নীরবতা, শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা

দ্বিতীয় সৈয়দ-হক
শেষ পর্যন্ত আমরা বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি ভাবি নাই যে, এই বইটি লিখতে লিখতেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে। সবকিছু কেমন জানি একটু ওলটপালট হয়ে যায়। কমপক্ষে ছয় মাস তো তাঁর থাকবার কথা ছিল কিন্তু শেষে দেখা যায় তিনি একটি মাসও রইলেন না। এক সাতাশ তারিখে যার জন্ম, তিনি চলে গেলেন আরেক সাতাশ তারিখেই, মাত্র সাতাশ দিন লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসবার পর। এবং, যখন যাবার সময় এলো, খুব দ্রুততার সঙ্গেই তিনি বিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে। এই ছিলেন ঠিক আর তারপর – এক-দুই-তিন – তিনদিনের মধ্যে তিনি পরিণত হলেন আমার জলজ্যান্ত বাবা, আমার জন্মদাতা, আমার জীবনে সবচাইতে প্রিয় বন্ধু থেকে নিষ্প্রাণ একটি মৃতদেহে। স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, আমার এই বইটি আগামী একুশে বইমেলায় তুলে দেবো তাঁর হাতে; কিছু না হলে তাঁর জীবনের এবং আমারও মনের একটি বিশাল আশা পূরণ করে তাঁকে বিদায় দিতে পারবো। কিন্তু না, পারলাম না। বাবা চলে গেছেন এখনো পুরোপুরি তিন সপ্তাহ হয় নাই, তবু লিখতে বসেছি আবার। না, আমি অমানুষ নই; আমার বাবা একজন সাধারণ মানুষ হলেও আমি এই একই শোক অনুভব করতাম। কিন্তু আমার দুঃখ যে কেউ টের পাবে না আমার চোখের জলে। আমার দুঃখ, আমার শোকপ্রকাশ একমাত্র আমার কলমে, ঠিক যেভাবে বাবা চাইতেন আমি করি।
বাবার শেষ মুহূর্তগুলো নিয়ে একদিক থেকে তেমন বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না যদিও, তবু অনেক কিছু বলার থাকে। বাবা এবং ছেলের মধ্যে এটি একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত সময়, যেটি জীবনে একবারই তো আসে। শুধু এটুকু বলব যে, সেদিন সকাল থেকেই আমি বুঝতে পাই তাঁর আর বেশি সময় নাই। একদিকে সকলের সঙ্গে প্রাণপণে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলে দোয়া করছি তাঁকে আমাদের মাঝে রাখতে, আরেকদিকে মনপ্রাণে চাচ্ছি তিনি যেন আর কষ্ট না পান; সেই কষ্ট যে আর চোখে দেখা যায় না। শেষ চব্বিশ ঘণ্টায় তিনি যেন অচেতন হয়ে যান এবং সেই সঙ্গে আমরাও পরিবারের সকলে হয়ে থাকি নিদ্রাহীন। আমাদের মুখের রুচি চলে যায়। ইউনাইটেড হাসপাতালের সেই বার্গার আর প্যাটিস, যা খেয়ে বলা যায় বেঁচে ছিলাম গত তিন সপ্তাহ ধরে, সেই খাবার যেন আর দুচোখে দেখতে ইচ্ছে করে না। চোখের সামনে বাবা না-খেয়ে মারা যাচ্ছেন আর সেটি দেখে কোন মানুষ, কাছের মানুষ, বিশেষ করে একটি সন্তান, এক লোকমা খাবার তুলতে পারে মুখে? শেষের দিকে আমরা ঘুমাই না, খাই না, আমরা এমনকি একে অপরের সঙ্গে তেমন কথাও বলি না, এমনও হতে পারে আমরা চোখের পলক পর্যন্ত ফেলি না। কিন্তু এতকিছু করেও আমরা পারি না বাবাকে ধরে রাখতে। এক মুহূর্তের জন্যও নয়। যার যখন যাবার সময়, তাঁকে যে তখনই যেতে হয়।
এদিকে কুড়িগ্রামের আব্রাহাম লিঙ্কন, যাঁর ওপর বাবাকে কবর দেওয়ার সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি, এতদিনে আমার একজন বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ চলে ক্রমাগত আড়ালে আড়ালে। বাবা আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার পরদিন সকালে, যখন আমি বুঝতে পাই যে তিনি আর থাকবেন না, ধরে থাকতে পারছেন না, লিঙ্কনকে ফোন করে চোরের মতো ফিসফিস করে বলি, ‘ভাই, আমি জানি না কীভাবে পারবেন কিন্তু আজ-কালের মধ্যে যেন বাবার কবরের সবকিছু অবশ্যই ঠিকঠাক হয়ে যায়। আমাদের হাতে সময় নাই। বড়জোর এক থেকে দুই দিন।’
কথাগুলো এভাবে বলাতে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। দুদিন আগেই আমাদের মধ্যে কথা হয় এসব ব্যাপার নিয়ে। কবর কোন জায়গায় হবে; কীভাবে নিশ্চিন্ত মনে বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করা যায়। অনেক ধরাধরি, অনেক পরিকল্পনার ব্যাপার। আর এদিকে আমার বাবা, আমার কাছে অন্তত, বিশিষ্ট সব্যসাচী লেখক তো নন, বাংলার একজন ঐতিহ্যময় ব্যক্তিও নন – তিনি শুধুমাত্র আমার বাবা। পড়ে আছেন; অসহায়, আইসিইউতে। সকলে দোয়া করেন তিনি যেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকেন। কিন্তু আমি তাঁকে যে অবস্থায় দেখি, সেভাবে বেঁচে থাকা, বিশেষ করে তাঁর মতো মানসিকতার একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা, সেই অবস্থায়, তার চাইতে যে মৃত্যু অনেক ভালো, আমি মনে করি। গোপনে মেনে নিই যে বাবা চলে যাবেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে, তিনি অন্তত সুস্থ মস্তিষ্কে তাঁর এই অসাধারণ জীবন ত্যাগ করে যাওয়ার সুযোগ পান। একসময় নানান লোকের সঙ্গে বাবার কথা আলাপ করতে-করতে, দুশ্চিন্তার মধ্যে, আইসিইউর নার্স এসে আমাদের নিকট পরিবারের মানুষদের ডাকেন। বাবার অবস্থা একদম ভালো নয়। চলমান মূর্তির মতো মা, আমি ও আমার একটি আদরের ছোট বোন প্রবেশ করি আইসিইউতে আবার। আমার স্ত্রী তখন আটকা ঢাকা শহরের কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যামে। ক্লান্ত হয়ে বাসায় গিয়েছিল এক কাপ চা খেতে। আইয়াম্বিক পেনটামেটারে বাবার হৃৎপি- ধুকুর-ধুকুর করে যায় আইসিইউর মনিটরে। আমারও মধ্যে যেন সেই সঙ্গে শেক্সপিয়রের সনেটের একটি লাইন সংকেত দিতে থাকে :

Tired with all these, for restful death I cry
সারাজীবন দীর্ঘ খরার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বাবা, যিনি আমাকে গোপনে আজীবন বলে গেছেন সাহিত্যকর্মে তিনি কত একাকী বোধ করেন, যাঁর লেখার প্রতিটি বাক্যে জড়িয়ে আছে সে-নিঃসঙ্গতা, যাকে লোকে বলে জলেশ্বরীর জাদুকর, তিনি যে আমার চোখের সামনে নাই হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার কাল ফুরিয়ে এসেছে। বাবা, আমার বাবা, তিনি যে এখন বিদায় নেওয়ার পথে। বাবার বিছানার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমার দৃষ্টি যেন অনবরত একটি ত্রিভুজ এঁকে যায় শূন্যতায়, একবার মনিটরের দিকে, সেই থেকে বাবার অচেতন মুখ হয়ে আবার ডাক্তারের মুখের দিকে। মন্তরের মতো ফিসফিস করে বলতে থাকি, ‘আল্লাহ্, আমার বাবাকে বাঁচতে দাও’… কিন্তু তবু জানি বাবা মারা যাবেন।
একসময়, তিনি যান।
চারিদিক থেকে যেন একটি নিস্তব্ধতার চাদর নেমে আসে; এক নিস্তেজ অনুভূতি। ভেঙে পড়ে আমার চারপাশে সকাল থেকে অপেক্ষমাণ অনেকে। অনুভব করি যে, যেই মুহূর্তে আমি আমার বাবাকে হারালাম, অনেকেই তাদের খুব কাছের, প্রিয় একজন মানুষকে হারালেন। শুধু, তাঁদের ক্ষেত্রে তাঁরা খোলামেলাভাবে কাঁদতে পারছেন। আমি পারি নাই। আমার অদৃশ্য মুখোশটি খোলার অনুমতি নিজেকে দিই নাই। বোঝাতে পারি নাই যে, আমার মধ্যে সেই মুহূর্তে এমন একটি নিঃসঙ্গতার সৃষ্টি হলো, যা আমি কোনোদিনও পূরণ করতে পারলেও কখনো চাইবো না। যেন হৃদয়ের ভেতরে ছিল একটি কক্ষ যার দরজা বন্ধ করে মনের পকেটে চাবি রেখে দিলাম অনন্তকালের জন্য। হয়তো-বা সেই দরজা খুলবো একদিন; তবে এখন নয়। এখন নিজেকে সামলে নেওয়ার সময়। আমার প্রথম চিন্তা তখন মায়ের জন্য। তিনি তো সহ্য করতে পারেন নাই বাবার সেই শেষ মুহূর্তগুলো আইসিইউতে, একসময় বেরিয়ে যান, আমাকে ফেলে রেখে। সঙ্গে আমার ছোট বোন, দুজনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম বাবার বিছানার গোড়ায়। মনে পড়ে গেল আমার সঙ্গে বাবার শেষ কথা। তার দুদিন আগেই তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে সন্ধ্যায় আমাকে বললেন, ‘বাবা, ইউ লুক টায়ার্ড, বাসায় চলে যাও।’ এভাবে তিনি বোঝালেন যে, জীবনের শেষ প্রান্তেও একটি বাবা ভেবে যান তার সন্তানের কথা। চলে গিয়েছিলাম সেদিন সন্ধ্যায় কেননা আমি আসলেই ক্লান্ত ছিলাম। রক্তমাংসের এই শরীরটিকে এখনো মনে মনে দূরছাই করি সেদিন ক্লান্ত হওয়ার জন্য। যেটি আমার বাবা তাঁর মরণাপন্ন অবস্থাতেও বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের মধ্যে সেই সন্ধ্যায়। এখনো ভাবি, সেদিন রাতে থেকে গেলেই পারতাম, কেন আমি বাবার কথা শুনে বাসায় চলে গেলাম, আর কিছু না হলে আর দু-একটি কথা তো বলা যেত। এমন দু-একটি কথা যা আমরা সারাজীবন আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে চেপে রাখি, অথচ যখন বলতে মন আসলেই চায়, দেখি যে বলার সময় পার হয়ে গেছে। আইসিইউর ডাক্তাররা বাবার বুকে আঘাত করে যান, কোনোমতে যদি তাঁকে জীবনের অন্ধকার ওপার থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু আমি জানি সেটি আর সম্ভব নয়। সেই মুহূর্তে মনে হয় যেন বাবা তাঁর অনেক আগেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। তাঁর দেহকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে শুধু তাঁর চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো যন্ত্রপাতি দিয়ে। একবার যখন দেখি গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সাদা প্লাস্টিকের নল দিয়ে একটি বোতলে জমা হচ্ছে, জানি তিনি আর ফিরে আসবেন না।
বাবা চলে গেলেন এবং আমার মাথা থেকে এতসব বই লেখালেখি, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি স্বপ্ন উড়ে গেল হাওয়ার সঙ্গে। আমি কেন লিখছি? কার জন্য লিখছি? যাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যাশায় কলম ধরেছিলাম, তিনি তো নাই হয়ে গেলেন। তাহলে? এখন? বাবার নিষ্প্রাণ দেহ দেখে বারবার মনে পড়ে এই কথা। ডাক্তারের কব্জির হাতুড়ি আমার বাবার বুকের নেহাইয়ের ওপর ঠুকে যায়, অবিশ্বাস্য মনে ভাবি, তাহলে কি তিনি আসলেই আর আসবেন না ফিরে? সেদিন থেকে পরবর্তী দুদিন, হতে পারে তিনদিন, আমার হিসাব থাকে না, আমি বাবার মৃতদেহের সঙ্গে, মনে হয় কত জায়গায় যাই। একবার দেখি তিনি আমাদের গুলশানের বাসায়, তাঁকে গোসল দিচ্ছি, আবার দেখি সেই দিনের পর দিন চলা একই পথ ধরে তাঁকে নিয়ে যাই ইউনাইটেড হাসপাতালে। শুধু এবার তো আমি আর তাঁকে ছয়শো চার নম্বর কেবিনে রেখে আসি না, আমি রেখে আসি এক শীতল কক্ষে; ফ্রিজ বলতে, আর কি। জীবনে বহুবার শুনেছি, বহু বইতে পড়েছি যে, মানুষ জীবনে কোনো এক সময় রোবটের মতো চলাফেরা করে; কিন্তু কোনোদিন অনুভব করতে পারি নাই তাঁরা কী বলছেন। এখন দেখি আমি হয়ে গেলাম সেই রোবট, ফ্রিজে ঢোকাচ্ছি আমার বাবার মৃতদেহকে, নিষ্পলকভাবে সই করে যাচ্ছি কাগজের পর কাগজ, ফরমের পর ফরম, সারা পৃথিবীকে জানাতে যে, আমার বাবা মারা গেছেন, তাদের ব্যক্তিগত রেকর্ডের জন্য। কিন্তু আসল রেকর্ড যে সই হয়ে গেছে আমার বাবার শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে, আমার মনে, অন্তত। যেন তিনি গেছেন তো দুঃখের কথা বটেই, শুধু এখন রয়েছে কিছু প্রশাসনিক ব্যাপার-স্যাপার যেগুলো আমাদের করতেই হবে। শোক করবার সময় পরে আসবে। যখন আমাদের অনুমতি দেওয়া হবে, মনে হলো তখন।
মৃত্যুর পর বাবাকে আমাদের বাসায় এসে গোসল দেওয়া ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা, একটি মৃতদেহকে কবরের জন্য প্রস্তুত করবার ব্যাপারে। কোত্থেকে দুজন হুজুর এসেছেন, তাদের ভাব দেখে মনে হলো এসব জিনিস তাঁরা রোজই দেখেন, এতে দুঃখের কিছু নাই, বরং আল্লাহ্র বান্দা আল্লাহ্র কাছেই ফিরে গেছেন। এখানে আমাদের কর্তব্য হলো শুধু মৃত ব্যক্তিকে নিয়ম অনুযায়ী পাঠানো পরকালে। কিন্তু তাহলে, আমার বাবা? তিনি গেলেন কই? খাটিয়ার ওপর শুয়ে থাকা লাশ দেখে যে আমার শুধু মনে হয়, তাহলে পায়ের আওয়াজ, নূরলদিন, ঈর্ষার সেই প্রৌঢ়, পরানের গহিনে, আলিফ মুহম্মদ, জলেশ্বরী, শহর, আমার পরিচয়… আমার পরিচয়… সব কি নাই হয়ে গেল? বাবার দেহের দিকে তাকাই, সেটিকে গোসল দিই আর ভাবি, এ যেন একটি স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো। হাজার ইচ্ছা করলেও সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়; চোখ বুজলেও নয়। বাবা হয়ে গেছেন একটি খোলস মাত্র। শত শত সুঁই ফোটানোর ঘা, কাটা, ছেঁড়া একটি শরীর। কী লাভ হলো এতসব করে? এবং তাঁর জন্য গত কয়েক মাস ধরে যে দিনরাত জেগে নিজের হাতে আমাদের বাসায় নতুন করে পড়ার জায়গা তৈরি করেছি – যেটিকে তিনি নাম দিয়ে গেছেন ‘পশ্চিমের পাঠাগার’ – নতুন করে শোবার ঘর, কুড়িগ্রাম থেকে আনা আমার দাদার পুরনো খাট দিয়ে – কী লাভ হলো এসব করে? গোসলশেষে বাবাকে একবার নিয়ে যাই সেই ঘরে। জীবিত থাকতে যেই জিনিস উপভোগ করতে পারেন নাই, অন্তত মৃত্যুর পর একটিবার তাঁকে সেখানে রাখতে। সেখান থেকে আবার ইউনাইটেড হাসপাতালে, আবার সেই একই পথে। কিন্তু এবারে কোনো কেবিনে নয়, আইসিইউতেও নয়, বাবাকে রেখে আসি একটি ফ্রিজের মধ্যে। বিশ্বাস যে হতে চায় না। একসময় মনে হয়, আমার অনেকক্ষণ ধরে মুখে কোনো শব্দ হয় না। কথা বলতে ভুলে গেছি, অথচ মনের মধ্যে যে অনবরত কথা বলে চলেছি নিজের সঙ্গে। ভাবি, সেদিন রাতে আমাদের কারো ঘুম হবে না, কিন্তু হয়। আমরা যে সবাই ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি গত দু-তিন দিনের ঘটনায়।
এমন সময় একটি পাবলিক ফিগারের সন্তান হওয়া সহজ নয়। মন চায় পৃথিবী থেকে লুকিয়ে নিজের মতো করে শোক করি, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। সকলে শুনতে চান কিছু কথা, একের পর এক সাংবাদিক ও টেলিভিশন চ্যানেল থেকে মানুষ এগিয়ে আসেন। আরো কত মানুষে লেখা চায়, মন্তব্য চায়, অথচ আমি শুধু চাই আমার অদৃশ্য মুখোশটি খুলে একবার কাঁদতে। কিন্তু কাঁদতে পারা যে একটি বড় বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগেই বাবা বানিয়ে গেছেন তিনটি পাঞ্জাবি – একটি সাদা, একটি কালো এবং আরেকটি লাল রঙের। অন্যপ্রকাশের মাজহারভাইকে দিয়ে তিনি নিখুঁতভাবে বলেছিলেন একেকটি কেমন হবে। হাতে কুঁচি থাকতে হবে, শেক্সপিয়রের হ্যামল্লেটের মতো, আবার কালো পাঞ্জাবির কলারে থাকবে একটু লাল। অনেক শৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি, তাই তখন কিছু ভাবি নাই, আমরা ভেবেছিলাম তিনি নিজের কথা ভেবে বানাতে দিয়েছেন। কিন্তু বাবা যাওয়ার পর খুলে দেখি সেগুলো সবই আমার সাইজে তৈরি। আমার কাছে তেমন উপযুক্ত পাঞ্জাবি ছিল না, বাবা মনে রেখেছিলেন। এবং আমি জানি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমি বুঝে যাবো কখন কোনটি পরতে হবে। সাদা পাঞ্জাবি মাটি দেওয়ার সময় ও সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, কালোটি সব শোকসভায় ও স্মরণসভায়, এবং লালটি… আমি জানি তিনি কী বলতে চাইলেন। একথা লিখি আর অনুভব করি তিনি এখনো কোনো এক প্রান্ত থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন… লাল পাঞ্জাবিটি তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন আমার এই বই প্রকাশ হলে মেলায় পরার জন্য। এমন দার্শনিক ছিলেন আমার বাবা, এমন আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক টান যে, তিনি মারা যাওয়ার পরও আমি তাঁর মনের কথা বুঝতে পারি।
(২০১৭-এর একুশে গ্রন্থমেলায় কথাপ্রকাশ থেকে বের হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় সৈয়দ-হকের মেঘ ও বাবার কিছু কথা শীর্ষক গ্রন্থ। প্রকাশিতব্য সেই গ্রন্থের শেষাংশ থেকে নেওয়া)। 