পাঁতি

অর্ণব রায়

রতন সকালে এসে গোয়াল ধরার আগে অবধি ব্যাপারটা বোঝা যায় নি।

এমনিতে মেজোকত্তার বরাবরের অভ্যাস ভোর থাকতে উঠেই গোয়ালঘরের দিকটা একবার চক্কর দিয়ে আসা। কিছুই না, নিজে হাতে করে কুটোটিও নাড়েন না তিনি। কিন্তু ওই, ঝুঁঝকো অাঁধার ফর্সা হতে হতে গোবরের গন্ধ আর মশার কামড়ের মধ্যেও গরুগুলোকে একবার দেখে আসা চাই। অভ্যাসও কিছু আজকের নয়। সেই কবে বাবা সকালে হাঁটতে গিয়ে গঙ্গার ধারে লাঠি হড়কে পড়ে গেলেন আর ফিরলেন চারজনের কাঁধে চেপে। না, জীয়ন্তই ফিরেছিলেন একসময়ের ঝানু ব্যবসাদার মন্মথ সিংহ রায়। শুধু কোমড়ের হাড়টা বেজায়গায় সরে যাওয়ায় আর খাড়া হয়ে বা বসে থাকতে পারেননি। প্রায় বছরটাক ভুগে সে-হাড়ও জায়গায় এলো। প্রথমে ওয়াকার তারপরে লাঠি ধরেও আস্তে আস্তে হাঁটতে পারেন। কিন্তু ওই যে জীবিত থাকতে থাকতে চারজনের কাঁধে চেপে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা, বাকি কয়টা দিন তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি।

নানারকম হাড়ের ছবি, ওষুধ, ইনজেকশন আর গোটাদুয়েক অপারেশনের পরে যখন একটু বিছানায় উঠে বসতে পারলেন, প্রথমেই তিন ছেলেকে ডেকে ব্যবসা আর সব সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন। শুধু মুখের কথা নয়, এক্কেবারে লিখিত-পড়িতভাবে। সেই মোতাবেক, বাজারের সিনেমাহলটা পেল বড় ছেলে। সঙ্গে দরবেশপাড়ার তেলের মিলটাও। মেজোর ভাগে মালদা-বহরমপুর রুটে চলা দুটো বাসের মালিকানা, হার্ডওয়্যারের দোকান ইত্যাদি পাঁচটা খুচরো ব্যবসার সঙ্গে বাড়ির দুধের ব্যবসাটাও হাতে আসে। আর ছোটোর ভাগে পড়েছিল… সে যাকগে।

নেই নেই করে গরুও কিছু কম নেই। প্রায় কুড়ি-বাইশটা হয়ে যাবে। জার্সিই তো তেরো-চোদ্দোটা। লোহাপুরের রোববার রোববার বসা গরুর হাট, লালগোলার হাট, এমনকি পাকুড় হয়ে ঝাড়খন্ড, কোথায় না গেছেন ভালো লখ্না গরুর খোঁজে। প্রথম প্রথম নিজেই যেতেন। তখন এত কথায় কথায় গাড়ি চড়ার চল ছিল না। রাস্তায় এত বাস-লরিও চলত না। একটা বাস কোনোভাবে মিস করে গেলে অন্তত ঘণ্টাখানেক হাঁ করে বসে থাকা। নয়তো কোনো লরি কি ম্যাটাডোর গেলে তাকে হাত দেখিয়ে থামানো গেল তো গেল।

এত কান্ড করে হাটে পৌঁছে হাজারটা জানোয়ারের মধ্যে নিজের মনের মতো একটাকে পছন্দ করে, তার মুখের মধ্যে হাত ভরে দাঁত গুনে, তার পায়ের গোছ থেকে শিংয়ের বাঁক পর্যন্ত মেপে তবে ঘরে এনে তোলা। আর এই রাবুণে হ্যাপার পরে যে-জীবটাকে ঘরে আনা গেল, তার ঠিকমতো আদরযত্ন না করলে হয়! দুধের কারবারটা বাবার আমল থেকে মেজোবাবুই দেখাশোনা করতেন। নিজের নামে হয়ে যাওয়ার পরে চাড়টা আরো বাড়ে। যা-ই হয়ে যাক না কেন, সকাল-বিকাল একবার করে গোয়ালঘরে তিনি যাবেনই।

কিন্তু এই হারামজাদা শরীরের জন্য কি তার আর উপায় আছে? এতদিন সুগার ছিল, ছিল। সুগার পুরনো সাথি। খাওয়া-দাওয়া কাটছাঁট করে আর মাঝেমধ্যে মিষ্টিফিষ্টি বেশি খেয়ে ফেললে  হালকা ইনসুলিন ইনজেকশন নিয়ে ভালোই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মাসতিনেক থেকে কী যে এক হতচছাড়া পেটের রোগ এসে ধরেছে। রাত সাড়ে এগারোটা- বারোটার দিকে শুরু হয়। এক এক রাতে সাতবার- আটবার করে বাহ্যে যেতে হয়। এই যাওয়া আর আসা চলে প্রায় দুটো-আড়াইটে অবধি। তারপর নিজে থেকেই একটু ধরণ দেয়। ঘুম আসতে আসতে রাত কাবার। তারপর কি আর সকাল সকাল উঠে গরুদের দেখভাল কি আর কোনো কাজ করা যায়!

আজ রতন সাইকেল রেখে গোয়ালে ঢুকতেই দেখল গেলবারের আগেরবার সোনাটিকুরির ইমরাত সেখের কাছ থেকে কেনা কালো গাইটার তেইশ দিনের বাছুরটা মরে পড়ে আছে।

বাছুরটা এমনিতে খুবই তিড়বিড়ে। হওয়া-ইস্তক নিজের পায়ে দাঁড়াতে যে দু-পাঁচ ঘণ্টা লাগে, সেটুকুই। তারপর এই লাফাচ্ছে, এই কোনো বড়ো গরুকে গুঁতোতে যাচ্ছে, গোবরজলে পেছল হয়ে থাকা মেঝেতে হড়কে পড়ে যাচ্ছে। আর মেইন দরজা একটুখানি খোলা পেলে তো হয়েই গেল। আর দেখাদেখি নেই। দে ছুট। দিনের মধ্যে কতবার যে পালায় আর কোথা কোথা থেকে যে ধরে আনতে হয়, তা আর বলার নয়! একদিন তো হাসপাতালের পেছনের পাড়া থেকে দুধ নিতে আসা মোটা মাস্টারটাকে এমন দৌড় করিয়ে দিলো! বকনা-বাছুর যে এত শয়তান হয়, জানা ছিল না বাপু।

দূর থেকে বাছুরটাকে পড়ে থাকতে দেখেই সন্দেহ হয় রতনের। এমনিতে শেষ রাতের দিকে বাচ্চাগুলোর ক্ষিধে পায়। আর মায়ের থেকে বাচ্চাগুলোকে একটু দূরে বেঁধে না রাখলে সকালে একফোঁটা দুধও পাওয়া যাবে না। সবটুকু দুধ খেয়ে শেষ করে রেখে দেবে। আর এটা এতো হারামির হারামি, নিজের মা পরের মা ভেদাভেদ তো নেইই, গাইগরুর পাশে রাখলেই বাঁটে মুখ দেবে। তা মুখ দিবি দে; দুধ খাবি, দুধও খা। এটা করে কী, বাঁটটা মুখে পুরেই জোরসে চিবিয়ে দেবে। এই করেই মাসপাঁচেক আগে লোহাপুরের হাট থেকে কেনা অমন চমৎকার দুধেল গাইটার বাঁটে এমন ঘা ধরে গেল যে, এই মরে কি সেই মরে অবস্থা।

সেই থেকে বদমাশটাকে অন্যসব গরুর থেকে আলাদা করে কোনার দিকে একটা খুঁটের সঙ্গে একটু শক্ত করেই বেঁধে রাখা হয়। রতন দেখল, খুঁটোয় বাঁধা আর গলায় পেঁচানো দড়িটা টানটান হয়ে আছে। তেমনি টানটান হয়ে খিঁচে আছে বাছুরটার গলা আর চারটে পা। মুখটা হাঁ করা। জিভ একপাশে লটকে আছে। আর এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

দূর থেকে লক্ষণ দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলেও রতন ছুটে গেল। যদি এখনো না মরে থাকে। একটু হলেও যদি প্রাণটা থাকে। তাড়াতাড়ি করে গলা থেকে দড়ি খুলে মুখে জল দিলো।                 হাত-পাগুলো দলাই-মলাই করতে শুরু করল। একবার মনেও হলো যেন নড়ে উঠল। মনের ভুলই হবে হয়তো। মেজোবাবুর আওতায় আসার পরেই তিনি পুরো গোয়ালঘরটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে বাঁধিয়ে দেন। তার মাঝে মাঝে লোহার আংটা বের করে রাখা আছে। সেগুলোই খুঁটির কাজ করে। সেজন্যেই যতই টানাটানি করুক, কিছুতেই কিছু হয়নি। মাটিতে পোঁতা খুঁটো হলে উপড়ে আসত। বাছুরটাকে এভাবে মরতে হতো না।

চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। তাছাড়া রতন কোনো পরিস্থিতিতেই ঘাবড়ে গিয়ে হাট বাধাবার লোক নয়। সে নিজের মতো করে আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করল। লাভ নেই দেখে আস্তে আস্তে বাইরে এসে যুগীনকে ডাকল। যুগীন               এ-বাড়ির তিন পুরুষের সবসময়ের লোক। কাজের লোক বলতে আরো দু-চারজন থাকলেও সকলেরই সব ব্যাপারে যুগীনকে লাগে।

এক মেজোবাবুই গরুবাছুরের চক্করে সকাল সকাল ওঠেন। তাছাড়া এ-বাড়িতে কোনো বাবুরই আটটা-সাড়ে আটটার আগে ঘুম ভাঙে না। তা তিনিও ইদানীং পায়খানার ব্যামোতে এমন কাবু যে, সকালে উঠতেই পারছেন না। এদিকে খবরটা না দিয়ে এভাবে ফেলে রাখাও যায় না। অতএব যুগীনই ভরসা।

রতন খুঁজতে চেষ্টা করে, বডিতে কোথাও দুটো দাঁতের দাগ আছে কি? মসৃণ ছিটছিট নরম লোমে হাত বোলায়। পড়ে গিয়ে ছটফট করেছিল বোধহয়। গোটা গায়ে গোবর আর খড়ের কুটো লেগে আছে। খুব খুঁটিয়ে দেখেও রতন সারাশরীরে কোথাও কোনো ক্ষত খুঁজে পায় না। তবে কী হয়ে থাকতে পারে, তার একটা ধারণা করে নেয়। আর ধারণা করতে পেরেই বাছুরটার গলায় বাঁধা দড়িটা যত্নের সঙ্গে খুলে নিয়ে একপাশে রাখে। তখনই মেজোবাবু এসে দাঁড়ান।

মেজোবাবু হাঁকডাক করা লোক। তিনি আসা মানে তার পেছনে পেছনে বাড়ির আর পাঁচটা লোক, মুনিশ-মাহিন্দার সব এসে জোটে। সক্কাল সক্কাল ভিড় জমে ভালোই। নানাজনে নানারকম কথা বলতে থাকে। বাছুরটা কী করে মরতে পারে তা নিয়ে পঁচিশরকম মত শোনা যেতে থাকে। আর এসব ক্ষেত্রে যা হয়, সবাই মিলে রতনের ঘাড়ে দায় চাপাতে চেষ্টা করে।

– হ্যাঁ জি, তুমি কেমন ঘোষের ব্যাটা হে, অমন কচি বাছুরকে কেউ অত টাইট দিয়্যা বাঁধে?

– অত দূরে ওই প্যাঁদাড়ের দিকেই বা বেঁধ্যাছিলা কুন বুদ্ধিতে? পাশেই খড়ের ঢিবলি। সাপ-খোপ বেঢ়াতে কতক্ষুণ?

– সাপেই কাটলে, নাকি ফাঁস লাগল গলায়?

রতন বুঝল এ-প্যাঁচাল এখুনি থামাতে না পারলে সবাই মিলে তাকেই চেপে দেবে। সে সোজা মেজোবাবুকে তাক করে বলে – শুনেন, মনে লিছে যে, সাপটাপ কিছু দেখে ডর খেয়ে গেলছিল। ফটফট কর‌্যে পালাতে যায়। পা হড়কে যায় আর তাতেই গলায় দড়িটাতে ফাঁস লেগে যায়। প্রাণ মনে হয় তাতেই বেরিয়েছে। বিষটিষ কিছু শরীলে ঢুকেছে বলে তো মনে হয় না। যা হোক, এখুন যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

দুখু সেখের আগে দুধের ব্যবসা ছিল। নেশা-ভাং করে আর  জুয়া খেলে সেসব লাটে উঠেছে। এখন ঠিকাদার শঙ্করের বাড়ি থাকে। ফাইফরমাশখাটা বাজারহাট করা বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে দেওয়া-নেওয়া এইসব করে। সব শুনেটুনে সে বলে, তাহলে তো আফনেদেরগে ‘পাঁতি’ মাইনতে হবেক গো। ফাঁস লেগে মর‌্যালছে যখুন।

দুখু যতই ফালতু লোক হোক না কেন, সে ডাকসাইটে সুদন ঘোষের নাতি। একসময় একদিকে আইলের ওপর থেকে, অন্যদিকে অজগরপাড়া এই পুরো এলাকায় সবচেয়ে বেশি গরুমোষের মালিক ওরাই ছিল। ওর কথা চট করে ফেলেও দেওয়া যায় না।

ইতোমধ্যে উঠোনে দুধ নিতে আসা লোকের ভিড় জমতে শুরু করেছে। তারাও উঁকিঝুকি মেরে দেখে, পাঁচরকম কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে কারো কারো দুখু ঘোষের কথাটা কানে গেছে। বিডিও সাহেব নতুন বদলি হয়ে এসেছেন। সঙ্গে কাজের লোক এনেছেন। সেও দুধ নিতে আসে। এদিকের লোক নয়। সে জিজ্ঞেস করে, পাঁতি কী? যে-সমস্ত বুড়ো রিটায়ার করার পরে দুবেলা হেঁটে টাইমে ভাত খেয়ে বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে থেকে পরের বাড়ির মেয়ে-বউদের আপাত নির্দোষ ভাবে, আগাপাছতলা মেপেও সারাদিন কী করবে বুঝতে পারে না আর সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করে কখন সকাল হবে আর সকাল হলেই দুধ নেওয়ার নাম করে এখানে এসে জোটে, তাদেরই মধ্যে একজন বুঝিয়ে দেয়, ‘পাঁতি’ হলো একধরনের স্থানীয় আচার। গরু তো ধরো বাড়ির ছেলের মতোই। বাড়ির যদি কেউ মারা যায়, তাহলে তো অশৌচ পালন করতে হয়। গরু মারা গেলেও যে-মালিক বা যে গরুর দেখাশোনা করে তাকে দিনদশেক নিরামিষ খেতে হয়। তারপর মাথা মুড়িয়ে ফেলতে হয়। আর গরু যদি কোনোভাবে অপঘাতে বা মালিক কি রাখালের হাতে মার খেয়ে মারা যায়, তাহলে গরুর মালিককে সেই মরা গরুর দড়িটা গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করে সেই গরুর পারলৌকিক কাজের পয়সা তুলতে হয়। একবার সেই দড়ি গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে আর কথা বলা যায় না। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় দাঁড়াতে হবে আর হাম্বা-আ-আ করে ডাকতে হবে। তাহলেই লোকে বুঝে যাবে।

এসব শুনে কেউ বলে, আরে এগুলো তো ঘোষেদের নিয়ম। সবাই কেন মানবে। তাতে আবার কারো অাঁতে ঘা লাগে। সে গরম খেয়ে বলে, তা কেন, যার গরু আছে সে-ই মানতে বাধ্য। এর মধ্যে ঘোষ-হালদার এসব আসছে কোথা থেকে। এইসব গরমাগরমি থামানোর জন্য বুড়োমতন একজন স্বভাবমতোই বলে ওঠে, এগুলো তো পুরনো আমলের নিয়ম, এসব কি আর আজকাল কেউ মানে? সেই যে মোটা মাস্টার, যার একটু হাবিজাবি লেখার বাতিক রয়েছে, সে ভাবে, এই বিষয়টা নিয়ে চমৎকার একটা গল্প হতে পারে। কিন্তু গল্পের শেষটা কী হবে ভেবে পায় না।

কথাবার্তা গোলমাল পিঁপড়ের থুকের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষজনের মধ্যেই মেথরপাড়া থেকে ছিদাম চলে আসে। মরা            গরু-ছাগল নিয়েই তার কারবার। এ-বাড়িতে আগেও অনেকবার গরু মরেছে। সে এসে মাটি দিয়ে গেছে।

মেজোকত্তা একফাঁকে রতনকে ডাকেন। রতন তখন বডিটা পোঁতার জন্য পনেরো-বিশ কেজি লবণ কিনতে পাঠাচ্ছিল যুগীনকে। মালিকের ডাক পেয়ে চলে আসে। বার বাড়ি থেকে ভেতর বাড়ি যাওয়ার মাঝে যে-উঠোন, মেজোবাবু সেখানে একটা চেয়ার নিয়ে বসে সবুজ রঙের শরবতের মতো কী একটা জিনিস বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে খাচ্ছেন। পাশে মেজোমা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন, যাতে বাবু পাঁচনটা ফেলে দিতে না পারেন। গ্লাস খালি করে হাতে দিতে মেজোমা চলে গেল। মেজোবাবু দু-তিনবার গা-ঝাঁকি দিলেন। এত হুড়োপাড়া, এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও রতনের মনে হলো, বাস্ রে, পাঁচনটা না জানি কি বদখদ খেতে!

মেজোবাবু গলা নামিয়ে বললেন, মারধর করেছিলি না কি রে?

রতন চুপ করে থাকে। কী করে বলে, পাজিটার বদমায়েশিতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল কাল। সকাল থেকে তিনবার পালিয়েছে। শেষবার তো সেই কৌরীপাড়া থেকে ধরে আনতে হলো। খুঁজতে খুঁজতে রতনের কান্না পেয়ে যাওয়ার জোগাড়। শেষে কাজেম সেখের পানবরজের পেছন থেকে গলার দড়ি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসে। গোয়ালে ঢুকিয়ে খুঁটোর সঙ্গে বাঁধার পরেও রাগ পড়ে না। আবার ছটফট করে উঠতে সামলাতে না পেরে বেশ জোরেই একখানা ঘুসি পিঠের ওপর বসিয়ে দেয়। বাচ্চাটা কঁক্ করে ওঠে। রতন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জল দিয়ে খড় দিয়ে অনেকক্ষণ দলাই-মলাই করে ব্যাপারটাকে আয়ত্তে আনে। ভাগ্যিস তখন ঘুলি ঘুলি অন্ধকার হয়ে এসেছিল। গোয়ালঘরের আশেপাশে কেউ ছিল না। এমনিতে রতনের কাজকর্ম নিয়ে এ-বাড়িতে কেউ আঙুল তোলার হিম্মত রাখে না। কিন্তু কেউ যদি দেখে, ভর সন্ধেবেলা রতন একটা কচি বাছুরকে গায়ের জোরে ঘুষি মারছে, তাহলে কি আর কথাটা মেজোকত্তার কানে উঠবে না?

রতন মাথা নাড়ে। পরিষ্কার গলায় বলে, না মারধোর তো কিছুই করি নাই খো।

ইতোমধ্যে সুতোবাবু এসে পড়েন। রতন গরুর মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চলে যায়। সুতোবাবু এ-বাড়ির বারোমাসের পুরোহিত। সুতোবাবুর নাম বোধহয় মুকুন্দ বা ধনঞ্জয় এরকম কিছু একটা হবে। এই বাড়িতে তিনি ঢোকেন নিতান্ত কাঁচা বয়েসে। এবং পুরোহিত হিসেবে একেবারেই নয়। বুড়োবাবুর মাঝখানে সুতো তৈরির কারখানা করার শখ হয়েছিল। সেই কারখানার হিসাবপত্তর রাখার জন্য এই বামুনের ছোকরাকে কোথা থেতে ধরে আনেন। সেই থেকে চাকর-বাকরের মুখে তিনি সুতোবাবু। পরে বাড়ির পুরোহিত ভটচাজমশাই পরপর দুখানা স্ট্রোকে বিছানা নিলে বড়োবাবু তাকে পুরুতগিরিতে লাগিয়ে দেন। নারায়ণকে দৈনিক জল-বাতাসা দেওয়ার কাজটা তিনিই চালিয়ে দেন।

সুতোবাবুর চালচলন কোনোটাই পুরোহিত পুরোহিত নয়। তিনি পুরোদস্ত্তর প্যান্টশার্ট পরে এ-বাড়িতে আসেন। কোনোমতে ছালের কাপড় পড়ে দুটি অং-বং করেই আবার পুরনো পোশাকে ফিরে যান। ভেতর বারান্দায় তার জন্য একটা চেয়ার পাতাই থাকে। সেটায় বসে সারা সকাল মেজোবাবুর সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে শলাপরামর্শ করেন আর কাপের পর কাপ চা খান।

রতন এসে আবার যখন এদের সামনে দাঁড়াল, তখন এরা ওই গরুটারই শ্রাদ্ধশান্তিকাজের সামগ্রীর ফর্দ বানাচ্ছেন। ওদিকে ছিদাম বাগানের পেছনে পুকুরধারে গর্ত খুঁড়ে ফেলল প্রায়। এবার বাছুরটাকে শুইয়ে লবণ আর মাটি দিয়ে ঢেকে দিলেই হলো। রতনকে দেখে মেজোবাবু বলেন, এই তো তুই এসে গেছিস। লিস্টটা একবার দেখে নে তো, কিছু বাদছাদ পড়ল কি-না।

রতন লিস্টটা নেয়। চোখ বুলিয়ে মাথা নেড়ে ফিরিয়ে দেয়।

মেজোবাবু বলতে থাকে, এই সুতোকে বলছিলাম, বুঝলি, মরেছে যখন, তখন অশৌচের কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। কিন্তু ওই পাঁতি নাকি যেন বলে, ওসব ফালতু লোকাচার, ওসব মানার কোনো প্রয়োজন নেই।

এতক্ষণে মেজোবাবুর খেয়াল পড়ে, রতন বোধহয় কিছু বলবে। বাইরে এখনো খরিদ্দারদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দুধ-দোয়ানো এখনো শেষ হয়নি। রতনও দুধ দুইতে দুইতেই উঠে এসেছে। ওর হাতে মুখে জামায় ছোট ছোট দুধের কণা লেগে।

– কিছু বলছি?

রতন বলে, কালীগাইটা কিছুতেই কাউকে কাছে যাতি দিছে না। হামাকে অব্দি লাথি ছুঁড়ত্যাছে। খানি উর বাচ্চাটাকে ঢুঁড়ত্যাছে।

মেজোবাবু এতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলেন। এবার একটু সজাগ হয়ে কান পাততেই অন্যসব গরুর ডাক ছাপিয়ে কালীগাইয়ের একটানা হাম্বা হাম্বা শুনতে পেলেন। কোনো ফাঁক না রেখে ডেকে যাচ্ছে গরুটা। এত বেলা হয়ে গেল, তবু তার বাচ্চাটা তার কাছে আসছে না কেন? এত করে ডাকছে, ডেকেই চলেছে, তবু সাড়া দিচ্ছে না।

মেজোবাবুর একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সুতোবাবুও মুখ দিয়ে সময়োচিত চুক-চুক শব্দ করেন।

মেজোবাবু বলেন, অন্য বাছুর ভিড়িয়ে দেখেছিস?

রতন মাথা নাড়ে, নিচ্ছেই না। তাছাড়া ওরকম বয়সের বাছুরই তো নেই। সব ওটার থেকে গায়েগতরে বড়ো। কাছেই যেতে দিচ্ছে না। এরকম একটা সমস্যা আসবে মেজোবাবু অাঁচ করতে পারেননি। করা উচিত ছিল। গাইগরুর বাচ্চা মারা গেলে দুধ দুইতে সমস্যা হবে, সে তো জানা কথা। আসলে এতদিন ধরে গরু-বাছুর নিয়ে ঘর করলেও এত কমদিনের বাছুর মারা যাওয়া এই প্রথম। দুধেল গাইয়ের দুধ দুইয়ে না নিলেও চলে না। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মেজোবাবু একটা সিগারেট ধরান। খুব খানিক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রতন দাঁড়িয়ে আছে। সবরকম চেষ্টা করে ফেল মেরে না গেলে সে তার কাছে আসত না। সুতোবাবুর কাজ সব ব্যাপারে তার হাঁ-তে হাঁ মেলানো। তাকে দিয়েও কিছু সাহায্য হবে না।

রতন বরাবরই বলে, বিপদের সময় মাথা খুলতে সে মেজোবাবুর মতো আর কারোরই দেখেনি। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মেজোবাবু বলেন, এক কাজ কর। তাড়াতাড়ি ছিদামকে কাজ বন্ধ করে এখানে আসতে বল।

রতন দৌড়ে যায়। ছিদাম এলে মেজোবাবু বলেন, গর্ত খোঁড়া হয়ে গেছে?

ছিদাম বলে, এই হলো বলে। আর হাতখানেক। যা শক্ত মাটি।

মেজোবাবু এদিক-ওদিক একটু তাকিয়ে বলেন, ওসব ছাড়। তুই বাছুরটার চামড়াটা ছাড়িয়ে নে। রতন তুই খড় দিয়ে একটা গরুর মাথার মতো কিছু একটা বানা। ছিদাম চামড়া ছাড়ানো হলে খড়ের মাথাটাকে ওই চামড়া দিয়ে ঢেকে দে। তারপর ওই মাথা গরুর কাছে নিয়ে যা, দেখবি বাচ্চা এসেছে মনে করে আপনি দুধ দেবে। কী রে, পারবি না?

রতন আর ছিদাম দুজনেই খুশি হয়ে মাথা নেড়ে চলে যেতে নেয়। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। গরু দুধও দেবে। কিছু বুঝতেও পারবে না। ওরা চলেই যাচ্ছিল, মেজোবাবু ডাকলেন, ওরে ছিদাম, ওইসব চামড়া ছাড়ানো-টাড়ানো বাড়ি থেকে যতোটা পারিস দূরে করিস বাবা। আমাদের পুজোআচ্চার বাড়ি। অধম্ম সইবে না।

রতন আর ছিদাম মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসে। মেজোবাবু আর একবার ফর্দতে ঢুকে যান।