নির্বাসন

রেজাউর রহমান

মে ১৯৭১।

ট্রেনের যাত্রীরা কেউই রাজেন্দ্রপুর রেলস্টেশনে পৌঁছুতে কতটা সময় লেগেছে, তা এ মুহূর্তে আন্দাজ করতে পারবে না। পারার কথাও নয়। আর এখানকার সময়টাই-বা কত তাও-বা কে বলবে? ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের চোখ-মুখের অবস্থাও এতটা নিমগ্ন ও আতঙ্কিত যে, তাঁদের চেহারা-সুরত, ইঙ্গিত-ইশারার সময় বিবেচনা করার মতো মনের অবস্থা কারো ছিল না। আশপাশের বনজঙ্গলের অবস্থাও যেন অনেকটা তেমনি। গড় অঞ্চলের শাল-গজারি বনের ঝোপঝাড়েও যেন জমে আছে বিরস আধো-অন্ধকার। ইঞ্জিনের হুস-হুস ও গুটিকয়েক মাত্র বগির গড়গড়-হড়হড় শব্দে ট্রেনটা যখন প্রকান্ড কোনো

যান্ত্রিক সরীসৃপের মতো বাঁক নিয়ে শ্রীপুরের দিকে চলে গেল, তখন হঠাৎ করেই একঝলক শেষ বিকেলের রোদ পুরো এলাকাটা ঝলসিয়ে দিলো যেন। সেই আলোর ঔজ্জ্বল্য কাটাছেঁড়া জনপদ ছাড়িয়ে গজারি বনের আবছায়া অন্ধকারেও ঢুকে পড়ে। তাতেও ঝলমলে নিমগ্ন আবহ তৈরি করে জেগে উঠতে পারছে না যেন ট্রেন থেকে নামা ছোট একটা জনগোষ্ঠী। তাঁরা ঢিল খাওয়া বন্য পাখির মতো কে কীভাবে যে পালিয়ে বাঁচবে, সেই ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন। দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত।

তাঁদের সামনে বন্দুকের নল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে গুটিকয়েক পাকিস্তানি সেনাদলের পোশাকি সদস্য। তাদের আধাআধি টহলে মহড়ারত, বাকিরা স্থাণুবত। বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। তারা শত্রুর মুখোমুখি। শুধু তফাত তাদের বিপক্ষ নিরস্ত্র জনগণ। তাঁরা শুধু মরতে জানে। মারতে শেখেনি তখনো।

রাজেন্দ্রপুর রেলস্টেশনের যাত্রীদের মধ্যে রওশন, তমিজ, আদুও ছিলেন। তাঁরা তিনজন ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলেন সকাল আটটায়। অন্য সময় হলে রিকশায় পুরনো শহরের বংশাল থেকে নবাবপুর হয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছুতে বড়জোর এক-দেড় ঘণ্টা লাগার কথা। সেখানে আজ লেগেছিল চার ঘণ্টারও বেশি।

রওশন-তমিজ খুব সকালে ওঠেন। আদু ঝটপট চুলায় খিচুড়ি চড়িয়ে দেন। রাতের অবশিষ্ট মোরগের মাংস-ঝোল আর খিচুড়ি খেতে বসে কারো মুখে কোনো কথা নেই। নীরবে সবাই খেয়ে উঠে পড়েন। তাদের চোখ-মুখে অনিশ্চিত-দুশ্চিন্তার কালো ছায়া।

তাঁরা ঠিক করেন, পথ যথেষ্ট দীর্ঘ হলেও একবারে স্কুটার না নিয়ে রিকশা নেবেন। তাও ভেঙে ভেঙে এবং তাঁদের জানা গলিপথ ধরে। তাঁরা জানেন, নবাবপুর রোডটা নিরাপদ নয় তেমন। রথখোলা-বনগ্রাম থেকে ফুলবাড়িয়া রেলগেট পর্যন্ত এলাকা – টহলদার পাকিস্তানি সেনা যতটা না, অবাঙালি বিহারিদের দৌরাত্ম্য বেশি। তারা নাঙ্গা তরবারি হাতে নিরীহ বাঙালি, এর ওপর যদি কোনোক্রমে হিন্দু পথযাত্রী পেয়ে যায়, তা হলে তাদের উল্লাসের সীমা থাকে না। যেন ভয়ংকর হিংস্র জন্তুর নাগালের সীমানায় লোভনীয় শিকার এসে হাজির। তারা তখন ‘নারায়ে তকবির… আল্লাহু আকবার’ বলে নারকীয় উল্লাসে মেতে তাদের জবাই করে রাস্তায় ফেলে রাখে। এমন দৃশ্য গত এপ্রিলের প্রথম দিকে রিকশায় চলতে চলতে রওশন-তমিজ দেখেছিলেন।

রওশন-তমিজ তখন রিকশায় এ-পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা আড়চোখে অনেক কিছুই দেখলেন না দেখার ভান করে। তখন তাঁরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত শীতল রক্তপ্রবাহ বয়ে যেতে থাকে। তিনি দেখেন, স্থানীয় ‘পদ্মনিধি ফার্মেসি’র মালিক কার্তিক সাহার অসাড় হয়ে আসা দেহের শেষপর্বের গলাকাটা মুরগির মতো তাঁর পা দুটির খিঁচুনির দৃশ্যটি।

কার্তিক সাহা তাঁর নবাবপুরের দোকানে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা রাখতেন। রওশন মাঝেমধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে তাঁর ফার্মেসিতে পত্রিকা পড়তে যেতেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুসুলভ হৃদ্যতাও ছিল রওশনের। রওশনের বাড়ি সেখান থেকে খুব একটা দূরে ছিল না।

 

বাড়ি ছাড়ার সময় রওশন-তমিজ মোটামুটি ভেঙে ভেঙে রাস্তা ধরার একটা পরিকল্পনা নিয়ে বের হন। স্থানীয় রিকশাওয়ালারাও আজকাল দামদর কম করে। মেপে কথা বলে। যাত্রার পথ ও  গন্তব্যস্থলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা ভেবে তবে প্যাসেঞ্জার নেয়।

রওশন-তমিজ ওয়েল ড্রেসড হয়ে বের হয়েছিলেন। এটা তাঁদের কৌশলগত এক বিবেচনা। তাঁরা শুনেছেন, বড়লোকি বা সম্ভ্রান্ত দেখালে সময় সময় পাকিস্তানি সেনারা সমীহ করে। উৎপাত-অত্যাচার কম করে। আদু তাঁর নিজের জামা-কাপড় নিয়ে কখনো ভাবেননি। তাঁর তেমন কিছু নেইও। সুতরাং তাঁর পরনে লুঙ্গি-হাফহাতা শার্ট। পায়ে ময়লা আধা খসে যাওয়া স্পঞ্জের চপ্পল।

তাঁরা প্রথম ধাপে গুলিস্তানে এসে রিকশা বদলান। সেখান থেকে কাকরাইল। কাকরাইল থেকে ফকিরাপুল। সেখান থেকে কমলাপুর, কমলাপুর রেলস্টেশন।

তাঁরা রেলস্টেশনের চত্বরে উঠে ভড়কে যান। এ-যে এক যুদ্ধক্ষেত্র। ওপরে দোতলার দিকে চেয়ে দেখেন সারি সারি মেশিনগান। ট্রিগারে আঙুল রেখে রেলিংয়ের পেছনে যেসব সৈনিক দাঁড়িয়ে, তাদের তেমন চোখে পড়ে না। তাদের মাথার হেলমেটে বনজঙ্গলের গাছগাছালি সাজানো।

রওশন-তমিজ-আদু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ধীর-পদক্ষেপে তাঁরা টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যান। টিকিট ঘরে আলো কম। সেখানে চুপচাপ বসে আছেন এক সফেদ দাড়িওয়ালা কর্মচারী। মাথায় তাঁর জিন্নাহ ক্যাপ। তাঁকে রওশন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই সাহেব, রাজেন্দ্রপুরের ট্রেন কখন ছাড়বে?’

কর্মচারী কোনো উত্তর দেন না। নির্বিকার বসে থাকেন। রওশন আবার কথা বলতে গেলে রেল কর্মচারী ধমকে ওঠেন।

‘আপনারা রাস্তায় বের হন কেন? ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। এটা রেলস্টেশন না ক্যান্টনমেন্ট… অবস্থা দেখেন না? আমরাও তো জীবিত না মৃত বলতে পারি না।’ পরক্ষণে তিনি তাঁর গলা নামিয়ে ফেলেন।

‘রাজেন্দ্রপুর একটা ট্রিপ দেওয়ার কথা। তবে তা কখন এক আল্লাহ্ বিনে কেউ জানে না। অপেক্ষায় থাকুন।’

বেলা বয়ে যায়। তাঁদের ক্ষুধা পায়। তাঁরা ঠিক করেন, স্টেশন চত্বর থেকে বেরোনো যাবে না। চারিদিকের সৈনিকদের যে ভয়াবহ অবস্থান! তাঁরা একটা পিলারের আড়ালে লেটি মেরে বসে পড়েন। তমিজ ইশারায় এক ভ্রাম্যমাণ চা-ওয়ালাকে ডাকেন।

ছোকড়া চা-ওয়ালা চা-বিস্কুট দিতে গিয়ে ফিসফিসিয়ে তাঁদের সাবধান করে। ‘অবস্থা গরম… গতকাল চলতি হুন্ডা থেইক্কা দুইডা ছেলে বোমা ছুইড়া মাইরা পালাইয়া গেছে। তাদের মাঝখানে আইয়া বাঙালিরা এমন করতে পারে পাকিস্তানি সেনারা ভাবতে পারে নাই। তারা ভয় পাইছে। সেনাগোর একজনের চোখ জইলসা গেছে গা। চাইরদিকের অবস্থা দেহেন না?’

তাঁরা কথা বাড়ায় না। নীরবে চা খায়। আদু কি একটা বলতে গেলে তমিজ তাঁকে থামিয়ে দেন।

ঘণ্টাখানেক পরে স্টেশনে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। খবরটা মুখে মুখে ছড়ায়। রাজেন্দ্রপুরের ট্রেন ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। টিকিট কাউন্টারমুখী লাইনে দাঁড়িয়ে যায় অনেকে। টিকিট সংগ্রহ করে। টিকিট নেন রওশনরাও। ধৈর্য ধরেন। নীরব অনড় ভঙ্গিমায়। পাছে সাজানো বন্দুকের নলের পেছনের লোকগুলোর চোখে কোনো দোষ ধরা পড়ে।

যাত্রীদের মধ্য থেকে যার সামনে যে বগি পড়েছে তাতেই উঠে পড়ে। কোনটা সুবিধার, কোনটায় বসার জায়গা আছে – এসব বিবেচনার সময় নেই কারো। স্টেশনে সশব্দ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে টহল দেওয়া সঙ্গিন উঁচানো পাকিস্তানি সেনাদের চোখের আড়াল হতে পারলেই যেন আপাতত রক্ষা। পরের খবর কারো জানা নেই।

কালো ভুতুড়ে ট্রেনের ইঞ্জিন টেনে নিয়ে চলে গুটিকয়েক মাত্র বগি। ঘুষ-ঘুষ, হুস-হুস শব্দে কালো-সাদা বড় আকারের ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে। রওশনরা মাঝামাঝি বগিতে যথেষ্ট ভিড়ের চাপাচাপির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে তিনজনে যেন এক হয়ে সেঁটে থেকে কিছুটা নিরাপদ বোধ করেন। কুর্মিটোলায় এসে ট্রেন একেবারে ধীরগতিতে চলে। অনেকটা না চলার মতো।

সেখানকার লাইন ধরা সেনাসদস্যরা বন্দুকের নল সই করে বগি চেক করে যায়। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে।

‘কই মুক্তি হ্যায়, ইধার…ইধার। রাহে তো উতর যাও… আগার বাদ মে মিলা তো বুড়াই হোগা… জাহান্নাম মে ভেজ দেগা… স্রিফ এক গোলি। দো নেহি। গোলি কা দাম বহুত। মালাউন-খিঞ্জির (শূয়র) এ দেশমে নেহি রাহেগা।…’

সবাই কথাগুলো শোনে। দাঁত চেপে, শ্বাস বন্ধ করে। ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ আপসার (অফিসার) হাতে ইশারা করে। আবার কালো-ভুতুড়ে ইঞ্জিন সিটি মেরে চলতে শুরু করে।

রওশন-তমিজ-আদু ও অন্য যাত্রীরা রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে ভয়ংকর-ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে পড়ে যান। এক তরুণ পাকিস্তানি অফিসারের নির্দেশনায় সব যাত্রীকে লাইন করে দাঁড়াতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে দুজন জওয়ান প্রথমে সবার কনুই পরীক্ষা করে, দুজনকে বুকে সজোরে থাপ্পড় মেরে লাইন থেকে বের করে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে দুজন কালচে দেহরঙের সৈনিক বন্দুকের নল উঁচিয়ে এগিয়ে আসে। ‘তোম লোগ মুক্তি হ্যায়?’

তাঁরা অফিসারের দিকে চায়। অফিসার কিঞ্চিৎ মাথা নোয়ায়। আর মার্চ করে এগিয়ে আসা দুজন সৈনিক তাঁদের মাথা বরাবর দুটো গুলি করে। তাঁরা মাটিতে পড়ে হাত-পা ছেড়ে দেয়। চোখ মেলে থাকা শূন্য-দৃষ্টি তাঁদের স্থির হয়ে যায়। তাঁদের তাজা রক্ত স্টেশন ফ্লোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে যেতে গড়িয়ে যায় খানিক। বাকি সবাইকে ধমকে ওঠে একজন সৈনিক।

‘ভাগ্গো ইহাছে…।’

রওশন, তমিজ ও আদু বাকি সবার সঙ্গে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে ছুটতে থাকেন। কিছুদূর এসে তাঁরা এক ছাপড়া চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ান। তারা বড্ড পিপাসার্ত তখন। তমিজ টিউবওয়েল চাপেন, রওশন অাঁজলা ভরে পানি গেলেন ঢক্ ঢক্ করে। আর তখন তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জন সৈনিক। তারা যে চায়ের ছাপড়ার ভেতরে বসে ছিল বেশিরভাগ ছুটতে থাকা লোকজন তা দেখেননি।

সৈনিক দুজন রওশন-তমিজ-আদু ও অন্য একজনকে লাইনে দাঁড় করায়। তাঁদেরকে ফাঁকা ফাঁকা একটা বনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। চিৎকার করে। তারা সঙ্গিন উঁচিয়ে পেছন থেকে তাড়া করে, ‘জলদি হাঁট্টো।’

দলের চতুর্থ অপরিচিত ব্যক্তিটি ছিল রুগ্ণ-জীর্ণশীর্ণ। সে ভালো হাঁটতে পারছিল না। তাঁকে পেছন থেকে বেয়নেট চার্জ করে ঝোপের পাশে ফেলে দেয়। লোকটি অাঁতকে কঁকিয়ে উঠলেও কাঁদতে পারে না। মৃত্যুভয়ে যন্ত্রণাকাতর হয়। শব্দ না করে। সৈনিক দুজন কিছুদূর গিয়ে রওশন ও তমিজকে দাঁড় করায়। পকেট  সার্চ করে টাকা-পয়সা যা পেল হাতিয়ে নিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলে আদু চিৎকার করে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ‘না…।’

এবার একজন সোলজার ঘুরে আদুর মাথা বরাবর গুলি করে। আদু ছিটকে পড়ে যায়। আর পাকিস্তানি সেনা দুজন রওশন-তমিজকে লক্ষ করে চিৎকার করে ওঠে। ‘হাঁট্টো… ইহাছে। জলদি ভাগো…।’ তাঁরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকেন। কাঁচা সড়ক ধরে নয়। আধা গজারি বনের জঙ্গলাপথে। নিজেদেরকে আড়াল করে। সেই দৌড় এসে থামে রাজাবাড়ীর বাজারে।

তাঁরা চাপকল খুঁজে পানি গেলেন ঢক্ ঢক্ করে। তাঁরা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, হতভম্ব-ভগ্নপ্রায়। কলের পাশেই বসে পড়েন তাঁরা। এতক্ষণে তমিজ মুখ খোলে। ‘ভাইজান… আমাদের ব্যাগ যে কোথায় ফেলে এসেছি…।’

দেরিতে মুখ খোলেন রওশন। ‘তমিজ বুকে হাত দিয়ে দেখ তো আমাদের জান আছে কিনা…, বেঁচে আছিস কিনা? ব্যাগ দিয়ে আর…।’

‘ভাইজান এখনো আছি…, তবে কতক্ষণ থাকব জানি না। আবার-না চোখ তুলে দেখি পাকিস্তানি সেনা দু’পা ফাঁক করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে।…’

বিশাল সান্ধ্য-সূর্যের রক্তিম বলয় একটু আগে আড়াল হলো। গজারি বনের ধারঘেঁষে। চারপাশ অন্ধকার প্রায়। বাজারে লোকজন আছে বলে মনে হলো না। তারপরও দেখা গেল, বাজারের পুবকোনার ঢালুতে দুটি দোকানে হারিকেনের মৃদু বাতি জ্বলছে।

তাঁরা সেদিকে এগিয়ে যান। তাঁরা দেখেন একটি ছোট পরিসরের মিষ্টির দোকান। তাঁরা সরাসরি সেটাতে ঢুকে যান।

‘খাবার দেন আমাদের’ – রওশন বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন।

দোকানি যেন তাঁদের অবস্থা বুঝতে পারে। সে কথা না বলে দুই প্লেট মুড়ি ও বাসি জিলাপি এগিয়ে দেয় তাঁদের দিকে।

‘কৈথনে আইছেন… গাজীপুর? হুনলাম অনেক মানু আইজ মারা পড়ছে ইস্টিশনে।’ তমিজ মুখে জিলাপি তুলে দিতে দিতে মাথা নাড়ে।

‘ভাইজান… আদুরে যে রেখে এলাম?’

রওশন তমিজের দিকে চেয়ে থাকে। ফ্যালফ্যাল করে। বিরতি দিয়ে মুখ খোলেন।

‘থেকে যাওয়ার তো কথা ছিল আমাদের। কেমনে জানি…।’

তমিজ মাথা নুইয়ে মুড়ি চিবান। ঢক্ ঢক্ করে পানি গেলেন। তাঁকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখায়। তাঁরা ছায়ার মতো বসে থাকেন একঠায়। সময় যায়। রাত বাড়ে।

দোকানি দোকানের ঝাঁপি ফেলার প্রস্ত্ততি নেয়।

‘ভাইজান উঠতে অয়। যা দিনকাল পড়ছে। আপনেরা যাইবেন কই?’

‘পলাশডাঙ্গা। কাসুন্দিয়া গ্রাম।’

‘হে তো… অনেকদূর। তাড়াতাড়ি হাঁটলেও তো দেড়-দুই ঘণ্টার পথ।’…

তমিজ পকেটে পয়সা খোঁজেন। রওশন মোজার ভেতর থেকে টাকা বের করেন। কষ্টে হাসেন।

তাঁরা উঠে দাঁড়ান। তাঁদের গা-গতর তখনো কাঁপছে। চোখের সামনে এত মৃত্যু! ‘পথে আবার মিলিটারির টহল পড়বো না তো?’

‘না দাদা, রাইত-বিরাইতে তারা বাইর অয় না। এদিকে মুক্তিগোর আনাগোনা বাড়ছে’ – দোকানি সাহস দেয়।

 

রাত করে রওশন-তমিজ বাড়ি গিয়ে উঠলে সবার আগে টের পায় রওশনের ফুফাত বোন কুসুমী। সে স্থানীয় কলেজে পড়ে। সে সবাইকে জাগিয়ে তোলে।

রওশনের মা দৌড়ে আসেন।

‘এত দেরি করলা যে… আদু কই? তাঁর না আওয়ার কতা? তাঁর বউ কয়বার আইয়া গুইরা গেছে।’

রওশন চুপ। দেরিতে উত্তর দেয় তমিজ।

‘সে পরে আইবো।’

 

রওশন তমিজের আপন খালাত ভাই। চাকরির সূত্রে তমিজের বাবাসহ পুরো পরিবার করাচিতে আটকা পড়েছে। তমিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। প্রথম বর্ষ জৈব রসায়ন। রওশনের সঙ্গে থাকেন। রওশন এমএসসি পাশ দিয়ে নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন। আদু ৭-৮ বছর বয়সে রওশনদের বাড়িতে ফুটফরমায়েশ করার জন্য এসেছিল। তাঁদের গ্রাম থেকে। সে রওশনের সমবয়সী প্রায়। আসল নাম তার আবদুল। ডাকের সুবিধার্থে তা হয়ে গেছে ‘আদু’। রওশনের বাবার নওয়াবপুর রোডে সাইকেল পার্টসের দোকান ছিল। মার্চের শেষের দিকে তা বিহারিরা লুট-দখল করে নেয়। তখন মেয়ে-পরিবার নিয়ে ঢাকায় আর নিরাপদ রইল না। তাঁরা ডেমরা হয়ে নদীপথে নিজ গ্রাম কাসুন্দিয়ায় চলে আসেন।

রওশনের মা-কুসুমী দৌড়ে পাকের ঘরে যান। কুপি হাতে। গুড়-মুড়ি-দুধ সাজিয়ে দেয়। মাদুর বিছিয়ে।

রওশন-তমিজ খাওয়াতে খুব আগ্রহ দেখায় না।

‘মা… আমরা বড় ক্লান্ত… সারাদিন এক দৌড়ের মাথায়। আমাদের বরং একটু শুতে দাও।’

কুসুমী ঝটপট উঠে যায়। বৈঠকখানার বড় চৌকিতে বিছানা-বালিশ গুছিয়ে দেয়।

‘আসেন ভাইজান।’

রওশন কলপাড় থেকে চোখে-মুখে জলের ছিটা দিয়ে শুতে চলে যান। কারো সঙ্গে খুব একটা কথা না বলে। কুসুমী ধরে নিয়েছিল পরে হয়তো রওশন আসবে। কিন্তু  তিনি আসেননি আর।

কিছুক্ষণ ঢাকা-দেশের খোঁজখবর নিয়ে বাকিরাও উঠে যায়। একে একে। থেকে যায় শুধু তমিজ-কুসুমী। উঠানের পশ্চিম কোনার ডালিম গাছের নিচে তাঁরা বসে থাকেন। আকাশজুড়ে ফুটফুটে তারার মেলা। জ্বলছে-নিভছে।

তমিজ কুসুমীকে কাছে টানেন।

‘কাউরে কইও না। আদু মারা গেছে।’

‘কী বলেন?’ ভয়ে তমিজের হাত জড়িয়ে ধরে কুসুমী।

তমিজ স্পষ্ট যেন দেখতে থাকে, তাঁদেরকে গুলি করার পূর্বমুহূর্তে আদু দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল পেছন থেকে। তাঁদের বাঁচাতে। পাকিস্তানি সেনার এক গুলিতে তার মাথার মগজ বেরিয়ে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। সেই কথা মনে হলে তাঁর এখনো বুক ধড়ফড় করে। হাত-পা কেঁপে ওঠে।

কুসুমী হু-হু করে কেঁদে চলে।

‘এইডা কি হুনাইলেন!’

‘রওশন ভাইয়ের মুখ দেইক্কা বুঝ না। হে যে এহানে বইল না একদন্ড।’

‘তাই তো।’

তাঁরা অনেক রাত পর্যন্ত এমনি বসে থাকেন। শেষরাতের দিকে এলোমেলো ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে। নারিকেল-সুপারি বাগিচার মাথা নাড়িয়ে।

ভীতসন্ত্রস্ত  হয়ে কুসুমী জড়ানো কণ্ঠে জানায়,

‘হুনা যাইতাছে আমাদের স্কুলের মাঠে নাকি পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প বইবো।’

‘তাই নাকি?’ চিন্তিত দেখায় তমিজকে।

অদূরের জুম্মাঘর থেকে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসে। আর আজান শেষ হতে না হতে আদুর বউ জমিলার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

‘রওশন-তমিজ বাবারা তোমরা আইছ?’

কুসুমী মুহূর্তে পালিয়ে যায় উঠান ছেড়ে।

তমিজ উঠে দাঁড়ায়।

‘আসেন জমিলা বু। কেমন আছেন?’

‘কেমন থাকমুরে বাপ’… মাইনসের রক্তে তো সারাদেশ ভিজ্জা যাইতাছে গা।… আল্লাও যে আমগোর উপর থনে চোখ তুইল্লা নিছে গা।’

অাঁচলে চোখ মুছেন জমিলা।

‘ত বাবা আদু রে কৈ রাইক্কা আইলা।’

‘বু খালি বাড়ি রাইক্কা আইতারলাম না। চুরি-ডাকাতি এত বাড়ছে। আমরা গেলে হে আইবো। এই হপ্তাখানেক বাদে। চিন্তা কইরেন না।’

‘আল্লাহ্-ভরসা।…’

 

তিনদিনের মাথায় রওশন একা ঢাকা যাওয়ার প্রস্ত্ততি নেন। নতুন চাকরি তাঁর, তাও আবার সরকারি। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর পাকিস্তানি সেনা, গোয়েন্দা দফতরের নজরদারি রয়েছে। অনুপস্থিত থাকা যায় না। তারপরও তিনি কেন, অনেকেই ফাঁকি ও নানা উছিলায় দেশে যায়। অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবার-দাবার, টাকা-পয়সা তো সব সংসারেই লাগে। মানুষের আয়ও তো সীমিত হয়ে পড়েছে। আর আয় করার সুযোগও কমে গেছে। এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য তো তেমন নাই বলা চলে। স্থানীয় কিছু কায়কারবার আছে। তাতে অনেকের সংসার না চলার অবস্থায় এসে ঠেকেছে। রওশনের অবস্থাও তাই। মাস কাবারে তাকে কাসুন্দিয়ায় আসতে হয়।

রওশনের সুবিধামতো ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে আসাটা তেমন সাদামাটা দায়ভারই শুধু নয়, এর পেছনে তাঁর অন্য একটা অন্তরের টান রয়েছে। সেটি কুসুমী। তাঁকে রওশন নিরিবিলি, অগোচরে পেলে ‘কুসুমকলী’ বলে ডাকে।

এমন কোমল ডাকে কুসুমী কৃত্রিম লজ্জার ভান করে আরো কাছে ভেড়ে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ খোঁজে। যখন-তখন।

এ-বাড়িতে একটা সাধারণ রেওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে। তা হলো বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন যেই যাক না কেন, রাতের খাওয়ার পর উঠানের পশ্চিম কোনার ডালিম গাছের নিচে তাঁরা বসে কিছুটা সময় কাটান। পরে অবস্থা বুঝে যার যার মতো কেটে পড়েন। শুতে চলে যান। শেষে যান তমিজ। তিনি অবস্থাটা ভালো বোঝেন। রওশন-কুসুমীকে কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে যান। তাঁরা তখন একজন আরেকজনকে মনের কথা শোনান। তাঁদের ভবিষ্যতের স্বপ্নঘোরে চলে যায়। রওশন আলগোছে কুসুমীর হাত ধরে বসে থাকেন। তাঁরা একে-অপরের হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করেন। এমনি কেটে যায় তাঁদের সময়। দীর্ঘ সময়। এই সময় কুসুমীকে অস্থির দেখায়। সে আবদেরে হয়, ‘কিছু বলো?’

‘বলছি তো… শুনতে পাও না?’

‘হ্যাঁ… পাই।’ এমনি করে তাঁদের সময় কাটে যায় তাঁদেরই অগোচরে। কখন রাত কেটে হঠাৎ আলোর ইশারা ফুটে ওঠে চারিদিকে, তাঁদের খেয়াল থাকে  না।

উঠানে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে রওশনকে বিদায় জানায়। রওশন নিচু স্বরে তমিজকে জানিয়ে যায়, ‘বাজারজুড়ে রব… সেনাবাহিনী হঠাৎ করে পলাশডাঙ্গার স্কুল-মাঠে ছাউনি ফেলবে। চোখ-কান খোলা রাখিস। বিশেষ করে, এ ধরনের কোনো আভাস পেলেই মেয়েদের সরিয়ে ফেলবি।’

শেষবারের মতো পেছনে তাকিয়ে রওশন দেখেন, কলাপাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে কুসুমী হাত নাড়ছে। হয়তো ফেলছে দুফোটা চোখের জলও।

 

নদীপথে শীতলক্ষ্যা বেয়ে, ডেমরা হয়ে রওশন ঢাকায় ফেরেন। নদীতে ভাসতে থাকা চিল-শকুন, না হয় কুকুরে খাওয়া গলিত বীভৎস মানুষজনের মৃতদেহ দেখেছেন তিনি। এক যাত্রায় তিনি এতকিছু দেখবেন, এতকিছু শুনবেন এর আগে ভাবেননি রওশন। রাতে শুয়ে পড়লে শুধু আদুর চেহারাটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তাঁর বউকে মিথ্যা কথা বলে এসেছেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। মনে পড়ে কুসুমীকেও।

সারারাতের নির্ঘুম প্রহর, ভয়ংকর সব দৃশ্য। অভাবনীয় সব কাহিনি। দেশের-দশের কথা, ভাবতে ভাবতে রওশন যেন অমানবিক হয়ে ওঠেন। মন তাঁর বিতৃষ্ণ-বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকে। দেশের মাটি, দেশের আকাশ-বাতাস, জনগোষ্ঠী সবকিছুর প্রতি তিনি যেন মমত্ববোধ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। নিজের প্রতিও তিনি যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন। এবং তাঁর এক সময় মনে হতে থাকে, তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। অবশ্য এর সঙ্গত কারণ তিনি খুঁজে পান না। তারপরও…।

 

দেশ স্বাধীন হলো। রওশনের ছোট আঙ্গিকে মনে হতে থাকে কুসুমী-আদু ও তমিজের চোখের বিনিময়ে এ-প্রাপ্তি, যা কিনা তাঁর দেহ অস্তিত্বেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।

সময় গড়িয়ে চলে সরীসৃপের মতো। চারপাশের লোকজন দেখে রওশনের মনে হতে থাকে যার যার তল্পিতল্পা গোছাতেই যেন ব্যতিব্যস্ত সবাই। কাকে মেরে কে খাবে। তিনি দেখেন, দেশের অগণিত বেঁচে যাওয়া নিরীহ মানুষ যেন মৃত গরু-ছাগল হয়ে পড়েছে আগ্রাসী শিয়াল-শকুনের পাল্লায়। এই অশুভ প্রতিযোগিতা ও তাঁর ট্র্যাজিক ব্যক্তিজীবন বিদেশমুখী করে তুলতে থাকে তাঁকে। ১৯৭৬-এর শুরুতে রওশন দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। তাঁর উদ্দেশ্য একটাই : অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান। নয়তো আলো থেকে অন্ধকারমুখো হয়ে               চির-অন্ধকারে তালিয়ে যাওয়া। রওশন তাই করলেন। ভালো ফলাফল, পিএইচডি আরো কী কী করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন। টেক্সাসে রেঞ্জ-বনাঞ্চল কিনলেন। নিজের চাহিদামতো কাঠের ছোট্ট বাড়ি বানালেন। নিরিবিলি একা একা থাকেন। নিঃশব্দ, নির্জনতায়। দেশের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখেননি।

 

মে-২০০৭

প্রায় ৩৬ বছর পর রওশন দেশে ফেরেন। কী জন্যে তা তাঁর ভালো জানা নেই। বাড়ি ফিরে অনেকের মুখে নানা কথা, নানা ঘটনা শোনেন। নীরব হয়ে। এর মধ্য থেকে যে-ক’টি ঘটনা-বৃত্তান্ত তাঁকে তাড়া করে ফেরে প্রচন্ডভাবে, বিতৃষ্ণও করে তোলে, বিষণ্ণ করে তোলে, তা হলো : কুসুমীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পরও তাঁদের কাউকে কাউকে যুদ্ধাহত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তমিজ মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে একচোখ নিয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেননি। বাড়িতে কৃষিকাজ করেন। এখন রওশনের প্রতি তাঁর কোনো টান নেই। আদুর বউ জমিলা অকালে বুড়িয়ে গেছেন। চোখে দেখেন না। বাজারে ভিক্ষা করেন। তাঁর ছেলে চালের আড়তদারে বোঝা টানে।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে রওশন তমিজকে নিয়ে আদুদের বাড়ির দিকে রওনা হন। তমিজ হাসেন, ‘ভাইজান তাঁরা তো আপনার করে দেওয়া সেই টিনের ঘরে থাকেন না। তাঁরা বাজারের বড় চাল বেপারি সুলমান সরকারের চালের গুদামের বারান্দায় ঘুমান।’

‘তাঁদের সেটাই বাড়ি।’

তমিজ হাসেন। ‘সেসব এখন নাই। কবে দখল হয়ে গেছে।’

‘কে দখল করল?’

‘কেন… পলাশডাঙ্গার স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, মেম্বার-চেয়ারম্যান… সবাই।’

তারপরও রওশন ওদিকেই হাঁটেন। আদুর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি দেখেন, সেখানে টিনের একাধিক বড় চৌচালা ঘর উঠেছে। বিরাট সাইনবোর্ডে লেখা ‘কাসুন্দিয়া প্রগতি সংঘ ক্লাব’। আর আদুর বাড়ির সামনের জমিতে বসানো হয়েছে কাঁচা বাজার। শাকসবজি, দুধ বিকিকিনির হাট।

রওশন প্রচন্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মন তাঁর কেঁদে ওঠে।

পলাশডাঙ্গা বাজারের দিকে হাঁটেন রওশন-তমিজ। পথে একটা কালভার্ট পড়ে। সেখানকার পাকা শানে জরাজীর্ণ এক বুড়ি শুয়ে আছেন। তমিজ ইশারায় রওশনকে দেখান।

‘ওই যে ভাইজান আদুর বউ, জমিলা।’

রওশন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যান। জমিলাকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয়। তিনি গলায় কৃত্রিম শক্তি জুগিয়ে বলার চেষ্টা করেন, ‘জমিলা… এই জমিলা… আদুর বউ… আমি রওশন।’

বুড়ির অন্ধ চোখের পাতি নড়ে। জমিলা উঠে বসার চেষ্টা করেন।

‘আমি চোহে দেহি না বাবা… আমারে সাহায্য কর। আল্লাহ তোমগোরে দিবো। আমি বড় দুঃখী বাবা… আমার সোয়ামি নাই…। আমি বেওয়া-রাড়ি…।

তমিজ মুখ খোলেন।

‘জমিলা জমি-জিরাত সব হারাইয়া পাগল হইয়া গেছেন গা…।’ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই জেনে এগিয়ে যান তাঁরা। সুলমান সরকারের চালের আড়তের দিকে। তমিজ জানান, ‘আদুর ছেলের নাম বেলায়েত।’

রওশন বেলায়েতের খোঁজ করেন। বেলায়েত তখন চালের বস্তার ভারে প্রায় কাত।

বেলায়েতের কাছে যান রওশন-তমিজ। সে কৌতূহল প্রকাশ করে। ‘তমিজ চাচা, আবার কারে লইয়া আইলা। আমাগোর কাছ থেইক্কা নেওয়ার মতো তো আর কিছু নাই। তোমরা যাও… আমি কাজ করি। একটা বোঝা বেশি মারতে পারলে দুইডা পয়সা বেশি পাওয়া যাইবো।’

বেলায়েত দ্রুত চলে যায় বস্তা মাথায়।

‘এটা কেমন কথা? আমরা এত লোক থাকতে, তাঁদের সর্বস্ব নিয়ে যাবে?’

‘এত লোক কই দেখলা রওশন ভাই? তাঁরা সবাই যে একই…।’

রওশন চুপ মেরে যান। দেশে ফেরার সময় রওশন ভেবেছেন, তাঁর পরিবারের, দেশের কোনো কিছুতে মাথা ঘামাবেন না।

তমিজ তাঁর বাড়িতে কাজ আছে জানিয়ে কেটে পড়েন। রওশন একা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্থির করেন, আদুর পরিবারের ওপর চরম অন্যায় হয়েছে। এর কি কিছু করার নেই? তিনি ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরেন এবং দুপুরের পর আবার বেরিয়ে যান। রওশন প্রথমে যান থানার চেয়ারম্যান- মেম্বারদের কাছে। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়ে আদুর বাড়ি, তাঁদের সামান্য জমিজমা হারানো নিয়ে কথা তোলেন।

তাঁরা বাজারের অফিসে বসে কী একটা গোপনীয়  আলোচনায় ব্যস্ত। তাঁরা তাঁকে সময় দিতে চাইল না খুব একটা। তাঁদের মধ্য থেকে একজন হয়তো তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।

‘দেখেন, এগুলো কলেজের ছেলেপেলেদের ব্যাপার। তারা হাইকমান্ডের নির্দেশে চলে। আমাদেরও অনেক সময় তাদের তাঁবেদারি করতে হয়। অন্যথায় আমাদের গদিও নড়ে ওঠে। জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। বরং এ ব্যাপারে কলেজে যান। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেও লাভ হবে না। তবে এ ব্যাপারগুলো ভাইস-প্রিন্সিপাল দেখেন।’

রওশন উঠে যান। বাজারের কাছেই পলাশডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ। প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন রওশন। আদুর ইস্যুটা তুলতেই তিনি হেসে ফেলেন।

‘আপনাকে তো দেখি নাই। আপনি কি এদিককার মানুষ?’

‘জি… আমি কাসুন্দিয়া গ্রামের। আমি সর্দার বাড়ির ছেলে। আমি বিদেশ চলে গিয়েছিলাম।’

‘কোথায়?’

‘আমেরিকায়।’

‘দেখেন, এসব ছাত্রদের ব্যাপার কলিমুদ্দী ভাই ভালো জানেন।’

‘তিনি কে?’

‘ভাইস-প্রিন্সিপাল।’

‘তা হলে তাঁর কাছে যাই।’ রওশন ওঠেন।

ভাইস-প্রিন্সিপাল রুমে নেই। রওশন বসে থাকেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তিনি আসেন। তাঁর গায়ে রঙিন পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে চকচকে পাম্প সু।

রওশন দাঁড়িয়ে হাত মেলান।

‘কী ব্যাপার?’

‘আমি এসেছিলাম আদুর জমিজমার ব্যাপারে। তাঁর বউটা অন্ধ। ছেলেটা বোঝা মারে… কুলি।’

‘ছেলেটাকে তো আমিই কাজটা জুগিয়ে দিয়েছি। ছাত্ররা তাঁকে তো রাজাকারের ছেলে বলে। আদু নাকি ঢাকায় রাজাকার ছিল।’

‘কী বলেন!… ও যে আমার সামনে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে নিহত হয়েছিল।’

‘আপনি কোথায় ছিলেন? আপনাকে তো দেখেনি।’

‘বিদেশে ছিলাম।’ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন রওশন।

‘স্বাধীনতার পরে গেছেন।’

‘জি।’

‘তাহলে তো আপনার ব্যাপারটাও সুবিধার নয়, রহস্যজনক। যাই হোক… দেখেন এসব ছাত্র-ছেলেপেলেদের ব্যাপার। এরা ক্লাবঘর করেছে… এটা তো ভালো কথা। হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে ঘোরাঘুরির চেয়ে এক জায়গায় বসে গল্পগুজব করবে, দেশের ভালোমন্দ আলোচনা করবে, পত্রপত্রিকা, বইপত্র পড়বে। সময় সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করে তারা। এই তো গত ফাল্গুনে তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা নাটক মঞ্চস্থ করল…। এদেরকে এসবের সুযোগ আমরা করে না দিলে কে করবে?’

রওশন চরম অপমানিত ও মর্মাহত হয়ে তাঁর কথা শোনেন।

তিনি আবার তাঁকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে জেরা করেন।

‘বিদেশে কী করেন।’

‘মাস্টারি।’

‘কোথায়?’

‘আমেরিকায়।’

‘স্কুলে?’

‘না… ইউনিভার্সিটিতে।’

‘তা হলে চলে আসেন না দেশে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের কলেজগুলোতে শিক্ষকের অভাব। দেশের ছেলেপেলে মানুষ করার দায়িত্ব তো আমাদেরই।’

রওশন নিজেকে সংবরণ করেন বহু কষ্টে। তিনি উঠতে চাইলে কলিমুদ্দী বেল বাজিয়ে চা অর্ডার করেন।

‘বিদেশ থেকে এসেছেন। গল্প করি খানিক। আমেরিকায় আমাদের যাওয়ার সুবিধা কেমন? চাকরি-বাকরি…।’

‘তা কঠিন। ওদের ডিগ্রি ছাড়া…।’

‘কেন আমরা পড়াশোনা না করে পাশ করেছি?’

তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা না হলেও চা সামনে নিয়ে বলতে হয়।

‘তারপরও উন্নত বিশ্বের শিক্ষা অন্য রকম। আমার একটু উঠতে হয়। বাড়িতে মা…।’

‘আছেন কয়েকদিন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আসবেন। না হয় আমিই যাব। আপনার বাড়ি কাসুন্দিয়া তো…? বিদেশ যাওয়ার শলাপরামর্শ…।’

‘আচ্ছা।’

রওশন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ান। পথে আবার সেই কালভার্ট। আর সেখানকার চড়া দুপুরের রোদে  ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে অন্ধ আদুর বউ। তিনি কায়ক্লিষ্ট কণ্ঠে কঁকিয়ে কঁকিয়ে বলে চলেছেন, ‘… বাবারে অন্ধরে দান করলে আল্লাই তোমাদের দিব… বেহেশত নাজিল করব। বড় কষ্টে আছি… ভাতের মুখ দেহি না দুইদিন… বাবারে অন্ধরে…।’ রওশন যেন স্পষ্ট দেখতে পান, রওশন-তমিজকে তাক করা বন্দুকের নলের সামনে আদু চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে আর চোখের পলকে তিনি মাথায় গুলি খেয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ছেন। তাঁর হাতের পোঁটলা ছিটকে পড়ে মাটিতে। গায়ের জামা-কাপড় ভিজে যায় তাঁর গায়ের তাজা রক্তে। ৩৫-৩৬ বছর কেটে গেছে।

রওশন সজ্ঞানে ভুলক্রমেও কুসুমীর কোনো কথা কাউকে জিজ্ঞেস করেননি। দেখতে যাননি কুসুমীর একমাত্র বেঁচে থাকা মাকেও।

নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে থাকে তাঁর। রওশন ভাবেন, এখানে আর নয়। কালই পলাশডাঙ্গা ছেড়ে ঢাকা চলে যাবেন। ঢাকা থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় টেক্সাসের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন। ফিরে যাবেন তাঁর নির্জন গভীর অরণ্যে। রেঞ্জের কাঠের বাড়ির ঠিকানায়। বনবাসে।