নিশিরঙ্গিণী

স্বকৃত নোমান

Sulekha (Noman)
Sulekha (Noman)

আমার বন্ধু সীমান্ত নওশের প্রায়ই বলে – জীবন একটাই বন্ধু। এই সুন্দর মুখ নিয়ে পৃথিবীতে তোমার একবারই আসা। জীবনের সব রং একটু-একটু করে মুখটাতে লাগাতে হবে।
নিশিরাতে বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েটস অফিসের একতলার ছাদে দাঁড়ালে নওশেরের কথাটি বারবার উঁকি দেয় মনে। পেছনের গলিটা তেমন চওড়া নয়, বড়জোর দুটি প্রাইভেট কার ক্রস করতে পারে। এখনো পিচঢালা হয়নি। খানাখন্দে ভরা। দুপাশে উঁচু-উঁচু ভবন উঠছে। কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি কোনোটির। দু-একটির হলেও এখনো চুনকাম বাকি। রাত বাড়লে গলিটাতে বিক্ষিপ্ত পায়চারি করতে থাকা,
কিংবা খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা নিশিরঙ্গিণীগণকে একেকটা রঙের বোতল বলে মনে হয় আমার। ইচ্ছে করে, একটা বোতল বগলদাবা করে ধরতে, ছিপিটা খুলে খানিকটা রং মুখে মেখে নিতে। জীবন যে একটাই!
আমি তাদের প্রথম দেখি এ-অফিসের জুনিয়র হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পরদিন রাতে। জুনের গা-পোড়া গরমে অতিষ্ঠ হয়ে একাকী ছাদে গিয়ে বসেছিলাম। রাত যত গভীরতার দিকে গড়াল শহর গড়াল ততো নিরিবিলির দিকে, আর গলিটা হতে লাগল সরগরম। যাদের আনাগোনায় নিষ্প্রাণ গলিটা সপ্রাণ উঠছে, তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। কেউ শাড়ি আর কেউ সালোয়ার-কামিজ পরে প্রজাপতির মতো কোত্থেকে যেন উড়ে-উড়ে আসতে লাগল। দেখে মনে হয় না, এদের কেউ এই অভিজাত এলাকার বসিন্দা। কারো বয়স আমার গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস সেভেনে পড়া আকলিমার মতো, কেউ দেখতে আমার ভাবির মতো, কেউ বা আমার কমবয়সী চাচিটার মতো। কাউকে দেখতে ঠিক আমার মায়ের বয়স্য মনে হয়। সুরত-শেকলেও তাই। আমার মা লিপস্টিকে অধর রঙিন করেন না, কুঁচি মেরে শাড়ি পরেন না, মাথাটা ঘোমটাহীন এমন উদোম রাখেন না – তফাৎটা শুধু এখানেই।
এরা বুঝি কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নাইট ডিউটি করতে যাচ্ছে – গ্রাম থেকে আসা একজন যুবকের পক্ষে রাজধানীর নিশিরঙ্গিণীগণ সম্পর্কে জানার কথা নয়। বিশেষ করে আমার পক্ষে তো নয়ই। কারণ, স্কুল-কলেজ জীবনের বেশিরভাগ সময় আমাকে বীজগণিতের জটিল সূত্র নিয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে। তার ওপর ছিল বাঙালি মুসলিম পরিবারের ধর্মীয় কঠোর বিধিনিষেধ।
ক্রমে রাত বাড়তে থাকে। নারীদের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে দু-একজন পুরুষকেও দেখা যায়। তাদের হাঁটাচলা ধূর্ত শেয়ালের মতো মনে হলো আমার কাছে। চোখে একধরনের চোরা চাহনি। এরাও বুঝি গার্মেন্টসে চাকরি করে? নওশের বলেছিল, কাপড়ের কারখানায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে ডিউটি করে।
গলির পশ্চিম মাথায় লাল শাড়ি পরা একজন মহিলাকে দেখতে পাই। বয়স ত্রিশের বেশি নয়। কমও হতে পারে। আলো-আঁধারিতে ঠিক বুঝে ওঠা মুশকিল। ধীরপায়ে হাঁটতে-হাঁটতে সে একটা বৈদ্যুতিক খুঁটির আড়ালে দাঁড়াল। পুব থেকে আসা সালোয়ার-কামিজ পরা কমবয়সী মেয়েটাও হেলতে-দুলতে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। লাইটপোস্টের আলোয় ঠাওর করি, খানিক আগে পশ্চিম থেকে যে-মেয়েটা পুবে গিয়েছিল, আবার সে ধীর কদমে পশ্চিমে যাচ্ছে। পশ্চিম থেকে পুবে, পুব থেকে পশ্চিমে। নিরুদ্দিষ্ট হাঁটাহাঁটি। তার মতো আরো কজন মেয়ে কি মহিলা বিক্ষিপ্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি বিভ্রমে পড়ে যাই। এরা যদি নাইট ডিউটিই করে, তাহলে এ-গলিতে ঘুরেফিরে বেড়াবে কেন?
মেইনগেটে দারোয়ান গলা খাঁকারি দেয়। আমার ডাক শুনে সে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল।
: ফজলু মিয়া!
: জে শ্যার!
: পেছনের রাস্তায় কিছু মেয়েলোক দেখছি, এরা কি কোথাও নাইট ডিউটি করে?
ফজলু মিয়া হি-হি করে চাপা হাসে। হাসতে-হাসতে জবাব দেয় – হ শ্যার, নাইড ডিটি করে…। হি-হি হি… হি-হি-হি…।
ফজলু মিয়ার অকারণ হাসি আমাকে খানিকটা বিব্রত করে তুলল। ভার মনে ছাদ থেকে নেমে রুমে চলে যাই। অফিসের পুবদিকে ছোট্ট অ্যাটাচড বাথরুমওয়ালা রুমটাতে একা থাকি। দুপুরে বুয়া রান্না করে দিয়ে গেছে। রাত প্রায় ১২টা। ঝটপট খেয়ে শুয়ে পড়ি। দক্ষিণের জানালাটা খোলা, ফ্যানটা হাইস্পিডে শাঁ-শাঁ করে ঘুরছে। তবু বিছানাচাদরটা ঘামে ভিজে উঠেছে। গরম এতোটাই তীব্র!
জানালাপথে গলির খানিকটা দেখা যায়। জানালার বাইরে কয়েক হাত ফাঁকা জায়গা, তারপর তিন ফুট উুঁচ দেয়াল। তবু রাস্তার ধুলোবালি ভেতরে এসে ঢোকে। দু-পাট্টার পর্দাটা ঝুলছে জানালায়। বাতাসে উড়ছে পত্পত্। জানালার বাঁদিকে একটা দরজা আছে। গত দুদিনে একবারও খোলা হয়নি। খোলার দরকার পড়েনি। আমার আগে যে-রুমটাতে থাকত, সেও হয়তো কোনোদিন খোলেনি। ছিটকিনি ও তালার কড়ায় মাকড়সার আঁশ দেখে বোঝা যায়।
রাত প্রায় দেড়টা। গরমের তীব্রতায় ঘুম গাঢ় হলো না। তন্দ্রার ভেতর খেয়াল করি, জানালার পাশে কাদের যেন ফিসফাস কণ্ঠস্বর। কাত থেকে চিত হয়ে কান দুটি খাড়া করি। কণ্ঠস্বর আরো স্পষ্ট হয়। নারী-পুরুষের গলা। কৌতূহলবশত জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কথোপকথন আরো পষ্ট শোনা যায়।
: এ্যাঁ! ১০ ট্যাকা…! স্বাদ কত! ছাড় ছাড়!
: ক্যানে?
: ক্যানে বোঝ না? ১০ ট্যাকায় এইডাও তো পাওন যায় না।
: আইচ্ছা যা, ১৫ দিমুনে।
: উঁহু। একবার পানি ফেলাইলে ২০ ট্যাকা। কম হইব না।
: আইচ্ছা দিমুনে, খোল।
বাতাসের ঝাপটায় জানালার একটা পাট গ্রিলের সঙ্গে বাড়ি খায়। কয়েক মুহূর্ত। তারপর আবার শুরু হয় ফিসফিসানি। খানিক পর মেয়েলি গলার কঁকানি, পুরুষালি শীৎকার। জানালার পাশ থেকে সরে বিছানায় শুয়ে পড়ি। ফিক করে হেসে দিই। ফজলু মিয়াকে বেহায়ার মতো হাসতে দেখে মনে-মনে যেটুকু মাইন্ড করেছিলাম, এক সেকেন্ডে উবে গেল। বন্ধু নওশের কানের কাছে যেন ফিসফিস করে বলছে – জীবনের সব রং একটু-একটু করে মুখটাতে লাগাও বন্ধু।
পরদিন রাতে অতোটা গরম ছিল না। দখিনা দমকা বাতাসের দরুন গরম তার তেজটা ধরে রাখতে পারছে না। হয়তো দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ কিংবা চাঁদপুরে। তবু কী এক গোপন তাড়নায় রুম থেকে বেরিয়ে উত্তরের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দারোয়ানের রুমের দরজা খোলা। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বিড়ি ফুঁকছে। গতরাতে ছাদে ওঠার আগে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম, তখনো তাকে এভাবে বিড়ি ফুঁকতে দেখেছি। সে জেগে আছে দেখে একাকিত্বটা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আজ কী জানি কী হলো, তার জেগে থাকাটা বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। কেন যেন নিজেকে তার কাছ থেকে আড়াল করতে চাইছি। বুকের মাঝখানটায় অকারণ ধুকপুক করছে। অনেকটা তার দৃষ্টির আড়ালে চটজলদি সিঁড়ি টপকে ছাদে গিয়ে উঠি।
সারাদিন সূর্য থেকে যে-উত্তাপ ধরে রেখেছিল ছাদটা, এখনো আছে। তবে সহনীয় মাত্রার। গলিপথে দু-একজন পথচারী দেখা যায়। একজন ইস্ত্রি করা কিছু কাপড় বগলদাবা করে পশ্চিমের ১০ তলা ভবনটাতে ঢুকল। আরেকজন দেড়-দুই লিটারি একটা পেপসি কি কোকা-কোলার বোতল ডান হাতে দোলাতে-দোলাতে ঢুকল বাঁয়ের ফ্ল্যাটে। গলির মাথায় শাড়ি পরা একটা মহিলা দেখা যায়। হেলতে-দুলতে বিদ্যুতের খুঁটিটার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। গতরাতে ওখানে যাকে দেখেছিলাম সে নাকি?
ঠোঁট উলটে, গালের এক পাশ ফুলিয়ে, দেদার আয়েশে পান চিবুচ্ছে মহিলাটা। পিক ফেলে চুনওয়ালা ডাঁটার মাথাটা একবার জিবের আগায় ঘসে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাকে চিনতে অসুবিধা হলো না এবার। হ্যাঁ, গতরাতে তাকেই দেখেছিলাম ওখানে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। আজ কী এক চনমনে উত্তেজনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বুকের ভেতরটায়। গলা বাড়িয়ে একবার দারোয়ানের রুমের দিকে তাকাই। বিছানায় শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশে ডান পা-টি নাচাচ্ছে ফজলু মিয়া। আবার চোখ ফেরাই মহিলাটার দিকে। পান চিবুতে-চিবুতে মাথার ইশারায় আমার উদ্দেশে কী যেন বলল। চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাই। সালোয়ার-কামিজ পরা একটা মেয়েকে দেখা যায় পুবে। গতরাতের মেয়েটা হয়তো। আমার উদ্দেশে ডান হাতের কবজিটা ঘুরিয়ে একটা চাপা হাসি দিলো সে। দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠি। পাছার নিচে ছাদটাকে আগের চেয়ে খানিকটা গরম মনে হয়। শরীরের নিচের দিকটা ভারি ভারি লাগছে। ঘামের একটা বিন্দু গলা বেয়ে সরীসৃপের মতো বুকের দিকে নেমে যায়। নওশেরের কথাটা মাথায় হানা দিয়ে গেল একবার।
শাড়ি পরা মহিলটি ঝাঁঝাল গলায় মেয়েটির উদ্দেশে বলল – এ্যা ছুঁড়ি! ইদিকে আইবি না, আগে আমি কতা কয়েছি।
রাঙা অধর উলটে মেয়েটি জবাব দিলো – ইঁহ্! তোমার কেনা লাঙ নাকি?
: তা তোর কেনা, হারামজাদি?
: ইঁহ্! পচা মালের কত দেমাগ!
: এ্যাই রঙ্গিণী, কতা সাবধানে ক। আমি পচা মাল? তাইলে তোরটাতে তো পুকায় ধরিছে মাগি। পুকা নিয়া লাঙ ধরতি আসিস ক্যা?
মেয়েটার নাম তবে রঙ্গিণী? বাহ্, দারুণ মানানসই নাম। রঙ্গিণীর সঙ্গে মহিলার বাগ্বিতণ্ডা চলতে থাকে। ভীষণ হাসি পায় আমার। দুজনকেই রঙের বোতল বলে মনে হয়। বগলদাবা করে ছিপি খুলে মুখে রঙের ছোপ লাগানোর খায়েশ জাগে। রঙ্গিণীর একটা নতুন নামও আবিষ্কার করে ফেলি হঠাৎ – নিশিরঙ্গিণী। আমার বন্ধু নওশের বাংলার ছাত্র, তার ওপর কবি। নতুন-নতুন শব্দ আবিষ্কারে তার তুলনা ভার। তার প্রভাবটা বুঝি আমার ওপর পড়ল! নইলে কমার্সের ছাত্রের পক্ষে এমন একটা সুন্দর নাম বা শব্দ আবিষ্কার সম্ভব?
কিন্তু নিশিরঙ্গিণীর সঙ্গে মহিলাটার অকারণ বাগ্বিতণ্ডায় আমার ভেতরে অস্বস্তি জাগল। আমিই তো দুজনের বিবাদের কারণ। খানিকটা অস্বস্তি, খানিকটা ভয়, আর খানিকটা লজ্জা নিয়ে ভারি শরীরটাকে টেনে তুলে সিঁড়ি টপকে বারান্দায় নামি। রুমে ঢুকে খাটে শোয়ামাত্র বিদ্যুৎ চলে গেল। এই এলাকায় লোডশেডিং হয় না তেমন। হলেও আধঘণ্টার বেশি থাকে না। ফজলু মিয়ার রুমটা অন্ধকার। হয়তো ঘুমিয়েছে। আমার ঘুম শিগগির আসবে বলে মনে হচ্ছে না। ভেতরে এখনো আগের মতো উত্তেজনা।
উত্তেজনাটা প্রশমিত করতে, কিংবা লোডশেডিংজনিত গরমের তীব্রতা থেকে রেহাই পেতে বিড়ালের মতো পা ফেলে ফের ছাদে গিয়ে উঠি। গলিটা আগের চেয়ে সরগরম। রঙ্গিণীর মতো আরো কজনকে দেখা যায়। বিদ্যুৎ না থাকলেও গলির লাইটপোস্টগুলো জ্বলছে। সাঁঝে আঁধার নামার সঙ্গে-সঙ্গেই লম্বা থামের মাথায় লাইটগুলো জ্বলতে শুরু করে। লাইটগুলো জ্বালানোর সুইচ কোথায়, কারাই-বা জ্বালিয়ে যায়? ব্যাপারটা আমার কাছে একটা রহস্য।
বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মহিলাটার সঙ্গে হাফপ্যান্ট পরা মোটাসোটা একটা লোক চাপা স্বরে কথা বলছে। তাদের আলাপের বিষয় কী, বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার। খানিক পর লোকটার পিছু পিছু মহিলাটা দক্ষিণের ডাস্টবিনের পেছনে অন্ধকার জায়গাটার দিকে হাঁটা ধরল। আমার তলপেট থেকে নিচের দিকটা আরো ভারি হয়ে ওঠে। ওদিকে লুঙ্গি পরা মাঝবয়সী একটা লোকের হাত ধরে পাছা দোলাতে-দোলাতে একটা মেয়ে দেয়ালটার পশ্চিমের গলিতে ঢুকে পড়ল।
আমার চোখ রঙ্গিণী বা নিশিরঙ্গিণীকে খুঁজে বেড়ায়। দেখতে তার মতো সাত-আটটা মেয়ে গলির উলটোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে ঠিক কে নিশিরঙ্গিণী, আলো-আঁধারে ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারি না। সবাইকেই নিশিরঙ্গিণী বলে মনে হয়। মনে হওয়াটা এক অর্থে ঠিকই বলা চলে। নিশিরাতে রং তো সবাই বিলায়। সে-অর্থে সবাই নিশিরঙ্গিণী বইকি!
পুবের ঝাউগাছটার তলায় দাঁড়ানো একটা মেয়ে আমার উদ্দেশে হাত নাড়ায়। দেখতে ঠিক নিশিরঙ্গিণীর মতো। হয়তো সে-ই। বিশের বেশি হবে না বয়স। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে ধরা। রহস্যময় হাসি। চোখের চাহনি তেরছা। আমার বুকের মাঝখানটায় ধড়ফড়ানির মাত্রাটা আরো বাড়ে। বসা থেকে উঠে দাঁড়াই। পেছনে ফিরে দারোয়ানের রুমের দিকে তাকাই। আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। শিগগির আসবে বলে মনে হচ্ছে না। দারোয়ানের রুমটা অন্ধকার। ঘাড় ঘুরিয়ে ফের নিশিরঙ্গিণীর দিকে তাকাই। তার উদ্দেশে আমারও হাত নাড়াতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
আমার হাবভাব বুঝে নিশিরঙ্গিণী সামনে এগিয়ে আসে। এক হাতে দেয়ালটা ধরে দাঁড়িয়ে মাথার ইশারা করে। আমার কানের কাছে মুখ রেখে বন্ধু নওশের যেন ফিসফিসিয়ে বলে – জীবন তো একটাই বন্ধু। জীবনের সব রং একটু-একটু করে মুখটাতে লাগাও।
নিশিরঙ্গিণী দেয়ালঘেঁষা লাইটপোস্টটার নিচে এসে দাঁড়াল এবার। আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাকে। পরনে বড়-বড় ফুলওয়ালা থানকাপড়ের সালোয়ার-কামিজ। নাকে ইমিটিশনের নাকফুল আর কানে ঝুমকা। দেখতে ঠিক আমার গ্রামের হাইস্কুলের আকলিমার মতো, কিংবা পাশের বাড়ির আলেয়ার মতো, অথবা কলেজের মর্জিনার মতো। আমি তাকে আকলিমা, আলেয়া বা মর্জিনা বলে ভুল করে বসতাম, যদি না তার ভুরু দুটি প্লাগ করা থাকত। যদি না পায়ের হাইহিলের কারণে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা বেখাপ্পা লাগত।
বাঁহাতটা ভাঁজ করে কোমরে ঠেকিয়ে বাঁকা ভুরুর ইশারা করল নিশিরঙ্গিণী। তার ভুরুর ভাষা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ উঠলেও তার ইশারার সায় দিতে ভুল করি না। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হাতের ইশারায় তাকে দেয়াল টপকে ভেতরে আসতে বলি।
: ট্যাকা কিন্তু ঠিক পঁচিশই লাগব, হুঁ।
চাপা গলায় বলি – আরে আসো তো!
রুমে ঢুকে দক্ষিণের দরজাটার ছিটকিনি খুলে একটা কপাট টান দিই। ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। হরিণীর মতো এক লাফে ভেতরে ঢুকল নিশিরঙ্গিণী। নারিকেল তেলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিলো নাকে। সেইসঙ্গে আরো কী এক বিচিত্র ঘ্রাণ। হয়তো লিপস্টিকের, অথবা নেইল পোলিশ, তিব্বত ঘামাচি পাউডার বা কেয়া বিউটি সোপের। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ফেয়ারনেস বা হেনোলাক্স স্পট ক্রিমেরও হতে পারে। কিংবা এসবের মিশ্রিত ঘ্রাণ।
যথারীতি আমার মনে হয়, কোনো মেয়ে বা মহিলা নয়, বোন-ভাবিও নয়, আকলিমা-আলেয়া-মর্জিনাও নয় – একটা রঙের বোতল খাড়া হয়ে আছে আমার সামনে। ভেসে আসে দূরাগত কণ্ঠস্বর – জীবনের সব রং একটু-একটু করে মুখটাতে লাগাও বন্ধু। আমি নওশেরের কথাটা এড়াতে পারি না। তার কণ্ঠস্বর মিলানোর সঙ্গে-সঙ্গে বোতলটাকে বগলদাবা করে ধরি। ভারি চঞ্চলা নিশিরঙ্গিণী। আমার নিচের দিকটা এতোটাই ভারি হয়ে উঠল, ভারটা বহন করতে পারলাম না। রঙের বোতলসুদ্ধ বিছানায় গড়াগড়ি খাই। অন্ধকারে হাতড়ে ছিপি খুলি। রঙের কী অদ্ভুত ঘ্রাণ! প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে বের করে নিশিরঙ্গিণী তৈলাক্ত পিচ্ছিল জিনিসটা ধরিয়ে দিলো আমার হাতে। আমি সেটা ছুড়ে ফেলি জানালাপথে। সঙ্গে-সঙ্গে তার দুহাতের ধাক্কা এসে লাগল আমার বুকে।
: নিশিরঙ্গিণী!
: ধুত্তরি শালা! জিনিসটা কই?
: ফেলে দিয়েছি।
: ফালাই দিছস? লাগলে ঠ্যাকাবি কোন শালা, এ্যাঁ?
নিশিরঙ্গিণীর কথা বুঝতে আমার দেরি হয় না। কাঁপা গলায় বলি – আমি ঠেকাব।
: হি-হি-হি…। ইরকম সবাই কয়। ঘাট পারালি নাইয়া শালা।
তার খিস্তি শুনে খানিকটা চুপসে যাই। সে চাপাস্বরে হাসে। খসখস করে আরেকটা প্যাকেট ছিঁড়ে তৈলাক্ত জিনিসটা আবারও আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।
: ওটা না হলে হয় না?
: হবি না কেন? ১০০ ট্যাকা লাগবি। নগদে ৫০, হুঁ।
অন্ধকারে হাতড়ে চেয়ারে ঝোলানো প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে একটা নোট তার হাতে গুঁজে দিই। ৫০, ১০০, নাকি ৫০০-র নোট কে জানে! নিশিরঙ্গিণী এক দৌড়ে জানালার সামনে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে নোটটাতে চোখ বুলাল। চাপা স্বরে হি-হি করে হাসল। আমি তার পেছনে দাঁড়াতেই সে ঘুরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠেলতে-ঠেলতে বিছানায় ফেলল। চিরাচরিত আদিম আগুনে পুড়তে থাকি আমি। মাটির শরীরে আগুনের তাণ্ডব। পুড়তে-পুড়তে মুখে ছোপ ছোপ রং মাখতে থাকি… মাখতে থাকি। নিশিরঙ্গিণীও পোড়ে, কিন্তু দহনে তার জ্বালা নেই। হয়তো নিশিরঙ্গিণীরা পুড়তে জানে না। হয়তো পুড়তে-পুড়তে তারা অঙ্গার হয়ে গেছে।
লাইটের সুইচটা অফ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। বিদ্যুৎ এসে পড়ল হঠাৎ। সুইচটা অফ করার আগে নিশিরঙ্গিণীর মেছতা পড়া মুখের দিকে তাকাই একবার। তার চেহারায় বিরক্তি আর  ক্লান্তির যুগপৎ ছাপ, চোখে কান্নার আগমুহূর্তের ভাব। দারোয়ানের রুমে তার গলাখাকারি শোনা যায়। আমি আঁতকে উঠি। চটজলদি, অনেকটা জোর করে নিশিরঙ্গিণীকে পেছন দরজা দিয়ে ঠেলে বের করে দিই। দরজাটা বন্ধ করার আগে একবার তার গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। সে আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল।
পরদিন রাতে গরমের মাত্রা আরো বাড়ল। আধঘণ্টার লোডশেডিং দেড় ঘণ্টায় গড়াল। নিদারুণ জুন শেষ হতে চায় না। যথারীতি আমি ছাদে গিয়ে বসি। এক অদ্ভুত টানে, এক দুর্বার আকর্ষণে। রঙের বোতলগুলোর পা গজায়। ঠিক পা নয়, পাখনা। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় তারা। এদিকে দরদাম ঠিক হয়, ওদিকে খিস্তিখেউড়। ডাস্টবিনের পেছনটায় কঁকানির শব্দ। আমি সতর্ক চোখে গতরাতের নিশিরঙ্গিণীকে খুঁজি। তার চেহারাটি ঠিক মনে করতে পারি না। বুদ্বুদের মতো স্মৃতিতে হঠাৎ তার মুখটা ভেসে ওঠে। ফের মিলিয়ে গিয়ে অন্য একটি চেহারা ভাসে। আমি ঠিক মেলাতে পারি না, ভেসে ওঠা কোন চেহারাটা নিশিরঙ্গিণীর। আমার পায়ের কাছে একটা মশা উড়ছে অনেকক্ষণ ধরে। পাতায় একবার হুল ঢুকিয়েছে। টের পেয়ে থাপ্পড় মারি। কোন ফাঁকে যে উড়ে গেল! হাত ঝেড়ে বারবার তাড়াই, বারবার উড়ে এসে হুল ফোটানোর চেষ্টা করছে। রক্তের মজা পেয়ে গেছে বুঝি!
গলির পশ্চিম মাথায় একটা পিকআপভ্যান থামল। দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো আচমকা। হরিণের অভয়ারণ্যে যেন চিতার হানা। পুলিশের পাঁচ-ছয়জনের একটি দল ভ্যান থেকে নেমে পুবদিকে ছুটল। বিদ্যুতের খুঁটিটার সামনে থেকে সালোয়ার-কামিজ পরা দুটি মেয়েকে ধরে ভ্যানটার দিকে নিয়ে চলল এক কনস্টেবল। কেন যেন আঁতকে উঠি আমি। দুজনের একজন কি নিশিরঙ্গিণী? কে জানে! হলেও হতে পারে। তাতে আমার কী যায়-আসে? কেন যে আমি এসব তুচ্ছ বিষয়ে আঁতকে উঠি!
নিশিরঙ্গিণীর মতো লম্বাচওড়া আরেক নিশিরঙ্গিণী কনস্টেবলের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। বিরক্তিমুখে তার পাছা বরাবর ডাণ্ডাটা ওঠায় কনস্টেবল। বাড়ি দিতে গিয়ে দিলো না। তার বদলে ‘ছাড় মাগি, উঠ্’ বলে খিস্তি করল।
আমি পেছনে সরে দাঁড়াই। পায়ের দিকে মশারা ভনভন করছে। গামছা বুলিয়ে তাদের তাড়াই। পুলিশের যে-দলটি গলির পুব মাথায় গিয়েছিল, ফিরে আসছে তারা। সঙ্গে দুই শিকার।  একটি শাড়ি পরা, অন্যটি সালোয়ার-কামিজ। পুলিশ তাদের ধাক্কাতে-ধাক্কাতে ভ্যানটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা হুঁ-হুঁ হিঁ-হিঁ করে নাঁকিসুরে কাঁদার চেষ্টা করে কিংবা কাঁদে।
পুলিশের দলটি গলির মাঝবরারবর থামে। সালোয়ার-কামিজওয়ালি ওড়নার গিঁট খুলে ৫০ কি ১০০ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলো এক কনস্টেবলের হাতে। নোটটা চটজলদি পকেটে চালান করে দিয়ে কনস্টেবল হাঁক দিলো – ‘যা মাগি। আর যেন কখনো না দেখি।’
তবু দেখা যায়। কয়েকজন শিকারকে নিয়ে শিকারিদের  ভ্যানটি চলে গেলে একে-একে আবার আসতে শুরু করে আকলিমা-আলেয়া-মর্জিনারা। আকলিমা হাতের ইশারায়, আলেয়া মাথার ইশারায়, মর্জিনা ভুরুর ইশারায় আমাকে ডাকে। আমি নিশিরঙ্গিণীকে খুঁজি।
: এ্যাই মরদ! লাগবি না?
আমি চমকে উঠি। ঠিক যেন নিশিরঙ্গিণীর গলা! লাইটপোস্টের আলোয় মেয়েটার মুখের দিকে তাকাই। না, এর মুখে তো মেছতা নেই। তার লিপস্টিকরাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ হেসে উঠি। হাহ্! নিশিরঙ্গিণী কি কোনো নারীর নাম? হলেই বা কী? নিশিরাতে রঙের ফেরি করে বেড়ানো সব রঙ্গিণীই তো নিশিরঙ্গিণী। আলাদা করে নিশিরঙ্গিণীকে খোঁজার দরকার কী?
: হ্যাঁ, লাগবে। দেয়াল টপকে আসতে হবে কিন্তু। পারবে?
: হ, পারুম না ক্যান? ট্যাকা কিন্তু ১৫।
: পনেরোর বদলে আমি ২০ দিই। জীবন তো একটাই!
: হেই মরদ!
: হ্যাঁ।
: কী?
: আসো।
: ট্যাকা কিন্তু ২০।
বিশের বদলে আমি ৪০ দিই। জীবন তো একটাই!
কখনো ২০, কখনো ৪০, কখনো ৫০, কখনো ১০০ – শেয়ারবাজারের মতো প্রতিরাতে টাকার অঙ্ক ওঠানামা করে। কখনো শাড়ি পরা, কখনো সালোয়ার-কামিজ। কখনো মেছতা পড়া, কখনো আলতারাঙা, কখনো নেইল পোলিশ। কখনো ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, কখনো তিব্বত ঘামাচি পাউডার, কখনো হেনোলাক্স স্পট ক্রিম। বদল নেই কেবল একটাতে – রং। টাকার বদলে আমি মুখে জীবনের রং মাখি। জীবন যে একটাই!
পাঁচ মাসের ব্যবধানে আমি অফিসের এমডির আস্থাভাজন হয়ে উঠি। বেতন ১৫ হাজার থেকে বেড়ে ২৫ হাজারে ঠেকল। বেতনের সঙ্গে পদবিও বাড়ল। জুনিয়র থেকে সিনিয়র হিসাবরক্ষকে উন্নীত হই।
খুব শীত পড়ছিল সেদিন। শীতের দাপটে কুঁকড়ে আছে সমস্ত শহর। আকাশ ছেয়ে আছে কুয়াশার দুধেল বুদ্বুদে। মাসের ১ তারিখ। অফিস স্টাফদের বেতনের ভাউচার রেডি করছি। হঠাৎ মেইনগেটে নারীকণ্ঠের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। দু-একজন সহকর্মী অফিস থেকে বেরিয়ে মেইনগেটের দিকে ছুটে গেল। আমার হাতে টাকার বান্ডিল। যে-সহকর্মীটা পেছনে দাঁড়িয়ে, তাকে বেতনের টাকা বুঝিয়ে না দিয়ে বাইরে যাই কী করে?
এক সহকর্মী হাসতে-হাসতে বাইরে থেকে ফিরে এলো।
: কী হলো ভাই? তার কাছে জানতে চাই আমি।
: হে-হে-হে…।
: কাজের বুয়াটা নাকি?
: আরে না রে ভাই। কোত্থেকে এক খানকি এসে কেঁদেকেটে অস্থির। এই অফিসে নাকি তার বেটার বাপ চাকরি করে। হে-হে-হে…। দেখুন কাণ্ড! পেটে থাকতেই অস্থির। হে-হে-হে…। শহরটাকে নষ্ট করে ফেলল শালিরা।
বুকের মাঝখানে হঠাৎ যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল। কেন যেন একেবারে চুপসে যাই আমি। বেতনের খাতায় সহকর্মীটার সিগনেচার নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠি। একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙি। ধীরপায়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। মেইনগেটে এসে এদিক-ওদিক চোখ বুলাই। না, চেনাজানা কাউকে দেখতে পাই না।
: খেদাই দিছি স্যার। – ফজলু মিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে। আমিও হাসার চেষ্টা করি। হাসিটাকে জোর করে ধরে রেখে পেছনে ঘুরি। হাওয়াই মিঠাইর মতো হাসিটা মিলিয়ে যায়। অফিসে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকি। চাকরিটা কেন যেন বিরক্তিকর মনে হলো। কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। সারাদিন দারুণ বিরক্তির মধ্য দিয়ে কাটে। রাতটাও বিরক্তিতে ভরে ওঠে। হয়তো বিরক্তি নয়, ভয়। কিংবা বিরক্তি ও ভয়ের মিশেলে অন্য এক অনুভূতি। আজ আর ছাদে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। বিচিত্র এক অনুভূতির তাড়নায় সারারাত বিছানায় জেগে থাকি।
বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েটসের ওপর বিরক্তির কারণে, নাকি ডেভিট-ক্রেডিট আর ভালো লাগছিল না বলে আমি চাকরি বদল করি। জীবনের রংও বদল হয়। নওশেরের কথাটা আরো বেশি সত্যি হয়ে ওঠে আমার জীবনে। আমি রমনা পার্কে যাই, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বা চন্দ্রিমা উদ্যানে যাই। ফকিরাপুল, ফার্মগেটের আবাসিক হোটেলগুলোতে ঢুঁ মারি। মুখে জীবনের রং মাখি। আকলিমা-আলেয়া-মর্জিনা – আরো কত নাম-না-জানা নিশিরঙ্গিণীর কত না বাহারি রং! টাকা ওড়াই, রং মাখি। রং মাখি, টাকা ওড়াই। নিশিরঙ্গিণীদের রংনদীতে বৈঠা বাইতে-বাইতে হয়ে যাই রঙের মাঝি। তবু নিদারুণ অতৃপ্তি কাজ করে ভেতরে। কিছুতেই তৃপ্তি মেটে না আমার। অতৃপ্তিটা মেছতা-পড়া নিশিরঙ্গিণীকে খুঁজে না পাওয়ার কারণেই কিনা, তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
কিন্তু চাকরি ছাড়া তো নদীর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। টাকার জন্য চাকরি চাই। খুঁজতে-খুঁজতে জুতসই একটা চাকরি পেয়েও যাই। হয়তো নওশেরের প্রভাব পড়েছিল আমার ওপর। তার মানবিক কথাগুলোর প্রভাব হয়তো এড়াতে পারিনি। নয়তো মানবাধিকারবিষয়ক এনজিওতে চাকরি নিলাম কেন? ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও মানবাধিকার’ বিষয়ক একটি এনজিওতে প্রোগ্রাম অফিসার পদে চাকরি নিই। চাকরিটার বয়স প্রায় চার বছর হতে চলল। মালিবাগে অফিস। মোহাম্মদপুরে বাসা নিয়ে সপরিবারে থাকি। প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তন বা জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে নারী নির্যাতনবিরোধী গোলটেবিলের আয়োজন করি। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে স্বাগত বক্তৃতা দিই। …দেশে নারী নির্যাতন বাড়ছে, এ-বছর সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার, যৌনকর্মীরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, তাদের সন্তানেরা সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছে না ইত্যাদি। শ্রোতারা মুহুর্মুহু করতালি দেয়, প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা খসখস করে বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট করে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরা কাঁকড়ার চোখের মতো আমার দিকে ঘোরে। একজন মানবতাবাদী হিসেবে নিজের ওপর আস্থাটা বাড়তে থাকে।
সেদিন বাসা থেকে অফিসে যাচ্ছি। খামারবাড়ির জ্যামে আটকা পড়ে আছি অনেকক্ষণ। ১০টা বেজে গেল, অথচ জ্যাম ছাড়ার কোনো আলামত নেই। গাড়িগুলো ইঞ্জিন বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে আছে। এয়ারপোর্ট রোডে হয়তো কোনো ভিআইপি যাবেন। প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি। অফিসে ১১টায় মিটিং। এক ঘণ্টার আগে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। বাস থেকে নেমে ইন্দিরা রোড ধরে সোজা হাঁটা ধরি। ওভারব্রিজটা পার হয়ে ছয় নম্বর বাসে চড়ে বসলে জ্যাম ছাড়ার আগেই মালিবাগ পৌঁছে যেতে পারব।
জোর কদমে ওভারব্রিজের সিঁড়ি টপকে উঠতে থাকি। দুপাশে ভিখিরির দল। কেউ অন্ধ, কেউ খঞ্জ। কারো হাত নেই, কারো পা। ওপরের শেষ সিঁড়িটাতে হেলান দিয়ে কালিময়লা সালোয়ার-কামিজ পরা এক মহিলা বসে আছে। কামিজের বড়-বড় ফুল ঠিক বোঝা যায় না। অতি ব্যবহারে ধুয়েমুছে গেছে। কোলে তিন কি চার বছরের একটা শিশু। হয়তো তার ছেলে। কিংবা ভাড়া করা। কাছাকাছি গিয়ে মহিলাটার চোখে চোখ পড়ে গেল। কেন যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়াই। খাদে পড়া চোখ, জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা, মেছতা-পড়া গালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।
: একটা ট্যাকা দ্যান গো ভাই। ছেলেটার কিডনি নষ্ট গো ভাই…।
মহিলাটি হাত বাড়িয়ে আছে। আমার দৃষ্টি তার মুখের ওপর থেকে ছেলেটির মুখের ওপর স্থির হয়। তীব্র রোদে হাঁসফাঁস করছে ছেলেটা। তার ঘামসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখতে ঠিক আমার দুবছর বয়সী ছেলেটার মতো। নাক-মুখ-চোখ-ভুরুর হুবহু মিল। সম্মোহিতের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। একবারের জন্যও পলক পড়ে না। চেহারায়-চেহরায় এতোটা মিল থাকতে পারে!
: দ্যান গো ভাই। দুইডা কিডনি নষ্ট গো…।
দীর্ঘ হর্ন বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটছে। হর্নের শব্দে আমি সচকিত হই। শেষ সিঁড়িটা টপকে দ্রুত পা বাড়াই। প্যান্টের পকেট থেকে স্ক্রিনটাচ মোবাইলটা বের করে হাঁটতে-হাঁটতে সময় দেখি। ঠিক সাড়ে ১০টা। ‘যৌনকর্মীদের শিশুদের অধিকার’ বিষয়ক জরুরি মিটিং ঠিক ১১টায়। আমাকে মিটিংয়ে যোগ দিতে হবে। মেছতা পড়া মহিলাটা আকলিমা-আলেয়া-মর্জিনা বা নিশিরঙ্গিণী কিনা, জিজ্ঞেস করার মতো সময় কই?
ঘামতে-ঘামতে আমি দ্রুত হাঁটতে থাকি…।