পাইন-পাতার রূপকথা

সাত্যকি হালদার

মানুষটা কবে থেকে এলো তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল অনেক। এক-একজন একেক রকম কথা বলত। কেউ বলত, পাশেই আলগরায় ওর জন্ম। পরে এদিকে চলে আসে। বুড়ো জুলে শেরপা বলত, আদতে ও এদিকের লোকই নয়। বাপ-মার সঙ্গে কখনো পাহাড়ে এসেছিল। কোনো একটা বোর্ডিং ইশ্কুলে নাকি ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল বাবা-মা। পরে যে-কোনো কারণে হোক খোঁজ নিতে পারেনি। তারপর থেকেই নাকি ও এদিকে।

কিন্তু হঠাৎ বারমিকের মতো একটা জায়গায় কেন চলে এলো ও! আশেপাশে তো আরো কত জায়গা। ছোট-বড় শহর। মানুষ তো শহরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বারমিক তো গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে একটা গ্রাম। ছড়ানো-ছিটানো কিছু বাড়ি।

কালিম্পং থেকে রংপো যাওয়ার যে পাকা রাস্তা গ্রাম চিরে চলে গেছে তার ধারে গোটা চার-পাঁচ দোকান। নিচে, অনেকটা নিচে খানিকটা সমানমতো জায়গায় একটা খেলার মাঠ। আরেকটা ঝরনা আছে গ্রামের গা-ঘেঁষে। অনেকখানি পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে একটা চওড়া পাথরের ওপর পড়ছে। সেখান থেকে প্লাস্টিকের বোতলে বা জারিকেনে ভরে জল আনে গ্রামের লোকেরা। সেটাই বলতে গেলে বারমিকের খাওয়ার জল। পথচলতি ড্রাইভাররা অনেক সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঝরনা থেকে তাদের বোতলে জল ভরে নেয়।

এসব নিয়েই একটা গ্রাম, ছোট গ্রাম পাহাড়ের গায়ে।

উমাশংকর নামে একটা লোক অনেকদিন আগে বিহার-মুলুক থেকে এসে প্রথম মুদিদোকানটা করেছিল বারমিকে। সে-দোকানটা এখনো চলছে। উমাশংকরের ছোট দোকানটা আসলে এখানকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। চাল-ডাল-আদা থেকে দড়ি-সাবান-হাওয়াই চটি, এমনকি জ্বর, মাথাব্যথা, পেটের গোলমালের ওষুধটুকুও মেলে। এক-দুদিন আগে অর্ডার দিলে উমাশংকর কালিম্পং বাজার থেকে ছোট বাচ্চাদের জামাকাপড় বা টিফিন ক্যারিয়ার এনে দেয়। ছোট দোকান। উমাশংকরের খানিকটা বয়স হয়ে গেছে। ও আর ওর বউ মিলে দোকানটা চালায়।

এছাড়া বারমিকের নিচে ওই খেলার মাঠের কাছাকাছি একটা প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। দুজন দিদিমণি। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর। সকালবেলা পিঠে ব্যাগ নিয়ে বাচ্চারা গুটিগুটি পায়ে স্কুলের পথে নেমে যায়। ফিরে আসে এগারোটা নাগাদ। ডিসেম্বর-জানুয়ারির খুব ঠান্ডা আর জুলাই-আগস্টের বৃষ্টিতে স্কুল বন্ধ থাকে কিছুদিন। সেই সময় পুরো পাহাড়ি গ্রামটাই বলতে গেলে অচল হয়ে যায়। ঘরে আটকে থাকে সবাই।

তারপর রোদ উঠলে আলো ফুটলে আবার বাইরে আসা। আবার স্কুল চালু। উমাশংকরের দোকানের পাশে গুমটি মতো জায়গায় বিকেলের দিকে কিছু লোকজন জড়ো হয় আবার। নিচে খেলার মাঠ থেকে খানিক পরপর ছেলেদের গলা শোনা যায়।

এরকম একটা শীতের শেষেই এসে হাজির হয়েছিল ও। তখন কত বয়স হবে, হয়তো চল্লিশ। গুটিগুটি পায়ে এক দুপুরে এসে বসেছিল পাকা রাস্তার ধারে দোকানের পাশে গুমটিমতো জায়গাটায়। একটা টাইট জামা, সোয়েটার, ঢোলা প্যান্ট, গলা থেকে ঝোলানো একটা ছোট যন্ত্র, তারের। ও বলেছিল, ম্যান্ডোলিন। কোথা থেকে এসেছে তা জানার আগে বিকেলে হাজির হওয়া আমুদে লোকজন বলেছিল, হলো তো ম্যান্ডোলিন, তা বাজাও তো শুনি।

সেই বিকেলেই কাঁধ থেকে ঝোলানো যন্ত্রটা বাজিয়ে শুনিয়েছিল ও। সঙ্গে নিচু সুরে গান। দুটো নেপালি, একটা লেপচা, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি। প্রথম বিকেলেই লোকজন মুগ্ধ। কোত্থেকে এলে ভাই?

ও হেসেছিল। বলেছিল, এই হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম।

যাবে কোথায়?

এখনো ঠিক করিনি। আবার ঠোঁটে-চোখে হাসি। যেদিকে দুচোখ যায়।

আজ রাতে?

তোমাদের এখানে কোথাও থাকি।

এরকম পাহাড়ি গ্রাম কখনো কাউকে ফেরায়নি। পাহাড়ের পথে মাঝে মাঝেই নানা রকম লোক চলে আসে। কাঁধে বড় রুকস্যাক ফেলা ট্র্যাকিংয়ে চলা মানুষ, বেশিরভাগ ছোট দলে, কখনো একা। এক রাত থেকে যায়। বছরে এক-দুজন ভবঘুরে। দেশি বা বিদেশি। এলোমেলো ঘুরে-বেড়ানো লোক। এই লোকটাও সেরকমই কেউ। সঙ্গে গান জানে। ফলে বারমিক তাকে যত্ন করেই সে-রাতে রেখে দেয়।

মেরিকা বুড়ি থাকত রাস্তা যেদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সেই দিকটায়। গ্রামের একমাত্র যে-ছোট্ট মনাস্ট্রি, তার কাছাকাছি। গাছপালার ভেতর কাঠের মনাস্ট্রি। ভেতরটা আধো-অন্ধকার। বড় শহরের যে বড় মনাস্ট্রি তার চাইতে অনেক অনেক ছোট।  মনাস্ট্রি-লাগোয়া যে ছোট ঘর, সেখানে বুড়ির তত্ত্বাবধানে সেই রাতে রেখে দেওয়া হয় তাকে। গ্রামে ট্র্যাকাররা এলে এই ঘরে থাকে, ভবঘুরে মিসকিনদের জন্যও এই ঘর। গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল যারা তাদের দুজন এসে দুটো কম্বল রেখে যায়। বুড়ি বড় একবাটি থুকপা ফুটিয়ে সন্ধের পর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।

সকালবেলা ফুলবা আসে। ফুলবা দোরজে। কালিম্পংয়ের হোটেলে কাজ করে ও। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে। গ্রাম থেকে একমাত্র শহরে কাজ করতে যাওয়া ছেলে ওই ফুলবা। ও এসে আগের দিনের সেই মানুষটাকে দেখে বলে, ওর নাম মনে হয় নারিয়া। কালিম্পং বাজারে গত কমাস ধরে দেখেছি। ওখানে সবাই চিনে গিয়েছিল ওকে। দুপুরের পর থেকে যন্ত্রটা বাজিয়ে গান গেয়ে যেত ডম্বারচকের সিঁড়ির ধাপে বসে।

পরদিন ও চলে যেত ঠিকই কিন্তু কেউ ওকে যাওয়ার কথা বলল না। কখন যাবে, কোথায় যাবে – সেসব কিছু নয়। ও-ও বলল না কিছু। বরং দুপুরের পর মনাস্ট্রির ওখান থেকে বেরিয়ে ছোট গ্রামটার এদিক-ওদিক ঘুরল। ভাঙা নেপালি, ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলল দু-একজনের সঙ্গে। নিচে নদীর দিকে প্রতিদিন গরু চরাতে নিয়ে যাওয়া নরবু লেপচার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল দরজায় পর্দা ধরে নরবুর সাত-আট বছরের মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ও ওর সেই পরিচিত হাসিটা হাসল। তারপর নেপালিতে বলল, বিকেলে বৃষ্টি না হলে সামনের মোড়ে যেও। পাহাড়ি রাজকুমারীদের পুরনো গান হবে।

নরবুর মেয়ে রম্মিত নতুন লোককে দেখে লজ্জা পেল। আরো লজ্জা পেল রাজকুমারীর গানের কথা শুনে। কিন্তু লোকটার হাসিমুখ দেখে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে টানা চোখের নিচে রম্মিত হাসল একটু।

বিকেলে গান হলো না। ওই বৃষ্টির জন্যই হলো না। পাহাড়ের এদিকের বৃষ্টি তো আশ্চর্য ধরনের। দিন নেই, রাত নেই। শীতকাল নেই, বর্ষাকাল নেই। শুরু হলেই হলো। যতক্ষণ বৃষ্টি ততক্ষণ বাইরে কেউ নয়। মোড়ের মাথার মোটা লেজের কুকুরগুলোও নয়, এমনকি এখানে-ওখানে ঘোরা জুলে শেরপাও নয়। চারদিকের পাইন আর সরু পাতার লম্বা গাছেরা বাধ্য ছেলের মতো পাতা নামিয়ে ভিজবে। অনেক দূরের পাহাড়গুলো ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে থাকবে। আর গ্রামের পথে লাফিয়ে নামা ঝরনার শব্দটা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। উমাশংকরের দোকানের পাশে তার মধ্যে এসে বসেছিল লোকটা। টিংটিং করে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে নিচু সুরে কী একটা গান গাইছিল। ফুলবা এসে নামধাম বাড়িঘর নিয়ে দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করায় ও একবার বলল আলগরার কথা, একবার বলল গ্রামহোমসের হোস্টেলের কথা।

আর বাপ-মা?

ও গান থামিয়ে ঠোঁটে হেসে বলল, ছিল, আপাতত কেউ নয়।

কিন্তু এই লোকটাকেই কদিনের মধ্যে ভালোবেসে ফেলল গোটা গ্রাম। তা শুধু ওর গানের জন্য নয়। ও-ও কেমন মিশে গেল সবার সঙ্গে। মনাস্ট্রি ওর থাকার জায়গা ঠিকই কিন্তু ওর খাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট ঠেক নেই। যে যেদিন পারে ডেকে নেয় ওকে। উমাশংকরের বউ ডাকে। ফুলবা কালিম্পংয়ে থাকলেও ফুলবার মা ডাকে। গরু চরানো নরবু ডাকে যেদিন গরু নিয়ে নিচে নদীর ঢালে না-যাওয়া হয়। আর নরবুর মেয়ে ওকে দেখলে পর্দার আড়ালে একটু-একটু হাসে।

বারমিক বলে শুধু নয়, এরকম সব পাহাড়ি গ্রামেই বেশিরভাগ দিন ঠিক আগের দিনটার মতো। সকালের দিকে যার যেটুকু কাজ সে সেটুকু করে। যে-মেয়েরা ওপরের পাহাড়ে ঘাস আনতে যায় তারা দুপুর না গড়াতে ফিরে আসে। বাচ্চাদের ইশ্কুল শেষ হয়ে যায় বেলা এগারোটার মধ্যে। উমাশংকরের দোকানের কেনাবেচাও সকাল শেষ হলেই একেবারে ঢিলেঢালা হয়ে আসে। নারিয়ারই একমাত্র কোনো কাজ নেই। সে মনাস্ট্রি থেকে বেরিয়ে এখানে বসে, ওখানে বসে, আধ-ঘণ্টাখানেক চক্কর মেরেই গোটা গ্রামটা ঘুরে নেয়। তারপর কোনো দিন গান গায়, কোনো দিন গায় না। সন্ধে হতে না হতে গ্রাম একদম চুপচাপ। যে যার ঘরে ঢুকে যায়। মনাস্ট্রিতে ঢুকে নারিয়া তখন ধুনো আর ধূপকাঠির ছাইয়ের মেঝেতে কম্বল পেতে টান হয়ে শুয়ে থাকে।

ফুলবা সেই প্রথম দিন বলেছিল, কালিম্পংয়ে দেখা এই লোকটার নাম মনে হয় নারিয়া। তারপর থেকে সে-লোকের মুখে নারিয়াই।

কিন্তু এর মধ্যে একটা ছোট ব্যাপার হয়। নারিয়া মনাস্ট্রিতে থাকলে গাঁয়ের অনেকেই দেখা করতে আসে তার সঙ্গে। দু-চারটে খোশগল্প হয়। নারিয়ার ছোট ঘরটায় উঠে-বসেও কেউ কেউ। কিন্তু এর মধ্যে একদিন দুপুরের পর থেকে বারমিক কুয়াশায় ঢেকে গেলে কে একটা নারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে এসে দেখে, জমাট ঠান্ডায় ঘরে বসে ম্যান্ডোলিনে পুরনো একটা লেপচা সুর বাজাচ্ছে নারিয়া, আর ঘরের মেঝেতে ওর সামনে বসে গান শুনছে সাতাশ-আটাশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির লম্বা চুল, চেহারাটা ঠিক পাহাড়িদের মতো নয়। মেয়েটিকে আগে কখনো দেখা যায়নি বারমিকে। চুপ হয়ে বসে সে নিচু সুরের বাজনা আর গান শুনে যাচ্ছে।

তারপর বিকেল হলো। কুয়াশা কমে এলো। যে দেখা করতে গিয়েছিল সে-ও ফিরে এলো। মেয়েটি রয়ে গেল মনাস্ট্রি-লাগোয়া ঘরে।

সেদিনও আবার বৃষ্টি হলো সারারাত।

পরদিন রোদ উঠলে বড় গাছের পাতারা যখন রোদে সবুজ, উঁচু গাছের মাথায় বসে খানিক পরপর শিস দিচ্ছে অদৃশ্য মোনাল, ঝরনা লাফিয়ে নামছে নিচের পাথরে, তখন নারিয়ার সঙ্গে গ্রাম ঘুরে দেখছিল সেই মেয়েটি। তার চোখমুখে কেমন ঘোর। যেন রোদের পাহাড়, ছোট-ছোট বাড়ি, মেঘ, আকাশ এসব দেখে সে অবাক। সে কাঁধে ম্যান্ডোলিন নেওয়া নারিয়ার পাশেপাশে হাঁটল, উমাশংকরের দোকানের পাশে এসে বসল একটু, আর যারা এসেছিল অবাক-অবাক চোখে তাদের কথা শুনল, তারপর আবার ফিরে গেল মনাস্ট্রিতে। তার মুখে কখনো একটুও কথা নেই। শুধু দু-একবার একটুখানি হাসি।

লোকেরা খানিকটা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু কেউ জানতে চাইল না হঠাৎ-আসা মেয়েটি কে। কোথা থেকে এসেছে সে। কেনই-বা এসেছে। এরকম প্রশ্ন পাহাড়ি গ্রামের রীতি নয়। মনাস্ট্রি-লাগোয়া ছোট ঘরটায় বছরের নানা সময়ে একটু-একটু করে আসে যারা তাদের কাছে কেউই ঘরবাড়ির খবর জানতে চায় না। কেনই-বা জানতে হবে অত কিছু!

যেমন নারিয়ার কাছেও তো ততদিনে কেউ জানতে চায়নি আরো কত দিন ও বারমিকের এই ছোট মনাস্ট্রিটায় থাকবে। এরপর সে আর কোথাও যাবে কিনা। শুধু সন্ধের পর গরু নিয়ে ফিরে নরবু ওর মেয়ের জন্মদিনের আগের দিন ধূপ জ্বালাতে এসে দেখেছিল কদিন আগে আসা মেয়েটিকে নারিয়া নিজের থাকার ছোট ঘরটি ছেড়ে দিয়েছে। ও নিজে মনাস্ট্রির ভেতরে কাঠের মেঝেতে গালিচার ওপর শুচ্ছে।

প্রথমে একটি লোক গ্রামের হয়ে গিয়েছিল, পরে দুজনেই ওরা বারমিকের হয়ে গেল। উমাশংকরের দোকানের, নরবুর, জুলে শেরপার। তারপর আরো সবার। মেয়েটির বেশ ভাব হলো নরবুর মেয়ের সঙ্গে। সকালে যে গোলগোল চোখমুখের বাচ্চারা পিঠে ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ের গা-বেয়ে খানিকটা নেমে ইশ্কুলে যায় তাদের সঙ্গেও ভাব হলো ওর। যদিও মেয়েটি পাহাড়ের ভাষা জানে না, ওর যা ভাষা বাচ্চারাও জানতো না তা। তবু কেমন কথা হতো। অনেক কথা হতো নরবুর মেয়ে রাম্মিতের সঙ্গে। হিমালয়ের ঢালে এসব ছোট গ্রামে কথা তৈরি হতে অনেক কথা লাগে না। অনর্গল শব্দও লাগে না। হাসলে কিংবা হাত বাড়ালে চলে। কিংবা পাশাপাশি হাঁটলে। রাম্মিতের সঙ্গে সে দুপুরের পর ঝরনা দেখতে যেত। অনেক দূরে পেছন-পেছন ম্যান্ডোলিন কাঁধে হেঁটে যেত নারিয়া। মেয়েটি যাওয়ার পথে বারবার থেমে ছোট ছোট গাছে কীসব খুঁজত।

কথা হচ্ছিল না ঠিকই। আবার একটু-একটু কথা হলো। সে-কথাও হাত বাড়ানোর, কাছে টানার। এই গ্রামের যে-মাথা সেই সিজো লেপচার অনেকখানি বয়স হয়ে গেছে। বুড়ো আর আগের মতো প্রতিদিন ঘর থেকে বেরোয় না। উমাশংকরের দোকানে তো আসেই না। তবু বুড়ো খবর রাখত সবই। ঘরে বসেই রাখত। একদিন সারারাত হাড়-কাঁপুনি ঠান্ডার পর কয়েকজন যখন সকালে রাস্তার ধারে উমাশংকরের দোকানের পাশে এসে রোদে দাঁড়িয়ে বা বসে ছিল তখন আবার বুড়ো এলো। তার গায়ে মোটা কম্বল। গাল আর কপালের চামড়া ভাঁজপড়া। সে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে উবু হয়ে বসল। তারপর বলল, পাহাড়ের ঢালে এখনো এতো জমি, ওদের দুজনকে কোথাও একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেই তো হয়। একটা ঘর তুলে পাকাপাকিভাবে না হয় বারমিকেই থাকুক।

তা থাকুক…

তা থাকুক…।

জুলে শেরপা বলে, তবে ওরা মনে হয় থাকবে না।

থাকবে না কেন?

জুলে বলে, ঘরে থাকার কথা তো আমি আগেই ওদের বলেছি। আমার ছেলেটা মাসছয়েক কাজ নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেছে। ওর ঘর খালি। নারিয়াকে বলেছিলাম মনাস্ট্রি ছেড়ে দুজনে মিলে এখানে এসে থাকতে। ও হেসেছিল, পরে আর কিছু জানায়নি।

কম্বল জড়ানো সিজো লেপচা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, নারিয়াকে বরং একদিন আমার সঙ্গে দেখা করাও। আমিই ওকে যা বলার বলি। ও যদি চাষ করতে চায় খানিকটা জমিও না হয় দেওয়া যাবে।

পরপর বেশ শীত গেল কয়েকটা দিন। রাতে ঠান্ডা, বারমিকের দিনগুলোও কনকনে। ভোরবেলা থেকে একটানা হাওয়া প্রায় সন্ধে পর্যন্ত। সন্ধে থেকে চারপাশ পরিষ্কার, তখন বাইরে এলে আকাশ দেখা যায়। শীতের সময় দিনের বেলাতেও আকাশ ঝকঝকে। প্রায় সারাদিন ধরে দূরে দেখা যায় বরফ-পাহাড়ের সারি। শীত কম হলে একদিন ডাকা হলো নারিয়াকে। সেদিন সকাল থেকেই হাওয়া।

শীত আর শীতের শেষে পাহাড় ঢেকে থাকে বুনো ফুলে। বাতাসে পাইনের শুকনো পাতা ছড়ায়। রডোডেনড্রনে কুঁড়ি আসতে থাকে। ঝরনার শব্দটা দিনেরাতে একই রকম শোনায়। নারিয়া এলো একা। কাঁধ থেকে খুলে ম্যান্ডোলিনটা কোলের ওপর নিয়ে বসল। বলল, জমি নিয়ে আমি কী করব!

কেন, চাষ করবে, ঘর তুলবে। সংসার।

নারিয়া হাসে। এদিকে অনেক দিন হলো। এবার চলে যাব অন্য কোথাও।

কেন যাবে! বারমিকের মতো ভালো জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। জমি নাও। চাইলে তিনটে গরুও দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।

উত্তরে ম্যান্ডোলিনটা কয়েকবার আঙুল টেনে বাজাল নারিয়া। ওর সেই চেনা হাসিটা ঠোঁটে। পুরনো একটা পাহাড়ি গান ধরল নিচু গলায়, যে-গানে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে মানুষের পৃথিবীতে নেমে আসার কথা। মানুষের সঙ্গে এসেছিল পাখি আর বুনো শিয়াল। আর এসেছিল মস্ত এক সাপ। পাহাড় ছাড়িয়ে বেশিদূর যাওয়ায় তখন মানা ছিল মানুষের। প্রথম দিকের সেই মানুষেরা বনে ঘুরত আর পুজো করত পাহাড়ের। আর ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার।

নারিয়া গান গাইলেই সকলে চুপ। কথা ভুলে যায় সবাই। কত দিনের পুরনো সব কথা আছে নারিয়ার গানে। পাহাড়ের হারিয়ে যাওয়া দিনের নানা রকম কাহিনি। কোথা থেকে ও এসব গান শিখতে পেরেছে কে জানে!

তবু বুড়ো সিজো লেপচা গানের শেষে চোখের পাশটা একটু মুছে নিয়ে বলে, তোমরা ঘর করে বারমিকে থাকলে খুশি হতো এদিকের সবাই। কোথাও না কোথাও তো থাকতে হবে তোমাদের।

নারিয়া বলল, আমাদের বলে তো কিছু নেই। আমি একলা মানুষ। একা মানুষের ভাবনা কী অতো!

পাশ থেকে জুলে শেরপা বলল, কিন্তু যে এসে মনাস্ট্রিতে রয়েছে? নরবুর মেয়ে রাম্মিত আর সব বাচ্চার সঙ্গে যার ভাব!

নারিয়া হাসল আবার। পাইনের পাতার মতো ওর হাসি। বলল, সে আমার সঙ্গে আসেনি। আমার জন্যও আসেনি। পাহাড়ের গাছপালা নিয়ে পড়াশোনা করতে হিমালয়ে বেরিয়েছে। আপাতত তাই তোমাদের এখানে এসে থাকছে।

আর গান? মনাস্ট্রির পাশের ছোট ঘরে তোমার সামনে বসে যে গান শুনতে দেখি ওকে! অন্য সময়ও দেখেছি।

নারিয়া উঠে পড়ে। বলে, তোমাদের মতো সে-ও হয়তো গান ভালোবাসে। আর কিছু না।

তবু ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয় না সবার। বারমিকের সবাই এটা জেনে ফেলে তবু মন থেকে মানতে চায় না। নারিয়ার কাছাকাছি থাকা মেয়েটি নারিয়ার আসলে কেউ নয়! কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। কিন্তু এই কটা দিন পাশাপাশি থেকেও তো সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। পাহাড়ের ঢালের অনেকে যে-সম্পর্কটা ভেবে নিয়েছিল তা আসলে কিছু নয় শেষ পর্যন্ত?

নারিয়া বলল, ওর বর আছে। সে কোথাও একটা কলেজে পড়ায়। ফুল আর পাহাড়ি গাছপালা নিয়ে কাজটা শেষ হলে ও বরের কাছে চলে যাবে।

এরপর আর কথা চলে না কোনো। নারিয়াকে আর কিছু বলে বা বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। সিজো লেপচা উঠে ঘরের দিকে যায়। উমাশংকরের দোকানের পাশে জুলে বসে থাকে অনেকক্ষণ। নিচে ইশ্কুল ছুটির পর পাহাড় বেয়ে উঠে আসা বাচ্চাদের হল্লা শোনা যায়।

তারপর সত্যিই একটা সকালে রওনা হয়ে যায় নারিয়া। ওর যাওয়াটা একই রকম। যেভাবে এসেছিল সেভাবে। আগেভাগে তেমন কিছু জানানো নয়, সকালে উঠে ম্যান্ডোলিন কাঁধে বেরিয়ে চলে যাওয়া। উমাশংকরের দোকানের কাছে এসে চা খেল একবার। তারপর হাঁটতে শুরু করে দিলো।

উমাশংকরের বউ জিজ্ঞাসা করেছিল, আর আসবে না নাকি?

নারিয়ার সেই হাসি। মন চাইলে আবার কখনো আসব। তবে মন কবে চাইবে তার তো কোনো ঠিক নেই। পথের যে-দিকটা রংপোর দিকে চলে গেছে সেদিক বরাবর হাঁটতে থাকল ও। অনেকদূর পর্যন্ত ওকে দেখা যাচ্ছিল। একটা লোক, রোগাটে লম্বা, কাঁধে ম্যান্ডোলিন, হাঁটতে-হাঁটতে যেন পাহাড়ের সবুজের সঙ্গেই মিলে গেল।

পাহাড়ের গায়ে ছোট গ্রামটা চুপ হয়ে থাকল সারাটা দিন।

রাম্মিত আর বাচ্চাদের বন্ধু রয়ে গেল মনাস্ট্রিতে। বিকেলে সামান্য একটু কাজ করল সে লাগোয়া বাগানে গাছের কাছে গিয়ে। মনাস্ট্রির ঘণ্টায় সন্ধে নামল।

দিনসাতেক পর একটা সাফারি গোছের গাড়ি এলো বারমিকে। উমাশংকরের দোকানের কাছে নামল দুজন। কীসব জানতে চাইল। তারপর গাড়ি নিয়ে দাঁড় করাল মনাস্ট্রির বাগানের গায়ে।

মনাস্ট্রির বুড়ি পরে বলেছিল, মেয়েটির সঙ্গে লোক দুজনের কথা হয়েছিল নানারকম। ভাষা আলাদা। বুড়ি এক বর্ণও বোঝেনি। তবে বেশ উঁচু গলায় কথা বলছিল তাদের মধ্যে একজন। যেন মেয়েটিকে শাসাচ্ছিল। মেয়েটি কিছুই প্রায় বলেনি। ওরা যেন জোর খাটাতে এসেছিল মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেভাবেই কথা বলছিল। মেয়েটি যায়নি।

বারমিক এসব শুনল। কেউ কিছু বলল না।

তারপর হয়ে গেল অনেক দিন। অনেক বছর। পাহাড়ের গায়ে ছোট গ্রাম আগের মতোই রয়ে গেছে। বছরে প্রায় তিন-চারমাস সেখানে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়। গাছপালা আর পাহাড়ের ঢালেচরে-বেড়ানো গরুরা ভিজতে থাকে তখন। নেমে আসা ঝরনার শব্দ অনেকখানি বেড়ে যায়। বাচ্চাদের ইশ্কুল বন্ধ রাখা হয়।

আবার শীতের সময় কাঁপ-ধরানো বাতাস বইতে থাকে সারাদিন। পাইনের পাতা কেঁপে যায়। আকাশ নীল হয়ে থাকে। বরফের পাহাড় ডাকতে থাকে দূর থেকে। শীত কমলে গ্রামের আশপাশের জঙ্গল আর মোটা বাঁশগাছেরা পাতা ঝরাতে শুরু করে।

বারমিকে গেলে এখনো তার দেখা মেলে। এখন অনেকটাই বয়স হয়ে গেছে। চেহারা সামান্য ভারি। এদিকের লোকজনের মতো জড়ানো পোশাক পরে থাকে সে। স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। রাম্মিত বিয়ে করে চলে গেছে সিংথামের দিকে। আগের বাচ্চারাও বড় হয়ে ছড়িয়ে গেছে নানা জায়গায়। তবু নতুন দিনের বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব রয়েছে তার। সে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ইশ্কুলে যায়। গ্রামে ঘুরে খবর নেয় সবার। বুড়োবুড়িদের সঙ্গেও সে গল্প করে সময় কাটায়। বিকেল শেষ হলে ঢুকে যায় আবছা আলোর মনাস্ট্রি-লাগোয়া ছোট ঘরটুকুতে।

তার কাছে জানতে চাইলে বলে, পাহাড়ের এই ছোট গ্রামটি ছেড়ে পৃথিবীর আর কোথাও সে যাবে না।