পরিচিত বিষয়, নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি

ওমর শামস
পিলখানা ও অন্যান্য দীর্ঘশ্বাস
মারুফ রায়হান
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
ঢাকা, ২০১০
১২০ টাকা

বাংলাদেশের ষাটের এবং তার পরবর্তী কবিতা সম্মন্ধে  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি কঠোর মন্তব্য আছে, আমার মনে হয় না যার সম্মন্ধে একালের কবি ও কবিযশোপ্রার্থীরা খুব পরিচিত। তিনি মন্তব্যটি করেছিলেন বুলবুল চৌধুরী সম্পর্কিত একটি নিবন্ধে যা তাঁর সংস্কৃতির ভাঙা সেতু প্রবন্ধ সংগ্রহের অন্তর্গত। উদ্ধৃত করি : ‘আমাদের কবিতার একটি মান তৈরি হয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকাল মোটামুটি পাঠযোগ্য কবিতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ছন্দ, শব্দ, বাক্য, প্রতীক, উপমা, রূপক প্রভৃতি এমনভাবে তৈরি আছে যে কলমের একটু ব্যায়াম করতে পারলে একটা কবিতা মোটামুটি দাঁড় করানো চলে। প্রেম ভালোবাসা এমনকি প্রতিবাদের ভাষা পর্যন্ত প্রস্ত্তত। কেউ যদি এসবের মধ্যে নিজেকে ফিট করিয়ে নিতে পারেন তা ভাবনার কিছু নেই, কবিতা আপনি-আপনি বেরিয়ে আসে। ফলে বাংলা কবিতা এখন শিল্পের আনন্দ ও কম্পন, বেদনা ও ভার, সংশয় ও সংকল্প থেকে বঞ্চিত।’
ইলিয়াসের এই বক্তব্য এখনও সঙ্গত কিনা এই বিচার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম। তবে কবিতা লেখা, কবিতা পড়া- বিশেষ করে একালের কবিতা-, এবং নিতান্তই ভাবা, এইসব প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্ধৃত বক্তব্য অন্তত আমার মনে একটা পারস্পেকটিভের মতো সেঁটে থাকে। এই প্রেক্ষিত ও পশ্চাৎপটে ২০১১ সনের প্রথমদিকে আমার হাতে ‘পিলখানা ও অন্যান্য দীর্ঘশ্বাস’ কবিতাগ্রন্থটি এলো; কবি মারুফ রায়হান।  তাঁর কবিতার সঙ্গে এর আগে আমার পরিচয় হয়নি, যদিও মারুফের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘স্বপ্নভস্মের চারুকর্ম’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯২ সনে এবং এপর্যন্ত তাঁর মোট ১৩টি কাব্যগ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে। এই গাফেলতির দায়িত্ব অবশ্য আমার নিজের।
প্রথমেই ‘মুদ্রা অন্বেষণ’, মাত্র ১০ লাইনের একটি কবিতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি। গোধূলিবেলায় বৈষয়িকভাবে সফল দীর্ঘদেহী এক পুরুষকে ঘিরে বন্ধুদের বিস্ময় এবং আড্ডা। ‘বুদ্ধির সুতোয় গাঁথা বরমাল্যে আর সৌভাগ্যের জামা গায়ে ক’জন পৌঁছে যেতে পারে’ ‘অলৌকিক টাঁকশাল’ এবং ‘মুদ্রা-মদিরায়’? এই হচ্ছে কবিতার প্রাথমিক আবহ। উপস্থাপনার একটু পরেই সফলতার গৌরব স্বীকার করেও মারুফ তাঁর নিজস্ব অন্তর্দীপ্তি খুঁজে পান কথিত জাগতিক সৌরকরোজ্জ্বল সাফল্যের বিপ্রতীপে :

আমার রয়েছে এক ভিন্নতর মুদ্রা-অন্বেষণ
নিসর্গের উদারা-মুদারা-তারা
নক্ষত্রের সংরক্ত সংকেত
নদীর যৌবন-রেখা
কবিতার আশ্চর্য ধ্বনি ও মাত্রা
নাচের নীলাভ ছন্দ

নিসর্গের ‘উদারা মুদারা তারা’, ‘নদীর যৌবনরেখা’, ‘কবিতার আশ্চর্য ধ্বনি ও মাত্রা’ উল্লেখ করে মারুফ স্পষ্ট কিন্তু প্রতীকে তাঁর নিজস্ব অভিলাষিত মুদ্রা কী, তা জানিয়ে দেন। এই আত্মবিশ্বাস জেনে নিয়েই আমি ‘পিলখানা ও অন্যান্য দীর্ঘশ্বাস’  গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়েছি। দেশ ও স্বজন, সাম্প্রতিক ঘটনা, ভালোবাসা, শিল্প সম্মন্ধে প্রতিক্রিয়া- এগুলোই মারুফের কবিতার বিষয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় সব কবির বিষয় মোটামুটি একইরকম, তবে পরিচিত বিষয়কে কী অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে, কী শৈলীতে কবি পেশ করেন সেখানেই তাঁর নিজস্ব মুদ্রা পাওয়া যাবে। এই কবিতাগুলোর মধ্যে দেশ-প্রীতি, দেশকে নিয়ে সংশয়-ভীতি, মমতা, ভালোবাসা এটাই প্রধান থীম। পিলখানা সংক্রান্ত শোক-বেদনা-রাগ-ক্ষোভ-হতাশা বাদ দিয়েও একটি তালিকা প্রস্ত্তত করা যাক যেখানে দেশ সম্মন্ধে এক স্তম্ভে ইতিবাচক উদ্দীপনার, ভালোবাসার, অন্য স্তম্ভে নেতি-বেদনা-আশঙ্কা-হতাশার ছবি রয়েছে। কবিতার শিরোনাম:

উদ্দীপনা সংশয়

১. তেজগাঁও সতেজগাঁও ১. নববর্ষে নব বর সে
২. বাঙালি থাকিসনে আর কাঙাল ২. কবিকে আর কত অভিজ্ঞতা দেবে
৩. মুক্তিযুদ্ধের কবি       ৩. পথ পথভ্রষ্ট
৪. নতুন বৈশাখ আনো   ৪. যুদ্ধোত্তর নবীন প্রজন্মের প্রতি
৫. নবান্ন উৎসব খুঁজি     ৫. ক্ষমা নাই

একটি কবিতা, তেজগাঁও সতেজগাঁও, বাংলাদেশের শ্রমশীল স্বনির্ভরতাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগী সেলাই কারখানার মেয়েদের প্রশংসায় লেখা। এই কবিতায় অন্তত মারুফ জীবনের জয়, উদ্দীপনা, সাহসের কথা তুলে এনেছেন সাম্প্রতিক জীবনের অন্যান্য সহস্র সংশয় বাঁচিয়ে। বাঙালিসমাজ বিবর্তনের অন্তত একটি ইতিবাচক দলিল এই ছোট্ট কবিতায় মমতার কালিতে লেখা আছে।
বাস্তবিক জীবনের ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে থেকে মানুষকে চিনিয়ে দেবার মতো এবং সামান্য ক্ষুদ্র ঘটনাকে প্রমূর্ত করবার মতো ক্ষমতার একটি কবিতা ‘একাকী সবুজ’। সান্দ্র উপস্থাপন, মনোস্তত্ত্বের একটু বিদ্যুচ্ছটা এবং শেষ দু’লাইনে সাহসের সবুজ ঝলকানি:
তিনটি বিষাক্ত প্রাণী ত্রাণকর্তা সর্দারসমেত
সারাক্ষণ গুপ্ত গর্তে করে শলা- সৃজনশীলের
পথে পথে কীভাবে বিছোবে কাঁটা তার নক্সা অাঁকে
লুকোনো কলুষ বুকে- মধু ঝরে অধরের ফাঁকে,
হাসিও মধুর বটে, যেন সুসন্তান সুশীলের!
লুসিফারপুত্র তবু, দ্বেষ-ভর্তি প্রেতাত্মা, সমেদ-
পথচ্যুত হলো কতো শুভবোধ, সুন্দরেরা ধ্বংস
উদিত নক্ষত্র হলো ভস্ম, স্বচ্ছ নদীরা নির্বংশ।
তারা কি শঙ্কিত নয় এইবার? একবার অন্ততো?
এ-প্রথম- কী আশ্চর্য আচানক- পাপবোধে নত!
সর্বদা বিজয়ী সত্য, আর ষড়যন্ত্র সাময়িক
প্রকৃত মানব জানে গভীরে সততা অমায়িক
দাঁড়ালাম এসে ঋজু- মুখোমুখি বিষাক্ত ত্রিভূজ
ওপাশে সহস্র কালো- প্রতিপক্ষ একাকী সবুজ।

এই বইয়ের আমার একটি প্রিয় কবিতা ‘চা-বাগানে শ্রাবণের গানে’, যেখানে প্রকৃতির একটি আদিম ও অকৃত্রিম চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের বৃক্ষ, বৃষ্টি, চা-পাতা, জোঁক, বাঘ, হরিণের সমাগমে। এ অাঁরি রুশোর সেই চিত্রকর্মের মতো, যেখানে পাতা, বন, পশুর সমারোহে এক নারী আদিম কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, শুদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে। কবিতাটি চা-বাগান এবং তার আশেপাশের বন-জঙ্গলে বৃষ্টির বর্ণনা- ‘নক্ষত্রকে সাক্ষী করে’, ‘রাতভর পুণ্যার্থী জঙ্গলে’, ‘শ্রাবণ-বৃষ্টির গানে’, ‘কদম স্মিত সিক্ত’ কিছু মানুষ এখনো তেমন শুদ্ধতার সংগ্রহী নয় :
এইখানে বৃষ্টির কী মানে আছে?
এখন সাপিনী কি ভুলেছে তার প্রেমিকের যৌনতার টান
লাল মাকড়সা সাজে নি কি ডিমের ডম্বরু?
সাঁওতাল নারীর টুকরিতে টুকরো-টুকরো চা-পাতার
চাওয়া আজও রাজসিক বাংলোর ছাদে টিনের বৃষ্টির তান
বর্ষণ-বিস্মিত বাদুরের বীভৎস্য পাখার ওড়াউড়ি
রক্ত খুঁজে ফেরা জোঁকেদের নীরব উল্লাস
……………………………..

শ্রাবণ-বৃষ্টির গানে আছে শিহরণ-জাগা অবোধ্য শব্দের ধারাপাত
বিশেষত বর্ষায় বাগানে বাঘিনীকে বাগে পায়
অলৌকিক হরিণের হাহাকার!
শেষ দু’লাইনের স্পষ্ট মানে আমরা পাইনে, কিন্তু এক ধরনের অনাদি নিসর্গকে পেয়েও না পাওয়ার এক ধরনের হাহাকার ঠিকই অনুরণিত হয়ে ওঠে। এইখানে মারুফের চিত্র, বর্ণনা, শ্রুতি, বোধ সব নিজস্ব এবং বাঙ্ময়।
পিলখানা সংক্রান্ত ৯টি কবিতার বিষয় ও দীর্ঘশ্বাস বইটির এবং কবিতাগুলোর নামকরণেই সশব্দ।
পিলখানা নিয়ে একটা কবিতা লিখছি সেই ফাল্গুন থেকে
ফাল্গুন মানে তবে বারবার অবাক আগুন?
রক্তরঞ্জিত প্রজাপতি গুনগুন…!

আমার কবিতাটা শেষ হয় না হয় না
একেকটা লাইন যোগ করেই চলেছে সে একেকটা দীর্ঘশ্বাস…
যেহতু বিষয় এবং ঘটনা একেবারে সাম্প্রতিক এবং আমাদের ইমোশন সম্পৃক্ত, সেইজন্য এসব কবিতার বিচার সময়সাপেক্ষ।
পিলখানা বিষয়ক কবিতাগুলোর মতো শোকে-হতাশায় বিহবল, প্রায় রাগী হয়েও বইয়ের প্রথম কবিতাটি আসলে একই বিষয়ের। তির্যকভাবে একটু ব্যাঙ্গাত্মক বলে বেশি আকর্ষণীয়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের হতাশা ও নৈরাজ্যে যাদের যুদ্ধে যাবার কথা তাদের পতনের এমন নির্মম নিরাবরণ- কবিতা মেনেও- খুব সুলভ নয়। কবিতাটি সার্থক সনেট :
মিহি আশা মাখানো বাতাসা বিলি হচ্ছে পথে পথে
বাতাসে বাতাসে রটে গেছে তার মিথ্যের মৈথুন
দাম্ভিক দাগীর দল নিরঙ্কুশ বিচিত্র বেলুন
ফাঁপা বুলি ফাঁকা মাথা দিকে দিকে পাতক-পতাকা
ভূপাতিত হওয়ার নিয়তি মনে পড়ে না ভুলেও
দেখে না আপন মুখ একবারও মুখোশ খুলেও
নেপথ্যে আছে কি অস্ত্র- বস্ত্রহীন বীভৎস্য, বলুন?
সুন্দর ভেবেছে সমীচীন নির্জন নীরব থাকা!

কবিতার জন্য কবিতা, এই মতবাদের বিপ্রতীপে মারুফ বরং উৎকণ্ঠিত : কবি কেন ধরতে পারছে না সমাজের স্পন্দন, কেন এগোতে পারছে না বন্ধুর সড়কে (‘কবি ও মানব প্রকৃতি’); আর কত দুঃখ পেতে হবে কবিকে (‘কবিকে আর কত অভিজ্ঞতা দেবে’); এমনকি কবিতা নিজেই, ‘ফালগুনের কবিতা লিখতে চেয়েছিল জখমি যমুনার জল, মঙ্গা-ঝলসিত পোড়োজমি, গুলিবিদ্ধ পাহাড়ী ঝর্ণা’ (ফাল্গুনের কবিতা পড়তে চেয়েছিল’)। অবশেষে কবি নিজেই বলে ওঠেন, ‘চৈত্ররাত্রিশেষে ফিরবে না বাংলার বৈশাখ-বৈভব’ ( ‘চৈত্ররাত্রি’); ‘বাঙালি থাকিস নে আর কাঙাল’ (বাঙালি থাকিস নে আর কাঙাল’)।
এই কবিতাগুলোর শৈলী ও প্রকরণের দিক থেকে নিম্নলিখিত চিহ্ন এবং চারিত্র্য আমার চোখে-কানে পড়েছে।  :
ছন্দে, শ্রুতিবোধে মারুফ রায়হান সিদ্ধ। অনুপ্রাসের বহু কুশলী ব্যবহার বিভিন্ন কবিতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর মনের টান অক্ষরবৃত্তে, কিন্তু গদ্যকবিতায়ও হাত পাকা।
এই বইয়ে অন্তত বেশির ভাগ কবিতা লিরিক। সনেটে মারুফ কুশলী। বইয়ের ৬৪টি কবিতার মধ্যে ১৩টি সনেট।

নমনীয়তার সঙ্গে কাঠিন্য মেশাতে মারুফ পারঙ্গম।
এটুকু বলতে হবে যে, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ মারুফের অনেক আগেই ঘটেছে। শুধু আমার মনে হয়েছে যে, (১) কবিতার বিষয়কে আরো বহুবিধ করলে- বাংলাদেশের এতদিনের সিদ্ধ প্রথাকে ডিঙোতে পারলে- এবং (২) গদ্য কবিতায় আরো হাত দিলে মারুফ তাঁর স্বাত্র্যকে আরো শানিয়ে তুলবেন।