নিমগাছের নিচে ছয়জন


আনোয়ারা সৈয়দ হক

ছয়জনই দাঁড়িয়ে থাকে দাদার আমলের নিমগাছের নিচে। তারা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না, মাঝে মাঝেই ওঠবস করে, মাঝে মাঝে পায়চারি; অস্থিরতায় মাঝে মাঝেই নিজেদের হাতের আঙুল মটকায়, মটকানো আঙুলে মটমট শব্দ ওঠে, শব্দগুলো যেন হে আল্লা, আল্লাহু করে, প্রকৃতপক্ষে যাকে বিলাপ বলা যায়।

তাদের বুকের ভেতরে যেন পাথরের ভার নেমে আসে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, জিভ শুকিয়ে আসে, প্লাস্টিকের ময়লা বোতল খুলে মাঝে মাঝে ভাগ করে পানি খায়, তবু ঘরে ঢোকে না।

ঘরে ঢুকতে তাদের ভয় করে। মনে হয় এমন কিছু ক্ষতি তাদের হয়ে যাবে যে, ঘরে থাকলে তারা সেটা টেরও পাবে না।

এভাবে আজ সন্ধেবেলা থেকে।

কিন্তু তাদের মনে হয়, তারা যেন অনন্তকাল ধরে

এরকম।

এখান থেকে, এই নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে চোখ তুলে তাকালে চোখের সামনে দিগন্ত দেখা যায়। যদিও সেই দিগন্ত আহামরি কিছু নয়, বহুদূরের লাল বা নীল হাতছানি নয়, দিগন্ত রেখার কোনো রংধনুও নয়, শুধু কিছুটা ফাঁকা আকাশ, তুলোট কাগজের মতো প্রায়শ বিবর্ণ আকাশের একটি খণ্ডমাত্র, যেখানে কোনো স্বপ্ন ভেসে ওঠে না, আশা নেই, ভবিষ্যৎও হাতছানি দেয় না; ভেসে ওঠে এমন এক বাস্তবতা যার ব্যাখ্যা দেওয়া খুব মুশকিল। একটু জটিলও বুঝি।

তবু তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারা দাঁড়িয়ে থাকে ছয়জন। শুধু এইটুকু জায়গাতেই তারা যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের কিছুটা হলেও যেন খুঁজে পায়; পালক-ছেঁড়া হাঁস যেমন দিন শেষে গুটিয়ে থাকে নিজের শরীরের ভেতরে, যেন নিজের অস্তিত্বের ধ্যানে মগ্ন হয়ে, অনেকটা যেন সেরকম।

না, তাদের শরীরে যেমন পালক নেই এ-কথা অবধারিত সত্য, তেমনি তাদের শরীরের ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড়কে পালক বলেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ এ-পোশাক তাদের বাড়িতে থাকার পোশাক। এ-পোশাক শুধু যে বড় তার জন্যেই প্রথমে কেনা বা বানানো হয়, তারপর ক্রমে ক্রমে সবকটি মেয়েই বয়স অনুযায়ী একবার করে এই পোশাক পরে। এটাই এ-বাড়ির নিয়ম।

আর যখন তারা বাইরে যায়, তখন দু’সেট পোশাকের একটাতে গা মাথা চিবুক ঢেকে যায়। এর চেয়ে বেশি পোশাক তাদের দরকার হয় না। কারণ তারা মাদ্রাসা ছাড়া আর কোথাও যায় না।

জোবেদা, শারমিন, রুমানা, শাহনাজ, তাসনিম, মমতাজ এই ছয় বোন এরকম এক সংসারের ভেতরে যেন ক্রমাগত ঘুরপাক খায়। বাড়ির চারটে দেয়াল আর উঠোনের চার কোণে তারা দিবারাত্রি বিচরণ করে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ঘরদোর ঝাঁটপাট দেওয়া, সকালের নাস্তা করা, মাদ্রাসায় যাওয়া, দুপুরে বাড়ি ফিরে আসা, রাতের রান্না করা বা রান্নায় মাকে সাহায্য করা; যে মা তার পেটের ভেতরে যেন বছর ধরেই প্রায় নতুন নতুন গর্ভ ধারণ করে চলে, যে-গর্ভের অনেকগুলো প্রায় পূর্ণ হওয়ার আগেই স্খলন হয়ে যায়।

আর যেগুলো স্খালন হয় না, তারা এ-পৃথিবীতে জন্ম নেয় মেয়েশিশু হয়ে।

 

হেই আল্লা, এইবার আমাগো একখান ভাই হইবো!

প্রথম কথা বলে ওঠে জোবেদা। সে সকলের বড়। এবং বোধহয় সবচেয়ে বেশি সুশীল ও ধৈর্যশীল। অথচ সে-ই সবচেয়ে বেশি এখন উত্তেজিত, সবচেয়ে বেশি করে তার শরীর বেয়ে অনর্গল ঘাম বেরোচ্ছে, বলতে গেলে সেই সন্ধে থেকে, যখন থেকে তাদের মা আঁতুড়ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

আঁতুড়ঘর থেকে মাঝে মাঝে গোঙানি ভেসে আসে।

সেই বিকেল থেকে এই গোঙানির শুরু। এখন প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। নিমগাছের ঝিরঝিরে পাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছে তারা। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে তাদের ভেতরটা মাঝে মাঝেই হুতাশ হয়ে উঠছে। আর তার ভেতরেই একভাবে হয়ে চলেছে চাপা এক গোঙানি। তাদের মা আঁতুড়ঘরে ঢুকেছে।

জোবেদা অনুভব করে, মায়ের সেই গোঙানির ভেতরে শুধু যেন গর্ভযন্ত্রণা নয়, আরো অনেক কিছুর সংকেত থাকে, যা বড় মেয়ে জোবেদা ছাড়া আর কেউ বোঝে না, কারণ আর কারো বোঝার ক্ষমতা এখনো হয়ে ওঠেনি।

রহিমা দাই একবার আঁতুড়ঘর থেকে বেরোয়। গলাভর্তি থুতু মুখে করে ছাইগাদার কাছে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলে। রহিমা দাইয়ের শরীর শুকনো পাটকাঠির মতো। তার গলায় একটা পিতলের হার ঝোলে। এ-হার সে কোথায় পেয়েছে জিজ্ঞেস করলে রহস্যময় হাসি হাসে, কারণ ওই এলাকায় কারো গলায় পিতলের হার দেখা যায় না।

ছয় বোন একভাবে রহিমা দাইয়ের চালচলন তাকিয়ে দেখে। তার থুতু ফেলা দেখে, তার গলা টেনে টেনে থুতু ফেলা দেখে। কিন্তু তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেন সাহস পায় না।

রহিমা দাই থুতু ফেলে একবার যেন করুণা করে ছয় বোনের দিকে তাকায়। যেন দাঁড়ে বসে থাকা ছয়টা সারস পাখি। মনে মনে ভাবে সে। তারপর একগাল হেসে বলে, মণি-রা, আল্লার কাছে দোয়া চাও, যেন এইবার তুমাগের একখান ভাই হয়।

রহিমা দাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছয় বোনের মনে হয়, তাদের মতো রহিমা দাইয়ের মনেও ভয় আছে। কারণ সেই দুবছর আগে সবচেয়ে ছোটবোন মমতাজ জন্ম নিলে তাদের বাবা রহিমা দাইকে একরকম মারতে উঠেছিল। যেন ছেলে না হবার ষড়যন্ত্রে দাইয়ের হাত ছিল।

কিন্তু সে অনেকদিন আগের ঘটনা। সেসব ব্যাপার এতদিনে হয়তো মিটমাট হয়ে গেছে।

রহিমা দাই কোন দেশ থেকে এসেছে জোবেদারা জানে না। কিন্তু সে যে এই এলাকার নয়, এ-কথা তার চেহারা আর মুখের দিকে তাকিয়ে সকলেই বুঝতে পারে। বাচ্চা খালাসের হাত ভালো, এজন্যে সে এ-এলাকায় এসে টিকে গেছে। নইলে কবে তাকে এ-জায়গা ছাড়তে হতো। কারণ রহিমা দাইয়ের চলাফেরা বেআব্র“। কখনো মাথায় ঘোমটা থাকে, কখনো থাকে না। বোরকা কাকে বলে যেন রহিমা দাই চেনেই না! অথচ এ-এলাকায় একজনও মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা পর্দাপুশিদার সঙ্গে চলাফেরা না করে।

খবিশ জেনানা, কেউ কেউ রাস্তায় দাঁত খেলাল করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে।

কিন্তু রহিমা দাইয়ের সেসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আপনমনে গ্রামের রাস্তায় পথ হাঁটে। আপন মনে বাজারঘাট করে। একজনের চালার নিচে সামান্য ভাড়া দিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কখনো-বা দেশের বাড়ি যায়। যতদিন সে দেশ থেকে না ফেরে পাড়ার গর্ভবতী মেয়েরা উৎসুক হয়ে তার ফিরে আসার পথের দিকে চেয়ে থাকে। তারা রহিমা দাইয়ের হাতে খালাস হতে চায়। মেয়েদের ভেতরে জনরব যে, রহিমা দাইয়ের হাত মাখনের মতো নরম। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ধাত্রীদের মতো খরখরে হাত নয়। বা কথায় কথায় ডাক্তাররা যেমন সিজার করে তেমন কোনো উপদেশও সে দেয় না।

আল্লা মাবুদের ইচ্ছা, মেয়ে মানুষ কষ্ট কইরে মা হবে এই দুনিয়ায়, এই আইন কিডা অমান্য করবে বলোদিনি?

রহিমা দাইয়ের এহেন বক্তব্যে গ্রামের পুরুষদেরও যে বিশেষ আপত্তি নেই, তা বোঝা যায়। কারণ সিজার করতে হাজার হাজার টাকা লাগে, তার চেয়ে রহিমা দাই অনেক ভালো।

মেয়েদের দিকে তাকিয়ে রহিমা দাই আবার ঘরের ভেতরে ঢোকে। সেই আঁতুড়ঘর। উঠোনের এক কোণে বিচালি রাখার ঘর সেটা। বর্তমানে আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করছে। ঘরের বেরোবার মুখে মস্তবড় এক ঝাঁপ আটকানো আছে এখন। অন্যসময় প্রায় পুরোটাই খোলা থাকে।

রহিমা দাই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছয় বোনের গলা দিয়ে আর্তি বেরোয়।

হে আল্লা, হে রসুল, হে বড় পির, হে মাবুদ, আমাগো যেন এইবার একখান ভাই হয়, ভাই। মাবুদ, একখান ভাই।

চৌদ্দ বছরের জোবেদা আকুল হয়ে কথা বলতে বলতে আকাশের দিকে হাত তুলে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে আরো কী সব বলে। অন্য বোনগুলো তার মুখের দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকায়। যেন তাদের মনে হয়, আল্লা এবার নিশ্চয় তাদের বড় বোন জোবেদা আপার আবেদন শুনবে। কারণ আকুলভাবে প্রার্থনা করার সময় জোবেদার মুখের তারুণ্য থিরথির করে কাঁপে। চোখ ভরে ওঠে পানিতে। চিবুকের নিচে পানি গড়িয়ে পড়ে। নাক টেনে নিয়ে সেই পানি ওড়না দিয়ে মুছে ফেলে জোবেদা। যদিও সে এখন বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে, তবু তার মুখ ও কপাল পেঁচানো ওড়না দিয়ে। এই আব্র“ সর্বক্ষণ তাকে ধরে রাখতে হয়, এমনকি নিজের বাড়িতেও। কারণ বাড়িতেও পরপুরুষের আনাগোনা মাঝে মাঝে হঠাৎ হয়ে যায়, যেমন দূরসম্পর্কের চাচা বা মামা বা মামাতো ভাই।

এইবার ভাই না হইলে আব্বা আমাগো বাড়ি থনে দূর কইরা দিবে, তাই না আপু? বড় ব্যাকুল হয়ে বলে ওঠে শারমিন। জোবেদার পিঠোপিঠি সে। কারণ তার মনের ভেতরে ভেসে ওঠে গতবারের দৃশ্য। সেবার মমতাজের জন্ম হলে তাদের বাবা আঁতুড়ঘরে গিয়ে লাথি মেরেছিল তাদের মাকে। তখনো মমতাজের নাড়ি কাটা সেরে উঠতে পারেনি রহিমা দাই। তখনো তার মা রক্তে পানিতে আঁতুড়ঘরে গড়াগড়ি।

তখনো বাচ্চা প্রসবের পরিশ্রমে তার সারা শরীর ঘর্মাক্ত।

খানকি মাগি, মাইয়া বিয়াইছিস আবার। এই বাড়িতে আজ থেইকা তর ভাত পানি বন্ধ। তুই তর মাইয়াগো লইয়া আমার বাড়ি ছাইড়া বাপের বাড়িত গিয়া উঠবি, এই কইয়া দিলাম। তিন দিন মাত্তর সময় দিলাম। এই তিন দিনের মইধ্যে –

ওহ্, সেই সময় যেন গজব নেমে এসেছিল এই বাড়ির ভেতরে। পাঁচ মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে খাটের নিচে লুকিয়েছিল। সারাদিন খাটের নিচ থেকে সেদিন বেরোয়নি।

আল্লার গজব কি একেই বলে? মনে মনে যেন ভেবেছিল মেয়েগুলো। বিশেষ করে জোবেদা আর শারমিন। তারা তখন অনেকটা বড়।

সুর করে এবার শারমিন বলে, হে আল্লা, হে রাসুলিল্লা, হে মোহাম্মদ, আমাগো দিকে খেয়াল রাইখেন। এই বাড়ি আমাগো লগে এহন বিষ হইয়া গেছে গা। এহন রাত অনেক, কিন্তুক আমাগো চক্ষে ঘুম নাই, খাওয়া নাই, শান্তি নাই, আমরা খুব পাপ করছি হুজুর। হে পরবারদেগার, হে মাবুদ, আমাগো একখান ভাই ভিক্ষা দ্যান, বাবা। একখান ভাই!

শারমিনের গলায় বুড়ো মানুষের মতো আকুতি শুনে জোবেদা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকায়।

রুমানা এবার ব্যাকুল হয়ে জোবেদার হাত আঁকড়ে ধরে বলে, এইবার যদি আমাগো ভাই না হয়, তাইলে কী হইবে আপু, আপুমণি?

সবার ছোট মমতাজ বড় বোন জোবেদার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার তুলতুলে নরম শরীর বড় কাতর হয়ে পড়েছে এখন ঘুমে। কিন্তু বড় শান্ত মেয়ে মমতাজ। বেশি কান্নাকাটি করে না। কেন যেন জন্ম থেকেই সে বুঝতে শিখেছে যে, এই পরিবারে বেশি দাপট দেখানো যাবে না। কারণ অস্তিত্বের সংকট দেখা দিতে পারে।

জোবেদা মমতাজের কোমল পিঠে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে। কারণ এখন চারপাশে অন্ধকারের ছায়া বড় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। রাতের চাঁদ এখনো ওঠেনি।

রুমানার উদ্বিগ্নতা ছোট বোন শাহনাজের ভেতরেও সঞ্চারিত হয়, নইলে সে এতক্ষণ বেশ চুপ করেই ছিল, দূরে মাথা ভাঙা তালগাছটার দিকে তাকিয়েছিল কখন চাঁদ ওঠে দেখার জন্যে। কারণ ঠিক প্রায় প্রতি রাতে ওখান দিয়ে আজকাল চাঁদ ওঠে। এই চাঁদটাকে শাহনাজের বড় আপন বলে মনে হয়। কারণ চাঁদটা শাহনাজের বড় ভক্ত। পাঁচ বছরের শাহনাজ যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে বা বাড়ির লম্বা উঠোন দিয়ে আপন মনে হাঁটে, এই চাঁদটাও তখন তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। মনে মনে এজন্যে বড় গর্বিত থাকে শাহনাজ।

কিন্তু এখন সে তার গর্ব ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে বড় বোনের দিকে। তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, ভাই কোথায় আপু, ভাই? আল্লা কোথায় আপু, আল্লা?

জোবেদা বোনদের ব্যাকুলতা দেখে নিজেকে কীভাবে যেন বড় দায়িত্বশীল মনে করে। গম্ভীর হয়ে অকম্পিত স্বরে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, আল্লার কাছে দোয়া চা বইন, এইবার নিশ্চয় আমাগো ভাই হইবে।

এরকম দোয়া তো হর টাইম চাইতেছি আপু, কিন্তু ভাই তো একবারও হয় না। গলার স্বরে এবার অনুযোগ তুলে বলে ওঠে শারমিন।

ভাগ্য ভালো আজ তাদের বাবা রহমতউল্লা বাড়িতে নেই। গঞ্জে গেছে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে দুদিন বাদে ফিরবে। তার ভেতরে কতকিছু ঘটে যেতে পারে। অবশ্য হাতে তার মোবাইল আছে। ইচ্ছা হলেই খোঁজখবর নিতে পারে। তবে সে মোবাইল বেশি বাজে না। বাড়ির খোঁজখবর নেবার জন্যে সে মোবাইল বেশি বাজে না। কখনো খুব দরকার হলে বাজে। তবে কখনো খুব দরকার রহমতউল্লার হয় না।

এ-কথাও অবশ্য জোবেদা জানে যে, তার বাবা কখনো তার মাকে মোবাইল করলে তার মা খুব যেন চিন্তায় পড়ে যায়। মোবাইলের আওয়াজ কানে না শোনার ভান করে, জোবেদাকে তখন তড়িঘড়ি করে মাকে বলতে হয় মোবাইল হাতে ধরার জন্যে। কারণ বাবার রাগ জোবেদা খুব ভালো করে জানে। সে তার বাবাকে রাগাতে চায় না। তার মাও যে বাবাকে রাগাতে চায় না সেটা জোবেদা জানে, তবু কেন যে মা তার বাবা মোবাইল করলে সহজে ধরতে চায় না, জোবেদা এর কারণ বুঝতে পারে না!

নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ছয় বোন। আলুথালু পোশাক পরে তারা দাঁড়িয়ে আছে সেই সন্ধে থেকে। তারা বাড়ির ভেতরে ঘুমোতে যেতে চায় না, কারণ তাদের চোখে এখন ঘুম নেই। শুধু ছোট বোনটি ছাড়া, যে কী না এখনো অবোধ, এ দিন-দুনিয়ার কোনো কিছু জানে না, চেনে না, ভালো কি খারাপ কিচ্ছু জানে না, এমনকি মানুষকেও ভালো করে জানে না, সে তার আপুর পিঠে চড়ে স্বর্গীয় ঘুম ঘুমোচ্ছে। হয়তো আরো কিছুদিন বাদে সে তার অন্য বোনদের মতোই এভাবে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে, দুশ্চিন্তায় ওঠবস করবে, আল্লা মাবুদের নাম কাতরে উঠে ডাকবে, কিন্তু সে-সময় এখনো তার জন্যে আসেনি।

আকাশ ফেটে এখন অদ্ভুত এক আলো বেরোচ্ছে। যদিও সে আলোয় বাস্তবের চেয়ে স্বপ্ন বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে। জোবেদাদের চোখের সামনে জীবন ও জগৎ এখন কেমন নিস্তব্ধ। কেমন শান্ত। যেন এ-পৃথিবীর কোথাও কোনো অভাব নেই, দুঃখ নেই, হতাশা নেই, আশাভঙ্গ নেই। সবই সুখ। সবকিছুই সুখ।

তবু এত সুখেও এ-বাড়ির মেয়েদের চোখে ঘুম নেই। রাত অনেক হলেও মেয়েদের চোখে ঘুম নেই। অবশ্য তারা এখন আর সেই আগের মতো উত্তেজিত কিংবা অস্থিরও নয়। তারাও এখন শান্ত। নিমতলা, জামতলা, আমতলা, লিচুতলা এখন যেন নিঃশব্দ। যেন কোথাও কোনো ঢেউ ওঠেনি। আবার সবকিছু কেমন নির্বিকার, দূর, নিরপেক্ষ।

জোবেদা, শারমিন, রুমানা, শাহনাজ, তাসনিম এবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে নিমগাছের তলায়। মমতাজকে পাতার বিছানায় যতœ করে শুইয়ে দেয়। চিৎ হয়ে তারা ছয় বোন আকাশ দেখে। ঝিলিমিলি পাতার ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখে। আকাশ কত বড়। আকাশে কত তারা।

শারমিন হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা আপুমণি, আমরা মাইয়া না হইয়া আকাশের তারা কেন হইলাম না? আল্লা মাবুদ আমাগো আকাশের তারা করলেও তো পারত। এতগুলান তারার মইধ্যে আমরা দুই-চারটা তারা বেশি হইলে কী এমুন বেশি হইত? তাইলে তো এইহানে আমাগো আর আসতে হইত না। এই পৃথিবী চক্ষে না দেখলে কী এমন ক্ষতি হইত, আপুমণি?

বুড়া মাইনসের মতন কথা বলিস না, শারমিন। ধমকে উঠল জোবেদা। কিন্তু মনে মনে স্বীকার না করে পারল না যে, তার বোন কথাটা একেবারে ফালতু বলেনি।

একটু পরে হিম পড়তে শুরু করল। দু-একটা নিম ফল টুপটুপ করে পড়তে লাগল তাদের শরীরে।

তরা ঘরে যা গিয়া, বলে উঠল জোবেদা।

বোনের কথা শুনে রুমানা, শাহনাজ, শারমিন, তাসনিম চিৎকার করে উঠল। সমস্বরে বলে উঠল, আমরা ঘরে যামু না আপু, আবার বইন হইলে বাবা আমাগো মাইরা ফালাইবে। হেইদিন সে কী বলছিল মনে নাই?

মনে ছিল জোবেদার। বাবা রহমতউল্লা দুপুরে ভাত খেতে তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, এইবার মাইয়া হইলে তুমি আমার সংসার থনে যাইবা গিয়া, আমি আবার বিয়া বসুম।

আর আপনার মাইয়াগো রাখবেন কোথায়? তার মা সাহসী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

তাগো তোমার সঙ্গে লইয়া যাইবা। আমি কি তোমারে মাইয়া বিয়ানোর জন্য বিবাহ করছিলাম, হেই মাতারি?

তারপর বাবা ভাত খাওয়া অসমাপ্ত রেখেই রাগে গরগর করতে করতে হাত ধুয়ে উঠে চলে গিয়েছিল।

ঘটনাটা বেশিদিন আগে ঘটেনি। তাই মেয়েদের সব কথা মনে ছিল। মাঝে মাঝে তাদের মনে হয়, কেন আল্লা তাদের এমন একটা সংসারে পাঠিয়েছে যেখানে তাদের ঠাঁই হবে না তা ভালো করে জেনেই? মেয়েদের সঙ্গে আল্লার এ কী রকমের ঠাট্টা-তামাশা?

তারা চিৎ হয়ে শুয়ে এসব ভাবনা ভাবতে থাকে। তারা ছোট হলেও এ-সংসারে যে অনাহূত হয়ে আছে কথাটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাদের বাড়িতে কখনো কোনো উৎসব হয় না। ঈদে বকরিদেও তাদের বাড়ি থাকে বিষণœ। এত খরচ কীসের জন্যে? এই মাইয়াগুলানের পেট ভরাইয়া লাভ কী? সব তো সেই পরের বাড়িতে বান্দি হইয়া থাকবো সারাজীবন?

আর তাই তাদের মা আঁতুড়ঘরে ঢোকামাত্র যেন এটা বুঝে গেছে যে, আজ রাতের ভেতরেই তাদের এ-সংসারে অবস্থান কোথায় সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যেন ভালো খবর শুনলেই কেবলমাত্র তারা ঘরের ভেতরে ঢুকবে, নইলে নয়, নইলে যেন তারা যাত্রা করবে দূরের কোনো জগতের দিকে, যেখানে শুধু ভালো মানুষেরই বসবাস, আর কোনো কিছুর নয়। ঘুমন্ত ছোট বোনটিকে পিঠে করে নিয়ে রওনা দেবে তারা। উঠোন পেরিয়ে, পুকুরপাড় ধরে, মাঠ, পাগার, শস্যক্ষেত ধরে, আলপথ ধরে, গঞ্জের ইটবিছানো লম্বা পথ ধরে তারা চলে যাবে সকলের চোখের আড়ালে। আর এ-বাড়িতে, এই গ্রামে, এই জনপদে তারা আর ফিরবে না।

যেন তারা এ-পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে হতভম্ব, অবাক, কুণ্ঠিত।

অথচ তারা কেউ, যতদূর তাদের মনে পড়ে, এ-পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতে চায়নি।

চাঁদের আবছা আলোয় নিমের পাতা ঝিলমিল করে বাতাসে দোলে। আমগাছে রাতজাগা পাখি এসে বসে। তার ডানা ঝাপটানি মাঝে মাঝে শোনা যায়। ছয় বোনের নিঃসঙ্গ জীবনে থিরথির করে প্রত্যাশার ঢেউ নড়তে থাকে। সে-ঢেউ ক্রমশ ব্যাপ্তি লাভ করে ছড়িয়ে যায়।

শারমিন সরু গলায় কাঁপন তুলে বলে ওঠে, আল্লা, এইবারও আমাগো ভাই না দিলে আম্মা আবারো আঁতুড়ে যাইবো। গঞ্জনা দিবো মাইনষে। তগো বাড়িতে আবার মাইয়া, আবার? তর মায়ে কি মাইয়া উৎপাদনের ফ্যাক্টরি খুলছে? মাইয়া কি তর বাপ-মায়ে বিদেশ চালান দিবো? – আমরা আবার মাইর খাইবো। মাদ্রাসার হুজুরে গাল টাইন্যা ধরবো। ফুপুগুলান আমাগো গালি দিবো তাগো ভাইরে ফতুর কইরা দিতেছি বইল্যা। বাবায় বাড়ি আইয়া চিল্লায়বো। রাতে না খাইয়া থাকন লাগবো। মায়ে বলবো, মুখপুড়ি, মইরা যা তোরা, মইরা যাস না ক্যান, এত কীসের তদের বাঁচনের সখ। আমি এমুন কী পাপ করছিলাম?

বোনের নকল করে রুমানা চিরচিরে গলায় সুর তুলে নিয়ে বলে, আমরা তো বাঁচতে চাই না, আমরা মরতে চাই, কিন্তুক ভাই চোক্ষে দেইখা মরুম, মায়ের কষ্ট লাঘব দেইখা মরুম, মাবুদ গো!

তারা আবছা চাঁদের আলোয় আপন মনে ঘুরঘুর করে। এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে চোখে তাদের ঘুম নেমে আসছিল। হাজার চেষ্টা করেও সে ঘুম তারা যেন আর তাড়াতে পারছিল না। চোখের ঘুম তাড়াবার জন্যে তাদের কেউ আমগাছের ধারে, কেউ জামগাছের ধারে, কেউ হাঁস-মুরগির দরমার কাঠের পাটাতনের ধারে ঘুরঘুর করছিল। শুধু জোবেদার পিঠের ওপরে সবচেয়ে ছোট মমতাজ। তার কোনো নড়াচড়া নেই। সে একভাবে স্থির হয়ে আছে। শুধু তার নিঃশ্বাসের ওঠানামা। জোবেদা আবার তাকে পিঠে করে দাঁড়িয়ে আছে। আবার সেই অবস্থাতেই ওঠবস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ মধ্যরাতে একটি নবজাত শিশুর কান্নায় ভরে উঠল সমস্ত বাড়ি। তার গলায় জোর কি! যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয় করার জন্যে সে এই পৃথিবীতে এসে অবতরণ করেছে। চমকে উঠল জোবেদা। চমকে ওঠে তার অন্য বোনেরাও। জোবেদার কান খাড়া হয়ে উঠল। নবজাতের কান্না শুনে কি বোঝা যায় সে কোন লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে? হায় আল্লা, কান্না শুনে কি মানুষ কী লিঙ্গের তা বোঝা যায়?

জোবেদাদের জন্যে সে কী বার্তা নিয়ে এসেছে তা কি এখন বোঝা যাবে? এর আগেও তো এ-বাড়িতে যত শিশু জন্ম নিয়েছে তাদের কারো গলায় তো জোরের কোনো অভাব ছিল না! তাহলে?

আর পাঁচজন বোনও শিশুটির কান্না শোনে। তাদের শরীর ভয়ে, শঙ্কায়, অনিশ্চয়তায় থমথম করে ওঠে। তারা পিলপিল করে যে যেখানে ছিল নিমগাছের নিচে এসে হাজির হয়। আধো আলো আধো অন্ধকারে তাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তারা যেন ছাগ শাবক। তারা তাদের বড় বোনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারা মুখ তুলে আকাশ দেখে। আকাশের ব্যাপ্তি দেখে। কামানের গোলার মতো ঝুলন্ত লম্বা চাঁদ দেখে।

আপু, আপুমণি রে, বলে ডুকরে ওঠে শারমিন।

আর চুপ, চুপ বলে ওঠে জোবেদা।

তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে সে নিজেই এবার আর্তচিৎকার করে, এইবার একখান ভাই চাই, ভাই। হে আল্লা মাবুদ আমাগো প্রার্থনা শুনেন। আমাগো একখান ভাই দিবেন। আমাগো জানের মূল্য নাই মাবুদ। আমাগো সংসারে একখান মূল্যবান জীবন দিবেন। একখান ভাই দিবেন। একখান ভাই দিবেন।

বড় বোনের আর্তি দেখে চার বোন সমস্বরে আহাজারি করে ওঠে।

শেষের জন অবশ্য চুপ। সে সেই সন্ধে থেকে জোবেদার কোলে। সে শুধু ঘুমায়।

ঘষা চাঁদের আলোয় গাছগাছালির মাথায় কুয়াশা জমে। কুয়াশা ক্রমশ ব্যাপ্তি লাভ করে। জীবজগতের জন্ম-রহস্য ক্রমশ ঘনায়মান এক জটিলতার ভেতরে আবর্তিত হয়। বাস্তব এবং স্বপ্নের ভেতরে সংঘর্ষ কখনো কখনো হয়ত বা একটি শব্দের স্ফুরণ মাত্র, একটি লিঙ্গের স্ফুরণ মাত্র, কিংবা হয়ত এসবের ঊর্ধ্বে কিছু। সঠিক কে বলতে পারে।