নয় এ মধুর খেলা

সনৎকুমার সাহা

 

 

খুলনা একাত্তর : আমার মুক্তিযুদ্ধ

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা, ২০১৪

 

২৫০ টাকা

 

বইটি পড়ে আমি অভিভূত। চেতনার সূক্ষ্ম তারে এ-অনুরণন তোলে। তা সঞ্চারিত হয় তার সকল পরিবাহিকায়। হৃদয়ে জাগায় আকুতি, পাওয়া এবং হারানো, দুটোকেই যা তুমুল বৈভবে ও অন্তহীন আক্ষেপে একই বিন্দুতে মেলায়। অথচ কোথাও এ উচ্চকণ্ঠ নয়। রুচির সংযমে এতটুকু চির খায় না। যেটুকু জানার, তাতে কিছু বাদও যায় না। যদিও যা ঘটে, তা সবই আমাদের উত্তেজনাকে শিখরস্পর্শী করে ভয় ও জয়, দুই-ই হাত ধরাধরি করে চলে। এবং তারা প্রত্যক্ষ বাস্তব। ইতিহাসের এক সৃষ্টি-মুহূর্তের আনন্দ-বেদনায় মাখা। ভাষা লাগামছাড়া হয়ে পড়লে তা অস্বাভাবিক হতো না। কিন্তু তা হয়নি। লেখায় রাশ শক্ত হাতে, কিন্তু পরম মমতায় আগাগোড়া ধরা। ‘ইমোশন্স রিকলেক্টেড ইন ট্র্যাংকুইলিটি’ – এই দিয়ে কবিতার জাত-বিচার করেছেন কোনো ভাবুক কবি। এখানেও পাই স্মৃতির প্রশান্তিতে আবেগের অবগাহন। তবে কবিতা নয়, এ স্মৃতিরই সঞ্চয়।

বইটি দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুলনা একাত্তর : আমার মুক্তিযুদ্ধ। ছেপেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ২০১৪-এ। অবশ্য লেখার সময় একুশ শতকের প্রথম কবছর একটু-একটু করে। তাও একাত্তর থেকে তিন দশক পেরিয়ে। আমিও পড়ি কমাস আগে। তখনই মনে হয়েছে, এই বই উপেক্ষা করার নয়। যেমন উপেক্ষা করা যায় না নাজিম মাহমুদের যখন ক্রীতদাস অথবা হাসান আজিজুল হকের একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা। তবে প্রেক্ষাপট পুরো এক নয়। নাজিম মাহমুদ বা হাসান আজিজুল হক লিখেছেন ইঁদুর যেমন জাঁতাকলে আটকা পড়ে, তেমনি দেশের ভেতরে থেকে ওই সময়ের অভিজ্ঞতার অনুভূতি নিয়ে, আর দীপা লিখেছেন পদে পদে মৃত্যুর ফাঁদ ডিঙিয়ে কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে সহায়-সম্বলহীন অনিশ্চয়তায় আর দুর্গতিতে ভরা উদ্বাস্ত্ত জীবনের কথা নিয়ে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে গান গেয়ে তিনিও তাঁর ‘যেটুকু সাধ্য’ ঢেলে দিয়েছেন। তবে এখানে বর্ণনায় নিজের অবদান তাঁর প্রাধান্য পায়নি। কী অবস্থার ভেতর দিয়ে মার্চ-এপ্রিল থেকে ওই সময়টা তিনি পার করেছেন, সেইটিই বলার মুখ্য বিষয়।

এদিক থেকে তাঁর লেখা নাজিম মাহমুদ বা হাসান আজিজুল হকের সমগোত্রীয়। কিছুটা বা পরিপূরক। তবে মেজাজ আলাদা। আলাদা হলেও লেখা একই রকম অসামান্য। ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে মঙ্গল-আলোক’, – তারই জন্যে তাঁর প্রার্থনা। তখন। এখনো।

বইটি পড়ার সময়েই মনে হয়েছে, এর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত। শুধু বিষয়ের জন্যে নয়, সততা ও পরিমিতিবোধের জন্যেও। আর ভাষার সৌরভে এর যে নিজস্বতা তাও আমাদের টানে। কোথাও ঝাঁঝ নেই, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে ঠিকই। তা পরিশীলিত, কিন্তু গভীরভাবে আত্মনিষ্ঠ। কোমল কিন্তু ভঙ্গুর নয়। আপন মর্যাদা এবং তা বারোয়ারি নয়, সহজ-সাবলীলতায় অটুট। কিন্তু আমি যে লিখব, এতে আমার কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল। মূল কারণ, বইটি যাঁর লেখা, তিনি আমার চেনা। যাঁদের কথা এখানে আছে তাঁদেরও কেউ কেউ আমার অপরিচিত নন। আর তাঁর যাত্রারম্ভ থেকে দেশে ফেরার অভিজ্ঞতার বর্ণনা উসকে দেয় কম-বেশি আমাদের স্মৃতিকেও। তাই ভয় হয়, এই বই নিয়ে কথা বলতে গেলে যা অপরিহার্য, সেই নিরাসক্তি বুঝি আমার বিপর্যস্ত হয়। আশা করেছিলাম, আরো অনেকে হয়তো এর ভেতরে বইটি পড়ে থাকবেন। তাঁদের কেউ তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু লেখায় আগ্রহীও হবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কিছু চোখে পড়েনি। অগত্যা আমিই যা পারি, লিখি। নিরপেক্ষতার অভাব ঘটতে পারে এই ঝুঁকি মাথায় নিয়েও। বিচ্যুতি ঘটলে কেউ নিশ্চয়ই তা ধরিয়ে দেবেন। বইটি কোনো কাল্পনিক বিষয় নিয়ে নয়। আমাদের জীবনে এই ভূখন্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সবচেয়ে ভয়ংকর ও সবচেয়ে গৌরবের ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আমাদের তার সাক্ষী হওয়া। কাজেই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যদি অগ্রাধিকার পায়, তবে তা যথার্থ হয় না। আর সবার মতো আমার বেলাতেও না।

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি প্রথম দেখি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-চত্বরে খুলনা থেকে তিনি এসেছিলেন ইংরেজি পড়তে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দখল না থাকলে তখন কেউ এতে সাহস করতো না। তাই সমীহ জাগান তিনি সবার মনে তখনই। তবে অন্য ভবনে আমাদের কাছে – আসলে গোটা ক্যাম্পাসেই – সাড়া জাগান তিনি আর এক গুণে। সে তাঁর গানের বৈভব। রবীন্দ্রসংগীত তখন এই বাংলায় আত্মপরিচয়ের ও আত্মগৌরবের অভিজ্ঞান। তাঁর গলায় তা অমৃতসঞ্চারী। চাতক পাখির মতো আমরা তার আশায়-আশায় থাকি। এমনে বেশভুষায় তিনি অতিসাধারণ। কিন্তু তাতেই ফুটে উঠত গরীয়সী শ্রী। মনে হতো, ওই গানের সঙ্গে এমনই মানায়। যাকে বলি সংস্কৃতি, যা বহুযুগের চলমান ধারায় মূর্ত ও প্রাণময়ী হতে হতে চলে, তারই যেন তিনি জীবন্ত প্রতিমা – ঘোরাফেরা আমাদের চোখের সামনেই; – আনন্দধ্বনি জাগে, যখন মঞ্চে বসে সুরের মায়াজাল তিনি বুনে চলেন। অধিকাংশই রবীন্দ্রসংগীত, তবে ওই সময়ে আমাদের অন্যান্য আত্মজাগরণের গানও তাতে যুক্ত হয়। ঊনসত্তর-সত্তরের এই বাংলাকেই যেন তাঁর ভেতরে বাঙ্ময়ী হতে দেখি। তাই অবাক হই না, যখন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো মনীষীও তাঁকে স্নেহের ছায়ায় টেনে নেন।

তবে সংকটের বিহবলতা আসে পিছু পিছু। ঊনসত্তরের গণরোষে আইয়ুব খানের পদত্যাগ, অনন্যোপায় নতুন সমরশাসক ইয়াহিয়া খানের সব প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এখানে বাঙালি জাতিসত্তার বিস্ফোরণ, সত্তরের নির্বাচন, তাতে অখন্ড পাকিস্তানেই বাঙালির নিরঙ্কুশ প্রাধান্য, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর তাকে বানচাল করার চক্রান্ত, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য ঐতিহাসিক ঘোষণা – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, আর তাঁরই নির্দেশে বাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের শুরু – এইখানেই দেখি এই বইয়ে পাঠপর্বের যবনিকা উন্মোচন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার দিন ঘোষণা করা হয়েছিল আগেই। কিন্তু অসহযোগের মুখে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষারত দীপা হয়তো মন্নুজান হলের কোনো এক ঘরের কোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে তখন কোনো অবকাশে গুনগুন করে গাইছিলেন, ‘নিশীথে কী কয়ে গেল মনে কী জানি, কী জানি।/… সে কথা কি অকারণে ব্যথিছে হৃদয়, এ কি ভয়, এ কি জয়।/… সে কথা কি নানা সুরে বলে মোরে ‘চলো দূরে’ -/ সে কি বাজে বুকে মম, বাজে কি গগনে। কী জানি, কী জানি।’ পরদিন ৮ মার্চ, তাঁর খুলনার উদ্দেশে রাজশাহী ছেড়ে রওনা হওয়া। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল দিনগুলো পাতা ওলটাত শুরু করে তখন থেকে। সুধা-বিষে মেশা এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এখানে তারই কথা তিনি শোনান।

কথার সূত্রপাত এলিয়ট থেকে ধার করে ‘এপ্রিল : নিষ্ঠুর মাস’ – এই নাম মাথায় নিয়ে। দীপা তো স্পষ্ট করেছেন প্রথম অনুচ্ছেদেই : ‘এপ্রিল বসন্তের মাস। টি. এস. এলিয়ট এপ্রিলকে বলেছেন নিষ্ঠুর মাস। বসন্ত বর্ষণে শীতে শুকিয়ে যাওয়া মরা মাঠে লাইলাকের শেকড় মাটি ভেদ করে মাথা তুলতে চায়। একই সঙ্গে এপ্রিলের বসন্ত বাতাসে স্মৃতি আর বাসনা-কামনারাশি, একাকার হয়ে মিশে যায়।…’ ইঙ্গিত, আরো ভালোভাবে ধরা পড়ে দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের প্রথম কবিতা ‘দ্য বারিয়াল অফ দ্য ডেড’ পূর্বাপর আরো একটু খুঁটিয়ে পড়লে। ইংরেজির ছাত্রী দীপার কাছে ইশারাটাই যথেষ্ট মনে হয়ে থাকতে পারে। আমরা যারা অতশত জানি না, তারা কবিতাটির কিছু কিছু রূপকল্পের দিকে ফিরে তাকালে যোগাযোগটা হয়তো আরো ভালো বুঝতে পারি। অবশ্য এটা আমার ধারণা। আমি আমারটাই বলি। ‘The Burial of the Dead’ – এই নামের ভেতরে যেন একাত্তরের এপ্রিলে এদেশে দীপার ও এরকম আরো কতজনের জীবনে আসন্ন ভবিতব্যের আভাস মেলে। এই বইতে একটু পরে জানতে পারি, ওই শেষ সৎকারও জোটে না কতজনের! কবিতায় আরো পড়ি ‘Winter kept us warm, covering/ Earth in forgetful snow, feeding/ A little life with dried tubers/ Summer surprised us…’ এ যেন বাঙালি-সমষ্টি জীবনের পাকিস্তানি অভিজ্ঞতা পেরোবার কথা। মুক্তিসংগ্রামের বিস্ময় ওই Summer-এর মতোই। একটু পরে আবার পড়ি ‘…He said, Marie,/ Marie, hold on tight. And down we went/ In the Mountains, there you feel free…’ আমাদের ওই সময়ে কি এই অনুভব ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিতে ছড়ায় না? কবিতার শেষ স্তবকে দেখি, ‘…Unreal City,/ under the brown fog of a writer dawn,/ A crowd flowed over London Bridge, so many,/ I had not thought death had undone so many./ Sighs, short and infrequent, were exhaled,/ and each man fixed his eyes before his feet…’ এও তো একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের পর আমাদেরই কথা। পরে উপান্তিক কটি চরণ, ‘that corpse you planted last year in your garden,/ ‘Has it begun to sprout? will it bloom this year?…’ এই বাংলায় অসংখ্য শহীদ-সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে এ-প্রশ্ন আজো আমাদের অনিঃশেষ। দীপা তাঁর কথামালার গোড়ার মুখটুকু শুধু ধরিয়ে দিয়েছেন। বাকিটা ছড়িয়ে গেছে তাঁরই অভিজ্ঞতার বর্ণনায়। তা শুধু তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধ’ থাকেনি। আরো কতজনের কথা কতভাবে ওই মোহনায় এসে মেশে। সুখ না পেলেও তাদের মনে সান্ত্বনার প্রলেপ একটু পড়ে। এলিয়টের এই কবিতা অবশ্য অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও পড়া যায়। আমি কেবল আমার ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছি।

এখানে একাত্তরের এপ্রিল আসে মার্চের ঘাত-প্রতিঘাতের ধারাবাহিকতায়। গণ-অসহযোগ বিকল করে ফেলে পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র। শক্তিমদগর্বিত শাসকচক্র মনে করে, ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করেই তারা একে শায়েস্তা করে ফেলবে। পঁচিশে মার্চ রাতে চলে আন্দোলনমুখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাদের মনমতো না হলে নির্বাচনের রায়কে তারা থোরাই কেয়ার করে। কিন্তু ফল হয় উলটো। বাংলার মানুষ নতি স্বীকার করে না। পাকিস্তানি শাসনকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করে। বাড়িতে বাড়িতে উড়তে থাকে তৎক্ষণিকভাবে রচিত ও গণ-অনুমোদনের উন্মাদনায় স্বীকৃত এই বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা। ‘দানবের সাথে সংগ্রামের তরে’ প্রস্ত্ততি চলে ঘরে ঘরে। একে নির্মূল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরিকল্পিত নীল-নকশা অনুযায়ী উৎকট সাম্প্রদায়িক রোষে বিভিন্ন বড় শহরে সংখ্যালঘু নেতৃস্থানীয় যাঁরা তাঁদের ঘর থেকে টেনে বের করে এনে রাতের বেলাতেই সবাইকে দেখিয়ে হত্যা করা শুরু করে। খুলনায় ঘটে এটা ১ এপ্রিল। ইসলামি রাষ্ট্রে শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলেই সেখানে প্রাণ হারালেন সমাজে শ্রদ্ধেয় ছয়জন বড়মাপের মানুষ। এপ্রিলের নিষ্ঠুরতার আর এক রূপ দেখলেন দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দি পাকিস্তানি মানসে সম্ভবত এটিই কাজ করেছিল, খুন করে, ভয় দেখিয়ে বিধর্মীদের দেশছাড়া করতে পারলে অধিকাংশ মানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি চেতনা মূল্য হারাবে। তখন এই ভূখন্ডে পাকিস্তানি মনোভাব নিরঙ্কুশ হবে। আর কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বললে বা ভাবলে তাকেও দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, পাকিস্তানি জুলুমই এখানে চূড়ান্ত বিধান। নারী নির্যাতন ও শিশুহত্যাও যৌক্তিকতা পায়। এই সর্বগ্রাসী নিষ্ঠুরতার পরিমন্ডলে শুধু দীপাদের পরিবার কেন, তাঁদের মতো আর কেউই নিরাপদ থাকেন না। তাঁদের মতো লাখ লাখ মানুষ, শেষ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি দেশত্যাগে বাধ্য হন। দেশে যাঁরা থেকে যান, তাঁদেরও সিংহভাগ ধর্ম যাই হোক না কেন বাঙালি-চেতনা মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন না। তা চানও না। অনেক ঝুঁকি মাথায় নিয়েও তাঁরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, যা তখন ঘোষিত বাস্তব, মনের গভীরে লালন করে চলেন। জঙ্গি পাকিস্তানিদেরও হিসাবে ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রবাসেই তার বৈধ ক্রিয়াকর্ম বজায় রাখে। অবরুদ্ধ দেশ উদ্ধারে মুক্তিযুদ্ধ তার নেতৃত্বে ভিন্ন মাত্রা পায়।

এই পটভূমিতে দীপা তাঁর অনিশ্চিত জীবনযাত্রার কথা লেখেন বইটিতে। একদিক থেকে এটা তাঁর একার কথা। কিন্তু এই একার কথাই সমজাতীয় বাস্তবের অভিঘাতে সবার কথা হয়ে যায়।

‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ সবার মুক্তিযুদ্ধের সারাৎসার তুলে ধরে, তবে কোথাও তিনি উচ্চকণ্ঠ নন। অসহায় দুঃখবোধ তাঁর ভাষার শুচিতা ও শালীনতাকে বিপর্যস্ত করে না। এতে ওই দুঃখ আরো জমাট বাঁধে। তিনি আমাদের যেমন আপন হয়ে ওঠেন, তেমনি আরো শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন। খুলনা শহরে ১ এপ্রিল ছয় বিশিষ্ট স্বধর্মী নিধনের পর অনুরূপ আর সবার মতো দীপারাও মনস্থির করেন, পালাতে হবে – আপাতত গ্রামের আড়ালে। দীপারা মানে, বাবা-মা, বাবাই অভিভাবক, আর তিন ভাই। ভাই-বোনদের ভেতর দীপাই বড়। ভাই-বোন সবাই পড়ুয়া। সব ছোট শাশ্বত এখনো স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি। তার বড় ভার্গব ও ভাস্বর। আক্ষরিক অর্থে অজ্ঞাতবাসের উদ্যোগ। বাড়িঘর ছেড়ে নদীপথে প্রথম যাত্রাবিরতি বটিয়াঘাটা ইউনিয়নের ফুলতলা গ্রামে। তাঁরাই শুধু নন, এই রকম আরো অনেক পরিবার। বংশানুক্রমে থেকে যাওয়া মাড়োয়ারিরাও। তাতেও নিরাপত্তা মেলে না। পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের এদেশি অনুচরেরা-ঘাতক-দালাল নামে এখন যাদের পরিচয় – তাড়া করে ফেরে। নদীতে ভেসে চলে অগুনতি মানুষের মৃতদেহ। পথে-পথে প্রকাশ্যে পড়ে থাকে, গাছের ডালে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে থাকে। বাঙালিসত্তায় নিজেদের মনুষ্যত্বকে তারা বুঝতে চেয়েছিল বলে। অথবা তাও নয়। যারা তেমন বুঝতে চেয়েছিল, তাদের সারিতে মিশে গিয়েছিল বলে।

পাকিস্তানি হানাদারদের গানবোটে হামলা, নির্বিচার গোলাগুলি, সম্পন্ন-গৃহস্থ গোলদারদের সর্বস্ব পুড়িয়ে ছাই করা, তাদের ফেউদের উৎপাত – এ সবই বুঝিয়ে দেয়, নিভৃত পল্লী ফুলতলাও আর নিরাপদ নয়। শেষে মনে হয়, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা যতই থাক সীমান্ত পেরোনো ছাড়া টিকে থাকার আর কোনো উপায় নেই। আলাদা-আলাদা নয়, একত্রে। প্রথমে ছোট-ছোট দলে। আবার সেই নদীপথে। সাতক্ষীরা পেরিয়ে কেয়ারগাতি গ্রামে দীপাদের নৌকো পড়ে জঙ্গি দখলদারদের সহায়ক-শক্তি শান্তিবাহিনীর খপ্পরে। অসীম করুণা তাদের, বড় কোনো অঘটন ঘটায়নি। তবে পথের সম্বল সামান্য যা ছিল কেড়ে নেয়। শুধু করুণা করে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেটগুলোর বান্ডিল ফেরত দেয়। পাঠায় আবার ওই জলপথে ফুলতলায়। দ্বিতীয়বার যাওয়ার চেষ্টা ভিন্নপথে। ডুমুরিয়া পর্যন্ত নৌকোয়। তারপর হাঁটাপথ। বেশ দীর্ঘ। অনেক  গ্রাম ভেঙে এসেছে হাজার-হাজার মানুষ। প্রাণ হাতে নিয়ে, তাড়া-খাওয়া ছিন্নমূলদের মিছিল। রাতে চুকনগরে যাত্রাবিরতি। পথের মাঝখানেই ইটের ওপর মাথা রেখে শুয়ে শ্রান্তি ভোলার চেষ্টা। সকালে জানাজানি হলেই পাকিস্তানি জঙ্গি-বাহিনীর হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কা। ঘটেও তাই। সেটা ২০ মে। দীপারা ভাগ্যক্রমে তার একটু আগেই এক মাড়োয়ারি দলের সঙ্গে গাদাগাদি করে লঝ্ঝরমার্কা এক বাসে ওঠার সুযোগ পান। ভয়াবহ গণহত্যায় বলি হওয়ার হাত থেকে রেহাই মেলে। পরে কেশবপুর থেকে আবার পায়ে হাঁটা। আবার পড়েন সামনে পাকিস্তানি সেনাদের। দুপাশে খাল-বিলে খানা-খন্দে মাথা ডুবিয়ে রক্ষে। ওপর দিয়ে ছুটে যায় মেশিনগানের গুলি। ঝাউডাঙ্গার এই হত্যাকান্ডেও যে কতশো জন প্রাণ হারালেন তার ইয়ত্তা নেই। তারপরেও হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়ে এক ছোট নদী। হঠাৎ করেই উদয় হয়। এই নদী পেরোলেই সীমান্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার নিষ্কৃতি। বেলা তখন অপরাহ্ণ। পাঁচটা বেজে গেছে ঘড়িতে। দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের একটি পালার অবসান। তবে নতুন অনিশ্চয়তার শুরু।

ছজনের সংসার। কিন্তু কপর্দকশূন্য। থাকবেন কোথায়? শুরুতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় মেলে না। বাংলাদেশের উদ্বাস্ত্তরা রেশন পায়। তাতে খাবার জোটে। ট্রেনে-বাসে ভাড়া লাগে না। তাতে চলাফেরার খরচ বাঁচে। তারপরেও ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর নানা তাগিদ থাকে। দীপাকেই তার বেশির ভাগ সামলাতে হয়। সহানুভূতির পরিমন্ডল একটা ছিল। তাই দিনে-রাতে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে কিছু টাকা হাতে আসে। পাকিস্তান বেতারে রাজশাহী খুলনা, দুই কেন্দ্র থেকেই তিনি নিয়মিত গান গাইতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও গান গাইবার সুযোগ মেলে। কথিকাও পড়েছেন। সবগুলোই মনে দাগ কাটার মতো। তখনকার কলকাতার গুণিজনদেরও তারিফ পেয়েছেন। পুরো সংসার এক জায়গায় থাকার মতো মনের বল আবার জাগে। পায়ের তলায় মাটিও যেন খুঁজে পান। নকশাল দৌরাত্ম্যের কারণে যথেষ্ট কম ভাড়ায় থাকার জায়গাও জোটে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ওখানে নকশালরা নাক গলায়নি। এখানকার শরণার্থী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, কেউই অহেতুক বিড়ম্বনায় পড়েননি।

কিন্তু অবর্ণনীয় আঘাত হানা দেয় অকল্পনীয় আকস্মিকতায়। দীপা লিখছেন, ‘মাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। মানসিকভাবে তিনি পুরো সুস্থ ছিলেন না। একাত্তরের শেষাশেষি সন্তোষপুরে বাসা ভাড়া করা গেলে তিলজলা থেকে মাকে সঙ্গে করে আনতে তিন ছেলে ট্যাক্সি ভাড়া করে। মা সঙ্গেই ছিলেন। গাড়ির পেছনের ঢাকা তুলে অল্প কিছু জিনিসপত্র ভরতে ছেলেরা পেছন ফিরে কয়েক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঘুরে তাকাতেই দেখে মা নেই। তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।’ এই কষ্ট দীপাকে কুরে কুরে খায়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘মাকে’।

তারপরেও মুক্তিযুদ্ধ চলে। শেষ হয়। ষোলই ডিসেম্বর আসে। হানাদাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। পরে দীপাও ফিরে আসেন এই বাংলায়। একা নয়। তবে একজনকে ফেলে রেখে। লেখেন, ‘একাত্তরে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়েছিলাম ছয়জন, ফিরে এলাম পাঁচজন।… মা নেই সঙ্গে।’

তবু যুদ্ধের অবসান। স্বাধীন স্বদেশ মুক্ত। দীপার কথা শেষ হয় এই বলে, ‘…মানুষের মধ্যে যেমন আছে দানব, তেমনি দেবতাও আছে। পালাবদলের মহৎ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের কি মহৎ মানুষে পরিণত করতে পারি না? স্বপ্ন দেখার মনটাকে মেলে রাখি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিকশিত হয়েছে, যেন মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারি।’

এই বই থেকে আরো কটি নমুনা দিই। তা থেকে দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনবোধ ও তাঁর লেখার মেজাজ সম্পর্কে একটা ধারণা হতে পারে –

১. মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতেও মনে হয়েছে শেষ পর্যন্ত জীবনই জয়ী হয়। মৃত্যু সত্য, অনিবার্য। জীবন তার থেকেও অনেক বড় সত্য। (পৃ ১৮)

২. জীবন একটাই। সেই জীবনেরও অনেকটাই প্রতিদিনের জীবনযাপনের তুচ্ছতা আর অনিবার্য নিয়মের গন্ডির মধ্যে বাঁধা থাকে। তার থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। এইভাবে কখন যে জীবনের ধ্রুপদী অনুষঙ্গগুলি নাগালের বাইরে চলে যায় কেউ বোধহয় বুঝতে পারে না। (পৃ ২৫)

৩. মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলব, সব সময় আমার মনে হয়েছে, এখনো বিশ্বাস করি, আমাদের ভিয়েতনামের মতো একটি যুদ্ধ দরকার ছিল। স্বল্প সময়ে সহজে বিজয় পেয়ে দুর্লভ স্বাধীনতাকে সুলভ পণ্যে পরিণত করেছি আমরা। (পৃ ৩৪)।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ’ শব্দগুলো অতি-ব্যবহারে বড় ক্লিশে হয়ে গেছে। জীবন ঘষে যে আগুন জ্বালানো হয় নিবে গিয়েও সে আগুন ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। একুশ মানে যেমন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মাথানত না করা, একাত্তর মানেও তাই। যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়েও প্রতি মুহূর্তে জীবনের যুদ্ধটা চালিয়ে যাবার যে শিক্ষা সেও তো একাত্তরের কাছ থেকেই পাওয়া। (পৃ ৫৫)। বইটি ক্ষীণাঙ্গী। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪।

দীপার লেখা আমার পছন্দের, এ কথা আগেই বলেছি। নিজের কথাও এখানেই আপাতত শেষ। তবে এতেই সবটুকু দায় এড়াতে পারি না। নৈর্ব্যক্তিকতার দূরত্বকেও মানতে হয়। তাতে বিষয়ের মায়াজাল দূরে সরে। যতদূর পারি দৃষ্টিকে ভাবলেশহীন করি। কথা কিছু বাড়ে। যা বলেছি, তা খন্ডন করে নয়। প্রেক্ষাপটের  বিস্তার ঘটিয়ে। কালের রেখাকে সচল করে।

মুক্তিযুদ্ধের অবসানে বাংলাদেশ ঠিক-ঠিক এগোয়নি। এ নিয়ে দীপার আক্ষেপ আছে। আক্ষেপ আছে আমাদেরও। কিন্তু যে বাস্তবের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ, যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ও বিশ্বাসের ঘেরাটোপে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ধারাবাহিকতা, তাতে মুক্তিসংগ্রামের স্বপ্নসাধ তার সফল সমাপ্তিতেই মূর্ত হবে এই আশা কি একটু বেশি আকাশচারী হয়ে যায় না? এ-কথা বলে যা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা খুঁজি। কিন্তু তার সমর্থন জোগাই না। প্রকৃতপক্ষে এটা ব্যতিক্রমও নয়। যে-ফরাসি বিপ্লব গোটা পৃথিবীর সচেতন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়, তার পরের সময়টা কম দুর্বিষহ ছিল না। ডিকেন্স যে বলেছেন, একই সঙ্গে তা ছিল সেরা সময় ও নিকৃষ্ট সময়, তা দীপার অজানা নয়, শিল্পবিপ্লবের অগ্রযান চাকার তলায় কতজনকে যে পিষে মেরেছে, নির্বিকার ইতিহাস তারও সাক্ষ্য দেয়। আরো কাছে রাশিয়া বা চীনের বিপ্লবের কথা যখন ভাবি, তখন স্ট্যালিন বা মাও জে দং-এর বাড়াবাড়ি কি আমাদের পীড়িত করে না? চার দশক ধরে কেন স্পেনে চালু থাকলো একনায়ক ফ্র্যাংকোর দুঃশাসন? তবু মানুষ এক জায়গায় স্থির থাকে না। এগোয়। কিন্তু ‘পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা’। সব জায়গায় একসঙ্গে নয়। একই হারে নয়। এবং তা স্থির করে প্রতিটি জায়গায় ‘যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী’। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রজ্ঞা-নির্বুদ্ধিতা দিয়ে। সভ্যতার উত্থান ও অবলুপ্তির ধারাকেও তারা বয়ে চলে। পৃথক পৃথক বস্ত্তগত অবস্থায়। পৃথক পৃথক চালে।

দীপা যে বলছেন, ‘ – আমাদের ভিয়েতনামের মতো একটা যুদ্ধ দরকার ছিল।’ – এর আবেগগত দিকটা আমাদেরও টানে; কিন্তু বস্ত্তগত ভূমি কি তখন তেমন সম্ভাবনার জন্য উপযুক্ত ছিল? পাকিস্তানি সমরশাসকরাও চাইছিল, হত্যা-লুণ্ঠন ও অবাঞ্ছিতদের বিতাড়নের পর দেশের ভেতরে স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। মার্চ-এপ্রিলের বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ তাতে কতটুকু অবশিষ্ট থাকত? দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। বিরূপতার বীজও কিন্তু থেকে গেছে। তাদের পরিচর্যা ও পরিপুষ্টিতেও ব্যাঘাত ঘটেনি। এমনকি না জেনেও অনেকে তাতে প্রশ্রয় দিয়েছি। মাশুলও তার দিয়ে চলেছি কম নয়। সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকেও। তবু বাংলাদেশ হয়েছে। বাংলাদেশ আছে। আশার আলোও জ্বালাতে পারছে। তখন স্বাধীন না হলে এর সম্ভাবনাও কিন্তু উবে যেতে পারত। ভবিষ্যতে কী করবো, আর কী হবে, তা ঠিক করার পুরো অধিকার কিন্তু আমাদের। দায়িত্বও বইতে হবে আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে যদি কিছু থাকে তবে তা সেইখানেই। একাত্তরে নয়, একাত্তরের ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের নির্মাণে। যে-ভবিষ্যৎ প্রত্যেককে ‘আপনার নিরানন্দ অন্ধ কারাগার’, – স্বেচ্ছাকৃত হলেও তা থেকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্র রচনা করবে।

‘নয় নয় এ মধুর খেলা -/ তোমায় আমায় সারা জীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা -’ এ গান দীপা, বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় বহুবার বহু জায়গায় গেয়েছেন। এখানে ‘তুমি’কে আর ‘আমি’ই বা কে? নিশ্চয় কোনো ব্যক্তি, এমনকি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ‘আমি’ নন। সামষ্টিক মানব চৈতন্য বলে ধরলেই বোধহয় এতে সংগতি মেলে। একই রকম ‘তুমি’ অপার বিশ্বের চলমানতার অন্তহীন সৃষ্টিশীল প্রেরণা। কিন্তু ‘আমি’র বিকাশে তুমি-আমি সম্পর্কে কত বাধা, কত সংশয়। কতবার যে ‘নিবল বাতি গর্জে এল ঝড়ের রাতি -’; আবার, ‘বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে/ দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে।’ সহজেই বোঝা যায়, রূপকের আড়ালে যে দুর্গতির ইঙ্গিত, তা আমাদের একাত্তরের দুর্ভোগেরই সমতুল্য। তারপরেও ‘তোমার প্রেমে আঘাত আছে নাইকো অবহেলা’ – এ কথা বলার যোগ্যতা ‘আমাকেই’ অর্জন করতে হয়। ‘তুমি’ নিজে থেকে দেয় না, বরং কেড়ে নেয়, যেমন এখানে দীপার মাকে। বঞ্চনার পর বঞ্চনায় আছড়ে ফেলেন তাঁকে।

তারপরেও মনে রাখি, পঁয়তাল্লিশ বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শাপমোচন-পালার অনুষ্ঠান হয়, তাতে দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বড়ো বিস্ময় লাগে’ গান। আমরা যারা নতুন শ্রোতা, তাদের দেহে-মনে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তার আবেদন কি আজো একই রকম নয়? দুঃখ পাওয়া-দুঃখ দেওয়ায় কি কোনো বিরাম আছে? আর মানুষ তো সব মিলিয়ে এগোবার পথই খোঁজে। একাত্তর এই বাংলায় সেভাবেই প্রেরণা জোগায়। কোনো একজনকে নয়। অবিনাশী আলোর মশাল হয়ে সবাইকেই। তা কাজে লাগাতে পারি আমরাই। এখন এবং ভবিষ্যতে আরো ‘এখন’। জানি ব্যর্থতা আছে। স্খলন-পতন-ত্রুটি আছে। পরস্পরবিরোধী বহুমুখী তাগিদ আছে। সেসব জীবনেরই অনুষঙ্গ। আজকের ভিয়েতনামেও। পিছুটান পিছে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সৎ চেষ্টাটাই শেষ বিচারে মূল্য পায়। তা না-থাকলে, অথবা তাতে ব্যর্থ হলে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় শামিল হতে না পারাই নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়।

সবশেষে একটা ছোট্ট অনুযোগ। যথার্থ না হলে খারিজ হবে অবশ্যই। বইয়ের নাম খুলনা একাত্তর : আমার মুক্তিযুদ্ধ। খুলনা পর্ব কিন্তু শেষ হয়ে যায় ২০ মে। পরের কমাস ওখানে কী ঘটলো, আমরা জানতে পারি না। প্রতিরোধে, প্রতিশোধে কী করে মুক্তিযুদ্ধ দুর্বার হয়ে উঠলো, তা-ও না। শুধু জানি, যুদ্ধশেষে কিছু দুর্বৃত্তকে সমুচিত সাজা দেওয়ার কথা। কোথাও কি কিছু অপূর্ণতা থাকলো? ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ অবশ্য আমাদের আগাগোড়া নিবিষ্ট রাখে।

আরো একটা কথা। অবিরাম চেতনা প্রবাহে, প্রবহমান স্রোতস্বিনীতে ভেসে যাওয়া কোনো কোনো বস্ত্ত বা বস্ত্তপুঞ্জ যেমন ঘুরে ঘুরে পাক খেতে খেতে যায়, এখানেও তেমনি কিছু কিছু বিষয় ঘুরে ঘুরে আসে। তবে প্রুস্ত, ভার্জিনিয়া উল্ফ বা ফকনার, – সচেতনভাবে এঁদের কারো ঘরানার নয়। দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের মতো কথা বলে গেছেন। তাতেই কিন্তু অধিকার চেতনাপ্রবাহের আলাদা আমেজ একটা এসেছে। হয়তো বিশ্বসাহিত্য তাঁর অনেক পড়া। তাঁদের নির্যাস আপনা থেকে এখানে চুঁইয়ে পড়েছে। তিনি খেয়ালও করেননি।

তারপরেও বলি, এ-বই সুখপাঠ্য নয়। আমরা কষ্টই পাই। তবু এ অবশ্যপাঠ্য।