পশুপাখির অভিব্যক্তিতে রচিত ক্যানভাস

বসন্ত রায়চৌধুরী

 

তমালের শিল্পকর্মের বিষয় বাস্তবধর্মী। কোনো কোনো ছবিতে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন বিষয়। প্রদর্শনীর মোট কাজের সংখ্যা ৫৫টি। প্রতিটি কাজের বৈশিষ্ট্য ও মাধ্যম আলাদা। কাজগুলো রিলিফ প্রসেস, অ্যাকুয়াটিন্ট, কাঠখোদাই মাধ্যমে করা। তমাল দর্শকদের সামনে যখন থেকে কাজ নিয়ে হাজির হয়েছেন তখনই তাঁর ছবির বিষয়গুলো আলাদাভাবে নির্ণীত হয়ে আছে। তমালের ছবি আঁকার প্রিয় বিষয় পক্ষেকুল, প্রাণিকুল। প্রাণীদের অভিব্যক্তি মানুষের অভিব্যক্তির চেয়ে আলাদা থাকে। একেক প্রাণীর একেক রকম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তমাল বেছে নেন নির্দিষ্ট কিছু পাখি ও পশু, যেমন – ছাগল, বিড়াল, কুকুর, কাক, মোরগ। এসব পাখি ও পশুর ভঙ্গিতে একরকম মায়া দেখা যায়। মানুষের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে পশুর একটা যোগসূত্র খুঁজে বেড়ান, সে-অভিব্যক্তি ক্যানভাসে দেখান একেবারে বাস্তবধর্মী ঢংয়ে। তমালের চিত্রতল ব্যবস্থাপনায় একধরনের শৃঙ্খলা দেখা যায়। তাঁর আঁকা একদল ছাগলের সারিবদ্ধ চলাচল দেখে মনে হয়, মানুষের দলগত চলাচলের যে-বিধি তমালের পশুকুল তা মেনে চলছে। চিত্র রচনার ব্যাকরণ মেনে তমাল তাঁর ক্যানভাসে নন্দন রচনায় মনোযোগী হয়েছেন। পাঠক, তমালের ছবির বিষয় নিয়ে আমরা এভাবে আলোচনা করতে পারি – তাঁর ছবির উলেস্নখযোগ্য অংশের বিষয় ‘কাক’। অন্যান্য পাখির চেয়ে কাকের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন – কাকের চাহনি কৌতূহলী, সতর্ক দৃষ্টিতে তারা মানবকুল পর্যবেক্ষণ করে, কাকের বুদ্ধিমত্তা অন্য পাখির চেয়ে ভিন্ন। তমালের ছবির কাকগুলোতেও চঞ্চলতা, নিবিড় মনোযোগে খাবার গ্রহণের মুহূর্ত খুঁজে পাওয়া যায়। কাকের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে গড়া সবচেয়ে বড় চিত্রতলকে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। তমালের ছবির রেখায় শক্তি আছে। ধীরলয়ে ব্যবহৃত রেখার প্রয়োগে একটি গন্তব্যের দিকে যাত্রা করছে কালি ও কলমের কাজগুলোতে। ‘গ্রাজিং গ্রাউন্ড’ সিরিজের কাজে ছবির জমিনের বিশাল অংশ আকাশের জন্য ছেড়ে দিয়ে নিচে ছাগলের পাল আঁকা। কাছে থেকে অনেক দূরে যাওয়ার মুহূর্তকে চিহ্নিত করে ছবির বাস্তবানুগ পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছেন। ‘গ্রাজিং গ্রাউন্ড’ ছবিগুলোতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় – যে-কোনো একটি-দুটি ছাগলের মুখ সাদা রেখে দেওয়া।

তমালের কাজে একদল ছাগলের মধ্যে দু-একটি ছাগলের মুখের শুধু আকৃতি দেখানোকে বিশেষভাবে দৃষ্টিকে আটকে রাখার প্রবণতা তৈরি করেছে। ইতিপূর্বে তমালের একক প্রদর্শনীতে দেখা কাজের রং ছিল সাদাকালো। সারফেস সাদা রেখা ও রং কালো। এই কালো রং-রেখার মাঝে ছবির কোনো একটি অংশকে ছেড়ে দেওয়ায় তমালের কাজ আলাদা রূপ পেয়েছে। তমালের এ-প্রদর্শনীর কাজে দুটি রং ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। রঙের মধ্যে বাছাই করা দুটি রংকে সহজে আলাদা করা যায় – একটি হালকা সবুজ, অন্যটি ফ্যাকাশে কমলা। এ-দুটি রং ভিন্ন ভিন্ন ছবিতে জমিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ছাপচিত্রে বাংলাদেশের অগ্রণী শিল্পী শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম দিককার কাজে সাদাকালো রং ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর ছাপচিত্রে রঙের ব্যবহার শুরু করেন। সে-ধারাবাহিকতায় ছাপচিত্রে তরুণরা অপেক্ষাকৃত বেশিসংখ্যক রঙের ব্যবহারে তাঁদের শিল্পকর্ম গড়ে তুলছেন। এ-প্রদর্শনীতে রাখা কালি ও কলমের আঁকা আরো দুটি কাজের মধ্যে দেখা যায় বিড়ালের চঞ্চলতা। ছবির সামনের অংশে বিড়াল তীক্ষন দৃষ্টিতে অপেক্ষা করে আছে। দূরের উঁচু-নিচু পাহাড়ে একদল  বিড়ালের ছোটাছুটিতে ক্যানভাস ছন্দময় হয়ে আছে। তমালের পশুপাখির পর্যবেক্ষণক্ষমতা প্রখর। একদৃষ্টিতে তমাল পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করে তাদের অভিব্যক্তি ছবিতে প্রকাশ করেছেন, তাতে ছবিগুলো বিশেষ হয়ে ওঠে। ‘ক্যাট ফ্যামিলি’ বা বিড়ালের পরিবার শিরোনামে আড়াআড়ি দুটি শিল্পকর্মে কালো জমিনে সাদা রেখার বিন্যাসে বিড়ালের মুখ ও অভিব্যক্তির সঙ্গে খাঁচার আকৃতি দেখা যায়। এ-দুটি ছবির বিষয়ে বিড়ালের খাঁচা দেখানোকে বন্দিদশা থেকে মুক্তির কথা হিসেবে বলতে চান শিল্পী। প্রাণীর চঞ্চলতা, পাখির অবয়বে একাগ্র দৃষ্টি তমাল খুব মনোযোগের সঙ্গে আত্মস্থ করেন। এই আত্মস্থ অভিব্যক্তি একসময় তাঁর ক্যানভাসে হাজির হয়। প্রদর্শনীর কোনো কোনো কাজের আকৃতি ছোট হলেও উপস্থাপনায় ভিন্ন রীতি অনুসরণ করলে হয়তো দেয়ালে ঝোলানো শিল্পকর্মে বৈচিত্র্য আসত। দৃশ্যশিল্পের উপস্থাপনায় চলতি সময়ে প্রথাগত সারিবদ্ধ প্রদর্শনের ধারণা পালটে গিয়ে তৈরি হতো প্রদর্শনীর নতুন ধারণা। সেটি হয়তো আগামীতে আমরা দেখতে পাব।

রাজধানীর শিল্পাঙ্গনে ৮ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ২৬ ডিসেম্বর। r