পটেশ্বরী

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

সপ্তম কিসিত্ম

 

অনেক পরে জেনেছি যে, ১৯০১-এ প্যারিসে এসে পিকাসো নিজের একাকিত্বকে ভরিয়ে তুলতেন ভিখিরি আর বেশ্যা এঁকে। এখনো আকৃতি বিকৃত করে, রূপরেখা ভেঙে নিজের বহুমাতৃক, বহুরূপী রেখাঙ্কন, রেখাঙ্কন সৃষ্টি হয়নি ওঁর। প্রলম্বিত রেখার ওই নির্মাণপ্রবাহ আমারও মডেল অাঁকায় এসে গিয়েছিল। এখন ভাবলে একটু চমকাই কী করে পিকাসোর প্রলেপ পড়ল আমার ছবির সংসারে। আমার ছবির ঘর সমানে আন্দোলিত করছেন তখন সেজান, গোগ্যাঁ, ভ্যান গঘ্ আর মদিলিয়ানি।

পিকাসো সম্পর্কে তখন যে একেবারেই অনবহিত ছিলাম তা কিন্তু নয়। কারণ বহুকাল পরে সিমলা থেকে জওহরলাল নেহরম্নকে লেখা একটা চিঠিতে বলেছিলাম : আমার স্টুডিও বেশ ন্যাড়া, সাদা-সাদা দেওয়ালে ঘেরা পেলস্নায় একখান ঘর, তাতে শুধু খান দুয়েক চীনা ছবি আর একটা ছবি আমার বন্ধু মারি লুইজ শাসানির, যে বন্ধুটির কথা তোমায় আগে বলেওছি, যার ছবিতে পিকাসোর ১৯০৪-১৯০৫ সময়কালের সংবেদী, অদ্ভুত আকর্ষণ এবং সু  তিন-এর সেরা কাজের অসাধারণ মেলামেশা ও মোহাবেশ।

যে-স্টুডিও আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম মারি লুইজের সঙ্গে সেটা মোপার্নাসের পথে নোত্র দাম দে শঁজ-এ। মোপার্নাস সে-সময় শিল্প ও শিল্পীদের সেরা আখড়া। আমাদের স্টুডিওতে কতটুকু সময়ই বা আর দিতে পারতাম, তাই এক বুড়ো দ্বারবানের কাছে চাবি রেখে আসতাম বন্ধুদের ব্যবহারের জন্য। অনেকেই এই চাবি চেয়ে নিয়ে কাজ করে যেত স্টুডিওতে। তাদের মধ্যে একজন আমার ক্লাসমেট বরিস তাসলিৎস্কি।

সেজান, গোগ্যাঁ, ভ্যান গঘ্, মদিলিয়ানিদের প্রভাবে অল্প দিনেই বেশ দখল এসে গিয়েছিল টেকনিক এবং মানবদেহের আকার প্রকারের বোঝদারির ওপর। ফলে শয়ে শয়ে নারী ও পুরম্নষ দেহের নগ্ন ছবি বানিয়ে ফেললাম কাঠকয়লায়। এসব ছবিকে পাঠ্যসূচির কাজ ধরে নিলেও আমার অাঁকার কাজে এদের যে কী প্রভাব বর্তাল তা আমি অচিরে টের পেলাম। মানবদেহের গড়ন গঠন ভাঙচুরের অনমত্ম রহস্যে ক্ষণিকের জন্য সামান্য আলোকপাত ঘটল যেন। মনে পড়ল ফ্লোরেন্সের স্কুলজীবনে শোনা গল্পটা। মিকেলাঞ্জেলো বন্ধুর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে কবর থেকে লাশ খুঁড়ে আনছেন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও হাড়ের বাঁধুনি বোঝার জন্য। এই দেহসৌষ্ঠব বিচার ও ছবিতে তার চর্চা করতে এক সময় টান অনুভব করলাম তেলরং ছবির প্রতি। আমার অয়েল পেন্টিং জীবন শুরম্ন হলো। দেখতে দেখতে দুবছরে আমার তেলরং ছবির সংখ্যা দাঁড়াল ষাট!

এই ষাটখানা তেলরং ছবির অধিকাংশই ছিল পোর্ট্রেট এবং  সেলফ-পোর্ট্রেট। এর মধ্যে ইন্দু আর আমার বান্ধবী দেনিজ প্রম্নতোকে মুখোমুখি বসিয়ে যে-ছবিটা এঁকেছিলাম সেই ‘ইয়ং গার্লজ’ ১৯৩৩-এ ঘ্রঁ সালঁ-র প্রদর্শনীতে সোনার মেডেল পেল। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল তখন বিশেষ করে সালঁ-র শিক্ষায়তনে আমাকে যখন অ্যাসোসিয়েট মেম্বার পদ দেওয়া হলো ওই মেডেলের জোরে। কিন্তু সালঁতে নিয়মিত যেতে শুরম্ন করে বুঝলাম, বড্ড চাপা পরিবেশ ওখানে। দেনিজ জিজ্ঞেস করল একদিন, কেন বলছিস?

বললাম, দেনিজ, আমার অনেক খোলা হাওয়া চাই। চারদিকে মূর্তি আর ছবি, যেন জাদুঘর। আর বাকি জায়গা জুড়ে ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো খোলা জমি, খোলা হাওয়া কোথায়?

এই কথার মধ্যে আমরা নদীর ধারে এসে পড়েছিলাম। দেনিজ বলল, এই নদীর ধারেই তাহলে তাঁবু খাটিয়ে বস।

এই যে কথাটা ও বলল এ যে আমার মনের কথা তা ও-ই সব চেয়ে ভালো জানত। আমি আর উত্তর না করে স্কেচের খাতাটা বার করে স্যেনের পাড়ে দাঁড়ানো ওর মুখটা অাঁকতে লাগলাম। ও মুখ ভেংচে বলল, এটা কী হচ্ছে, মাদমোয়াজেল? একটা বাজে ড্রেসে আমি এখন, আর তুই আমাকে এঁকে চলেছিস।

খুব গম্ভীর একটা গলার স্বর তৈরি করে আমিও বলে দিলাম, মাদমোয়াজেল প্রম্নতো, তোমার পোশাক আমার কৌতূহলের বিষয় না। আমি খুঁজছি তোমার নারীত্ব।

ও বলল, তাহলে দু-তিনটে মেয়েকে একসঙ্গে ধরে কী চাস?

বললাম, তাদের সম্পর্ক। তাদের মনোভাব। দূরত্ব। নৈকট্য। নারী যে শুধু পুরম্নষের কোল আর আলিঙ্গন খুঁজে বেড়ায় না, এটা তো সত্যি? মানিস?

ও চুপ করে রইল, আমি এঁকে গেলাম। একটা সময় মনে হলো পড়মত্ম আলোয় যে-মুখটা ধরতে চেয়েছিলাম আসছে না। তখন স্কেচটা পড়পড় করে ছিঁড়ে স্যেনের জলে ছুড়ে দিলাম।

ও ‘কী, করছিস কী? কী, করছিস কী?’ করে ঠেকাতে গেল, কিন্তু ততক্ষণে ছবির টুকরোগুলো উড়ে গেছে নদীর দিকে। আমি ‘ও হো! আ হা! হি হি!’ ইত্যাদি অদ্ভুত আওয়াজ করে বললাম, সে পা ঘ্রাভ। সাংঘাতিক কিছু ঘটেনি। যেদিন মনে করবি সুন্দর সেজে আছিস, অাঁকব তোকে। শুধু পোশাকটা চেঞ্জ করে দেব আজকের পোশাকে। ও বলল, তার মানে?

বললাম, আজকের দামি পোশাকটা তোর খারাপ লেগেছে তো? ঠিক ভেবেছিস। আমারও ভালো লাগেনি।

ও বলল, তাহলে অাঁকছিলি কেন?

বললাম, পোশাকসমেত থোড়াই অাঁকছিলাম। শেষ রোদের আলোয় তোর মুখটা ধরে স্যেনের পাড়ে তোকে ন্যুড অাঁকছিলাম।

এরপর বহুক্ষণ হাহা, হিহি করে হাসলাম আমরা নদীর পাড়ে অন্ধকার নামা অবধি।

দেনিজ যে-কথাটা বলেছিল সেদিন সেটা ওই সময়ে চরে বেড়াচ্ছিল আমার মনের ভেতরে। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে বসতাম, মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, দূরত্ব আমাকে এত ভাবায় কেন? পুরম্নষ সম্পর্ক থেকে মেয়েদের স্বাধীন করে দেখার এত আগ্রহ কেন আমার? পুরম্নষের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক কি বাধ্যতামূলক? সেখানে কি একের ওপর অন্যের প্রাধান্য ধরা পড়ে না?

নারী ও নারীর সম্পর্ক কতদূর যায়? যেতে পারে? ছবিতে তার ছায়াপাত ঘটে?

এই সময়টায় আরো একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছিল আমার চারপাশে। আমার সতীর্থ অঁরি জ্যানো একের পর এক নগ্নিকা এঁকে নিজের একটা স্টাইলও গড়ে ফেলছিল, ওর ১৯৩৩-এ অাঁকা ‘ওদলিস্ক’ এক চর্চার বিষয়ই হয়ে উঠেছিল। আর রব্যের উম্বলো তো ওর ক্যানভাসে তুলে ধরল দুই মহিলা শিল্পীকে মুখোমুখি। প্যারিসজুড়ে তখন কেবলই মুক্তির আন্দোলন, স্বাধীনতার জিগির। শিল্পের মুক্তি, চিমত্মার মুক্তি, সাহিত্যের মুক্তি, আর এর সমসত্ম কিছুর মধ্যে আচ্ছন্ন থাকা – নারীর মুক্তি।

আমিও আমার মতো করে মেয়েদের খোলামেলা করছিলাম। আমার মেয়ে মডেল তো আশপাশেই। মারি লুইজ, দেনিজ, কখনো ইন্দু, আমি নিজে, আর যখন যাকে পেলাম। এর মধ্যে মারি লুইজ, দেনিজ আর নিজেকে নিয়ে একটা কম্পোজিশন করেছিলাম। সেখানে চতুর্থ এক উপস্থিতি ছিল এক ন্যুড মডেল।

স্টুডিওতে বসে করা বিরাট মাপের নারীমূর্তির সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে আমারই ভেতরের কোনো চেহারা বার করে আনছিল। মারি লুইজ শাসানি পড়ছে – আমার পড়ুয়া সত্তা যেন; দেনিজ বয়স্কা ন্যুড মডেল দেখছে আর ভাবছে – কোনো নগ্নিকা অাঁকতে গেলে যেমন অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনায় পড়ি আমি। আমি যে আমি অমৃতা, সেও ছবিতে অাঁকার মুহূর্তে দৃপ্ত চোখে চেয়ে আছে ছবির বাইরে, ছবির দর্শকের দিকে; ভাবখানা – যে দেখছো শুধু এটুকু দেখো না, এর মধ্যে নারী নিয়তিদর্শনও করো।

পরে একসময় বড় ছবিটার থেকে নিজের মুখ ও শরীরের অংশটা কেটে দেনিজকে উপহার করেছিলাম।

মেয়েদের নিয়ে বলতে বলতে আমার নিজের কথাও এসে পড়ছে। প্যারিসের জীবন নিয়ে বলতে গেলে আমার নিজের যৌনতার কথাও এসে যায়। আর যৌনতার কথা না বলে নিজের কী কথাই বা শোনাবে অমৃতা শের-গিল?

আমার যৌনজীবনের শুরম্নটা কীভাবে শোনাতে গেলে সাতকাহন গাইতে হয়, সেই সাতকাহনই গাইব আমি, যারা পড়ছে তারা অনুমতি করলে। আর অনুমতি তলব করারই বা ঢং করি কেন? বলছি তো নিজের কথাই। নিজের নগ্নিকা অাঁকার বেলায় কি সবার অনুমতি চেয়ে বেড়াই?

ব্যাপারটা শুরম্ন হয়ে গেল কিন্তু মা’র জন্য। মারি লুইজ শাসানির সঙ্গে আমার মেয়ে-মেয়ে সম্পর্ক নিয়ে যে একটা চর্চা শুরম্ন হয়ে গিয়েছিল যার জন্য  অনেকখানি দায়িত্ব কিন্তু মা’র। অথচ এই মা-ই আমাকে হাঙ্গেরি থেকে চিঠি লিখে শাসাতে লাগল : এসব কী শুনি আজকাল? তুই নাকি একটা মেয়ের সঙ্গে জড়িয়েছিস? কে এই মারি লুইজ শাসানি? ছবি অাঁকে বেশ করে। তো তোকে নিয়ে পড়েছে কেন? তোরও বলিহারি!

মেয়ে-মেয়ে সম্পর্কে যে আমার কৌতূহল বা ঔৎসুক্য ছিল না, তা বলব না। তা বলে মারি লুইজের সঙ্গে যে আমি শরীরে-শরীরে ভিড়ে গেছি এটা একদম বাজে কথা। তবে ওর সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লাম তার কারণটা তো মা-ই।

কথা নেই, বার্তা নেই, মা কোত্থেকে এক নবাবপুত্র খাড়া করল আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে বলে। তারা বাসত্মবিকই নামে ও পদে নবাব। পাত্রের বাবার নাম রাজা নবাব আলি। ইউনাইটেড প্রভিন্সেজের আকবরপুরের নবাবি খানদান ওদের। ছেলেটির নাম ইউসুফ আলি খান, ও সেই সময় প্যারিসেই ছিল। ওকে পেয়ে মা’র ধারণা হলো আকাশের চাঁদ হাতে। মেয়েকে রানি বানানোর এই তো সুযোগ।

একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কী রে, ইউসুফকে কেমন মনে হয়?

বললাম, কী আবার মনে হবে?

মা বলল, তোর বর হিসেবে ভাবতে পারিস?

– কী!

– ওর বাবাই লখনউয়ের ম্যারিস কলেজ বানিয়েছেন। ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের সেরা ইনস্টিটিউট।

– বুঝলাম। গানবাজনার একটা চক্কর পেয়ে গিয়েছ তাহলে।  তোমার বাছা পাত্রটি কি গানবাজনা করে?

মা ‘জানি না’! বলে ঝাঁঝের মাথায় বেরিয়ে গিয়েছিল।

আমি যে এই নবাবপুত্রটিতে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছিলাম তারও একটা কারণ ছিল। ওই ষোড়শী বয়সেই একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। প্যারিসে থাকাকালীনই একবার ছুটি কাটাতে গেলাম মাসি বস্নাঙ্কার বাড়ি হাঙ্গেরিতে। অনেকদিন পর ফের ওচির সঙ্গে দেখা হলো। ওচি মানে ভিক্টর, মাসতুতো ভাই।

রেলে করে বুদাপেসত্ম যেতে যেতেই মনে পড়ছিল দানিউরের পাড়ে দুনাহারাসিত্মর সেই বালিকাবেলা। একটা চোখা রোদ এসে পড়েছিল রেলের জানলার কাচে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা চলে গিয়েছিল এগারো বছর আগের এক সকালে। দুনাহারাসিত্মর সেই সকাল ভোলার নয়। বাবা বাইরে বাগানে, মা রান্নাঘরে, ইন্দু কোথায় জানি। বসার ঘরে শুধু আমি আর ওচি। থুড়ি ভিক্টর।

হঠাৎ কী মনে হলো জানি না, রেডিওতে কী একটা মিউজিক বাজছিল, আমি ওই পাঁচ বছরের পুঁচকি (আমি কোনোদিনই পুঁচকি ছিলাম কী!) হঠাৎ লাফিয়ে উঠে গায়ের সব জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে নগ্না ব্যালেরিনা হয়ে নাচা ধরলাম। দেখি ভিক্টর বেজির সামনে পড়া সাপের মতো থমকে আছে। না দুলছে, না হেলছে। আসলে ওই বয়সেই ভিক্টরের চাহনি ছিল বড় মানুষের মতো; বুঝছে ব্যাপারটা একটু অসভ্য হচ্ছে; কিন্তু ভুরম্ন কুঁচকানো বা লজ্জা পাওয়াটা আমাকে টিটকিরি করা হবে।

রেলের কাচে রোদ, আর আমি মনের পর্দায় আমার সেই নাচ দেখতে দেখতে একসময় খেয়াল করলাম আমরা বুদাপেসেত্ম ঢুকছি।

আর স্টেশনে ঢুকেই প্রথমে কী দেখলাম? স্যুটেড, বুটেড হয়ে স্টেশনের পস্ন্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আঠারো বছরের পূর্ণ পুরম্নষ, আমাদের ওচি, থুড়ি ভিক্টর!

প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম। আমি ওর, ও আমার। এই ভালোবাসার স্মারক হিসেবে ওর একটা ছবি এঁকেছিলাম। ভিক্টর সেটা দেখে বলেছিল, বেশ স্টুপিড দেখাচ্ছে আমাকে। আমি বলেছিলাম প্রেমে পড়লে ছেলেদের একটু স্টুপিডই লাগে।

যাই হোক, যে-কথা থেকে এখানে এলাম সেখানে ফিরি…

মা যখন আমাকে ইউসুফের গিন্নি করতে চাইছে তখন তলে তলে ওর এই ভয়টাও আছে, আমি না আবার ভিক্টরকে বিয়ে করে বসি! ভিক্টরের সঙ্গে আমার  মাখামাখিটা তখন ওর দুচক্ষের বিষ।

একদিন তো পরিষ্কার বলেই দিলো, তোমার বাবাকে বিয়ে করে ঢের নাকানি-চোবানি খেলাম জীবনে। এরপর তুমিও একটা কা- করলে ডুবেই মরতে হবে। সাধে আমি রাজা-রাজড়া খুঁজি না।

ইঙ্গিতটা ভিক্টরের প্রতি জেনে আমি চুপ করেই ছিলাম। মা বলল, আমিও কনসার্টে, কনসার্টে গেয়ে বেড়াতে পারতাম। তার বদলে কী করছি দেখতেই পারছ। তাই চাই না অাঁকাঅাঁকি বরবাদ করে রান্নাবাড়া নিয়ে পড়ে থাকো। শিল্পীর জীবনে বিয়েটা জুয়ো নয়, এইটা জেনো।

অনেকক্ষণ শোনার পরে শেষে বললাম, আমাকে কী করতে বলছ তাহলে, শুনি।

মা বলল, কালকের সন্ধের আসরে আমি ইউসুফকে আসতে বলেছি। বাড়িতে এখন থেকে যখন যা হয় সন্ধেবেলায়, ওকে আসতে বলব। মিশে দ্যাখো না? হয়তো তুমি নিজেই তখন প্রপোজ করে বসবে।

কী করব, না-করব কোনো ধারণাই নেই, তবু বিয়ে একটা জুয়ো জেনে দান দিয়ে বসলাম – ঠিক আছে মুচিকো, আসতে বলো তোমার প্রিন্স চার্মিংকে।

প্রিন্স চার্মিং হয়েই হাজির হয়েছিল ইউসুফ প্রথম দিনে। দারম্নণ একটা বিস্কিট কালার টুইডের স্যুট আর গলায় প্রিন্টের সিল্কের ক্রাভ্যাট, পায়ে দামি কালো ব্র্যান্ডেড শু, ব্যাকব্রাশ করা চুলে ক্রিম, গালে উবিগঁ-র লোশন আর এমনিতেই ঢুলুঢুলু ধরনের চোখজোড়ায়, ও মাই গড! – সুরমা। ড্রেসড ফর দ্য অকেজন বললে কিছুই বলা হয় না, বলতে হয় ড্রেসড টু কিল। অমৃতা শের-গিলকে বধ করবে বলে তৈরি হয়েই এসেছে।

পটে যাওয়ার মতোই চেহারা ইউসুফের। সঙ্গে দুরমত্ম স্টাইল কথাবার্তার, মেয়ে পটানোর জন্যই ধৈর্য ধরে শানানো। কিন্তু যেটা একটু অস্বসিত্মর ঠেকল তা হলো যাকে বিয়ে করার কথা উঠেছে সেই আমার সঙ্গেও সমানে ফ্লার্ট করে যাচ্ছে। এবং সে-সময় চোখ যে শুধু আমার ওপরই আছে তাই নয়, দিব্যি ভেসে বেড়াচ্ছে আশপাশে। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, এ আবার কীরকম পাত্র জুটল আমার?

তৃতীয় কি চতুর্থ দিন গল্প করতে করতে মজা করেই বললাম, তোমাদের নবাবি প্রাসাদে গেলে জেনানায় ঠুসে দেবে না তো?

ও হো হো হো করে খুব অস্বাভাবিক একটা হাসি দিলো।

তখন ফের বললাম, ঘোমটা টানতে হবে?

ও মুখের সামনে মেয়েদের মতো ঘোমটা টানার নখরা করে বলল, ওই রূপ কি ঘোমটায় ঢাকা পড়ে, মেমসাহিব?

বুঝলাম এর সঙ্গে দরকারি কথাগুলো সরাসরি বলা দরকার। মা’র কাছে শুনেছি ওর বান্ধবী আর ইউসুফদের নিকট আত্মীয়া রানি পাসলি বলেছেন, ইউসুফ নাকি মদ ছোঁয় না। তাই ভনিতা ছেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি সত্যি যে তুমি নাকি মদ ছেড়ে দিয়েছ?

ও ফের ওর কথার চালটাই ধরল, ছেড়েছি? ধরলামটা কবে?

– সেটা তুমিই বলবে।

– দ্যাখো, তোমার মতো চাঁদ আমার পাশে, আমার নেশা। আমার আরো নেশার দরকার কী?

আমি ফের ওকে পথে আনার চেষ্টা করলাম, আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু নেশার সম্পর্ক না।

ও বলল, চাঁদ আর সুরজের সম্পর্ক আকর্ষণের সম্পর্ক, নেশার সম্পর্ক না। অথচ চিরকালের, অনমত্মকালের সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্ক সেটাই। ব্যস।

ও ‘ব্যস’ বলে সব চোকাবার চেষ্টা করল ঠিকই, কিন্তু ওখানেই ব্যস হলো না। কদিন বাদেই আমাদের বাড়ির সান্ধ্য আসরের পর ও আমার বোজারের সতীর্থদের সঙ্গে মদ খেতে বেরিয়ে যা খেল তাতে এই ফরাসিগুলোই তাজ্জব। পাব ক্রলিং বলতে যা বোঝায় তাই করে গেল, এক কাফে থেকে আরেক কাফে, মদের ওপর মদ চড়িয়ে। সেও অবজ্ঞা করতে পারতাম, এর পরেও ওর যে চরিত্র আমার দেখতে হলো।

ইন্দুর সঙ্গে গ্রীষ্মের ছুটিতে হাঙ্গেরির সেবেগেনিতে বেড়াতে গেছি। ইউসুফ লিখল যে ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বুদাপেসেত্ম। আমি লিখলাম, তোমাকে আসতে বারণ করতে পারছি না। তবে তোমার সঙ্গে বিয়েটা করতে পারব না।

ও চিঠি লিখে জানতে চাইল – কেন?

আমি লিখলাম – তুমিও মদ ছাড়বে না, ফলে আমিও তোমায় বিয়ে করছি না।

ও লিখল – আমি রোজ পান কমাচ্ছি, খুব শিগগির আর খাবই না।

লিখলাম – দেখি।

লিখল – আসছি।  r (চলবে)