘটনাটি দেখছে এই জীবনে। সাপের একেবারে গায়ের ওপর বেজি, একটির পর একটি চোখ ধাঁধানো ছোবল পড়ছে তার গায়ে। কখন কীভাবে সে সরে যাচ্ছে দেখতে পাওয়া না গেলেও ছোবল প্রত্যেকটা পড়ছে মাটিতে। বেজি সামনে আসছে, পাশে যাচ্ছে, ঘুরে লেজের দিকে যাচ্ছে, ব্যতিব্যস্ত রাখছে শত্র“কে, ছোবল আর বিষ ফুরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। সাবিত্রী বুঝতে পারল, সেটা বোঝার ক্ষমতা শুধু বেজিটারই আছে, মানুষের তা আয়ত্তে নেই। কখন ক্লান্ত হয়েছে সাপ, বিষের ভাণ্ডার শেষ হয়ে আসছে তার, সমস্ত প্রাণটা একসঙ্গে জড়ো করে শেষ ছোবলটা সে ঠিকই মারল শত্র“র শক্ত খাড়া লোমঢাকা পিঠে। কিন্তু সেখান থেকে মাথা তোলার আগেই একটা লাফ দিয়ে, সাবিত্রী দেখল, বেজিটা তার অত ছোট মুখ দিয়েই কামড়ে ধরেছে       গুটিয়ে-আসা ফণার ঠিক নিচে আর একইসঙ্গে অন্তত পাঁচটা কুণ্ডলী দিয়ে বেজিটাকে পেঁচিয়ে ধরেছে গমরঙা বিষধর। ওইটুকু শরীরের এই বেজিটাকে অতগুলো কুণ্ডলী দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে, পিষে তো ওকে ফেলবেই। সাবিত্রী একেবারে সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াল, বেজির         মরণ-চ্যাঁচানি শুনতে পাবে ভাবল, তবে তখুনি সে দেখতে পেল সাপের মাথা খণ্ড হয়ে মাটিতে পড়ল আর প্রায় দেখাই গেল না যা তা হলো, কুণ্ডলীগুলো খুলে গেল আর সর্পরাজের দেহ চার-পাঁচটা কি ছটা খণ্ড হয়ে মাটিতে পড়ল। চেয়ে দেখল একবার বিজয়ী তারপর এক ছুটে সামনের ঘাসে দুবার মুখ মুছে ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।
সাবিত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছে। পলক পড়ছে না চোখে। নিতম্বের ওপর থেকে তার শরীর বাঁকারেখায় স্থির, বুক সামনের দিকে ঝুঁকে, মাথা আবার সিধে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভের ডগা বেরিয়ে এসেছে। ডান-বাঁয়ে মাথা কি তার সামান্য দুলছে? তা কি বোঝা যায়? সাপিনী যা পারেনি, তা সে পারবেই। সারারাত না ঘুমুনোর কোনো ক্লান্তি তার শরীরে নেই। চাউনি তার স্থির আর হিম।
বাইরের ঘরের তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। সৈয়দ ঢুকছেন, তার পেছনে বাড়ির মাহিন্দার ছেলেটাই হবে, বড়ো একটা খাঞ্চায় খাবার-দাবার নিয়ে আসছে। খাঞ্চা বারান্দায় নামিয়ে রাখতেই চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন সৈয়দ, মুখে একটি কথা বললেন না। সবুর তখনো ঘুমুচ্ছে। সোজা ঘরে ঢুকে সবুরকে ডেকে তুললেন সৈয়দ, নিচু নরম গলায় বললেন, সবুর, দুপুরে কিংবা বৈকালে পুলিশের লোক আসবে খোঁজখবর নিতে। কোনোরকমে সামলাবো। কাল ভোরবেলায় তোমাদের গাঁ ছাড়তে হবে। শুনতে পাচ্ছি এ তল্লাটের হিন্দুরা কানাঘুষো করছে। হিন্দুসমাজের বড়ো-বড়ো সব নেতা ভদ্দরলোকেরা সাধারণ মানুষদের খুব তাতাচ্ছে। একটা ছোট্ট ঘটনাও যদি ঘটে যায়, আগুন ছড়িয়ে যাবে গোটা তল্লাটে। আমাকে সবদিক সামলাতে হবে। তোমাকে একটু ভালোবাসি, তোমাকেও বাঁচাতে হবে। পারব কিনা জানি না। যদি পারি তাহলেও আমাকে অপরাধী হয়ে দগ্ধাতে হবে। খুব-খুব নোংরা কাজ করেছ – এই এলাকাটাকে ডুবিয়েছ তুমি। তোমাকে আমি বাঁচাতেও চাই, তোমার শাস্তি হোক, তা-ও চাই। বদমাইশ ছেলে তুমি। যাই হোক সকাল এখনো হয়নি ভালো করে, গাঁয়ের লোকজন উঠে পড়ার আগেই, সবার চোখ এড়িয়ে ধারসোনায় ফিরে যাও। সারাদিন বেশারতুল্লার বাড়িতে থাকবে, কোথাও যাবে না। রাত থাকতে-থাকতেই চলে আসবে এখানে। ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। আমি বর্ধমান পর্যন্ত যাবো তোমার সঙ্গে, বড়ো লাইনের ট্রেনে তোমাকে তুলে দোব। তারপর কোন চুলোয় যাবে আমি জানি না। তোমাদের সঙ্গে কাটান-ছিটেন।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল সবুর। একটা কথা বলার সাহস পেল না। সৈয়দ চুপ করলে সে কাঁচুমাচু হয়ে জিগ্গেস করল, কোথা যাব সয়েদ সায়েব?
দূর হও, উচ্ছন্নে যাও।
সয়েদ সায়েব, তাইলে কলকাতার দিকেই যাই। টাকা-পয়সা খুব নাই। কলকাতায় কোথা যাবো?
মুসাফিরখানা চলে যাও। চিৎপুর রোডে খুব বড়ো মুসাফিরখানা আছে। মিছে কথা-টথা বলে সেখানে থাকো গা। আর কী বলব আমি? আমাকে এখন দাঙ্গা সামলাতে হবে। যাও, এখুনি ধারসোনা চলে যাও।
মেয়েটা? শিবানী কোথা থাকবে?
ফের শিবানী? একটি চড়ে তোমার দাঁতকপাটি খুলে দোব হারামজাদা। মেয়েটা এখানেই থাকবে। কোনোরকমে রাতটা লুকিয়ে রাখব ওকে।
যেমন ছিল তেমনি বেরিয়ে গেল সবুর। সাবিত্রীর দিকে একবার ফিরে তাকাল না। সে চলে গেলে সাবিত্রীকে সৈয়দ বললেন, তোমার নাম শিবানী নয়, তুমি কোটালের মেয়েও নও। আমি জানি তুমি বামুনের মেয়ে। আমাকে তোমার আসল নাম বলো।
সাবিত্রী – লোকটার চোখে কী দেখতে পেয়েছে সাবিত্রী। একটু অবাক চোখে সে চেয়ে রইল।
সবকিছু না জানলেও অনেকটাই আমি জানি। আমার এখন কিছু কাজ আছে। দেখছি, কী করতে পারি। সকালের জলখাবার খেয়ে নাও। তারপর ঘরে দোর দিয়ে ভেতরে থাকবে। বেরোবে না ঘরের বাইরে। দুপুর, রাতের খাবার আমি পাঠিয়ে দোব। একজন মানুষ এসে দিয়ে যাবে। চিড়ে মুড়ি গুড় মিষ্টি দুধ কলা এসব খেতে তো তোমার আপত্তি নেই! রান্না-করা খাবার আমি পাঠাব না। আর একটিও বাড়তি কথা না বলে সৈয়দ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভাঙা দরজায় মরচে-ধরা তালা পড়ল।
সব ঠিকঠাক খেয়ে নিয়েছিল সাবিত্রী। কতোদিন পরে আবার সে খাবারের স্বাদ পেল। মিষ্টিকে মিষ্টি, নোনতাকে নোনতা লাগল। থালায় খাবার মণ্ড পাকিয়ে ভারি তৃপ্তির সঙ্গে খেল মুড়ি বাতাসা দুধ। দুপুরে রাতে আবার এই খাবারই আসবে ভেবে খুশি হলো। উঃ এতদিনে আমি আমি। শরীরের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছি। এখন কষ্টটা উড়ে বেড়াচ্ছে না, ভেসে বেড়াচ্ছে না। ছুঁতে পারছি না, ধরতে পারছি না, এমন মনে হচ্ছে না। আমি স্থির হয়েছি, যা যেমন তেমনি লাগছে। সাবিত্রী সদ্য যুবতী, অথচ তার নিজের রসভাণ্ডারের কোনো স্বাদ পায়নি, এরই মধ্যে পেয়ে গেছে জরতীর জীবন, তবু সে কোথাও হয়তো নিশ্চিত জানে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে যে কচি গাছ, সে শুকিয়ে জ্বালানি কাঠ হতে-হতে শুধুমাত্র মাটিতে পড়ে থাকার সুযোগ পেলেও আবার তার শুকনো ডালে নতুন পাতা দেখা দিতে পারে।

ফাল্গুনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। তাতে কী হয়েছে? বাতাসে কী আছে? কিছুই যদি না থাকবে তাহলে পাড়াগাঁয়ে হলুদের গন্ধমাখা, বিয়ের জল-লাগা ভরা-যুবতী বউমানুষ সন্ধের সময় বাড়ির ভেতরের তালগাছের তলায় দুটো ইটের ওপর বসবে-বসবে করছে, এইসময় তালগাছের পাতা খড়খড় করে উঠল, ফাল্গুনের একটা দমকা বাতাস দুম করে নেমে এলো। বউটি বিকট চিৎকার করে চোখ কপালে তুলে দাঁতকপাটি লাগিয়ে দড়াম করে মাটিতে পড়ল কেন। বাতাস লেগেছে।
দুপুরে পুলিশের লোক এলো সৈয়দের সঙ্গে। তখন একটুও বাতাস ছিল না। ঝিমঝিম করছিল পড়ন্ত বিকেল। দারোগাদের খুব ভুঁড়ি থাকে – মোষের চামড়ার বেল্টেও আটকানো যায় না, উপচে পড়তে থাকে। মনে হয় কোনো কিছু দিয়ে একবার ফাটিয়ে দিতে পারলেই খাট পালঙ্ক বালিশ বিছানা কোর্মা-কালিয়া বেরিয়ে আসবে। এই পুলিশের একদম ভুঁড়ি নেই, মেজো বা ছোট দারোগা বোধহয়। বেশ মানানসই খাকি পরনে, ভয়ঙ্কর চামড়ার জুতো, খাকি মোজা, হাতে একটা ছোট লাঠি। উঠোন পেরিয়ে ঘরের বারান্দার কাছে এলো তারা। সৈয়দ কথা বলছেন দারোগার সঙ্গে। মুখ একেবারে ছাঁচা-বোঁছা, কাঁচুমাচু বিব্রত হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। একই নিচু গলায় পরিষ্কার কথা বলছেন। সাবিত্রী সব কথাই শুনতে পাচ্ছে।
দায়িত্ব তাহলে আপনার ঘাড়ে? সৈয়দ জিগ্গেস করলেন।
তা বলতে পারেন। এসআই নিজেই আসতেন। শেষ পর্যন্ত পাঠালেন আমাকেই। চারদিকের অবস্থা এখন নাজুক। ঠোকাঠুকি হলেই আগুন জ্বলবে। আমি তো মুসলমানের ছেলে, বুঝতে পারছি সবই। ভালো কিছু হলে আমাদের সবারই ভাগে কিছু-কিছু জুটবে, নাহলে কিন্তু সমূলে নিপাত। দাঁড়ান, লিখে নিই আপনার কথা। কোনোদিন দরকার পড়লে আদালতে আবার এই কাগজই যাবে কিন্তু। হ্যাঁ, বলুন।
আপনি কী জানতে চান সেটা আগে বলুন। তবে তো জবাব পাবেন।
একটি মেয়ে হারিয়েছে এই এলাকায়। জোর করে তাকে বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়েছে। বামুনের মেয়ে, সদ্য বিয়ে হয়েছে।
হ্যাঁ।
তার ঠিক নামটা কী – কোন গাঁয়ের মেয়ে, কারা তাকে ধরে এনেছে এসব খবর শিগগিরই আমাদের মিলে যাবে। আপনি এ ব্যাপারে কী জানেন।
হ্যাঁ, জানি। এই মেয়ে কিনা জানি না। পরশুদিন ইউনিয়ন বোর্ডের কাজে একটু ধারসোনা যেতে হয়েছিল। সেখানে বেশারতুল্লার বাড়িতে একটি মেয়েকে দেখেছি। তার নাম জানি না।
কোনো সন্দেহ হলো না আপনার।
অত সন্দেহ বাতিক থাকলে সাধারণ গেরস্থ বাড়িতে যাওয়া যায় না মশাই।
কিন্তু এখন যে একটু সন্দেহ-টন্দেহ করতেই হবে সৈয়দ সাহেব। আপনি আবার এই এলাকার প্রতিনিধি – অভিভাবক। লোকে আপনার কাছে আসবেই।
সে তো একশবার।
দারোগা কথা বলছিলেন, শুনছিলেন আর মাঝে-মাঝে কাগজে কী লিখছিলেন।
এটা কি আপনার বাগানবাড়ি।
ছি-ছি, কী বলছেন দারোগা সাহেব! বাগানবাড়ি আবার কি। সবজিবাগান বলতে পারেন। এখানে বাদুড়-চামচিকেরাই থাকে।
তা বটে সৈয়দ সাহেব। এই ঘরটিতে কে থাকে?
কেউ থাকে না। মক্তবের ওস্তাদজি থাকতেন। এখন তিনি বাড়িতে। ঘর তালাবন্ধ আছে।
দারোগা জানলার দিকে এগিয়ে এলেন। সাবিত্রী চট করে ঘরের এক কোণে অন্ধকারের আড়ালে সরে গেল।
তালা-টালা মাঝে মাঝে খোলেন মনে হচ্ছে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
মাঝে মাঝে করতেই হয়।
আচ্ছা, এক কাজ করুন সৈয়দ সাহেব।
বলুন।
এ-বাড়িতে যে কেউ থাকে না সে তো স্বচক্ষে দেখে গেলাম। আপনি বরং ধারসোনায় যা দেখেছিলেন সেটা একটু লিখে দিন। এটা কাজে লাগবে। আপনি নিজের হাতে দুটো কপি করুন, একটা আপনি রাখুন আর একটা আমাকে দিন।
সে আমি আগেই লিখে রেখেছি। দিচ্ছি আপনাকে। সৈয়দ সাহেব ফুলশার্টের বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন। সাবিত্রী দেখতে পেল কাগজটার সঙ্গে কড়কড়ে ক-টা নোট দারোগা সাহেবের আনমনা বাঁ-হাতের তালুতে জমা হলো।
সন্ধের বাতাসটা আবার বইছে। সারাদিনের এলোমেলো বাতাস নয়। এখন দক্ষিণ দিক থেকে টানা বাতাস। ঝরঝর করে হলুদ পাতা ঝরছে। সাবিত্রী ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে বসেছে। দুপুরেই রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছে। আর কেউ আসবে না এখানে। রাতটা কি তাহলে তাকে একলাই থাকতে হবে এই ঘরে? এত শনশন বাতাসের মধ্যে? এত ঝরা হলুদ পাতার মধ্যে? সে কি চায় কেউ একজন আসুক এই ছিলছিলে আলোভরা অন্ধকারে। যদি কোনোরকমে হাড়িদিদি এসে পড়ে? যে মায়ের মুখ দেখেনি কখনো সেই মা এসে পড়ে? কলকাতা থেকে দুকড়ি এসে পড়ে? গা গুলিয়ে উঠল তার। পিথিমির মদ্দা কোনো শুয়োর যেন তার কাছে না আসে!
রাত আর একটুখানি গড়ালে সাবিত্রী উঠে গিয়ে হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিয়ে বাতিটা কমাতেই থাকল যতোক্ষণ না এক ফোঁটা নীল আলো ঘরের অন্ধকারে টানা কাঁপছে। তারপর সে দুটো বাতাসা খেল, কাঁসার গেলাসে একগ্লাস জল খেল, ঠিক করল রাতে আর সে কিছু খাবে না, বারান্দায় বসে রাতটা কাটিয়ে দেবে। একবার হিসেব নিতেই হবে কতোটা বেঁচে আছে সে এখনো! এটুকু পুঁজি করে আর একদণ্ডও বাঁচা যাবে কিনা? সাবিত্রী ঘরের দরজাটা আলতো করে ঠেসিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দক্ষিণমুখো হয়ে বসল। আঁচল বুকের কাছে জড়ো, হাতদুটো কোলের ওপর।
অনেকগুলো পেঁচা একসঙ্গে ডেকে না উঠলে আর নিঃশব্দে উড়ে এসে গাছপালার মধ্যে বাদুড় বসার শব্দ না পেলে রাত বেশি হয়েছে বলে কিছুতেই মনে হয় না। কাছের মাঠকোঠার খড়ের চালের মরকোচা থেকে গুচ্ছের কালপেঁচার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ এলো, পেয়ারা গাছে বাদুড় বসল তার শব্দ এলো, তা সাবিত্রীর খেয়াল হয়নি কিন্তু তখুনি যে বাইরের দরজার তালা খোলার আওয়াজ এলো তা যেন বাজপড়ার মতো ফেটে পড়ল তার কানে। কে আসবে এখন এখানে? সবুর ধারসোনায়, সে আসবে ভোররাতে। তাহলে আর কে আসবে এখন? যে এলো তার হাতে টর্চ ছিল, দু-একবার জ্বালিয়ে পথ দেখে নিচ্ছিল কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছিল না। একেবারে কাছে এসে পড়লে সাবিত্রী দেখল সৈয়দ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনে। হ্যাঁ সৈয়দই। কাছে এসে আর টর্চ জ্বাললেন না। মুখ দেখা গেল না তাঁর।
সাবিত্রীর দিকে একটু ঝুঁকে জিগ্গেস করলেন সৈয়দ, আজ রাতটা তোমাকে একা থাকতে হবে এখানে। একটু খবর নিতে এলাম। ভয় করবে না তো তোমার?
চেষ্টা করেও সাবিত্রী সৈয়দের মুখ দেখতে পেল না। একেবারে আবছা। মুখের উঁচুনিচু জায়গাগুলোয় অন্ধকার জমা। চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখ দেখতে না পারলে আদৌ মানুষ কথা বলছে কিনা বুঝতে পারা যায় না। আকাশে ছিলছিলে আঁধার, ফাল্গুনের আকাশে এখনো রং ফোটেনি, আকাশ কুয়াশায় ঢাকা, তারা কম দেখা যাচ্ছে। তবে যেভাবে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন সৈয়দ, জবাব দিতে দেরি করা গেল না।
না, ভয় করবে না। করলেই বা কী? সাবিত্রী নিচু গলায় বলল।
দ্যাখো মেয়ে আমি তোমার নাম জানি। বোধহয় এখন আমি সবই জানি। কানে এসেছে আমার। তুমি বামুনের মেয়ে, মাত্তর কদিন আগে বিয়ে হয়েছে। কারা এই জানোয়ারের কাজ করেছে, তাদের দু-একজনের নাম জানতে পেরেছি, সবুরের নাম তো জানিই। কিন্তু আমি বলছি মেয়ে – যা হয়েছে তার তো আর কোনো চারা নাই, এমনকি এখনও তোমাকে আমি বাঁচাতে পারব না। ভয়ানক সর্বনাশ হবে এই এলাকার আমি জানি। খুনোখুনি লেগে গেল বলে। আমার ঘাড়ে জোয়াল চাপানো। কথা বলতে বলতে সৈয়দ ঝুঁকে এলেন সাবিত্রীর মুখের দিকে। মনে হয় তাঁরও দরকার ছিল এই মেয়ের চোখ দুটি দেখতে পাওয়া। সেখানে যদি একটুখানি নির্ভরতার প্রার্থনা মেলে! কিন্তু অন্ধকার তো সেখানেও। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কিছু পেলেন  না সৈয়দ। আমি এখুনি চলে যাবো। আজ ভোররাতেই তোমাকে রওনা করিয়ে দিতে হবে তোমাদের কথায় সোজা নরকের রাস্তায়। তোমাকে ওরা এই পর্যন্ত এনেছে। এখন আর আমার কিছু করার নাই। বরং একটু দায়ভাগীই হচ্ছি। থাকো তুমি রাতটুকু এখানে। আমি যাচ্ছি। আরও একটু ঝুঁকে এলেন সৈয়দ সাবিত্রীর মুখের দিকে। তার চোখদুটিকে দেখা ওঁর খুব দরকার। তাহলে কিছু সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারত।
বাতাসটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে এলো। ধুলো ঝেঁটিয়ে নিয়ে আসছে এদিকে। শুকনো ঝরাপাতা কিছু খড়খড় করে উড়ে এসে ওদের গায়ে পড়ল। সৈয়দের চোখেও লাগল বালির ঝাপটা। মেয়ের চোখ দেখা তো দূরের কথা – কিছুক্ষণের জন্যে তিনিও পুরোপুরি অন্ধ। এই অবস্থাতেই সাবিত্রী ফিরছে। কতোদূর থেকে এক অমানুষিক কণ্ঠ জিগ্গেস করছে, আমি কোথা যাব?
আমি জানি না।
তুমি পাঠাচ্ছ, তুমি জানো না? ভগোমানের দোহাই, আমাকে বলো আমি কোথা যাচ্ছি।
তোমাকে, তোমাদের সবাইকে একদম লুকিয়ে ফেলা দরকার। পারলে সবটাকে গুম-খুন করে ফেলতাম।
অন্ধকারের মধ্যেই সিধে হয়ে বসল সাবিত্রী, ব্যগ্র হয়ে বলল, তাই করো, তাই করো, ভগোমানের দোহাই তাই করো। তোমার কোনো পাপ হবে না। এইটুকুনি জীবনে যে পুণ্যি করেছি, সব তোমাকে দিয়ে যাবো। হায় ভগোমান পিথিমিতে মেয়েমানুষ কেন জন্মায়!
সৈয়দ ফিরলেন। আবার খুব কাছে ঘেঁসে দাঁড়ালেন সাবিত্রীর। এবার খুব শান্ত গলায় বলল সাবিত্রী, আমাকে কোথা পাঠাবে?
হয়তো কলকাতা-টলকাতা হবে। তারপর আমি জানি না। সত্যিই জানি না।
আর কোনোদিন গাঁয়ে ফিরব না?
বলতে পারি না। কী করে বলব বলো?
শ্রীকেষ্টপুর আর কোনোদিন দেখব না? আমার ভগোমানের দোহাই তোমাকে, আমাকে এইখানেই মেরে ফেল। যেমন করে তোমাদের খুশি। কেটে কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, বিষ খাইয়ে, জলে ডুবিয়ে যেমন করে খুশি। সে তোমাদের হত্যা হবে না; শুধু মরাকে আবার মারা হবে।
সৈয়দ চুপ করে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পর আরেকবার কঁকিয়ে উঠল সাবিত্রী, একবার হাড়িদিদির কোলে যেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
হাড়িদিদি কে? তোমার মা-বাবা নাই?
না।
খানিক আগে তোমাকে বলছিলাম, আমি তোমার সব জানি না, আসলে আমি কিছু জানি না। তুমি কেমন করে এইরকম তার কিছুই জানা নাই আমার। জানার ইচ্ছেও নাই আমার, মেয়ে! ভুঁইচাঁপা চেন? কোথাও কিছু নাই, হঠাৎ একদিন গোটাগুটি একটা গাছ আর লকলকে ডাঁটার ওপর তাজা একটা ফুল! ওইটুকুই, একদিনের জন্যেই।
তোমাদের ভদ্দরলোকদের কথা আমরা কোনোদিন বুঝতে পারি না, বুঝতে চাই-ও না। তোমরা যা চাও, তা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারি। ভদ্দরলোকদের কথা আমরা ধরি না। ফের দোহাই, আমাকে আজ রাতেই মেরে ফেলে পুঁতে দাও। সবুরকে বললে সে ঠিকই করে ফেলবে কাজটা।
করবে না, তার বাবারও তা সাধ্যি নাই।
আগুন লেগেছে সাবিত্রীর দু-চোখে। চোখের জল এত গরম, এতই জ্বলুনি তার। কোনো শব্দ বের হলো না গলা থেকে। সমস্ত জলটা পুড়ে গেল চোখের মধ্যেই, একফোঁটা গড়িয়ে পড়ল না।
আমাকে একটু নাহয় বললে তোমার কথা – সৈয়দ বসে পড়লেন সাবিত্রীর পাশে। আবার চেষ্টা করলেন তার চোখদুটি দেখতে। বাতাস এলোমেলো হয়ে উঠেছে, ধুলোবালির ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। কী কাজে একটা চামচিকে বেরিয়ে এসেছে কোথা থেকে। পোকা-টোকা ধরতে বোধহয়। কী গেরো! বারবার ওদের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে সেটা। সৈয়দ হাতটা একটু তুলে রাখেন চামচিকের আক্রমণ ঠেকানোর মতো করে।
তোমার মা নেই?
না। শুকনো কাঠ-কাঠ গলায় বলল সাবিত্রী। সৈয়দ যেন শুনল কোনোদিন ছিল না।
মা ছাড়া কেউ থাকে? এই মেয়ে, আমাকে বলো কী হয়েছিল তোমার মায়ের?
খুব অনেয্য একটা কাজ করেছিল মা। সে আর একটু আগে মরলে আমি জন্মাতাম না। ওই আবাগী তা না করে আমাকে পিথিমিতে জম্মো দিয়েই মরে গেল।
কথা নেই বার্তা নেই শুকনো জমিতে গজিয়ে উঠেছে লকলকে একটি চারা, তার মাথায় একটি ফুটন্ত ফুল। জন্মবৃত্তান্ত জানা নেই, ব্রাহ্মণী মরার আগে শেষ ধাক্কাটা এত জোরে দিয়েছিল যে মেয়ে ছিটকে পড়েছিল দূরে। নাড়ি প্রায় ছেঁড়ে-ছেঁড়ে আপনা-আপনিই, হাড়ি-দাইমা তখনই তুলে নেয় তাকে।
তোমাকে দাইমা বড়ো করে তুলেছিল? চামচিকেটা এখনো জ্বালাচ্ছে। সৈয়দ হাতটা তুলেই আছে। বিচ্ছিরি কর্কশ গলায় ক্যাঁচক্যাঁচ করে আরেকবার চেঁচিয়ে উঠল পেঁচাগুলো।
তার কাছে কতোটা বড়ো হয়েছি তা আমি জানি না। কোনোরকমে মুখটা শুধু মনে পড়ে। মায়ের সাথে-সাথে তার ধর ছিল, সে-ও আমাকে ফেলে পালালে।
মনে হয় সাবিত্রীর ভেতরের তাপ কমে আসছিল। প্রথম  বসন্তের ঠান্ডা বাতাসেও একটু-আধটু ওম জমতে শুরু করেছিল। অন্ধকারটাও খানিকটা ফিকে হয়ে এলো। এখন একমন দিয়ে চেয়ে থাকলে সৈয়দ তার চোখ দেখতে পারবেন, ইচ্ছে হলে সাবিত্রীও সৈয়দের চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারবে।
মা নাই তা বুঝতে পারছি, বাপ ভাই তো আছে।
বাপ ছিল, এখন নাই। দাদা একটা আছে। সে দিনে রাতে কখন বাড়িতে থাকে বুঝতে পারতাম না। বাপও মায়েরই মতোন আর একটা অনেয্য কাজ করে পিথিমি ছেড়েছে।
সৈয়দ প্রশ্ন করল না, কারণ জিজ্ঞাসা নিয়ে সাবিত্রীর চোখের দিকে চেয়ে থাকা এখন সম্ভব ছিল।
সাত-আট বছরে আমার একটা বিয়ে দিয়ে সে-ও মায়ের পথে গেল।
আমি শুনেছি বটে তোমার বিয়ে হয়েছে। তাহলে?
তাহলে আবার কি? ডাগর না হলে বউ নেবে কে? পরের গাছে ডাঁসাবে, তবে তো খাবে? হাড়িদিদি – ও হাড়িদিদি – ভেঙেচুরে কঁকিয়ে উঠল সাবিত্রী, দাইমা তার মেয়ে হাড়িদিদির কাছে আমাকে ফেলে দিয়েছিল গো! সে আমাকে তুলে নিয়ে কোলে রাখে, বুকে রাখে, আঁচলে বেঁধে রাখে। আমি হতভাগী তার আঁচল খুলে বেরিয়ে আসি, ওঃ ভগোমান –
সৈয়দ তার জ্বালাভরা চোখ দিয়ে সাবিত্রীর চোখদুটিকে অল্প আঁচে ননির মতো গলে যেতে দেখে। সেই আঁচে সেও গলতে থাকে। হাড়িদিদি কেমন?
হাড়িদিদি সাদা কাপড় পরে। অন্ধকারে ফুটে থাকে, আলোতে ঝকঝক করে। গায়ের রং তার জমাট কালো, তার নাক ছোট, দাঁতের জায়গায় মুক্তো আছে, তার মাই থেকে কখনো দুধ গড়ায়নি। স্বামীর কাছে এক বছর থেকে ফিরে আসে। স্বামী মানুষটা কলেরায় মরে গেলে, বুকদুটো সে শক্ত করে বেঁধে নেয়, সাবিত্রীকে সেখানেই রাখে সে। তার বিয়ের পর থেকে আট বছর ধরে। তারপর কলকাতার মুদিদোকানের কর্মচারী সাবিত্রীর স্বামী মানুষটা যে রাতে আসবে, সেই সন্ধেতে সে বেরিয়ে এসেছিল কী ঘটতে পারে তার কিছুই না জেনে।
একটা চামচিকে থপ করে মেঝেতে এসে পড়ল। ওদের রকমই এমন। উড়তে-উড়তে হঠাৎ মরার মতো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। কলাবাদুড়ের কলা! সৈয়দ জানেন ওকে মাটি থেকে তুললেই জ্যান্ত হয়ে হাত ফস্কে আবার উড়ে যাবে। কেন খানিকক্ষণের জন্যে ওরা মারা পড়ে? সৈয়দ আর এখানে থাকতে পারেন না, অতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। থাকুক এই মেয়ে এখানে, সে এখন বাড়ি যাবে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই টের পান তাঁর ডান হাত সাবিত্রীর একটা হাত মুঠো করে ধরে আছে। সৈয়দ ভীষণ অবাক, আমি কখনোই এই মেয়ের হাত ধরিনি, ধরতে পারিই না। কিন্তু তিনি জানতেই পারলেন না মুঠো খুলে নেননি, ধরেই আছেন এক সকালের ভুঁইচাঁপা, ভূমিচম্পা, আকাশ থেকে নেমে আসা, আবার আকাশেই মিলিয়ে যাওয়া। কখন সৈয়দ বসে পড়েছেন সাবিত্রীর পাশে। এবার অনেকটা কাছ ঘেঁষে। এখন তাঁর সামনে এলোমেলো ছবি, এলোমেলো বাতাস। একটিমাত্র ফুলের মাথানাড়া, একটিমাত্র টুকরো লাল আকাশ। বিভ্রম কি কাটাতে চেষ্টা করেন সৈয়দ – এ কী করছেন তিনি, এত কাছে বসে পড়েছেন এই মেয়ের? কী অসম্ভব কটু একটা গন্ধ আসছে ওর গা থেকে! ওঁর স্ত্রীর ঋতুস্রাবের         পরে-পরেই এরকম গন্ধ আসত। কটু বিশ্রী তো বটেই, আবার তারই মধ্যে ডুবে-থাকার ইচ্ছেও; দুপুরের তাড়ির নেশার মতো ঘোর। এই যে এখন মেটে গন্ধ, ভাঁটফুলের কড়া গন্ধ, মাটির গন্ধ, আকন্দের গন্ধ, আবার ভীষণ শিউরে ওঠা, এই যে, এ যে তারই বাড়ি, সামান্য তঞ্চকতা করে কেনা, এখানে বাস করবে কোনোদিন কি – এই মেয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রথম যেদিন রমণ জানবে, ঠিক সেদিন সন্ধেতেই একটা জানোয়ারের দল তাকে তুলে এনেছে, খোলা আকাশের তলায়, কাঁটাজঙ্গলের মধ্যে, অজয়ের বুকের শুকনো বালির বিছানায় কেবলি বলাৎকার করেছে, তারপর সবচেয়ে উজবুক জানোয়ারটার ঘাড়ে তাকে চাপিয়ে দিয়ে সরে পড়েছে। এখন হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে, ফিন্কি-দিয়ে ছুটে আসা রক্ত সরাসরি চোখের দিকে ছুটে আসছে। খুব ছোট হলেও এই এলাকার হাকিম তিনি, টুপি বন্দুক বেতের লাঠি আছে তাঁর। একটা ফুলকে পায়ে মাড়িয়ে থ্যাঁতলা করে ধুলোবালির মধ্যে গুঁড়ে ফেলেছেন। শাস্তি হবে না? ছাড়ান পেয়ে যাবেন? যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে সৈয়দের মাথা।
এক গোছা সুতোর টানেই যেন সাবিত্রীর দিকে অনেকটা ঝুঁকে এলেন সৈয়দ। চোখ-টোখ কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করলেন তার মুখ। কেমন আছে মেয়েটা এখন? তার কি আবার মরণশ্বাস উঠেছে? কিছুতেই তার মুখ দেখতে পেলেন না সৈয়দ। নিজেই তো কিছু দেখছিলেন না। সামনের ছবির জগৎটা এখন লেপা, ধূসর কালো পর্দা ঝোলানো। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বজ্রমুঠিতে তখনো ধরে আছেন সাবিত্রীর হাত। এক পা এক পা করে এগোলেন ঘরের দিকে। সেখানে হারিকেনের মোলায়েম আলো, মেঝেয় শীতল পাটিটা বিছানোই আছে। ঘরে গিয়েই সাবিত্রীর হাতটা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। কাঁধে হাত রেখে তিনি তাকে বসাচ্ছেন শীতল পাটির ওপর, নিজেও বসেছেন একটু দূরে, পা দিয়ে দরজাটা আর একটু ভেজিয়ে দিয়েছেন।
নিস্তব্ধতার ভীষণ শব্দ ভেসে এলো এখন। সাবিত্রীকে এখন আর প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। সৈয়দের পাশে শুধুমাত্র একটা নেতি শূন্যতা। কী জানেন সৈয়দ, কী ভাবতে পারেন, কী চিন্তা তাঁর,  রুচি-পছন্দ কেমন! গাঁয়ের ভদ্রলোক, মহামান্য সরকারের বশংবদ, স্কুলের গণ্ডিটাও পেরোতে পারেননি। সবচেয়ে ভালোবেসে এসেছেন নিজেকে। অবস্থাপন্ন সৈয়দ হয়ে উঠেছেন। গাঁ-অঞ্চলের একজন ভদ্রলোক বলে গণ্য এখন। চাষাভুষোদের থেকে তফাত একটু হলেও অন্তত খানিকটা আছে। বড়ো বড়ো করে কামড় দিয়ে হাম হাম করে গেলেন না কিছু – তারিয়ে-তারিয়ে চেখে-চেখে খান, সুখাদ্য মুখে নিয়ে ধীরে-সুস্থে ধীরে স্বাদ নিতে থাকেন। অন্তত কখনো-কখনো ভাবতে পারেন তাঁর ভেতরে একটা জন্তুও আছে। কখনো কোনো সময়ে ভেবে উঠতে পারেন সকালে হাত-মুখ ধুতে বসে ফুলন্ত নিমগাছটার দিকে চেয়ে যে, কখনো তিনি রমণ করেননি, সারাজীবনে একবারও না, স্ত্রীকে গর্ভবতী করেছেন মাত্র, জড়ায়ু খালি থাকলে মস্ত ষাঁড়টি যেসব করে। তাঁর মধ্যে জন্তু নেই? অনেক জন্তু, অনেক সাপখোপ তাঁর মধ্যে।
সৈয়দ দেখতে পেলেন তাঁর পাশের নেতি-শূন্যতাটি আলোয় পূর্ণ হচ্ছে। বুঝতে পারলেন বাতাস বন্ধ হয়েছে, পাতা ঝরছে না, বাইরেটা শব্দহীন, হারিকেনের বাতিটাও অকম্প। কে এখন তাঁর পাশে। ঘন ঘন ব্যবহারে মলিন বিপর্যস্ত এই মেয়েটি কে হতে পারে তাঁর। তাকে কন্যার ভূমিকা দিয়ে দ্যাখে হ্যাঁ, মেলে, মায়ের ভূমিকাতেও মানিয়ে যায় তাকে, বোন হিসেবেও দেখা চলে। কেউ নয়, কিছু নয়, দিঘির মাঝখানে একা অনপেক্ষ নির্জন একটি পদ্ম।
সৈয়দের মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে। এমন অবয়বহীন আগন্তুক অচেনা ভাবনা কোথা থেকে আসে! অচেতনার তলা থেকে, না অস্তিত্বের মধ্যে থেকে? সৈয়দ সাবিত্রীর হাত ছেড়ে দেন, দু-হাত বাড়ান। পদ্মটিকে কাছে টেনে আনার জন্য, বিছের তীব্র কামড়ের যেন মর্ম ছিঁড়ে দেয় একটা চিন্তা! কী আছে মেয়েমানুষের দেহে? কী আলাদা, কী তফাত? দুটি নরম মাংসপিণ্ড আর তার দেহে ঢোকার জন্যে একটি দরজা ছাড়া! পদ্মকে পেতে গেলে সেখানে কি ঢুকতেই হবে? বাড়ানো দুহাত দিয়ে তিনি সাবিত্রীর কালো কোঁকড়া রুখু চুলেভরা মাথাটা বুকে টেনে আনেন, আলো আরও একটু কমান, ধীরে-ধীরে শ্বাস টেনে প্রাণপণে এই পৃথিবীর বাতাস বুক ভরে নেন। শেষে নমনীয় লতানো একটি দেহের ওপর শুয়ে পড়েন। তারপর।

[আমি আমার নাম বলিতে যাইতেছি, এই সময় সবুর বলিল, আমার নাম শিবানী সরকার। আমি কিছু বলিলাম না। সবুর নিচু গলায় কথা বলিতেছিল, সৈয়দ তখন কিছু লিখিয়া লইলেন। রাত্রে সবুর এবং বেশারতুল্লা আমাকে বাড়ি হইতে বাহির করিয়া আনিল। পথে সৈয়দ আমাদের সহিত যোগ দিলেন। বেশারতুল্লা বাড়ি ফিরিয়া গেল এবং সবুর ও সৈয়দ আমাকে ধান্যগ্রামে লইয়া গিয়া সেখানে একটি ঘরে রাখিয়া দিলো। সাত হইতে আটদিন সেখানে আমি ছিলাম। হয় সবুর, নাহয় সৈয়দ আমার সহিত ঘুমাইত। দুজনেই আমাকে বলাৎকার করিত। সৈয়দ আমাকে মুড়ি দুধ মিষ্টি পাঠাইত। সেখানে এক রাত্রে কাটোয়া হইতে একজন হাকিম আসিলেন। তখন আমার সহিত সবুর ঘরের মধ্যে ছিল। ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করা ছিল। হাকিম বন্ধ দরজায় ঠেলা দিলেন। জানালা দিয়া আমি হাকিমকে দেখিলাম, তাঁহার একটি চক্ষু ট্যারা ছিল, গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ। তিনি হ্যাট ও কোট পরিয়া ছিলেন। সৈয়দ তাঁহার সহিত ছিলেন। হাকিম তাঁহাকে বলিলেন, লোকেরা আমাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। অন্যত্র সরাইয়া লওয়া প্রয়োজন।
হাকিম চলিয়া গেলে সৈয়দ আবার আসিলেন। সবুর দরজা খুলিয়া দিলো। সবুর বলিল, সে দরজা খোলে নাই পাছে আমাকে এখান হইতে লইয়া যায় বলিয়া। সৈয়দ বলিলেন, হাকিম বলিয়াছেন আমাকে তাড়াতাড়ি এখান হইতে সরাইয়া লইতে।]
[সাবিত্রীর এজাহারের অংশ, অনুবাদ আমার]

সৈয়দ রাতেই চলে গিয়েছিল কিনা সাবিত্রী জানে না। ভোররাতের দিকে হুস্ করে একটা ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকতে সে চেয়ে দেখে ভেজানো দরজাটা খুলল আর আবছা দুজন মানুষ দেখা গেল। হারিকেন নিভে গেছে, সাবিত্রী ঠিকই বুঝতে পারল সৈয়দ আর সবুর এসেছে। সবুর একা আসেনি, সৈয়দকে বাড়ি থেকে ডেকে এনেছে।
শিবানী উঠে পড়ো – আমরা এখন এখান থেকে যাবো। বাইরে গাড়ি এসেছে। আজ থেকে তোমার নাম শিবানী, সাবিত্রী নয়। তুমি কোটালের মেয়ে, বামুনের মেয়ে নও। মনে থাকবে?
উঠে দাঁড়িয়েছে সাবিত্রী। কোনো কথা বলল না। সৈয়দের কথাগুলো ভালো করে শুনলও না। সবুর গায়ে একটা সুতি চাদর জড়িয়েছে, ঘাড় নিচু। সৈয়দ একটু পাশে সরে দাঁড়াল সাবিত্রীকে তৈরি হওয়ার সময় দিয়ে। আলোয়ানটা ঘরের  কোণে জড়ো করে রাখা, বেনারসিটাও একপাশে রয়েছে, ন্যাকড়ার অধম। সাবিত্রীর পরনে রয়েছে বেলালের বউয়ের দেওয়া শাড়িটা। হেঁট হয়ে আলোয়ান আর শাড়িটা জড়ো করে বগলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। সৈয়দ জিগ্গেস করল, আর কিছু? সাবিত্রী দরজার দিকে পা বাড়াল। পেঁচাগুলো আরেকবার চেঁচিয়ে উঠল। আজকের রাতের মতো শেষ। বাদুড়েরা এখন পেয়ারা গাছ ছাড়বে বোধহয়, ডালপালার মধ্যে উসখুস করছে।
বাড়ির উঠোনটা পেরোতে অনেক সময় লাগল, চোয়াল চেপে আছে এই পোড়ো বাড়ি, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারা যাচ্ছে না। একটা বড়োসড়ো কাঁটানটে গাছ একটু আটকে রাখল। ভোরবেলার আকাশটাও খানিকটা উলটোপালটা ঠান্ডা তারাদের ভুতুড়ে আলোতে। বেরোনোর দরজা ঠিক কোনদিকে ঠাহর করতে সময় লাগে। বেরিয়ে এসে সৈয়দ খুব যতœ করে তালা লাগায়। মরচে-ধরা তালাটাই লাগিয়েছে। দরজার মুখেই একটি ছইওলা গাড়ি দাঁড়িয়ে। গরু নয়, মোষের ভারি গারী। কালো মেঘের মতো দুটো মোষ চুপচাপ অপেক্ষা করছে। এই কোটালের মেয়ে, ভেতরে যাও, একবারও মাথা বের করবে না, সবুরও ভেতরে যাও। একটি কথাও নয় রাস্তায়। তোমাদের ভোরের ট্রেন ধরিয়ে দেব, বর্ধমানের টিকিট কাটবে। বর্ধমানে পৌঁছে ঠিক করো কী করবে, কোথা যাবে। আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবে না।
ছইয়ের ভিতরে ঢুকেছে সবুর আর সাবিত্রী। সবুর আগে, সাবিত্রী পরে। জোয়াল ঘাড়ে নেওয়ার আগে হাতির মতো বড়ো মোষটা ফোঁস-ফোঁস করে গোটাকতক নিশ্বাস ছাড়ে, পেছনের ডান পা-টা টেনে-টেনে খিঁচ ছাড়িয়ে নেয় তার অভ্যেসমতো, আর শক্তপোক্ত ছোট মোষটা দু-তিনবার ঘাড় থেকে জোয়াল ফেলে দিয়ে আপত্তি জানায়। তার বিরক্তি ফুঁসে উঠে আক্রোশের চেহারা নেয়। যাই হোক, তাদের ঘাড়ে জোয়াল চাপানোর ঝামেলাটা চুকলে মাথামুখে কাপড় জড়িয়ে যে লোকটা লাফিয়ে গাড়ির মুখে বসে পড়ে, তাকে কিছুতেই ঠিক মানুষ বলে মনে হয় না। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে দেখা যায় সৈয়দ পেছন-পেছন হেঁটে আসছেন।
সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল। একেবারে নিঃসাড়, মানুষজন পথঘাট ঘুমিয়ে, ভোরের আলোটা গোলমেলে, ওদের কথাবার্তা যেটুকু হচ্ছে ফিসফিস করে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড, গাড়ি গাঁয়ের বাইরে এসে মাঠে পড়তেই প্রথমে একটি চাকা, পরপরেই অন্য চাকা কঁকিয়ে-কঁকিয়ে কাঁদতে বা গাইতে শুরু করে। শুরুটা অদ্ভুত, টুকটাক, খুচরো ক্যাঁ-ক্যাঁ, তারপর একটু থেমে-থেমে বিলম্বিত লয়ে আলাপের মতো। চমকে উঠে সৈয়দ এগিয়ে এলো গাড়োয়ানের কাছে, এ্যাই, গাড়ির লিগে তেল দিস নাই?
দেওয়া হয়েছে পরশু।
থাম, কোরবানির গরুর চর্বি বাড়িতে ছিল না?
ছিল।
তবে, ক্যাঁ-ক্যাঁ করছে কেন?
কী জানি। বড্ডো ধুলো রাস্তায়।
ছিঃ, কেলেঙ্কারি। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যা।
পিঠে পাঁচন-বাড়ি পড়তে মোষদুটো খুব রাগ করে। বুড়োটা সাপের মতো নিশ্বাস ফেলতে থাকে ঘনঘন। কমবয়েসি ছোটোটা লেজমাথা নাড়িয়ে জোরে হাঁটার তোড়জোড় করে বটে, তবে তার বেশি চেষ্টা সড়ক ছেড়ে গাড়িসুদ্ধ মাঠে নেমে পড়তে।
স্টেশন নিঝুম, গাড়ি আসতে দেরি আছে। ঘুমচোখে ছোট মাস্টার এসে টিকিট-জানলা কেবল খুলে দিয়েছেন। ঘণ্টাও পড়েনি এখনো। মোষের গাড়িটা দাঁড়িয়েছে প্লাটফর্মের উলটোদিকের ঢালুতে। সামনে সিগন্যালের তারের গোছা, তারপরে পাশাপাশি দুটো লাইন, তারপরে নুড়ি-পাথর ঢাকা প্লাটফর্ম। সবুরকে নিয়ে সৈয়দ দুই লাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়ালেন, সাবিত্রীকে বলে গেলেন, তুমি এখানেই থাকো, প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর দরকার নাই ওদিকটা সদর, লোকজন ওঠানামা ওদিকেই করবে, তুমি এদিক দিয়ে গাড়িতে উঠবে। আমরা কামরায় উঠে তোমাকে এখান থেকে তুলে নেব। তুমি বরং এখন তার পেরিয়ে প্রথম লাইন পার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো মাথায়-মুখে কাপড়-টাপড় জড়িয়ে। ট্রেন থামবে প্লাটফর্মের ধারের লাইনে। সবুর যাও, টিকিট নিয়ে এসো। টিকিটের জানলা খুলেছে, কোথাকার টিকিট সেটা বললেন না। সবুর টিকিট আনতে গেল, সৈয়দ প্লাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে দেখলেন সাবিত্রী সিগন্যালের তারের গোছা পেরিয়ে, কালো পাথরঢালা প্রথম লাইনটা পেরিয়ে পরের লাইনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ঘোমটা-টোমটা কিছু দেয়নি, মাথা খালি, দু-হাতে বুকের কাছে শাড়ি আলোয়ান ধরে আছে। প্লাটফর্মের আবছা আলোয় তার মুখ দেখা যায় না তবে মেয়েমানুষের যৌবনের রেখাগুলি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল কি সৈয়দ? ওকে তো পুরোপুরি ঢাকা দিয়ে ফেলা চাই, এমন করে মুছে দেওয়া যেন কোনোদিন ছিলই না। সাবিত্রী মাথা সোজা তুলে আছে, চোখও চেয়ে আছে, তবু কোনোকিছুই দেখছে না সে। এরই নাম মনে হয় স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকা। পাথরের ভাস্কর্যে চোখ আঁকা কিন্তু দৃষ্টি নেই। পলক নেই। পাথুরে অনাসক্তি তাতে।
এতক্ষণে ট্রেন আসার ঘণ্টা পড়ল। প্লাটফর্ম স্টেশনঘর একটু জ্যান্ত হয়ে উঠল, উড়ে ছেলেটা বিনাশব্দে সিগন্যাল ডাউনের হাতলটা নামিয়ে ফেলল। ছোটমাস্টার টিকিট ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়ালেন। ঘুমের রেশটা কাটতে না কাটতে ট্রেনটা পার করে কোয়ার্টারে ফিরে আরও খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারলে বাঁচা যায়। সকালের ট্রেন সেই বেলা ৮টায়। সৈয়দ প্লাটফর্মের কিনারায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন সাবিত্রীর দিকে। মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরে যায়নি তো?
ট্রেন আসার ঘুটঘুট আওয়াজটা এইবার শোনা গেল। স্টেশনে ঢোকার মুখেই লাইনে একটা বড়ো বাঁক আছে। সেটা না পেরোলে ট্রেন দেখা যায় না, আর যখন ইঞ্জিনটা দেখা যায় তখন ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে প্রায়। বাঁকে এসে পৌঁছুলেই ছোট লাইনের ট্রেনের ঘুটঘুট আওয়াজটা শোনা যায়। তারপরে ব্রিজে উঠলেই আওয়াজটা অন্যরকম হয়ে যায়, গমগম আওয়াজ ওঠে আর বাঁক পেরোলেই সিগন্যাল পোস্টের তলায় ট্রেন। সৈয়দ ইঞ্জিনের সেই চিরাচরিত চোখ-ধাঁধানো ভয়ঙ্কর ভ্রƒকুটি-কুটিল বুভুক্ষু চোখটা দেখতে পেল। এখন আর কোনো শব্দ নেই, ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিঁ-সিঁ শব্দ উঠেছে একটা। সেটা যেন স্তব্ধতারই ঘনশ্বাসের শব্দ।
সেই পুরনো ধাঁধা! আলো এত নিঃসাড়ে এগিয়ে আসে যেন থেমে আছে। সৈয়দ চেয়ে দেখেন সাবিত্রী লাইনের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু পুবদিকে সরে গেলে ভালো – এতক্ষণ তো সেখানেই ছিল! এগিয়ে এলো কখন? ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখলেন আলো যেমন ছিল, তেমনি স্থির, একটুও এগোয়নি। আবার চেয়ে দেখলেন আলো প্লাটফর্মের লাইন ধরে এগিয়ে আসছে। এসে পৌঁছে গেল বলে, সৈয়দ ফের দেখলেন সাবিত্রীর দিকে, আলোয় ভেসে যাচ্ছে সে। এত বিভাময়ী কে ও? মাথায় কাপড় নেই, দুই হাত বুকে-বাঁধা, মুখটা একটু তুলে স্থির চেয়ে আছে। এগিয়ে আসছে ইঞ্জিন, তীব্র আলো এসে পড়েছে সাবিত্রীর মুখে, সুডৌল ঘাড়ের একদিক ঢাকা পড়েছে কালো কোঁকড়ানো চুলে – সেখানে অজস্র সরু সরু সোনার সাপ হিলহিল করে দুলছে, সোনালি থমকে রয়েছে। না, ইঞ্জিন থেমে নেই, একটানা এগিয়ে আসছে, এই যে আলোটা সাবিত্রীকে পেরিয়ে যাচ্ছে – কীরকম একটা অস্ফুট চিৎকার করে সৈয়দ প্লাটফর্ম থেকে লাইনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাবিত্রীকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়লেন। সাবিত্রী তার শরীরের নিচে রয়েছে। ইঞ্জিন সৈয়দকে ঠিক চাপা দিতে পারল না, শুধু তাঁর শার্টে দুর্দান্ত একটা বাতাসের ঝাপট দিয়ে গেল। বিকট চিৎকার করে একটিমাত্র খুব নোংরা গাল দিলো ড্রাইভার।

পথে আগাগোড়া ঢুলেছে সবুর। কোনো কথা হয়নি। কামরায় প্রায় সবাই মুখে-মাথায় চাদর জড়িয়ে বেঘোর ঘুমোচ্ছে। শুধু সাবিত্রী টকটক করে চেয়ে আছে, তার দিকের জানলাটা ভাঙা, বন্ধ করার উপায় নেই। হু-হু করে বাতাস ঢুকছে, সাবিত্রীর সাড় নেই, ভাঙা জানলা দিয়ে মাঠঘাট টানা পিছন দিকে সরে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছে শুধু। কোনোকিছু ঠাহর হওয়ার আগেই গলে মিলে স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। গ্রাম আসছে, গতি একটু কমছে, দু-তিনবার করে বুকফাটা হুইসেল বেজে উঠছে, ঘুমন্ত গ্রামগুলো শুধু পেরিয়েই যাচ্ছে, কোথাও কোনো সাড়া উঠছে না। এই সময়টায় সাবিত্রীর ভেতরে উঁকি দিয়ে কিছুই দেখা গেল না। বাইরে থেকে স্থির বসে থাকাটা দেখা যাচ্ছে আর বাকি সবকিছুই কল্পনা করে নিতে হচ্ছে।
পৌনে দু-ঘণ্টা হয়ে গেল। সাবিত্রীর নিতান্ত অনিচ্ছাতেও সকালের আলো ফুটলই। এখন আর সে অন্ধকার করে রাখতে পারবে না বুকের ভিতরের পর্দা, সেখানে ছবির পর ছবি ফুটে উঠতে থাকবে – চোখে দেখতে পাবে, কানে শুনতে হবে, সাজাতে হবে, বাতিল করতে হবে, গা গুলিয়ে উঠবে, বমি পাবে, হাড়িদিদিকে দেখতে পাবে, মরা মাকেও দেখতে হবে বাধ্য হয়ে। সারারাত সম্ভব হয়েছিল ভিতরের নিজের পৃথিবীটাকে বোবা কালা অন্ধ করে রাখা, এখন সাড়া দিতে হবে, পছন্দ করতে হবে, বেঁকে বসতে হবে, বাধ্য হতে হবে।
বর্ধমানে ঢুকছে ছোটো লাইনের গাড়ি। ময়লা নোংরা রেলকলোনি, শুয়োরের পাল, কুচকুচে কালো দড়ির মতো পাকানো বুড়ি, বুকখোলা মাঝবয়েসি মেয়েমানুষ, টিকিওয়ালা উড়ে বামুন, গলায় রঙিন রুমাল জড়ানো কলোনির গুণ্ডা।
শহরে কোনোদিন আসেনি সাবিত্রী, ছোটলাইন বড়োলাইন কোনো ট্রেনেই কোনোদিন চড়েনি সে। কলের পুতুলের মতো সে সবুরের পিছু-পিছু ট্রেন থেকে নামল। পিচঢালা রাস্তা ঘুরে ব্রিজ পেরিয়ে বড়োলাইনের স্টেশনে এলো, সবুর টিকিট কেটে আনল দুটো, বিনা কারণে বলল, ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, ওটাতে উঠতে হবে – বলে সে গেট পেরিয়ে প্লাটফর্মে চলে এলো, একজায়গায় দাঁড়িয়ে গোটাকতক বড়ো-বড়ো লুচি আর খানিকটা মিহিদানা কিনল, সাবিত্রীর কাছে এসে তার একটা হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়েও আবার সরিয়ে নিল সেটা, তারপর সামনের কামরাটায় উঠে গেল। কলের মানুষের মতোই সাবিত্রী তার পিছু-পিছু উঠে এলো ট্রেনে।
ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেছে প্রায় বিকেলে। ঝড়ের বেগে চলে এই ট্রেন। সাবিত্রী বসতে জায়গা পেয়েছিল জানলার পাশে। ঠান্ডা ঝড়ো বাতাস শুষে নিয়েছে শরীরের রস, গায়ের চামড়া কাগজের মতো শুকনো খড়খড়ে, ঘন কোঁকড়া চুল ঝাঁপিয়ে পড়েছে চোখে-মুখে। এতটা পথ সে পেরিয়ে এসেছে, মাঠঘাট, নদী খাল, গাঁয়ের পর গাঁ, ছোট-বড়ো শহর স্রোতের মতো বয়ে গেছে তার চোখের ওপর দিয়ে – সে ঘুমোয়নি একবারও, জেগেও ছিল না। এমন করেও তাহলে বেঁচে থাকা চলে? আছে আর নেই। মানুষের ভিড় ঠেলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে দরদাম করে সবুর একটা ঘোড়ার গাড়ি নিল। ঘোড়ার গাড়ি জীবনে চক্ষে দেখেনি সাবিত্রী। এখন সে হাড়ে-হাড়ে জানে জীবনে অনেক কিছুই সে দেখেনি, বলতে কী, কিছুই দেখেনি। এখন এত জানার ভার সে নিতে পারবে না। মনের জমি তার একেবারেই আ-চষা, কিছু জন্মায়নি সেখানে, হয়তো এজন্মে আর জন্মাবেও না। এখন তার ওপর দিয়ে বিবর্ণ সাদাটে মেঘের মতো ভেসে-ভেসে যাচ্ছে হাওড়া স্টেশনের জনস্রোত, হাজার-হাজার মানুষের চলাফেরা, অচেনা সব যানবাহনের বিচিত্র ভয়ঙ্কর আওয়াজ। তার মধ্যে রোগা-রোগা দুই ঘোড়ায় টানা এই নড়বড়ে রং-চটা ঘোড়ার গাড়ি। হাওড়া ব্রিজে ওঠার পর দেখল বুকভরা ফুঁপিয়ে-ওঠা কান্নার মতো ফুলে-ফেঁপে ওঠা গঙ্গা নদী। তার বুকের ওপর লঞ্চ নৌকো জলযানগুলি নিমেষে শূন্যে উঠে যায় আর ম্যাটমেটে মেঘের মতো ভেসে বেড়াতে থাকে। হাওড়া ব্রিজের আকাশছোঁয়া ইস্পাতের কাঠামোর মধ্যে ঢুকে সাবিত্রীর একবার যেন মনে হলো মেলার নাগরদোলায় হুশ করে আকাশে উঠে গেল সে, তলপেট খালি লাগল। গলা পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠল বমি।
সবুর তাকে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। রোগা ঘোড়াদুটো গাড়ি টানতে পারছে না আর। চওড়া চওড়া পথ, দুদিকে কেমন সব বাড়িঘর, দোকানপাট, খোলা ঘিঞ্জি বস্তি রোদ আলো ছায়া গলিঘুঁজি, খুটুর খুট, খুটুর খুট শব্দে ঘোড়ারা যাচ্ছে, এক একবার মনে হচ্ছে গাড়িটা ভেঙে ছত্রখান হবে। এর মধ্যে মাত্রই একবার বিদ্যুৎ-চিকুর হানা দেয় বুকের  পর্দায় : হাজার-লক্ষ মানুষ এখানে কতো ছোট, পিঁপড়ের মতো, নিজের নিজের রাস্তায় চলছে আসছে যাচ্ছে, জাহাজের মতো বড়ো বড়ো বাড়িতে ঢুকছে, সেখান থেকে বেরোচ্ছে, তারা গর্তে আছে, গলিতে আছে, এই এত এত মানুষের মধ্যে কোথায় আছে একটি মানুষ – যার নাম দুকড়ি – কোন দুর্গন্ধভরা মুদির দোকানে বসে খাতা লিখছে, নাহয় দাঁড়িপাল্লায় মাল মাপছে – কী ছোট, কী সামান্য – সেই মানুষ সাবিত্রীর স্বামী। তার চেয়ে দরকারি মানুষ আর কে সাবিত্রীর কাছে, আর কে ছিল? কঠিন শক্ত দড়িটা আজ ছিঁড়ে গেছে, এই কলকাতাতেই আছে সে এখন, কিছুই জানছে না। জানলেই বা এই পিঁপড়ে আর কী করবে? সেই রোগা পিটপিটে চোখওলা বেচারা একমুঠো মানুষটা? দুবার তিনবার চিকুর হেনে পর্দা আবার ঘষা আয়না।
গাড়ির একদিকের দরজা পুরো বন্ধ, অন্যদিকেরটা আধখোলা। সেই ফাঁকটুকু দিয়ে কলকাতা শহর টানা সরে-সরে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই একটু ঝুঁকে সাবিত্রী দরজাটা খুলে দিতে পারত। তবে তার চোখ তো এখন পাথরের। সে যা দেখছে তার কিছুই বাইরের নয়, যা সে দেখতে পারছে, তা দেখতে দৃষ্টির কোনো দরকার নেই। বুকের ভিতরে সেঁটে লেগে আছে সারি-সারি লোহার কড়াই, তাদের কোনো একটার ফুটন্ত তেলের মধ্যে বিশাল হাতা ডুবিয়ে তাকে মাঝে-মাঝে তুলে দেখা হচ্ছে সে সেদ্ধ হয়েছে কিনা। চলে যাচ্ছে অনন্তকাল। সময় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলেই সমস্ত পার হতে পারে এর আর কোনো অর্থ নেই। কলকাতা শহর সরে-সরে আর কতোদূর যাবে?
চিৎপুর রোডে গাড়ি এসে পৌঁছুলো বিকেলবেলায়। ১ নম্বরেই নাখোদা মসজিদ। মূল রাস্তা থেকে ডানদিকে গলি মসজিদের গা ঘেঁষে। অনেকটা ঘুরতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ওই মসজিদেরই ঠিক পেছনে মুসাফিরখানা। সবুর কখনো আসেনি এখানে আগে। ঠিকানাটাই শুধুমাত্র জোগাড় করতে পেরেছিল সে। মুসলমানদের নিশ্চিন্ত বিনিপয়সার আশ্রয়। মুসলমান বললেই হলো, মুসলমানের চিহ্ন-টিহ্ন কিছু দেখে না। ভবঘুরে এসে এখানে থাকে, পশ্চিমবাংলার হাজার হাজার গাঁ থেকে মুসলমান নারী-পুরুষ হজযাত্রীরা এসে থাকে, প্রত্যেক বছর আজমীর শরীফের পুণ্যলোভীরা এখানে আস্তানা গাড়ে। চোর বদমাশ লুঠেরা গুণ্ডারা থাকলে তবেই বা আটকাচ্ছে কে? সকলের জন্যে দরজা খোলা, ঢালাও ব্যবস্থা! বিরাট পুরনো তেতলা দালান – অসংখ্য ঘর, একতলার মেঝেতেই বিছানাপত্র পেতে থাকতে পারে অনেক মানুষ। পয়সা লাগে না, ঘর পেতে চাইলে সামান্য কিছু টাকা গুনতে হয়। জমাট কফ-বাঁধা জীর্ণ বাড়ি, মাঝে-মাঝে হাড়পাঁজর কাঁপিয়ে কেশে ওঠে – জ্বরকাশির তাড়সে কাঁপতে থাকে। মুসাফিরখানায় খাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে তাতে আর অসুবিধে কি? আশেপাশে অনেক দোকান, যার যা খুশি কিনে এনে খেতে পারে। সব পাওয়া যায়।
দেখা যাচ্ছে, সবুর শেষ পর্যন্ত দোতলায় একটা ঘরই নিল। একতলার ঘরের এককোণে টেবিল পেতে বসে একটা লোক নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে ঘরের চাবি দিচ্ছিল। সে লোকটার মাথায় টুপি, বিহারি-টিহারি হবে বোধহয়, বাংলা কথা তো বলছিল না। চোখদুটো শকুনের মতো। সবুর তাকে কী নামে পরিচয় দিলো কে জানে। ঘরের চাবি নিয়ে সে সাবিত্রীর দিকে একবার চেয়ে দেখে। তার সেই ঘোমটা খোলা মুখ, স্থির চোখ, সাপের মতো ঝুলতে থাকা চুল। সবুর এখন কোনো কথা তাকে বলবে না সে জানে, ধীর পায়ে সে এগিয়ে এলো, নোংরা ঠান্ডা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো দোতলায়, ঘরের তালা খোলা হলে তার পিছু-পিছু ঘরে গিয়ে ঢুকল। একটা মাঝারি চৌকিতে ময়লা চাদর পাতা বিছানা, গুমোট অন্ধকার, জানালা নেই একটাও, কোনোদিক থেকেই আলো আসার পথ নেই। কালিঝুলিতে ঢাকা একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব। সবুর সেটা জ্বালালে জ্বললো, তাতে যে লাল আলোতে ঘরটা ভরে গেল তা অন্ধকারের চাইতে হাজারগুণে ভয়ানক।
আমাদের এখানেই থাকতে হবে।

এতদিনে তবে মানুষের পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে সে পুরোপুরি মুছে গেল।

এই অতি পুরনো কহনে যে এজাহারগুলি মাঝে মাঝে দেওয়া হচ্ছে – পুরো এজাহার বা অংশবিশেষ – তাদের দাখিলের তারিখ খেয়াল করা প্রয়োজন। আসলে সব এজাহারই জমা পড়েছিল আটত্রিশ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে। ঘটনার আট-ন-মাস পরে, মামলা শুরুর সময়ে। এগুলির অংশবিশেষ এই আখ্যানের মধ্যে নানা জায়গায় দেওয়া হয়ে গেছে শুধুমাত্র গল্পটাকে পরম্পরা ধরে সাজানোর জন্যে। এটা করা হয়েছে এ কারণে যে, একমাত্র লেখকই গল্পটা আগাগোড়া জানেন। তিনি যতোটা জানেন এই বৃত্তান্তের সঙ্গে যুক্ত আর কারও পক্ষেই ততোটা জানা সম্ভব নয়। যেমন ধরা যাক, নিচের এই এজাহারটা দিয়েছিলেন বাদীপক্ষের তিন নম্বর সাক্ষী সাবিত্রীর শ্বশুর ভূদেব বাঁড়ুজ্জে উনিশশো আটত্রিশ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে সাবিত্রী-হরণ মামলা রুজুর সময়ে।
[সাক্ষী তিনের এজাহার, বয়স ৬৫ বছরের মতো]
আমার নাম ভূদেব চন্দ্র বাঁড়–জ্জে, পিতার নাম ভবানীচরণ চাটুজ্জে (ভুল হলো, চাটুজ্জে নয়, বাঁড়ুজ্জে), বাড়ি শ্রীকৃষ্ণপুর, থানা নানুর, জেলা বর্ধমান। আমি একজন চাষী।
তিনকড়ি, দুকড়ি আর এককড়ি আমার তিনপুত্র। তিনকড়ি তিনু নামেও পরিচিত। দুকড়ি আমাদের গ্রামের শরৎ বাঁড়–জ্জের মেয়ে সাবিত্রীকে বিবাহ করিয়াছে। প্রায় আট বৎসর আগে তাহাদের এই বিবাহ হয়। সাবিত্রী এখন পনেরো কি ষোলো বৎসর বয়সী হইবে। আমার বাড়িতে তিনকড়ির একটি কাপড়ের দোকান আছে। দুকড়ি কলিকাতায় কর্ম করে। এককড়ি স্কুলের ছাত্র।
দুকড়ি ১৩৪৩ সালের আষাঢ় মাসে প্রথম কলকাতায় যায়। সে আমার কাছে টাকা চাহিয়াছিল, আমি তাহাকে মাত্র দুটি বা তিনটি টাকা দিতে পারি। আমি তখন জানিতাম না সে অন্য কাহারও নিকট হইতে আরও টাকা পাইয়াছিল কিনা। আশ্বিন মাসে দুকড়ি বাড়ি আসে। এর পরে মাঘ কিংবা ফাল্গুন মাসে আমার গৃহপরিচারিকা সরোজিনী আমাকে জানায় যে, সাবিত্রী তাহাকে দিয়া আট টাকায় তেলার নিকট তাহার একখানি অনন্ত বন্ধক দিয়াছে এবং তেলা তাহা ফিরৎ দিতেছে না। আমাকে না জানাইয়া এই কাজ করার জন্য আমি তাহাকে বকিলাম। আমার স্ত্রী এবং আমি এই কাজের জন্য সাবিত্রীকেও বকিলাম। সরোজিনীকে সঙ্গে লইয়া হোসেনপুরে তেলার কাছে গেলাম (সাক্ষী দুর্গাপদ ওরফে তেলাকে দেখাইল)। তেলা জানাইল সে অন্য এক-জায়গায় অনন্তটি বন্ধক দিয়াছে। আমি অনন্ত ফিরৎ পাইলাম না। অভিলাষ, সরোজিনী এবং সাবিত্রীর দাদা গুরুদাসও অনন্তের জন্য তেলার নিকট গিয়াছিল কিন্তু ফল কিছুই হয় নাই। এ পর্যন্ত অনন্ত ফিরৎ পাওয়া যায় নাই।
সাবিত্রী ১৩৪৪ সালের বৈশাখ হইতে তাহার ভ্রাতার বাড়িতে বাস করিতেছিল। ইহার মধ্যে মাত্র একবার কি দুবার আমাদের বাড়িতে আসিয়াছিল। পৌষ মাসের দুই তারিখে আমি তাহাদের বাড়িতে গিয়া জানিতে পারিলাম যে সাবিত্রীকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। তার দাদা তখন বাড়িতে ছিল না। সেইদিনই সকালে সে বাড়িতে ফিরিল। আমরা সকলে মিলিয়া সাবিত্রীকে খুঁজিলাম। এইসময় খবর পাওয়া গেল যে তেলা এবং সবুর তাহাকে লইয়া গিয়াছে। তাহাদের কাছে খোঁজ লইতে গিয়া জানা গেল দুইজনই অনুপস্থিত। ইহার এক সপ্তাহ পর আমি কলিকাতায় গেলাম এবং দুকড়িকে সব সংবাদ জানাইলাম।
ইহার পর একখানি সংবাদ পাইয়া আমি বর্ধমান আসিয়া সাবিত্রীর দেখা পাইলাম। আমাকে দেখিয়া সে কাঁদিতে লাগিল। তাহার হারাইয়া যাইবার বিষয়ে সে আমাকে কোনো কথা বলে নাই। সাবিত্রী তাহার পিতামাতার শেষ সন্তান। সাবিত্রী যখন জন্মায় তখন অক্ষয় বাগদি আমাদের চৌকিদার ছিল। সে এখনো বাঁচিয়া আছে। শ্রীকৃষ্ণপুর আগে বর্ধমান জেলায় ছিল। জেলা সেটলমেন্টের সময় ইহা বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। সাবিত্রীর মা মারা যাইবার সময় সে দেড় কিংবা দুই বছরের ছিল। নলিনের স্ত্রী তাহাকে বড়ো করিয়াছে।
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে, সাবিত্রীর ভাইয়ের বাড়ির বিঘা তিনেকের মধ্যে একটি আমের বাগান আছে। এই বাগান হইতে অজয় মাত্র দশ/পনেরো বিঘা তফাতে হইবে।
স্বাক্ষর : ৯. ১১. ৩৮ [সাবিত্রীর শ্বশুরের সম্পূর্ণ সাক্ষ্য, অনুবাদ আমার]

এই সাক্ষ্যও ঘটনাকাল পার হয়ে যাওয়ার পরে সাবিত্রী ফিরে এলে দেওয়া হয়েছিল। অন্য সাক্ষ্যগুলির যাচাই দিয়েছিল সাবিত্রীর দাদা গুরুদাস। ঘটনার দিন সে বাড়িতে ছিল না – ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনে ভোট দিতে না কী করতে আরেক গাঁয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল সকালবেলায় সাবিত্রী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরে। তার সাথে রাতে হাড়িদিদি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিল না। অদ্ভুত কথা, সাবিত্রীর স্বামী দুকড়ির সেদিন রাতে সাবিত্রীর কৌমার্য ভাঙবার কথা থাকলেও সে-ও আর শেষ পর্যন্ত আসেনি। কেন, তা বলা শক্ত। কোনো পুরুষমানুষ কি এমন নেমতন্ন ছাড়ে? সে লোকটার কোনো খুঁত-টুঁত আছে কি না কে জানে? সাক্ষ্য থেকে বোঝা যাবে সদ্যবিবাহিত একমাত্র বোনটির লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাতেও সে তেমন একটা গা করেনি। বোন গেলে বোন পাওয়া যাবে না, তবে বোন তো একটা মেয়ে। যতোদিন থাকে বাপ-মা-ভাইদের কেবল ভোগান্তিই সইতে হয়। পাত্রস্থ করতে প্রাণ বেরিয়ে যায়। সেই বোন যখন নিরুদ্দেশ হয়েই গেল, কী আর করা যাবে। তখনকার দিনে গড়পরতায় ভাবনাটা এরকমই – গুরুদাসও তেমনি ভাববে সেটা স্বাভাবিক। না, আপদ গেছে সে হয়তো ভাবেনি – তবে তার খোঁজখবরের ধরন দেখলে মনে হতে পারে তেমন কোনো চাড়ও তার ছিল না। সাবিত্রী ফিরে এলে তাকে কুলনাশিনী কুলত্যাগী হয়তো কেউ বলবে না, কিন্তু কুলছাড়া মেয়ে বলবেই। হাজার হলেও সে এঁটো হয়ে-যাওয়া মেয়েমানুষ, কে নেবে তাকে? দুকড়ি তাকে বাড়ি ঢুকতে না দিলে কিছুই করতে পারবে না গুরুদাস। গলার গাবের মতো সে তাকে গিলতেও পারবে না, উগরে দিতেও পারবে না। সে জানে এই সংসারের মজা সে কোনোদিন পাবে না। তবু তাকে খুঁজে বেড়াতেই হয়। বাবা নেই, আর কোনো ভাইবোনও নেই, তাই দায় তার একার। এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে খুঁজতে বেরোতে হচ্ছে। এলাকার সব মাথা-মাথা মানুষের কাছে তাকে ধরনা দিতেই হয়। সাবিত্রী যেখানে যেখানে গিয়েছে, কুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে তাকে ঠিক সেখানেই গিয়ে হাজির হতে হচ্ছে। তবে খবর সে একটাই পাচ্ছে : সাবিত্রী এখন আর সেখানে নেই।
এবার গুরুদাসের পুরো সাক্ষ্যটা তুলে দিই।
[বাদীপক্ষের ৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য, বয়স আনুমানিক ২২ বৎসর।
আমার নাম গুরুদাস ব্যানার্জি, পিতার নাম শরৎ ব্যানার্জি বাটি শ্রীকৃষ্ণপুর।
আমি একজন কাপড়ের দোকানদার।
আমরা দুই ভাই। আমার বড়োভাই শৈলেন্দ্র জন্মের পরেই মারা যায়। সাবিত্রী আমার পিতামাতার পরবর্তী      সন্তান। আমাদের মধ্যে সেই-ই কনিষ্ঠ। সাবিত্রীর যখন দেড় বা দুই বৎসর বয়স তখন আমাদের মা মারা যায়। সাত কিংবা আট বৎসর বয়সে দুকড়ির সহিত তাহার বিবাহ হয়। দুকড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে শুধুমাত্র একটি পুকুরের ব্যবধান। বাড়িতে আমার একটি কাপড়ের দোকান আছে।
১৩৪৩ বাংলা সনের ফাল্গুন মাসে আমি ভূদেববাবুর কাছে শুনিলাম যে সাবিত্রী তাহার একটি অনন্ত হোসেনপুরের দুর্গাপদ দাঁয়ের নিকট বন্ধক রাখিয়াছে। সরোজিনী, অভিলাষ, ভূদেববাবু এবং আমি অনন্তখানি ফিরৎ পাইবার খুব চেষ্টা করিয়াছিলাম কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। নানা অজুহাতে দুর্গাপদ অনন্ত ফিরৎ দিলো না।
গত অগ্রহায়ণের আগের অগ্রহায়ণ আমার বোন বাড়িতেই ছিল। পহেলা পৌষ আমি বাড়িতে ছিলাম না, ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনে ভোট দিতে গোপাডিহি গিয়াছিলাম। দোসরা পৌষের সকালে আমি বাড়িতে ফিরিয়া দেখিলাম সাবিত্রী নাই। শুনিলাম যে আগের রাত্রি হইতে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। আমরা তাহাকে অনেক খুঁজিলাম। দুর্গাপদ দাঁ ও সবুরও বাড়িতে অনুপস্থিত ছিল। তাহার নিকট হইতে সংবাদ পাইয়া (কার কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল উল্লেখ নেই) আমি বেলগাঁর কালিপদ দাস ও ভোলানাথ ভট্টাচার্যের কাছে গিয়া শুনিলাম যে একজন স্ত্রীলোককে গ্রামে আনা হইয়াছে বটে তবে সে এখন ধারসোনা গ্রামে। আমি ধারসোনা গেলাম কিন্তু সেখানে কোনো সন্ধান মিলিল না। ইহার দুই বা তিনদিন পর আমি ধান্যগ্রামে দাশরথী পাঠক, কালিদাস দেও, গোকূল নন্দীর নিকট শুনিতে পাইলাম যে, একজন স্ত্রীলোককে তথায় আনা হইয়াছিল বটে তবে সে আর তখন সেখানে নাই।
ইহার পর আমাদের গ্রামের লোকেরা মহকুমার এসডিও বরাবর একটি দরখাস্ত পাঠাইল। আমিও তাহাতে স্বাক্ষর করি। এই সেই দরখাস্ত। (আলামত-১,           অভিযুক্ত-র আপত্তিসহ উপস্থাপিত)
আমিও কাটোয়ার এসডিও বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করিয়াছিলাম। (আলামত : ২,) ইহার পর আরও সাত-আটটি দরখাস্ত এসডিও বরাবর পাঠানো হইয়াছিল।
আমি চিনাইয়া দিলে কলিকাতায় দুর্গাদাস দাঁ গ্রেফতার হইয়াছিল। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত ছাড়া পাইল (জামিন কিনা উল্লেখ নাই)। ইহা গত চৈত্র মাসের শেষ দিকের ঘটনা।
এই জামিনের বিরুদ্ধে বর্ধমান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আমি আপত্তি উত্থাপন করিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় পুলিশকে তদন্ত করিতে আদেশ দিলেন। মঙ্গলকোট থানার সাব-ইন্সপেক্টর তদন্ত করিলেন এবং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন।
এই আলোয়ানখানি সাবিত্রীর (আলামত-১ শনাক্ত)। সাবিত্রী নিখোঁজ হওয়ার সময় তাহার হাতে চুড়ি, রুলি এবং গলায় হার ছিল।
অভিযুক্ত সবুর এবং তেলা প্রায়ই আমার কাপড়ের দোকানে আসিত। বটকৃষ্ণ তেলার বন্ধু ছিল এবং তাহার সহিত সেখানে আসিত।
গত ভাদ্রমাসে খবর পাইয়া আমি বর্ধমান আসিলাম এবং সাবিত্রীর দেখা পাইলাম। সে আমাকে বলিল যে নলিন, তেলা, বটকৃষ্ণ, সবুর, ধান্যগ্রামের সৈয়দ এবং শামসুল হুদাসহ অন্যরা তাহাকে অপহরণ করিয়াছে এবং বারবার ধর্ষণ করিয়াছে ও তাহাকে জোর করিয়া আটকাইয়া রাখিয়াছে। (সবুর, তেলা, বটা এবং নলিন শনাক্ত)
স্বাক্ষর : ৯. ১১. ৩৮

এখন কয়েকটি এজাহার পরপর তুলে দেওয়া দরকার। তাতে এলাকার পাঁক-কাদা-জমা স্থির নোংরা ডোবার জলে কতোটা আন্দোলন দেখা দিয়েছিল তার কিছুটা বোঝা যাবে। বোধহয় তেমন বেশি নয়। ওই ডোবায় ঢিল ছোড়ার মতোই! টুবুং করে একটা শব্দ, ঘোলা জলে একটা ছোট গর্ত, গর্তের চারপাশে জলের সামান্য কাঁপন, ঢিলটা গেল তলিয়ে, জল আবার আগের মতোই সর-জমা স্থির। কিছুই হয়নি, মানুষ ডাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাচ্ছে, দিনও হচ্ছে, রাতও হচ্ছে, কোনোকিছুতেই কোনো রং ফুটছে না। মাটির মতো প্রত্যেক দিন-রাতের স্বাদ। রাতটা ভোরবেলায় সাদা হয়ে এলে দোয়েল দু-একবার শিস দিয়ে ওঠে, ভোর ফোটার সময়টাতে কাক ডেকে ওঠে। দিনে রোদে রং নেই, মেঘে রং নেই।
এর পরের সাক্ষীর বিবরণটা এইবার এখানে দিয়ে দিচ্ছি।
[রাষ্ট্রপক্ষের ৫ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য, বয়স আনুমানিক ৩০ বৎসর]
আমার নাম সরোজিনী ডোমনি, বাবা মুকুন্দ ডোম, গ্রাম শ্রীকৃষ্ণপুর। আমি বাড়ির চাকরানি।
আমার মা ভূদেববাবুর বাড়ির চাকরানি ছিল। মা মারা গেলে তাহার স্থলে আমি চাকরানির কাজ করিতে থাকি। প্রায় সাত মাস পূর্বে আমার স্বামী অন্য একটি গ্রামে বসবাস সরাইয়া লইলে এখন সেখানেই আমরা বাস করি।
বাংলা ১৩৪৩ সালের আষাঢ় মাসে সাবিত্রী বন্ধক দিয়া টাকা জোগাড়ের জন্য আমাকে একটি অনন্ত দিয়াছিল। প্রথমে আমি তুষ্টু কোটালের কাছে যাই কিন্তু সে অগ্রিম টাকা দিতে তাহার অপারগতা জানায়। তাহার পর আমি তেলার নিকট যাই এবং সে আমাকে অনন্তের জন্য ৮ আট টাকা দেয়। সাবিত্রীকে আমি সেই টাকা দিই। সে তাহার স্বামীর কলিকাতার খরচ চালাইবার জন্য এই টাকা চাহিয়াছিল। এই টাকা লইয়া তাহার স্বামী কলিকাতা চলিয়া গেলেন।
পরের আশ্বিনে আমি অনন্ত ফিরৎ পাইবার জন্য তেলার কাছে যাই। সে বলে যে উহা অন্য একজনের কাছে বাঁধা রহিয়াছে, পরে আসিতে হইবে। এই প্রকারে তিন মাস সে আমাকে ফিরাইয়া দিলো। তাহার পর সে বলিল যে, আমি যেন অনন্তের মালিককে তাহার কাছে লইয়া যাই, অনন্ত সে তাহার কাছেই ফিরৎ দিবে। এই কাজের জন্য আমাকে সে একটি পুরস্কার দিবারও প্রতিশ্র“তি দেয়। বটকৃষ্ণ সে সময় তাহার নিকটে ছিল। সাবিত্রীকে আমি এই কথা বলিলে সে জানায় যে ভদ্রলোক পরিবারের স্ত্রীলোক হইয়া সে যাইতে পারিবে না। সে অনন্ত ফিরাইয়া আনিবার জন্য তাহার শ্বশুরকে বলিতে বলে। তাঁহাকে বলিলে তিনি ফাল্গুন মাসের একদিন আমার সহিত তেলার কাছে গেলেন কিন্তু অনন্ত ফিরৎ পাওয়া গেল না। (তেলা এবং বটা শনাক্ত)
[স্বাক্ষর : ৯. ১১. ১৯৩৮]
রাষ্ট্রপক্ষের ৫নং সাক্ষীর এই বিবরণে ভুল কিছু নেই তবে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। অনন্ত বন্ধক দেওয়া, ফেরত পাওয়ার জন্যে বারবার দুর্গাপদকে তাগাদা দেওয়া ইত্যাদি সবই করেছিল নিশিবালা। সে ছিল সাবিত্রীর বাড়িতে। এই বিবরণে বলা হচ্ছে, বন্ধক দিয়ে এসেছিল সরোজিনী ডোমনি, অনন্ত ফেরত পাওয়ার জন্য বারবার যাতায়াত করেছিল সেই-ই। সাবিত্রীর শ্বশুরের সঙ্গে আরও দু-একজনকে দুর্গাপদের কাছে নিয়েও গিয়েছিল সে আর সে ছিল সাবিত্রীর শ্বশুর ভূদেব বাঁড়–জ্জের বাড়ির পরিচারিকা। অনন্ত নাকি সাবিত্রী তার শ্বশুরবাড়ি থেকেই বন্ধক দেওয়ার জন্যে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে সাবিত্রী ছিল তার বাপের বাড়িতে আর নিশিবালাই অনন্ত নিয়ে তেলার কাছে বাঁধা দিয়ে এসেছিল। গোলমালটা ঘটল কোথায়? এ কি হতে পারে যে, সাবিত্রী হারিয়ে যাওয়ার পর হয়তো সারারাতই তার অপেক্ষায় বসেছিল নিশিবালা। নলিনী কেউটের বাড়ির দিকে গিয়েছিল সাবিত্রী অনন্ত আনতে, আর ফিরল না। দুকড়িও রাতে আসেনি, নিশিবালা একা ছিল বাড়িতে। কেমন কেটেছিল তার রাতটা? বাইরে বেরিয়ে গিয়ে সে কি খোঁজ করেছিল সাবিত্রীর? আন্দাজ করতে পেরেছিল কি যে সাবিত্রী দুর্গাপদদের হাতে পড়েছে, আর ফিরবে না কোনোদিন? সকালবেলায় সে কি আর বিছানা থেকে উঠতে পারেনি? ঠান্ডা মাটির ওপর ময়লা কাঁথার বিছানাটাই কি টেনে নিয়েছিল তাকে? তারপর একদিন সে মরে গেল? এরকম করে মরতে এই হাড়িদিদিরাই পারে, ভদ্রলোকের সাধ্যি নেই অমন ইচ্ছেমৃত্যুর, যেমন সিংহটা খাঁচার মধ্যে মরে গেল ছোট কুকুরছানাটার শোকে? আর একটা সম্ভাবনাও কি থাকতে পারে? নিশিবালা কোনোমতেই আদালতে যেতে রাজি হয়নি, কাউকেই ভাগ দিতে চায়নি তার শোক? শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিতে রাজি করানো হয়েছে সরোজিনী ডোমনিকে?         সে-ও তো ভূদেববাবুর বাড়ির চাকরানি ছিল! বাড়ি বদল ছাড়া বয়ানটা একই দাঁড়াবে!
এখন পরপর কয়েকটি সাক্ষ্য তুলে দেওয়া যাক :
[রাষ্ট্রপক্ষের ৬নং সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ৪০ বৎসর]
আমার নাম প্রহ্লাদ চন্দ্র দাঁ, পিতা মৃত গোপাল ভল্ল, জাতি উগ্রক্ষত্রিয়, বাড়ি শ্রীকৃষ্ণপুর, পেশা চাষী।
আমার বাড়ি ভূদেববাবুর বাড়ি হইতে আনুমানিক দশ বিঘা জমি তফাতে। দুকড়ির সহিত সাবিত্রীর বিবাহ হইয়াছিল। পৌষ মাসের দুই তারিখ সকালবেলায় আমি জানিতে পারিলাম যে সাবিত্রীকে পাওয়া যাইতেছে না। তাহাকে অনুসন্ধান করা হইল। তাহাকে খুঁজিতে আমি তেলার বাড়িতে গিয়াছিলাম। সে বাড়িতে অনুপস্থিত ছিল। এই সময় একটি সংবাদ পাইয়া গুরুদাস বেলগাঁ যায়। কিন্তু সাবিত্রীকে পাওয়া গেল না। আমরা গ্রামবাসীরা কাটোয়ার মহকুমা হাকিম বরাবর একটি দরখাস্ত করিলাম। ইহাতে আমিও স্বাক্ষর করি। (আলামত-১)
সবুর ও তেলা প্রায়ই আমাদের গ্রামে আসিত। তেলার সহিত নলিনের বন্ধুত্ব ছিল। [তেলা নলিন সবুর এবং বটা শনাক্ত] বটা আমাদের গ্রামে বিবাহ করিয়াছিল।
স্বাক্ষর : ৯.১১.৩৮।
[রাষ্ট্রপক্ষের ৮নং সাক্ষীর সাক্ষ্য, বয়স প্রায় ২৬ বৎসর]
আমার নাম গৌরচন্দ্র মণ্ডল। পিতা  ঁমনীন্দ্রচন্দ্র মণ্ডল, জাতি সদগোপ, বাড়ি হোসেনপুর, থানা নানুর, পেশা চাষাবাদ।
অভিযুক্ত তেলা ওরফে দুর্গাপদকে আমি চিনি। আমরা দুজন একই গ্রামবাসী, আগে আমাদের গ্রামের তুষ্টু কোটালের বাড়িতে তাহার একটা মুদিদোকান ছিল। পরবর্তীকালে আমার সহিত যুগ্মভাবে সে একটি দোকান করিয়াছিল। বৎসরখানেক পূর্বে সেই দোকানটি বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ভূদেববাবুর অনন্ত ফিরৎ দিবার জন্য সরোজিনী ডোমনিকে দুর্গাপদকে তাগাদা দিতে দেখিয়াছি। দুর্গাপদ বলিয়াছিল অনন্ত তাহার কাছে নাই, সে পরে ইহা ফিরৎ দিবে। আমি শুনিয়াছি যে সাবিত্রীকে পাওয়া যাইতেছে না। ইহা হইল দোসরা পৌষের কথা। পহেলা পৌষের বিকালবেলায় আমি দুর্গাপদকে নলিনী কেওটের সহিত শ্রীকৃষ্ণপুরের দিকে যাইতে দেখিয়াছি।
[রাষ্ট্রপক্ষের নয় নম্বর সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ৫০ বৎসর]
আমার নাম যুগল রাধিকা দাসী, পিতা হরিদাস, জাতি বৈষ্ণব, বাড়ি বেলগাঁ, থানা মঙ্গলকোট।
আমি ফেরিওয়ালি ও ভিক্ষুক।
আমি বৈষ্ণব। বেলগাঁয়ে আমার বাস। আমি ভিক্ষা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করি এবং তাহার সহিত চুড়ি, মালা ইত্যাদি বিক্রয় করিয়া থাকি। আমি বেলগাঁ, ভাটাকুল, গোবর্ধনপুর ইত্যাদি গ্রামে ভিক্ষার জন্য যাই। গত পৌষ মাসে আমি বাড়িতে ছিলাম। ওই দিন সকালে আমাদের গ্রামের ইশাহাকের বাড়ির উঠানে একটি মেয়েলোক দেখিলাম। তিন-চারজন মোসলমান মেয়ে তাহার নিকটে ছিল। তাহাদের মধ্যে একজন ওই মেয়েটিকে কাঁচের চুড়ি দিতে বলিল এবং জানাইল যে, সে হইল নতুন বিবি (অভিযুক্তদের পক্ষ আপত্তি জানাল)। আমি তাহার হাত হইতে শাঁখা ও লোহার বালা খুলিয়া লইলাম এবং তাহাকে কাঁচের চুড়ি পরাইয়া দিলাম। স্ত্রীলোকটি কাঁদিতেছিল। তাহাকে আমার হিন্দু বলিয়া মনে হইয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া আমি আমাদের গ্রামের কালিবাবুকে ইহা জানাইলাম। কালিবাবু আমাকে পরের দিন পুনরায় সেখানে যাইয়া মেয়েটি তখনও সেখানে আছে কিনা দেখিয়া আসিতে বলিলেন। তিনি আমাকে আরও বলিলেন, আমি যেন মেয়েটি ঠিক কোন গ্রামের তাহা জানিয়া আসি। পরদিন আমি আবার সেখানে গেলাম। তবে ইশাহাকের বাড়িতে আর তাহাকে দেখিলাম না। ইহার পর তাহাকে আবার তিনু মুনশির বাড়িতে দেখিতে পাইলাম। সে একটি ঘরে বসিয়াছিল। ওই বাড়িতে মেয়েরা যাহারা আশেপাশে ছিল তাহারা একটু সরিয়া গেলে আমি মেয়েটিকে তাহার কোথায় বাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম। সে উত্তর করিল যে, সে শ্রীকৃষ্ণপুরের মেয়ে এবং সে ব্রাহ্মণকন্যা। সে আরও বলিল, সবুর তাহাকে লইয়া আসিয়াছে। সে পলাইয়া আসিবে কিনা জিজ্ঞাসা করিলে বলিল, ‘আমি কী করিয়া যাইব? তাহা হইলে তাহারা আমাকে পিটাইয়া মারিয়া ফেলিবে।’ এই সমস্ত কথা আমি কালিবাবুকে জানাইয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, এ বিষয়ে কী করা যায় তিনি পরে দেখিবেন এবং এ বিষয়ে সমস্ত ঘটনা সাঁওতার প্রেসিডেন্ট আনন্দবাবুকে জানাইয়া দিতে কহিলেন। আমি আনন্দবাবুর নিকট গিয়া তাঁহাকে সব জানাইলাম। মেয়েটিকে দেখিলে আমি চিনিতে পারিব। (সাবিত্রীকে শনাক্তকরণ)
স্বাক্ষর : ৯. ১১. ১৯৩৮
একইরকম সাক্ষ্য-বিবরণ আর বেশি তুলে দিয়ে পাঠককে ক্লান্ত করে তোলা ঠিক নয়। তার চেয়ে বরং গল্পটা যেভাবে বয়ান করা হচ্ছে, তার সঙ্গে খানিকটা সংগতি রেখে, পরম্পরার সূত্র ধরে কিছু কিছু সাক্ষ্য ব্যবহার করা যাক। যদিও এই সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সাবিত্রী ফিরে আসার পরে আদালত মারফত পাচ্ছি, তবু সেগুলিকে ঘটনাক্রম ধরে মোটামুটি সাজিয়ে নিতে পারলে এই একটি মাত্র ঘটনা সমাজে কতোটা আলোড়ন তুলেছিল, সেই উপনিবেশী ব্রিটিশ আমলেও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা কতোটা অকার্যকর হয়ে উঠেছিল, আর উপনিবেশপোষিত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঠিক কতোটা ছড়িয়ে পড়েছিল, জনসাধারণই বা তাতে কতোটা সাড়া দিয়েছিল এসবের কিছু কিছু আন্দাজ পাওয়া যাবে। যাই হোক, এর মধ্যেই অসতর্কভাবে উলটোপালটা কিছু সরকারি সাক্ষ্য-বিবরণ উদ্ধৃত হয়েছে বটে, এরপরও হয়তো তেমন গণ্ডগোল ঘটে যাবে বয়ানের জটিলতার কারণে, তবু একটু সতর্ক হওয়া যাক।
এখন পরপর কয়েকটি সরকারি সাক্ষ্য। সাবিত্রীকে জবরদস্তি-গ্রহণের পর থেকে, এইসব সাক্ষ্য ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা খুঁটিনাটিতে আলো ফেলবে।
[সরকারি পক্ষের ৩১ নম্বর সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ২৬ বৎসর]
আমার নাম সদানন্দ কর্মকার, পিতা মৃত দ্বিজপদ কর্মকার, বাড়ি ভূমশোর, থানা বর্ধমান সদর। বর্তমানে কাটোয়ার বাসিন্দা।
আমি একজন স্বর্ণকার, কাটোয়ায় আমার একটি দোকান আছে। আমি অভিযুক্ত দুর্গাপদ দাঁকে চিনি (দুর্গাপদকে শনাক্ত)। ১৩৪৩ বঙ্গীয় সনের ২৩শে আশ্বিন সে আমার কাছে একটি আড়াই পেঁচি অনন্ত বাঁধা দিতে আসে। সেজন্য আমি তাকে ৩০্ টাকা দিই। ইহা আমার খাতায় লেখা রহিয়াছে (আলামত ১০)। ১৩৪৪ বাংলা সনের ১০ই শ্রাবণ সে আমার নিকট গহনাটি বিক্রয় করে। অনন্তখানির মোট ওজন ছিল ১ ভরি ৩ আনা সাড়ে তিন রতি। ইহার মধ্যে ১ ভরি দেড় রতি বিক্রয় করা হইল। তিরিশ টাকা ভরি দরে ইহার মূল্য বাবদ আমি তাহাকে ৩০্ টাকা ১২ আনা পরিশোধ করি। তাহার নিকট হইতে আমি একজোড়া সোনার রুলিও ৫১্ টাকা ১২ আনা দিয়া খরিদ করি। এই সমস্ত লেনদেনই আমার স্বহস্তে আমার খাতায় লেখা রহিয়াছে (আলামত-১১)। সমস্ত ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব এই খাতায় রহিয়াছে।
স্বাক্ষর : ২৮.১১.৩৮

অপহরণের পরে দুর্গাপদদের কংকনার মেঠো ঘরে রাতে আটক থাকার পরে সাবিত্রীকে নিয়ে দুর্গাপদ প্রথম গিয়েছিল চৈতন্যপুরের সেই বিধবা মহিলার নির্জন বাড়িতে। সাক্ষ্য এই মহিলাকেও দিতে হয়েছিল। সেই সাক্ষ্য :
[সরকার পক্ষের ২৬ নম্বর সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ৬২ বৎসর]
আমার নাম ননীবালা দাসী. পিতা হরেকৃষ্ণ দে, জাতি উগ্রক্ষত্রিয়, সাকিন চৈতন্যপুর।
আমি অভিযুক্ত দুর্গাপদ দাঁকে চিনি (দুর্গা শনাক্ত)। সে আমার ছেলের শ্যালক। সে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসে। দোসরা পৌষ ভোরবেলায় দুর্গাপদ একটি মেয়ে লইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়াছিল। সে জানাইয়াছিল যে মেয়েটি তাহার শ্যালিকা। সে তাহাকে লইয়া কলিকাতা যাইতেছে। আমি মেয়েটিকে মুড়ি খাইতে দিলাম। আমি তাহার সঙ্গে কোনো কথা বলি নাই। সে ঘরে ঘুমাইয়াছিল, দুর্গাপদ ঘরের বারান্দায় রহিল। এই ঘরটি পূর্বদুয়ারী। সন্ধ্যার পরে তাহারা কৈচর রেলস্টেশনে গেল। আমার পুত্র ও পুত্রবধূ তখন বাড়িতে ছিল না। দুই কি তিন মাস পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি জ্ঞানবাবুকে এইসব কথা বলি। গত ভাদ্র মাসে পুলিশ আমার বাড়িতে আসিয়াছিল। এই মেয়েটি পুলিশের সঙ্গে ছিল। সে আমাকে চিনিতে পারিল এবং যে ঘরখানিতে সে আশ্রয় লইয়াছিল সেই ঘরখানি দেখাইয়া দিলো। বনবিহারী হাতি আমার পুত্র। (সাবিত্রী শনাক্ত)।
স্বা : ১১. ১১. ১৯৩৮
[সরকার পক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ৪৩ বৎসর]
আমার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরী। পিতা দুর্যোধন চৌধুরী জাতি উগ্রক্ষত্রিয়। আমি মঙ্গলকোট থানার শিমুলিয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। বর্ধমান এবং বীরভূম জেলায় আমার জমিদারি আছে। জমিদারি হইতে আমার বার্ষিক আয় ৫০,০০০ টাকা।
আমাদের গ্রামের দুর্গাদাস দত্ত আমাকে জানায় যে, পৌষমাসের এক সন্ধ্যায় সে অভিযুক্ত তেলাকে একটি মেয়ে লইয়া আমাদের গ্রামের নিকট দিয়া যাইতে দেখিয়াছে। এ বিষয়ে আমি সন্ধান করিয়া তেলার খুড়তুতো বোনের শাশুড়ি ননীবালার নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, তেলা একটি মেয়ে লইয়া তাহাদের বাড়ি গিয়াছিল এবং তাহাকে সে কলিকাতা নিয়া গিয়াছে। তেলা ননীবালাকে বলিয়াছে যে মেয়েটি তাহার শ্যালিকা, তাহার স্বামী অসুস্থ বলিয়া তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাইতেছে।
আমি এসপি এবং এসআই সাহেবের তদন্তকালে তাঁহাদের সঙ্গে ছিলাম। ননীবালার বাড়িতে একটি পূর্বদুয়ারি ঘর দেখাইয়া সাবিত্রী জানাইল যে, সেই ঘরে তাহাকে রাখা হইয়াছিল। ননীবালাকে শনাক্ত করিয়া জানাইল যে এই মহিলাই তাহাকে মুড়ি খাইতে দিয়াছিল।
আসামি তেলার পক্ষ থেকে জেরার উত্তর :
দুর্গাদাস দত্ত ফাল্গুনের মাঝামাঝি আমাকে এইসব কথা বলিয়াছিল। পরদিন আমি ননীবালাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছিলাম। গত ভাদ্রমাসে আমি প্রথম পুলিশের সঙ্গে দেখা করি। পুলিশের কাছে আমি একটি জবানবন্দি দিয়াছিলাম।
স্বা : ১১. ১১. ৩৮
[সরকার পক্ষের ২০ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য, বয়স আনুমানিক ৪৫ বৎসর]
আমার নাম ইশাহাক শেখ. পিতা আবদুল গফুর. বাড়ি বেলগ্রাম. আমি একজন স্বর্ণরেণু ব্যবসায়ী।
গত পৌষ মাসের দুই কিংবা তিন তারিখ দুপুরবেলায় আমি বাড়ি ফিরিয়া দেখিলাম অভিযুক্ত সবুর একটি স্ত্রীলোক লইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়াছে। আমি তক্ষুনি মেয়েটিকে লইয়া যাইতে বলিলাম। সে মেয়েটিকে লইয়া আমাদের গ্রামের তিনু মুনশির বাড়িতে লইয়া গেল। মেয়েটিকে দেখিলে আমি চিনিতে পারিব (সাবিত্রীকে শনাক্ত) আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিলে সে জানাইয়াছিল যে সে শ্রীকৃষ্ণপুরের মেয়ে।
স্বা : ১০. ১১. ৩৮
যতো একঘেয়েই লাগুক আমাদের অন্তত আরো তিনজন সাক্ষীর বিবরণ সহ্য করতে হবে। মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া ঘাসের জঙ্গলে মাথা উঁচু করে দু-একটি বড়ো গাছ তো থাকেই, এই ঘাসেদের মধ্যেও কিছু ইতরবিশেষ দেখা যায়, মাথায় কেউ-কেউ একটু বেশি উঁচু, তার লম্বা ডাঁটা সামান্য বাতাসেই দুলতে থাকে। এখনকার পৃথিবীতে নৃশংসতাই মূল সংবাদ। তার মাত্রা কোন তীব্রতায় পৌঁছুলে মনের ওপর একটু আঁচড় পড়বে তার হদিস করা অসম্ভব। স্থির, বদ্ধ, সমস্ত দিক থেকে আটক একশ বছর আগের এই দেশের একটা অঞ্চল থেকে সাবিত্রী অপহরণের ঘটনা আর কতোটাই বা আলোড়ন তৈরি করবে সেটা আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব। তবু আঁচ একটা পেতেই হবে। ঝড় না উঠুক, পৌষ-মাঘ মাসের হিম কনকনে বাতাসের সঙ্গে ভয় আতঙ্কের অশুভ বাতাস তো একটা উঠেছিল। সমাজের মাথা-উঁচু দু-চারটি বড়ো গাছ, ঘাড়-উঁচু কিছু ডাঁটিওলা ঘাস তখন কতোটা মাথা বেড়েছিল সেই বাতাসে তার কিছু নমুনা দেখাবার জন্যেই সাক্ষীদের এই বিবরণগুলি এখানে ছাপা হলো। এখন জানতে চাওয়া যে, সমতলের ঘন-বিস্তৃত ঘাসের পাতাগুলিতে কি সামান্য কাঁপনও দেখা দেয়নি? সংসারযাত্রায় বিঘœ হয়নি কি কোথাও, গৃহস্থ তার বয়স্থা কন্যা, কচি নববধূটিকে বুক দিয়ে আগলানোর ব্যবস্থা করতে চায়নি? বাড়িতে যে দু-চারটি ভোঁতা দা কাটারি বল্লম খাঁড়া বঁটি আছে সেগুলিকে কি তৈরি রাখেনি? খিড়কির দরজা হুড়কো দিয়ে প্রতিরাতে বন্ধ করেনি? ঘরের কোণে বড়ো হুড়কো কিংবা বাঁশের লাঠিটি কি খাড়া করে রাখেনি? ঘুসঘুসে জ্বর যতোই শুধু ম্যাজম্যাজ করুক – একদিন ঠিক বেরিয়ে আসে মৃত্যুর পুঁজ-রক্ত-বসা নিয়ে। এই যে এখানে পরপর আরো কয়েকটি সাক্ষ্য।
[সরকার পক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী, বয়স আনুমানিক ৪৬ বৎসর]
আমার নাম আনন্দ কুমার কোঙার. পিতা লালবিহারী কোঙার. মৌজা সাঁওতা. থানা মঙ্গলকোট।
আমি নিগণ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। সাঁওতা এবং অন্যান্য গ্রামে আমার জমিদারি আছে। গত ১লা পৌষ রাধিকা বোষ্টুমি আমাকে বলিল যে শ্রীকৃষ্ণপুরের একটি ব্রাহ্মণকন্যা তিনু মুনশির বাড়িতে রহিয়াছে। আমার  গোমস্তাকে আমি শ্রীকৃষ্ণপুর পাঠাইলাম এবং গুরুদাস আমার কাছে আসিল। সে বলিল যে তাহার বোন নিখোঁজ হইয়াছে। আমি গুরুদাসের সহিত বেলগাঁ গেলাম এবং ইশাহাক, তিনু মুনশি এবং সবুরের বাড়িতে খবর লইলাম। ওই গ্রামের কালিপদ দাস এবং ভোলানাথ ভট্টাচার্জির সহিত আমার কথা হইয়াছিল।
স্বা : ১১. ১১. ৩৮
[সরকার পক্ষের ২২ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি. বয়স আনুমানিক ৩৫ বৎসর]
আমার নাম কালিপদ দাস, পিতা নিত্যহরিদাস, সাকিন বেলগ্রাম। আমি একজন কৃষক।
আমি রাধিকা বোষ্টুমিকে চিনি। সে ভিক্ষা করিয়া ও কাঁচের চুড়ি বিক্রয় করিয়া জীবিকানির্বাহ করিয়া থাকে। গত পৌষ মাসের প্রথম দিকে সে আমাকে জানাইল যে গ্রামের ইশাহাকের বাড়িতে একজন স্ত্রীলোককে দেখিয়াছে এবং ওই বাড়ির মেয়েদের নির্দেশ অনুসারে ওই মেয়েটির শঙ্খ ও রুলি খুলিয়া লইয়া তাহাকে কাঁচের চুড়ি পরাইয়া দিয়াছে। আমি তাহাকে সেখানে আবার যাইতে এবং সে কাহার মেয়ে তাহা জানিয়া আসিতে বলিলাম। পরদিন সে আমার কাছে আসিয়া বলিল যে, মেয়েটি শ্রীকৃষ্ণপুরের এক ব্রাহ্মণের মেয়ে। রাধিকা আরও বলিল যে, মেয়েটিকে আর একবার তিনু মুনশির বাড়িতে দেখিতে পাইয়াছে। মেয়েটি নাকি তাহাকে তাহার ভাইয়ের কাছে খবর দিতে বলিয়াছে। আমি রাধিকাকে এইসব খবর প্রেসিডেন্ট আনন্দবাবুকে জানাইতে বলিলাম।
গুরুদাস এবং আনন্দবাবু ইহার পর স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আমার নিকট আসিয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে আমি যাহা জানিতাম তাহা সব বলিয়াছি। তাঁহারা জানাইল যে মেয়েটি গুরুপদর (গুরুদাস?) ভগিনী।
স্বা : ১১. ১১. ৩৮
বাদীপক্ষের ২৩নং সাক্ষীর বয়ান, বয়স আনুমানিক ৪৮ বৎসর]
আমার নাম ভোলানাথ ভট্টাচার্জি পিতা মৃত শশীভূষণ ভট্ট, সাকিন বেলগ্রাম। আমি একজন কৃষক।
গত পৌষ মাসের প্রথম দিকে রাধিকা বোষ্টুমি আমাকে জানায় যে, সে ইশাহাক শেখের বাড়িতে চুড়ি বেচিবার জন্য গিয়াছিল। তখন বাড়ির মেয়েরা তাহাকে বলে যে বাড়িতে একজন নতুন বিবি আসিয়াছে, তাহাকে চুড়ি দিতে হইবে। এজন্য সে ওই মেয়েটির শঙ্খ ও লোহা খুলিয়া লয়। মেয়েটি তখন কাঁদিতেছিল। আমি রাধিকাকে তাহার বাড়ির ঠিকানা জানিয়া আসিতে বলিলাম। দুই কি তিনদিন পরে সে আমাকে জানাইল যে মেয়েটিকে সে এবার তিনু মুনশির বাড়িতে দেখিয়াছে এবং মেয়েটি তাহাকে জানাইয়াছে সে শ্রীকৃষ্ণপুরের ব্রাহ্মণদের মেয়ে। সে ওখানে কী করিয়া আসিল তাহা জিজ্ঞাসা করিলে বলিয়াছে যে তাহার কপাল। সে আরও বলিয়াছে যে, তাহার দাদার নিকট খবর দিতে পারিলে ভালো হয়। এই কথা শুনিয়া আমি রাধিকাকে প্রেসিডেন্ট আনন্দবাবুকে জানাইতে বলিলাম। গুরুপদ (গুরুদাস?) এবং আনন্দবাবু জিজ্ঞাসাবাদের নিমিত্ত আমার কাছে আসিয়াছিলেন। আমি যাহা জানি সব তাহাদিগকে বলিয়াছি।
স্বা : ১১. ১১. ৩৮

সাবিত্রীর কাছে এখুনি আর ফিরতে পারা যাচ্ছে না। সবুরের সঙ্গে সে এখন চিৎপুর রোডে নাখোদা বড়ো মসজিদের ঠিক পেছনে পুরনো ভাঙা জাহাজের খোলের মতো বিরাট বাড়িটার দোতলা একটা ঘরে উঠে পড়েছে। তার কাছে ফিরে যাওয়াটা বেশ  জরুরি তবে একমাত্র তার কারণেই এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে  না। সে আগুন আর ভূমিকম্পের সূচনা করে দিয়ে গেছে। যদি-টদি দিয়ে এতক্ষণ যে একঘেয়ে জবানবন্দিগুলো তুলে দেওয়া  হলো, মনে হচ্ছে এরকম আরও কিছু সাক্ষীর বিবরণ এখন জানাতেই হয়।