পদ্মা নদীর পার : রবীন্দ্রজীবন ও সাহিত্যের অনবদ্য বাঁক

স্বাগতা গুপ্ত
রবীন্দ্র-সাহিত্য পাঠকের কাছে শিলাইদহ-শাজাদপুর বা পতিসর কেবল তিনটি স্থানের নাম নয়, তা তাঁদের কাছে প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশি কাছের  করে  পাওয়ার ও জানার নাম। বস্তুত রবীন্দ্রভুবনে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত এই তিনটি স্থান দখল করে রেখেছে রবীন্দ্রজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁককে। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেন ‘জোড়াসাঁকোতে জন্মলাভ হলেও রবীন্দ্রনাথ যথার্থ ভূমিষ্ঠ হলেন শিলাইদহে এসে।’১ শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরে এসে সঞ্চিত হয় কবিজীবনের অসামান্য উপার্জন। আর এই উপার্জন কবি রবীন্দ্রনাথকে, গল্পকার রবীন্দ্রনাথকে, চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথকে, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথকে, সর্বোপরি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে উদ্ভাসিত করল।
১২৮২ সনের ২১ অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শিলাইদহের উদ্দেশে প্রথমবার যাত্রা বালক রবির। এ সময়ে কতদিন তিনি শিলাইদহে ছিলেন তার সঠিক দিনকালের হিসাব পাওয়া যায় না, তবে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল নানা নথি দেখে অনুমান করেছেন ‘এ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ খুব বেশিদিন শিলাইদহে ছিলেন না…।’২ রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার শিলাইদহের উদ্দেশে যাত্রা করেন ৫ই ফাল্গুন ১২৮২ সনে, ইংরেজি ১৬ই ফেব্র“য়ারি ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছিলেন দাদা  জ্যোতিরিন্দ্রনাথের  আহ্বানে এবং এখানে একমাসের থেকে কিছুটা বেশি সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। প্রথমবার যখন তিনি এসেছিলেন তখন শিলাইদহের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে ওঠার জন্য যে সময়টুকুর প্রয়োজন ছিল, তা পাননি রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু দ্বিতীয়বারের শিলাইদহ ভ্রমণে তিনি সে-সুযোগ পান। ছেলেবেলা গ্রন্থে তিনি লিখছেন, ‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোট একটি কোণের ঘর, যত বড়ো ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি।…. বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই।’৩ তবে বলা বাহুল্য, শিলাইদহের উত্তরে প্রবাহিত পদ্মা বা পশ্চিমে প্রবাহিত গড়াই নদী বা শিলাইদহের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পনেরো বছরেরও কমবয়সী রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, তিনি হয়তো তাকে অনুভবও করেছিলেন কিন্তু সেই প্রকৃতির মধ্যেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের বয়স তখনো তাঁর হয়নি।
তৃতীয়বার রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে আসেন তখন তিনি আটাশ বছরের যুবক। ১২৯৬ সনের ১১ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর রবীন্দ্রনাথের এই যাত্রা শুরু হয়। পতœী মৃণালিনী দেবী, পতœীসখি অমলা দাশ, কন্যা বেলা, পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং ভ্রাতৃষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ সঙ্গী হন রবীন্দ্রনাথের। না, কেবল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাঁর এইবার শিলাইদহে আসা নয়, ঠাকুরবাড়ির উত্তরবঙ্গে যে বিস্তৃত জমিদারি তা পরিদর্শনের ভার পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর।
এই হলো শুরু। এরপর পদ্মার উর্বর ভূমিখণ্ডে একে-একে ফলেছে রবীন্দ্রসৃষ্ট ফসল। রবীন্দ্রজীবনের এই উর্বর বাঁকে পদ্মার দান অতুলনীয়। প্রমথনাথ বিশী শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে বলেন, ‘পদ্মাকে যে দেখেনি বাংলাদেশকে দেখেনি সে, পদ্মাকে যে জানে না বাংলাদেশকে জানে না সে, পদ্মাকে যে বোঝেনি, বাংলাদেশকে বোঝেনি সে; যা কিছু দেখা জানা বোঝা সমস্ত সংহত এই নদীটির মধ্যে।’৪ আর বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ পদ্মাকে দেখেছিলেন, বাংলাদেশকে বুঝেছিলেন আর তাঁর সেই দেখা আর বোঝা বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রবাহে যোগ করেছে কিছু অমর সৃষ্টি। বাংলাদেশের এই পর্বটিকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমানস ও সাহিত্যমানসকে বোঝা যায় না, অসম্পূর্ণ রয়ে যায় রবীন্দ্রনাথকে জানা।
কলকাতার অট্টালিকার ভিড়ে, পারিবারিক আভিজাত্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাককে-থাকতে কবির দেখা হয়নি বাংলার প্রকৃতিকে আর মেশা হয়নি বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে। জমিদারির দায়িত্ব কবিকে পরিচিত করালো অসীম সবুজ আদিগন্ত প্রান্তরের সঙ্গে, খোলা আকাশের সঙ্গে, সদা আপন গতিতে প্রবাহিত নদ-নদীর সঙ্গে আর ছোট-ছোট সুখ-দুঃখ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকা বাংলার মানুষের সঙ্গে। পদ্মাতীরে বসে কবি তাঁর অন্তর্নিহিত কবিধর্মকে যেমন আবিষ্কার করলেন, তেমনি পদ্মার কলধ্বনিতে শুনলেন বাংলার জনজীবনের কোলাহল।
জমিদারির প্রয়োজনে বা প্রাণের টানে বারে-বারে রবীন্দ্রনাথ গেছেন শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরে। পদ্মার পাশাপাশি তাঁর পরিচয় হয়েছে আত্রাই, গড়াই প্রভৃতি নদীর সঙ্গে। এই তিন জায়গার প্রকৃতি ও মানুষ রবীন্দ্রনাথকে ঋদ্ধ করেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ শুধু গ্রহণই করেছেন এমনটা নয়, ফিরিয়েও দিয়েছেন তাঁর যথাসাধ্য। পদ্মাতীরে বসবাসকালে রবীন্দ্র-কর্মপ্রবাহকে তিনটি স্রোতের মিলন হিসেবে দেখা যেতে পারে –
প্রথমত : সাধারণ দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক প্রয়াস।
দ্বিতীয় : রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহের কাজ।
তৃতীয়ত : রবীন্দ্রনাথের নিজের সৃষ্টিক্ষেত্র।
প্রথম চৌধুরী তাঁর রায়তের কথা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসাবে মহাজনের কবল থেকে প্রজাকে রক্ষা করবার জন্য আজীবন কী করে এসেছেন তা আমি সম্পূর্ণ জানি – কেননা তাঁর জমিদারি সেরেস্তায় আমিও কিছুদিন আমলাগিরি করেছি। আর আমাদের একটা বড় কর্তব্য ছিল, সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচানো। কিন্তু সেই সঙ্গে এও আমি বেশ জানি যে, বাংলার জমিদার মানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন। রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে ও যেমন জমিদার হিসেবেও তেমনি  unique|’৫
প্রজাদের আত্মশক্তিতে জাগাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দেশের মাটিকে ভূমিলক্ষ্মী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। শিলাইদহ ও পতিসরে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করেছিলেন। আশি বিঘা জমির ওপর শিলাইদহে কৃষিক্ষেত্র স্থাপিত হয়েছিল।  কৃষকদের কথা ভেবে এবং কৃষির উন্নতির জন্য ট্রাক্টর, পাম্পসেট, সারের ব্যবস্থা করেছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ, অধিক ফলনের আশায় স্থাপন করেছিলেন কৃষি ল্যাবরেটরি। প্রজাদরদি জমিদার রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় কালীগ্রামের নায়েব শৈলেশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা তাঁর একটি পত্রে, ‘কালিগ্রামের অবস্থা [শুনিয়া] চিন্তিত হইলাম। প্রজাগণ [যাহাতে অতিষ্ঠ] হইয়া না উঠে তৎপ্রতি দৃষ্টি [রাখিয়া আদায়] করিবে।’৬
সুদখোর মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচানোর জন্য পতিসরে সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। বন্ধুদের থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংক তিনি স্থাপনে উদ্যোগী হন, পরে নিজের নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থ থেকে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা এই ব্যাংকে দেন। গ্রামের রাস্তাঘাট মেরামত, পানীয় জলের ব্যবস্থা করে রবীন্দ্রনাথ প্রজাস্বার্থের দিকটি দেখেন। কুটিরশিল্প ও বয়নশিল্পেও উন্নয়নের দিকে রবীন্দ্রনাথ নজর দিয়েছিলেন।  শৈলেশচন্দ্র মজুমদারকে ৮ই ফাল্গুন ১৩০৫ সালে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমরা [এখানে] গুটি পোকা চাষের পরীক্ষা করে দেখলুম বিশেষ লাভজনক। তোমাদের ওখানে চালাতে পারলে প্রজাদের বিশেষ উপকার হয়। খুব সহজ এবং খরচ প্রায় নেই বল্লেই হয়।’৭ বোঝা যায়, প্রজাদের স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখাতে রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক প্রচেষ্টা।
প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ এবং সেই সঙ্গে ছাত্রাবাস গঠন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিস্তারের প্রয়াস। শিলাইদহে তিনি স্থাপন করেন ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র’। এই চিকিৎসাকেন্দ্রে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি – তিন পদ্ধতিতেই চিকিৎসা হতো। পতিসরে একটি বড় হাসপাতালও গড়েন তিনি। জমিদার রবীন্দ্রনাথ নিজের জমিদারির পরিসরে প্রজাসাধারণকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য।
রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের দ্বিতীয় স্রোতপ্রবাহটি হলো সংগ্রহের কাজ। পল্লিপ্রকৃতির আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে থাকে সংগীত-সাহিত্য। এই পর্বেই রবীন্দ্রনাথ সেগুলোর সাক্ষাৎ পান। পল্লীমানবের মুখে-মুখে সে-সাহিত্য-সংগীতের জন্ম, তার লিখিত কোনো নিদর্শন রাখা হতো না। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়িয়ে বেঁচে থাকত তা, কিন্তু পল্লিবাংলার সেই সুর, সেই সংগীত, সেই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথই প্রথম সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম এই সম্পদ ধরে রাখতে চান খাতায়-কলমে। ছেলে-ভুলানো ছড়া, মেয়েলি ছড়া, গ্রাম্য গান, শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণবের গান সংগ্রহে প্রবৃত্ত হন রবীন্দ্রনাথ। ১৩০০ বঙ্গাব্দের শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছড়া সংগ্রহের কাজে হাত দেন। বিভিন্ন সূত্রে ছড়া সংগ্রহ করে তিনি ২০শে ভাদ্র ১৩০১-এ একটি প্রবন্ধ রচনায় হাত দেন। ইন্দিরা দেবীকে এ-সম্বন্ধে বলেন, ‘আজ সকালে বসে ‘ছড়া’ সম্বন্ধে একটা লেখা লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম – সেটার ভিতরে বেশ সম্পূর্ণ নিমগ্ন হতে পেরেছিলুম, বড়ো ভাল লাগছিল।’৮ ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যসভায় পাঠ করেন এবং তা প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গে পল্লীর নিভৃত কোণে লুকিয়ে থাকা সাহিত্য সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা শুরু  হয়। লোকসাহিত্যের নানা উপাদান সংগ্রহের পেছনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-ভাষা-সমাজসচেতন ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়।
শিলাইদহ-পর্বে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় স্রষ্টার ভূমিকায়। নতুন সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলায় তিনি ভরিয়ে তুলেছেন তাঁর সৃষ্টির ভুবন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘…বাবার গদ্য ও পদ্য দুরকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি। এই সময় তিনি অনর্গল কবিতা প্রবন্ধ ও গল্প লিখে গেছেন – একদিনের জন্যও কলম বন্ধ হয়নি। শিলাইদহের যে রূপবৈচিত্র্য, তার মধ্যে পেয়েছিলেন তিনি লেখার অনুকূল পরিবেশ।’৯ রবীন্দ্রজীবনের স্বর্ণফসল ফলেছে শিলাইদহ-পর্বে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ – এই বছরগুলোতে প্রকৃতি ও মানুষকে কাছ থেকে দেখছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং তা হচ্ছে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির রসদ। ছিন্নপত্রের পাতায়-পাতায় একদিকে যেমন রয়েছে নদীকেন্দ্রিক প্রকৃতির শোভা, তেমনি তারই মধ্যে সৃষ্টির নানা উপকরণ। প্রমথনাথ বিশী ছিন্নপত্রকে পদ্মার মহাকাব্য বলে অভিহিত করেছেন। কবিমনে পদ্মা ধীরে-ধীরে বাস্তব প্রকৃতিকে ম্লান করে মানস প্রকৃতির ভাব গ্রহণ করেছে। সে পরিণত হয়েছে এক মানবীয় সত্তায়, ভরা বর্ষায় দুকূলপ্লাবিনী পদ্মার কাছে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছেন জীবনের আশ্বাস। এগিয়ে চলার মন্ত্র।
সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালীর মতো কাব্য গড়ে উঠছে এ-সময়। চিত্রাঙ্গদা, বিদায়-অভিশাপ লিখিত হওয়ার সময়ও এটি। গড়ে উঠেছে অজস্র গান। ‘দাঁড়াও, মন, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড-মাঝে’, ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে’, ‘বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে’ প্রভৃতি গানের উদ্ভবই হয়তো হতো না, যদি-না রবীন্দ্রনাথ বিশাল উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে গিয়ে একা দাঁড়ানোর সুযোগ পেতেন।
ছোট-ছোট দুঃখ-ব্যথা নিয়ে গড়ে উঠছে তাঁর ছোটগল্প। শুধু রবীন্দ্রসাহিত্য নয়, বাংলা সাহিত্যেও যে-প্রকরণটির পথচলা শুরু হচ্ছে এখান থেকেই। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক, ‘সুভা’ গল্পের সুভা বা ‘সমাপ্তি’ গল্পের ‘মৃন্ময়ী’র কি জন্ম হতো রবীন্দ্রনাথ যদি শিলাইদহ, শাজাদপুর বা পতিসরের সাধারণ মানুষের জীবনকাব্য না পড়তেন? আর ‘অতিথি’ গল্পের  তারাপদের  মতো চরিত্র-সৃষ্টির পেছনে বোধহয় কাজ করে যায় নদীর প্রবহমানতার মন্ত্র। কখনো কোথাও তাকে বেধে রাখা যায় না। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ বা  ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র মতো গল্পের সৃষ্টিও তো হয় পদ্মার পারেই। ‘দেনাপাওনা’, ‘শাস্তি’, ‘স্বর্ণমৃগ’ গল্পের সৃষ্টির পেছনে রয়ে যায় পদ্মাপারের জনজীবন।
পদ্মা হয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটা দর্শন। ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’ এই জীবনদর্শনে বিশ্বাসী হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবন নদীপ্রবাহের মতো, তা এক অভিজ্ঞতা থেকে অন্য অভিজ্ঞতায় স্থানান্তরিত করবেই। কোথাও থেমে গেলে তা জীবনধর্মকে বিঘিœত করো, বদ্ধতা জীবনধর্মের বিরোধী।
বলাকা কাব্যে যে-গতিবাদের সন্ধান পাওয়া যায়, তা নদীতে ভাসারই ফল। রবীন্দ্রজীবনে এটাই পদ্মার দান। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ পর্বে এসে জানছেন প্রকৃতিকে, মানুষকে, দেশকে। তাই গোরা উপন্যাসে গোরাও প্রকৃত দেশের সন্ধান পায় চরঘোষপুরে। গ্রামে গিয়ে পরিশ্রমী মানুষের সংস্পর্শে এলেই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যায়, এ-পাঠও তো রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন পদ্মা-তীরবর্তী অঞ্চলেই।
শিলাইদহে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য প্রবল প্রেরণা দেয় চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথকেও। সেসব ছবির বেশির ভাগই পাওয়া যায়নি। বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে তাঁর এই পর্বের ছবি আঁকার কিছু বর্ণনা দেন, তা থেকে অনুমান করা যেতেই পারে সে-পর্বের চিত্রের মূল উৎস নিজের মনের তাগিদ। যে-কটি চিত্র পাওয়া গেছে তাতে বলা বাহুল্য নিসর্গ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। পরবর্তীকালে যখনই রবীন্দ্রনাথ হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি, তখনই অধিকাংশ সময়ে এসেছে প্রকৃতির দৃশ্য এবং তা শিলাইদহের স্মৃতিকেই বহন করছে, তা স্পষ্ট।  তবে শিলাইদহ-পর্ব মানে তো শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষও। তাই রবীন্দ্রচিত্রে শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা স্থান করে নিয়েছে। তাদের মুখাবয়বের মিল পাওয়া যায় পদ্মা-তীরবর্তী জনতার ভিড়ে।
‘বাংলাদেশের গ্রাম আমি দেখিনি, এটা সত্য নয় – বাংলাদেশের গ্রাম অতি গভীর করে দেখেছি, দেখেছি তার আনন্দ, তার বেদনা।’১০ শিলাইদহ-পর্বের রবীন্দ্রনাথকে জানলে রবীন্দ্রনাথের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিতেই হয়। জীবনযুদ্ধেরত মানুষেরা, রবীন্দ্রজীবন ও সাহিত্যকে পরিবর্তনের স্রোতে ভাসায়। আর এই পরিবর্তিত জীবন বোধই এক অন্য রবীন্দ্রনাথের জন্ম দেয়, সে-জীবনবোধ রবীন্দ্রনাথকে জীবনের শেষ পর্যন্ত চালিত করেছে।

উল্লেখপঞ্জি
১.     ‘শিলাইদহ পর্ব ও চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৩৯৫, পৃ ২৭৫।
২.     রবি জীবনী (প্রথম  খণ্ড), প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, পৌষ ১৪০০ (প্রথম সংস্করণ ১ বৈশাখ ১৩৮৯),                পৃ ২১৩।
৩.     ‘ছেলেবেলা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড), পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৩৯৬, পৃ ১১৩।
৪.     শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ বিশী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭২।
৫.     রায়তের কথা, প্রমথ চৌধুরী।
৬.     প্রতিক্ষণ, শারদীয় ১৩৯৩, পৃ ২৮ [পত্রের জীর্ণতার জন্য বন্ধনীর মধ্যস্থিত শব্দগুলি সম্পাদক সুমিত মজুমদারের অনুমিত]। [প্রবন্ধে উদ্ধৃতিটি প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী (চতুর্থ খণ্ড) থেকে পুনরুদ্ধৃত]
৭.    দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮৭, পৃ ২৮।
৮.     ছিন্নপত্রাবলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পত্রসংখ্যা ১৪৯, পৃ ৩২২-২৩।
৯.     পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৬৬।
১০. মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, প্রাইমা পাবলিকেশনস্, কলকাতা, ১৯৪৩, পৃ ১৬৭।